কামার ও শয়তান – ২

(প্রথম পর্বের পর)

প্রস্তরযুগের মানুষের বিবর্তনের কথা বলেছি এর আগে। সেসাথে আগুনের আবিষ্কারের ফলাফল। আগুনের পরপরই সম্ভবত ধাতুকার্যের কাকতালীয় আবিষ্কার।

প্রস্তরযুগ আর তাম্রযুগের মাঝের যুগটাকে বলে ক্যালকোলিথিক। এসময় তামা মেশানো পাথর বা আকরিক দিয়ে অস্ত্র আর যন্ত্রপাতি বানানো হত। হয়ত এরকম কোন আকরিক পাথর আগুনের কুন্ডলীতে ফেলার পর সেটা গলে পরিশুদ্ধ ধাতু হয়ে বেরোয়। ক্যাম্পফায়ারের তাপমাত্রা খুব বেশি নয়, হয়ত কোন বিশেষ ধরনের চুলোর মধ্যে অত্যধিক তাপমাত্রার কারণে এই আকস্মিক আবিষ্কারটি হয়।

আবিষ্কারটি প্রথম যারা করেছিল, তারা ওয়াকিবহাল ছিল এর তাৎপর্য সম্পর্কে। ধাতু পাথরের থেকে কয়েক গুণ বেশি শক্ত আর গলিত অবস্থায় বিভিন্ন আকার দেয়া যে যায় তাকে, তারা সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে কারণে যে খনি থেকে তামার আকরিক পেয়েছে, সেখানে তারা ফিরে গেছে আরো সংগ্রহের জন্যে। তারপর আরো গবেষণা করে জ্ঞানটাকে মোটামুটি পাকাপোক্ত করেছে।

আর এরা জ্ঞানটা গোপন রেখেছে অন্যান্যদের কাছ থেকে। ইন ফ্যাক্ট, এই প্রাচীন কামারদের কাছে এটা বিজ্ঞান নয়, প্রকৃত অর্থেই জাদুবিদ্যা ছিল। কারণ কখনো কখনো ঠিক তাপমাত্রায় চুল্লী গরম রাখতে না পারলে পুরো কাজটা যেত ভেস্তে। তাই মন্ত্রপাঠ আর দেবপূর্বপুরুষদের পূজোর দরকার হয়ে পড়ত বৈকি। আবার কখনো পশু কিংবা নরবলিরও!

এই যে তামা কিংবা তামার সাথে টিন মিশিয়ে আরো শক্ত ব্রোঞ্জ তৈরির প্রণালী, এর আবিষ্কার কমপক্ষে আট হাজার বছর আগে। ওয়েলসের ক্লানদুদনোতে ৪,০০০ বছরের পুরনো বিশাল এক তামার খনি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেখান থেকে উত্তোলিত তামা পুরো মধ্যোপসাগরে রপ্তানি হত। অর্থাৎ ইতিমধ্যে ধাতুর খনন কুটিরশিল্প থেকে বৃহদশিল্পে পরিণত হয়েছে। এরকম আরেকটা জায়গা বর্তমান সাইপ্রাস, যার নামের মধ্যেই রয়েছে ‘কপার’ (গ্রীকে ক্যুপ্রোস, তুর্কীতে কিবরিস)। প্রাচীন মিশর-তুরস্ক-গ্রীসের ব্রোঞ্জশিল্পের তামার আদি উৎস এই সাইপ্রাস।

ওয়েলসের ক্লানদুদনোর গ্রেট ওর্ম কপার মাইনস। ৪,০০০ বছর আগে এখানে খনিতে কাজ শুরু হয়। ম্যালাকাইট নামের আকরিক উত্তোলনের পন্থা ছিল পশুর হাড় আর পাথরের হাতুড়ি দিয়ে খনির দেয়াতে ক্রমাগত ঘা মারা।
সাইপ্রাসের স্কুরিওতিসার তামার খনি বিশ্বের প্রাচীনতম। ৪,০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে এখনও পর্যন্ত এখানে তামা উত্তোলন চলছে।

ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের পরে কর্মকারদের সৃজনশীলতা তুঙ্গে ওঠে। খোদার ওপর খোদকারি করে নানা জন্তু-জানোয়ার, মানুষ, বস্তু, এমনকি দেবদেবীর নিখুঁত মূর্তি পর্যন্ত তারা বানিয়ে ফেলতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে এ বিদ্যা জাদুটোনার থেকে কম কিছু ছিল না। শিকারী কিংবা কৃষকের কাছে খনির গভীর অন্ধকারে ঢুকে পাথর খোঁড়া ছিল রহস্যময় একটা ব্যাপার। সে ‘পাথর’ যে চুল্লীতে ঢুকে নতুন সৃষ্টি হয়ে বেরিয়ে আসছে, এটাও অলৌকিক শক্তির লক্ষণ। শয়তান বা অশুভ আত্মাকে যদি কেউ নাকানি-চুবানি দিতে পারে, তো সে এই ধূর্ত কামারই। ‘কর্মকার’ মানেও আসলে ‘স্রষ্টা’।

ব্রোঞ্জ আমলের কামারদের অবশ্য অনেক পেশাগত ঝুঁকি ছিল। তামা-টিনের খনিতে মিশ্রিত থাকে বিষাক্ত আর্সেনিক ও সীসা। এ বিষের সংস্পর্শে এসে শারীরিক ও মানসিক বৈকল্য দেখা দিত তাদের। এ কারণেই হেফেস্টাস ল্যাংচা, পাগলা, বেঁটে। হয়ত আয়রিশ লোককথায় ডয়ার্ভস কিংবা বামনদের সাথে খনি ও ধাতুবিদ্যার রহস্য জড়িত এ কারণেই।

১৫৫০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে সোনার তৈরি মাস্ক অফ আগামেমনন। ট্রয়ের আবিষ্কর্তা হাইনরিষ শ্লীমান মাইসেনির ধ্বংসাবশেষে এটি খুঁজে পান। তিনি ভেবেছিলেন ইলিয়াডের আগামেমননের সমাধি খুঁজে পেয়েছেন। ব্রোঞ্জ যুগের অসাধারণ ধাতবশিল্পের প্রমাণ এটি।

ব্রোঞ্জের পর লৌহযুগের শুরু হয় প্রায় ২,২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। এ ছিল আরেক অসম্ভব ব্যাপার। সাধারণ ক্যাম্পফায়ারে ৪০০ ডিগ্রিরই বেশি তাপমাত্রা ওঠে না, আর লোহার গলনাংক ১,৪০০-১,৫০০ ডিগ্রি। অর্থাৎ লোহা গলানোর জন্যে দরকার হয়ে পড়ে বিশেষ ধরনের চুল্লি। তাছাড়া কাঠকয়লারও দরকার পড়ে আকরিককে পরিশুদ্ধ করার জন্যে। কখনো কখনো পশুর হাড়গোড়ও চুল্লিতে ফেলত কামাররা, এতে অর্গানিক কার্বন মিশে লোহাকে আরেকটু মজবুত করত। স্টীলের রহস্য ঠিক তাই। সাধারণ মানুষ অবশ্য এর উসিলায় ‌গুজব রটাত যে কামাররা চুল্লীতে নরবলি দেয়। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

ইতিহাসের সবচে পুরনো লোহার তৈরি অস্ত্র পাওয়া গেছে তুরস্কের প্রাক-হিট্টাইট হাট্টিয়ান কালচারে। এ অসম্ভব না যে, এদের উত্তরপূর্বের পন্টিক স্তেপের আদি ইন্দোইউরোপীয়রাই লোহা বিশুদ্ধকরণ প্রণালী প্রথম আবিষ্কার করে। মিশরে অবশ্য এর থেকেও পুরনো লোহার তৈরি ছুরি আবিষ্কৃত হয়েছে, তুতানখামুনের সমাধিতে। কিন্তু সেটা পৃথিবীর লোহা নয়, উল্কার লোহা! অর্থাৎ তার বিশুদ্ধিকরণের তেমন কোন প্রয়োজন ছিল না। মোটামুটি একটা উচ্চ তাপমাত্রায় নিয়ে পিটলেই হলো।

