আমার মতে, কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকাদের ষড়যন্ত্রকে বানচাল করতে সরকারের থেকে জনগণের ক্ষমতা বেশি। তাদের এই সচেতনতা আসা দরকার যে তারা নিজেরাই ইন্টারনেটে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য ছেড়ে দিচ্ছে, আর তারা কি রং পছন্দ বা অপছন্দ করে এধরনের সামান্য তথ্যই হয়ত অ্যানালিটিকার জন্য যথেষ্ট। ফেসবুক–গুগলের মত কম্পানিগুলি কিন্তু এখন গ্রাহকদের কি কি তথ্য তাদের কাছে আছে সেটা ডাউনলোড করার সুযোগ দেয়। তা করলেও সে তথ্য কতটুকু গূঢ় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে, সেটা কিন্তু বোঝা সহজ নয়। আর ফেসবুকের সুবিধাগুলি ছেড়ে দিতেও কেউ চায় না। সুতরাং সবচে’ বড় কাজ যেটা করতে পারেন সেটা হলো নিজের মনে বাইরে থেকে কি ঢুকছে তার উপর ফিল্টার বসানো। ফেসবুকে আপনার ফ্রেন্ডের শেয়ার করা পোস্ট, ইন্টারনেট, সংবাদপত্র, টিভিতে যেটাই দেখবেন বা শুনবেন না কেন, পরখ করে দেখবেন আগে যে, কোন একটা খবরের উদ্দেশ্য কি আপনার পিলে চমকে দেয়া? যদি তাই মনে হয়, খবরটা নিয়ে নিজের মনেই প্রশ্ন তুলবেন, প্রগতিশীলই হোন, কিংবা রক্ষণশীল। সঠিক প্রশ্ন তুললে সঠিক জবাবের খোঁজ করবেন আর তা খুঁজে পাবেন, আর তখন হয়ত মনে হবে এতে পিলে চমকানোর কিছুই নেই! যদি আপনি গ্রাজুয়েট স্কুলে পড়ে থাকেন, তাহলে জানেন যে একাডেমিক পেপার লিখলে তার কিরকম কড়া রিভিউ হয়। সেরকম রিভিউটা সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে, বিশেষ করে ইন্টারনেটে, করাটা এখন খুবই দরকারী। আর রাজনৈতিক বা অন্যান্য ব্যাপার যত ইন্টারনেটে শেয়ার করবেন কম, আর সেসবে লাইক যত কম দিবেন, কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থাগুলো আপনার ও আপনার সমমনাদের প্রোফাইল করার প্রয়োজনীয় তথ্যও ততটা কম পাবে।
কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার তথ্যসংগ্রহের মত কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের জন্য ফেডারেল সরকার অনেক আগে থেকেই নানা পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে ২০১১তে ফেডারেল ট্রেড কমিশন ফেসবুক-গুগলসহ ১১টি কম্পানির কনজিউমার ড্যাটা সংক্রান্ত আচরণ তদন্ত করে এবং অনেক ফাঁকফোকর বের করে। সেসময় এ কম্পানিগুলি প্রাইভেসি জোরদার করার পদক্ষেপ নেয়ার কথা ঘোষণা করলেও ফেসবুক ভুজুং-ভাজুং প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার পেয়ে যায়, কারণ তাদের পয়সাই আসে মানুষের নাড়িনক্ষত্রের খবর আর অ্যাডভার্টাইজিং থেকে। ‘১১র পরে ২০১৩তে যখন এডওয়ার্ড স্নোডেন ফাঁস করে দেন যে এনএসএ মানুষের ওপর ইন্টারনেটে নজরদারি করে, তখন সিলিকন ভ্যালির কম্পানিগুলি সরকার থেকে যতটা সম্ভব দূরে সরার চেষ্টা করে। এর ফলে ড্যাটা প্রাইভেসি সংক্রান্ত আলোচনা আর বেশি গঠনমূলক দিকে আগায়নি। সুযোগটা নিয়ে ফেসবুক-গুগলের মত