চীনের আপৎকালে যুক্তরাষ্ট্র


ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রাক-আধুনিক যুগের বহু সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল করুণ। ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য, পশ্চিম এশিয়ায় ইরানী আব্বাসী সাম্রাজ্য, চীনের চিং, ভারতের মুঘল — এরা সকলেই ইউরোপীয়, মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী, অস্ট্রোহাঙেরীয়, রুশ, কিংবা জাপানী আগ্রাসনের সম্মুখীন। আফ্রিকার পুরনো রাজ্যগুলিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তাদের ভাগাভাগি করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করছে ব্রিটিশ-ফরাসী-জার্মানরা। ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পেনীয়রাও দ্বিতীয় কাতারে।

ফরাসী পত্রিকা ল্য পতি জু্র্নালে চীন ভাগাভাগির কার্টুন, ১৮৯৮

একটা ব্যাপার মাথায় এল যে, মুঘল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূল সুবিধাভোগী হল ব্রিটিশরা। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে অস্ট্রীয়, ব্রিটিশ ও রুশ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা পেল কিংবা বিচ্ছিন্ন হল গ্রীস, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি। কিন্তু চীনের ভাগ্য কেন এমন টুকরোটুকরো হল না? ইউরোপীয় ও জাপানীদের চীন নামের কেক কেটে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কার্টুন তো সে সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু আসলে তো তা হয়নি।

হ্যাঁ, হংকং ও মাকাউ ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। চীনের বিভিন্ন বন্দরে পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীদের বিশেষ সুবিধা ছিল। শাংহাইয়ে ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট। ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের মত এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের মত ফরেন কলোনাইজেশনের সম্মুখীন হয়নি চীন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ তুরস্ক ও অস্ট্রোহাঙেরি যেভাবে বিভক্ত হয়ে “ডিকলোনাইজেশন”ধাঁচের ব্রেকআপের মাধ্যমে নতুন কিছু দেশের জন্ম দিয়েছিল, সেরকম ভাগ্যও চীনের হয়নি। যদিও সেটিও মূলে মাল্টিএথনিক এম্পায়ার রুলড বাই আ মাইনরিটি পীপল। হংকং-মাকাউয়ের মত কলোনি পর্তুগীজদের গোয়া-দমন-দিউ কিংবা ব্রিটিশদের ফোর্ট উইলিয়ামের থেকে তেমন কিছু বেশি ছিল না। বাকি চীনের আয়তনের তুলনায় এ সকল উপনিবেশ নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

তবে ফোর্ট উইলিয়াম যেমন ব্রিটিশ বেঙ্গলের ভবিষ্যতের দিকেই নির্দেশ করছিল, চিং শাসনামলের এক পর্যায়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সেইরকম শেষ পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল চীন। সে থেকে ঘটনাচক্রে তারা রক্ষা পায় এক উঠতি স্থানীয় পরাশক্তির কারণে। সে পরাশক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র!

এ বলছি না যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল শুভানুধ্যায়ী হিসাবে চীনের পাশে এসে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়ায়। সেটা অবশ্যই একটা লেভেলে ছিল। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারের “নিকট” প্রতিবেশী হিসাবে চীনের ভাগ্য নিয়ে কিংবা চীনে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে মার্কিনদের মাথাব্যথা আর সক্ষমতা দুটোই যথেষ্ট ছিল, যেটা তুরস্ক কিংবা ভারতের বেলায় অতটা ছিল না। ইউরোপীয় ও জাপানীদের ওজনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা দাঁড়িপাল্লায় বিশাল এক ব্যালেন্স হিসাবে কাজ করে।

একটু ব্যাখ্যা করে বলি চীনকে সম্পূর্ণ উপনিবেশায়নের হাত থেকে কিভাবে একার্থে মার্কিনরা রক্ষা করে।

চীনের সাথে ইউরোপীয়দের সরাসরি বাণিজ্য শুরুর অনেক পরে মার্কিনদের আবির্ভাব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুয়েকটা সরকারী মিশন সরাসরি যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা চীনে আফিমের ব্যবসায় বেশি জড়িত ছিল। ব্রিটিশরা যেখানে ভারত থেকে একচেটিয়া আফিম রপ্তানী করত, সেখানে মার্কিনরা পারস্য থেকে কিনে সে বস্তু চীনে বিক্রি করত। চীনে এ বাণিজ্যের সিংহভাগ অবশ্য ছিল ব্রিটিশদের হাতে।

চীনে স্থানীয় পোশাকপরিহিত মার্কিন মিশনারি, ঊনবিংশ শতক

এর পাশাপাশি মার্কিন মিশনারিদের আনাগোনা হতে শুরু করে চীনে। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের জনগণের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে তারা। মিশনারিদের অনেকে এখনো খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। আমি, আমার পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষিত হয়েছি ক্যাথলিকপরিচালিত স্কুল বা কলেজে। ধর্মপ্রচারণার বিন্দুমাত্র অন্তত আমি দেখিনি। চীনের কিছু সাধারণ মানুষও মিশনারিদের শিক্ষার সে সুফল ভোগ করে।

আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর চিং সাম্রাজ্যকে অনেক ছাড় দিতে হয় ব্রিটিশদের কাছে। বাণিজ্যে তারা পায় মোস্ট ফেভারড নেশনের সম্মান। পাঁচটি বন্দরে মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা পায়। এর আগে সরকারীভাবে চীনের অভ্যন্তরের সাথে সরাসরি বাণিজ্য ছিল নিষিদ্ধ, তবে চোরাকারবারী ঠিকই চলত। ব্রিটিশরা এই লাভজনক সরকারী সুবিধাটি পাওয়ার কারণে ‌অন্যান্য বাণিজ্যিক শক্তিরাও একই ন্যায্য দাবি নিয়ে চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠায়। সামরিক হুমকি দিয়ে হোক, উপঢৌকনের বিনিময়ে হোক, সে দাবি আদায় করে নেয় ফরাসী, রুশ, জাপানী, ও অন্যান্য দেশ। সাথে মার্কিনরাও।

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় রেললাইন তৈরিতে নিযুক্ত চীনা শ্রমিক, ঊনবিংশ শতক

মার্কিন বণিকরা যখন চীনা বন্দরে ব্যবসারত, তখন চীনা শ্রমিকদেরও আগমন হতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়াসহ অন্যান্য মার্কিন টেরিটরিতে। প্যাসিফিক রেলওয়ে লাইনে কাজ করে অনেকে, আবার নতুন আবিষ্কৃত স্বর্ণখনিতেও। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি চীনা আসে যে অনেক মার্কিন নাগরিক চীনাবিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে চীনা শ্রমিকদের প্রবেশ কয়েক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তারপরও এখনো সান ফ্রান্সিস্কোতে অনেক পরিবারের দেখা মিলবে যারা সেই চীনাবংশোদ্ভূত।

শুধু যে শ্রমিকের আগমন হয় তা নয়। ১৮৫০ ও ১৮৬০এর দশকে তাইপিং নামে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ হয় চীনে। চিং সাম্রাজ্য ছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। মার্কিন ও ইউরোপীয়দের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সহযোগিতায় সে যাত্রা বেঁচে যায় হান জনগোষ্ঠীর ওপর শাসনরত বহিরাগত মাঞ্চুরিয়ান রাজপরিবার। এর পর তাদের উপলব্ধি হয় যে পশ্চিমা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ না পেলে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। চায়নিজ এডুকেশন মিশন নামে একটি প্রজেক্টে দেড়শ’র মত টীনেজ বয়েসী চীনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসে। এসব সাংস্কৃতিক লেনদেনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন আদিতে চীনে বাণিজ্যকরা মার্কিন ব্যবসায়ীরা আর তদকালীন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

কানেকটিকাটে চায়নিজ এডুকেশন মিশনের চীনা ছাত্রদের বেসবল টীম, ১৮৭৮
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চিং সম্রাটের রাষ্ট্রদূত লিয়াং চেং, চায়নিজ এডুকেশন মিশনে শিক্ষিত, বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ডের প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন, বিংশ শতকের প্রথমভাগ