১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বে ডেনমার্কে ব্রোঞ্জের তৈরি এই সূর্যরথ। সূর্যদেবতাকে প্রতি ভোরে ঘোড়ায় টানা এ রথ টেনে তোলে। ঋগ্বেদসহ সকল ইন্দো-ইউরোপীয় মিথে প্রায় একই মোটিফের ছড়াছড়ি।
৩৭০০-৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বে ককেশাসে মাইকপ কালচারের মানুষ ব্রোঞ্জ দিয়ে এই ষাঁড়টি বানায়। পন্টিক স্তেপের ইন্দোইউরোপীয়দের সরাসরি দক্ষিণের পড়শী ছিল এরা। দু জাতের মধ্যে প্রযুক্তি আদানপ্রদান হওয়ারই কথা।
২৩০০-২০০০ খ্রীষ্টপূর্বের আনাতোলিয়ার হাট্টিয়ান কালচারের মানুষ ব্রোঞ্জে তৈরি করেছে এই জোড়া ষাঁড়।
১৭০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্বে ডেনমার্কে তৈরি হয়েছিল ব্রোঞ্জের এই শিরোস্ত্রাণ।

লৌহযুগের আগমনের সাথে সাথে অস্ত্রশস্ত্র বানানোতে একটা বিপ্লব শুরু হয়ে যায়। ভাল কামাররা তরবারি তৈরির প্রক্রিয়াকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব ‘অলৌকিক’ তরবারিকে নাম দিলে তার জাদুশক্তি আরো কয়েকগুণ বাড়ত। সেই থেকে আর্থারের এক্সক্যালিবার, রোলাঁর দ্যুরন্দাল, শার্লমেনের জোয়াইওজ, সিগুর্দের গ্রাম, বেওউল্ফের হ্রুনটিং, আলীর জুলফিকার, ইত্যাদি।

এদের সাথে যোগ করতে পারি বর্তমান যুগের ‘রূপকথা’ লর্ড অফ দ্য রিংসের দুটো ধাতব জিনিস। ওয়ান রিং — যার মধ্যে রয়েছে সারা বিশ্বের ক্ষমতালাভের শক্তি। আর নারসিল, যে তরবারি দিয়ে সাউরনের হাত বিচ্ছিন্ন করে ফেলে ইসিলদুর। ভেঙে যাওয়া নারসিলের ধাতু গলিয়ে তৈরি হয় নতুন তরবারি আন্দুরিল। আর ধাতুবিদ্যায় শ্রেষ্ঠ গিমলির জাত ডয়ার্ফরা। তাদের আবাস পাহাড়ের গভীরের খনিশহরে।

তুতানখামুনের সমাধিতে পাওয়া মিটিওরিক আয়রনের তৈরি ছুরি, ১৩২৩ খ্রীষ্টপূর্ব, ব্রোঞ্জ যুগ চলছে তখনও।
শার্লমেনের তরবারি লা জোয়াইয়োজ। লেজেন্ডারি এই তরবারি নাকি আরো আদি রাজা রোলাঁর দ্যুরন্দালের ধাতু গলিয়ে তৈরি। ফরাসী রাজাদের রাজ্যাভিষেকে দ্বাদশ শতক থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে।
লর্ড অফ দ্য রিংসে ভেঙে যাওয়া তরবারি নারসিলের ধাতু গলিয়ে তৈরি এল্ফরা আরাগর্নের জন্যে তৈরি করে নতুন আরেক তরবারি আন্দুরিল।

যাক গে, রূপকথা থেকে বহু দূরে সরে এসেছি। কামার ও শয়তান রূপকথাটির একটা মোরাল বা নীতিকথা অবশ্য আছে। ফাউস্টের মত বিদ্বান ব্যক্তিরা, যারা কিনা কামারের উন্নত সংস্করণ, তারা নিজেদের আত্মা বিকিয়েছেন জাগতিক অলৌকিক ক্ষমতার বিনিময়ে। তারা বৈশ্বিক জ্ঞানকে প্রাধান্য দিয়েছেন ঐশ্বরিক জ্ঞানের ওপরে।

কামারদের চরিত্রটাও অনেকটা সেরকম। খোদার ওপর খোদকারির ব্যাপারটা বলেছি। তাছাড়াও সোনা-রূপা ইত্যাদি ধাতুর জাগতিক মূল্যটাই খালি বুঝতে পারে কামার। এখানেই তার ট্র্যাজেডি। ধূর্ত শয়তানকে ঠকিয়ে ইহলোক সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে পরলোকে স্বর্গ-নরক কোথাও ঠাঁই হয় না জ্যাক ও’ল্যান্টার্নের। এ কারণেই প্রাচীন গল্পটা পরবর্তীকালের খ্রীষ্টান ধর্মের লেজেন্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেছে।

