ট্যাপড্যান্স

Featured Video Play Icon

হলিউডের পঞ্চাশের দশকের জৌলুসভরা মিউজিকাল ‘সিঙিং ইন দ্য রেইনে’ জীন কেলির ট্যাপ ড্যান্সিং দেখে বিমুগ্ধ হয়েছিলাম। পরে জেনেছি, আয়ারল্যান্ড থেকে কিভাবে এই নাচ আমেরিকায় এসেছে। রিভারড্যান্সেও অরিজিনালের কাছাকাছি আইরিশ ড্যান্স দেখেছি নব্বইয়ের দশকের টিভিতে।

যেটা প্রথমে বুঝিনি, কিন্তু মনে প্রশ্ন ছিল যে আইরিশরা তো নাচার সময় হাত দুটো সোজা করে মুষ্টিবদ্ধ করে নাচে, হাত নড়লেই তার নাচ ডিসকোয়ালিফাইড। কথিত আছে, আয়ারল্যান্ডের কট্টর ক্যাথলিক বিশপরা চাইতেন না, ছেলেমেয়েরা নাচার সময় কোন হ্যাংকিপ্যাংকি করুক। তো নিয়ম দাঁড়িয়ে গেল, যার যার হাত তার তার নিজের কাছে রাখো! (টাইটানিক দ্রষ্টব্য)

তাহলে আমেরিকায় আইরিশ ট্যাপ ড্যান্সকে স্ট্রেইটজ্যাকেটের বন্ধন থেকে মুক্ত করলো কে?

কে আর? মার্কিন দেশে আসা ক্রীতদাসদের সেই ভুমচাক আফ্রিকান নৃত্য!

আফ্রিকার থেকে আমেরিকায় আসা দাসদের সপ্তাহে একটা দিন বরাদ্দ ছিল নিজ সংস্কৃতির আচার পালনের জন্যে। সে কাজটা তারা করত শহরের মাঝখানে কঙ্গো স্কয়ার বলে কোন চত্বরে ড্রাম পিটিয়ে নর্তনকুর্দন করে। লুইজিয়ানার নিউ অরলিয়ান্সে গেলে এখনো কঙ্গো স্কয়ারের দেখা মিলবে।

আফ্রিকান সঙ্গীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এই ড্রামের অবশ্য আরেকটা ব্যবহার ছিল। যুদ্ধের সংকেতপ্রেরণে আফ্রিকার জাতিগুলি নানারকম ড্রাম ব্যবহার করে। ১৭৩০এর দশকে ড্রামের ব্যবহার করে কয়েক জায়গায় রক্তাক্ত দাসবিদ্রোহ সংঘটিত হয়। তখন সাদার্ন অনেক স্টেটে আইন করে কৃষ্ণাঙ্গদের ড্রামবাদনা নিষিদ্ধ করা হয়।

তো, ঐ ভুমচাক নৃত্য থেমে থাকেনি। পারকাশনের স্থান পূরণ করলো স্যাক্সোফোন, ট্রম্বোন, ফ্রেঞ্চ হর্ন, ডাবলবাস, গীটার প্রভৃতির পূর্বসূরী যন্ত্রপাতি। তাই জ্যাজ-ব্লুজের শেকড়। আমেরিকার অন্যান্য যেসকল দেশে আফ্রিকান দাস ছিল, যেমন ব্রাজিল, কিউবা, এসব জায়গায় ড্রামবাদনা নিষিদ্ধ ছিল না। তাই তাদের মিউজিক গেল ড্রামভিত্তিক সাম্বা-মাম্বোর দিকে।

আরো যে জিনিসটা আফ্রিকান দাসরা ব্যবহার শুরু করলো সেটা অনন্য একটা ব্যাপার! খেতখামারে দাসদের পাশাপাশি যেসকল আইরিশ কাজ করত তাদের দেখাদেখি ট্যাপ ড্যান্সটা রপ্ত করে ফেলল। ড্রামের অভাব পূরণ করলো সেটাই!

আর আফ্রিকান নৃত্যে কী হাত স্থির থাকে!

তারপর বিশ-ত্রিশের দশকের ভডভিল শোগুলিতে নিগ্রো ট্যাপড্যান্সার রাখা হত নেহাত হাসিঠাট্টার জন্যে। কখনো সাদারা মুখে কালো রঙ করে (ব্ল্যাকফেস) সেই ট্যাপড্যান্স করত। ব্যাপারটা আজকের স্ট্যান্ডার্ডে হাল্কা রেসিস্ট বলতে হবে!

