আগের পর্বগুলোতে বলেছি অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর নোংরা পদ্ধতির বৃত্তান্ত। এপর্বে বলবো ২০১৬-এর ব্রেক্সিট নির্বাচন আর মার্কিন সাধারণ নির্বাচনে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা আর অসত্য প্রচারণার ভূমিকা। আর আগামী পর্বে তাদের ষড়যন্ত্র ঠেকাতে আমাদের করণীয় কি তাই বলে শেষ করব।
উপরের দুই নির্বাচনের আগেই কিন্তু অ্যানালিটিকার পদ্ধতি বিভিন্ন দেশে ব্যবহার হয়েছে। পুতিনের রাশিয়াতে এটি পেয়েছে শৈল্পিক রূপ, তার ওপর সেখানে টেলিভিশন-রেডিওও সরকারের (বা পুতিনের নিকটজনের) একচেটিয়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে, আর ফেসবুকের পরিবর্তে আছে তার ক্লোন ভ্কন্তাক্তিয়ে, যেটা পুতিনের ট্রোলে ভর্তি। তার ফলে আপনারা এমাসেই দেখলেন রুশে পুতিনের ৭৫% ভোটে জয়লাভের নির্বাচন নামের ভং। চীনসরকারও এসব পদ্ধতি ২০০৮-এ তাদের তিব্বত আর শ্শিনজিয়াং-উইগুর প্রদেশের প্রতিবাদ দমাতে ব্যবহার করেছে। পশ্চিমা দেশ, যাদের গণতন্ত্র এদের থেকে বেশি টেকসই আর পরীক্ষিত, ২০১৬তে তাদের ওপরে এসব পদ্ধতি প্রথম সফলতা পায়।
ব্রেক্সিট নির্বাচন হয় ২০১৬র জুনে। তাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাবার (বা ব্রেক্সিটের) স্বপক্ষে প্রায় ৫২% ভোট পড়ে, ৭২% ভোটার ভোট দেয়, আর দু’দলে ভোটের তফাত ছিল মোটে ৬লাখ, সাড়ে চার কোটি ভোটের মধ্যে। অর্থাৎ মোটামুটি ১%-এর মধ্যে ফটোফিনিশ। এ নির্বাচনের আগেও দু’দলে বিতর্ক-বিভক্তি হয়েছে অনেক, বিদেশী অভিবাসী-রেফ্যুজি, অর্থনীতি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘অন্যায্য’ দাবি-দাওয়া, এসব ছিল হট টপিক। বিশেষজ্ঞরা অনেকভাবেই দেশের মানুষকে সাবধান করার চেষ্টা করেছিলেন যে এর ফলে যুক্তরাজ্যের যারপরনাই অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়ে যাবে। ব্রেক্সিটের স্বপক্ষে ছিল এখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বোরিস জনসনের নেতৃত্বে ক্ষমতাসীন টোরি পার্টির এক সুবিধাবাদী বিদ্রোহী গ্রুপ, তদ্কালীন প্রধানমন্ত্রী জেমস ক্যামেরন ছিলেন এর বিপক্ষে। আরো স্বপক্ষে ছিল ইউকিপ নামে কট্টর জাতীয়তাবাদী এক পার্টি আর তার নেতা নাইজেল ফারাজ।
ফারাজকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সেই একই ভিলেন রবার্ট মার্সার! তারা ইউকিপকে সাহায্য করে নির্বাচনী প্রচারণার কাজে, কিন্তু তার বিনিময়ে অ্যানালিটিকা নাকি কোন পয়সা নেয়নি। অর্থাৎ এই সার্ভিস ছিল মার্সারের দেয়া ‘উপহার’। যুক্তরাজ্যের আইনে এ অবৈধ, কারণ মার্সার ব্রিটিশ নাগরিক নন। এনিয়ে সেদেশের পার্লামেন্টে এখন তদন্ত চলছে। অপরদিকে বোরিস জনসন গিয়ে ধরেন অ্যাগ্রেগেট আইকিউ বলে এক কানাডিয়ান কম্পানিকে, একই কাজের জন্য। যেটা পরে বেরিয়েছে সেটা হল অ্যাগ্রেগেট আইকিউ হলো গিয়ে কানাডায় কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মাতৃসংস্থা এসসিএলের নাম-ভাঁড়ানো ফ্রন্ট কম্পানি! জনসনের ভোট লীভ প্রচারণীদল তাদের পয়ত্রিশ লাখ পাউন্ড দেয়। দুইদলের মধ্যে নির্বাচনী তহবিল নিয়ে যোগসাজশের সম্ভাবনা আছে, এবং তারা আইনের সীমালংঘন করে বেশি অর্থ খরচ করেছে কিনা পার্লামেন্ট এ নিয়েও তদন্ত করছে।