আজকে অবশ্য আমরা এত কিছু গবেষণা করে বের করতে পারছি কামারের মতই প্রযুক্তির ম্যাজিক খাঁটিয়ে। তেহরানি তার গবেষণায় যে খান পঞ্চাশেক ভাষার আড়াইশ’ রূপকথার প্রব্যাবিলিস্টিক অ্যানালিসিস করেছেন, তা সম্ভব হয়েছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের বদৌলতে। ঊনবিংশ শতকের গ্রিমভ্রাতৃদ্বয় জার্মানিতে, আর বিংশ শতকে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাদেশে বছরের পর বছর গবেষণা করে যে সব ইন্দোইউরোপীয় রূপকথার কাহিনী একে অন্যের সাথে যুক্ত করেছেন, সে কাজটা কম্পিউটারের বদৌলতে এখন কয়েক সপ্তাহের না হলেও মাস দুয়েকের ব্যাপার। তাই বলতে পারি, জয় হোক কামারের হাতুড়ি-নেহাই-হাঁপর-চিমটের। আর প্রোগ্রামারের মাউস-কীবোর্ড-মনিটরের।

সজ্ঞান সমাধিচর্চা

বিগত কয়েকটি পোস্টে বলছিলাম আদি মানুষের ধর্মবিশ্বাস আর কল্পনাশক্তির কিভাবে বিকাশ হল, তার একটা সম্ভাব্য কাহিনী। আগুনের আবিষ্কার সেই কাহিনীর কেন্দ্রবিন্দু।

অবশ্য আগুন এই প্রক্রিয়ার একমাত্র নিয়ামক হয়ত নয়, আর মানুষ এক-দুই জেনারেশনে হঠাৎ করে ‘মানুষ’ হয়ে ওঠেনি। লাখখানেক বছর তো লেগেছেই। কবে কিভাবে তার ঊর্বর মস্তিষ্কে প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের উদয়, তার সঠিক নির্দেশক নির্ধারণ করা কঠিন। কারণ মৌখিক ভাষা কোন ফসিল রেখে যায় না। ঠিক তেমন সঙ্গীতনৃত্য আর প্রার্থনারীতিরও কোন প্রত্যক্ষ নিদর্শন উদ্ঘাটন সম্ভব নয়।

সেকারণে নৃতত্ত্ববিদরা দু’ধরনের বাস্তব প্রমাণের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতার আরম্ভকাল নির্ধারণ করেন। পাথরের অস্ত্র যদি হয় মানুষের প্রযুক্তিগত বিবর্তনের প্রমাণ, তাহলে তার কল্পনাশক্তি বিকাশের প্রমাণ মেলে মূর্তশিল্পে আর সমাধিতে।

সেকারণে চারটি ছবি দিয়েছি। এগুলির তিনটি সভ্যতাপূর্ব মানববসতিতে প্রাপ্ত সমাধির চিত্র, আর একটির কথা পরে বলছি। ব্যাখ্যা করার আগে বলে নেই, এদের দু’টি শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়াম আর ওয়াশিংটনের স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্টরিতে প্রদর্শিত। একটি স্টকহোমের মিউজিয়াম অফ ফার ঈস্টার্ন অ্যান্টিকুইটিজে। আরেকটি জার্মানির উল্ম মিউজিয়ামে।

কোভিড মহামারিতে এসকল মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে রয়েছে বহুদিন। দর্শক সমাগম নেই। তাই আয়ের উৎস এদের সংকুচিত। ব্যয়বহুল রক্ষণাবেক্ষণ তো বটেই, যেসব গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এ সকল জাদুঘরের কর্মীরা দেশেবিদেশে করে থাকেন, সেগুলিও স্থগিত। যদি আপনি মিউজিয়াম ভালবাসেন আর মনে করেন যে ভবিষ্যত প্রজন্মের এসকল কাহিনী জানা জরুরী, দয়া করে নিচে দেয়া লিংকে গিয়ে ফীল্ড মিউজিয়ামে কিছু দান করুন। ১২০ বছর আগে শিকাগোর এক কোটিপতির অনুদানের মাধ্যমে মিউজিয়ামটির শুরু। এ মুহূর্তে ক্রাউডফান্ডিং ছাড়া এদের উপার্জনের খুব বেশি রাস্তা নেই।

শিকাগোর ফীল্ড মিউজিয়ামের মূল গ্যালারী।

মূল কথায় ফিরে আসি। ছবিতে দেখানো সমাধিগুলির প্রথমটি মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের। মৃতদেহটি মরুভূমির শুষ্ক আবহাওয়া আর ন্যাট্রন লবণের কারণে সম্ভবত প্রাকৃতিকভাবেই মামিতে পরিণত হয়েছে। সময়কাল প্রায় সাড়ে চার হাজার খ্রীষ্টপূর্ব, অর্থাৎ গিজার পিরামিডের থেকেও দু’হাজার বছরের পুরনো।

দ্বিতীয় ছবির কংকালটি আবিষ্কৃত হয়েছিল জর্দানের ডেডসীর কাছে বাবেজজারাতে। এটি সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। আর তৃতীয় ছবিটি আরো দূরের চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি। সেটাও প্রায় সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের।

মিশরের নাকাদা-বাদারি কালচারের সমাধি।
বাব-এজ-জারার প্রস্তরযুগীয় সমাধি।
চীনের বানপো গ্রামের প্রস্তরযুগীয় সমাধি।

তিনটি ভিন্ন স্থানের সমাধির ধরন প্রায় একই রকম। মাটিতে অথবা পাথরে ওভাল শেপের একটা গর্ত করে তাতে ‘ফিটাল পজিশনে’ (মাতৃগর্ভে যেভাবে থাকে শিশু) মৃতদেহটিকে শোয়ানা হয়েছে। মুখটা কোন বিশেষ দিকে ফেরানো। কোন ক্ষেত্রে সাথে দেয়া হয়েছে রঙীন নুড়ি, পাথরের অস্ত্র, আর মাটির পাত্রভরা খাবার। অর্থাৎ মানুষ ইতিমধ্যে পরকাল বলে একটা কিছু আছে সে বিশ্বাস করা শুরু করেছে। পরপারের যাত্রায় যা যা লাগতে পারে, তা প্রিয়জনের সমাধিতে দিয়ে দিয়েছে।

আজকের দৃষ্টিতে বিচার করলে মনে হতে পারে এ আর এমনকি ব্যাপার। কিন্তু মাথায় আবার প্রস্তরযুগীয় মস্তিষ্কটি ফিট করুন। কেন হঠাৎ করে মনে হলো আপনার, যে মৃতদেহটিকে সমাহিত করতে হবে, সাথে দিতে হবে প্রয়োজনীয় সব বস্তু? কেন অন্য জানোয়ারের মত মৃতদেহটি ফেলে রেখে চলে গেলেন না? আপনার পশুমনোবৃত্তিটির পরিবর্তন কেন কিভাবে হলো?

এই যে একে অন্যের জন্যে কেয়ার করার ব্যাপারটা, সেটা শিম্পাঞ্জি ছাড়াও অন্যান্য আরো কিছু প্রাণীর মধ্যে আছে, যাদের মধ্যে হাতিও পড়ে। আফ্রিকার হাতিরা নাকি মৃত্যুকালে তাদের ‘নির্ধারিত’ কবরস্থানে গিয়ে অপেক্ষা করে। বিপুলসংখ্যক হাতির কংকাল সেসব জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে। হতে পারে এর মধ্যে একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার রয়েছে। স্বল্প উন্নত মস্তিষ্কের প্রাণীও হয়ত বুঝতে পারে যে, মৃতদেহ পচনশীল, তার থেকে যে গন্ধ ও জীবাণু ছড়ায় তা জীবিতদের জন্য স্বাস্থ্যকর নয়।

এরকম ন্যাচারাল ইন্সটিংক্ট থেকে হয়ত প্রাচীন মানুষ মৃতদেহ কবর দেয়া শুরু করে। কুরআনে হাবিল-কাবিলের কাহিনীটাও অনেকটা সেরকম। কাবিল হাবিলকে হত্যা করার পর খোদার পাঠানো দাঁড়কাকের দেখাদেখি কবর খুঁড়ে ভাইকে সমাহিত করে। অর্থাৎ প্রকৃতি থেকে শেখার একটা ক্লু রয়ে গেছে গল্পটাতে।

তিনতোরেত্তোর ছবিতে হাবিল-কাবিলের কাহিনী, ১৫৫০-৫৩।

কিন্তু সমাধির সাথে সাথে অন্যান্য বস্তু দেয়ার চিন্তাটা কেন মানুষের মাথায় এল? উত্তর খুব সোজা। আদি মানুষ কল্পনার জগতে ভেবেছে তাদের পূর্বপুরুষেরা মৃত নয়, সীমানা পেরিয়ে অন্য একটি স্থানে প্রবেশ করেছে মাত্র। সেখানেও তাদের দৈহিক চাহিদা থাকবে। জীবিতদের দায়িত্ব সেসব পূরণের যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত করা।

আদিম মানুষ কবে থেকে সজ্ঞানে এ ধরনের সমাধি দেয়া শুরু করেছে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। ২০১৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাইজিং স্টার কেভ সিস্টেমে এক প্রাচীন প্রজাতির হোমিনিডের ফসিল আবিষ্কৃত হয়, যার নাম দেয়া হয় হোমো নালেদি। খননকার্যের এক পর্যায়ে কেভ সিস্টেমের খুব গভীরে আবিষ্কৃত হয় বেশ কয়েকটি দেহাবশেষ। সরু সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় এসকল মৃতদেহের এখানে এসে পড়াটা সহজ নয়। হিংস্র কোন প্রাণীও যে টেনে এনে এখানে ফেলবে তাও সম্ভব নয়। সব মিলিয়ে তিন লাখ বছরের পুরনো এই দেহাবশেষগুলিকে গুহার গভীরে ‘কবর’ দেয়া হয়েছে বলে কিছু নৃতত্ত্ববিদের ধারণা। এখনো এ নিয়ে বাকবিতন্ডা চলছে।

প্রস্তরযুগীয় ‘জার’ সমাধি, নিয়াহ কেভ, সারাওয়াক।

এর সাথে আবার মেলে মালয়েশিয়ার সারাওয়াকের গুহাবাসী হোমো সেপিয়েন্সদের সমাধি। এগুলি ‌অবশ্য তুলনামূলক নতুন, মোটে সাড়ে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বের। বাঁশের তৈরি ঝাঁকিতে করে ফীটাল পজিশনে বসিয়ে মৃতদেহ তারা রেখে আসত গুহার টয়াইলাইট জোনে, অর্থাৎ যেখানে আলোর শেষ আর আঁধারের শুরু। পরবর্তীতে যারা মারা যেত, তাদের কবর হত তাদের প্রয়াত পূর্বপুরুষদের সাথে। এভাবে পারিবারিক গোরস্তান গড়ে উঠেছিল গুহার অভ্যন্তরে। এই টয়াইলাইট জোনই হয়ত পরবর্তীকালের ধর্মবিশ্বাসের ‘পাতাল’ — আন্ডারওয়ার্ল্ড। স্বর্গ-নরকের থেকেও ‘পাতালের’ কনসেপ্ট বেশি পুরনো।

দেড় লাখ বছর আগের হোমো নেয়ান্ডারটালেনসিসের বিশাল এক বসতি ক্রোয়েশিয়ার ক্রাপিনাতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে বেশ কিছু সমাধিও রয়েছে। ৫২ হাজার বছর আগের একটি নেয়ান্ডারটাল কবরও ফ্রান্সে আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে নেয়ান্ডারটালের যথেষ্ট কল্পনাশক্তি ছিল কিনা তা নিয়ে এখনো বিতর্ক রয়েছে। এসব কবরে কোন সমাধিবস্তু পাওয়া যায়নি। একমাত্র ইরাকের শানিদার গুহায় নেয়ান্ডারটাল কবরে ফুলের পোলেন পাওয়া গেছিল, যদিও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পরে বলেছেন সেটি নাকি অন্য প্রাণীর কাজ।

ইজরায়েলের কাফজা গুহায় আবিষ্কৃত প্রস্তরযুগীয় দ্বৈত সমাধি।

সন্দেহাতীতভাবে সবচে’ প্রাচীন মানবসমাধি ৯২ হাজার বছরের পুরনো। ইজরায়েলের কাফজা গুহাতে মা-মেয়ের একত্রিত কবর আবিষ্কৃত হয়েছে। সমাধিদ্রব্য হিসাবে পাওয়া গেছে রঙকরা ফোঁড়া ঝিনুক, যেগুলি সম্ভবত সুতোয় বেঁধে গলায় নেকলেস হিসাবে পড়া হত। আরো পাওয়া গেছে রেড ওকার। একধরনের পাথর গুঁড়িয়ে এই রংটি তৈরি হত। গুহাচিত্রে যেমন এর ব্যবহার ছিল, তেমন সমাহিত মৃতদেহের মুখমন্ডল রঙীন করতেও। অর্থাৎ এ কবরটির নিঃসন্দেহে ‘কালচারাল রিচুয়াল’ তাৎপর্য রয়েছে।

প্রায় এক লাখ বছর আগে এদের হোমো সেপিয়েন্স পূর্বপুরুষ আফ্রিকা থেকে প্রথম মধ্যপ্রাচ্যে পদার্পণ করে। কিন্তু দশ-বিশ হাজার বছরের মধ্যে বসতি বিলীন হয়ে যায়। সত্তর হাজার বছর আগে দ্বিতীয় চেষ্টার পর হোমো সেপিয়েন্স লেভান্ট ও আরবে স্থায়ী আবাস বাঁধতে সক্ষম হয়। সেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে এশিয়া, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকায়। আর মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপে এসে তাদের মোলাকাত হয় অতি দূর সম্পর্কের কাজিন নেয়ান্ডারটালদের সাথে। এমনটা অসম্ভব নয় যে দুই প্রজাতি একে অন্যের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছে।

স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহার প্রস্তরযুগীয় শিল্প।

সমাধির সাথে সাথে যদি মূর্তশিল্পের দিকে নজর দিই, তাহলেও একটা ট্রান্সফর্মেশন ধরা পড়ে কেভ পেন্টিংয়ের শুরুতে। স্পেনের মালত্রাভিয়েসো গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে ৬৪,০০০ বছরের প্রাচীনতম গুহাচিত্র। এগুলির মূল বিষয়বস্তু শিকারের জন্তুজানোয়ার। এঁকেছে নেয়ান্ডারটাল কাজিনরা। মডার্ন হিউম্যানের আঁকা গুহাচিত্রও প্রায় সমসাময়িক। ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার বছরের পুরনো চিত্রগুলো ইন্দোনেশিয়া আর ইউরোপে আবিষ্কৃত হয়েছে। এসব আঁকারও রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স রয়েছে, যেটা বিগত লেখায় বলেছি।

জার্মানিতে আবিষ্কৃত সিংহমানবের মূর্তি।

একই সময়কালের আরও যে অদ্ভূত নিদর্শনটি জার্মানিতে আবিষ্কৃত হয়েছে তার নাম লোভেনমেনশ বা লায়নম্যান ফিগার। মানুষের দেহের ওপর সিংহের মাথা লাগানো আইভরির তৈরি এই ছোট্ট ‘পুতুলটি’ ৩৫ থেকে ৪০ হাজার বছরের পুরনো। মানুষের এহেন কল্পনাশক্তির এর থেকে প্রাচীন কোন নমুনা এখনো পাওয়া যায়নি।

অন্য পশুপাখির যে ক্ষমতা রয়েছে — কিন্তু মানুষের নেই — তা দিয়ে কোন অসাধ্য সাধনের ‘ম্যাজিক’ করতে চেয়েছে হয়ত সেকালের মানুষ। যেসব বিশেষ পশুকে মানবরূপ দেয়া হয়েছে, তাদের বলা যেতে পারে অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যানিম্যাল স্পিরিট। যেমন আমার লক্ষ্য যদি হয় আকাশে দেখা উজ্জ্বল একটি নক্ষত্রে পৌঁছনো, যেখানে রয়েছে আমার প্রয়াত পূর্বপুরুষ, তাহলে আমার দরকার ঈগলের মত কোন পাখির সাহায্য।

