ট্যাপড্যান্স

Featured Video Play Icon

হলিউডের পঞ্চাশের দশকের জৌলুসভরা মিউজিকাল ‘সিঙিং ইন দ্য রেইনে’ জীন কেলির ট্যাপ ড্যান্সিং দেখে বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। পরে জেনেছি, আয়ারল্যান্ড থেকে কিভাবে এই নাচ আমেরিকায় এসেছে। রিভারড্যান্সেও অরিজিনালের কাছাকাছি আইরিশ ড্যান্স দেখেছি নব্বইয়ের দশকের টিভিতে।

যেটা প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু মনে প্রশ্ন ছিল যে আইরিশরা তো নাচার সময় হাত দুটো সোজা করে মুষ্টিবদ্ধ করে নাচে, হাত নড়লেই তার নাচ ডিসকোয়ালিফাইড। কথিত আছে, আয়ারল্যান্ডের কট্টর ক্যাথলিক বিশপরা চাইতেন না, ছেলেমেয়েরা নাচার সময় কোন হ্যাংকিপ্যাংকি করুক। তো নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল, যার যার হাত তার তার নিজের কাছে রাখো! (টাইটানিক দ্রষ্টব্য)

তাহলে আমেরিকায় আইরিশ ট্যাপ ড্যান্সকে স্ট্রেইটজ্যাকেটের বন্ধন থেকে মুক্ত করলো কে?

কে আর? মার্কিন দেশে আসা ক্রীতদাসদের সেই ভুমচাক আফ্রিকান নৃত্য!

আফ্রিকার থেকে আমেরিকায় আসা দাসদের সপ্তাহে একটা দিন বরাদ্দ ছিল নিজ সংস্কৃতির আচার পালনের জন্যে। সে কাজটা তারা করত শহরের মাঝখানে কঙ্গো স্কয়ার বলে কোন চত্বরে ড্রাম পিটিয়ে নর্তনকুর্দন করে। লুইজিয়ানার নিউ অরলিয়ান্সে গেলে এখনো কঙ্গো স্কয়ারের দেখা মিলবে।

আফ্রিকান সঙ্গীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ড্রামের অবশ্য আরেকটা ব্যবহার ছিল। যুদ্ধের সংকেতপ্রেরণে আফ্রিকার জাতিগুলি নানারকম ড্রাম ব্যবহার করে। ১৭৩০এর দশকে ড্রামের ব্যবহার করে কয়েক জায়গায় রক্তাক্ত দাসবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তখন সাদার্ন অনেক স্টেটে আইন করে কৃষ্ণাঙ্গদের ড্রামবাদনা নিষিদ্ধ করা হয়।

তো, ঐ ভুমচাক নৃত্য থেমে থাকেনি। পারকাশনের স্থান পূরণ করলো স্যাক্সোফোন, ট্রম্বোন, ফ্রেঞ্চ হর্ন, ডাবলবাস, গীটার প্রভৃতির পূর্বসূরী যন্ত্রপাতি। তাই জ্যাজ-ব্লুজের শেকড়। আমেরিকার অন্যান্য যেসকল দেশে আফ্রিকান দাস ছিল, যেমন ব্রাজিল, কিউবা, এসব জায়গায় ড্রামবাদনা নিষিদ্ধ ছিল না। তাই তাদের মিউজিক গেল ড্রামভিত্তিক সাম্বা-মাম্বোর দিকে।

আরো যে জিনিসটা আফ্রিকান দাসরা ব্যবহার শুরু করলো সেটা অনন্য একটা ব্যাপার! খেতখামারে দাসদের পাশাপাশি যেসকল আইরিশ কাজ করত তাদের দেখাদেখি ট্যাপ ড্যান্সটা রপ্ত করে ফেলল। ড্রামের অভাব পূরণ করলো সেটাই!

আর আফ্রিকান নৃত্যে কী হাত স্থির থাকে!

তারপর বিশ-ত্রিশের দশকের ভডভিল শোগুলিতে নিগ্রো ট্যাপড্যান্সার রাখা হত নেহাত হাসিঠাট্টার জন্যে। কখনো সাদারা মুখে কালো রঙ করে (ব্ল্যাকফেস) সেই ট্যাপড্যান্স করত। ব্যাপারটা আজকের স্ট্যান্ডার্ডে হাল্কা রেসিস্ট বলতে হবে!

