কামার ও শয়তান – ২

(প্রথম পর্বের পর)

প্রস্তরযুগের মানুষের বিবর্তনের কথা বলেছি এর আগে। সেসাথে আগুনের আবিষ্কারের ফলাফল। আগুনের পরপরই সম্ভবত ধাতুকার্যের কাকতালীয় আবিষ্কার।

প্রস্তরযুগ আর তাম্রযুগের মাঝের যুগটাকে বলে ক্যালকোলিথিক। এসময় তামা মেশানো পাথর বা আকরিক দিয়ে অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি বানানো হত। হয়ত এরকম কোন আকরিক পাথর আগুনের কুন্ডলীতে ফেলার পর সেটা গলে পরিশুদ্ধ ধাতু হয়ে বেরোয়। ক্যাম্পফায়ারের তাপমাত্রা খুব বেশি নয়, হয়ত কোন বিশেষ ধরনের চুলোর মধ্যে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে এই আকস্মিক আবিষ্কারটি হয়।

আবিষ্কারটি প্রথম যারা করেছিল, তারা ওয়াকিবহাল ছিল এর তাৎপর্য সম্পর্কে। ধাতু পাথরের থেকে কয়েক গুণ বেশি শক্ত আর গলিত অবস্থায় বিভিন্ন আকার দেয়া যে যায় তাকে, তারা সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে কারণে যে খনি থেকে তামার আকরিক পেয়েছে, সেখানে তারা ফিরে গেছে আরো সংগ্রহের জন্যে। তারপর আরো গবেষণা করে জ্ঞানটাকে মোটামুটি পাকাপোক্ত করেছে।

আর এরা জ্ঞানটা গোপন রেখেছে অন্যান্যদের কাছ থেকে। ইন ফ্যাক্ট, এই প্রাচীন কামারদের কাছে এটা বিজ্ঞান নয়, প্রকৃত অর্থেই জাদুবিদ্যা ছিল। কারণ কখনো কখনো ঠিক তাপমাত্রায় চুল্লী গরম রাখতে না পারলে পুরো কাজটা যেত ভেস্তে। তাই মন্ত্রপাঠ আর দেবপূর্বপুরুষদের পূজোর দরকার হয়ে পড়ত বৈকি। আবার কখনো পশু কিংবা নরবলিরও!

এই যে তামা কিংবা তামার সাথে টিন মিশিয়ে আরো শক্ত ব্রোঞ্জ তৈরির প্রণালী, এর আবিষ্কার কমপক্ষে আট হাজার বছর আগে। ওয়েলসের ক্লানদুদনোতে ৪,০০০ বছরের পুরনো বিশাল এক তামার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখান থেকে উত্তোলিত তামা পুরো মধ্যোপসাগরে রপ্তানি হত। অর্থাৎ ইতিমধ্যে ধাতুর খনন কুটিরশিল্প থেকে বৃহদশিল্পে পরিণত হয়েছে। এরকম আরেকটা জায়গা বর্তমান সাইপ্রাস, যার নামের মধ্যেই রয়েছে ‘কপার’ (গ্রীকে ক্যুপ্রোস, তুর্কীতে কিবরিস)। প্রাচীন মিশর-তুরস্ক-গ্রীসের ব্রোঞ্জশিল্পের তামার আদি উৎস এই সাইপ্রাস।

ওয়েলসের ক্লানদুদনোর গ্রেট ওর্ম কপার মাইনস। ৪,০০০ বছর আগে এখানে খনিতে কাজ শুরু হয়। ম্যালাকাইট নামের আকরিক উত্তোলনের পন্থা ছিল পশুর হাড় আর পাথরের হাতুড়ি দিয়ে খনির দেয়াতে ক্রমাগত ঘা মারা।
সাইপ্রাসের স্কুরিওতিসার তামার খনি বিশ্বের প্রাচীনতম। ৪,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে এখনও পর্যন্ত এখানে তামা উত্তোলন চলছে।

ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের পরে কর্মকারদের সৃজনশীলতা তুঙ্গে ওঠে। খোদার ওপর খোদকারি করে নানা জন্তু-জানোয়ার, মানুষ, বস্তু, এমনকি দেবদেবীর নিখুঁত মূর্তি পর্যন্ত তারা বানিয়ে ফেলতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে এ বিদ্যা জাদুটোনার থেকে কম কিছু ছিল না। শিকারী কিংবা কৃষকের কাছে খনির গভীর অন্ধকারে ঢুকে পাথর খোঁড়া ছিল রহস্যময় একটা ব্যাপার। সে ‘পাথর’ যে চুল্লীতে ঢুকে নতুন সৃষ্টি হয়ে বেরিয়ে আসছে, এটাও অলৌকিক শক্তির লক্ষণ। শয়তান বা অশুভ আত্মাকে যদি কেউ নাকানি-চুবানি দিতে পারে, তো সে এই ধূর্ত কামারই। ‘কর্মকার’ মানেও আসলে ‘স্রষ্টা’।

ব্রোঞ্জ আমলের কামারদের অবশ্য অনেক পেশাগত ঝুঁকি ছিল। তামা-টিনের খনিতে মিশ্রিত থাকে বিষাক্ত আর্সেনিক ও সীসা। এ বিষের সংস্পর্শে এসে শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য দেখা দিত তাদের। এ কারণেই হেফেস্টাস ল্যাংচা, পাগলা, বেঁটে। হয়ত আয়রিশ লোককথায় ডয়ার্ভস কিংবা বামনদের সাথে খনি ও ধাতুবিদ্যার রহস্য জড়িত এ কারণেই।

১৫৫০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে সোনার তৈরি মাস্ক অফ আগামেমনন। ট্রয়ের আবিষ্কর্তা হাইনরিষ শ্লীমান মাইসেনির ধ্বংসাবশেষে এটি খুঁজে পান। তিনি ভেবেছিলেন ইলিয়াডের আগামেমননের সমাধি খুঁজে পেয়েছেন। ব্রোঞ্জ যুগের অসাধারণ ধাতবশিল্পের প্রমাণ এটি।

ব্রোঞ্জের পর লৌহযুগের শুরু হয় প্রায় ২,২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। এ ছিল আরেক অসম্ভব ব্যাপার। সাধারণ ক্যাম্পফায়ারে ৪০০ ডিগ্রিরই বেশি তাপমাত্রা ওঠে না, আর লোহার গলনাংক ১,৪০০-১,৫০০ ডিগ্রি। অর্থাৎ লোহা গলানোর জন্যে দরকার হয়ে পড়ে বিশেষ ধরনের চুল্লি। তাছাড়া কাঠকয়লারও দরকার পড়ে আকরিককে পরিশুদ্ধ করার জন্যে। কখনো কখনো পশুর হাড়গোড়ও চুল্লিতে ফেলত কামাররা, এতে অর্গানিক কার্বন মিশে লোহাকে আরেকটু মজবুত করত। স্টীলের রহস্য ঠিক তাই। সাধারণ মানুষ অবশ্য এর উসিলায় ‌গুজব রটাত যে কামাররা চুল্লীতে নরবলি দেয়। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

ইতিহাসের সবচে পুরনো লোহার তৈরি অস্ত্র পাওয়া গেছে তুরস্কের প্রাক-হিট্টাইট হাট্টিয়ান কালচারে। এ অসম্ভব না যে, এদের উত্তরপূর্বের পন্টিক স্তেপের আদি ইন্দোইউরোপীয়রাই লোহা বিশুদ্ধকরণ প্রণালী প্রথম আবিষ্কার করে। মিশরে অবশ্য এর থেকেও পুরনো লোহার তৈরি ছুরি আবিষ্কৃত হয়েছে, তুতানখামুনের সমাধিতে। কিন্তু সেটা পৃথিবীর লোহা নয়, উল্কার লোহা! অর্থাৎ তার বিশুদ্ধিকরণের তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। মোটামুটি একটা উচ্চ তাপমাত্রায় নিয়ে পিটলেই হলো।

১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে ডেনমার্কে ব্রোঞ্জের তৈরি এই সূর্যরথ। সূর্যদেবতাকে প্রতি ভোরে ঘোড়ায় টানা এ রথ টেনে তোলে। ঋগ্বেদসহ সকল ইন্দো-ইউরোপীয় মিথে প্রায় একই মোটিফের ছড়াছড়ি।
৩৭০০-৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বে ককেশাসে মাইকপ কালচারের মানুষ ব্রোঞ্জ দিয়ে এই ষাঁড়টি বানায়। পন্টিক স্তেপের ইন্দোইউরোপীয়দের সরাসরি দক্ষিণের পড়শী ছিল এরা। দু জাতের মধ্যে প্রযুক্তি আদানপ্রদান হওয়ারই কথা।
২৩০০-২০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আনাতোলিয়ার হাট্টিয়ান কালচারের মানুষ ব্রোঞ্জে তৈরি করেছে এই জোড়া ষাঁড়।
১৭০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে ডেনমার্কে তৈরি হয়েছিল ব্রোঞ্জের এই শিরোস্ত্রাণ।

লৌহযুগের আগমনের সাথে সাথে অস্ত্রশস্ত্র বানানোতে একটা বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ভাল কামাররা তরবারি তৈরির প্রক্রিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব ‘অলৌকিক’ তরবারিকে নাম দিলে তার জাদুশক্তি আরো কয়েকগুণ বাড়ত। সেই থেকে আর্থারের এক্সক্যালিবার, রোলাঁর দ্যুরন্দাল, শার্লমেনের জোয়াইওজ, সিগুর্দের গ্রাম, বেওউল্ফের হ্রুনটিং, আলীর জুলফিকার, ইত্যাদি।

এদের সাথে যোগ করতে পারি বর্তমান যুগের ‘রূপকথা’ লর্ড অফ দ্য রিংসের দুটো ধাতব জিনিস। ওয়ান রিং — যার মধ্যে রয়েছে সারা বিশ্বের ক্ষমতালাভের শক্তি। আর নারসিল, যে তরবারি দিয়ে সাউরনের হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ইসিলদুর। ভেঙে যাওয়া নারসিলের ধাতু গলিয়ে তৈরি হয় নতুন তরবারি আন্দুরিল। আর ধাতুবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ গিমলির জাত ডয়ার্ফরা। তাদের আবাস পাহাড়ের গভীরের খনিশহরে।

তুতানখামুনের সমাধিতে পাওয়া মিটিওরিক আয়রনের তৈরি ছুরি, ১৩২৩ খ্রীষ্টপূর্ব, ব্রোঞ্জ যুগ চলছে তখনও।
শার্লমেনের তরবারি লা জোয়াইয়োজ। লেজেন্ডারি এই তরবারি নাকি আরো আদি রাজা রোলাঁর দ্যুরন্দালের ধাতু গলিয়ে তৈরি। ফরাসী রাজাদের রাজ্যাভিষেকে দ্বাদশ শতক থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
লর্ড অফ দ্য রিংসে ভেঙে যাওয়া তরবারি নারসিলের ধাতু গলিয়ে তৈরি এল্ফরা আরাগর্নের জন্যে তৈরি করে নতুন আরেক তরবারি আন্দুরিল।

যাক গে, রূপকথা থেকে বহু দূরে সরে এসেছি। কামার ও শয়তান রূপকথাটির একটা মোরাল বা নীতিকথা অবশ্য আছে। ফাউস্টের মত বিদ্বান ব্যক্তিরা, যারা কিনা কামারের উন্নত সংস্করণ, তারা নিজেদের আত্মা বিকিয়েছেন জাগতিক অলৌকিক ক্ষমতার বিনিময়ে। তারা বৈশ্বিক জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়েছেন ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপরে।

কামারদের চরিত্রটাও অনেকটা সেরকম। খোদার ওপর খোদকারির ব্যাপারটা বলেছি। তাছাড়াও সোনা-রূপা ইত্যাদি ধাতুর জাগতিক মূল্যটাই খালি বুঝতে পারে কামার। এখানেই তার ট্র্যাজেডি। ধূর্ত শয়তানকে ঠকিয়ে ইহলোক সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে পরলোকে স্বর্গ-নরক কোথাও ঠাঁই হয় না জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের। এ কারণেই প্রাচীন গল্পটা পরবর্তীকালের খ্রীষ্টান ধর্মের লেজেন্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আজকে অবশ্য আমরা এত কিছু গবেষণা করে বের করতে পারছি কামারের মতই প্রযুক্তির ম্যাজিক খাঁটিয়ে। তেহরানি তার গবেষণায় যে খান পঞ্চাশেক ভাষার আড়াইশ’ রূপকথার প্রব্যাবিলিস্টিক অ্যানালিসিস করেছেন, তা সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বদৌলতে। ঊনবিংশ শতকের গ্রিমভ্রাতৃদ্বয় জার্মানিতে, আর বিংশ শতকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশে বছরের পর বছর গবেষণা করে যে সব ইন্দোইউরোপীয় রূপকথার কাহিনী একে অন্যের সাথে যুক্ত করেছেন, সে কাজটা কম্পিউটারের বদৌলতে এখন কয়েক সপ্তাহের না হলেও মাস দুয়েকের ব্যাপার। তাই বলতে পারি, জয় হোক কামারের হাতুড়ি-নেহাই-হাঁপর-চিমটের। আর প্রোগ্রামারের মাউস-কীবোর্ড-মনিটরের।

কামার ও শয়তান – ১

“… শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারের স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এত বড় আস্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল যে বেচারার দমই ফেলা দায় । সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল— সেই চেয়ার, যাতে একবার বসলে আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই।

“কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে তা দিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিপে ধরল। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে হেইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রাবারের মত লম্বা হতে লাগল। … “

প্যারা দুটি উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘তিনটি বর’ নামে গল্প থেকে নেয়া। ছোটবেলায় তার সংকলিত দেশ-বিদেশের উপকথা নিয়ে একটা বই পড়েছিলাম। তাতে ছিল। শয়তানের মত ধূর্ত বদ চরিত্রকেও যে ঢিঁট করা সম্ভব, সে গল্প পড়ে বেদম মজা পেয়েছিলাম।

এই গল্পটা নাকি কমপক্ষে ছয় হাজার বছরের পুরনো!

২০১৬ সালে গবেষক জামশেদ তেহরানি ও গ্রাসা দি সিলভা ফাইলোজেনেটিক অর্থাৎ ভাষাগোষ্ঠীর পারস্পরিক সম্পর্ক ও বিবর্তনের ভিত্তিতে রিসার্চ করে এ তথ্যটা আমাদের দিয়েছেন। তাদের বিচারে ইন্দোইউরোপীয় ভাষার জন্মের আদিকালে এ গল্পটি মুখে-মুখে প্রচলিত ছিল। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়া আর রাশিয়া থেকে শুরু করে আয়ারল্যান্ড অব্দি এটি নানা রূপে উপস্থাপিত হয়েছে শ্রোতাদের কাছে। সে সময়ে বই দূরের কথা, লিখনপদ্ধতিরও আবিষ্কার হয়নি। কথক কিংবা বার্ড বলে একটি পেশা ছিল যাদের কাজ কেচ্ছা শুনিয়ে বেড়ানো।

ঊনবিংশ শতকের ইলাস্ট্রেশনে সেন্ট ডানস্ট্যান শয়তানের নাকটা চিমটে দিয়ে ধরে দিলেন এক টান, হেইয়ো…

গল্পটার সারবস্তু হলো শয়তান, মৃত্যু, জ্বীন কিংবা কোন অপদেবতার কাছ থেকে নিজের আত্মার বিনিময়ে কামার অলৌকিক ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়। তারপর সে ক্ষমতাটাকে কাজে লাগিয়েই কূটকৌশল করে চুক্তি থেকে মুক্তি ছিনিয়ে নেয়।

উপেন্দ্রকিশোরের গল্পটিতে অবশ্য কামার তিনটি বর পায় এক বৃদ্ধ মানুষের ছদ্মবেশধারী দেবতাকে সাহায্য করে। আর মৃত্যুর পর স্বর্গ-নরক কোথাও কামারের স্থান হয় না। শয়তান নরকের আগুন থেকে কাঠকয়লা ছুঁড়ে তাকে দূর করে দেয়। সেই জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে জলায় জলায় সে ঘুরে বেড়ায়, আর তার আলো দেখা যায়। তাইই নাকি আলেয়া — জ্যাক ও’ল্যান্টার্ন। হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের উৎপত্তি এই রূপকথা থেকেই। ইংরেজী কাহিনীতে কামারের নাম জ্যাক। আবার অন্য কোন কাহিনীতে সে সেন্ট ডানস্ট্যান। ফ্রান্সে সেন্ট ডানস্ট্যান হয়ে গেছে স্যাঁত-এলোয়া।

হ্যালোয়িনের জ্যাক ও’ল্যান্টারনের উৎস স্মিথ অ্যান্ড দ্য ডেভিল নামে সুপ্রাচীন এক উপকথায়।

রাশিয়াতে কাহিনীটা একটু পরিবর্তিত। সেখানে কামারের সহকারী শয়তান, যে কিনা তাকে বিপদে ফেলে। গ্রীকদেরও প্রায় একইরকম গল্প আছে। চেক ভারশনে উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের মত স্টুলে শয়তানকে আটকে রাখে কামার। এর্রেমেন্তারি বলে একটা বাস্ক ভাষার ছবি দেখেছিলাম ক’দিন আগে নেটফ্লিক্সে, তার কাহিনীতেও শয়তানকে চালাকি করে নিজের কারখানায় নেহাইয়ের সাথে আটকে রেখে দিয়েছিল শ্মশ্রুমন্ডিত পাগলা কামার। আয়রিশ ভার্শনে কামারকে বর দেয় ফেইরি কুইন।

বাস্ক লোককাহিনীভিত্তিক মুভি এর্রেমেন্তারিতে শয়তানকে খাঁচায় পুরে রেখে দিয়েছে কামার।

প্রায় একই রকম গল্প জার্মানিতে প্রচলিত ছিল বিদ্বান ডক্টর ফাউস্টের নামে। শয়তানের কাছে নিজের জীবন বন্ধক রেখে নানান অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াত মধ্যযুগীয় এ চরিত্র। পরে ক্রিস্টোফার মার্লো আর গ্যেটে ফাউস্টকে নিয়ে মেলোড্রামাটিক ক্লাসিকাল কাহিনী ফেঁদে বসেছেন। আটলান্টিক পেরিয়ে আমেরিকায় এসেও কাহিনীটির বিবর্তন শেষ হয়নি। আপালাচিয়ান পর্বতমালার মানুষ জনি দ্য ফিডলার নামে চেনে এই ধূর্ত কামারকে।

