সুবর্ণদ্বীপের বানরনৃত্য

Featured Video Play Icon
জাকার্তা, সুকার্নো, ইয়োগইয়াকার্তা, সুহার্তো, জাভা, সুমাত্রা, গারুডা, মালয়, সিঙ্গাপুর — মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার এই নামগুলির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আজ বলবো কি কারণে এই নামগুলো যথাক্রমে আসলে জয়কর্তা, সুকর্ণ, যোগ্যকর্তা, সু-অর্থ, যব, সমুদ্র, গরুড়, মলয়, সিংহপুর ইত্যাদি থেকে এসেছে।

লেখার সাথের ভিডিওতে দেখতে পাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘কেচা’ নামক অনুষ্ঠান। অপার্থিব এই দৃশ্যটি নেয়া হয়েছে ‘বারাকা’ বলে ১৯৯২এ তৈরি তথ্যচিত্র থেকে। এটা ধারণ করা হয়েছে বালির গুনুং কাউয়ি বলে একাদশ শতাব্দীর এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে।

বালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ট্যুরিস্টদের কাছে যেমন জনপ্রিয়, ঠিক ততটা মনকাড়া তাদের শিল্প-সংস্কৃতি — যার মধ্যে আছে ছায়ানাট্য, লেগংবারং নৃত্য, আর রামায়ণের নাট্যাভিনয়। রাবণের রাক্ষসবাহিনী বনাম হনুমানের বানরবাহিনীর যুদ্ধের প্রতীকী রি-এন্যাক্টমেন্ট এই কেচা  নামক ‘বানরনৃত্য’।

অংশগ্রহণকারীদের কানে গোঁজা জবাকুসুম — যেটা বাংলায় দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত হয়। দৃশ্যটির গোঁড়ার দিকে দেখা যাচ্ছে বালির উলুওয়াতু মন্দিরের নিকটবর্তী অরণ্যের শাখামৃগদের, তারা সেখানকার পবিত্র রক্ষক। আর দেখানো হয়েছে জাভার বোরোবুদুর বৌদ্ধবিহার আর কম্বোডিয়ার আংকোর ভাটের বিষ্ণুমন্দিরের স্থাপত্য ও অলংকরণ। সেগুলি ভারতবর্ষের মন্দির-মসজিদগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয়!

রামায়ণ আর হিন্দুধর্ম বালিসহ সারা ইন্দোনেশিয়াতে এসেছে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো।

ভিয়েতনামের ফুনানচম্পা, কম্বোডিয়ার চেনলাখ্মের, থাইল্যান্ডের দ্বারাবতী, মালয়েশিয়ার গঙ্গানগরলংকাসুকা, ইন্দোনেশিয়ার মজাপহিতশ্রীবিজয়াশৈলেন্দ্র, মায়ানমারের পাগান — অতীতের এ সকল রাজ্য সবাই কোন না কোনভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করেছে। এদের অধিকাংশের নামই সে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষ্য।

বিশেষ করে ভারতের দুটো অঞ্চল পূর্বদিকে হিন্দু-বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত-পালি ভাষা, নাগরীলিপি, স্থাপত্যশৈলী, আর পরবর্তীতে ইসলাম, ইত্যাদির বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সে দুটো কোরোমান্ডেল উপকূল আর বঙ্গ। নালন্দার বৌদ্ধবিহারে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে খচিত শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি ‘সুবর্ণদ্বীপের’ — অর্থাৎ সুমাত্রার — শ্রীবিজয়া রাজ্যের শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজা বলপুত্র কর্তৃক একটি মঠস্থাপনের জন্যে অনুদানের কথা। আর আমাদের বিক্রমপুরের বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে ধর্মপ্রচারে যাবার আগে সুবর্ণদ্বীপেই  শ্রীবিজয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যয়ন করেন।