এপ্রসঙ্গে দু’টো বৃত্তান্ত না বললেই নয়। ইউকিপের ফারাজ মিথ্যা প্রচারণা চালান একটি চটকদার পোস্টারের মাধ্যমে, যেটায় কিছু সংবেদনশীল শ্লোগানের সাথে দেখানো হয় হাজার হাজার আরব-এশিয়ান চেহারার অভিবাসী লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে বর্ডার ক্রসিংয়ে। এই চিত্র দেখিয়ে ব্রিটেনের যারা খেঁটে খাওয়া মানুষ (যাদের সামান্যসংখ্যকই বর্ণবাদী) তাদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়া হয় যে, এরা ব্রিটেনে ঢুকলে তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি-কর্মসংস্থান ধ্বংস হয়ে যাবে। এই পোস্টার দিয়ে ইন্টারনেটের মাধ্যমে এসব ভোটারদের মাইক্রোটার্গেট করা হয়। বোরিস জনসনেরও প্রচারণার অংশ ছিল একটা ডাবলডেকার বাস যার গায়ে লেখা যে ব্রিটেন নাকি ইইউকে প্রতি সপ্তাহে ৩৫ কোটি পাউন্ড পাঠায়, সে টাকা তাদের এনএইচএস নামের সরকারি গণস্বাস্থ্য প্রকল্পে ব্যয় করলে তার যথোপযুক্ত ব্যবহার হত। বোরিসের সাথে লন্ডনের গর্বের প্রতীক ডাবলডেকার ব্রিটেনময় ঘুরে বেড়ায়, তার ছবিও ইন্টারনেটে মধ্যবিত্ত ব্রিটিশদের টার্গেট করে ছাড়া হয়।
বলা বাহুল্য দু’টোই মিথ্যাপ্রচারণা। সেই ‘অভিবাসীচিত্র’ আসলে ছিলো ক্রোয়েশিয়া-স্লোভেনিয়া বর্ডারে শরণার্থীশিবিরের ছবি, যারা দাতব্য সংস্থা ও জাতিসংঘের অর্থসাহায্যের উপর নির্ভরশীল। আর ইইউকে ব্রিটেন যত টাকা পাঠায় তার থেকে বেশি অংকের সুবিধা তাদের থেকে পায়, অর্থের আকারে না হলেও। যথারীতি মানুষের মনের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সামান্য ভোটের ব্যবধানে ব্রেক্সিটের স্বপক্ষদল কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের সাহায্যে অবিশ্বাস্যজনকভাবে জিতে যায়।
ট্রাম্পের বিজয় ছিল সেরকমই অবিশ্বাস্যকর। বলছি কিভাবে সে কাহিনী অন্যরকম হতে পারত, তার আগে বলি কেম্ব্রিজ অ্যানালাটিকার সম্পর্ক। ট্রাম্পের আগে টেড ক্রুজের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ করে অ্যানালিটিকা। ট্রাম্পের সাথে কাজ শুরু করার আগেই তাদের নেটওয়ার্ক ১৭টি স্টেটে বিস্তৃত ছিল। রিপাবলিকান প্রাইমারির পরে তারা এই নেটওয়ার্ক আরো বাড়ায় আর ট্রাম্পের পক্ষে অনলাইন অ্যাডভার্টাইজিং করে, ফেসবুক-টুইটারে ফেক প্রোফাইল দিয়ে সম্ভাব্য ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, অনেকসময় পার্সোন্যাল মেসেজও পাঠায়। পুতিনের রুশ ট্রোলরাও একই ভাবে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় সাহায্য করে। অ্যানালিটিকার কর্মকর্তারা