গ্রীক কামার দেবতা হেফেস্টাস তার কর্মশালায়, ক্লাসিকাল শিল্পীর কল্পনাতে।

কামারের ধূর্ততা আর কূটকৌশলের একটা তাৎপর্য যে আছে সেটা আরেকটু ব্যাখ্যা করতে চাই। শুধু যে লোককথায় আছে কামার তা নয়। বিভিন্ন প্রাচীন দেবদেবীর কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে কামার দেবতার পেশাভিত্তিক যে স্থান, সেটা আর কারো নেই। উদাহরণ, গ্রীক দেবতা হেফেস্টাস, আফ্রোদিতির স্বামী। মুখভর্তি দাঁড়ি, লেংচা, কুৎসিত। অথচ ধাতু নিয়ে সে অসাধারণ সব জিনিস বানিয়ে ফেলে। জিউসের বজ্র থেকে শুরু করে হার্মিসের শিরোস্ত্রাণ, একিলিসের বর্ম — এগুলি তারই বানানো। একটা রথও সে বানিয়ে ফেলে যা কিনা নিজ থেকেই সচল। অর্থাৎ হেফেস্টাস গ্রীক দেবতাদের টেক-গীক! ও হ্যাঁ, নিজের মা হেরাকেও চেয়ারে সেঁটে রাখার কৃতিত্ব তারই। এখানে শয়তানের জায়গা নিয়েছেন মাতৃজননী স্বয়ং।

গ্রীকদের হেফেস্টাসের মত রোমানদের ভাল্কান। দু’জনেরই কর্মশালা আগ্নেয়গিরির মধ্যে। যখন তারা কাজ শুরু করে সেখানে, তখন মাউন্ট এটনা থেকে অগ্ন্যুৎপাত হয়।

নর্স-জার্মানিক জাতিগোষ্ঠীদের কামার দেবতার নাম ওয়েল্যান্ড কিংবা ভলুন্ড। আইসল্যান্ডিক ভাষায় লেখা পোয়েটিক এডাতে তার গল্প রয়েছে। কেল্টিকদের গভন্যু। ফিনিশ ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় নয়, তারপরও তাদের জাতীয় কাহিনী কালেভালাতে ইলমারিনেন নামে এক কামার চরিত্র রয়েছে। জাদুর ধাতব জিনিসপাতি বা সাম্পো তৈরি করে সে — তামার জ্যান্ত ঘোড়া পর্যন্ত।

ফিনিশ-সোভিয়েত যৌথ প্রযোজনার ছবি ‘সাম্পো’তে কালেভালা কাহিনীর কামার ইলমারিনেন একটা ধাতব স্লেজ বানাচ্ছে।

ইরানী উপকথায় কাভে আহাঙ্গারানও কামার। অত্যাচারী রাজা জাহাকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পারসিকদের মুক্ত করে সে। ককেশাসের ওসেটিয়াতেও রয়েছে কামারদেবতার উপকথা। আর বৈদিক যুগের ভারতের ত্বস্তৃ, পরবর্তীতে বিশ্বকর্মা নামে ব্রহ্মায় মিলিয়ে যান। জাপানেও রয়েছে আদি কামার আমাকুনি।

কেন্টাকির লেক্সিংটনে পুরনো বাড়ির চৌকাঠে হর্স শু ঝুলছে। এ কুসংস্কার আমেরিকায় এসেছে আইরিশদের সাথে।

শুধু এশিয়া আর ইউরোপ নয়, পশ্চিম আফ্রিকাতেও কামারদের আলাদা মর্যাদা। অনেকের ধারণা তারা জাদুকর। কোন কোন কালচারে কামার আর মেডিসিনম্যান একই ব্যক্তি। লোহা আর আগুনের কম্বিনেশন দিয়ে ভূত তাড়ানোর ব্যাপারটাও মনে হয় কামার-ওঝাদের ঊর্বর মস্তিষ্কের ফল! হর্সশুও তাই অমঙ্গলনাশক। নাইজেরিয়ার দেবতা ওগুন কামারদেরই পৃষ্ঠপোষক।

অর্থাৎ, ইন জেনারেল, কামার পেশাটা ম্যাজিকের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, শুধু ইন্দোইউরোপীয় সংস্কৃতিতেই নয়। কেন ও কিভাবে, এটাই জানতে চাই! হাজার হোক, টেকনলজিস্ট আর ইনজিনিয়াররা এ যুগের কামার, শুধু সেকালের সম্মানটা আর নাই!

(দ্বিতীয় খন্ডে সমাপ্য)

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!