কিন্তু সেই হাসিঠাট্টা বেশিদিন চলেনি! কালে সেটাই হয়ে গেছে মেইনস্ট্রীম! আইরিশ, ইটালিয়ান সব ইমিগ্র্যান্ট সমাজ ঐ নাচ শিখে নেচেছে। তারা যে কৃষ্ণাঙ্গভিত্তিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে তাকে বলে হারলেম রেনেসাঁস। তারপর কালো-সাদা সবে মিলে হলিউডের খোমা বদলে দিয়েছে ট্যাপড্যান্স দিয়ে।

বর্তমান যুগেও ট্যাপ ড্যান্স আছে, আমরা টের পাই না। মাইকেল জ্যাকসনের পায়ে যে জুতো দেখি সেগুলি আসলে কৃষ্ণাঙ্গ ট্যাপড্যান্সার স্যামি ডেভিস জুনিয়রের অনুকরণে, আর তার মুনওয়াক প্রথম করে বিল বেইলী বলে আরেক ট্যাপ ড্যান্সার।

পপ সংস্কৃতির কি ভয়ংকর শক্তি! যে জিনিস মানুষের মন কাড়ে, সেটা জাত-বর্ণের মধ্যে আটকে থাকে না — আইরিশ থেকে কালো, আবার কালো থেকে সাদা, সবাই লালন করে সেটা। দু’য়েকদিন বোকার দল হাসাহাসি করবেই। ঐসব ঠাট্টাতামাশা গায়ে না লাগিয়ে যারা নিজের ভালোলাগাটা নিয়ে পড়ে থেকেছে, তারাই পরিবর্তন করে দিয়েছে ভবিষ্যতের চিত্র!

নিচে বেশ কিছু দেখার মত স্নিপেট দিয়েছি।

লেখাশেষে খেয়াল করলাম আজ আইরিশ প্যাট্রন সেন্ট সেন্টপ্যাট্রিকস ডে!

 


জিন কেলী সিঙিং ইন দ্য রেইন

https://www.youtube.com/watch?v=D1ZYhVpdXbQ

রিভারড্যান্স আইরিশ ড্যান্স ট্রুপ

 

ত্রিশ চল্লিশ দশকের সেরা ট্যাপ ড্যান্সার কৃষ্ণাঙ্গ ভ্রাতৃযুগল নিকোলাস ব্রাদারস

আরেক বিশ্বসেরা ট্যাপ ড্যান্সার এলিনর পাওয়েল

মাইকেল জ্যাকসনের মুনওয়াক আসলে বিল বেইলী প্রথম রূপালীপর্দায় পারফরম করেন

মাইকেল জ্যাকসনের প্রথম লাইভ কনসার্টের মুনওয়াক

ব্লুগ্রাস!

Featured Video Play Icon

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিমে প্যাসিফিক মহাসাগরের পাশে দুটো সুন্দর স্টেট আছে — ওরেগন আর ওয়াশিংটন। এই এলাকার রেইন ফরেস্টের সুউচ্চ চিরহরিৎ গাছপালা, নয়নাভিরাম তুষারাবৃত পর্বত আর পাথুরে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিস্কো পর্যন্তও বিস্তৃত। ওরেগনে বেশ ক’বছর আগে গ্রীষ্মের কয়েক মাস কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেসময়ের অন্যতম স্মৃতি হল এক মার্কিন সহকর্মী বন্ধুর সাথে প্রশস্ত কলাম্বিয়া নদীর তীরে ক্যাম্প করে দু’রাত্রি কাটানো — স্কামানিয়া ফ়োক ফ়েস্টিভাল উপভোগ করার উসিলায়।

সে উৎসবে গেছিলাম মূলত আইরিশ স্টেপ ড্যান্সিং সামনাসামনি দেখার লোভে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই এনিয়াচীফটেইনস প্রমুখ শিল্পীর গান আর স্টারটিভিতে রিভ়ারড্যান্স শো দেখে আইরিশকেল্টিক ঐতিহ্যের প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। হাতে আঁকা ছবির মত নিসর্গের মাঝে খোলা আকাশের নিচে সেই আইরিশ নৃত্য-গীতি-বাদ্য দেখা-শোনা তো হলোই, উপরি হিসাবে পেলাম মার্কিনদেশের নানারকম উপভোগ্য লোকগীতির পরিবেশনা। তার মধ্যে ছিল ফ়োক, ব্লুজ়, জ্যাজ় — আর ব্লুগ্রাস!