চায়নিজ এডুকেশন মিশনে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, এদের অধিকাংশ আর ফিরে যায়নি। চিং সম্রাট এদের পাঠালেও সম্রাটের হর্তাকর্তাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলই। এরা তাইপিং বিদ্রোহের জন্যে তাইপিং নেতার পশ্চিমা মিশনারি শিক্ষা, আর তার খ্রীষ্টান সিনক্রেটিক ধর্মকে দোষারোপ করে। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনাবিদ্বেষী মনোভাব থেকে ইমিগ্রেশনের ওপর কড়াকড়ি হবার কারণেও চায়নিজ এডুকেশন মিশন বন্ধ করার একটা চাপ আসে। ছাত্ররা বেশি বেশি পশ্চিমা ও “বিলাসী” হয়ে যাচ্ছে এমন জজবা তোলা হয়। তবে এদের মধ্যে যারা ফিরে গেছিল, তাদের অনেকেই চীনে পজিটিভ একটা অবদান রাখে। প্রজাতন্ত্রী চীনের একাধিক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রনেতা ছিলেন মার্কিনশিক্ষিত। সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে নারীদের পা-বাঁধার কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও আমাদের দেশের বিদ্যাসাগরের মত ভূমিকা রাখেন এসকল মার্কিনশিক্ষিত চীনারা।

১৯০৫এ কোরিয়ায় মোতায়েন জাপানী সৈন্য, লক্ষ্য করুন পশ্চিমা পোশাক ও অস্ত্রসজ্জা

জাপান সাগরের অপর পারে কিন্তু চলছিল চিংদের সংস্কারবিমুখতার বিপরীত চিত্র। জাপানীরা খুব দ্রুত পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পাশ্চাত্যদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। নইলে তারা ১৮৫০এর দশক নাগাদ চীনের মতই বন্ধ দেশ ছিল। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও কম্পানিকেও পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখে তারা নিজেদের আখেরটা গুছিয়ে নেয়। খুব দ্রুত একটা রাজনৈতিক ও শিল্পসংস্কার ঘটে যায় সে দেশে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয় জাপান।

পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চীনে “অধিকার আদায়ের” প্রতিযোগিতায় শামিল হয় জাপানও। নানা ছুঁতোয় কোরিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুদ্ধ হয় জাপানের। সেটা ১৮৯৪/৯৫ সাল। পরাজিত চীন কোরিয়ায় জাপানের অধিকার মেনে নেয়, সাথে আরো কিছু সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়।

কাঁচি দিয়ে চীনের মানচিত্র কাটতে উদ্যত জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স। মাঝখানে ওপেন ডোর পলিসির কাগজ হাতে বাগড়া বেঁধে দাঁড়িয়েছে আংকল স্যাম, পাক ম্যাগাজিন, ১৮৯৯

এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অবতীর্ণ হয় চীনের অখন্ডতা রক্ষায়। চীনের এই দুর্বল অবস্থার সুযোগে মুখিয়ে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, জাপানী, রুশ সকলে। ল্য পতি জু্র্নাল নামের ম্যাগাজিনে তখনই সেই কেক কাটার কার্টুন প্রকাশিত হয়। এ সকল পরাশক্তি চীনকে টুকরো টুকরো করে যার যার নিজের “স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স” বানানোর স্বপ্নে গোপনে এক অন্যের সাথে মোলাকাত করতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকার মত বড় একটা ভূখন্ড নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন ডোর পলিসি নিয়ে ব্রিটিশ কার্টুন যে রুশ ভল্লুক ভদ্রভাবে মার্কিন ফ্রী ট্রেড লেডিকে চীনের ওপেন ডোর দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেবে (সার্কাজম অর্থে!), ১৮৯৯ পাঞ্চ ম্যাগাজিন

কিন্তু বাদ সাঁধে মার্কিনরা। তাদের নীতি ছিল “ওপেন ডোর পলিসি।” সে নীতি অনুযায়ী চীনে মুক্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল দেশ সমান অধিকার ভোগ করবে। চীনের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অখন্ডতা বজিয়ে থাকবে। বাণিজ্যকর আদায়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণ চিং সরকারের। বাংলায় ব্রিটিশরা যেমন মুঘল সম্রাটকে ঘুষ দিয়ে সে লাভজনক দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছিল, সেটি হবে না। অন্যান্য পরাশক্তি মার্কিনদের এই ওপেন ডোর পলিসির সাথে একমত না হলেও নতুন পরাশক্তিটির ভৌগোলিক নিকটতা আর সামরিক শক্তির ভয়ে চুপচাপ সেটা মেনে নেয়। সে যাত্রা বেঁচে যায় চীন।

জাপানের সাথে যুদ্ধে হারার পর আবার একটা বোধোদয় ঘটে চীনের নেতৃত্বের মধ্যে। তরুণ সম্রাট গুয়াংশু রাজ্যের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একটি ছোট দল নিয়ে নতুন করে একটি সংস্কার আন্দোলন দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি! একশ’ দিনের মাথায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল আমলা ও সেনানায়করা বিধবা রাণীমাতা সিশিএর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থীদের ক্যুয়ের মাধ্যমে পদচ্যুত করে। অনেক বুদ্ধিজীবী নিহত হন, গুয়াংশু হন প্যালেস প্রিজনার। আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যায় চীন।

চীনের অশীতিপর বৃদ্ধা বিধবা রাণীমাতা সিশি, চীনের সকল আধুনিকায়ন ও সংস্কার রহিত করেন, বক্সারদের উস্কানি দেন, ফলশ্রুতিতে চিং সাম্রাজ্যের শেষ ঘন্টা বেজে ওঠে, ১৯০০

প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ আর বিদেশীবিদ্বেষ। শহরে শহরে গড়ে ওঠে কুংফুএর মুগুরভাঁজা “বক্সার” ষন্ডাদের ক্লাব — অনেকটা অনুশীলন সমিতির মত। এবার চিং সাম্রাজ্যের প্রকাশ্য সমর্থন ও সহায়তায় প্রতিটি প্রদেশে এসকল বক্সার মব আক্রমণ করতে থাকে বিদেশী যে কোন কিছু। হোক খ্রীষ্টান মিশন, দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল। এ অবস্থায় চিং সম্রাট ইচ্ছাকৃতভাবে হাত গুঁটিয়ে বসে থাকার কারণে বিদেশী চৌদ্দটি দেশ একসাথে একটি শান্তিরক্ষীবাহিনী পাঠায় চীনে। অনুপ্রবেশের দোহাই দেখিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে সিশির প্রতিক্রিয়াশীল সরকার। যেসব সংস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন সিশি, সেগুলির অভাবেই দ্রুত পরাজিত হয় কুস্তিগীর বক্সার বিপ্লবী আর চিং সেনাদল।

১৯১১ সালের পূর্বের মাঞ্চুরিয়ার মুগুরভাজা বক্সারদের চিত্র
১৮৯৯ সালের বক্সার বিদ্রোহের সময় বক্সার ও চিং সেনাদল পশ্চিমা, সন্দেহজনক পশ্চিমা চর ও খ্রীষ্টানদের ওপর বেধড়ক হত্যাকান্ড চালায়, ধ্বংস হয় তাদের জীবিকা

কিন্তু যে বিদেশী কনসার্নগুলির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বক্সার বিদ্রোহ থেকে হয়, তার পুরো ক্ষতিপূরণের দাবি থেকে মুক্তি পেলেন না সিশি। চিং সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে বিশাল পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হতে হল। এ ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেল’স ব্যাক। চিং সাম্রাজ্যের বাকি দিন ছিল হাতেগোনা।

বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাকি পরাশক্তিগুলোর থেকে ভিন্ন একটা পন্থা অবলম্বন করে। বক্সারের ক্ষতিপূরণ থেকে একটা বিশাল অংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। ১৯০৮ সালে কংগ্রেস ঠিক করে যে এ টাকা চীনকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ চিন্তাটি আর কোন পরাশক্তি করেওনি। যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ নামে একটি বিখ্যাত এডুকেশন ফান্ড। এর মাধ্যমে প্রচুর চীনা ছাত্র আবারও পড়তে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের অনেকেই পরে প্রজাতন্ত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী কম্যুনিস্ট চীনা মূল ভূখন্ড আর তাইওয়ানে বিদ্বান ও বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ড থেকে বেজিংএ একটি প্রযুক্তি কলেজও শুরু হয়, যার নাম ছিংহুয়া। এটি কিন্তু এখনও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এক নাম্বার বিদ্যাপীঠ।

বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ পাওয়া প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রী, ১৯০৯ সাল। সামনের সারিতে বসা ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট চৌ জিচি।
বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপের টাকায় প্রতিষ্ঠিত চীনের নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছিংহুয়ার বর্তমান চিত্র

