ইউ পম গানা?

Featured Video Play Icon

“ইউ পম গানা?” মনে আছে নিশ্চয় অনন্ত জলিলের সেই ইন্টারভিউটার কথা? ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিংবা ‌অবচেতন মন থেকে হোক, জলিল সাহেব হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে বাঙ্গালীর বর্ণবাদী মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন।

বাঙ্গালী কতটা-কেন কৃষ্ণাঙ্গদের নিচুচোখে দেখে — সেটা নিয়ে বিতর্ক-গবেষণার অবকাশ আছে। হয়ত সুলতানি আমলে হাবশি ক্রীতদাসদের কূটচালে রাজা হওয়া দেখে প্রাথমিক খারাপ ধারণাটা তৈরি হয়েছে। তারপরে সম্ভবত ব্রিটিশ শাসকদের মাংকি-সী-মাংকি-ডু করে আফ্রিকানরা নিম্নগোত্রীয়, এই বিশ্বাসটা প্রগাঢ় হয়েছে। দ্য গডস্ মাস্ট বি ক্রেজ়ির মত ছবি আমার ছোটবেলায় সেই বিরূপ ধারণা ভাঙতে খুব একটা সাহায্য করেনি। (এর বিপরীতে অবশ্য ছিল কিং সলোমন’স মাইনসএর মত রোমাঞ্চকর উপন্যাস!)

আজকের ট্র্যাকটা পছন্দ করলাম বাঙ্গালী স্টেরেওটাইপিংটাকে যদি কিছুটা নড়বড়ে করে দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যে। গানের কণ্ঠশিল্পী ভ়িও ফ়ার্কা তুরে মালির অধিবাসী। বাবা আলি ফ়ার্কা তুরেও ছিলেন বিশ্বখ্যাত মিউজিশিয়ান। বিশ্বের কাছে মালির ট্র্যাডিশন্যাল গানবাজনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পিছনে তুরে সিনিয়র আর সিদকি ও তুমানি দিয়াবাতে বলে পিতা-পুত্র ‘কোরা’-বাদকের অনেক অবদান আছে।

যারা মার্কিন ব্লুজ় শুনেছেন, বিশেষ করে জন লী হুকারের গান, তারা এটা শোনামাত্রই বুঝবেন কতটা মিল! এর কারণ পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সাথে এই ধরনের সঙ্গীত আমেরিকায় আসে। তাদের সুরগুলি গীটারের জন্যে খুবই মানানসই ছিল। নতুন দেশে নিজেদের ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেললেও তারা সঙ্গীতকে হারায়নি।

এ ঐতিহ্য পশ্চিম আফ্রিকায় এক-দুই শতাব্দীর পুরনো নয়, কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর ধরে তারা সভ্যতার সাথে পরিচিত। মালির জেন্নে শহরে ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নগরসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতার মত নদীতীরে গড়ে উঠেছিল; সে নদীর নাম নিঝ়ের বা নাইজার — যার নামে নিঝ়ের ও নাইজেরিয়া দেশদু’টির নাম। আরবরা এই নদীর ডাকনাম দিয়েছিল ‘কৃষ্ণাঙ্গদের নীলনদ’।

অনন্ত জলিল যে গানা দেশটার নাম আমাদের কাছে সুপরিচিত করলেন, সেটা আসলে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান একটা শক্তিশালী সাম্রাজ্যের নাম। ব্রিটিশ ঔপনেবিশকতা থেকে সর্বপ্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত আফ্রিকার স্বর্ণসমৃদ্ধ দেশটির নাম গোল্ড কোস্ট থেকে পরিবর্তন করে রাখা হয় গানা। অষ্টম শতকে আরবরা উত্তর আফ্রিকাবিজয়ের পরে তাদের বাণিজ্যের কাফেলা সাহারার দক্ষিণেও বিস্তৃত হয়েছিল। গানা সাম্রাজ্যের শহরগুলি এ সময় ছিল সোনা-লবণ রপ্তানির মূল কেন্দ্র। গানার শাসকরা পরে ইসলামগ্রহণ করে নিজেদের রাজবংশকে আরো বৈধতা দেয়। তা হলেও অনেক প্রাক-ইসলামিক নিয়ম রয়ে গেছিল। যেমন মাতৃবংশীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থা, যে কারণে এক রাজার পরের রাজা হত তার ভাগ্নে, ছেলে নয়!

গানা সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পরে সেখানে অভ্যুদয় ঘটে মালি বা মান্দে সাম্রাজ্যের। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর এ রাজ্য সমৃদ্ধির শিখরে ছিল মোঙ্গলদের পরেই সেসময়ের সবচে’ বিস্তৃত সাম্রাজ্য। ইবনে খালদুন-ইবনে বতুতা মালি ভ্রমণের সময় তাদের বিপুল সামরিক লোকবল দেখে যেমন অভিভূত হয়েছিলেন, তেমনি অবাক হয়েছিলেন নারীপুরুষের একত্রে ওঠাবসা দেখে। মালির এক রাজা, বা মান্সা, মুসা কেইতা হজ্জ্বে গিয়েছিলেন বিশাল দলবল আর প্রচুর সোনা নিয়ে। তিনি যাত্রাপথে যেখানেই থেমেছেন সেখানেই বিলাসদ্রব্য কিনতে, এমনকি ভিক্ষা দিতেও, সোনা ব্যয় করেছিলেন। তাতে তখনকার পৃথিবীর সোনার সাপ্লাই রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বারো বছর ধরে নাকি সোনা অবমূল্যায়িত ছিল! মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়রাও এই কাহিনী অবগত ছিল, তাই তাদের তৈরি মানচিত্রে তিম্বাক্তু শহরের অবস্থান দেখানো শুরু হয়।

মালি সাম্রাজ্য স্থাপত্যশৈলী আর জ্ঞানবিজ্ঞানেও এগিয়ে ছিল। তাদের তৈরি অসাধারণ মসজিদ-মাদ্রাসা-মিনারগুলি এখনো তিম্বাক্তু, গাও শহরে দেখা যায়। সাঙ্কারে বলে এক মাদ্রাসায় গোটা বিশ্ব থেকে মনীষীরা আসতেন জ্ঞান আদান-প্রদানের জন্যে। মিশরের প্রাচীন আলেকজ়ান্দ্রিয়া লাইব্রেরির সাথে টেক্কা মারার মত পান্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল সেখানে।

মালি সাম্রাজ্যের অবনতির কারণ ছিল তাদের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, যেটার সুযোগ নিয়ে পড়শী সঙায় সাম্রাজ্য তাদেরকে পরাজিত করে। সেই যুদ্ধে মালির শাসকরা নব্য পরাশক্তি পর্তুগীজদের সাহায্য চেয়েছিল। জেনে হয়ত অবাক হবেন যে ইউরোপীয়রা সাম্রাজ্যবিস্তারের সুযোগটা তখন নেয়নি, তারা এটাকে মালির আভ্যন্তরীণ সমস্যা ভেবে পাশ কাটিয়ে গেছিল। অবশ্য সমুদ্রউপকূলে পর্তুগীজদের কেল্লা ছিল, সেসব থেকে তারা ইউরোপে ক্রীতদাস রপ্তানি করত। তাদেরকে লোক্যাল সাপ্লাই দিত কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ দালালরাই!

মালির পরে সঙায় সাম্রাজ্য বেশিদিন টেকেনি। পর্তুগীজ নয়, মরক্কোর সুলতানের পাঠানো সেনাবাহিনীর গোলন্দাজদের কাছে তারা হার মানে। সেই পরাজয়ের পরে গোটা সাম্রাজ্য ভেঙে অসংখ্য টুকরো হয়ে যায়, যারা নিজেদের মধ্যে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করে। ঊনবিংশ শতকে ফরাসীরা এদেরকে বশে এনে উপনিবেশ বানায়। তারপর ষাটের দশকে একে একে অনেকগুলি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। গানা, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মরিতানিয়া, গিনি, গিনি-বিসাউ, বুরকিনা ফাসো, নাইজেরিয়া, নিঝ়ের — এদের সকলেই গানা-মালি-সঙায়দের প্রাচীন ঐতিহ্যের দাবিদার।

‘পম গানা?’ প্রশ্নের উত্তর একটু লম্বা-চওড়া হয়ে গেল, অতএব ক্ষান্ত হলাম!
***

[সাফারে গানটার বিষয়বস্তু অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও বের করতে পারিনি। ফরাসী কোন ওয়েবসাইটেও লিরিক-ট্রান্সলেশন নেই। ইচ্ছে ছিল এ‌ই গানটার বদলে আলি ফ়ার্কা তুরের ‘আল্লা উইয়া’ গানটা শেয়ার করার, কিন্তু সেটার কোন লাইভ পারফর্ম্যান্স পেলাম না। লাইভে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যেভাবে দেখা যায়, স্টুডিও রেকর্ডিংয়ে সেটা সম্ভব নয়। আগ্রহী হলে এখানে শুনুন ‘আল্লা উইয়া’।]

বাঙ্গালীর দাসপ্রথা

আমেরিকার গৃহযুদ্ধের মূল কারণ ছিল ক্রীতদাসপ্রথার উচ্ছেদ। এখনো বর্ণবৈষম্যের ব্যাপারটা নিয়তই চলে আসে এদেশের রাজনীতির মধ্যে। আমাদের জন্য সেটা কেমন ছিল?

চর্যাপদের আবিষ্কর্তা হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন বাঙ্গালী আত্মভোলা একটা জাত। সেকথা এক্কেবারে ঠিক! বাঙ্গালীর ইতিহাসেও দাসপ্রথা ছিল এবং এখনো আছে। সে নিজে দাস হয়েছে, আবার ক্রীতদাসের মালিক হতেও তার খুব একটা বাঁধেনি।

প্রথমে বলি কবে কোথায় আমাদের স্বজাতি দাসত্বের শৃঙ্খল পরেছিল। অনেকে ভুল আন্দাজ করবেন যে মুসলিম শাসনামলে এর শুরু। ইসলামের আগেও আরবদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল। ইসলামে ক্রীতদাসের সাথে সদাচরণ করতে বলা হলেও সেটাকে বিলুপ্ত করা হয়নি। সে কারণে নানাযুগে মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে হাবশী-তুর্কী দাসেরা এদেশে এসেছে। আবার তারা নিজেরাও একসময় রাজা বনেছে, যেমন দিল্লীর মামলুক, বাংলার হাবশী রাজ্য। এইসব রাজারা সবাইই যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন এলাকা থেকে পরাজিত গোষ্ঠীর নারী-পুরুষ-শিশুদের ধরে দাস হিসেবে পৃথিবীর আনাচেকানাচে বিক্রি করে দিয়েছে।

দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের প্রতিষ্ঠাতা কুতুব মিনার খ্যাত কুতব আলদ্বীন আইবক (১১৫০-১২১০) শিশুকালে দাস হিসাবে বিক্রিত হন। তুর্কীস্তানের অধিবাসীদের দাস হিসাবে চাহিদা ছিল, কারণ প্রশিক্ষণ দিলে তারা ভাল সৈন্য হত। ছবিতে লাহোরস্থিত আইবকের সমাধি।
ভারতের গুজরাতের নেটিভ রাজ্য সাচিনের নবাব দ্বিতীয় ইব্রাহিম মোহাম্মদ ইয়াকুত খান (নবাবীর কাল, ১৭৯১-১৮০২)। জাঞ্জিরা দ্বীপের আফ্রিকান সুন্নি মুসলিম রাজবংশে জন্ম। তার পূর্বসূরীরা সুলতানী আমলে দাস হিসাবে ভারতে এসেছিল, পরে সম্রাটের অনুগ্রহে রাজত্ব পায়।

কিন্তু এই অভিশাপ শুধু মুসলিম শাসনামলেই ছিল না। জীমূতবাহনের দায়ভাগে আমরা দেখতে পাই দ্বাদশ শতাব্দীর হিন্দু উত্তরাধিকারবিধিতে দাসীর উল্লেখ, তারও আগের বৌদ্ধ বিনয়পিটকেও দেখি দাসেদের ভিক্ষু হওয়া বারণ। বলা বাহুল্য, খ্রীষ্টধর্মেও যীশু এপ্রথার বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলে যাননি, যার ফলে সন্ত পল দাসদের উপদেশ দিয়েছেন মালিকের প্রতি বিশ্বস্ত হতে। শ্বেতাঙ্গরাও অতীত আর বর্তমানকালে দাসত্বের শৃংখল পরেছে, সেকথা সুযোগ হলে অন্য সময়।

প্রাগাধুনিক যুগে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনার সাথে সাথে দাসবাণিজ্য আরও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছিল। পর্তুগীজ হার্মাদ জলদস্যু আর বার্মার আরাকানের মগ দুয়ে মিলে ষোড়শ শতকে দক্ষিণ বাংলার সুন্দরবন, সন্দ্বীপ আর চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রায়ই লুট তরাজ চালিয়ে দাস ধরে নিয়ে যেত — যাকে আক্ষরিক অর্থেই বলা হতো ‘মগের মুল্লুক’। অন্যদিকে মোঘলরা ছিল দাসপ্রথার বিরোধী (আওরঙ্গজেব বাদে), তারা ১৬৬৬ সালে চট্টগ্রাম দখল করে এই মুল্লুকের সমাপ্তি ঘটায়।

মনুস্মৃতিতে জীমূতবাহনের দায়ভাগে দাসীর ঔরসে সন্তান জন্মালে কিভাবে সম্পত্তি ভাগ হবে তার নিয়ম।
বৌদ্ধ বিনয়পিটক অনুযায়ী দাসদের ভিক্ষু হওয়া বারণ।
সেন্ট পল দাসদের বলে গেছেন মনিবের প্রতি অনুগত থাকতে।
কুরআন অনুযায়ী দাসদাসীদের সাথে কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তার নিয়ম।

প্রায় একই সময়ে, সপ্তদশ শতকে, ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (VOC) কাশিমপুর, হুগলী এসব জায়গায় ঘাঁটি গাঁড়ে। তারা লুটতরাজ করত না, কিন্তু দাস কেনাবেচা সেখানে ঠিকই চলত। এসব দাসদের কারা এনে তাদের হাতে সমর্পণ করত, তার কাগজেকলমে প্রমাণ না থাকলেও আন্দাজ করা যায় অনেক ক্ষেত্রে এদের পরিবারের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত কর্তাই হয়ত পেটের দায়ে সে কাজটি করেছেন, নয়ত বাঙ্গালী বা অন্য ভারতীয় বেনিয়া-ছেলেধরাদের কাজ। ইন্দোনেশিয়ার বাতাফিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে এসব দাসের অধিকাংশ গিয়ে পৌঁছায়, এখনও তাদের বংশধররা সেখানে আছেন, কিন্তু নিজ সংস্কৃতি-ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলেরা অনেকে সেখানে করেছে হাঁড়ভাঙা খাটুনি, আর মেয়েদের চাহিদা ছিল ভাল সেবক আর সূঁচকর্মী হিসাবে, কারও কারও ভাগ্যে পণমুক্তি আর ওলন্দাজ জামাইও জুটেছিল। সেদেশের এককালীন শ্বেতাঙ্গ-আধিপত্যবাদী প্রেসিডেন্ট ডিক্লার্কেরও ধমনীতে নাকি বাংলার রক্ত আছে।

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিও (EIC) কিছুটা সময় মাদ্রাজ আর কলকাতা থেকে এসব করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্যে ভাঁটা পড়া শুরু হল ব্রিটিশদের কারণেই। ১৮৩৩ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে দাসপ্রথা আইন করে বন্ধ করে দেয়, আর তাদের সমুদ্রে কোন দাসবাহী জাহাজ পেলে সেটা দখল করে দাসদের মুক্তি দেয়া শুরু করে। অবশ্য এতে করে অন্য ধরনের দাসত্বও শুরু হয়ে যায়, সেটা ক্রয়বিক্রয়ের দাস নয়, একে বলে চুক্তিভিত্তিক দাসত্ব। ভারতে অবশ্য তখনও ব্রিটিশরা দেশীদের ভিতরে ক্রীতদাস-প্রথা সহ্য করত, অভ্যন্তরীণ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নাক গলাতে এসে ঝামেলা পোহাতে চাইত না। অবশেষে তারা সেটাও আইন করে বন্ধ করে ১৮৬১ সালে।

১৬০১এর এনগ্রেভিংয়ে পূর্ব ইউরোপীয় জনগণকে গলায় দড়ি বেঁধে দাস হিসাবে নিয়ে যাচ্ছে তুর্কী অটোমান সেনাদল।
ঊনবিংশ শতকে আলজিয়ার্সের মুসলিম শাসকরা মার্কিন ও ইউরোপীয় জাহাজ দখল করে তার নাবিকদের দাস হিসাবে ব্যবহার করত।
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রের বিজ্ঞপ্তিতে পালিয়ে যাওয়া আইরিশ চাকরানীর সন্ধানের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
ঊনবিংশ শতকের মার্কিন সংবাদপত্রে পালিয়ে যাওয়া স্কটিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্টের জন্যে পুরস্কারের ঘোষণা
আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট পরিবার। ঊনবিংশ শতকে পটাটো ফ্যামিনের সময় প্রচুর আইরিশ চাকর হিসাবে আমেরিকায় আসে।

এখন বলি বাঙ্গালী কখন নিজে হয়েছে দাসের মালিক। ঐযে কেপ টাউনের কথা বললাম, সেখানেই কিছু কিছু বঙ্গীয় মুক্তি-অর্জনের পরে নিজেই স্বদেশ-বিদেশ থেকে আনা দাস ক্রয় করত। সেটা ১৭০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত একশ’ বছরেরও বেশি সময় ধরে। আরো পরে, এমন কী ১৮৬২ সালে সিডনি মর্নিং হেরাল্ডে ইন্ডিয়ান রিফরমার পত্রিকা থেকে পুনর্প্রকাশিত একটা খবর পড়লাম, তাতে প্রতিবেদক অভিযোগ করছেন যে পূর্ববঙ্গের ঢাকা, বরিশাল, বিক্রমপুর, ফরিদপুর, পাবনা, ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম – এসব জায়গায় নাকি গোলাম-বাঁদি কেনাবেচা চলে। এদের কেউ আক্ষরিক অর্থেই ক্রীতদাস, আর কেউ কেউ চুক্তিভিত্তিক। মফস্বলের জমিদারদের মধ্যে দাস কেনা-বেচা আর উপহার হিসাবে আদান-প্রদানও চলত পুরোদমে। সেসময়কার এরকম আরও অন্তত দুটো খবর ইন্টারনেটে খুঁজে পাই।

আধুনিক বাংলাদেশে সেই প্রথা কি এখন সম্পূর্ণ বিলুপ্ত? আমার শ্রদ্ধেয় এক অগ্রজ আলোকচিত্রী, আর তার স্ত্রী (হফস্ট্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক), এই একবিংশ শতকেই বাংলাদেশের দুবলার চরে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন আধুনিক দাসত্ব। শুঁটকির ফ্যাক্টরিতে কর্মরত আর শিকলপরা কিশোরদের প্রচুর ছবি আমাকে দেখিয়েছেন, এমনকি এক ছেলেকে উদ্ধার করেও নিয়ে এসেছিলেন। এরকম আরও নানারকম দাসত্ব আমাদের দেশে প্রতি নিয়ত দেখতে পাই।

সপ্তদশ/অষ্টাদশ শতকে আমেরিকার কলোনিগুলিতে ইংলিশ কনভিক্টদেরও কেনাবেচা চলত
সাদা দাসদাসীদের কপালেও সাজা খুব সোজা প্রকৃতির ছিল না। মার্কিন উডকাট, অষ্টাদশ/ঊনবিংশ শতক।
আঙ্গেলা ফন বেঙালা, বাংলা থেকে কিডন্যাপ করে দাসব্যবসায়ীরা ডাচদের কাছে বিকিয়ে দেয় এনাকে। ১৬৫৭ সালে কেপ কলোনিতে এসে হাজির হন। ১৬৬৮তে মালিক মুক্তি দিয়ে দেন, ও তিনি খ্রীষ্টান হিসাবে ব্যাপ্টাইজ হন। ১৬৬৯ সালে ডাচ বুর্গার সমাজে বিয়েশাদী করে সেটলার শ্রেণীর অংশ হয়ে যান।
এই বইটিতে বাঙালী দাসরা কিভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ কলোনিতে এসে হাজির হয় তার ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

যাই হোক, ধরলাম এইগুলি স্বভাবের ব্যতিক্রম। কিন্তু আমার মূল কথা হল, মার্কিনীরা গৃহযুদ্ধ করল এই নিয়ে, আর আমরা যুদ্ধ না করে পার পেয়ে গেলাম ব্রিটিশদের খাতিরে। যদি ব্রিটিশরা আমাদের ওপর খানিকটা ছড়ি না ঘোরাত— নাহয় তারা আর মার্কিনরাই এই প্রথার উচ্ছেদ করলো শুধু নিজেদের রাজ্যে — তাই যদি হতো, দাস কেনা-বেচাতে কি বাঙালী পিছিয়ে থাকত আরব কিংবা পর্তুগীজদের থেকে?

এই পেপারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রাক্তন শ্বেতাঙ্গ প্রেসিডেন্ট এফ ডি ক্লার্কের বংশলতিকার বিশ্লেষণে বেরিয়েছে যে তার এক পূর্বপুরুষের নাম ‘ডায়ানা অফ বেঙ্গল’।
ইংল্যান্ডের ফ্রমে দাসপ্রথাবিরোধী অ্যাবসিশনিস্টদের সম্মেলনের বিজ্ঞপ্তি, ১৮২৫।
১৮৩৩ সালের স্লেভারি অ্যাবলিশন অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার তার সকল কলোনিতে দাসপ্রথা রহিত করে।
দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণার পর ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট বা কন্ট্রাক্ট লেবারের মার্কেট তৈরি হয়। ঊনবিংশ শতকের এই সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে মার্কিন এক বন্দরে আসা ব্রিটিশ কারুকারদের ফিরিস্তি দিয়ে তাদের দাম বলা হয়েছে।
ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট হিসাবে ভারতেরও কিছু অচ্ছুৎ জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কুলি ও শ্রমিক হিসাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে হাজির হয়।
১৮৬২তে সিডনি মর্নিং হেরাল্ড পত্রিকায় বাংলাদেশের দাসপ্রথার বর্নণা।
ব্রিটিশরা ব্রিটিশ ভারতে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করলেও নেটিভ রাজ্যগুলি, বিশেষ করে দুর্গম এলাকায়, তখনো সেটা করতে পারেনি। ভারত সরকারের এগুলি বন্ধ করতে ষাটের দশক লেগে যায়।
নেপালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয় ১৯২৫এ
১৯২৭এ বার্মায় ক্রীতদাস মুক্ত করতে গিয়ে মারা গেছে ব্রিটিশ সৈন্য
ভূটানে দাসপ্রথা রহিত হয় ১৯৬০এ
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!