এর আগে ব্লুগ্রাস সম্পর্কে আমার ধারণা খুব বেশি ছিল না। শুধুমাত্র যেখানে এর নমুনা পেয়েছিলাম, সেটা হল কোয়েন ব্রাদারস পরিচালিত, জর্জ ক্লুনি অভিনীত অনবদ্য মিউজ়িক্যাল চলচ্চিত্র ‘ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ’। এ লেখার অনুসঙ্গ হিসাবে তার থেকে একটা গান জুড়ে দিলাম।

গানের কথায় বুঝতে পারছেন, গায়ক (বা গীতিকার) দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় উজাড় করে দিচ্ছে। আমেরিকার দক্ষিণের পাহাড়ী আপালাচিয়া অঞ্চলের কেন্টাকি স্টেটে তার জন্ম। সারাজীবন নানারকম ঝুটঝামেলা তার সঙ্গী। মানে, হয়ত সে সমাজচ্যুত আউটক্যাস্ট, অথবা আইন থেকে পলাতক আউটল’। তার নেই কোন বন্ধু-নিকটজন, যে তার ছন্নছাড়া জীবনে সহায় হতে পারে। পথে হয়ত প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সেখানেও পিছু ছাড়েনি তার অতীত। তাই আবার সে পলায়নপর, হয়ত তার মরণ হবে সে প্রচেষ্টায়। হয়ত প্রেমিকা তাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালবাসবে, কিন্তু তাতে তার হাঁহুতাশ নেই! কারণ এ সুনিশ্চিত, যে একসময় না একসময় স্বর্গের স্বর্ণালী সৈকতে আবার দেখা মিলবে দু’জনার!… গানটা যতটা না দুঃখের, তার থেকে বেশি বোধহয় দুর্ভাগ্যপীড়িত অনন্যোপায় গায়কের সান্ত্বনালাভের প্রয়াস। (মুভ়িটা দেখলেই বুঝবেন গানের মাজেজা!)

এখানে গানটা পুরোপুরি ব্লুগ্রাস স্টাইলে গাওয়া হয়নি, কারণ একমাত্র সঙ্গত গীটার। সাধারণত ব্লুগ্রাস গানে গীটারের সাথে ব্যাঞ্জো, ফ়িড্ল, ম্যান্ডোলিন, স্ট্রিং বাস, ইত্যাদি জুড়ি থাকে। কিন্তু মুভ়িতে ক্লুনির কল্পিত ব্যান্ড সগি বটম বয়েজ় নামের সাথে প্রখ্যাত ব্লুগ্রাস ব্যান্ড ফ়গি মাউন্টেইন বয়েজ়ের সুস্পষ্ট মিল। তিরিশ-চল্লিশের দশকে রেডিও আর গ্রামোফ়োন জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হওয়া শুরু করে যখন, তখন ১৯১৩তে লেখা এ গানটি আরো অনেকের পাশাপাশি ব্লুগ্রাস শিল্পীরাও রেকর্ড করেন। অধুনাযুগের সবচে’ খ্যাতিমান ব্লুগ্রাসগায়ক রাল্ফ় স্ট্যানলিও এটা গেয়েছিলেন, অ্যালিসন ক্রাউসও। সুতরাং ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র ব্লুগ্রাস যোগাযোগ অনস্বীকার্য।

কিভাবে ব্লুগ্রাসের উৎপত্তি হলো, সে কাহিনী ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মতই মর্মস্পর্শী। আমেরিকায় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত দাসত্বপ্রথা ছিল সে আমরা ভালমতই জানি। যেটা অত ভালমত জানি না, সেটা হলো একই শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ কিভাবে একরকম দাস হিসাবেই মার্কিনে এসেছিল। এখনকার ভাষায় এদেরকে বলে ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট, বা চুক্তিবদ্ধ চাকর।

ইউরোপীয় জাহাজী আর দালালের দল ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের সহায়সম্পত্তিহীন কর্মক্ষম মানুষ পেলে তাদেরকে নতুন বিশ্বের উন্নত জীবন আর সুযোগের কথা দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে চুক্তিনামায় সই করাত, তারপর আমেরিকায় এনে টাকার বিনিময়ে তুলে দিত তাদের মালিকের কাছে। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে পরপর কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কারণে জীবন বাঁচাতে গরিবদের চুক্তিস্বাক্ষরব্যতীত আর তেমন কোন উপায় ছিল না। চুক্তি অনু্যায়ী যতদিন না সেই চাকর গতর খেঁটেই হোক আর অন্য কোনভাবে হোক, অন্তত তার জাহাজভাড়া না পরিশোধ করছে, ততদিন সে মালিকের আজ্ঞাবাহী। যদি পালায় তো কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মতই তাকে খুঁজে বের করে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম

তো, এসকল দরিদ্র শ্বেতাঙ্গরা মুক্তির ঋণ পরিশোধ করার পরে যে সাথে সাথে সমৃদ্ধি, জমিজমা পেয়ে যেত, তা নয়! উত্তরের তেরো কলোনির অধিকাংশ ইতিমধ্যে জনবহুল হয়ে গেছে, জায়গাজমির মালিকানা দলিল-দস্তাবেজ হয়ে গেছে। অতএব এরা সুযোগের সন্ধানে যাওয়া শুরু করে দক্ষিণের কৃষিকাজনির্ভর স্টেটগুলিতে। আপালাচিয়ার দক্ষিণাংশের কেন্টাকি, টেনেসি, জর্জিয়া ইত্যাদি স্টেটে কাজ পায় অনেকে। কিন্তু জমির মালিকানা যারা খুঁজছিল, তাদের জন্যে বাকি ছিল অনূর্বর পাহাড়ী জমি। সেসবেই কোনরকমে বসতি গেঁড়ে সাবসিস্টেন্স ফার্মিং আর শিকার করে জীবননির্বাহ শুরু করে তারা।

আর যাদের এতে মন ভরলো না, তারা আর তাদের বংশধরেরা কাউবয়-আউটল’ হিসাবে গিয়ে হাজির হল ওয়াইল্ড ওয়েস্টে। কখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায়, কখনো সরকারের আইনি বিরোধিতা গায়ে না মেখে, নেটিভ আমেরিকানদের হটিয়ে নিজেরাই নিজেদের জায়গা করে নিল। কেউ কেউ ওরেগন ট্রেইলের পাইওনিয়ারদের পথ অনুসরণ করে পশ্চিমের স্টেটগুলিতে হাজির হয়ে গেল।

যারা আপালাচিয়াতে রয়ে গেছিল, অতীতের দারিদ্র্য, স্বল্পশিক্ষা, বর্ণবাদ আর কুসংস্কার এখনো তাদেরকে ছাড়েনি। গৃহযুদ্ধের সময়ে এরা দাসপ্রথার রক্ষক কনফ়েডারেট সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, কারণ কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্তি পেলে তাদের সীমিত জীবিকায় ভাগীদার বাড়বে। যারা জমির মালিকানাহীন কুলি ছিল তাদেরকে ডাকা হত পো’বয় (পুওর বয়) নামে, ক্রীতদাসদের মত তাদেরও ভোটাধিকার দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ছিল না। সে আইনের পরিবর্তন হয় গৃহযুদ্ধে ফ়েডারেল সরকারের জয়লাভের পরে।

হিলবিলি আর রেডনেক নাম দিয়ে অন্যান্য শিক্ষিত সাদারা এদেরকে এখনো কটাক্ষ করে। এদের ভুল বানান, অদ্ভূত উচ্চারণ, কাজ়িন বিয়ে করার রীতি, তাপ্পিমারা পোশাক, আর ঘরে বানানো মদের বোতল সত্তর-আশির দশকেও চলচ্চিত্রে দেখানো হত তাদের স্টেরেওটাইপ বুঝানোর জন্যে। ডেলিভ়ারেন্স মুভিটা দেখতে পারেন উদাহরণ হিসাবে। বলতে পারেন, এধরনের স্টেরেওটাইপিংও একরকম রেসিজ়ম, আর তা না হলেও অনেক নিচু চোখে দেখা। আবার আপালাচিয়ার ধনাঢ্য সাদা চাষী আর ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতিতে ঢুকত, তারা সরল হিলবিলিদের বর্ণবাদ আর অন্যান্য ভয়-বিদ্বেষ উস্কে দিত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্যে। এ কৌশল এখনও খাঁটে।

আইনকানুন মানার ব্যাপারেও হিলবিলিরা একটু অমনোযোগী, আর একরোখা-স্বাধীনচেতা হওয়ায় ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মত ট্রাবলে জড়াতেও সময় লাগে না। দক্ষিণের স্টেটগুলির কড়া আইন অনেকের জীবনে একবার এসে ধরলে বাকি জীবন পিছে লেগেই থাকে।

বুঝতে পারছেন, এ যুগে এরাই সম্ভবত আদর্শ ট্রাম্প সাপোর্টার! অপরদিকে রাল্ফ় স্ট্যানলির মত নামীদামী শিল্পীরা কখনোই রাজনীতিতে ঝোঁক দেখাননি!