ওদিকে ১৯০৫এ রুশ-জাপানী যুদ্ধের পর আবারও জাপান মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর-পূর্ব চীনে রুশদেরকে সরিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়। তখনো মার্কিনরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কূটনীতির মাধ্যমে চীনের অখন্ডতা নিশ্চিত করে। চীনের চলমান সংস্কারেও মার্কিন সাহায্য আসতে থাকে। ১৯১২ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। একই সাথে ওপেন ডোর পলিসির প্রতি নতুন করে আস্থা ব্যক্ত করে।

১৯১১ সালের শিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের চিং সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্রী সরকার
চীনা বিপ্লবের পুরোধা সুন ইয়াত সেন, ১৯১০, ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত হাওয়াইয়ে মার্কিন শিক্ষায় শিক্ষিত হন
ইউয়ান শিকাই, চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, ১৯১৫। সুন ইয়াত সেনের পরিবর্তে তাকে আপোষে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতে গিয়ে পুরো দেশে বিশৃংখলা অরাজকতার জন্ম দেন এই পুরনো ধাঁচের চিং জেনারেল।

তবে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আবার বিপদে পড়ে যায় চীন। ব্রিটিশদের অনুরোধে জাপান মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। কারণ আর কিছুই না। চীনের যে স্বল্প কিছু অংশে জার্মান কলোনি ছিল সেগুলি কব্জা করা। ব্রিটিশরা সেটা মেনে নেয়। কিন্তু জাপানীদের লোভ ছিল আরো বিস্তৃত। একুশ দফা নামে ১৯১৫ সালে তারা একটি আলটিমেটাম দেয়। এর সারবত্তা ছিল চীনের সকল কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক আর প্রশাসনিক দায়িত্ব জাপানের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সোজা কথায় চীন পরিণত হবে জাপানীপ্রশাসিত চীনে। যেখানে চীন নামটা ঠিক থাকবে, কিন্তু আসলে পরিচালিত হবে জাপানীদের দ্বারা।

ইউরোপের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা জাপানীদের সুযোগ নিয়ে এমন খাইখাই করাটা একদম সহ্য করেনি। তারা এই আল্টিমেটাম পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিনরা উল্টো চীনা সরকারকে বলে দেয় যেকোন মূল্যে জাপানকে রুখতে, যুক্তরাষ্ট্রের তাতে সমর্থন থাকবে। অবস্থা বেগতিক দেখে জাপানীরা পিছপা হয়। খুব সামান্য অর্জনের বিনিময়ে তারা খোয়ায় ব্রিটিশ ও মার্কিনদের বিশ্বাসভাজনতা। এ ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ঘটনাবলীতে প্রভাব রাখে।

অর্থাৎ এ যাত্রাও চীন বেঁচে যায়। তবে তাদের মূল্যও দিতে হয়। ১৯১৭ সালে সেদেশে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সেসব এলাকা স্থানীয় “ওয়ারলর্ডদের” শাসনাধীন হয়। তারা নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নামে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করতে থাকে। এই অবস্থায় মার্কিনদের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে। আর রুশ-জাপানীদের পলিসি ছিল একেক ওয়ারলর্ডকে পয়সা খাইয়ে নয়ত একের বিরুদ্ধে আরককে লড়িয়ে নিজেদের সুবিধা উদ্ধার।

১৯১৯এর ভের্সাই ট্রীটিতেও চীন ব্যর্থ হয় শানদং উপদ্বীপে প্রাক্তন জার্মান, এখন জাপানের শাসনাধীন কলোনি পুনরুদ্ধার করতে। এর জন্য বহু চীনা নাগরিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে দোষারোপ করে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, চীনা সরকার ভের্সাই ট্রীটির আগেই জাপানীদের সাথে আলদা গোপন চুক্তি করে সে দাবি ছেড়ে দেয়ায় উইলসনের আর কিছু করার ছিল না।

১৯২০/৩০এর দশকে শাংহাইয়ে মার্কন ধাঁচের জ্যাজ ব্লুজ সঙ্গীত ছিল জনপ্রিয়। চীনা সঙ্গীতের সাথে মিলে নতুন ধরনের মিশ্র গীতিবাদ্যের জন্ম হয়।

তবে বিশের দশকে কূটনীতির জোরে জাপানের এসকল আগ্রাসী কার্যকলাপকে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয় মার্কিনসহ অন্যান্য পরাশক্তি। বিশ-ত্রিশের দশক ছিল পাশ্চাত্য আর চীনা প্রগতিশীল নেতৃত্বের সুসম্পর্কের স্বর্ণযুগ। শাংহাই ছিল চীনা জ্যাজ-ব্লুজ সিনক্রেটিজমের ক্যাপিটাল, আর পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল। হংকংয়ের সাথে পাল্লা দেবার মত শহর ছিল সেটি।

১৯২৭-২৮ সালের মধ্যে প্রায় পুরো চীনকে একত্রিত করতে সক্ষম হয় কুওমিনতাং পার্টি। তাদের রাজধানী ছিল নানজিংয়ে। নতুন করে এরা পাশ্চাত্য ও মার্কিনদের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু হয় জাপানের চক্ষুশূল। ১৯৩১ সালে জাপানী সেনাবাহিনীর একদল ষড়যন্ত্র করে মাঞ্চুরিয়াতে মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের ছুঁতোয় চীনের ওপর একতরফা আক্রমণ করে। জাপানের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে আসে ব্রিটিশ লর্ড লিটনের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানকারী দল। চীনের পক্ষে তাদের রায় গেলে লীগ অফ নেশনস থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে জাপান। এসব ঘটনা টিনটিনের কমিক পাতাতেও এসেছে।

১৯৩৩ সালে লীগ অফ নেশনস থেকে জাপানের ওয়াক আউটের দৃশ্য এভাবে কমিক বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন বেলজিয়ান শিল্পী এর্জে।

মাঞ্চুরিয়ায় একতরফা জাপানী দখলদারিত্ব আর প্রাক্তন চীনা সম্রাট পু’য়ীর পুতুল সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক মহলে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জাপান বাণিজ্যিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে তাদের অনেক লাভজনক লেনদেন ছিল। জাপানের এমন কট্টরপন্থার পেছনে ছিল তাদের আর্মির এক অতি-জাতীয়তাবাদী ফ্যাকশন, যারা ত্রিশের দশকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থ হয়।

১৯৩৭ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে চীনা রাজধানী নানকিংয়ে ব্যাপক জাপানী বোমাবাজির ক্ষয়ক্ষতিতে আহতদের সহায়তায় কিভাবে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় মার্কিনরা।

মাঞ্চুরিয়ান ইনসিডেন্টের কপি-পেস্ট ১৯৩৭ সালে মার্কো পোলো ব্রিজ ইনসিডেন্ট ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। চীনে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা চীনা সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাণ প্রচেষ্টার আয়োজন করে। বহুর্বিশ্বে জাপানীদের নিষ্ঠুরতাকে হেডলাইনে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। “নানজিংয়ের ধর্ষণের” মত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আন্তর্জাতিক মহলের আর ভাবনার অবকাশ থাকে না যে, সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষুধিত ক্ষমতালিপ্সু জাপানী মিলিটারি হুন্তা কতদূর যেতে পারে। পরবর্তীতে অ্যাটম বোমা ফেলার মত সিদ্ধান্তে এসব ঘটনা ভীষণ প্রভাব ফেলে।

জাপানের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে চীনের প্রজাতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী সরকার নয় শুধু, মাওজেদংয়ের কম্যুনিস্টদেরও সহায়তা দেয় মার্কিনরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও রুশদের যে লেন্ডলীজ পদ্ধতিতে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেয়া হয়েছিল, তার শুরু আসলে এই চীনা সহায়তার মধ্য দিয়ে। সামরিক রসদের চালান যেত দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে। ব্রিটিশ কনভয়ে যেত মার্কিন অস্ত্র। জাপানীরা বার্মা দখল করলে সে কাজের দায়িত্ব নেয় ফ্লায়িং টাইগারস নামে ব্রিটিশ ও মার্কিন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক পাইলটদের দল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই চীনের সাথে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অসম চুক্তি রদ করা হয়, সকল ট্রীটি পোর্ট ফিরে যায় চীনের কাছে। শাংহাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল লেগেশনও। যুদ্ধের পর মার্কিন সমর্থনের কারণেই জাতিসংঘে স্থায়ী আসনটি পায় প্রজাতন্ত্রী চীন।

দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ রসদ যেত জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত চীনা সেনাবাহিনীর কাছে, ১৯৪১
বার্মা জাপানী দখলে চলে যাবার পর দুর্গম পর্বতের প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে চীনাদের কাছে রসদ নিয়ে পৌঁছে দিত ফ্লায়িং টাইগার্স নামে এই মার্কিন স্বেচ্ছাসেবক পাইলটের দল, ১৯৪৩

কম্যুনিস্টদের সাথে জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধেও মধ্যস্থতার একটা ইনিশিয়াল প্রচেষ্টা হয় মার্কিনদের থেকে। কিন্তু সোভিয়েত প্রভাব আর কোল্ড ওয়ার ডায়নামিক্সের কারণে সেগুলি সাফল্য পায়নি। কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ফলে ওপেন ডোর পলিসির আর কোন প্রয়োজন থাকে না। বাকি বিশ্ব থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চীনের মূল ভূখন্ড।

কোরিয়ান যুদ্ধে প্রথম চীনা কম্যুনিস্ট লালফৌজ আর মার্কিন সামরিক শক্তি মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া আর কখনো দেশ দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েনি। চীনাদের হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণের বিরুদ্ধে জেনারেল ম্যাকার্থার অ্যাটম বোমা আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। তার পাগলামো থামানোর জন্য তাকে পদচ্যুত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান স্বয়ং — জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলার দায় চাপানো হয় যার ওপর।

সত্তর দশকে চীন-সোভিয়েত শত্রুতা চরমে উঠলে তার সুবিধাটা বাগিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক মানবিক অবস্থানটি ভেতরে ভেতরে থাকলেও নিক্সন প্রশাসন গোপনে চীনের সাথে চ্যানেল তৈরি করে ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যস্থতায়। সে কারণে সকল ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরাসরি বিরোধিতা তারা করতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের অবস্থান ছিল খোলাখুলিরকম স্বাধীনতাবিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমনটা ছিল না।

চীন-মার্কিন এই দেতঁতের কারণেই কম্যুনিস্ট চীন জাতিসংঘে প্রজাতন্ত্রী চীনের স্থায়ী আসনটি পায়। নইলে সে ভোটটি ছিল তাইওয়ানের হাতে। সেই ওপেন ডোর পলিসির উত্তরাধিকার ধরেই তাইওয়ানকে এখনও অখন্ড চীনের অংশ হিসাবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের কোন দূতাবাস ও অফিশাল কূটনৈতিক মিশন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। আছে কেবল কালচারাল মিশন।

সারমর্মে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের নাম ধরে যে মড়াকান্নাটা চীনারা এখনো দেয়, সে সেঞ্চুরিটি আরো খারাপ হতে পারত তাদের জন্য। বেঁচে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। এর কারণ যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ শুধু দেখতে পেয়েছে তা নয়। ১৮৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত প্রাক্তন স্পেনীয় কলোনিগুলিকে হস্তগত করে নিজেদের একটা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বানানোর অবস্থানে ছিল। অন্যান্য পরাশক্তির সাথে যোগসাজশে চীনকেও কেটেছিঁড়ে খাবার একটা সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ছিল। সেটা ঘটেনি। অষ্টাদশ শতকে ওরিয়েন্টাল সভ্যতা বিশেষত চীনা সভ্যতার ব্যাপারে মার্কিনদের একটা ফ্যাসিনেশন ছিল। রোমান বা গ্রীক সভ্যতার প্রতি আকর্ষণের থেকে সেটা কম ছিল না। ফাউন্ডিং ফাদারদের অনেকেই চীনা সভ্যতার প্রশংসা করে গেছেন। এ সম্মানটার কারণেই চীন প্রচুর সহমর্মিতা সমবেদনা আর সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়।

বর্তমান যুগের চীনা-মার্কিন শত্রুতার নেপথ্যে চীনা সংস্কৃতি-সভ্যতা বাঁধা নয়। বাঁধা কম্যুনিজম, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, চীনা সম্প্রসারণবাদ ও বাণিজ্যে অসম সুবিধাভোগ। যদি চীনে কোন এক স্বপ্নের যুগে সিসিপি’র বিনাশ ঘটে, যুক্তরাষ্ট্র আর সে দেশটি নিঃসন্দেহে বন্ধুতার বহু প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই!

সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন

চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসকগোষ্ঠী তাদের পূর্বসূরী জাতীয়তাবাদী কুমিন্টাংয়ের বিরুদ্ধে ১৯৪৯এ গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। দাবি করা হয় যে, কম্যুনিস্ট শাসন শুরুর মাধ্যমে তারা চীনের “সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের” যবনিকাপাত করেছে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই টার্মটি আসলে চীনের কুমিন্টাং জাতীয়তাবাদীদেরই তৈরি ও ব্যবহৃত। অর্থাৎ চীনা কম্যুনিস্টরা কম্যুনিজমের শ্রমিক-চাষী-সৈনিক ইত্যাদি খেঁটে খাওয়া মানুষের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব কপচালেও পেতি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সোশালিস্ট মার্কেট পলিসি ছেড়ে দিলেও ঐ পেতি-বুর্জোয়া ন্যাশনালিজম রয়ে গেছে। এটা বলতে গেলে রাশিয়ার মত অবস্থা, স্তালিনের মৃত্যুর পর কম্যুনিজম চলেছে ন্যাশনালিজমের ওপর ভিত্তি করে। আর কম্যুনিজমের পতনের পর সোশালিজম নাই হয়ে গেলেও ন্যাশনালিজম ষোল আনা বর্তমান।

দং শিওয়েনের অংকিত “জাতির গোড়াপত্তন অনুষ্ঠান” চিত্রকর্মে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণারত মাও জেদং, বর্তমান চীনা ন্যারেটিভে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি একই সাথে।

যা হোক, আজকে চীন ও রাশিয়া আপাত মিত্র। তবে সে মিত্রতায় চীনের পাল্লা অসামঞ্জস্যপূর্ণরকম ভারি। আর কোন বাজার না থাকায় রাশিয়া ধীরে ধীরে পরিণত হতে পারে চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে। সেটা অবশ্য একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রান্তিক সম্ভাবনা। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে চীনের ওপর রাশিয়া অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ও ভোক্তাপণ্যের জন্য। দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে সন্তুষ্ট রাখার জন্য।

কিন্তু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে অন্য একটা ব্যাপারে খটকা লাগা স্বাভাবিক। সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি কি চীনা কম্যুনিস্টরা সম্পূর্ণ করেছে? তাইওয়ান তো এখন আর ভিনদেশীদের কলোনি নয়। আর হংকং-মাকাউ তো নব্বই দশকেই ফিরে গেছে, তাও তদকালীন কলোনিয়াল প্রভুদের ইচ্ছায় — সেসব স্থানের মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটে নয়।

সবুজ দাগে দেখানো “নাইন-ড্যাশ” লাইন বরাবর চীনা সমুদ্রসীমার দাবি, যেটা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের লংঘন ও প্রতিবেশী দেশগুলির ন্যায্য হিস্যার পদদলন
চিং সাম্রাজ্যের শিখরে চীনের সীমান্তরেখা, ঊনবিংশ শতকের পূর্বার্ধ

এখনো নাইন ড্যাশ লাইন, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে চীন লেগে থাকে। চীনাদের দাবি অন্যায্যভাবে চিং রাজত্বকালে ও রিপাবলিক অফ চায়না শাসনামলে এসব এলাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি নাকি গলাধঃককরণ করেছে। আসুন একটু সে অন্যায্যতার ফিরিস্তিটা দেখি। খেয়াল করে দেখবেন, ১৮৫৮ সালের ঘটনাটা!

