আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মূল কারণ ছিল ক্রীতদাসপ্রথার উচ্ছেদ। এখনো বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা নিয়তই চলে আসে এদেশের রাজনীতির মধ্যে। আমাদের জন্য সেটা কেমন ছিল?
চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন বাঙ্গালী আত্মভোলা একটা জাত। সেকথা এক্কেবারে ঠিক! বাঙ্গালীর ইতিহাসেও দাসপ্রথা ছিল এবং এখনো আছে। সে নিজে দাস হয়েছে, আবার ক্রীতদাসের মালিক হতেও তার খুব একটা বাঁধেনি।
প্রথমে বলি কবে কোথায় আমাদের স্বজাতি দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছিল। অনেকে ভুল আন্দাজ করবেন যে মুসলিম শাসনামলে এর শুরু। ইসলামের আগেও আরবদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল। ইসলামে ক্রীতদাসের সাথে সদাচরণ করতে বলা হলেও সেটাকে বিলুপ্ত করা হয়নি। সে কারণে নানাযুগে মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে হাবশী-তুর্কী দাসেরা এদেশে এসেছে। আবার তারা নিজেরাও একসময় রাজা বনেছে, যেমন দিল্লীর মামলুক, বাংলার হাবশী রাজ্য। এইসব রাজারা সবাইই যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরাজিত গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশুদের ধরে দাস হিসেবে পৃথিবীর আনাচেকানাচে বিক্রি করে দিয়েছে।
কিন্তু এই অভিশাপ শুধু মুসলিম শাসনামলেই ছিল না। জীমূতবাহনের দায়ভাগে আমরা দেখতে পাই দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু উত্তরাধিকারবিধিতে দাসীর উল্লেখ, তারও আগের বৌদ্ধ বিনয়পিটকেও দেখি দাসেদের ভিক্ষু হওয়া বারণ। বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টধর্মেও যীশু এপ্রথার বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলে যাননি, যার ফলে সন্ত পল দাসদের উপদেশ দিয়েছেন মালিকের প্রতি বিশ্বস্ত হতে। শ্বেতাঙ্গরাও অতীত আর বর্তমানকালে দাসত্বের শৃংখল পরেছে, সেকথা সুযোগ হলে অন্য সময়।
প্রাগাধুনিক যুগে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনার সাথে সাথে দাসবাণিজ্য আরও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছিল। পর্তুগীজ হার্মাদ জলদস্যু আর বার্মার আরাকানের মগ দুয়ে মিলে ষোড়শ শতকে দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবন, সন্দ্বীপ আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায়ই লুট তরাজ চালিয়ে দাস ধরে নিয়ে যেত — যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা হতো ‘মগের মুল্লুক’। অন্যদিকে মোঘলরা ছিল দাসপ্রথার বিরোধী (আওরঙ্গজেব বাদে), তারা ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম দখল করে এই মুল্লুকের সমাপ্তি ঘটায়।
প্রায় একই সময়ে, সপ্তদশ শতকে, ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (VOC) কাশিমপুর, হুগলী এসব জায়গায় ঘাঁটি গাঁড়ে। তারা লুটতরাজ করত না, কিন্তু দাস কেনাবেচা সেখানে ঠিকই চলত। এসব দাসদের কারা এনে তাদের হাতে সমর্পণ করত, তার কাগজেকলমে প্রমাণ না থাকলেও আন্দাজ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে এদের পরিবারের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কর্তাই হয়ত পেটের দায়ে সে কাজটি করেছেন, নয়ত বাঙ্গালী বা অন্য ভারতীয় বেনিয়া-ছেলেধরাদের কাজ। ইন্দোনেশিয়ার বাতাফিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে এসব দাসের অধিকাংশ গিয়ে পৌঁছায়, এখনও তাদের বংশধররা সেখানে আছেন, কিন্তু নিজ সংস্কৃতি-ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেরা অনেকে সেখানে করেছে হাঁড়ভাঙা খাটুনি, আর মেয়েদের চাহিদা ছিল ভাল সেবক আর সূঁচকর্মী হিসাবে, কারও কারও ভাগ্যে পণমুক্তি আর ওলন্দাজ জামাইও জুটেছিল। সেদেশের এককালীন শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী প্রেসিডেন্ট ডিক্লার্কেরও ধমনীতে নাকি বাংলার রক্ত আছে।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিও (EIC) কিছুটা সময় মাদ্রাজ আর কলকাতা থেকে এসব করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্যে ভাঁটা পড়া শুরু হল ব্রিটিশদের কারণেই। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে দাসপ্রথা আইন করে বন্ধ করে দেয়, আর তাদের সমুদ্রে কোন দাসবাহী জাহাজ পেলে সেটা দখল করে দাসদের মুক্তি দেয়া শুরু করে। অবশ্য এতে করে অন্য ধরনের দাসত্বও শুরু হয়ে যায়, সেটা ক্রয়বিক্রয়ের দাস নয়, একে বলে চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব। ভারতে অবশ্য তখনও ব্রিটিশরা দেশীদের ভিতরে ক্রীতদাস-প্রথা সহ্য করত, অভ্যন্তরীণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নাক গলাতে এসে ঝামেলা পোহাতে চাইত না। অবশেষে তারা সেটাও আইন করে বন্ধ করে ১৮৬১ সালে।
এখন বলি বাঙ্গালী কখন নিজে হয়েছে দাসের মালিক। ঐযে কেপ টাউনের কথা বললাম, সেখানেই কিছু কিছু বঙ্গীয় মুক্তি-অর্জনের পরে নিজেই স্বদেশ-বিদেশ থেকে আনা দাস ক্রয় করত। সেটা ১৭০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আরো পরে, এমন কী ১৮৬২ সালে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ইন্ডিয়ান রিফরমার পত্রিকা থেকে পুনর্প্রকাশিত একটা খবর পড়লাম, তাতে প্রতিবেদক অভিযোগ করছেন যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বরিশাল, বিক্রমপুর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম – এসব জায়গায় নাকি গোলাম-বাঁদি কেনাবেচা চলে। এদের কেউ আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাস, আর কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক। মফস্বলের জমিদারদের মধ্যে দাস কেনা-বেচা আর উপহার হিসাবে আদান-প্রদানও চলত পুরোদমে। সেসময়কার এরকম আরও অন্তত দুটো খবর ইন্টারনেটে খুঁজে পাই।
আধুনিক বাংলাদেশে সেই প্রথা কি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত? আমার শ্রদ্ধেয় এক অগ্রজ আলোকচিত্রী, আর তার স্ত্রী (হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এই একবিংশ শতকেই বাংলাদেশের দুবলার চরে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক দাসত্ব। শুঁটকির ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আর শিকলপরা কিশোরদের প্রচুর ছবি আমাকে দেখিয়েছেন, এমনকি এক ছেলেকে উদ্ধার করেও নিয়ে এসেছিলেন। এরকম আরও নানারকম দাসত্ব আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত দেখতে পাই।
যাই হোক, ধরলাম এইগুলি স্বভাবের ব্যতিক্রম। কিন্তু আমার মূল কথা হল, মার্কিনীরা গৃহযুদ্ধ করল এই নিয়ে, আর আমরা যুদ্ধ না করে পার পেয়ে গেলাম ব্রিটিশদের খাতিরে। যদি ব্রিটিশরা আমাদের ওপর খানিকটা ছড়ি না ঘোরাত— নাহয় তারা আর মার্কিনরাই এই প্রথার উচ্ছেদ করলো শুধু নিজেদের রাজ্যে — তাই যদি হতো, দাস কেনা-বেচাতে কি বাঙালী পিছিয়ে থাকত আরব কিংবা পর্তুগীজদের থেকে?