হাতির দাঁতে বানানো অসাধারণ এ মুখোশটি প্রদর্শিত হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়ামে। তৈরির স্থান পশ্চিম আফ্রিকার বেনিন সাম্রাজ্য, কাল আনুমানিক ১৫২০। মডেল, সাম্রাজ্যের অধিকর্তার (ওবা) রাণীমাতা স্বয়ং। মাতৃকুলীন সমাজব্যবস্থায় তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল, যেটা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে তাঁর প্রতিচ্ছবিতে।
ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল আফ্রিকার মানুষ উন্নত সভ্যতা স্থাপনের উপযুক্ত নয়। এ চিন্তার মূলে দাসপ্রথা আর বহু শতক পূর্বের দু’জাতের সমতাপূর্ণ সম্পর্কের বিস্মরণ। তারপর আবিষ্কৃত হয় কিছু অসাধারণ ব্রোঞ্জ মূর্তি, আর বেনিন রাজ্য থেকে লুটতরাজ করে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে এরকম কিছু প্রাচীন নিদর্শন। এসব মন্দ কাজের ভাল প্রতিফলও আসে। পশ্চিমা গবেষকরা ত্রিশের দশক থেকে নতুন করে আফ্রিকার প্রাচীন ইতিহাস উদ্ঘাটনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
ফিরে আসি মুখোশ প্রসঙ্গে। একটু খেয়াল করে দেখলে মুখোশের চারধারে একটা অদ্ভূত জিনিস চোখে পড়বে। রাণীমাতার কোঁকড়ানো চুলের একেকটি বিনুনি কিন্তু চুল নয়! অদলাবদলি করে মাডফিশ নামে এক মাছের প্রতিকৃতি, আর এক পর্তুগীজ নাবিকের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়ব! (২য় ছবি)
আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অবক্ষয়ের মধ্যে উত্থান স্বাধীন পর্তুগাল রাজ্যের। চতুর্দশ শতকে আরব প্রযুক্তি সম্বল করে একটি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন প্রিন্স হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর। নতুন নতুন দূরপাল্লার সব জাহাজ তৈরি শুরু হয়। সেগুলি নিয়ে আটলান্টিকের তীর ধরে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে তারা। মূল লক্ষ্য, ইতালির জেনোয়িজ আর তুরস্কের অটোমানদের একচেটিয়া প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্যের বিকল্প পথ বের করা।
সেই অভিযানের প্রথম পর্ব আমেরিকা-ভারত নয়, ছিল আফ্রিকার আবিষ্কার। ১৪৬০ থেকে শুরু করে ১৪৯০এর দশক পর্যন্ত পর্তুগীজরা একে একে কাবো ভের্দে দ্বীপপুঞ্জ, সেনেগাল, গাম্বিয়া, সিয়েরা লেওন, নাইজেরিয়া, বেনিন প্রভৃতি অধুনা আফ্রিকান দেশগুলির উপকূলে অবতরণ করে।
এসব সাবসাহারান দেশগুলি মোটেও অনুন্নত ছিল না, কোন কোনটি ছিল পুরোদস্তুর সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে মালি, বেনিন, সোনিনকে, মালিনকে ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। কিছু কিছু জাতি সাক্ষর ছিল যেমন মালির তিমবাক্তু ইসলামী-আরবী সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল। আর বেনিন-নাইজেরিয়ার রাজ্যগুলি সাক্ষর না হলেও কাঠ, আইভরি, ব্রোঞ্জ শিল্পে অগ্রসর ছিল।
পর্তুগীজদেরকে এসব জাতি প্রথমে ভেবেছিল তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রত্যাবর্তিত আত্মা হিসাবে। তাদের ধর্মে সাগর ছিল জীবিত-মৃতের মধ্যে পৃথককারী পর্দা। পর্তুগীজদের শ্বেত বর্ণও তাদের সে ধারণার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ প্রথম সে মোলাকাতে আমেরিকার অ্যাজটেক-ইংকাদের মত শ্বেতাঙ্গদের দৈবশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল।
তারপর ধীরে ধীরে যত সময় গেছে দু’জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। পর্তুগীজ বণিকরা বেনিন, সাপি, কোংগো রাজ্যে তৈরি আইভরি বা হোয়াইট গোল্ড নিয়ে স্বদেশে বিক্রি করেছে। বিনিময়ে আফ্রিকার রাজ্যগুলি কিনেছে পর্তুগীজ আগ্নেয়াস্ত্র।
আজকে অনেকে আফ্রিকান বলতে একটি অভিন্ন জাতি ভেবে থাকলে ভুল ভাববেন। বিভিন্ন ভাষাপরিবারের বিভিন্ন গোষ্ঠী কালের পরিক্রমায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মধ্যে সংঘাতও হয়েছে। উপকূলীয় রাজ্যগুলির জন্যে অভ্যন্তরের সাম্রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বন্দুক ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
এছাড়াও পর্তুগালে ছিল সোনা, মরিচ ও রকসল্টের বিশাল চাহিদা। সেগুলিরও সাপ্লাই আসে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে। ৩য় ছবির বেনিন আইভরিতে তৈরি সল্টসেলারটিতে পর্তুগীজ যোদ্ধাকে চিত্রিত করা হয়েছে।
আরো যে রসদটির যোগান দেয় পর্তুগীজদের নেটিভ দোসররা তা হলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। আটলান্টিকের দাসবাণিজ্যের শুরু কিন্তু এটা নয়। আফ্রিকার রাজ্যগুলিতে আগে থেকেই দাসপ্রথা ছিল। ভিন্নজাতের শত্রুদের পরাজিত করে দাস বানিয়ে তাদের গতর খাঁটানো হত। তাছাড়াও উত্তরের ‘বারবারি কোস্টের’ মুসলিম রাজ্যগুলি দাসব্যবসা করত। একই রকম অবস্থা বিরাজমান ছিল ভারত মহাসাগরের উপকূলে। সেখানে জানজিবার দ্বীপ ছিল আরবে দাস রপ্তানির ঘাঁটি।
পর্তুগীজ-স্প্যানিশ ও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা কিন্তু চাইলেই হৈচৈ করে আফ্রিকান দাস ধরে নিয়ে যেতে পারত না। আফ্রিকার অভ্যন্তর অঞ্চলে ঢোকার সাধ্য তাদের ছিল না। কারণ জলাজঙ্গলের ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগশোককে তারা ভীষণ ভয় পেত। আর কম লোকবল নিয়ে বিশাল সেনাশক্তির সাম্রাজ্যগুলির মোকাবিলা করার সাহস-সামর্থ্যও তাদের ছিল না। আফ্রিকার কলোনিয়ালাইজেশন তুলনামূলক অধুনার ইতিহাস — মোটে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। ততদিনে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।
ঊনবিংশ শতকের পশ্চিমাদের মত মধ্যযুগীয় পর্তুগীজরা যে কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এরকম মনোভাব পোষণ করেনি। বরং তারা নিজেদের পড়শী গ্রানাদার মুসলিম রাজ্যগুলিতে দেখেছে শ্বেতাঙ্গ খ্রীষ্টানদের ধরে দাস বানানো হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে অনেক ইউরোপীয় দেশে ঋণগ্রস্তরাও দাসে পরিণত হত। অপরদিকে তুরস্ক ও উত্তর আফ্রিকার সুলতানরাও দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ দেশগুলি থেকে ক্রীতদাস পাচার করত। তাদের অনেকে ছিল সেক্সুয়াল স্লেভ যাদের স্থান হত সুলতানের হারেমে — ছেলে-মেয়ে দুইই।
অর্থাৎ পর্তুগীজদের সাথে প্রথম মোলাকাতের পর আফ্রিকার একাধিক প্রভাবশালী রাজ্যই তাদের দাস সাপ্লাই দিয়েছে। আর কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এটাও ইউরোপে ছিল না। ৪র্থ ও ৫ম ছবিতে রেনেসাঁস যুগে অংকিত চিত্রকর্মে বনেদী কৃষ্ণাঙ্গ দুই ব্যক্তির ছবি দিয়েছি। সত্যি বলতে একটা সময় দাস আর বনেদীবংশ মিলে কৃষ্ণাঙ্গরা লিসবন শহরের জনসংখ্যার দশ শতাংশ হয়ে যায়।
দাসবাণিজ্যে জোয়ার আসতে শুরু করে আমেরিকার আবিষ্কার ও স্প্যানিশদের প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে সাথে। একটি ত্রিমুখী বাণিজ্যের সূচনা হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। আফ্রিকা থেকে ‘কাঁচামাল’ নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খালাস। সে ‘কাঁচামালের’ শ্রমে উৎপন্ন চিনি, রাম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি। তারপর ইউরোপের বন্দুক ও ফিনিশড গুডস নিয়ে আফ্রিকায় যাত্রা, বিনিময়ে আবার ‘কাঁচামাল’ জাহাজে উঠানো।
আফ্রিকান শ্রমের এরকম এবিউজ হয়ত হত না যদি না কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন পশ্চিম আফ্রিকার রাজ্যগুলিকে ওলটপালট করে দিত। প্রাচীন মালি সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরি ছোট ছোট রাজ্যগুলির সাথে নতুন বড় সাম্রাজ্যগুলির সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সপ্তদশ শতকে ঘানার আশান্তি সাম্রাজ্য বেশ প্রতাপশালী হয় ওঠে। কৃষিতে কিছু উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে তারা উত্তরে ও পশ্চিমে মালিংকে রাজ্যগুলির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে যুদ্ধলব্ধ দাসদের একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়।
একই ঘটনা ঘটে আরেকটু পূর্বে। নবাগত দাহোমে জাতি মূল জনগোষ্ঠী এদোদের ওপর শাসন কায়েম করে। সে ব্যবস্থায় বিজিতরা ছিল দাস। দাহোমের উপকূলেও দাসরপ্তানিকেন্দ্র গড়ে ওঠে।
অর্থাৎ আফ্রিকার পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ ছিল আটলান্টিক দাসব্যবসার বিশাল আকারের অন্যতম বড় কারণ। ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা হয় সেই মার্কেটের এন্ড ইউজার। যদি আফ্রিকান মিডলম্যানরা বলত দাস সাপ্লাই বন্ধ, তাহলে ইউরোপীয়দের পক্ষে শ্রম আমদানির উপায় হত হয় ইনডেনচার্ড সার্ভিচ্যুড — যেটার শিকার দাসপ্রথাপরবর্তীকালে দরিদ্র আইরিশ-স্কটিশ-ইংলিশরা হয়েছে। নয়ত পেইড লেবার।
ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ আর মার্কিনরাই আবার প্রথম দাসব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে। প্রথমে নিজেদের বন্দরে ক্রীতদাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এই শতকের প্রথমভাগে। এরপর ব্রিটিশরা জোরপূর্বক স্প্যানিশ-পর্তুগীজ জাহাজে হামলা চালিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করত। ব্রিটিশ-ফরাসীরা উত্তর আফ্রিকার বারবারি কোস্টের সুলতানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেসব রাজ্যের জলদস্যুতা আর শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের ধরে দাস বানানোর প্রতিশোধ হিসাবে। (৬ষ্ঠ ছবি)
উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নতুন দাস রপ্তানি বন্ধ হলেও মার্কিনদের স্বদেশে এতদিনে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ দাসের আগমন হয়েছে, তাদের দাস বংশধরদের মুক্তির কোন ব্যবস্থা হয়নি। তার জন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক দশক ও একটি যুদ্ধের জন্য। পশ্চিমা ও পশ্চিমাশাসিত দেশগুলির মধ্যে সবচে’ শেষে দাসপ্রথা রহিত হয় পর্তুগীজ ব্রাজিলে — ১৮৮০র দশকে।
আরব দেশগুলিতে দাসবাণিজ্য চলে ত্রিশের দশক পর্যন্ত। প্রকারান্তরে এখনো তা চলছে। ৭ম ছবিতে মক্কার এক বণিকের পাশে তার শ্বেতাঙ্গ দাসকে দেখা যাচ্ছে। তার চেহারাতে পূর্ব ইউরোপীয় স্লাভিক ছাঁচ দৃশ্যমান। এরা অটোমান সাম্রাজ্যে পরিচিত ছিল সিরকাসিয়ান হিসাবে।
আফ্রিকান আমেরিকানদের বেদনাময় ইতিহাস এখনো মার্কিন রাজনীতিতে অহরহ আসে। এই বিতর্কে কতটা হিস্টরিকাল কনটেক্সট টানা হয় তা খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। এতে কোন সন্দেহ নেই, মার্কিনদের দাসপ্রথার ক্ষণস্থায়ী ও তুলনামূলক অধুনা ইতিহাসে এর আগের একাধিক শতকের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচ-স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে।
আরো ঢাকা পড়ে গেছে আটলান্টিক দাসব্যবসার কৃষ্ণাঙ্গ মদদকারীদের ইতিহাস। পোস্ট কলোনিয়াল আফ্রিকার প্রথম স্বাধীন দেশ ঘানা। তার প্রথম প্রেসিডেন্ট কয়ামে ন্ক্রুমা প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা (৭ম ছবিতে চে গেবারার সাথে)। তার হাত ধরেই আরো বহু সাবসাহারান দেশ স্বাধীন হয়। সেসব দেশের স্কুল কারিকুলামে পড়ানো হয় প্রাচীন আফ্রিকান দেশগুলির প্রতিপত্তি-অগ্রগতির কথা। বলা হয়, শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিদের অত্যাচারের কথা। সবই খাঁটি কথা। কিন্তু শুধু চেপে যাওয়া হয় ন্ক্রুমার স্বগোষ্ঠী আশান্তিরাই যে ছিল অন্যতম মদদকারী দাসরপ্তানীকারী রাজ্য সে কথা। চেপে যাওয়া হয় পশ্চিম আফ্রিকার এলিট বংশগুলির কথা, যারা দাসব্যবসা করে স্বদেশে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভাল একটি ভবিষ্যত দিয়ে গেছে।
২০১৯এ ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে একটি সাড়াজাগানো আর্টিকেল লিখে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদীদের রোষের শিকার হন আদাওবি নওয়াউবানি নামের এক নাইজেরিয়ান পুরস্কারবিজয়ী লেখক। আজকের পলিটিকাল ক্লাইমেটে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অবিচার নিয়ে যারা সঙ্গত কারণেই সোচ্চার, আশা করি সেটা করার পাশাপাশি মুদ্রার এপিঠটাও তারা একটু উল্টে দেখবেন। আদাওবির লেখাটি পড়তে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন।