মাৎসুরি

জাপানের পরব মাৎসুরি বাংলাদেশের মেলার মতই উৎসবমুখর, রঙ্গীন। আর তাতে তাল-সুর দিয়েছে আমাদের ঢাকের মত তাইকো ড্রাম।

ছোটবেলায় গ্রাম্যমেলা রচনা লিখতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। ঢাকার উত্তরায় থাকতে আব্বা কাছের গ্রামেই বৈশাখী মেলায় নিয়ে যেতেন। চড়কীতে চড়া, বাতাসা খাওয়া, ইত্যাদির মধ্যে ব্যাপক আনন্দ ছিল।

এখন মার্কিনী প্রবাসজীবনে যাই কাউন্টি আর স্টেট ফেয়ারে। সে অভিজ্ঞতা বস্তুত অন্যরকম, কিন্তু ভাবে একইরকম! দূর-দূরান্তের ফার্ম থেকে গরু-ছাগল-ঘোড়া-ভেড়া চলে এসেছে, সাথে ট্রাক্টর-প্লাউ-ওয়্যাগন ইত্যাদিও হাজির। বাচ্চারা চরম মজা পায় সেগুলিতে চড়ে। টার্কি লেগ খাই যত অখাদ্যই হোক। একেক স্টেটের ফেয়ারের ভাবগতিকও তাদের ইতিহাস-সংস্কৃতিমত একেকরকম।

তবে আজকে লিখছি জাপানী মেলা নিয়ে!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




জাপানে গ্রাম্য মেলা এখন আর গ্রাম্য নেই। মাৎসুরি নামে পরিচিত এসব অনুষ্ঠান এখন সাধারণত শহরের মূল রাস্তা ধরেই হয়। প্রত্যেকটা পার্বণের পিছনে কোন শিন্তো বা বৌদ্ধধর্মীয় উপাসনার উপলক্ষ্য আছে। কোথাও কোথাও ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়াও হয়। একেক এলাকায় অনুষ্ঠান হয় বছরের বিভিন্ন নির্ধারিত সময়ে। বিশেষ করে পৌষপার্বণ বা নবান্নের সময়ে অনেক অঞ্চলেই এ অনুষ্ঠান হয়। হানামি বা চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল তো এখন বিশ্বের যেখানেই চেরি হয়, সেখানেই ছড়িয়ে গেছে! বু্দ্ধের জন্মোৎসবও পালিত হয় হানামাৎসুরির মাধ্যমে।

সেই মেলাতে কখনো কখনো জাপানীরা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা বা শিয়া সম্প্রদায়ের তাজ়িয়ার মত পাল্কিতে করে তাদের আঞ্চলিক কামি বা ‘দৈবশক্তির আধার প্রতিমাকে’ নিয়ে মন্দিরে স্থাপন করে। এমন একই জিনিস সামনাসামনি দেখেছি ঢাকার ইস্কন রথযাত্রায়, সেটার আরেকটু অরিজিন্যাল দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরে। কৃষ্ণের প্রতিমা বাৎসরিক বাপের-বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা করে। ক্যাথলিকদের প্যাশন প্লে-ও অনেকটা একই।

মাৎসুরি মেলার দোকানপাটে বড়রা তাকোইয়াকি বলে সীফুড স্ন্যাক খায়, ছোটরা গোল্ডফিশ ধরার খেলা খেলে। চীনের লায়ন ড্যান্স বা ড্রাগন ড্যান্সের মত কাগজের তৈরি নেবুতা ফ্লোট নিয়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিহিত জাপানীরা শোভাযাত্রা করে। হানেতো বলে লম্ফজম্ফের বিশারদ হাতে পাখা নিয়ে তাদের সামনে নাচতে নাচতে যায়।

আর সে উৎসবের প্রাণ ঢাক জিনিসটা বঙ্গীয়-জাপানী দুই কালচারে এক্কেবারে কমন!

বাংলাদেশে কমপক্ষে বিশ রকমের পারকাশন ইন্স্ট্রুমেন্ট আছে। পাখোয়াজ-তবলা তুলনামূলক অধুনার আবিষ্কার, আরবী-ফারসীদের রপ্তানী। জাপানী বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে, তাইকো নামের কয়েকরকম ঢাক প্রাচীনকালে — ষষ্ঠ শতকে — ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের সাথে সাথে সিল্ক রোডের মারফত চীন-কোরিয়া হয়ে আমদানি হয়। বহু বৌদ্ধ সংস্কৃত পান্ডুলিপিও সে পথে পাচার হয়েছে, সাথে সংস্কৃত কিছু প্রপার নাউনও জাপানীতে ঢুকে পড়েছে। যেমন ধ্যান হয়ে গেছে জ়েন, অমিতাভ বুদ্ধ থেকে আমিদা



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




যে ট্র্যাকটা দিলাম লেখার সাথে, সেটা পরিবেশন করছে কোদো বলে একটা বিশ্বখ্যাত তাইকো ড্রামারদল। সাদো বলে একটা ছোট দ্বীপে তাদের বাস। বাঁশি, করতাল, জয়ঢাক আর দুন্দুভির মত বাদ্যযন্ত্রের সাথে নাচানাচি করে তারা মাৎসুরির চমৎকার একটা আবহ তৈরি করেছে। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে শোনা ঢাকের তালও মনে করিয়ে দেয় এদের ঢাকের আওয়াজ। শব্দধারণটাও খেয়াল করবেন! ভাল হেডফোনে বা থ্রিডি সাররাউন্ড সিস্টেমে ফুল ভল্যুমে শুনলে আপনার মনে হবে লাইভ শুনছেন।

আর এ লাইভে শোনারই বস্তু! আমি প্রথম তাইকো শুনি বোধহয় ২০০৩এ, ঢাকার শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে ওয়াদাইকো ইয়ামাতো দলটির পরিবেশনায়। সে এক না-ভোলা অভিজ্ঞতা! গগনবিদারী ড্রামের শব্দের ভাইব্রেশনটা আপনার হৃদয়ের গভীর ছুঁয়ে ফেলবে! মুস্তাফা জামান আব্বাসী বোধহয় তখন ডিরেক্টর আর উপস্থাপক ছিলেন, আমাদের দেশের ঢাকঢোলের সমান্তরালটা দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে ভুলেননি!

১৯৬৪র টোকিও অলিম্পিকে তাইকোর রিদম শোনার পরে পশ্চিমা বিশ্বও এই ঐতিহ্যকে জাতিনির্বিশেষে আপন করে নিয়েছে। খোদ আমেরিকাতেই মনে হয় এখন আটশ’র বেশি তাইকো ক্লাব। গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি আর শারীরিক ব্যায়ামের মজায় অনেকেই এসবে অংশ নেয়। জাপানের ইলেক্ট্রনিক মিউজ়িকের কম্পোজ়ার কিতারোও তাঁর কয়েকটি ট্র্যাকে তাইকো ড্রাম ব্যবহার করেছেন, মাৎসুরি নামে তাঁরও একটা কম্পোজ়িশন আছে।

এখন পপ কালচারে তাইকো জায়গা করে নিলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকের সামুরাই-সামন্ততান্ত্রিক কামাকুরা পিরিয়ড থেকে। জাপানের অন্যান্য স্বকীয় সংস্কৃতিরও উদ্ভব এসময়ে। তখন সমগ্র জাপান সম্রাটের শাসনে নামমাত্র থাকলেও সামন্তরা ছিল নিজেদের এলাকায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্য নিজেদের মধ্যে সামুরাই বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করত। তখন যুদ্ধসঙ্গীতে তাইকোর স্থান ছিল। তারপর নো বা কাবুকি নাটকের উদ্ভবের পরে তার আবহসংগীত তৈরিতে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাইকোও শামিল হয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পুরনো আমলে ঢাকঢোল পেটানোতে ছেলেদের একচেটিয়া মনোপোলি থাকলেও এখন কিন্তু জাপানে মেয়ে তাইকোবাদকের সংখ্যা ছেলেদের থেকে বেশি! জাপানের ট্র্যাডিশনাল সমাজে আরো অনেক কিছুর সাথে এখানেও একটা সমতা চলে এসেছে। টকিং অ্যাবাউট দ্যাট!… বাংলাদেশী মেয়েদের জন্যে ঢাকঢোল পেটানোর অনুপ্রেরণা রইলো!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!