কি উপায়ে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রথম পূর্ব এশিয়াতে এসে পৌঁচেছে, তার বিস্তারিত কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ধারণা করা যেতে পারে বাণিজ্যের খাতিরে শ’ শ’ বছর ধরে ধীরে ধীরে এখানকার স্থানীয় রাজ-রাজড়ারা — সাথে তাদের প্রজারা — ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-শিল্পকলা-ধর্মচিন্তার ঐশ্বর্য দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতের তেলেগু পল্লব বংশের রাজারাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমুদ্রের অপরপারে নতুন রাজ্য আর রাজবংশ স্থাপনে। এ ছিল কমবেশি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।

ভারতীয় দখলদারিত্ব আর ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাসও অবশ্য একটা সময়ে পাওয়া যায়। সেটা হলো একাদশ শতাব্দীতে তামিল চোলবংশের আগ্রাসনে শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের পরাজয়, যাদের স্থান পরে পূরণ করে ত্রয়োদশ শতকের মজাপহিত বলে জবদ্বীপের — অর্থাৎ জাভার — আরেকটি রাজবংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ঠিকানাও এ এলাকায় প্রাচীনতা থেকে পাওয়া যায়। সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে তাদের বাণিজ্যপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী বন্দর-নগরগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। সুফী ধর্মপ্রচারকরা দ্বীপগুলির আরো গভীরাঞ্চলে ইসলামের বাণী নিয়ে যায়। তার উপরে ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরে তাদের বনেদী বংশগুলির সাথে আত্মীয়তা করার জন্যে ইন্দোনেশিয়ার রাজারাও ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করে। তাছাড়াও আরবীর পরিবর্তে মালয় ভাষাতে ইসলামী পান্ডুলিপির প্রাচুর্য ছিল। এসব কারণে শীঘ্রই পুরো ইন্দোনেশিয়ার আশি শতাংশ মানুষ মুসলিম হয়ে যায়।

সেই ধারার ব্যতিক্রম শুধু বালি । বহুদিন ধরে তারা জাভা-সুমাত্রার মুসলিম রাজ্যগুলি থেকে স্বাধীন ছিল। আলাদা দ্বীপ হওয়ায় ধর্মপ্রচারকরাও সহজে সেখানে যেতে পারেনি। সেকারণে তারা আদিধর্ম বজিয়ে রেখেছে। তাদের রাজ্যগুলিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দখলে নেয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হল্যান্ড। বালিনিজ়দের উপর তাদের অত্যাচার দেখে বাকি ইউরোপীয় জাত তাদেরকে ছি-ছি করেছিল। সে কারণে তিরিশের দশকে অনেকটা ক্ষতিপূরণস্বরূপ ডাচরা বালির শিল্পসংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া শুরু করে। কেচা-নৃত্যের উদ্ভব সে সময়।

এদের হিন্দুধর্মও ভারতের থেকে অনেক স্বতন্ত্র। পুরনো অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের মূল খুঁজতে বেশিদূর যাওয়া লাগে না। যেমন, কেচা আসলে সাংহিয়াং বলে বালির এক ভূততাড়ানি অনুষ্ঠানের আধুনিক রূপ। বৌদ্ধধর্মও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। মজাপহিত রাজবংশের সময় শিব আর বুদ্ধ দু’য়েরই উপাসনা চলত একই মন্দিরে, এ ছিল তাদের অভাবনীয় ধর্মীয় সংস্কার আর সহনশীলতার প্রমাণ। ইসলামের বিস্তারের পরেও আগের অনেক আচারব্যবস্থা সুফী চিন্তার প্রভাবে রিডিফাইন-রিপারপাজ় হয়েছে। যেমন সুরো বলে নববর্ষের অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তাসহকারে পালিত হয়ে আসছে।

