গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!

Featured Video Play Icon

মালয়েশিয়ার এথনিক চীনা শিল্পী ইমী উইয়ের গাওয়া এ গানটি বৌদ্ধ ধর্মের সবচে’ পবিত্র মন্ত্রগুলোর একটি। এর নাম প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয় সূত্রম — সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতার অন্তঃকরণ। অর্থাৎ এ মন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে সর্বোচ্চ সত্য উদ্ঘাটনের গূঢ়তত্ত্ব।

মহাযান মতধারার বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞাপারমিতার স্থান উচ্চাসনে। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল যে, ইসলামে যেমন দু’টো বড় শাখা শিয়া ও সুন্নী, তেমন বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান ধারা বা ‘যান’ থেরবাদী, তান্ত্রিক আর মহাযানী। থেরবাদী আর মহাযানীর মধ্যে মৌলিক তেমন কোন তফাত নেই; থেরবাদকে ধরা যেতে পারে সনাতন, প্রাচীন; মহাযান অন্যান্য দেশে গিয়ে তাদের স্থানীয় আচারকে একীভূত করে নিয়েছে। বাংলাদেশ-শ্রীলংকা-মিয়ানমারসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে থেরবাদ প্রচলিত। চীন-ভিয়েতনাম-জাপানের মহাযান পন্থার শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা থেরবাদের থেকে বেশি। মহাযানী ধারার একাংশ ভূটান-তিব্বত-মোঙ্গোলিয়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাচীন শামানিস্ট বিশ্বাসকে মিলিয়ে নিয়ে হয়ে গেছে গূঢ়তাত্ত্বিক অধ্যাত্মবাদ, যার নাম তন্ত্রযান বা বজ্রযান।

ধারণা করা হয়, প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্রের উদ্ভব খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। সবচে’ প্রাচীন আবিষ্কৃত নমুনাটি ৭৫ খ্রীষ্টাব্দের, এর নাম অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, কারণ এতে আট হাজার পংক্তি রয়েছে। ১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে কুষাণ সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ শ্রমণ চীনা ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতার অনুবাদ করেন। এর আশপাশ দিয়েই ভারতবর্ষ থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে। চীনের সুপরিচিত শাওলিন টেম্পলের শ্রমণরা মহাযানপন্থারই অনুসারী। আত্মসংযম চর্চার জন্যে চীনা শ্রমণরা যে ধ্যান করে, তাকে তারা ডাকে ‘চান’ বলে। জাপানে গিয়ে চান হয়ে গেছে ‘জ়েন’

বাংলায় পাল রাজবংশ ছিল মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বড় পৃষ্ঠপোষক। অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পালরা উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য শাসন করে। বিহারের নালন্দাবিক্রমশীলা আর বাংলাদেশের নওগাঁর সোমপুর বিহার পালদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। দ্বাদশ শতকে দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এসকল বিহার লুন্ঠিত-বিধ্বস্ত হয় — অবশ্য ইতিমধ্যে পালসাম্রাজ্যের অন্তিমযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

নালন্দা-সোমপুর ছিল অনেকটা এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত। ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি চর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। পালপূর্ববর্তী গুপ্ত আর বর্ধন রাজবংশের আমলে চীন থেকে ঈ জিং, শ়ুয়ান ৎসাং, ফাশ়িয়ান — শেষ দু’জনকে আমরা চিনি ‘হিউয়েন সাং’ আর ‘ফা হিয়েন’ নামে — ভারতের এসব বিহারে এসেছিলেন সংস্কৃত শিখতে আর বৌদ্ধ সূত্রের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তারা চীনে ফিরে সেসবের অনুবাদ করেন — প্রজ্ঞাপারমিতাও ছিল এদের মাঝে। ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়ারাজ্যও পালযুগে নালন্দায় বিহারস্থাপনের জন্যে অর্থ যোগান দেয়।

পালদের যুগেই বাংলা ভাষার আদিরূপ আবির্ভাব হওয়া শুরু করে। প্রাচীন বাংলার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ তান্ত্রিক বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদের অমূল্য সাহিত্যকর্ম। ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপংকর মহাযান-বজ্রযান পন্থার বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় অধ্যয়নের পরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে তিব্বতের রাজার অনুরোধে সেদেশে যান অতীশ। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে তিনি এখনও সম্মানের আসনে অধিষ্ট। ২০০৩এ সোমপুর বিহার দেখতে গিয়েছিলাম যখন, তখন এই ভেবে গায়ে শিহরণ হয়েছিল যে, সাড়ে আটশ’ বছর পূর্বে সেখানের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান, আর হয়ত প্রাচীন বাংলাতেই তাঁর কথোপকথন হত সঙ্গী-সাথীদের সাথে! এখনো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রচুর বৌদ্ধ পর্যটক এসকল বিহারে তীর্থযাত্রায় আসেন।

প্রজ্ঞাপারমিতা বর্তমানযুগে ‘ধারণী’ মন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ মন্ত্র যে পাঠ করবে — সে অর্থ বুঝুক বা নাই বুঝুক — অমঙ্গল তাকে স্পর্শ করবে না। অনেকটা যেমন আমাদের দেশী সরল ধার্মিক মানুষ অর্থ না জেনে সূরা-দোয়া মুখস্ত করেন আর সোচ্চারে পাঠ করেন। বলতে পারেন, পালযুগে আমরা একই কাজ করতাম বৌদ্ধমন্ত্র নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মচর্চাপদ্ধতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি! চীনা-জাপানীদের বৌদ্ধধর্মের সেই একই দশা! তারা সংস্কৃত শব্দোচ্চারণের স্বদেশী রূপ দিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা আবৃত্তি করে — অথচ উচ্চারিত শব্দগুলোর কোন সত্যিকার অর্থ তাদের ভাষাতে নেই!

আনুষ্ঠানিকতার জাল ভেদ করে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মূল বিষয়বস্তুটা বুঝানোর চেষ্টা করি। এতে বুদ্ধশিষ্য, গৌতমের অন্যতম সাথী, শারিপুত্রের সাথে কথোপকথন হচ্ছে অবলোকিতেশ্বরের। অবলোকিতেশ্বর হচ্ছেন গৌতমের নির্বাণপরবর্তীযুগে পুনর্জন্ম হয়ে আসা বর্তমানযুগের বোধিসত্ত্ব। সংসারের জাল ছিন্ন করে বোধিপ্রাপ্ত হলেও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পরিনির্বাণ গ্রহণ না করে ফিরে ফিরে আসেন ধর্মদীক্ষাদানের জন্যে, যাতে অন্যেও তাঁর শিক্ষা নিয়ে বোধি বা সত্যের সন্ধান পেতে পারে।

শারিপুত্রকে অবলোকিতেশ্বর শেখাচ্ছেন মোক্ষলাভের মূলমন্ত্র: সকল বস্তু, ভাবের অস্তিত্বের সাথে তাদের অনস্তিত্ত্বের কোন পার্থক্য নেই! দ্বিতীয় বুদ্ধ বলে পরিচিত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যতাবাদের তত্ত্বে এই চিন্তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ তত্ত্ব লিখে বা বলে বোঝানো খুব কঠিন! মনোভাবটা জাগ্রত করতে হলে চাই কঠোর সাধনা। সোজা ভাষায় যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে, সকল দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় এটা অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করা যে, কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে বলেই আমরা তার অনস্তিত্ত্ব বা অভাব বোধ করি। দুঃখজরার মূল প্রথিত সেই জ্ঞানের মধ্যেই। যদি মোহমুক্তি পেতে চাই তাহলে আত্মপরিচয় বা ইগোকে পরিত্যাগ করতে হবে, মিলিয়ে দিতে হবে শূন্যতার মাঝে, যেখানে বস্তু বা ভাবের অনস্তিত্ত্ব আর অস্তিত্ত্বের উপলব্ধির মাঝে কোন ফারাক নেই। দুঃখ থেকে মুক্তি সে পথেই।

এটা অন্য ধর্মদর্শনের মাধ্যমে বোঝানোটা মনে হয় খুব বেশি কঠিন নয়। ইসলামের সুফী মতের সাথে তুলনা করে দেখতে পারেন। সেখানে খোদাপ্রেমের মদে মত্ত মানুষ নশ্বরতার পরিধি পেরিয়ে হতে চায় স্রষ্টার সাথে একাত্ম। হাদীসের ভাষায় ‘মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করা’! কিংবা চেষ্টাচরিত্রের পরে মন্দভাল যাই ফল হোক না কেন, তাকে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হওয়া। খুব একটা তফাত নেই প্রজ্ঞাপারমিতার থেকে। বাউলিয়ানার ওপরেও  বৌদ্ধ দর্শনের কিছুটা প্রভাব এক সময় পড়েছিল।

বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন বা নাস্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলেও এ ধরনের চিন্তাধারা রয়েছে। ঊনবিংশ শতকে আর্থার শপেনহাওয়ার তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ় উইল অ্যান্ড রিপ্রেজ়েন্টেশন’ বইটিতে অস্তিত্ত্বের উপলব্ধিকে তুলে ধরেছেন মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে। যদিও শপেনহাওয়ার বৌদ্ধ দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন আর সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান, তাঁর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ চিন্তাধারার অনেকটা বিকৃত পশ্চিমা সংস্করণ । শপেনহাওয়ার পক্ষান্তরে অনুপ্রেরণা যোগান আধুনিক যুগের আরো অনেক দার্শনিক, লেখক ও বৈজ্ঞানিককে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রয়ড, আইনস্টাইন, য়্যুঙ, মপাসঁ, নয়মান, নিচা, শ্রয়ডিঙার, তলস্তয়, ভ়াগনার — আর নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক হেরমান হেসা!

এই হেরমান হেসার ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসটি আমার তরুণ বয়সে পড়া, আমার পরবর্তী চিন্তাভাবনার উপর এর প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বেশ ভাল একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, পরে ইংরেজী দু’টি আলাদা অনুবাদও। এই অসাধারণ কাহিনীতে গৌতম নয়, সিদ্ধার্থ বলে আরেক সমসাময়িক কল্পিত রাজকুমারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অবলোকন করতে পারবেন — তাঁর মনোবেদনা, মোক্ষলাভের সংগ্রাম, শ্রমণজীবন, ‘মধ্যপন্থার’ আবিষ্কার, সংসারে মনোনিবেশ, গৌতমবুদ্ধের সাথে মোলাকাত, শেষ পর্যন্ত নদীপারাপারের তরীচালক হিসাবে তাঁর অহমলোপ আর বোধিপ্রাপ্তি।

হেসা খুবই নিখুঁতভাবেই মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সে তত্ত্বে বোধিলাভের জন্যে থেরবাদের অন্তর্মুখী সাধনার আবশ্যকীয়তা নেই, জাগতিক সুখদুঃখের অনুভূতি অক্ষত রেখেই শূন্যতার উপলব্ধি অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ আমি-আপনি যে জাগতিক অবস্থাতেই থাকি না কেন, কিছু মৌলিক সত্যের ওপর মনোনিবেশ করলে অহমের বিলোপ, মনের দ্বন্দ্বগুলি প্রশমন করে দুঃখজরার বিনাশসাধন অসাধ্য নয়।

মনে হয় পাঠক ইতিমধ্যে আন্দাজ করতে পারছেন সব ধর্মের একটা মৌলিক গুণ মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলির নিরসন করে শান্তিতে বিরাজমান হওয়ার পথ বাতলানো। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এব্রাহাম ম্যাজ়লো বলে এক মনস্তত্ত্ববিদ মানবিক চাহিদার খুঁটিনাটি গবেষণা করেছেন। তাঁর শ্রেণীবিভাগের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে দৈহিক চাহিদা, তার পরে নিরাপত্তা, তৃতীয়ত প্রেম-ভালোবাসা বা কোন জাতিগোত্রের সাথে একাত্মতার চাহিদা, চতুর্থত শ্রদ্ধা-মর্যাদার চাহিদা, আর সর্বোচ্চ স্তরের নাম দিলেন সেল্ফ়-অ্যাকচুয়ালাইজ়েশন। প্রথম চারটি স্তর অতিক্রম করে মানুষ শেষ স্তরে এসে চায় স্বপরিচয়ে, স্বপেশায় পারফ়েকশন বা পূর্ণতাপ্রাপ্তি। বৌদ্ধ দর্শনে এটা অহম বা ইগোর সর্বোচ্চ রূপ।

ম্যাজ়লো পরে আরো একটি পর্যায় যোগ করেন যার নাম দেন ট্রানসেন্ডেন্স বা স্ব-কে অতিক্রম করা। বৌদ্ধ দর্শনে এটাই অহমের বিলোপ, নিজের থেকে বেশি কিছু হয়ে ওঠা, শূন্যতা!

এপর্যায়ে এসে প্রজ্ঞাপারমিতার শেষ পংক্তি অনুযায়ী আপনি ‘গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!’ — নদীর অপরপারে! স্নান করছেন বোধির আলোকচ্ছটায়! তবে তাই হোক!

সুবর্ণদ্বীপের বানরনৃত্য

Featured Video Play Icon
জাকার্তা, সুকার্নো, ইয়োগইয়াকার্তা, সুহার্তো, জাভা, সুমাত্রা, গারুডা, মালয়, সিঙ্গাপুর — মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার এই নামগুলির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আজ বলবো কি কারণে এই নামগুলো যথাক্রমে আসলে জয়কর্তা, সুকর্ণ, যোগ্যকর্তা, সু-অর্থ, যব, সমুদ্র, গরুড়, মলয়, সিংহপুর ইত্যাদি থেকে এসেছে।

লেখার সাথের ভিডিওতে দেখতে পাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘কেচা’ নামক অনুষ্ঠান। অপার্থিব এই দৃশ্যটি নেয়া হয়েছে ‘বারাকা’ বলে ১৯৯২এ তৈরি তথ্যচিত্র থেকে। এটা ধারণ করা হয়েছে বালির গুনুং কাউয়ি বলে একাদশ শতাব্দীর এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে।

বালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ট্যুরিস্টদের কাছে যেমন জনপ্রিয়, ঠিক ততটা মনকাড়া তাদের শিল্প-সংস্কৃতি — যার মধ্যে আছে ছায়ানাট্য, লেগংবারং নৃত্য, আর রামায়ণের নাট্যাভিনয়। রাবণের রাক্ষসবাহিনী বনাম হনুমানের বানরবাহিনীর যুদ্ধের প্রতীকী রি-এন্যাক্টমেন্ট এই কেচা  নামক ‘বানরনৃত্য’।

অংশগ্রহণকারীদের কানে গোঁজা জবাকুসুম — যেটা বাংলায় দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত হয়। দৃশ্যটির গোঁড়ার দিকে দেখা যাচ্ছে বালির উলুওয়াতু মন্দিরের নিকটবর্তী অরণ্যের শাখামৃগদের, তারা সেখানকার পবিত্র রক্ষক। আর দেখানো হয়েছে জাভার বোরোবুদুর বৌদ্ধবিহার আর কম্বোডিয়ার আংকোর ভাটের বিষ্ণুমন্দিরের স্থাপত্য ও অলংকরণ। সেগুলি ভারতবর্ষের মন্দির-মসজিদগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয়!

রামায়ণ আর হিন্দুধর্ম বালিসহ সারা ইন্দোনেশিয়াতে এসেছে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো।

ভিয়েতনামের ফুনানচম্পা, কম্বোডিয়ার চেনলাখ্মের, থাইল্যান্ডের দ্বারাবতী, মালয়েশিয়ার গঙ্গানগরলংকাসুকা, ইন্দোনেশিয়ার মজাপহিতশ্রীবিজয়াশৈলেন্দ্র, মায়ানমারের পাগান — অতীতের এ সকল রাজ্য সবাই কোন না কোনভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করেছে। এদের অধিকাংশের নামই সে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষ্য।

বিশেষ করে ভারতের দুটো অঞ্চল পূর্বদিকে হিন্দু-বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত-পালি ভাষা, নাগরীলিপি, স্থাপত্যশৈলী, আর পরবর্তীতে ইসলাম, ইত্যাদির বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সে দুটো কোরোমান্ডেল উপকূল আর বঙ্গ। নালন্দার বৌদ্ধবিহারে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে খচিত শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি ‘সুবর্ণদ্বীপের’ — অর্থাৎ সুমাত্রার — শ্রীবিজয়া রাজ্যের শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজা বলপুত্র কর্তৃক একটি মঠস্থাপনের জন্যে অনুদানের কথা। আর আমাদের বিক্রমপুরের বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে ধর্মপ্রচারে যাবার আগে সুবর্ণদ্বীপেই  শ্রীবিজয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যয়ন করেন।

কি উপায়ে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রথম পূর্ব এশিয়াতে এসে পৌঁচেছে, তার বিস্তারিত কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ধারণা করা যেতে পারে বাণিজ্যের খাতিরে শ’ শ’ বছর ধরে ধীরে ধীরে এখানকার স্থানীয় রাজ-রাজড়ারা — সাথে তাদের প্রজারা — ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-শিল্পকলা-ধর্মচিন্তার ঐশ্বর্য দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতের তেলেগু পল্লব বংশের রাজারাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমুদ্রের অপরপারে নতুন রাজ্য আর রাজবংশ স্থাপনে। এ ছিল কমবেশি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।

ভারতীয় দখলদারিত্ব আর ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাসও অবশ্য একটা সময়ে পাওয়া যায়। সেটা হলো একাদশ শতাব্দীতে তামিল চোলবংশের আগ্রাসনে শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের পরাজয়, যাদের স্থান পরে পূরণ করে ত্রয়োদশ শতকের মজাপহিত বলে জবদ্বীপের — অর্থাৎ জাভার — আরেকটি রাজবংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ঠিকানাও এ এলাকায় প্রাচীনতা থেকে পাওয়া যায়। সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে তাদের বাণিজ্যপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী বন্দর-নগরগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। সুফী ধর্মপ্রচারকরা দ্বীপগুলির আরো গভীরাঞ্চলে ইসলামের বাণী নিয়ে যায়। তার উপরে ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরে তাদের বনেদী বংশগুলির সাথে আত্মীয়তা করার জন্যে ইন্দোনেশিয়ার রাজারাও ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করে। তাছাড়াও আরবীর পরিবর্তে মালয় ভাষাতে ইসলামী পান্ডুলিপির প্রাচুর্য ছিল। এসব কারণে শীঘ্রই পুরো ইন্দোনেশিয়ার আশি শতাংশ মানুষ মুসলিম হয়ে যায়।

সেই ধারার ব্যতিক্রম শুধু বালি । বহুদিন ধরে তারা জাভা-সুমাত্রার মুসলিম রাজ্যগুলি থেকে স্বাধীন ছিল। আলাদা দ্বীপ হওয়ায় ধর্মপ্রচারকরাও সহজে সেখানে যেতে পারেনি। সেকারণে তারা আদিধর্ম বজিয়ে রেখেছে। তাদের রাজ্যগুলিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দখলে নেয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হল্যান্ড। বালিনিজ়দের উপর তাদের অত্যাচার দেখে বাকি ইউরোপীয় জাত তাদেরকে ছি-ছি করেছিল। সে কারণে তিরিশের দশকে অনেকটা ক্ষতিপূরণস্বরূপ ডাচরা বালির শিল্পসংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া শুরু করে। কেচা-নৃত্যের উদ্ভব সে সময়।

এদের হিন্দুধর্মও ভারতের থেকে অনেক স্বতন্ত্র। পুরনো অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের মূল খুঁজতে বেশিদূর যাওয়া লাগে না। যেমন, কেচা আসলে সাংহিয়াং বলে বালির এক ভূততাড়ানি অনুষ্ঠানের আধুনিক রূপ। বৌদ্ধধর্মও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। মজাপহিত রাজবংশের সময় শিব আর বুদ্ধ দু’য়েরই উপাসনা চলত একই মন্দিরে, এ ছিল তাদের অভাবনীয় ধর্মীয় সংস্কার আর সহনশীলতার প্রমাণ। ইসলামের বিস্তারের পরেও আগের অনেক আচারব্যবস্থা সুফী চিন্তার প্রভাবে রিডিফাইন-রিপারপাজ় হয়েছে। যেমন সুরো বলে নববর্ষের অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তাসহকারে পালিত হয়ে আসছে।

অবশ্য ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের সময় থেকে মুসলিম-খ্রীষ্টান, মালয়-চীনা দাঙ্গা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। নাইন-ইলেভেনের মত ভূরাজনৈতিক কারণে স্থানীয় কট্টরপন্থীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা গিয়ে ইন্দোনেশীয়দের হাজার বছরের ধর্মীয় সহনশীলতা বিপন্ন। বালির হিন্দু জনগোষ্ঠী তাও বেঁচে গেছে দেশের কদর বাড়ানো আর ট্যুরিস্টদের টাকা উপার্জনের সামর্থের কারণে। সেটা কতদিন টেকে সেটা দেখবার বিষয়। অন্তত যতদিন ওয়াহহাবি মতবাদের সরকারগুলির অর্থায়ন থাকবে, ততদিন তাদের ভয় থেকেই যাবে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!