হাইতি – ৩, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাইতি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও, সম্মানজনক অবস্থান ঊনবিংশ শতকে ছিল না। দুটি দেশই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। বিশেষত, হাইতিতে ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকরা সপরিবারে গণহত্যার শিকার হয়। ফ্রান্স তাই হাইতিকে তাদের উপনিবেশই ধরত, আর বাকি ইউরোপীয় শক্তিগুলি ফ্রান্সের আগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী ছিল না।

তাই হাইতির বন্দরগুলিতে মার্কিন, জার্মান আর ব্রিটিশ জাহাজের আনাগোনা থাকলেও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি করার সামর্থ্য হাইতি সরকারের ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে ফ্রান্স হাইতিতে দূত পাঠায়। তাদের শর্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ফরাসী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জরিমানা দিলে ফ্রান্স হাইতিকে স্বীকৃতি দেবে।

উত্তর হাইতির রাজা ক্রিস্তফ ফরাসীদের একদমই বিশ্বাস করতেন না। তার দরবারে পাঠানো ফরাসী দূতকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। ঠিক তখনই দূতের হাত থেকে গোপন ফরাসী সরকারী নির্দেশনা এসে পড়ে ক্রিস্তফের কাছে। তার ভয় অমূলক ছিল না! দূতের কাছে নির্দেশ ছিল, শর্তে রাজি না হলে নিকটস্থ ফরাসী নৌবাহিনীকে সংকেত পাঠাতে, যেন তারা ক্রিস্তফের বন্দরগুলিতে আক্রমণ চালায়।

এসব নাটকীয়তার ফলে ফরাসীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারটা পিছিয়ে এসে পড়ে ১৮২৫ সালে। রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরের কাছে ফরাসীরা আবার দূত পাঠায়। ক্ষতিপূরণের অংক তারা ঠিক করে পনের কোটি ফ্রাংক — আজকের হিসাবে ৩৫০ কোটি ডলার! সামর্থ্যে না কুলালে ফরাসী ব্যাংকও প্রস্তুত রয়েছে দীর্ঘকালীন ঋণ দিতে!

হাইতির সরকারী বাজেট কমিশন এই ব্যাপারে না আগাতে বোয়াইয়েরকে সুপারিশ করে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের তার তোয়াক্কা না করে এতে রাজি হয়ে যান। এই একতরফা সিদ্ধান্তের মাশুল হাইতিবাসীকে গুনতে হবে প্রায় একশ বিশ বছর! সুদে-মূলে যত টাকা এতে খরচ হবে, তাতে হাইতিতে উন্নতমানের জনপথ-নৌবন্দর-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল হতে পারত অনেক।

ফরাসী দূতের সাথে ইনডেমনিটি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের, ১৮২৫। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত ফরাসী বইয়ে দেখানো চিত্র।

হাইতির সরকারী কোষাগারের সীমিত সম্পদের সিংহভাগই খরচ হয়ে যেত সেনাবাহিনী পালতে। তাদের মূল কাজটা আবার দেশরক্ষার চেয়ে বেশি বিপ্লবীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। হাইতির বাজেটের ১ শতাংশেরও কম খরচ হত শিক্ষাক্ষেত্রে। বোয়াইয়ের চাইলে ফরাসী দাবি কানে না তুলে সরাসরি তাদের প্রতিযোগী জার্মানি আর আমেরিকার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগ দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির রাস্তা কার্যত তৈরি হয়ে যেত।

বোয়াইয়েরের তো জাতীয়তাবাদী অহংকার ছিলই, তাছাড়াও তিনি হিসাব কষেছিলেন যে ফ্রান্সের স্বীকৃতি পেলে হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে। তা বেড়েছিল কিছুটা, কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় হাইতি। মুক্তবাণিজ্যের রাস্তা ধরে হাইতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। জার্মান বণিকরা হাইতির বন্দরগুলিতে আমদানি-রপ্তানির কারখানা খুলে বসে। আইনানুযায়ী তারা সম্পত্তির মালিক হতে না পারলেও, স্থানীয় নাগরিক বিয়ে করে সে আইন পাশ কাটানো সম্ভব ছিল।

তাও যদি হাইতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকত, মুক্তবাণিজ্য আর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্তি আর সমৃদ্ধি আসতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরকে তাড়িয়ে সম্রাট সুলুক, তারপর ১৮৫৯এ তাঁকেও খেদিয়ে রাষ্ট্রপতি জেফ্রার — এভাবে ১৮৪৩ থেকে ১৮৮৯এর মধ্যে ১২জন রাষ্ট্রনায়ক দেশ পরিচালনা করেন, আর গঠনতন্ত্র পরিবর্তিত হয় ৮বার। কিন্তু আসল সমস্যাগুলির কোন পরিবর্তন হয় না।