কিন্তু সেই হাসিঠাট্টা বেশিদিন চলেনি! কালে সেটাই হয়ে গেছে মেইনস্ট্রীম! আইরিশ, ইটালিয়ান সব ইমিগ্র্যান্ট সমাজ ঐ নাচ শিখে নেচেছে। তারা যে কৃষ্ণাঙ্গভিত্তিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে তাকে বলে হারলেম রেনেসাঁস। তারপর কালো-সাদা সবে মিলে হলিউডের খোমা বদলে দিয়েছে ট্যাপড্যান্স দিয়ে।

বর্তমান যুগেও ট্যাপ ড্যান্স আছে, আমরা টের পাই না। মাইকেল জ্যাকসনের পায়ে যে জুতো দেখি সেগুলি আসলে কৃষ্ণাঙ্গ ট্যাপড্যান্সার স্যামি ডেভিস জুনিয়রের অনুকরণে, আর তার মুনওয়াক প্রথম করে বিল বেইলী বলে আরেক ট্যাপ ড্যান্সার।

পপ সংস্কৃতির কি ভয়ংকর শক্তি! যে জিনিস মানুষের মন কাড়ে, সেটা জাত-বর্ণের মধ্যে আটকে থাকে না — আইরিশ থেকে কালো, আবার কালো থেকে সাদা, সবাই লালন করে সেটা। দু’য়েকদিন বোকার দল হাসাহাসি করবেই। ঐসব ঠাট্টাতামাশা গায়ে না লাগিয়ে যারা নিজের ভালোলাগাটা নিয়ে পড়ে থেকেছে, তারাই পরিবর্তন করে দিয়েছে ভবিষ্যতের চিত্র!

নিচে বেশ কিছু দেখার মত স্নিপেট দিয়েছি।

লেখাশেষে খেয়াল করলাম আজ আইরিশ প্যাট্রন সেন্ট সেন্টপ্যাট্রিকস ডে!

 


জিন কেলী সিঙিং ইন দ্য রেইন

https://www.youtube.com/watch?v=D1ZYhVpdXbQ

রিভারড্যান্স আইরিশ ড্যান্স ট্রুপ

 

ত্রিশ চল্লিশ দশকের সেরা ট্যাপ ড্যান্সার কৃষ্ণাঙ্গ ভ্রাতৃযুগল নিকোলাস ব্রাদারস

আরেক বিশ্বসেরা ট্যাপ ড্যান্সার এলিনর পাওয়েল

মাইকেল জ্যাকসনের মুনওয়াক আসলে বিল বেইলী প্রথম রূপালীপর্দায় পারফরম করেন

মাইকেল জ্যাকসনের প্রথম লাইভ কনসার্টের মুনওয়াক

সিন্তে নাচ

Featured Video Play Icon
পশ্চিম আফ্রিকার জনগোষ্ঠী রাজনৈতিকভাবে বিশাল সাফল্য হয়ত নানাবিচারে দেখাতে পারেনি (ব্যতিক্রম আছে!), কিন্তু সঙ্গীত-নৃত্য-বাদ্যে বিশ্বের অনেক সংস্কৃতিকেই হার মানাবে।
আলি ফার্কা তুরে, ইউসু ন্দুর প্রমুখ সম্বন্ধে সম্ভবত আগে লিখেছি। আজকে দিলাম সিন্তে নাচের একটা ভিডিও।
গিনি ও অন্যান্য পশ্চিম আফ্রিকার দেশে সেলেব্রেটরি ড্যান্স হিসাবে সিন্তের রিচুয়াল পারফরম্যান্স হয়। আমাদের ‘সভ্য’ সংস্কৃতির মত নু্য়ান্সড জেসচার হয়ত নাই, কিন্তু কয়েক রকম রিপিটিশনের মধ্যে প্রচন্ড অ্যাথলেটিক একটা নাচ। এর মধ্যে ব্রাজিলের সাম্বারও একটা প্রতিচ্ছবি দেখতে পাই।
এ ভিডিওটি পরিবেশন করেছে ওহাইও বিশ্ববিদ্যালয়ের আফ্রিকান ডান্স অনসম্বল, সাথে ঘানার ড্রামবাদক দল আজাগুনো।
আজকের পলিটিকাল কারেক্টনেসের যুগে কালোর ড্যান্স সাদা কেন করবে, এশিয়ানের রোল কেন কালো করবে না, ইত্যাকার নানাপ্রকার ভজঘট লজিক দাঁড়া হয়েছে।
আমার হিসাবে এসকল ঐতিহ্য সমগ্র মানবসভ্যতার সম্পদ। সবার এতে অংশীদারিত্ব কম নয়। আমার ভাষা শিখে একটা কালো মানুষ যদি একটা গান করে, আমার গর্বিত হবার কথা।
পলিটিকাল কারেক্টনেস পরিহার করে মনটাকে একটু উদার করুন। সবাইকে এনজয় করতে দিন!
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!