১৮৩৯-৪২ঃ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। পাঁচটি বন্দরে বিশেষ শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশদের। হংকং ব্রিটিশদের দখলে (শুধু হংকং দ্বীপটি, আয়তন ৮০ বর্গ কিমি)। পরে লীজকৃত নিউ টেরিটরিসহ হংকং চীনের কাছে ফিরে যায় ১৯৯৭ সালে। সকল ট্রিটী পোর্টের বিশেষ সুবিধা ত্রিশের দশকের মধ্যে পশ্চিমারা হারায়, প্রথমে মার্কিন মধ্যস্থতায়, পরে চীন-জাপান সংঘাতের ডামাডোলে। অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা আসার আগেই। ট্রিটি পোর্টগুলিতে চীনা সার্বভৌমত্বই জারি ছিল, কিন্তু পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীরা বিশেষ সুবিধা পেত।

হংকং ও আশপাশের ব্রিটিশ উপনিবেশ পুরো চীনের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষু্দ্র

১৮৪৪ঃ ফরাসীদের সাথে ব্রিটিশদের মত একই প্রকার আনইকুয়াল ট্রিটীর মাধ্যমে সে পাঁচটি বন্দরে বিশেষ সুবিধাপ্রদান।

১৮৫৬-৬০ঃ ব্রিটিশ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। হংকংয়ের সাথে কাউলুন যুক্ত, ৭০ বর্গ কিমি। এ সুযোগে রুশরা সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে জায়গা দখলের ষড়যন্ত্র করে।

১৮৬০ সালে আফিম যুদ্ধপরবর্তী চিং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

১৮৫৮ঃ ট্রিটী অফ আইগুনের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের হাতে চিং সম্রাটকে ছেড়ে দিতে হয় আউটার মাঞ্চুরিয়া নামক এক বিশাল এলাকা। আমুর-উসুরি নদী দ্বারা সীমানা নির্ধারিত হয়। এলাকা ৬,০০,০০০ বর্গ কিমি, বর্তমান ইউক্রেন সাইজের। এ অঞ্চল এখনো রাশিয়ার হাতে। ভ্লাদিভস্তক মূল শহর, আরেক বড় শহর খাবারস্ক। অধিকাংশ জনসাধারণ মাঞ্চুরিয়ান, রুশ নয়। চীন এখনো এই বিশাল সম্পদশালী এলাকা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কবে চীনের এ হিউমিলিয়েশনের শেষ হবে তাও কারো জানা নেই। ষাটের দশকে সোভিয়েতদের সাথে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সকলে মুখ চেপে আছে।

১৮৫৮ সালে বিনা যুদ্ধে সামরিক হুমকি-ধামকি দিয়ে উত্তরপূর্ব মাঞ্চুরিয়ার বিশাল এলাকা চীনের থেকে হস্তগত করে রুশ সাম্রাজ্য, এলাকাটি এখনো রাশিয়ার অংশ

১৮৫৮ঃ ট্রিটি অফ তিয়েনৎসিনের মাধ্যমে ট্রিটি পোর্টের সংখ্যা ও সুবিধা আরো বৃদ্ধি। ব্রিটিশ-ফরাসীদের পাশাপাশি রুশ-মার্কিন নাগরিকদের এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। রুশরাও পাবে ট্রিটি পোর্টের সুবিধা। প্লাস যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ।

১৮৮৪-৮৫ঃ ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ। ভিয়েতনামের তিনটি অঞ্চলের (আনাম — ১,৩০,০০০ বর্গ কিমি, তংকিন — ১,০৩,০০০ বর্গ কিমি, কোচিনচিন — ৬৯,০০০ বর্গ কিমি) ওপর ফরাসীদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার। তবে এ ভিয়েতনাম অতীতে বহুবার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। চীনই তাদের প্রাচীনতম শত্রু। ভিয়েতনাম স্বাধীনদেশ হিসাবে আবির্ভূত হয় ১৯৪৮ সালে। ফরাসী-মার্কিনদের বিরুদ্ধে পরে যুদ্ধ করলেও চীন তাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ।

ভিয়েতনামের উত্তরাংশ চিং সাম্রাজ্যের প্রভাববলয়ে থাকায় ফ্রান্স ও চীনের মধ্যে ১৮৮০র দশকে যুদ্ধের মাধ্যমে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়

১৮৮৮ঃ ব্রিটিশ ভারতের সিক্কিম অভিযান। তিব্বতের সাথে পাল্লা দিয়ে এ ছোট রাজ্যটির সাথে প্রটেক্টরেটের সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারত। সিক্কিমের আয়তন ৭,০০০ বর্গ কিমি। ওদিকে কিন্তু তিব্বতকে চিং সম্রাট সে অধিকার দেয়নি ইত্যাদি বলা হয়। তিব্বত নাকি চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও তিব্বত ছিল এ এলাকার সার্বভৌম একটি সাম্রাজ্য। কম্যুনিস্ট চীন ১৯৫০ সালে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তিব্বতের ক্ষুদ্র প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে “হিউমিলিয়েশনের” সমাপ্তি ঘটায়। এখনো দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের একটি নির্বাসিত সরকার আছে ভারতে। তিব্বতের আয়তন ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি।

১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন তিব্বতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে “শান্তিপূর্ণ মুক্তি” এনে দেয় চীনের লালবাহিনী

১৮৯৪-৯৫ঃ নব্য পরাশক্তি জাপানের সাথে যুদ্ধ ও পরাজয়। তাইওয়ান দ্বীপটি (৩৬,০০০ বর্গ কিমি) জাপানের কাছে সোপর্দ। কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর জাপানী প্রটেক্টরেট, যদিও সেটির পোশাকি নাম এম্পায়ার অফ কোরিয়া। কোরিয়া স্ব অধিকারে একটি সার্বভৌম সাম্রাজ্য ছিল, তবে মোঙ্গল দিগ্বিজয়ের পর পর চীনের ইউয়ান, মিং ও চিং সাম্রাজ্যের লেজুড় হয়ে রয়। তবে সে সম্পর্কটা ছিল করদ রাজ্যের। ১৮৮০র দশকে কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব হরণ করে চিং সাম্রাজ্য। ফলশ্রুতিতে জাপানী আক্রমণ। এখন দুই দেশে বিভক্ত কোরিয়া উপদ্বীপ (উত্তরঃ ১২০,০০০ বর্গ কিমি, দক্ষিণঃ ১০০,০০০ বর্গ কিমি)। চীন উত্তর কোরিয়ার ওপর বলতে গেলে এখনো সেরকম প্রাচীন প্রভাব খাঁটিয়ে চলেছে। তাইওয়ান ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও ছিল ডাচ-পর্তুগীজ ঘাঁটি। তাইওয়ানের মূল অধিবাসীরা চীনা নয়। চিং সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অন্তর্গত হলেও সেখানে স্থানীয়রা বিদ্রোহ করেছে, জাপানী শাসনের প্রাক্কালে ১৮৮০র দশকে একটি ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দখলে থাকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। ১৯৪৯এ রিপাবলিক অফ চায়না সরকার গৃহযুদ্ধে হেরে সেখানে পালিয়ে যায়।

১৮৯৪-৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে তাইওয়ান ও কোরিয়াসহ উত্তরের বেশ কিছু এলাকা চীনের প্রভাবমুক্ত হয়

১৮৯৫ঃ জাপান যুদ্ধে জিতে চীনের লিয়াওদং উপদ্বীপের পোর্ট আর্থার ও সংলগ্ন অঞ্চলের (৩৫০,০০০ বর্গ কিমি) লীজ পেলেও তিন ইউরোপীয় শক্তি জার্মানি, রাশিয়া ও ফ্রান্স জবরদস্তি করে সে এলাকা লীজে তুলে দেয় রুশদের হাতে। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শেষ মাথা বানানোর তাগিদে রুশরা জাপানীদের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯০৫এ তাদের মধ্যে যুদ্ধে এবং রুশদের পরাজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সোভিয়েত দখলদারিত্ব। তারপর মাওয়ের কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে ফিরে যায় এ এলাকা।

১৯০৩ সালের রুশ ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ট্রান্স-সাইবেরিয়া রেলওয়ের সাথে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়া রেললাইনের সংযুক্তি

১৮৯৯-০১ঃ বক্সার বিদ্রোহ। বিদেশীবিরোধী, খ্রীষ্টানবিরোধী এক পপুলিস্ট মিলিশিয়া যাদের নাম বক্সার, সমানে কচুকাটা করে পশ্চিমা আর তাদের স্থানীয় মিত্রদের। চিং সম্রাজ্ঞী সিশি গোপনে তাদের সমর্থন দেন। বিদ্রোহ দমনে আটটি দেশ অভিযান চালায়, যাদের মধ্যে রুশ ও জাপানীও ছিল। রাশিয়া এ সময় পুরো মাঞ্চুরিয়া (৯৮০,০০০ বর্গ কিমি) দখল করে রাখে ও লুটতরাজ চালায়। বিদ্রোহের পরও তারা সৈন্য প্রত্যাহার করেনি, ফলশ্রুতিতে জাপানের সাথে ১৯০৫এর যুদ্ধ। জার্মানি দখল নেয় চিংদাওয়ের (৫০০ বর্গ কিমি) আর ফরাসীরা কুয়াংচৌওয়ান (৫০০ বর্গ কিমি)। আর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় চিং সম্রাটকে। প্রসঙ্গত, মার্কিনদের যে ক্ষতিপূরণের ভাগ ছিল তা থেকে পরে আমেরিকায় চীনা ছাত্রদের পড়াশোনার ফান্ড তৈরি করে দেয়া হয়, বর্তমান ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও সে টাকায় শুরু।

১৯০১ সালে বক্সার বিদ্রোহদমনে চীনে অনুপ্রবেশ করে ৮ জাতির শান্তিরক্ষীবাহিনী

১৯০৫ঃ রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয়। মাঞ্চুরিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার ও লিয়াদংয়ের দখল জাপানের হাতে। মাঞ্চুরিয়ার আদিবাসীদের নাম জুরচেন, এরা হান গোষ্ঠীর চীনা নয়।

১৯১১ঃ সপ্তদশ শতক থেকে “আউটার মঙ্গোলিয়া” (১,৫০০,০০০ বর্গ কিমি) চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য হলেও ১৯১১তে বিপ্লবের গোলমালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৯এ চীনের প্রজাতন্ত্রী সরকার তাদের একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও রুশ বিপ্লবের জোয়ার এসে পড়ে এখানে। ফলশ্রুতিতে রুশ সোভিয়েত পাপেট একটি পীপলস রিপাবলিক গঠিত হয়। সেই থেকে দুই দেশের বাফার হয়ে রয়েছে বর্তমান মঙ্গোলিয়া দেশটি। যদিও ইনার মঙ্গোলিয়া (১,২০০,০০০ বর্গ কিমি) এখনো চীনের অধীনস্থ তথাকথিত “স্বায়ত্ত্বশাসিত” অঞ্চল। তিব্বতের মত তাদেরও স্বাধীনতা আন্দোলন চলমান। আর মঙ্গোলিয়া দেশটি ধীরে ধীরে প্রকারান্তরে চীনের ইকনমিক কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।

বর্তমান মঙ্গোলিয়া চীন থেকে স্বাধীন হলেও ইনার মঙ্গোলিয়া বলে একটি বিশাল এলাকা এখনো চীনের অধীন

১৯১১ঃ তিব্বতেও একই সময়ে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সিক্কিম নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাথে গোলমালের কারণে দক্ষিণ তিব্বতে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ভারত। কিন্তু তিব্বতের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। নামমাত্র স্বাধীন দেশ হিসাবে এরপর তিব্বত ১৯৫০ পর্যন্ত চীনের প্রভাবমুক্ত থাকে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি অন্য কোন দেশ।

১৯২৯ঃ চীনের সাথে সোভিয়েতের প্রথম যুদ্ধ। নতুন চীনা রিপাবলিক মাঞ্চুরিয়ায় চায়নিজ ঈস্টার্ন রেলওয়েতে যে যৌথ প্রশাসন থাকার চুক্তি তা অগ্রাহ্য করে। সোভিয়েত সেনাদল দ্রুত চীনাদের হারিয়ে আগের লীজের চুক্তি পুনর্বহাল করে। এ সুযোগে উসুরি নদীতে একটি বড় দ্বীপ জবরদখল করে নেয়। বলশয় উসুরিস্কি নামের এ দ্বীপ (৩৫০ বর্গ কিমি) মোটে ২০০৪ সালে রাশিয়া ফিরিয়ে দেয় চীনকে।

দখলকৃত কোমিনতাং পতাকা হাতে রুশ লালবাহিনীর সৈন্য

১৯৩১-৩২ঃ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের আগ্রাসন। জার্মানি কর্তৃক ১৯৩৯এ পোল্যান্ড আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট এই আক্রমণ। মাঞ্চুরিয়ায় একটি “স্বাধীন” পাপেট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জাপান। ক্ষমতাসীন করে ১৯১২তে ক্ষমতাচ্যুত চীনা চিং সম্রাটকে। ১৯৪৫এ সোভিয়েতরা জাপানীদের দুর্বলতার সুযোগে দখলদার শাসন প্রতিষ্ঠা করে ও পরে মাওয়ের কম্যুনিস্টদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সঁপে দেয়। এখানকার ঘাঁটি থেকেই চীনা কম্যুনিস্টরা কোমিনতাংয়ের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালায়।

মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের পর রেললাইনে “ক্ষয়ক্ষতি” পরিদর্শনে এসেছে জাপানী পরিদর্শকদল

১৯৩৪ঃ শিনজিয়াং বা পূর্ব তুর্কেস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন। এ সময় চীনে ছিল “স্বাধীন” বিভিন্ন ওয়ারলর্ডদের আধিপত্য। শিনজিয়াং বা উইগুর প্রদেশে কোমিনতাং সমর্থিত এক মুসলিম হুই চীনা ওয়ারলর্ড ও সোভিয়েত পাপেট আরেক ওয়ারলর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। উইগুর খানদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন পূর্ব তুর্কেস্তান রিপাবলিকও আবির্ভূত হয়, যেটা আসলে ছিল ইসলামিস্ট আখরা। কোমিনতাং ওয়ারলর্ড জিতে যাবার প্রাক্কালে সোভিয়েতরা আগ্রাসন চালিয়ে দ্বিতীয়জনের মাঞ্চু সৈন্যদলকে সহায়তা করে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পাঠানো লিটল গ্রীন মেনের মত উইগুরে পাঠানো এ সকল রুশ সৈন্যদের পোশাকে কোন পরিচয়ধারী প্রতীক ছিল না। মুসলিম সেই ওয়ারলর্ড যুদ্ধে পরাজয়ের পর সোভিয়েতের অভ্যন্তরে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিনজিয়াংয়ে অপর ওয়ারলর্ডের সোভিয়েত পাপেট শাসন চলে ১৯৪২ পর্যন্ত।

১৯৩৪ সালে প্রথম “স্বাধীন” পূর্ব তুর্কেস্তান (শিনজিয়াং) সরকার

১৯৩৭-৪৫ঃ চীন-জাপান যুদ্ধ, যেটা পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চলমান থাকে। এ সময়ে চীনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা ছিল জাপানের দখলে — প্রায় ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি। প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাপানী নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারায় অন্তত ৩৮ লাখ মানুষ। চীনকে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র — কম্যুনিস্ট ও কোমিনতাং উভয়কেই।

দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানীরা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করে চীনাদের বিপক্ষে

১৯৪৫ঃ জাপানের পাপেট রাষ্ট্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে সোভিয়েতরা, ‌হিরোশিমা-নাগাসাকির ঠিক পরপর। তারা জাপানী পাপেট সরকারের সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ করতে করতে সেখানে সোভিয়েতঅধিকৃত উত্তর কোরিয়া থেকে ঢুকে পড়ে বহু চীনা কম্যুনিস্ট, যারা রাশিয়া কিংবা কোরিয়ায় আত্মগোপনে ছিল। তাদের হাতে পড়ে মাঞ্চুকোর সেনাবাহিনীর অস্ত্র। কোমিনতাং সরকারের কাছে সোভিয়েতরা নামমাত্র মাঞ্চুরিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও কম্যুনিস্ট দোসরদের একটা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। মাও সেতুং উত্তরের ঘাঁটি থেকেই কোমিনতাং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। সোভিয়েতরা সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে চীনের সবচে শিল্পায়িত এলাকাটির কারখানার কলকব্জা ইত্যাদি খুলে লুট করে নিয়ে যায়। জাপান বা মাঞ্চুকো থেকে সরাসরি সোভিয়েতের ওপর যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও সোভিয়েতরা জাপানীদের সাথে সংযুক্ত সকল কম্পানিকে এমন “গনিমতের মাল” হিসাবে লুট করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে “নিরপেক্ষ” সোভিয়েতরা ঘোষণাব্যতিরেকে আক্রমণ চালিয়ে জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঞ্চুকো’র দখল নেয়

১৯৪৪-৪৯ঃ শিনজিয়াং উইগুর প্রদেশে আরেকটা “স্বাধীন সোভিয়েত” পাপেট রাষ্ট্র গঠন করে সোভিয়েতরা। ১৯৪৯এ চীনের গৃহযুদ্ধে কম্যুনিস্টদের বিজয়ের পর সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে এ রাষ্ট্রের নেতারা। প্রদেশটি অংশ হয় চীন গণপ্রজাতন্ত্রের।

ছোটখাটর মধ্যে এই ফিরিস্তি আশা করি এ ধারণাটা আপনাদের দেবে যে পশ্চিমারা চীনকে যতটা হিউমিলিয়েট করেছে তার থেকে হাজার গুণে বেশি করেছে তাদের নিকট দুই প্রতিবেশী জাপান ও রাশিয়া — যাদের কোনটিকেই সে আমলে ঠিক পশ্চিমা কাতারে ফেলা সম্ভব নয়। আর পশ্চিমাদের হাতে যে সকল ক্ষুদ্র এলাকা ছিল সব ফিরে পেয়েছে চীন। পায়নি কেবল রাশিয়ার দখলীকৃত বেশিরভাগ এলাকাগুলি। যেটুকু ফিরে পেয়েছে, তাও কম্যুনিস্ট আদর্শগত কারণে, ১৯৪৯এর পর, যখন মাও-স্তালিন দুই দিন পরপর হ্যান্ডশেক করতে ব্যস্ত, আর কোরিয়ার ভাগ্যনির্ধারণে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

হ্যাঁ, রাশিয়ার সাথে সীমানা নিয়ে কিছু শান্তি চুক্তি চীন সম্প্রতি করেছে। কিন্তু ভাবুন ইউক্রেনের সাথে দুই বার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি সত্ত্বেও রাশিয়া সেখানে আগ্রাসন চালিয়েছে “ঐতিহাসিক সংযোগ ও ভ্রাতৃত্বের” দোহাই দিয়ে — চুক্তিভঙ্গ করে। চাইলে চীন একইভাবে উত্তর মাঞ্চুরিয়ার “নিপীড়িত ‘চীনা’ বেরাদরদের” সাহায্যে এগিয়ে এসে ইউক্রেন সাইজের এলাকাটি বেদখল করে নিতে পারে। এ মুহূর্তে চীনের যা লাগে সব পুতিনের রাশিয়া না চাইতেই দিয়ে দিচ্ছে। যদি পুতিনের মৃত্যু হয়, রাশিয়ান ফেডারেশন আলগা হয়ে আসে, তাহলে চীন সেসব এলাকা ফিরে চাইতেই পারে। ১৯১৭ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও বিপ্লবের পরেও রুশ সাম্রাজ্য আলগা হয়ে এসেছিল। সেসময় সুযোগের সদ্ব্যবহারের অবস্থানে চীন ছিল না, ছিল জাপান।

কদিন আগে একটা খবরে এসেছে যে চীন উত্তর মাঞ্চুরিয়ার বিভিন্ন শহরের নাম নিজেদের সরকারী মানচিত্রে দেখানো শুরু করেছে চীনা নামে, সাথে ইংরেজী নাম, কিন্তু রুশে নয়। চীনের টেরিটরিয়াল ক্লেইম করার পন্থা এটাই। যে এলাকায় নিজেদের “ঐতিহাসিক সংযোগ” দাবি করতে চায়, সেখানকার একটি “প্রাচীন” চীনা নাম দেবে, এবং তারপর সেটিকে নিজেদের বলে দাবি করবে। এই কাজটি চীন করেছে ভারতের সাথেও — আকসাই চীন আর অরুণাচল প্রদেশে।

সুতরাং চীনের হিউমিলিয়েশনের শতক নিয়ে বেশি কুম্ভীরাশ্র বর্ষণ না করে তার প্রতিবেশীদের তক্কে তক্কে থাকা উচিত। ভিয়েতনাম, কোরিয়াকে অতীত বহু শতকে যেভাবে করদ বা ঔপনিবেশিক রাজ্যের হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছিল, কিংবা মাঞ্চুরিয়া-তিব্বত-ইনার মঙ্গোলিয়া-শিনজিয়াংকে এখনো সহ্য করতে হয়, সেরকম হিউমিলিয়েশনের গিভিং এন্ডে না থাকলে রিসিভিং এন্ডে থাকতে হবে। এ শিক্ষাটা রাশিয়া অতি শীঘ্রই পাবে।

মেইজি জাপান

ঊনবিংশ শতকের শেষে এশিয়াতে যে ক’টি স্বাধীন দেশ ছিল, তাদের মধ্যে জাপান সবচেয়ে ব্যতিক্রমী। (নিচে মানচিত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে এশিয়া-প্যাসিফিকের অবস্থা দেখা যাচ্ছে।) পশ্চিমাদের জবরদস্তির মুখে দেশের বদ্ধ দুয়ার খুলতে বাধ্য হলেও জাপান উপনিবেশ তো হয়ই নি, বরং খুব কম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক আর সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এশিয়ার কয়েকটি এলাকায় নিজেরাই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলে।

জাপানের প্রথম ডাকটিকেট (১৮৭১) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

জাপানের চূড়ান্ত রূপান্তর যে সময়টায় হচ্ছিল, তার সাক্ষী ছবিতে দেখানো আমার সংগ্রহের ডাকটিকেট দু’টি। প্রথমটা জাপানের প্রথম ডাকটিকেট (১৮৭১)। এর মাত্র তিন বছর আগে সম্রাট মুৎসুহিতোর সিংহাসনে আরোহণের সাথে ‘মেইজি’ যুগের সূচনা হয়। ১৯১৫তে রাজপুত্র ইয়োশিহিতোর অভিষেক ও তাইশো যুগের প্রারম্ভের স্মারক হিসাবে দ্বিতীয় ডাকটিকেটটি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ এই দুই ডাকটিকেটের মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে আছে জাপানের দিগনির্ধারক একটি যুগ।

চিন্তা করছিলাম জাপান কেন ইতিহাসের ব্যতিক্রম।

পশ্চিমা বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের আগমনের ঠিক আগে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বহুদিন বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মডেল ছিল চীন। এ ব্যবস্থায় শিক্ষা, বাণিজ্য, ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে ছিল সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য। সম্রাট ছিলেন দেবতার আসনে আসীন। ছিল ম্যান্ডারিন নামে বিশাল আমলাতন্ত্র। ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকলেও অর্থবহ সমাজজীবন সৌরজগতের গ্রহগুলির মত সূর্যদেবের প্রতিনিধি স্বর্গপুত্র সম্রাটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত । নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হলে সরকারই হত প্রকারান্তরে তার মালিকানাধারী পৃষ্ঠপোষক। বিজ্ঞানী, আবিষ্কর্তা, কবি বা শিল্পীরা ছিলেন রাজদরবারেরই সদস্য।

প্রাচীনকালে সিল্ক রোডের মাধ্যমে বাইরের সাথে যুক্ত থাকলেও চীনে বিদেশী দ্রব্যের প্রয়োজন তেমন একটা ছিল না। সব চাহিদারই স্থানীয় সরবরাহ ছিল। মিং-চিং যুগের চীনাদের অধিকাংশের দৃষ্টিতে বিদেশীরা ছিল বর্বর, আর নিজস্ব বিজ্ঞান-দর্শন ইত্যাদি ছিল সর্বোত্তম। বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের পরে বোধ করি বাইরের কোন গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক ধ্যান-ধারণাই চীন সাম্রাজ্যে পাকাপোক্ত স্থান পায়নি। আর চংহোর ট্রেজ়ারশিপবহরের অভিযাত্রার (১৪০৫-১৪৩৩) পরে সম্রাটের নির্দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য সীমিত করে ফেলা হয়। তদোপরি কনফুশিয়ান সমাজব্যবস্থা ছিল বর্ণকেন্দ্রিক। জন্মসূত্র নয়, সে বিভাজন ছিল পেশাভিত্তিক। এ শ্রেণীবিভাগে বণিকদের স্থান খুব একটা উচ্চ ছিল না।

শুধু চীন নয়, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জাপান — এদের সবাইই কোন না কোন প্রকারে চীনের শাসনব্যবস্থা অনুকরণ করত।

রাজপুত্র ইয়োশিহিতোর অভিষেক ও তাইশো যুগের প্রারম্ভের স্মারক ডাকটিকেট (১৯১৫) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

জাপান একটু ভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। ইউরোপে যেমন নানাভাষী অনেক জাতি নিজেদের মধ্যে ছাড়াও ওসমানী তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লেগে থেকে নিজেদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষসাধন করেছিল, চীনে তেমনটা বৃহদাকারে হয়নি। কিন্তু জাপানে অনেকটা এ অবস্থা বিরাজমান ছিল। সম্রাটকে দেবতুল্য আসনে রেখেই সেখানকার বিভিন্ন সামন্ত একে অন্যের সাথে প্রভাববিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অধিকাংশ সময় দেশচালনার শক্তির কেন্দ্র ছিল কোন না কোন সামন্তপরিবার, সম্রাট ছিলেন প্রতীকমাত্র। ষোড়শ শতকের শুরুতে যখন পর্তুগীজরা প্রথম আসে, তখন জাপান ছিল অনেকগুলি দাইমিয়ো বা সামন্তরাজ্যে বিভক্ত, আর একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুগকে বলে ‘সেনগোকু’ বা ‘ওয়ারিং স্টেটস’ যুগ (১৪৬৮-১৬০০)। চীনে বাণিজ্যের দুয়ার তখন জাপানীদের জন্যেও ছিল বন্ধ। আর তাদের দ্বীপপুঞ্জে কাঁচামালের প্রাচুর্য অতটা ছিল না যে বাণিজ্য ছাড়া স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