মার্কিন ম্যাগাজিন হার্পারস উইকলিতে হাইতির নতুন প্রেসিডেন্ট সালনাভের ছবি, ১৮৬৭। একই পৃষ্ঠার নিচে ডানের চিত্রঃ আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির একটি স্থানীয় নির্বাচনে।

প্রদেশগুলিতে সেনাশাসকরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বড় খামারগুলো তাদের অফিসারদের দখলে। নির্বাচন হলেও সেগুলি নামেমাত্র, আর ফলাফল পছন্দ না হলে তো বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের রাস্তা আছেই! রাষ্ট্রপতি গদিতে বসামাত্রই প্রাসাদে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এমন ঘাঁটি গাড়তেন, যেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তিনি!

এসব গোলমালের ফলে বৈদেশিক সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জার্মান বা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষতি সাধিত হলে, সেসব দেশের যুদ্ধজাহাজ হাইতির সাগরে টহল দিত আর বন্দরগুলির দিকে কামান তাগ করে থাকত। ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকত হাইতির বন্দর ও বাণিজ্য।

হাইতির আরও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। ফ্রান্সের সেই ইনডেমনিটির কিস্তি শোধ করতে গিয়ে আরো পর্যায়ক্রমিক ঋণ হাইতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। ১৮৬০এর দশকে বাজেটের ৩০% যেত সামরিক খাতে আর ২৫% ধারের কিস্তি পরিশোধ করতে। ১৮৯৮ নাগাদ ধারশোধের ভাগ হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ১৯১৩ নাগাদ ৬৭%। এক পর্যায়ে ফরাসী একটি ব্যাংক হাইতির কোষাগারের ‘ইজারা’ নেয়, তারাই ছাঁপাত হাইতির ব্যাংকনোট, আর সেভাবে দেশটির অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্স।

জার্মান অ্যালবামে ছাঁপানো হাইতির অনুপম দৃশ্যাবলী, ঊনবিংশ শতকে বহু জার্মান অভিবাসী হাইতিতে আবাস গাড়ে। ১৮৯৭ সালে ছাঁপানো এনগ্রেভিং।
১৮৯৭ সালে জার্মান এক নাগরিককে হাইতির আইনশৃংখলাবাহিনী চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে জার্মানি শার্লট নামে এই যুদ্ধজাহাজ পাঠায় হাইতিতে, শক্তিপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে তার নাগরিককে মুক্ত করার প্রয়াস। ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলি এরকম নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে হাইতিকে। ফিরম্যাঁর মত কূটনীতিবিদদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কস্থাপন করে ইউরোপীয়দের প্রভাবহ্রাস।

এ সময়টা অবশ্য পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গার মত হাইতির শিল্প-সংস্কৃতির জন্যেও একটা রেনেসাঁর যুগ ছিল। আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষিত গুণীজন আর অভিবাসীদের সমাগমে হাইতির শহরগুলিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এরাই নানা সময়ে হাইতির একনায়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যদিও তাদের বিপ্লবগুলিতেই নিহিত ছিল নতুন কোন একনায়কতন্ত্রের বীজ।

১৮৭০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারক জোসেফ হোলি দানের টাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের হাইতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে অভ্যাস না থাকায় রোগে-জরায় এদের অনেকে মারা যায়।

একই সময়ে ইউরোপীয় খ্রীষ্টান মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ে আসেন হাইতিতে। গ্রামাঞ্চলের দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয় সনাতন বিশ্বাসীদের সাথে। সহজ-সরল গ্রাম্য হাইতিবাসী ছিল কুসংস্কারাচ্ছ্ন্ন, ভুডুতে বিশ্বাসী। বহুবিবাহেরও প্রচলন ছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এসবের পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ভুডুবিশ্বাসীদের নরবলি-নরমাংসভক্ষণের গুজব হাইতির শহরগুলিতেও শোরগোল তোলে। স্বদেশের পশ্চাদপসরতা নিয়ে একটা হীনমন্যতা গড়ে ওঠে শহরবাসী দোআঁশলা সুধীসমাজের মধ্যে। তারাও উঠে পড়ে লাগে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। রাজনীতিতেও সেসবের প্রভাব এসে পড়ে।

হাইতির নতুন শিক্ষিত কাতারের একজন ছিলেন অঁতেনর ফিরম্যাঁ। পেশায় সাংবাদিক, ফ্রান্সে কাটিয়েছেন যুবাবয়স। ইউরোপে তখন ‘রেইস থিওরি’ নামে একটি সিউডোসায়েন্টিফিক তত্ত্ব বেশ চালু। এ তত্ত্বের প্রবক্তরা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ককেশিয়ান আর্যজাত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম, আর কৃষ্ণাঙ্গরা গায়েগতরে শক্তি ধরলেও মগজের জোরে সকলের অধম। ফিরম্যাঁ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একটি বই প্রকাশ করে এদের যুক্তিখন্ডন করেন। এসব গবেষণা করতে গিয়ে হাইতির বহু লোকসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এভাবে পুরোদস্তুর নৃতত্ত্ববিদ বনে যান।