কম্পানিরা আরো পয়সা বানিয়েছে। যাই হোক, এ বছর মার্কিন সরকারের চাপে না হলেও ইউরোপ থেকে কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার কারণে যথেষ্ট চাপ এসেছে এদের ওপর, আর শেয়ারহোল্ডাররাও এদের বিজনেস মডেল নিয়ে সন্দিহান হওয়া শুরু করেছে। ফেসবুকের গত কয়েক সপ্তাহের শেয়ারের দামের পতন তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। মার্কিন কংগ্রেস, রবার্ট ম্যুলার আর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার সাথে সাথে এদেরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ডাকছে। এই জল কোথায় গিয়ে গড়ায়, সেটা সময়ই বলে দেবে। এটা মানতেই হবে, ইন্টারনেট দেশসীমাবিহীন একটা মাধ্যম, আর কোন তথ্য হওয়া উচিত গোপনীয়, কোন স্তরের গোপনীয়, আর কি ধরনের রাজনৈতিক ইন্টারনেট প্রোপাগান্ডা বাকস্বাধীনতা পাওয়ার উপযুক্ত, এসব নির্ধারণ করা আর সে ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের ঐকমত্যে পৌঁছানো অবশ্যই সময়সাপেক্ষ।
এত কিছুর পরও আমি আশাবাদী। মানুষের গত একশ’ বছরের ইতিহাসে ইন্টারনেট যেমন এসেছে, সেরকম রেডিওও এসেছে, টিভিও বেশিদিন আগে আসেনি। অনেক মানুষ, বিশেষ করে একটু পুরনো প্রজন্মের যারা অনেকেই ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন, তারা, সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে এখনো খুব বেশি পরিচিত নন। মিলেনিয়ালদের পরে যারা আসবে, তারা এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন হবে বলে আমার ধারণা।
আরেকটা ব্যাপার স্বীকার করা দরকার। সত্যমিথ্যা বলে ভোটারদের যতটাই ট্রাম্পের দিকে টানা হোক না কেন, ট্রাম্প কিন্তু যথাযথভাবেই গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রতিবাদ-সমাবেশ সমানে চললেও ট্রাম্পকে ষড়যন্ত্র করে কেউ ঠেকায়নি। ট্রাম্পের বিজয় সেদিক থেকে চিন্তা করলে মার্কিন গণতন্ত্রের একটা পরীক্ষিত সাফল্য। কম ব্যবধানে জিতলেও অনেক মানুষই তাকে একটা সুযোগ দিতে চেয়েছে, এবং তার প্রতিপক্ষ সেটা মেনে নিয়েছে। আর ট্রাম্পের আমলে সাধারণ মানুষ রাজনৈতিকভাবে যতটা সক্রিয়, সচেতন আর প্রতিবাদী হয়েছে, এটা অনেকদিন এদেশে হয়নি। এদেশের স্বাধীনতাগুলি যে সত্যি সত্যি আছে, তার পরীক্ষা এখনই চলছে, মাঝেমধ্যে এই পরীক্ষাটা জরুরী। ট্রাম্প চাইলেই মানুষের কন্ঠরোধ করতে পারবেন না। এদেশের প্রাইভেট সেক্টর, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম, স্টেট ও স্থানীয় সরকার, বিচারালয় — এরা স্বাধীন, শক্তিশালী আর কেউই ট্রাম্পের মুখাপেক্ষী নয়। ট্রাম্প-ব্যাননগোষ্ঠী চাইলেও দেশের সামাজিক মূল্যবোধ আর রাজনৈতিক আলাপচারিতার ধ্যানধারণা রাতারাতি পরিবর্তন করতে পারবে না, এমনকি ইন্টারনেট আর কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকা দিয়েও না।
আমেরিকার রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা দু’টোই বহুলাংশে গণতান্ত্রিক, আমাদের দেশের মত শুধু রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখানো গণতন্ত্রের মত নয়। শুধু তাই নয়, পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশের মানুষের জাতীয়তা, মতামত, মূল্যবোধ যেমনটা সমসত্ত্ব, এখানকার মানুষের — এমনকি সাদাদের মধ্যেও — সেরকমটা নয়। প্রগতিশীল, রক্ষণশীল আর তাদের মাঝখানের সবারই কথা বলার সত্যিকারের স্বাধীনতা আছে। তাদের মধ্যে ইতিহাসের ক্রান্তিকালে বিতর্ক-বিতন্ডা হয়, এদেশে এ নতুন কিছু নয়। এদেশের নতুন অভিবাসীরা সম্ভবত জানেন না, মতপ্রকাশের এ স্বাধীনতা রাখার জন্য আমেরিকা অনেক টানা-পোড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে। তাই শুধু সে স্বাধীনতা উপভোগ নয়, সেসবের ইতিহাস আর সমঝোতার কাহিনী আমাদের জানা বিশেষ কর্তব্য। বিশেষ করে ষাটের দশকের সিভিল রাইটস মুভমেন্ট, সত্তরের দশকে নিক্সনের সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদ সমাবেশ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে শান্তিকামী আর বাস্তবতাবাদীদের বিতর্ক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পর আইসোলেশনিজমের উত্থান, আমেরিকার গৃহযুদ্ধ — এগুলির মধ্যে অনেক ছোট ছোট জরুরী বৃত্তান্ত আছে যেগুলি হেডলাইনের কারণে আমাদের চোখ এড়িয়ে যায়। এদেশে সরকার থেকে চাপিয়ে দেয়া সংস্কার কখনো সুখপ্রদভাবে সফল হয়নি; যখন সমাজে আসলেই পরিবর্তন চলে এসেছে, যথেষ্ট প্রতিক্রিয়াশীলতার বাঁধা অতিক্রম করেই সেসব নতুন মূল্যবোধ একসময় না একসময় সরকারি বৈধতা পেয়েছে। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্র চলে, দু’পা এগুলে একপা পিছুতে হয়, নতুন ‘সঠিক’ মূল্যবোধ খুঁজে পেতে আর প্রতিস্থাপন করতে সময় লাগে। আজকের মত বিভক্তি ঝগড়াঝাঁটি আগেও হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে। কেম্ব্রিজ অ্যানালিটিকার মত সংস্থা এ বিভাজনকে ব্যবহার করলেও এই সৎ ও সমালোচনামূলক বিতর্ক যে কোন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার জন্য খুবই জরুরী। আর এখনকার খারাপ সময় পার করার পর একসময় না একসময় সামাজিক মূল্যবোধে একটা কনভার্জেন্স আসবে।
যারা বর্ণবাদের উত্থান নিয়ে শংকিত তাদের কিছু আশ্বাস দেই। ট্রাম্পের কারণে ‘১৭র শুরুর দিকে বর্ণবাদী আর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীরা একটু শোরগোল তুললেও এখন কিন্তু তাদের যারা বেশি কট্টর তারা অনেক ধারায় বিভক্ত হয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ এমন এক ধরনের মতবাদ যার অনুগামী যত বাড়বে তত তারা নিজেদের মধ্যে মারকাট করবে কার জাত বেশি শুদ্ধ তাই নিয়ে। ট্রাম্পের কারণে এরা যে সাংগঠনিকভাবে একীভূত হয়ে সত্যিকারের রাজনৈতিক শক্তি হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে, তা কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়নি। বিশেষ করে স্টীভ ব্যাননকে সরিয়ে দেয়ার পরে আমি ব্যক্তিগতভাবে ট্রাম্পের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা নিয়ে তেমন একটা আতংকিত নই। ট্রাম্পভোটার সাদাদের অনেকের মনের মধ্যে অভিবাসীবিরোধী বা কিঞ্চিৎ বর্ণবাদী মনোভাব দেখলেও আমার হিসাবে তারা সেটাকে উগ্র হিংসাত্মক পর্যায়ে নেয়ার মত মানুষ নয়।
এককভাবে আর গোষ্ঠীগতভাবে যেটা করণীয় সেটা হলো আমাদের যার যার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাধারণ মানুষদের সাথে সরাসরি কথা বলা। শুরুতে মনে হবে তাদের মস্তিষ্ক প্রক্ষালিত। যত বেশি কথা বলবেন, আর রাজনীতি পেরিয়ে অন্য প্রসঙ্গেও যাবেন, ততই বুঝতে পারবেন এরা কিন্তু আপনার মতই কোন না কোন কারণে ভীত। তাদের ভয়টাকেই আপনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের নেতারা চাগিয়ে তুলছে, বাড়িয়ে তুলছে, যেমনটা হয়ত আপনার রাজনৈতিক ঘরানা করছে আপনার সাথে। যখন এদের সাধারণ সমর্থকদের সাথে কথা বলবেন, জিজ্ঞেস করবেন তারা ব্যক্তিগতভাবে আসলে কি চায়, দেখবেন যে তারাও চায় আপনার মত একটা ভাল জীবিকা, আবাসস্থল, নিজেদের মত করে জীবনযাপনের স্বাধীনতা আর পরের প্রজন্মের জন্য একটা উপযুক্ত পরিবেশ। তারা ভয়ে আছে যে আপনার রাজনৈতিক ঘরানা তাদের এসব চাওয়ার ঘোরতর বিরোধী আর এ ভয়টাই তাদের পরিচালনা করছে। সেখানে তাদের প্রার্থী নৈতিকতার সীমালংঘন করছেন কিনা তার থেকে বেশি তাকে মূল্যায়ন করা হয় তিনি তাদেরকে দেয়া প্রতিশ্রুতিগুলি পূরণ করছেন কিনা তা দিয়ে। কথোপকথনের পরের ধাপে গিয়ে যদি আপনি তাদের সম্পর্কে নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেন, তাদের আস্থা অর্জন করতে পারেন এবং বোঝাতে সক্ষম হন যে আপনার ব্যক্তিগত চাওয়াটাও মূলত একই আর মতের অমিল থাকলেও বন্ধুত্ব করতে আপনি রাজি, তখন তাদের এবং আপনার নিজেরও ভয়ভীতিগুলি কিছুটা লাঘব হবে, আর অ্যানালিটিকাগোষ্ঠীর পূর্ণচক্র তখনই ভাঙবে। এই কথোপকথনের সময় এখনই! আদর্শবাদ নিয়ে বুলি কপচানোর কিংবা প্রতিপক্ষের ‘পশ্চাদমুখী’ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে হাসাহাসি বা নাক-সিঁটকানোর সময় এখন নয়!
কথোপকথনের মূল বিষয়বস্তু যতদিন থাকবে শুধুমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্প, ততদিনই প্রগতিশীলতার নামে চলবে অসহিষ্ণুতা আর রক্ষণশীলতার নামে অসাধুতা। আমরা যতক্ষণ না চেষ্টা করব আমাদের ‘প্রতিপক্ষ’কে জানার-বোঝার, তাদের সাথে কথা বলার, ততদিন এই প্রগতিশীল-রক্ষণশীল ভন্ডের দল আমাদেরকে ইন্টারনেট আর টিভির মাধ্যমে আলাদা করে রাখবে, আর বুঝ দেবে যে আমরা একে অপরের শত্রু। যতক্ষণ না আমরা নিজেরা সেই অদৃশ্য দেয়াল ভাঙতে সক্ষম হচ্ছি, ততদিন আমাদের ভবিষ্যতে আসতে থাকবে আরো ‘ট্রাম্প’ এবং আরো খারাপ ‘ট্রাম্প’।