ব্লুগ্রাসের সুরের পিছনে এখনো ফ়োক ইংলিশ কিংবা আইরিশ-স্কটিশ একটা ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। ফ়িডলের দ্রুত তালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের জিগসরীলসের ছন্দের প্রভাব রয়ে গেছে। খুব দ্রুততার সাথে কর্ড পরিবর্তন করার জটিল ইমপ্রোভ়াইজ়েশনও ব্লুগ্রাসের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এমনকি, যতই বর্ণবাদী বলি না কেন হিলবিলিদের, কৃষ্ণাঙ্গদের ব্লুজ়-জ্যাজ় থেকে তারা অনেক কিছু শিখে মিলিয়ে নিয়েছে ব্লুগ্রাসের মধ্যে। বিষয়বস্তুর মধ্যে বিয়োগবেদনার পাশাপাশি রয়েছে অতীতের স্মৃতিচারণ, পূর্বপুরুষদের বীরত্বের জয়গাঁথা, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে বাকবিতন্ডা বা মারামারির উপাখ্যান, কিংবা বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আক্ষেপ-ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আর সর্বোপরি, গ্রাম্য আপালাচিয়ার সীমিত জীবিকা আর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনের কঠিন চিত্র।

ব্লুজ়ের মধ্যে যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের জাতিগত বেদনার স্মৃতি রূপান্তরিত হয়ে গেছে সার্বজনীন একটা আবেগপ্রবণতায়, আমি বলবো সেরকম ব্লুগ্রাসও শ্বেতাঙ্গ খেঁটে-খাওয়া মানুষের শ্রেণীগত আশা-নিরাশা-বীরত্ব-ভয়-সুখ-দুঃখ ইত্যাদির ভাবপ্রবণ সরল অভিব্যক্তি।

আশা করি তুলনামূলক স্বল্পপরিচিত একটি মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতিকে কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পেরেছি, আর পাঠকরা সামান্য হলেও এদের সহমর্মী হতে পারছেন। ও হ্যাঁ, ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ — দেখতে ভুলবেন না!

ইউ পম গানা?

Featured Video Play Icon

“ইউ পম গানা?” মনে আছে নিশ্চয় অনন্ত জলিলের সেই ইন্টারভিউটার কথা? ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিংবা ‌অবচেতন মন থেকে হোক, জলিল সাহেব হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে বাঙ্গালীর বর্ণবাদী মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন।

বাঙ্গালী কতটা-কেন কৃষ্ণাঙ্গদের নিচুচোখে দেখে — সেটা নিয়ে বিতর্ক-গবেষণার অবকাশ আছে। হয়ত সুলতানি আমলে হাবশি ক্রীতদাসদের কূটচালে রাজা হওয়া দেখে প্রাথমিক খারাপ ধারণাটা তৈরি হয়েছে। তারপরে সম্ভবত ব্রিটিশ শাসকদের মাংকি-সী-মাংকি-ডু করে আফ্রিকানরা নিম্নগোত্রীয়, এই বিশ্বাসটা প্রগাঢ় হয়েছে। দ্য গডস্ মাস্ট বি ক্রেজ়ির মত ছবি আমার ছোটবেলায় সেই বিরূপ ধারণা ভাঙতে খুব একটা সাহায্য করেনি। (এর বিপরীতে অবশ্য ছিল কিং সলোমন’স মাইনসএর মত রোমাঞ্চকর উপন্যাস!)

আজকের ট্র্যাকটা পছন্দ করলাম বাঙ্গালী স্টেরেওটাইপিংটাকে যদি কিছুটা নড়বড়ে করে দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যে। গানের কণ্ঠশিল্পী ভ়িও ফ়ার্কা তুরে মালির অধিবাসী। বাবা আলি ফ়ার্কা তুরেও ছিলেন বিশ্বখ্যাত মিউজিশিয়ান। বিশ্বের কাছে মালির ট্র্যাডিশন্যাল গানবাজনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পিছনে তুরে সিনিয়র আর সিদকি ও তুমানি দিয়াবাতে বলে পিতা-পুত্র ‘কোরা’-বাদকের অনেক অবদান আছে।

যারা মার্কিন ব্লুজ় শুনেছেন, বিশেষ করে জন লী হুকারের গান, তারা এটা শোনামাত্রই বুঝবেন কতটা মিল! এর কারণ পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সাথে এই ধরনের সঙ্গীত আমেরিকায় আসে। তাদের সুরগুলি গীটারের জন্যে খুবই মানানসই ছিল। নতুন দেশে নিজেদের ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেললেও তারা সঙ্গীতকে হারায়নি।

এ ঐতিহ্য পশ্চিম আফ্রিকায় এক-দুই শতাব্দীর পুরনো নয়, কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর ধরে তারা সভ্যতার সাথে পরিচিত। মালির জেন্নে শহরে ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নগরসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতার মত নদীতীরে গড়ে উঠেছিল; সে নদীর নাম নিঝ়ের বা নাইজার — যার নামে নিঝ়ের ও নাইজেরিয়া দেশদু’টির নাম। আরবরা এই নদীর ডাকনাম দিয়েছিল ‘কৃষ্ণাঙ্গদের নীলনদ’।

অনন্ত জলিল যে গানা দেশটার নাম আমাদের কাছে সুপরিচিত করলেন, সেটা আসলে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান একটা শক্তিশালী সাম্রাজ্যের নাম। ব্রিটিশ ঔপনেবিশকতা থেকে সর্বপ্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত আফ্রিকার স্বর্ণসমৃদ্ধ দেশটির নাম গোল্ড কোস্ট থেকে পরিবর্তন করে রাখা হয় গানা। অষ্টম শতকে আরবরা উত্তর আফ্রিকাবিজয়ের পরে তাদের বাণিজ্যের কাফেলা সাহারার দক্ষিণেও বিস্তৃত হয়েছিল। গানা সাম্রাজ্যের শহরগুলি এ সময় ছিল সোনা-লবণ রপ্তানির মূল কেন্দ্র। গানার শাসকরা পরে ইসলামগ্রহণ করে নিজেদের রাজবংশকে আরো বৈধতা দেয়। তা হলেও অনেক প্রাক-ইসলামিক নিয়ম রয়ে গেছিল। যেমন মাতৃবংশীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থা, যে কারণে এক রাজার পরের রাজা হত তার ভাগ্নে, ছেলে নয়!

গানা সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পরে সেখানে অভ্যুদয় ঘটে মালি বা মান্দে সাম্রাজ্যের। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর এ রাজ্য সমৃদ্ধির শিখরে ছিল মোঙ্গলদের পরেই সেসময়ের সবচে’ বিস্তৃত সাম্রাজ্য। ইবনে খালদুন-ইবনে বতুতা মালি ভ্রমণের সময় তাদের বিপুল সামরিক লোকবল দেখে যেমন অভিভূত হয়েছিলেন, তেমনি অবাক হয়েছিলেন নারীপুরুষের একত্রে ওঠাবসা দেখে। মালির এক রাজা, বা মান্সা, মুসা কেইতা হজ্জ্বে গিয়েছিলেন বিশাল দলবল আর প্রচুর সোনা নিয়ে। তিনি যাত্রাপথে যেখানেই থেমেছেন সেখানেই বিলাসদ্রব্য কিনতে, এমনকি ভিক্ষা দিতেও, সোনা ব্যয় করেছিলেন। তাতে তখনকার পৃথিবীর সোনার সাপ্লাই রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বারো বছর ধরে নাকি সোনা অবমূল্যায়িত ছিল! মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়রাও এই কাহিনী অবগত ছিল, তাই তাদের তৈরি মানচিত্রে তিম্বাক্তু শহরের অবস্থান দেখানো শুরু হয়।

মালি সাম্রাজ্য স্থাপত্যশৈলী আর জ্ঞানবিজ্ঞানেও এগিয়ে ছিল। তাদের তৈরি অসাধারণ মসজিদ-মাদ্রাসা-মিনারগুলি এখনো তিম্বাক্তু, গাও শহরে দেখা যায়। সাঙ্কারে বলে এক মাদ্রাসায় গোটা বিশ্ব থেকে মনীষীরা আসতেন জ্ঞান আদান-প্রদানের জন্যে। মিশরের প্রাচীন আলেকজ়ান্দ্রিয়া লাইব্রেরির সাথে টেক্কা মারার মত পান্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল সেখানে।

মালি সাম্রাজ্যের অবনতির কারণ ছিল তাদের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, যেটার সুযোগ নিয়ে পড়শী সঙায় সাম্রাজ্য তাদেরকে পরাজিত করে। সেই যুদ্ধে মালির শাসকরা নব্য পরাশক্তি পর্তুগীজদের সাহায্য চেয়েছিল। জেনে হয়ত অবাক হবেন যে ইউরোপীয়রা সাম্রাজ্যবিস্তারের সুযোগটা তখন নেয়নি, তারা এটাকে মালির আভ্যন্তরীণ সমস্যা ভেবে পাশ কাটিয়ে গেছিল। অবশ্য সমুদ্রউপকূলে পর্তুগীজদের কেল্লা ছিল, সেসব থেকে তারা ইউরোপে ক্রীতদাস রপ্তানি করত। তাদেরকে লোক্যাল সাপ্লাই দিত কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ দালালরাই!

মালির পরে সঙায় সাম্রাজ্য বেশিদিন টেকেনি। পর্তুগীজ নয়, মরক্কোর সুলতানের পাঠানো সেনাবাহিনীর গোলন্দাজদের কাছে তারা হার মানে। সেই পরাজয়ের পরে গোটা সাম্রাজ্য ভেঙে অসংখ্য টুকরো হয়ে যায়, যারা নিজেদের মধ্যে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করে। ঊনবিংশ শতকে ফরাসীরা এদেরকে বশে এনে উপনিবেশ বানায়। তারপর ষাটের দশকে একে একে অনেকগুলি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। গানা, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মরিতানিয়া, গিনি, গিনি-বিসাউ, বুরকিনা ফাসো, নাইজেরিয়া, নিঝ়ের — এদের সকলেই গানা-মালি-সঙায়দের প্রাচীন ঐতিহ্যের দাবিদার।

‘পম গানা?’ প্রশ্নের উত্তর একটু লম্বা-চওড়া হয়ে গেল, অতএব ক্ষান্ত হলাম!
***

[সাফারে গানটার বিষয়বস্তু অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও বের করতে পারিনি। ফরাসী কোন ওয়েবসাইটেও লিরিক-ট্রান্সলেশন নেই। ইচ্ছে ছিল এ‌ই গানটার বদলে আলি ফ়ার্কা তুরের ‘আল্লা উইয়া’ গানটা শেয়ার করার, কিন্তু সেটার কোন লাইভ পারফর্ম্যান্স পেলাম না। লাইভে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যেভাবে দেখা যায়, স্টুডিও রেকর্ডিংয়ে সেটা সম্ভব নয়। আগ্রহী হলে এখানে শুনুন ‘আল্লা উইয়া’।]

সাহারার তুয়ারেগ

Featured Video Play Icon

উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরোক্কো — এই দেশগুলিকে আমরা জানি আরব-অধ্যুষিত হিসাবে। কিন্তু এই এলাকার আদিবাসীরা আরব নয়, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানও নয়। গ্রীক-রোমান-যুগ থেকে তাদেরকে ভিনদেশীরা চেনে ‘বেরবের’ নামে; যদিও তারা নিজেদের বলে ‘আমাজ়িগ’ — যার অর্থ মুক্ত মানুষ। এখন মূলত আরবী বা ফরাসীতে কথা বললেও উপরের দেশগুলির একটা বড় জনসংখ্যা বেরবের।


জ়িনেদিন জ়িদানের বাবা-মা আলজেরিয়ার কাবিল উপজাতির আমাজ়িগ। মরোক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতাও ছিলেন আমাজ়িগ বংশোদ্ভূত। খ্রীষ্টান সেন্ট অগাস্টিনও তাই। রোমসম্রাট সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের ধমনীতেও ছিল বেরবের বংশধারার রক্ত। রোমের সৈন্যদলের একটা অংশও একসময় ছিল বেরবের মাউরি যোদ্ধাদের দিয়ে তৈরি, যাদের নাম থেকে পরে মুর বা মোরো শব্দটা এসেছে।


তারিক ইবনে জ়িয়াদ ছিলেন আরব-বিজিত ইফ্রিক্বিয়া (এখনকার তিউনিসিয়ায়) প্রদেশের গভর্নর মুসা ইবনে নুসাইরের ক্রীতদাস। জ়ানাতি বেরবের বংশে তার জন্ম, তাঁকে মুক্তিদানের পরে অষ্টম শতকে আরব-বেরবের সৈন্যদল নিয়ে উমাইয়্যা খলিফাদের হয়ে স্পেনবিজয় করেন। তার নামেই জিব্রাল্টার (জাবাল-আল-তারিক)।


স্পেনের দ্বাদশ শতাব্দীর রাজবংশ আলমোহাদ-আলমুরাবিতরা ছিল আরবীকৃত বেরবের। এসময় স্পেনের জামিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউরোপীয়রা দর্শন-বিজ্ঞানের শিক্ষা পেয়েছে মাইমোনিডিস-ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের মত মনীষীদের লেখা পড়ে। আলহামরা প্রাসাদের মুরিশ শিল্পশৈলী বেরবের-আরবদের যৌথ অবদান। আরব-বেরবের রান্নাও বিশ্বখ্যাত, যেকোন মরোক্কান রেঁস্তোরাতে সেটা আস্বাদন করতে পারবেন।


উমাইয়্যা আরব শাসনের সময় এই মুক্ত জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে আরবী কৃষ্টি আর অনারব দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে ফরাসী-ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী চাপিয়েছে ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতি। প্রতিবারই তারা বিদ্রোহ করেছে।


নিচের গানটা তু্য়ারেগ নামে আমাজ়িগদের একটা বড় উপজাতির শিল্পীদের গাওয়া, সাথে মার্কিন ব্লুজ মিশানো, মালির কৃষ্ণাঙ্গ ঘরানারও প্রভাব আছে। দলটার নাম তিনারিওয়েন, গানের ভাষা তামাশেক। তুয়ারেগদের বাস আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, মালি, নিঝ়ের, বুরকিনা ফাসোর দেশসীমাবিহীন সাহেল নামে সাহারা মরুভূমির পশ্চিমাংশে। যাযাবর এই গোত্রের অন্নসংস্থানের উপায় গোচারণ আর ‘সাবসিস্টেন্স ফার্মিং’।


তিনারিওয়েনের সদস্যরা উত্তর মালির সাহারার বাসিন্দা। ষাটের দশকে মালি স্বাধীন হবার সময়ে তামাশেকরা চেয়েছিল নিজেদের জন্যে আলাদা দেশ — আজ়াওয়াদ। তার পরিবর্তে সোভিয়েত-সমর্থিত মালির কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান একদলীয় শাসকরা তুয়ারেগদের অধিকার পদদলিত করার ফলে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রাণ হারায় অনেক নির্দোষ তুয়ারেগ, গৃহহারা হয় আরো অনেক।


এই গানটার ভোক্যাল ইব্রাহিম আগ্ আলহাবিবের চার বছর বয়সে তার বাবা সেই বিদ্রোহে প্রাণ হারায়। পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে এই এতিমরা ঘুরে বেড়ায় আলজেরিয়া-লিবিয়ার এক রেফ্যুজি ক্যাম্প থেকে আরেকে। গীটার শিখে পশ্চিমাগানের সাথে তুয়ারেগ সঙ্গীত মিলিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সাথে সাথে হাতে অস্ত্রও তুলে নেয় নব্বইয়ের দশকের আরেক বিদ্রোহে। ২০০০এর দশকেও আরেকটা বিদ্রোহ হয়। এরপরে একটা শান্তিচুক্তির ফলে তুয়ারেগদের অধিকার মালিতে মোটামুটি স্বীকৃত এখন। এই শান্তিচুক্তির পিছনে তিনারিওয়েনের মত দলের সাংস্কৃতিক গ্লোবাল আউটরীচের অবদান অনেক বড়।


তারপরেও ইউরেনিয়ামের মত খনিজ পদার্থ সংগ্রহ আর খরা-মরুকরণের ফলে চাষের সামান্যতম জমি ধ্বংস হওয়ায়, আর অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে, দরিদ্র সুন্নি সুফীমতানুসারী তুয়ারেগদের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক অভিযোগ আর কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে ফেরত সালাফী ইসলামী জিহাদীরা গাদ্দাফীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত-অস্ত্রসজ্জিত স্বাধীনতাকামী তুয়ারেগদের সাথে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে আরেকটা বিদ্রোহ করে, যার ফলে ঘরবাড়ি ছাড়া হয় ৬ লাখ মূলত তুয়ারেগই।


সেসময় ইসলামী কট্টরপন্থীরা মালির ঐতিহাসিক তিমবাক্তু শহর দখল করে নেয়, ‘শরিয়া আইন’ চাপিয়ে দেয় আর শহরটির ইউনেস্কোচিহ্নিত ঐতিহ্যবাহী মসজিদ-মিনার-মাজার এগুলোর ধ্বংসসাধন করে। ২০১০এ দক্ষিণ আফ্রিকার ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গানপরিবেশনকারী তিনারিওয়েনের এক সদস্যকেও তারা গ্রেফতার করে নির্যাতন করে আর গানবাজনা বন্ধ করে দেয়। ফরাসী সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মালির সরকার অবশেষে এদের হটাতে সমর্থ হয়। আর আজ়াওয়াদপন্থী স্বাধীনতাকামীরাও দল বদলে মালির সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এখনো মালিতে ফরাসী আর নিঝ়েরে মার্কিন সৈন্য আছে এসব দুর্গম অঞ্চলে জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রাখার জন্যে।


এই গানটিতে দেখবেন মুসলিম তুয়ারেগ পুরুষদের মুখ ঢাকা, কারণ তাদের আদি ঐতিহ্যে নারী নয়, পুরুষরাই মুখ ঢাকে! তুয়ারেগ নারীরা মাথায় কাপড় দিলেও সাধারণত পুরো মুখমন্ডল আবৃত করে না, আর সকল ধরনের কর্মকান্ডে সমান অংশগ্রহণ করে। অতীতের কোন এক সময় তুয়ারেগ পরিবারব্যবস্থা মাতৃকুলভিত্তিক ছিল বলেই নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা। এই গানে তেনেরে বলে সাহারার এক এলাকার অপার্থিব সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে মরুবাসী তুয়ারেগের অসহায়ত্ব বর্ণিত হয়েছে দুই শব্দে — আমান ইমান, পানিই জীবন।

গানের কথা আর অর্থ এখানে পাবেন।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!