১৮৮৯ সালে ফিরম্যাঁ দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাইতির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা হলেও ফিরম্যাঁ পপুলিস্ট রাজনীতিতে একদম বিশ্বাস করতেন না। তার দর্শন ছিল, দেশ পরিচালনার জন্যে দরকার হাতেগোনা কিছু অভিজ্ঞ দেশপ্রেমী নেতা। ফিরম্যাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হাইতির শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

অঁন্তেনর ফিরম্যাঁ (১৮৫০-১৯১১), হাইতিয়ান রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ১৮৮০র দশকের আগে হাইতিকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পার্শ্ববর্তী ডমিনিকান রিপাবলিকের ঋণলাঘবের বিনিময়ে নতুন স্টেট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের একটা কথাবার্তা অনেকদিন চলে। কিন্তু মার্কিন সেনেট সে প্রস্তাবনা ১৮৭৪এ নাকচ করে দেয়।

হিস্পানিওলা দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বাড়তে শুরু করে স্টীমশিপের কারণে। স্টীমশিপ তখনকার বিশ্বকে সংযুক্ত করে ফেলেছে, আরেক গ্লোবালাইজেশনের যুগ চলছে তখন (জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ রচনার সময়কাল ১৮৭২)। আটলান্টিক অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটে ৭ দিন! কিন্তু স্টীমশিপের জন্যে যেটা বেশ জরুরী সেটা হল কোলিং স্টেশন — এঞ্জিনে কয়লা ভরার বন্দর। প্রশান্ত মহাসাগরে এর প্রয়োজন থেকেই জাপানের বন্দরগুলি উন্মুক্ত করতে ১৮৫৪তে মার্কিন অ্যাডমিরাল পেরিকে পাঠানো হয়। হাইতিও ছিল ক্যারিবিয়ান এলাকায় কোলিং স্টেশনের একটা উত্তম অবস্থান।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টাকা ধার করে হাইতি সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। বছরে বছরে বিপ্লবের ফলে বিনিয়োগকারীদেরও কোন নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে হাইতির রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলিং স্টেশনের চাহিদাপূরণের তেমন কোন উপায় ছিল না, বিশেষ করে যখন ফিরম্যাঁর মত রাজনীতিবিদ ও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন চাইছে। হাইতিতে হস্তক্ষেপের যত অজুহাত ও লেভারেজ দরকার, সবই যুক্তরাষ্ট্রের ছিল।

১৮৮৯ সালে হাইতির মোল-স্যাঁ-নিকোলা দ্বীপে নৌঘাঁটি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি লেজিতিমকে পীড়াপিড়ি করে। তাতে কাজ না হওয়ায়, উত্তর হাইতির বিদ্রোহীদেরকে তারা ইন্ধন দিতে শুরু করে — ফিরম্যাঁ ছিলেন এদলে। উত্তরের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়। নির্বাচিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন অঁতেনর ফিরম্যাঁ।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা ফিরম্যাঁকে বেশ সম্মান করত। দ্বিপাক্ষিক সংলাপে সরাসরি অংশ নেন ফিরম্যাঁ ও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির পথিকৃত ফ্রেডরিক ডগলাস। প্রাক্তন দাস ডগলাস হাইতিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু হাইতির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ডমিনিকান রিপাবলিক মার্কিন স্টেট হলে কিংবা ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান ছোট দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নিলেই তাদের মঙ্গল হবে, এটা ছিল ডগলাসের দৃঢ় বিশ্বাস। অর্থাৎ এসব কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দেশগুলির একরকম মার্কিন ‘উপনিবেশায়ন’ ফ্রেডরিক ডগলাস নিজেই সমর্থন করতেন।

ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৭-৯৫), প্রাক্তন দাস, মার্কিন কূটনীতিক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক, অ্যাবলিশনিস্ট, ১৮৭২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, হাইতিতে প্রেরিত মার্কিন দূত (১৮৮৯-৯১)।

ফিরম্যাঁ ডগলাসের সাথে সংলাপ চালিয়ে গেলেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি, কারণ সংবিধান অনুযায়ী হাইতির সীমানায় বিদেশীদের কাছে জমিবিক্রি বারণ। ডগলাসও ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান হাইতিকে চাপাচাপি না করার জন্যে। সে কথা গায়ে না মেখে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা সাতটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান হাইতির সাগরে, তখন ফিরম্যাঁই প্রথম মার্কিন নৌবন্দরের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার লেখা প্রতিবাদলিপির বাগ্মীতার কাছে হার মেনে মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। ডগলাসও বেশ মনোক্ষুন্ন হন।