প্রায়শই গর্ব করে বলেছে যে তারা ট্রাম্পের ডিজিটাল প্রচারণা থেকে দেশের কোন অঞ্চলে তার নির্বাচনী সমাবেশ করতে হবে, এসবকিছুই নির্ধারণের দায়িত্বে ছিল। তারা উইকিলিকসের জুলিয়ান আসাঞ্জের সাথে যোগাযোগ করে ক্লিনটনের কেলেংকারিময় ইমেল সংগ্রহের জন্য। রুশ হ্যাকারদের থেকে আসাঞ্জ এগুলোর কিছু পেয়েছিলেন, এখন তিনি দাবি করছেন যে তিনি নাকি অ্যানালিটিকাকে এগুলি দেননি। কিন্তু পরে ঠিকই ব্যক্তিগত আক্রোশবসত সময়মত (ট্রাম্পের হলিউড অ্যাক্সেসের কেলেংকারি ভিডিও যেদিন বেরুলো) এগুলো প্রকাশ করেন।
আমরা অনেকেই জানি না যে যুক্তরাষ্ট্রের একটা মোটামুটি বড় মাইনরিটি সাধারণত ভোট দেয় না, তারা ভাবে কোন পার্টিই তাদের স্বার্থ দেখে না। এদের কিছু হয়ত বর্ণবাদী, শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যপাদী, স্রেফ বাইকার বা দন্তনখরহীন কন্সপিরাসি থিওরিস্ট। এরাও কিন্তু ইন্টারনেটে যাওয়া-আসা করে এবং তাদের ওয়েবসাইট-ফোরাম ইন্টারনেটের কোনা-কাঞ্চিতে বিপুল পরিমাণে আছে। গুগল-ফেসবুকের মাধ্যমে দ্বিতীয় পর্বে বোঝানো পদ্ধতিতে তাদের চিন্তাধারা কি আর তারা আসলে কি চায় তা জানা সম্ভব, এবং তৃতীয় পর্বের পদ্ধতিতে তাদেরকে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই ‘রিইনফোর্সিং মেসেজ’ দিয়ে কোন নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দিতে রাজি করানো সম্ভব। ট্রাম্প যখন দাবি করেছেন যে তাঁর কারণে বিপুল পরিমাণ ভোটার রিপাবলিকান পার্টিতে এসেছে, কথাটা সত্য। সাধারণ রিপাবলিকানদের সাথে ওপরের ঐ গোষ্ঠীর ভোটও যোগ হয়েছে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা এই কাজটা সফলভাবে করেছে, আর ট্রাম্প তাদের এজন্য ৬২ লাখ ডলার দেন। আমার ধারণা ট্রাম্প সত্যিকার অর্থে কট্টর রেসিস্ট নন, কিন্তু তার পক্ষে বর্ণবাদী লেবেলটা অস্বীকার করাটাও সোজা নয়, কারণ তিনি সে ধরনের ভোটারদের ব্যবহার করেছেন। তিনি হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা — যারা তার সুরে আকৃষ্ট হয়েছে, তাদের একটা ছোট্ট অংশ ইঁদুর হতে পারে, কিন্তু তিনি নিজে সম্ভবত তা নন, তিনি স্রেফ একজন সেলসম্যান।
একথাও এখানে বলা জরুরী যে হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী প্রচারণারও একটা বড় অংশ ছিল ডিজিটাল। কিন্তু তার অ্যানালিটিকাবাহিনীর পদ্ধতি নিয়ে কেউ এখনো প্রশ্ন তোলেনি, তুললে ট্রাম্পই সবার আগে গলাবাজি করে টুইটারে সত্য-মিথ্যা কিছু একটা দাবি করতেন। তার মানে এই নয় যে জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরিতে ক্লিন্টনের প্রচারণী ফার্মের কোনই ভূমিকা নেই।
এখন বলি এরকম অসম্ভাব্য ফলাফল কিভাবে হলো। অনেকেই হয়ত জানেন ক্লিনটন পপুলার ভোটে ট্রাম্পের থেকে প্রায় ৩০লাখ বেশি পেয়েছেন, সেটা মোট ভোটের ২.১%। ইলেক্টরাল কলেজ বলে একটা ব্যাপার আছে এদেশে, যার কারণে প্রেসিডেন্ট প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। একেকটা স্টেটের জন্য বরাদ্দকৃত কিছুসংখ্যক ইলেক্টরাল ভোট আছে, বেশিরভাগ স্টেটের নিয়মানুযায়ী যিনি সেখানে সবচে বেশি ভোট পাবেন, সে যতটুকু ব্যবধানেই হোক, তিনিই পাবেন সে স্টেটের সকল ইলেক্টরাল ভোট। আমেরিকার রাষ্ট্রনির্মাতারাই ইচ্ছা করে এরকমটা বানিয়ে দিয়ে গেছেন, এভাবেই দু’শতাধিক বছর ধরে চলছে, আর এটাকে পরিবর্তন করাও সহজ নয়। এধরনের ‘অন্যায্যতা’ রাখার কারণ হলো যেন কোন অসদুদ্দেশ্যের প্রার্থী চাইলেই জনগণের ভাবপ্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে পপুলার ভোটে বিজয়ী না হতে পারে। এক্ষেত্রে এই পুরনো নিয়মটিকেই পুরোপুরি ‘গেম’ করা হয়েছে।
অ্যানালিটিকাগোষ্ঠী তাদের তহবিলের অধিকাংশ টার্গেট করে ‘রাস্ট বেল্ট’ বলে জনবহুল একটি অঞ্চলে। সেখানকার জনগোষ্ঠী নানাকারণে খারাপ সময় পার করছে। পঞ্চাশ বছর আগে তাদের বাপ-দাদারা ম্যানুফ্যাকচারিং ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে সমৃদ্ধি পেয়েছিল, তা এখন ম্রিয়মান। অনেকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন ধরনের চাকুরিদক্ষতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেরকে পুরনোদিনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়াটা ছিল সহজ। ট্রাম্পও অ্যানালিটিকার হিসাব অনুযায়ী এসব জায়গায় গিয়ে বিশাল সমাবেশ করেন, কিন্তু ক্লিনটন বলতে গেলে সেসব জায়গায় যানই নি, ভেবেছেন গত দু’নির্বাচনের মত এরা ডেমোক্র্যাটদেরই ভোট দেবে। অথচ এরাই সুইং স্টেট, যাদের ভোটে শেষ ফলাফল নির্ধারিত হয়। সেসব জায়গায় অনলাইনে মিথ্যা প্রচারণা তাই চলেছে বেশি, ডেমোক্র্যাট শ্বেতাঙ্গ খেঁটে খাওয়া মানুষদের ব্রেক্সিটের উপায়ে কব্জা করা হয়েছে, আর ডেমোক্র্যাট কৃষ্ণাঙ্গদের বোঝানো হয়েছে কালো প্রেসিডেন্টের আমলে তাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, তাই তারা ভোটই দিতে যায়নি।
হিসাব দেখুন। পেন্সিলভানিয়াতে ট্রাম্প জিতেছেন মাত্র ৪৪,০০০ ভোটের ব্যবধানে, সেটা সেখানের মোট ভোট ৬৩ লাখের ০.৭% মাত্র, সেখানের ইলেক্টরাল ভোট পেয়েছেন ২০টি। উইস্কনসিনে জিতেছেন ২৩,০০০ ব্যবধানে, সেটা মোট ভোট ৩০ লাখের ০.৩% মাত্র, ইলেক্টরাল ভোট ১০টি। মিশিগানে জিতলেন মা-আ-ত্র ১১,০০০ বেশি পেয়ে, মোট ভোট ৪৭ লাখের ০.৩%! ইলেক্টরাল ভোট ১৬টি। তার সাথে যদি আরেকটা ছোট স্টেট নিউ হ্যাম্শায়ারকে যোগ করি, সেখানে আড়াই হাজার ব্যবধান, মোট ৮ লাখের ০.৩%, ইলেক্টরাল ভোট ৪টি। অর্থাৎ ৫০টি ইলেক্টরাল ভোট খুবই চুলচেরা ব্যবধানে জিতেছেন। পুরো ইলেক্টরাল ভোটে তিনি পেয়েছেন ৩০৪, ক্লিনটন ২২৭। ৫০ ইলেক্টরাল ভোট আর সাড়ে ৮০ হাজার পপুলার ভোট (মোট ভোটের ০.০৬%!) এদিক-ওদিক হলে ট্রাম্প পেতেন ২৫৪ ভোট আর ক্লিনটন ২৭৭ পেয়ে আজ থাকতেন মার্কিনের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট!