আফ্রিকার দাসবাণিজ্য

হাতির দাঁতে বানানো অসাধারণ এ মুখোশটি প্রদর্শিত হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়ামে। তৈরির স্থান পশ্চিম আফ্রিকার বেনিন সাম্রাজ্য, কাল আনুমানিক ১৫২০। মডেল, সাম্রাজ্যের অধিকর্তার (ওবা) রাণীমাতা স্বয়ং। মাতৃকুলীন সমাজব্যবস্থায় তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল, যেটা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে তাঁর প্রতিচ্ছবিতে।

হাতির দাঁতে তৈরি বেনিনের রাণীমাতার আদলে মুখোশ, নিউ ইয়র্ক মেট মিউজিয়াম, ষোড়শ শতক।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল আফ্রিকার মানুষ উন্নত সভ্যতা স্থাপনের উপযুক্ত নয়। এ চিন্তার মূলে দাসপ্রথা আর বহু শতক পূর্বের দু’জাতের সমতাপূর্ণ সম্পর্কের বিস্মরণ। তারপর আবিষ্কৃত হয় কিছু অসাধারণ ব্রোঞ্জ মূর্তি, আর বেনিন রাজ্য থেকে লুটতরাজ করে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে এরকম কিছু প্রাচীন নিদর্শন। এসব মন্দ কাজের ভাল প্রতিফলও আসে। পশ্চিমা গবেষকরা ত্রিশের দশক থেকে নতুন করে আফ্রিকার প্রাচীন ইতিহাস উদ্ঘাটনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ফিরে আসি মুখোশ প্রসঙ্গে। একটু খেয়াল করে দেখলে মুখোশের চারধারে একটা অদ্ভূত জিনিস চোখে পড়বে। রাণীমাতার কোঁকড়ানো চুলের একেকটি বিনুনি কিন্তু চুল নয়! অদলাবদলি করে মাডফিশ নামে এক মাছের প্রতিকৃতি, আর এক পর্তুগীজ নাবিকের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়ব! (২য় ছবি)

বেনিনের রাণীমাতার মুখোশের ডিটেইল।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অবক্ষয়ের মধ্যে উত্থান স্বাধীন পর্তুগাল রাজ্যের। চতুর্দশ শতকে আরব প্রযুক্তি সম্বল করে একটি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন প্রিন্স হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর। নতুন নতুন দূরপাল্লার সব জাহাজ তৈরি শুরু হয়। সেগুলি নিয়ে আটলান্টিকের তীর ধরে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে তারা। মূল লক্ষ্য, ইতালির জেনোয়িজ আর তুরস্কের অটোমানদের একচেটিয়া প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্যের বিকল্প পথ বের করা।

সেই অভিযানের প্রথম পর্ব আমেরিকা-ভারত নয়, ছিল আফ্রিকার আবিষ্কার। ১৪৬০ থেকে শুরু করে ১৪৯০এর দশক পর্যন্ত পর্তুগীজরা একে একে কাবো ভের্দে দ্বীপপুঞ্জ, সেনেগাল, গাম্বিয়া, সিয়েরা লেওন, নাইজেরিয়া, বেনিন প্রভৃতি অধুনা আফ্রিকান দেশগুলির উপকূলে অবতরণ করে।

এসব সাবসাহারান দেশগুলি মোটেও অনুন্নত ছিল না, কোন কোনটি ছিল পুরোদস্তুর সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে মালি, বেনিন, সোনিনকে, মালিনকে ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। কিছু কিছু জাতি সাক্ষর ছিল যেমন মালির তিমবাক্তু ইসলামী-আরবী সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল। আর বেনিন-নাইজেরিয়ার রাজ্যগুলি সাক্ষর না হলেও কাঠ, আইভরি, ব্রোঞ্জ শিল্পে অগ্রসর ছিল।

পর্তুগীজদেরকে এসব জাতি প্রথমে ভেবেছিল তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রত্যাবর্তিত আত্মা হিসাবে। তাদের ধর্মে সাগর ছিল জীবিত-মৃতের মধ্যে পৃথককারী পর্দা। পর্তুগীজদের শ্বেত বর্ণও তাদের সে ধারণার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ প্রথম সে মোলাকাতে আমেরিকার অ্যাজটেক-ইংকাদের মত শ্বেতাঙ্গদের দৈবশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল।

তারপর ধীরে ধীরে যত সময় গেছে দু’জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। পর্তুগীজ বণিকরা বেনিন, সাপি, কোংগো রাজ্যে তৈরি আইভরি বা হোয়াইট গোল্ড নিয়ে স্বদেশে বিক্রি করেছে। বিনিময়ে আফ্রিকার রাজ্যগুলি কিনেছে পর্তুগীজ আগ্নেয়াস্ত্র।

আজকে অনেকে আফ্রিকান বলতে একটি অভিন্ন জাতি ভেবে থাকলে ভুল ভাববেন। বিভিন্ন ভাষাপরিবারের বিভিন্ন গোষ্ঠী কালের পরিক্রমায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মধ্যে সংঘাতও হয়েছে। উপকূলীয় রাজ্যগুলির জন্যে অভ্যন্তরের সাম্রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বন্দুক ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বিনি পর্তুগীজ সল্ট সেলারে চিত্রিত হয়েছে ইউরোপীয় যোদ্ধা, ষোড়শ শতক, ম্যুজে দ্য কে-ব্রঁলি

এছাড়াও পর্তুগালে ছিল সোনা, মরিচ ও রকসল্টের বিশাল চাহিদা। সেগুলিরও সাপ্লাই আসে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে। ৩য় ছবির বেনিন আইভরিতে তৈরি সল্টসেলারটিতে পর্তুগীজ যোদ্ধাকে চিত্রিত করা হয়েছে।

আরো যে রসদটির যোগান দেয় পর্তুগীজদের নেটিভ দোসররা তা হলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। আটলান্টিকের দাসবাণিজ্যের শুরু কিন্তু এটা নয়। আফ্রিকার রাজ্যগুলিতে আগে থেকেই দাসপ্রথা ছিল। ভিন্নজাতের শত্রুদের পরাজিত করে দাস বানিয়ে তাদের গতর খাঁটানো হত। তাছাড়াও উত্তরের ‘বারবারি কোস্টের’ মুসলিম রাজ্যগুলি দাসব্যবসা করত। একই রকম অবস্থা বিরাজমান ছিল ভারত মহাসাগরের উপকূলে। সেখানে জানজিবার দ্বীপ ছিল আরবে দাস রপ্তানির ঘাঁটি।

পর্তুগীজ-স্প্যানিশ ও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা কিন্তু চাইলেই হৈচৈ করে আফ্রিকান দাস ধরে নিয়ে যেতে পারত না। আফ্রিকার অভ্যন্তর অঞ্চলে ঢোকার সাধ্য তাদের ছিল না। কারণ জলাজঙ্গলের ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগশোককে তারা ভীষণ ভয় পেত। আর কম লোকবল নিয়ে বিশাল সেনাশক্তির সাম্রাজ্যগুলির মোকাবিলা করার সাহস-সামর্থ্যও তাদের ছিল না। আফ্রিকার কলোনিয়ালাইজেশন তুলনামূলক অধুনার ইতিহাস — মোটে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। ততদিনে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের পশ্চিমাদের মত মধ্যযুগীয় পর্তুগীজরা যে কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এরকম মনোভাব পোষণ করেনি। বরং তারা নিজেদের পড়শী গ্রানাদার মুসলিম রাজ্যগুলিতে দেখেছে শ্বেতাঙ্গ খ্রীষ্টানদের ধরে দাস বানানো হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে অনেক ইউরোপীয় দেশে ঋণগ্রস্তরাও দাসে পরিণত হত। অপরদিকে তুরস্ক ও উত্তর আফ্রিকার সুলতানরাও দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ দেশগুলি থেকে ক্রীতদাস পাচার করত। তাদের অনেকে ছিল সেক্সুয়াল স্লেভ যাদের স্থান হত সুলতানের হারেমে — ছেলে-মেয়ে দুইই।

অর্থাৎ পর্তুগীজদের সাথে প্রথম মোলাকাতের পর আফ্রিকার একাধিক প্রভাবশালী রাজ্যই তাদের দাস সাপ্লাই দিয়েছে। আর কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এটাও ইউরোপে ছিল না। ৪র্থ ও ৫ম ছবিতে রেনেসাঁস যুগে অংকিত চিত্রকর্মে বনেদী কৃষ্ণাঙ্গ দুই ব্যক্তির ছবি দিয়েছি। সত্যি বলতে একটা সময় দাস আর বনেদীবংশ মিলে কৃষ্ণাঙ্গরা লিসবন শহরের জনসংখ্যার দশ শতাংশ হয়ে যায়।

১৫৭০ থেকে ১৫৮০র মধ্যে আঁকা এ ছবিতে পর্তুগালের লিসবন বন্দরের দৈনন্দিন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়সওয়ারের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু কসমোপলিটান ব্যাপারস্যাপার চলে এসেছে।
১৫২০/২৫এ ডাচ চিত্রকর ইয়ন মোশতারতের আঁকা পোরট্রেট অফ অ্যান আফ্রিকান ম্যান।

দাসবাণিজ্যে জোয়ার আসতে শুরু করে আমেরিকার আবিষ্কার ও স্প্যানিশদের প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে সাথে। একটি ত্রিমুখী বাণিজ্যের সূচনা হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। আফ্রিকা থেকে ‘কাঁচামাল’ নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খালাস। সে ‘কাঁচামালের’ শ্রমে উৎপন্ন চিনি, রাম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি। তারপর ইউরোপের বন্দুক ও ফিনিশড গুডস নিয়ে আফ্রিকায় যাত্রা, বিনিময়ে আবার ‘কাঁচামাল’ জাহাজে উঠানো।

আফ্রিকান শ্রমের এরকম এবিউজ হয়ত হত না যদি না কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন পশ্চিম আফ্রিকার রাজ্যগুলিকে ওলটপালট করে দিত। প্রাচীন মালি সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরি ছোট ছোট রাজ্যগুলির সাথে নতুন বড় সাম্রাজ্যগুলির সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সপ্তদশ শতকে ঘানার আশান্তি সাম্রাজ্য বেশ প্রতাপশালী হয় ওঠে। কৃষিতে কিছু উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে তারা উত্তরে ও পশ্চিমে মালিংকে রাজ্যগুলির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে যুদ্ধলব্ধ দাসদের একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়।

একই ঘটনা ঘটে আরেকটু পূর্বে। নবাগত দাহোমে জাতি মূল জনগোষ্ঠী এদোদের ওপর শাসন কায়েম করে। সে ব্যবস্থায় বিজিতরা ছিল দাস। দাহোমের উপকূলেও দাসরপ্তানিকেন্দ্র গড়ে ওঠে।

অর্থাৎ আফ্রিকার পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ ছিল আটলান্টিক দাসব্যবসার বিশাল আকারের অন্যতম বড় কারণ। ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা হয় সেই মার্কেটের এন্ড ইউজার। যদি আফ্রিকান মিডলম্যানরা বলত দাস সাপ্লাই বন্ধ, তাহলে ইউরোপীয়দের পক্ষে শ্রম আমদানির উপায় হত হয় ইনডেনচার্ড সার্ভিচ্যুড — যেটার শিকার দাসপ্রথাপরবর্তীকালে দরিদ্র আইরিশ-স্কটিশ-ইংলিশরা হয়েছে। নয়ত পেইড লেবার।

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ আর মার্কিনরাই আবার প্রথম দাসব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে। প্রথমে নিজেদের বন্দরে ক্রীতদাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এই শতকের প্রথমভাগে। এরপর ব্রিটিশরা জোরপূর্বক স্প্যানিশ-পর্তুগীজ জাহাজে হামলা চালিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করত। ব্রিটিশ-ফরাসীরা উত্তর আফ্রিকার বারবারি কোস্টের সুলতানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেসব রাজ্যের জলদস্যুতা আর শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের ধরে দাস বানানোর প্রতিশোধ হিসাবে। (৬ষ্ঠ ছবি)

অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়ার তুর্কিসমর্থিত দা’ইয়ির রাজ্যে শ্বেতাঙ্গ দাসত্বের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় দেশগুলি শোরগোল তোলে। ব্রিটিশ এক কাপ্তানের বর্ণনা সম্বলিত এই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় তখন। ১৮১৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আলজিয়েরস আক্রমণ করে।

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নতুন দাস রপ্তানি বন্ধ হলেও মার্কিনদের স্বদেশে এতদিনে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ দাসের আগমন হয়েছে, তাদের দাস বংশধরদের মুক্তির কোন ব্যবস্থা হয়নি। তার জন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক দশক ও একটি যুদ্ধের জন্য। পশ্চিমা ও পশ্চিমাশাসিত দেশগুলির মধ্যে সবচে’ শেষে দাসপ্রথা রহিত হয় পর্তুগীজ ব্রাজিলে — ১৮৮০র দশকে।

আরব দেশগুলিতে দাসবাণিজ্য চলে ত্রিশের দশক পর্যন্ত। প্রকারান্তরে এখনো তা চলছে। ৭ম ছবিতে মক্কার এক বণিকের পাশে তার শ্বেতাঙ্গ দাসকে দেখা যাচ্ছে। তার চেহারাতে পূর্ব ইউরোপীয় স্লাভিক ছাঁচ দৃশ্যমান। এরা অটোমান সাম্রাজ্যে পরিচিত ছিল সিরকাসিয়ান হিসাবে।

মক্কার হেজাজী সওদাগরের সাথে তার শ্বেতাঙ্গ সিরকাসিয়ান দাস, ১৮৮৬-৮৭

আফ্রিকান আমেরিকানদের বেদনাময় ইতিহাস এখনো মার্কিন রাজনীতিতে অহরহ আসে। এই বিতর্কে কতটা হিস্টরিকাল কনটেক্সট টানা হয় তা খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। এতে কোন সন্দেহ নেই, মার্কিনদের দাসপ্রথার ক্ষণস্থায়ী ও তুলনামূলক অধুনা ইতিহাসে এর আগের একাধিক শতকের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচ-স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে।

আরো ঢাকা পড়ে গেছে আটলান্টিক দাসব্যবসার কৃষ্ণাঙ্গ মদদকারীদের ইতিহাস। পোস্ট কলোনিয়াল আফ্রিকার প্রথম স্বাধীন দেশ ঘানা। তার প্রথম প্রেসিডেন্ট কয়ামে ন্ক্রুমা প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা (৭ম ছবিতে চে গেবারার সাথে)। তার হাত ধরেই আরো বহু সাবসাহারান দেশ স্বাধীন হয়। সেসব দেশের স্কুল কারিকুলামে পড়ানো হয় প্রাচীন আফ্রিকান দেশগুলির প্রতিপত্তি-অগ্রগতির কথা। বলা হয়, শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিদের অত্যাচারের কথা। সবই খাঁটি কথা। কিন্তু শুধু চেপে যাওয়া হয় ন্ক্রুমার স্বগোষ্ঠী আশান্তিরাই যে ছিল অন্যতম মদদকারী দাসরপ্তানীকারী রাজ্য সে কথা। চেপে যাওয়া হয় পশ্চিম আফ্রিকার এলিট বংশগুলির কথা, যারা দাসব্যবসা করে স্বদেশে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভাল একটি ভবিষ্যত দিয়ে গেছে।

কিউবার বিপ্লবী চে গেবারার সাথে ঘানার প্রেসিডেন্ট কওয়ামে ঙ্ক্রুমা, ১৯৬৫। চে সে যাত্রায় আটটি আফ্রিকান দেশ সফর করে বাছবিচার করেন কোন কোনটিতে বিপ্লবের উর্বর ক্ষেত্র রয়েছে।

২০১৯এ ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে একটি সাড়াজাগানো আর্টিকেল লিখে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদীদের রোষের শিকার হন আদাওবি নওয়াউবানি নামের এক নাইজেরিয়ান পুরস্কারবিজয়ী লেখক। আজকের পলিটিকাল ক্লাইমেটে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অবিচার নিয়ে যারা সঙ্গত কারণেই সোচ্চার, আশা করি সেটা করার পাশাপাশি মুদ্রার এপিঠটাও তারা একটু উল্টে দেখবেন। আদাওবির লেখাটি পড়তে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন।

বাঙ্গালীর দাসপ্রথা

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মূল কারণ ছিল ক্রীতদাসপ্রথার উচ্ছেদ। এখনো বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা নিয়তই চলে আসে এদেশের রাজনীতির মধ্যে। আমাদের জন্য সেটা কেমন ছিল?

চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন বাঙ্গালী আত্মভোলা একটা জাত। সেকথা এক্কেবারে ঠিক! বাঙ্গালীর ইতিহাসেও দাসপ্রথা ছিল এবং এখনো আছে। সে নিজে দাস হয়েছে, আবার ক্রীতদাসের মালিক হতেও তার খুব একটা বাঁধেনি।

প্রথমে বলি কবে কোথায় আমাদের স্বজাতি দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছিল। অনেকে ভুল আন্দাজ করবেন যে মুসলিম শাসনামলে এর শুরু। ইসলামের আগেও আরবদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল। ইসলামে ক্রীতদাসের সাথে সদাচরণ করতে বলা হলেও সেটাকে বিলুপ্ত করা হয়নি। সে কারণে নানাযুগে মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে হাবশী-তুর্কী দাসেরা এদেশে এসেছে। আবার তারা নিজেরাও একসময় রাজা বনেছে, যেমন দিল্লীর মামলুক, বাংলার হাবশী রাজ্য। এইসব রাজারা সবাইই যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরাজিত গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশুদের ধরে দাস হিসেবে পৃথিবীর আনাচেকানাচে বিক্রি করে দিয়েছে।

দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুব মিনার খ্যাত কুতব আলদ্বীন আইবক (১১৫০-১২১০) শিশুকালে দাস হিসাবে বিক্রিত হন। তুর্কীস্তানের অধিবাসীদের দাস হিসাবে চাহিদা ছিল, কারণ প্রশিক্ষণ দিলে তারা ভাল সৈন্য হত। ছবিতে লাহোরস্থিত আইবকের সমাধি।
ভারতের গুজরাতের নেটিভ রাজ্য সাচিনের নবাব দ্বিতীয় ইব্রাহিম মোহাম্মদ ইয়াকুত খান (নবাবীর কাল, ১৭৯১-১৮০২)। জাঞ্জিরা দ্বীপের আফ্রিকান সুন্নি মুসলিম রাজবংশে জন্ম। তার পূর্বসূরীরা সুলতানী আমলে দাস হিসাবে ভারতে এসেছিল, পরে সম্রাটের অনুগ্রহে রাজত্ব পায়।

কিন্তু এই অভিশাপ শুধু মুসলিম শাসনামলেই ছিল না। জীমূতবাহনের দায়ভাগে আমরা দেখতে পাই দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু উত্তরাধিকারবিধিতে দাসীর উল্লেখ, তারও আগের বৌদ্ধ বিনয়পিটকেও দেখি দাসেদের ভিক্ষু হওয়া বারণ। বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টধর্মেও যীশু এপ্রথার বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলে যাননি, যার ফলে সন্ত পল দাসদের উপদেশ দিয়েছেন মালিকের প্রতি বিশ্বস্ত হতে। শ্বেতাঙ্গরাও অতীত আর বর্তমানকালে দাসত্বের শৃংখল পরেছে, সেকথা সুযোগ হলে অন্য সময়।

প্রাগাধুনিক যুগে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনার সাথে সাথে দাসবাণিজ্য আরও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছিল। পর্তুগীজ হার্মাদ জলদস্যু আর বার্মার আরাকানের মগ দুয়ে মিলে ষোড়শ শতকে দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবন, সন্দ্বীপ আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায়ই লুট তরাজ চালিয়ে দাস ধরে নিয়ে যেত — যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা হতো ‘মগের মুল্লুক’। অন্যদিকে মোঘলরা ছিল দাসপ্রথার বিরোধী (আওরঙ্গজেব বাদে), তারা ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম দখল করে এই মুল্লুকের সমাপ্তি ঘটায়।

মনুস্মৃতিতে জীমূতবাহনের দায়ভাগে দাসীর ঔরসে সন্তান জন্মালে কিভাবে সম্পত্তি ভাগ হবে তার নিয়ম।
বৌদ্ধ বিনয়পিটক অনুযায়ী দাসদের ভিক্ষু হওয়া বারণ।
সেন্ট পল দাসদের বলে গেছেন মনিবের প্রতি অনুগত থাকতে।
কুরআন অনুযায়ী দাসদাসীদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তার নিয়ম।

প্রায় একই সময়ে, সপ্তদশ শতকে, ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (VOC) কাশিমপুর, হুগলী এসব জায়গায় ঘাঁটি গাঁড়ে। তারা লুটতরাজ করত না, কিন্তু দাস কেনাবেচা সেখানে ঠিকই চলত। এসব দাসদের কারা এনে তাদের হাতে সমর্পণ করত, তার কাগজেকলমে প্রমাণ না থাকলেও আন্দাজ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে এদের পরিবারের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কর্তাই হয়ত পেটের দায়ে সে কাজটি করেছেন, নয়ত বাঙ্গালী বা অন্য ভারতীয় বেনিয়া-ছেলেধরাদের কাজ। ইন্দোনেশিয়ার বাতাফিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে এসব দাসের অধিকাংশ গিয়ে পৌঁছায়, এখনও তাদের বংশধররা সেখানে আছেন, কিন্তু নিজ সংস্কৃতি-ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেরা অনেকে সেখানে করেছে হাঁড়ভাঙা খাটুনি, আর মেয়েদের চাহিদা ছিল ভাল সেবক আর সূঁচকর্মী হিসাবে, কারও কারও ভাগ্যে পণমুক্তি আর ওলন্দাজ জামাইও জুটেছিল। সেদেশের এককালীন শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী প্রেসিডেন্ট ডিক্লার্কেরও ধমনীতে নাকি বাংলার রক্ত আছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিও (EIC) কিছুটা সময় মাদ্রাজ আর কলকাতা থেকে এসব করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্যে ভাঁটা পড়া শুরু হল ব্রিটিশদের কারণেই। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে দাসপ্রথা আইন করে বন্ধ করে দেয়, আর তাদের সমুদ্রে কোন দাসবাহী জাহাজ পেলে সেটা দখল করে দাসদের মুক্তি দেয়া শুরু করে। অবশ্য এতে করে অন্য ধরনের দাসত্বও শুরু হয়ে যায়, সেটা ক্রয়বিক্রয়ের দাস নয়, একে বলে চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব। ভারতে অবশ্য তখনও ব্রিটিশরা দেশীদের ভিতরে ক্রীতদাস-প্রথা সহ্য করত, অভ্যন্তরীণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নাক গলাতে এসে ঝামেলা পোহাতে চাইত না। অবশেষে তারা সেটাও আইন করে বন্ধ করে ১৮৬১ সালে।

১৬০১এর এনগ্রেভিংয়ে পূর্ব ইউরোপীয় জনগণকে গলায় দড়ি বেঁধে দাস হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে তুর্কী অটোমান সেনাদল।
ঊনবিংশ শতকে আলজিয়ার্সের মুসলিম শাসকরা মার্কিন ও ইউরোপীয় জাহাজ দখল করে তার নাবিকদের দাস হিসাবে ব্যবহার করত।
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তিতে পালিয়ে যাওয়া আইরিশ চাকরানীর সন্ধানের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রে পালিয়ে যাওয়া স্কটিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্টের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট পরিবার। ঊনবিংশ শতকে পটাটো ফ্যামিনের সময় প্রচুর আইরিশ চাকর হিসাবে আমেরিকায় আসে।

এখন বলি বাঙ্গালী কখন নিজে হয়েছে দাসের মালিক। ঐযে কেপ টাউনের কথা বললাম, সেখানেই কিছু কিছু বঙ্গীয় মুক্তি-অর্জনের পরে নিজেই স্বদেশ-বিদেশ থেকে আনা দাস ক্রয় করত। সেটা ১৭০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আরো পরে, এমন কী ১৮৬২ সালে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ইন্ডিয়ান রিফরমার পত্রিকা থেকে পুনর্প্রকাশিত একটা খবর পড়লাম, তাতে প্রতিবেদক অভিযোগ করছেন যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বরিশাল, বিক্রমপুর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম – এসব জায়গায় নাকি গোলাম-বাঁদি কেনাবেচা চলে। এদের কেউ আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাস, আর কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক। মফস্বলের জমিদারদের মধ্যে দাস কেনা-বেচা আর উপহার হিসাবে আদান-প্রদানও চলত পুরোদমে। সেসময়কার এরকম আরও অন্তত দুটো খবর ইন্টারনেটে খুঁজে পাই।

আধুনিক বাংলাদেশে সেই প্রথা কি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত? আমার শ্রদ্ধেয় এক অগ্রজ আলোকচিত্রী, আর তার স্ত্রী (হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এই একবিংশ শতকেই বাংলাদেশের দুবলার চরে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক দাসত্ব। শুঁটকির ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আর শিকলপরা কিশোরদের প্রচুর ছবি আমাকে দেখিয়েছেন, এমনকি এক ছেলেকে উদ্ধার করেও নিয়ে এসেছিলেন। এরকম আরও নানারকম দাসত্ব আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত দেখতে পাই।

সপ্তদশ/অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার কলোনিগুলিতে ইংলিশ কনভিক্টদেরও কেনাবেচা চলত
সাদা দাসদাসীদের কপালেও সাজা খুব সোজা প্রকৃতির ছিল না। মার্কিন উডকাট, অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতক।
আঙ্গেলা ফন বেঙালা, বাংলা থেকে কিডন্যাপ করে দাসব্যবসায়ীরা ডাচদের কাছে বিকিয়ে দেয় এনাকে। ১৬৫৭ সালে কেপ কলোনিতে এসে হাজির হন। ১৬৬৮তে মালিক মুক্তি দিয়ে দেন, ও তিনি খ্রীষ্টান হিসাবে ব্যাপ্টাইজ হন। ১৬৬৯ সালে ডাচ বুর্গার সমাজে বিয়েশাদী করে সেটলার শ্রেণীর অংশ হয়ে যান।
এই বইটিতে বাঙালী দাসরা কিভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনিতে এসে হাজির হয় তার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

যাই হোক, ধরলাম এইগুলি স্বভাবের ব্যতিক্রম। কিন্তু আমার মূল কথা হল, মার্কিনীরা গৃহযুদ্ধ করল এই নিয়ে, আর আমরা যুদ্ধ না করে পার পেয়ে গেলাম ব্রিটিশদের খাতিরে। যদি ব্রিটিশরা আমাদের ওপর খানিকটা ছড়ি না ঘোরাত— নাহয় তারা আর মার্কিনরাই এই প্রথার উচ্ছেদ করলো শুধু নিজেদের রাজ্যে — তাই যদি হতো, দাস কেনা-বেচাতে কি বাঙালী পিছিয়ে থাকত আরব কিংবা পর্তুগীজদের থেকে?

এই পেপারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এফ ডি ক্লার্কের বংশলতিকার বিশ্লেষণে বেরিয়েছে যে তার এক পূর্বপুরুষের নাম ‘ডায়ানা অফ বেঙ্গল’।
ইংল্যান্ডের ফ্রমে দাসপ্রথাবিরোধী অ্যাবসিশনিস্টদের সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তি, ১৮২৫।
১৮৩৩ সালের স্লেভারি অ্যাবলিশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তার সকল কলোনিতে দাসপ্রথা রহিত করে।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পর ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট বা কন্ট্রাক্ট লেবারের মার্কেট তৈরি হয়। ঊনবিংশ শতকের এই সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন এক বন্দরে আসা ব্রিটিশ কারুকারদের ফিরিস্তি দিয়ে তাদের দাম বলা হয়েছে।
ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট হিসাবে ভারতেরও কিছু অচ্ছুৎ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কুলি ও শ্রমিক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হাজির হয়।
১৮৬২তে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় বাংলাদেশের দাসপ্রথার বর্নণা।
ব্রিটিশরা ব্রিটিশ ভারতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করলেও নেটিভ রাজ্যগুলি, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায়, তখনো সেটা করতে পারেনি। ভারত সরকারের এগুলি বন্ধ করতে ষাটের দশক লেগে যায়।
নেপালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯২৫এ
১৯২৭এ বার্মায় ক্রীতদাস মুক্ত করতে গিয়ে মারা গেছে ব্রিটিশ সৈন্য
ভূটানে দাসপ্রথা রহিত হয় ১৯৬০এ
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!