এরপর ফিরম্যাঁ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। মার্কিনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজ করার জন্যে কিছু প্রস্তাবও তোলা হয়। তার একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তির মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতির সেনেটর মনোনয়নের ক্ষমতা রহিত করা হয়। আরো বহু মানুষকে ভোটাধিকারের আওতায় আনা হয়।

সংস্কারের বিষয়গুলিতে সামরিক বাহিনীর অবশ্য সায় ছিল না। শীঘ্রই আবার হাইতির উত্তরাঞ্চলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকার অপসারিত হয়। এবার ফিরম্যাঁ স্বয়ং নির্বাচনে দল নিয়ে অংশ নিলেন। তার সমর্থকরা অধিকাংশ ছিল যুবাবয়সী ও পেশাজীবী শহুরে মানুষ। তার মূল প্রতিপক্ষ উত্তরের সেনাশাসক জেনারেল নোর্-অ্যালেক্সিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তার রেশ ধরে অ্যালেক্সিস ফিরম্যাঁপন্থীদের মার্কিন তাঁবেদার আখ্যা দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন।

ফিরম্যাঁপন্থীদের সাথে একদফা সংঘর্ষে জয়লাভ করে অ্যালেক্সিসপন্থীরা। ফিরম্যাঁ প্রাণভয়ে নিকটবর্তী সেন্ট টমাস দ্বীপে পালিয়ে যান। তাঁর বসতবাড়ি-লাইব্রেরি তছনছ করে ফেলে অ্যালেক্সিসের সৈন্যরা। নির্বাচনের যেটুকু ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে ফিরম্যাঁর দল বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে ফিরম্যাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণীজনের সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় হাইতির জনগণ।

জেনারেল পিয়ের নোর্-অ্যালেক্সিস (১৮২০-১৯১০), হাইতির রাষ্ট্রপতি (১৯০২-১৯০৮), যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফিরম্যাঁকে জোর করে রাষ্ট্রপতি হতে না দিলেও শেষমেশ বিপ্লবের মুখে গদি ছাড়তে হয় তাকেও।

আসলে হাইতির জন্মলগ্ন থেকেই বাইরের মানুষকে তাদের গভীর অবিশ্বাস। তারা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, এতটাই যে স্বদেশী সরকারের শাসনেও অবদমিত হয় না তারা। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অহংকারী অকর্মণ্য নেতাদের কারণে দায়িত্বশীল পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য নীতি হাইতির ছিল না। এসবের কর্মফল ফিরম্যাঁ নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

ফিরম্যাঁ বলেছিলেন, উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্রই হাইতির ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। হাইতিবাসীর সামনে একটাই পথ: নিজেদের বিবাদ-বিভক্তি ছেড়ে সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে সে দানবই হাইতিকে আপাদমস্তক গিলে খাবে। ফিরম্যাঁপন্থীদের বিফলতায় প্রমাণ হয়ে গেল, হাইতি বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথটিই।

১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য।
১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য, একশ বছরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
বন্দরে মার্কিন বাণিজ্যজাহাজ থেকে ময়দার বস্তা নামাচ্ছে খালাসীরা, ১৮৯০ থেকে ১৯০০র মধ্যে তোলা ছবি।

হাইতি – ২, রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

হাইতির স্বাধীনতার ঘোষণায় দেসালিন প্রজাদের জন্যে একরকম সাবধানবাণী লিখে রেখে গিয়েছিলেন। যেদিন নেতাদের আদেশ পালনের দায়িত্ব হাইতির জনগণ বিস্মৃত হবে, সেদিন আবার ভিনদেশের পরাধীনতার শৃংখল পরবে তারা। একরকম প্রচ্ছন্ন হুমকি আর কি!

হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মত জনপ্রতিনিধি-সম্মেলন ডেকে সংবিধানপ্রনয়ণ না হয়ে দেসালিনের অঙ্গুলিহেলনেই সব কিছু চলতে থাকল। লুভেরত্যুরের আমলেও ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সম্মেলনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাঠিয়েছিল হাইতি। সেসবের ধার না ধেরে সহসা সম্রাট বনে বসেন দেসালিন। এ যেন প্রতিপক্ষ ফরাসী সম্রাট নাপোলেওঁকে কাঁচকলা দেখানো!