ধরুন আমি-আপনি একটি প্রস্তরযুগীয় ক্লানের সদস্য। দলটির জন্যে ক্রান্তিকাল চলছে। শিকারীদল বার বার বিফল হয়ে ফিরে আসছে। মাংসের অভাবে বুনো ফলমূল খেয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। এহেন অবস্থায় ক্লানের প্রধান হিসাবে আপনি পুরোপুরি দিগহারা। শীতের তুষারপাত সমাগত প্রায়। আপনাদের হাতে দু’টি রাস্তা। এলাকাটি ছেড়ে আরো দূরে পাড়ি জমানো যেখানে শিকার জুটতেও পারে নাও পারে। নয়ত আরো একটিবার শিকারের প্রচেষ্টা করে শীতকালটি কাটিয়ে তারপর স্থানান্তর। যুবাবয়সে বয়োবৃদ্ধদের উপদেশ কাজে দিত। কিন্তু তাদের কেউ আর জীবিত নেই। আমাকে তাই আপনি নির্দেশ দিলেন মৃত পূর্বপুরুষদের উপদেশগ্রহণের জন্যে তাদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে।

যজ্ঞ করে একটি ঈগল শিকার করে তার পালক ও চঞ্চু দিয়ে মুখোশ বানালাম। তারপর দলবল নিয়ে, সাইকিডেলিক ওষধি শেকড়ে আগুন লাগিয়ে তার ধোঁয়া ফুঁকে, মন্ত্র পড়ে, দৌড়ঝাঁপ করলাম। তারপর হয়ত সে রাতে সত্যি সত্যি স্বপ্নে দেখলাম আমি নক্ষত্রমন্ডলে হারানো পিতা-পিতামহের সাথে পুনর্মিলিত হয়েছি। ট্রাইবের সবার অবশ্য এ বিশেষ শক্তি থাকবে না। আমার মত যার যার থাকবে, তাদের নাম ওঝা, মেডিসিনম্যান, শামান, ইত্যাদি। আর এই প্রক্রিয়ায় যে প্রাণীর স্পিরিট আমাকে সাহায্য করলো, সেটি ঈগল। আর আমার যজ্ঞে ব্যবহারের জন্যে এরকম একটা ঈগলম্যান মূর্তি কল্পনা থেকে বানিয়ে ফেলা কোন ব্যাপারই না।

বুঝতেই পারছেন আদিম মানুষের কল্পনাশক্তির দৌড় কতদূর!

প্রিয়জনকে সমাহিত করার মাধ্যমে মানুষ প্রমাণ করেছে যে শুধু পাথরের অস্ত্র তৈরিতে তার উদ্ভাবনী ক্ষমতা সীমাবদ্ধ নয়। চিন্তা করে দেখুন যে আজ থেকে ত্রিশ লাখ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষ পাথরের অস্ত্র ব্যবহার শেখে। কিন্তু সে প্রযুক্তির সম্মুখ বিবর্তন পরবর্তী বিশ লাখ বছরেও তেমন একটা হয়নি।

তারপর এল আগুন, সাথে জীবনযাত্রার একটা পরিবর্তন। আর বিগত এক লাখ থেকে পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে এল আমাদের ইমাজিনেশন-ভিজুয়ালাইজেশনের ক্ষমতা। প্রস্তরাস্ত্রের টেকনোলজি আবিষ্কার করেও মানুষ তাতে আটকে ছিল লাখ লাখ বছর। আর কল্পনাশক্তির আল্টিমেট ইভল্যুশনের পঞ্চাশ হাজার বছরের মধ্যে আমরা বর্তমান বিশ্বের অধিবাসী।

ইমাজিনেশন আর ম্যাজিক-স্পিরিট-শামানিজম, সোজা ভাষায় রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমের যে পাওয়ার অফ সাজেশন, সেটা মানবজাতিকে এমন একটা সম্মুখমুখী ঘাত দিয়েছে যার শক্তি এখনো ফুরোয়নি।

যতই বিজ্ঞানপ্রযুক্তি পড়ে জ্ঞানী হোন না কেন, যে শিকড় থেকে এই শক্তিটি মানুষ আহরণ করেছে, সেই স্পিরিচুয়াল-ম্যাজিকাল-রিলিজাস বিলিফ সিস্টেমটাকে অবজ্ঞা করবেন না!

ফীল্ড মিউজিয়ামে দানের লিংক:

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!