অবশ্য ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের সময় থেকে মুসলিম-খ্রীষ্টান, মালয়-চীনা দাঙ্গা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। নাইন-ইলেভেনের মত ভূরাজনৈতিক কারণে স্থানীয় কট্টরপন্থীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা গিয়ে ইন্দোনেশীয়দের হাজার বছরের ধর্মীয় সহনশীলতা বিপন্ন। বালির হিন্দু জনগোষ্ঠী তাও বেঁচে গেছে দেশের কদর বাড়ানো আর ট্যুরিস্টদের টাকা উপার্জনের সামর্থের কারণে। সেটা কতদিন টেকে সেটা দেখবার বিষয়। অন্তত যতদিন ওয়াহহাবি মতবাদের সরকারগুলির অর্থায়ন থাকবে, ততদিন তাদের ভয় থেকেই যাবে।

তুর্কীনাচন

Featured Video Play Icon
ইসলামের প্রসার ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফী চিন্তাধারার অবদান অনস্বীকার্য। আর সুফী সাধকদের মধ্যে মওলানা রুমী উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত — তুরস্ক-পারস্য-ভারতে তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাঁর কাব্য আজ বহুলপঠিত।

উপরের ভিডিওতে যেটা দেখছেন, তাকে নাচগানের পর্যায়ে ফেলাটা ভুল হবে। এই পারফরম্যান্সটা জনসমক্ষে করা হলেও অতীতে এ ধরনের প্রার্থনাগীতি আর ঘূর্ণিনৃত্যের সমাবেশ হত শুধু মৌলভীদের খানকায়। যে কেউ তাতে অংশ নিতে পারত বা দেখতে যেতে পারত, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা, দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন নয়।

এই ধরনের জ়িকর বা স্রষ্টার নামস্মরণ করাকে তুর্কী ভাষায় বলে সেমা, যেটার আরবী শব্দমূলের অর্থ শ্রবণ করা। প্রখ্যাত সুফী কবি জালালুদ্দিন রুমী ত্রয়োদশ শতকে মিস্টিসিজ়ম বা গূঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে সেমাসহ অন্যান্য সুফী ঐতিহ্যের সূচনা করেন, যেটা তুর্কী-ফার্সী-আরবী ভাষায় মৌলভী তরিকা বলে পরিচিত। মূলধারার অনেক মুসলিম মনীষীদের হিসাবে এগুলি ইসলামের বিপরীত নয়, নামাজ-রোজার প্রতিস্থাপকও নয়। রুমী কুরআন-হাদীসের বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রকাশিত জানা নিয়মকানুন থেকে শুরু করার পরে ইসলামের আরেকটি গূঢ় অন্তর্মূলে যাওয়া সম্ভব, যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক প্রেমের। সেমার মত জ়িকর সুফী সাধককে সেই পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করে।

সুফী দর্শনের শুরু রুমীর মাধ্যমে নয়, তাঁর আগেও অনেক মনীষী ইসলামের মানবিক আধ্যাত্মিক দিকগুলি খুঁজে বের করে তার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকী তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত সাধক ছিলেন একজন নারী, তাঁর নাম রাবিয়া বসরী। আর ইমাম গাজ্জ়ালী — যাঁর মতাদর্শের প্রসারের কারণে ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের ইসলামী যুক্তিবাদী দর্শন জনপ্রিয়তা-পৃষ্ঠপোষকতা হারানো শুরু করে — তিনি আশারী নামক সুফী মতবাদেরই প্রবক্তা ছিলেন। বিজ্ঞান দিয়ে স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে বোঝার থেকে তাঁর পছন্দ ছিল অন্তর্মুখী সাধনা আর ধ্যানের মাধ্যমে স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়া আর সৃষ্টির মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করা। তাঁর ফতোয়া অনুযায়ী, যদি অন্তরের পবিত্রতা থাকে, তাহলে নাচ-গান-সুরের সাহায্য নিয়ে জ়িকর করা অবৈধ নয়।

এই পারফরম্যান্সে তাই দেখতে পাচ্ছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার — যার মধ্যে আছে নেই নামক বাঁশি, রিক্ক্ বলে খঞ্জনী, গীটারের মত উদ, আর আমাদের সন্তুরের মত কানুন। শিল্পীরা তাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফাতিহা দিয়ে শুরু করেছেন, কিন্তু সেমার বাকি অংশে কোন কুরআন-হাদীসের বাণী টানা হয়নি। সেটা ইচ্ছামূলক, যেন কেউ তাঁদের আবৃত্তিকে পবিত্র বাণীর সাথে গুলিয়ে ফেলে পাপী না হয়।

কানুন বাদ্যযন্ত্রটি এখানে বাজাচ্ছেন জ়ুলিয়্যাঁ জালালুদ্দিন ওয়াইস বলে এক ফরাসী মিউজ়িশিয়ান, যিনি ইউরোপে সুফীসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার অন্যতম পথিকৃৎ। সিরিয়ার দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়্যা মসজিদের শেখ শাক্কুর এখানে প্রধান গায়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন। খোদাকে স্মরণ করছেন কয়েক রকম নামে, আল্লাহু হা’ঈ অর্থ আল্লাহ সদাজীবিত, সর্বদা-জাগ্রত। ক’দিন আগে একটা হিব্রু ইয়েমেনী গান নিয়ে লিখেছিলাম, সেখানেও স্রষ্টাকে একই হা’ঈ নামে ভূষিত করেছেন ইহুদী গীতিকার। আরেকটা উপাধিতে খোদাকে স্মরণ করছেন শেখ শাক্কুর, আলিমুল সির্‌রি‍‍‍ ওয়া জাহরি, অর্থাৎ গুপ্ত আর প্রকাশিত সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ। এখানেই উঠে এসেছে সুফী চিন্তাধারার মূল প্রতিপাদ্য, যে, আক্ষরিকের পরেও কুরআন-হাদীসে ‘গুপ্ত’ একটা লেভেল আছে, সেটা হিউম্যানিজ়ম বা মানবতাবাদ থেকে খুব অভিন্ন কিছু নয়।

ঘূর্ণিনৃত্যের পোশাক আর একেকটা অঙ্গভঙ্গির মধ্যেও গুহ্য অর্থ রয়েছে। সিক্কা বলে ঊটের লোমের তৈরি লম্বা টুপি আসলে সমাধিস্তম্ভের রূপক, সে সমাধি আত্ম-অহমের। আর শিল্পীদের পরনে যে ঢোলা স্কার্টের মত সাদা পোশাক, সেটা যেন কাফনের কাপড়। তাঁরা শুরু করছেন বুকের উপরে দু’হাত রেখে বাউ করে, এই ভঙ্গি তওহীদ বা স্রষ্টার একত্বের প্রতীকী ঘোষণা। তাঁরা ঘুরছেন ডান থেকে বামে, ডান হাত কখনো উপরে ফেরানো, বাম হাত অধঃমুখী। যেন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসার বাহক হিসাবে স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে এসে বিলিয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীর বাকিসব প্রাণীকে। গ্রহনক্ষত্রের আবর্তনের প্রাচীন স্বর্গীয় নিয়মকে অনুকরণ করে সেমাজ়েনরা ঘুরে চলেছেন। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়া তাঁদের লক্ষ্য নয়।

রুমীর চিন্তাধারার মধ্যে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষেরই খোদার ভালবাসা ‌অর্জনের ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, অন্যান্য অনেক প্রাচীন আর আধুনিক ধর্মের মধ্যেও সুফীদের মত আধ্যাত্মিক দর্শনের উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীষ্টের আগমনের সময়ে গ্নস্টিসিজ়ম বলে একটা গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শন প্রচলিত ছিল, যেটা প্রাক-ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্মকেও প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম কিংবা শ্রীকৃষ্ণলীলাও এধরনের গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উত্তম উদাহরণ। তাই বলে এটা ভাবাটা পুরোপুরি ঠিক নয় যে, রুমী ও অন্যান্য সুফীরা অনৈসলামিক চর্চাকে ইসলামী রূপ দিয়েছেন। তাঁরা স্বগরিমায় মূলধারার ইসলামী আইনকানুনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার বিবর্তন হয়েছে অনেক পড়াশোনা আর মেডিটেশনের মাধ্যমে।

সুতরাং সুফীবাদ ইসলামের থেকে আলাদা বিশেষ কিছু নয়। একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সুফীদের বহু তরিকা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। ভারতে ইসলামের বিস্তারের মূল কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে সুফী সাধকদের আগমন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ভারতবর্ষের নামীদামী মাদ্রাসাগুলো সুফী মতাদর্শেরই দিকপাল ছিল। বায়েজ়িদ বোস্তামী, হাফেজ়, শেখ সাদী, রুমী ইত্যাদি মনীষীর চিন্তাধারা পরবর্তীতে প্রভাবিত করেছে মির্জ়া গালিব, ইকবাল, নজরুলের মত কবিকে।

আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থার কারণে মুসলিমরা হয় পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাবে যুক্তিবাদী ধারায় ফিরেছে, নয়ত সালাফী-ওয়াহহাবী অর্থায়নের কারণে ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থটাকে গ্রহণ করে একটু কট্টরপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছে। দু’পক্ষের কেউই সুফী চিন্তাধারার শক্তিটাকে অনুধাবন করতে পারে না। অবহেলার কারণে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ভন্ডপীর আর মুরীদের দল সুফী মতবাদকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে।

বিশেষ করে সালাফীরা সুফীসাধনাকে অনৈসলামিক মনে করে। তারা সেমা, জ়িকর, নামাজের পর দোয়া — এসব সুফী প্রথাকে বলে বিদআত বা ধর্মবিচ্যুত উদ্ভাবন। সেকারণে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আইসিস খুঁজে খুঁজে সুফী সাধকদের হত্যা করেছে। জালালুদ্দিন ওয়াইস তখন তাঁর দামেস্কের বাসস্থান থেকে পালাতে বাধ্য হন। এই ভিডিওতে অংশ নেয়া সেমাজ়েনদের অনেকে এখন গৃহহীন রেফ্যুজি, একজন পায়ে শ্রাপনেলের আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী।

আবার যুক্তিবাদী সেক্যুলারদের শাসনেও সুফীরা তাদের অনেক অধিকার হারিয়েছে। ১৯২৫ সালে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে প্রকাশ্যে সুফী মতবাদের চর্চা আইন করে বন্ধ করে দেন, অভিযোগ ছিল এগুলো মধ্যযুগীয় কুসংস্কার। ইস্তাম্বুলের প্রায় আড়াইশ’ তেক্কে বা খানকা বন্ধ করে দেয়া হয়, নয়ত তাদের জাদুঘর হিসাবে সরকারী মালিকানায় নিয়ে আসা হয়। তারপরেও অনেক সুফী গোপনে ব্যাক্তিগতভাবে চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সেমা পালন করার লাইসেন্স দেয়া হয়। ২০০০এর দশক থেকে এখন খুব একটা কড়াকড়ি নেই। মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলি থেকে অবশ্য সত্যিকারের সুফীবাদ পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে, আছে খালি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের খোলস হিসাবে। অথচ একসময় এরাই সুফীসাধনার অগ্রগণ্য কেন্দ্র ছিল।

পশ্চিমাবিশ্বে কিন্তু এখন সুফীদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পরে অনেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে সুফীবাদকে পুনরাবিষ্কার করেছে। আমেরিকায় কবিতার বইয়ের কাতারে রুমীর অনুবাদগুলো এখন বেস্টসেলার। ইউনেস্কোও ২০০৮এ সেমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে মানবসভ্যতার অমূল্য ঐতিহ্য হিসাবে।

মানবতার সার্বজনীনতাকে তুলে ধরতে রুমীর লেখা একটি কবিতা দিয়ে শেষ করিঃ
“At times we are hidden, at times revealed;
We are Muslims, Christians, Jews; of any race.
Our hearts are shaped like any human heart,
But every day we wear a different face.”

সাহারার তুয়ারেগ

Featured Video Play Icon

উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরোক্কো — এই দেশগুলিকে আমরা জানি আরব-অধ্যুষিত হিসাবে। কিন্তু এই এলাকার আদিবাসীরা আরব নয়, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানও নয়। গ্রীক-রোমান-যুগ থেকে তাদেরকে ভিনদেশীরা চেনে ‘বেরবের’ নামে; যদিও তারা নিজেদের বলে ‘আমাজ়িগ’ — যার অর্থ মুক্ত মানুষ। এখন মূলত আরবী বা ফরাসীতে কথা বললেও উপরের দেশগুলির একটা বড় জনসংখ্যা বেরবের।


জ়িনেদিন জ়িদানের বাবা-মা আলজেরিয়ার কাবিল উপজাতির আমাজ়িগ। মরোক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতাও ছিলেন আমাজ়িগ বংশোদ্ভূত। খ্রীষ্টান সেন্ট অগাস্টিনও তাই। রোমসম্রাট সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের ধমনীতেও ছিল বেরবের বংশধারার রক্ত। রোমের সৈন্যদলের একটা অংশও একসময় ছিল বেরবের মাউরি যোদ্ধাদের দিয়ে তৈরি, যাদের নাম থেকে পরে মুর বা মোরো শব্দটা এসেছে।


তারিক ইবনে জ়িয়াদ ছিলেন আরব-বিজিত ইফ্রিক্বিয়া (এখনকার তিউনিসিয়ায়) প্রদেশের গভর্নর মুসা ইবনে নুসাইরের ক্রীতদাস। জ়ানাতি বেরবের বংশে তার জন্ম, তাঁকে মুক্তিদানের পরে অষ্টম শতকে আরব-বেরবের সৈন্যদল নিয়ে উমাইয়্যা খলিফাদের হয়ে স্পেনবিজয় করেন। তার নামেই জিব্রাল্টার (জাবাল-আল-তারিক)।


স্পেনের দ্বাদশ শতাব্দীর রাজবংশ আলমোহাদ-আলমুরাবিতরা ছিল আরবীকৃত বেরবের। এসময় স্পেনের জামিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউরোপীয়রা দর্শন-বিজ্ঞানের শিক্ষা পেয়েছে মাইমোনিডিস-ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের মত মনীষীদের লেখা পড়ে। আলহামরা প্রাসাদের মুরিশ শিল্পশৈলী বেরবের-আরবদের যৌথ অবদান। আরব-বেরবের রান্নাও বিশ্বখ্যাত, যেকোন মরোক্কান রেঁস্তোরাতে সেটা আস্বাদন করতে পারবেন।


উমাইয়্যা আরব শাসনের সময় এই মুক্ত জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে আরবী কৃষ্টি আর অনারব দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে ফরাসী-ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী চাপিয়েছে ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতি। প্রতিবারই তারা বিদ্রোহ করেছে।


নিচের গানটা তু্য়ারেগ নামে আমাজ়িগদের একটা বড় উপজাতির শিল্পীদের গাওয়া, সাথে মার্কিন ব্লুজ মিশানো, মালির কৃষ্ণাঙ্গ ঘরানারও প্রভাব আছে। দলটার নাম তিনারিওয়েন, গানের ভাষা তামাশেক। তুয়ারেগদের বাস আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, মালি, নিঝ়ের, বুরকিনা ফাসোর দেশসীমাবিহীন সাহেল নামে সাহারা মরুভূমির পশ্চিমাংশে। যাযাবর এই গোত্রের অন্নসংস্থানের উপায় গোচারণ আর ‘সাবসিস্টেন্স ফার্মিং’।


তিনারিওয়েনের সদস্যরা উত্তর মালির সাহারার বাসিন্দা। ষাটের দশকে মালি স্বাধীন হবার সময়ে তামাশেকরা চেয়েছিল নিজেদের জন্যে আলাদা দেশ — আজ়াওয়াদ। তার পরিবর্তে সোভিয়েত-সমর্থিত মালির কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান একদলীয় শাসকরা তুয়ারেগদের অধিকার পদদলিত করার ফলে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রাণ হারায় অনেক নির্দোষ তুয়ারেগ, গৃহহারা হয় আরো অনেক।


এই গানটার ভোক্যাল ইব্রাহিম আগ্ আলহাবিবের চার বছর বয়সে তার বাবা সেই বিদ্রোহে প্রাণ হারায়। পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে এই এতিমরা ঘুরে বেড়ায় আলজেরিয়া-লিবিয়ার এক রেফ্যুজি ক্যাম্প থেকে আরেকে। গীটার শিখে পশ্চিমাগানের সাথে তুয়ারেগ সঙ্গীত মিলিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সাথে সাথে হাতে অস্ত্রও তুলে নেয় নব্বইয়ের দশকের আরেক বিদ্রোহে। ২০০০এর দশকেও আরেকটা বিদ্রোহ হয়। এরপরে একটা শান্তিচুক্তির ফলে তুয়ারেগদের অধিকার মালিতে মোটামুটি স্বীকৃত এখন। এই শান্তিচুক্তির পিছনে তিনারিওয়েনের মত দলের সাংস্কৃতিক গ্লোবাল আউটরীচের অবদান অনেক বড়।


তারপরেও ইউরেনিয়ামের মত খনিজ পদার্থ সংগ্রহ আর খরা-মরুকরণের ফলে চাষের সামান্যতম জমি ধ্বংস হওয়ায়, আর অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে, দরিদ্র সুন্নি সুফীমতানুসারী তুয়ারেগদের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক অভিযোগ আর কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে ফেরত সালাফী ইসলামী জিহাদীরা গাদ্দাফীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত-অস্ত্রসজ্জিত স্বাধীনতাকামী তুয়ারেগদের সাথে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে আরেকটা বিদ্রোহ করে, যার ফলে ঘরবাড়ি ছাড়া হয় ৬ লাখ মূলত তুয়ারেগই।


সেসময় ইসলামী কট্টরপন্থীরা মালির ঐতিহাসিক তিমবাক্তু শহর দখল করে নেয়, ‘শরিয়া আইন’ চাপিয়ে দেয় আর শহরটির ইউনেস্কোচিহ্নিত ঐতিহ্যবাহী মসজিদ-মিনার-মাজার এগুলোর ধ্বংসসাধন করে। ২০১০এ দক্ষিণ আফ্রিকার ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গানপরিবেশনকারী তিনারিওয়েনের এক সদস্যকেও তারা গ্রেফতার করে নির্যাতন করে আর গানবাজনা বন্ধ করে দেয়। ফরাসী সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মালির সরকার অবশেষে এদের হটাতে সমর্থ হয়। আর আজ়াওয়াদপন্থী স্বাধীনতাকামীরাও দল বদলে মালির সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এখনো মালিতে ফরাসী আর নিঝ়েরে মার্কিন সৈন্য আছে এসব দুর্গম অঞ্চলে জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রাখার জন্যে।


এই গানটিতে দেখবেন মুসলিম তুয়ারেগ পুরুষদের মুখ ঢাকা, কারণ তাদের আদি ঐতিহ্যে নারী নয়, পুরুষরাই মুখ ঢাকে! তুয়ারেগ নারীরা মাথায় কাপড় দিলেও সাধারণত পুরো মুখমন্ডল আবৃত করে না, আর সকল ধরনের কর্মকান্ডে সমান অংশগ্রহণ করে। অতীতের কোন এক সময় তুয়ারেগ পরিবারব্যবস্থা মাতৃকুলভিত্তিক ছিল বলেই নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা। এই গানে তেনেরে বলে সাহারার এক এলাকার অপার্থিব সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে মরুবাসী তুয়ারেগের অসহায়ত্ব বর্ণিত হয়েছে দুই শব্দে — আমান ইমান, পানিই জীবন।

গানের কথা আর অর্থ এখানে পাবেন।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!