নাপোলেওনের সময়েও ফরাসীর পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেওল ভাষায় সরকারী ঘোষণা প্রকাশ করা হত। দেসালিন জনসাধারণের বোধগম্য এই ভাষাটাও পরিত্যাগ করেন। ভাবটা এমন যে, হাইতির অধিকাংশ মানুষ গ্রাম্য মূর্খ, তাদের এত দাম দিয়ে কোন ফায়দা নাই! ফরাসীভাষী শহুরে এলিট আর প্রাদেশিক সামরিক শাসকদের কথামতই দেশ চলবে।

হাইতির প্রথম রাষ্ট্রপতি ও সম্রাট দেসালিন (জীবৎকাল: ১৭৫৮-১৮০৬, শাসনকাল: ১৮০৪-০৬)। ফরাসী ছিন্নমস্তক হাতে। তাঁর আমলে হাইতির অবশিষ্ট ফরাসী শ্বেতাঙ্গদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে। ১৮০৪ সালের এনগ্রেভিং।
দেসালিনের স্বাধীনতার ঘোষণার পোস্টার, ১৮০৪। হাইলাইটেড অংশের অনুবাদ: “If you ever refused or grumbled while receiving those laws that the spirit guarding your fate dictates to me for your own good, you would deserve the fate of an ungrateful people.”
সম্রাট দেসালিনের রাজ্যাভিষেক, ১৮০৪।
দেসালিনের সম্রাট হবার প্রেরণা ফরাসী সম্রাট নাপোলেওনের থেকে এসে থাকতে পারে। তিনি ১৮০৪ সালে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন।

স্বেচ্ছাচারী শাসন করতে গিয়ে অবশ্য শীঘ্রই জনরোষের শিকার হন সম্রাট দেসালিন। প্রথমত, ভূমিদাসভিত্তিক খামার ব্যবস্থার কোন সংস্কার তিনি করেননি। দ্বিতীয়ত, দোআঁশলা মুলাটো শিক্ষিতশ্রেণীর সাথে তাঁর বেশি দহরমমহরম হাইতির মানুষ ভাল দৃষ্টিতে দেখেনি। তৃতীয়ত, প্রাদেশিক সেনাপ্রধানদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন তিনি।

১৮০৬ সালে তাঁরই দুই সহযোদ্ধা আলেকসন্দ্র পেতিওঁ আর অঁরি ক্রিস্তোফ আঁতাত করে অনুগত সেনাদল নিয়ে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসে প্রবেশ করেন। বিদ্রোহী জনগণ রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ থেকে সম্রাটকে রাস্তায় টেনে বের করে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, দেসালিনের মৃতদেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তারা।

রাষ্ট্রের স্থপতির এমন পরিণতি হাইতির ভবিষ্যতের জন্যে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দেসালিনের প্রাক্তন দোসররা তাঁর সৎকারের বালাই না করে ডাকলেন জনপ্রতিনিধির সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রের আদলে দ্বিকক্ষ সংসদ আর ত্রিমুখী ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব করা হল। সেনেটের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে যাবার ব্যাপারটা আবার ক্রিস্তফের পছন্দ হলো না। ছোটখাট একটা গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেল পেতিওঁ-ক্রিস্তফের মধ্যে, কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারলেন না।

দেসালিনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ কবরস্থ করার আর কেউ ছিল না, কেবল এক পাগলিনী দেফিলে সহমর্মী হয়ে সে দায়িত্বপালন করে, ১৮০৬।

ক্রিস্তফ তার দলবল নিয়ে হাইতির উত্তরাংশে গিয়ে নিজেকে রাজা দাবি করে বসলেন। বনেদী পদবীগুলি দেয়া শুরু করলেন কাছের মানুষদের। প্রজাদের শিক্ষাদীক্ষায় অবশ্য তার মনোযোগ ছিল। রাজধানী ল্যকাপে একটা মেডিকাল স্কুলও চালু করেন তিনি।

প্রাক্তন গৃহপালিত চাকর, আর এখন রাজা, ক্রিস্তফ বিশাল সঁসুসি প্রাসাদ তৈরি করেন। আরো তৈরি হয় সিতাদ্যাল লাফেরিয়ের বলে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা লিখে যান, শেকলপরা কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’ কঠোর পরিশ্রম করে নাকি এগুলি তৈরি করেছে। হাজারে হাজারে নাকি মারাও গেছে সে কাজে। ‘দাস’ কথাটা সম্ভবত সত্য নয়, কিন্তু ‘কোর্ভে লেবার’ বা সরকারের ‘উন্নয়নকাজে’ বাধ্যতামূলক শ্রমপ্রদানের ব্যাপারটা ক্রীতদাসপ্রথামুক্ত হাইতির সকল শাসকই সমানে ব্যবহার করেছেন। এ শ্রমিকরা বেতন পেত না, খুব একটা ভাল ব্যবহার তদারককারী সৈন্যদের কাছে পেতও না, বন্দুকের বাঁট কিংবা বেয়নেটের ব্যবহার চলত সমানে। আর লেবারক্যাম্পে বন্দীজীবন কাটাতে হত।

উত্তর হাইতির রাজা অঁরি ক্রিস্তফ (জীবৎকাল: ১৭৬৮-১৮২০, শাসনকাল: ১৮১১-২০)।
সিতাদ্যাল দ্যফেরিয়ের ক্রিস্তফের আদেশবলে তৈরি করে কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’, এটি এখনো একটি পর্যটন আকর্ষণ।
রাজা ক্রিস্তফের রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা, ১৮২০।

ওদিকে পেতিওঁ দ্বীপের দক্ষিণে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন হাইতি প্রজাতন্ত্র। সেখানে সেনেটের সাথে ভাগবাটোয়ারা করেই শাসন শুরু করলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সেনেটরদের মনোনয়নের ব্যাপারটা নিজের এখতিয়ারে নিয়ে আসলেন। বিরুদ্ধমতের সেনেটরদের কূটচাল চেলে সরিয়ে দিলেন। তবে প্রজাতন্ত্রের সকল পুরুষকে ভোটাধিকার দেয়া হল।

কর ও ভূমিসংস্কারও দক্ষিণে কিছুটা হলো। প্রথমে খামারব্যবস্থা চালু থাকলেও জনগণের দাবির মুখে বড় জমি ভাগ করে বিলিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পেতিওনের সৈন্যরাই এসব সুবিধার ভাগীদার হল। তাদের মালিকানার জমিতে ভাড়াটে হিসাবে চাষাবাদ করত গরিব ভূমিদাস চাষী।

পেতিওঁ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্প্যানিশ কলোনির স্বাধীনতাকামী নেতাদেরকেও সাহায্য করতে শুরু করলেন। এভাবে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে সিমন বলিভারের সাথে। এতে অবশ্য হাইতির সাধারণ করদাতার টাকাপয়সাই খরচ হলো।

দক্ষিণ হাইতির প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলেকসন্দ্র পেতিওঁ (জীবৎকাল: ১৭৭০-১৮১৮, শাসনকাল: ১৮০৭-১৮১৮)।

উত্তর-দক্ষিণের দুই রাজ্যই অবশ্য ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে সেসময়কার যুক্তরাষ্ট্রের মতই একরকম অচ্ছুৎ ছিল। ইউরোপীয়দের কাতারে যোগদানের জন্যে পেতিওঁ-ক্রিস্তফ দুজনই বেশ মুখিয়ে ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে কম নয়, এটা দেখাতে অবশ্য পেতিওনের থেকে ক্রিস্তফ বেশি আগে বাড়া ছিলেন, তাই অর্থনীতির খাতিরে খামারব্যবস্থাকে আগের মত রেখে দেন।

দুই হাইতিতেই এসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা মুক্ত কালোদের অভিবাসন চলে। একই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়ারও গোড়াপত্তন হয় — আগে লিখেছি এ নিয়ে। এভাবে হাইতিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। তবে মার্কিন থেকে আসা কালো কৃষক ও কারিগরদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হাইতিতে খাপ না খাওয়াতে পেরে ফিরে যায়। এর মূল কারণ ছিল ভূমিদাসপ্রথা আর পাসপোর্টছাড়া মুক্ত যাতায়াতের অভাব।

১৮২০ সালে উত্তরে রাজা ক্রিস্তফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর প্রজা আর দরবারের অভিজাত উভয়েরই সমর্থন এতদিনে মিইয়ে এসেছে। তাঁর অসুস্থতার সুযোগে অভ্যুত্থানের মুখে ক্রিস্তফ আত্মহত্যা করেন। কিছুদিনের মধ্যে দক্ষিণের প্রজাতন্ত্রের সৈন্যরা উত্তরের নেতৃত্বহীন সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দুই হাইতিকে আবার একত্রিত করে।

ততদিনে দক্ষিণে পেতিওনের মৃত্যু হয়েছে। আর সেখানে ক্ষমতাসীন তারই সহচর জেনারেল বোয়াইয়ের। শুধু উত্তর-দক্ষিণ হাইতি নয়, প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের স্প্যানিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের সুযোগে সে দেশেও দখলদার সৈন্য পাঠিয়েছেন তিনি। এভাবে দুই দশকের জন্যে পুরো হিসপানিওলা দ্বীপটি একই রাষ্ট্রের দখলে আসে।

পেতিওনের উত্তরসূরী জেনারেল জঁপিয়ের বোয়াইয়ের (জীবৎকাল: ১৭৭৬-১৮৫০, শাসনকাল: ১৮১৮-৪৩)। একনায়কতন্ত্র চালান দেশে।

বোয়াইয়েরের শাসনামল ছিল প্রজাতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র। সংসদ ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির আদেশাবলীতে সীল-ছাপ্পর মারার জন্যে। নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তিনি। প্রদেশগুলির শাসনভার ছিল সেনাসামন্তদের হাতে। প্রতিবাদ-বিরুদ্ধাচারের কোন সুযোগই ছিল না, ধরপাকড় আর বিরোধীদের ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদন্ডপ্রদান চলত নিয়মিত। শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে হাইতি। ক্রিস্তফের গড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। সারা হাইতিতে এসময় ছিল মোটে দশটা পাবলিক স্কুল। আর প্রাইভেট স্কুলগুলিও জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়। বোয়াইয়েরের হিসাবে, শিক্ষা মানেই বিপ্লব আর ক্ষমতার গদি ধরে টানাটানি।

কিন্তু এভাবেই ১৮৪৩এ আরেকটা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত গ্রাম্যসমাজ আর ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বাধীনতাকামী গুপ্তসংস্থার সাথে যোগ দিয়ে বোয়াইয়েরকে তাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই ডামাডোলের সুযোগে ডমিনিকান রিপাবলিক হাইতি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ডমিনিকানরা হাইতিতে খুব একটা সুখে ছিল না। বিশেষত সেখানে প্রচুর শ্বেতাঙ্গের বসবাস ছিল, হাইতির রাষ্ট্রতন্ত্র অনুযায়ী তারা ছিল সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত।

হাইতির নতুন উদারপন্থী সরকার আরেকটা সংবিধান রচনা করল। কিন্তু হাইতির প্রবাদেই রয়েছে, ‘শাসনতন্ত্র ছাঁপানো কাগজে, আর বেয়নেট তৈরি ইস্পাতে!’ সরকার যতই সংস্কারপন্থী হোক না কেন, ক্ষমতায় আসামাত্র গদি পাকাপোক্ত করতে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন সরকারের ওপর রক্ষণশীল সেনাবাহিনীর চাপ এক দিক থেকে, আরেকদিকে গ্রাম্য পপুলিস্ট মিলিশিয়াও দাঁড়িয়ে গেছে শহুরে এসট্যাবলিশমেন্টের প্রভাবের বিরুদ্ধে। এসকল বিদ্রোহ-বিপ্লবেই কেটে যায় কয়েক বছর।

শেষমেষ ১৮৪৭এ আপোষের ভিত্তিতে কৃষাঙ্গ বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ ফাউস্ত্যাঁ সুলুককে রাষ্ট্রপতি হিসাবে গ্রহণ করে নেয় বিবাদমান দলগুলি। তারা ভেবেছিল, নমনীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দোআঁশলা এলিটদের কথা যেমন শুনবেন, তেমন গ্রামাঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণও তুষ্ট হবে স্বগাত্রবর্ণের নেতা পেয়ে।

কিন্তু এদের সব পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিলেন সুলুক — ১৮৪৯এ তিনি হয়ে বসলেন হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট! এবার বোধহয় তাঁর রাস্তা ধরেই ১৮৫১তে ফ্রান্সের সম্রাট বনলেন তৃতীয় নাপোলেওঁ। নাপোলেওঁকে নিয়ে সরাসরি হাস্যকৌতুক করতে বাঁধা থাকায় ফরাসী থিয়েটারে সম্রাট সুলুক তাঁর স্থানপূরণ করেন! সুলুকের দরবারের হাস্যকর সব পদবীর অভিজাত, যেমন ডিউক অফ লেমনেড আর ডিউক অফ মারমালেডের কথোপকথন শুনে ফরাসীরা নাপোলেওনকে স্মরণ করেই হেসে গড়িয়ে পড়ত।

হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট ফাউস্ত্যাঁ সুলুক (জীবৎকাল: ১৭৮২-১৮৬৭, শাসনকাল: রাষ্ট্রপতি, ১৮৪৭-৪৯, সম্রাট, ১৮৪৯-৫৯)।
ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নাপোলেওঁ সুলুকের মতই প্রথমে ছিলেন রাষ্ট্রপতি (১৮৪৮-৫২), তারপর সম্রাট (১৮৫২-৭০)।

ক্রিস্তফ-পেতিওঁ-বোয়াইয়ের-সুলুক সবার আমলেই হাইতিতে অ্যাবলিশনিস্টদের যাতায়াত হয়েছে। এরা সকলেই হাইতির স্বাধীনতাপরবর্তী অবস্থা দেখে যারপরনাই বিব্রত হয়েছেন। দাসপ্রথা যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে অবশ্যপ্রয়োজনীয় নয়, তা প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো চিত্র দেখেন তারা। ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপের দাসদের থেকে হাইতির কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন কিছু ভাল হয়নি। পঞ্চাশ বছর আগে ফরাসীদের ছেড়ে যাওয়া চিনির খামার আগাছাভরা। মানুষজন গাত্রাচ্ছাদন ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বাসস্থান কুঁড়েঘরে, ইত্যাদি। সামান্য মুক্তি পেয়ে তারা সুখী বটে কিন্তু নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির কোন চিন্তা তাদের নেই।

তাদের এ পর্যবেক্ষণ অবশ্য সম্পূর্ণ নয়। হাইতির শুরুতে নগর ও গ্রামের বৈষম্যের বীজ রোপিত হয়েছিল। তার ফলে কৃষিখামারে উৎপন্ন শস্য রপ্তানি থেকে উপার্জিত রাজস্বে শহুরে ফরাসীভাষী মানুষ উন্নতি করেছে। আর ক্ষতি হয়েছে ক্রেওলভাষী কৃষ্ণাঙ্গ চাষাদের। বাণিজ্যে করারোপ করেই হাইতির রাষ্ট্রপরিচালনার সিংহভাগ খরচ উঠত, আর ১৮৮১ নাগাদ এই নির্ভরতা গিয়ে ঠেকে ৯৮ শতাংশে। অর্থাৎ শহুরে বণিকগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি যুগিয়েছে খামারের ভূমিদাস কৃষক। এদের উপার্জন একদিকে কমেছে, আর ভোগ্যপণ্যের খরচ বেড়েছে। খামারে কাজ করার পাশাপাশি রাস্তাঘাট তৈরি আর অন্যান্য সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পেও চাষাদের জোর করে কাজে লাগানো হত। সরকারী চাকুরে বা খামারের শ্রমিক না হলে যে কারো গ্রেপ্তার ও খামারে সোপর্দ ছিল অনিবার্য।

হাইতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল সামরিক বাহিনী আর শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তের হাতে, এদের অধিকাংশ ছিল মুলাটো বা দোআঁশলা বর্ণের। গ্রামের মানুষের সাথে এদের ছিল বিস্তর ফারাক।
গ্রাম্য হাইতিয়ানদের ভুডু ধর্মকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হত শহুরে সমাজে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ ভুডু চর্চা করত। এরা নাকি নরবলি দিত। এ চিত্রে ১৮৬৪ সালের একটি চাঞ্চল্যকর ভুডু নরবলির মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের দেখানো হয়েছে।
হাইতির গ্রাম্যসমাজে লাকু বা পঞ্চায়েতব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ সরকারের চোখের আড়ালে নিজেদের স্বাধীন জীবনযাত্রা চালিয়ে যায়।

নগরভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতে অভিনব পদ্ধতি বের করে হাইতির গ্রামগুলি। ‘লাকু্’ বলে একটা সিস্টেম তৈরি করে তারা, অনেকটা পঞ্চায়েতের মত। বড় যৌথ পরিবার নিয়ে ছোট আবাদী জমির মাঝে কুঁড়েঘরের গ্রুপ বানিয়ে তারা থাকত। সরকারী খামারে নামমাত্র কাজ করে এসে নিজ জমিতেই কফি-তামাক ফলাত, সেসবের একাংশ বেঁচত নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাজারে, বাকিটা নিকটস্থ বন্দরশহরে। সরকার ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না লাকুর বার্টার ইকনমিতে কি পরিমাণ শ্রম আর রাজস্ব ফাঁকি যাচ্ছে। বাধ্যতামূলেক শ্রমের ডাক পড়লেও সেখানে না গিয়ে কাছের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকত গ্রামবাসী।

এভাবে স্বদেশের শোষক সরকারই হয়ে দাঁড়ায় হাইতিবাসীর মূল প্রতিপক্ষ। কিন্তু নিজেরাই একটা লিবার্টারিয়ান-এগালিটারিয়ান সমাজ তৈরি করে ফেলে হাইতিবাসী, বাইরের সাহায্য ছাড়াই। সরকার থেকে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও লাকুগুলিতে ভুডু ধর্মের চর্চা চলতে থাকে, ক্রেওল ভাষাও উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।

কিন্তু এ ব্যবস্থা ছিল বেশ প্রিমিটিভ আর ভঙ্গুর। সরকারের হাত হাইতিবাসীর করের পয়সাতেই আরো যত লম্বা হতে থাকল, তত তাদের যাতায়াত ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হতে শুরু করল। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ক্ষণস্থায়ী কার্যকরী সমাজব্যবস্থা শীঘ্রই তাসের ঘরের মত ধ্বসে পড়বে উত্তাল সময়ের ঝড়ে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!