তাই পর্তুগীজ, ও পরে স্প্যানিশ-ওলন্দাজদের, সংস্পর্শে যখন জাপানীরা আসে, প্রথমে কালচার শক হয় তাদের। চীনাদের দেখাদেখি ইউরোপীয় বণিকদের ‘নানবান’ বা ‘দখিনা বর্বর’ বলে ডাকত জাপানীরা। আর আলকাতরা-মাখানো ইউরোপীয় জাহাজের নাম তারা দিয়েছিল ‘কুরোফুনে’ — কালোজাহাজ। (নিচের ছবিতে ঊনবিংশ শতকের জাপানী চিত্রে একটি কুরোফুনের রাক্ষুসে চেহারা দেখানো হয়েছে।) দক্ষিণ জাপানের দাইমিয়োগুলি কালচার শক দ্রুত কাটিয়ে উঠে ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তোলে। নাগাসাকি শহরের গোড়াপত্তনই হয় ইউরোপীয় বাণিজ্যঘাঁটি হিসাবে (১৫৭১)। গাদাবন্দুকেরও আমদানি করে পর্তুগীজরা। সে বন্দুক তৈরির প্রযুক্তি ত্রিশ বছরের মধ্যে জাপানীরাই শিখেপড়ে স্বদেশে উৎপাদন-শিল্প গড়ে তোলে। সেসময় ইউরোপের একেকটা দেশে যত না বন্দুক ছিল, জাপানে ছিল তার থেকে অনেক বেশি। চীনের বাণিজ্যপথ বন্ধ থাকায় জাপানীরা নিজেদের স্বার্থেই ইউরোপীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে, নৌবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে, আর নিজেরাও ‘রেড সীল’ বলে নৌবহর (১৬০০-১৬৩৬) পাঠিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে লেনদেনের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেসব দেশের বন্দরে জাপানী নাবিকদের দুর্নাম ছিল রুক্ষ মারপিটে স্বভাবের বলে।

জাপানের এ পর্যায় চলেছে প্রায় সত্তর বছর (১৫৪৩-১৬১৪)। এর মধ্যে পর্তুগীজ মিশনারীরা অনেক স্থানীয় মানুষকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছে। জাপানীরা তাদের সাথে ক্রীতদাস কেনাবেচাতেও অংশ নিয়েছে। দাইমিয়োগুলির মধ্যে যুদ্ধবিবাদে শেষপর্যন্ত বিজয়ী হয় তোকুগাওয়া বলে একটি সামন্ত পরিবার। তাদের নেতা ইয়েইয়াসু খ্রীষ্টধর্ম উৎপাটন অভিযান শুরু করেন এই কারণে যে সে ধর্মে জাপানী সম্রাটের বিশেষ দেবতুল্য স্থান নেই। স্প্যানিশ-পর্তুগীজদের সাথে আঁতাঁত করে খ্রীষ্টানরা জাপানকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেবে, এ ভয় ছিল তাঁর। দেশকে সুসংহত করার পর চীনের মত জাপানের দুয়ারও তাই বিদেশীদের জন্যে বন্ধ করে দেয় তোকুগাওয়া শোগুনাত

তোকুগাওয়া আমলে (১৬০৩-১৮৬৭) তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল জাপান। নিষিদ্ধ খ্রীষ্টধর্মের জায়গা নেয় কনফুশিয়ানিজ়ম, সাথে আসে পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজন। মূলত কৃষিভিত্তিক আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ছিল নগর আর গ্রামাঞ্চলের মাঝে। বন্দুকের বদলে সামুরাই তলোয়ার আবার একটি সম্মানজনক অস্ত্র হিসাবে স্থান পায়। হাইকু কাব্যচর্চা আর উডব্লক প্রিন্টিংয়েরও উৎকর্ষ সাধিত হয়

তোকুগাওয়ারা তাদের এই ‘সাকোকু’ নামক রুদ্ধদ্বারনীতি বেশ শক্তহাতে বাস্তবায়ন করে। জাপানে যদি ভুলেও কোন বিদেশী পদার্পণ করত, এমনকি জাহাজডুবি হয়েও, তাহলে তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। একই শাস্তি ছিল জাপানীদের কপালেও, যদি তারা স্বদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশে পা রাখত। শুধুমাত্র ওলন্দাজ়দের সাথে ভাল সম্পর্কের খাতিরে দেজিমা দ্বীপে তাদের বাণিজ্যঘাঁটি রাখার অনুমতি দেয়া হয়।

ঊনবিংশ শতকে কয়েকটি ব্রিটিশ, ফরাসী, রুশ ও মার্কিন কুরোফুনে চেষ্টা করে রুদ্ধদ্বারনীতির পাশ কাটিয়ে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করতে। প্রতিক্ষেত্রেই জাপানীদের আগ্রাসী মনোভাবের কাছে তারা পরাস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিলমোরের কাছ থেকে চুক্তির প্রস্তাবনাপত্র নিয়ে আসে কমোডর পেরির নেতৃত্বে চারটি যুদ্ধজাহাজ।

কুরোফুনে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসময় ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হয়েছে তিন বছরও হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ার বন্দর সান ফ্রান্সিস্কো থেকে তিমিশিকারী জাহাজ উত্তরে বেরিং প্রণালী পর্যন্ত যাওয়াআসা শুরু করে। কিন্তু একবার প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ফেললে তাদের স্টীমশিপের কয়লার মজুদ যেত ফুরিয়ে। প্যাসিফিকের অন্যপারে তাদের কোলিং স্টেশনের দরকার ছিল খুব। ইউরোপীয়রা জাপানে আসতো পশ্চিমদিক থেকে। তাদের যাত্রাপথে এশিয়া-আফ্রিকার নানা বন্দরে জ্বালানি সংগ্রহের বন্দোবস্ত ছিল। মার্কিনদের এমন সৌভাগ্য ছিল না।

পেরি এদো (বর্তমান টোকিও) এসে পৌঁছালে জাপানীদের নির্দেশমত বৈদেশিক বন্দর নাগাসাকিতে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি জাপানী কর্মকর্তাদের বার্তা পাঠান যে তাঁকে তীরে অবতরণ করতে না দেয়া হলে জাহাজের কামান থেকে গোলা মেরে শহরকেন্দ্র ধ্বংস করে দেবেন। শক্তি প্রদর্শনের জন্যে কামান থেকে ফাঁকা আওয়াজের নির্দেশ দেন তিনি। তখনকার শোগুন ছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী। যথাযথ নেতৃত্ব দেবার লোক না থাকায় জাপানীরা পেরিকে নোঙর ফেলার অনুমতি দেয়। পেরি চুক্তির প্রস্তাব হস্তান্তর করে সে যাত্রা ক্ষান্ত দেন।

পরের বছর আবার ফিরে আসেন পেরি। ততদিনে জাপানীরা বহির্বিশ্বের চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। জেনেছে পশ্চিমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কথা। চীনের মত দানবীয় শক্তিকে সৈন্যসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও কিভাবে ব্রিটেন কাবু করেছে প্রথম আফিম যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২) , তাও তাদের গোচরে এল। বিশেষত দক্ষিণের দু’টি দাইমিয়ো এসব দেখেশুনে তোকুগাওয়াদের রক্ষণশীল নীতির সমালোচনা শুরু করে। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর জাপানীরা সিদ্ধান্ত নেয় জাপানকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার। পেরির সাথে দ্বিতীয় মোলাকাতের সময় তোকুগাওয়ারা বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব আর বাণিজ্যের অসম চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারপরে ফরাসী, ব্রিটিশ, জার্মানদের সাথেও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এধরনের অসম চুক্তির মাধ্যমেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের বেশ ক’টি বন্দরের লীজ় বাগিয়ে নিয়েছিল । জাপানেরও এমনটা হতে চলছিল।

কিন্তু জাপানীরা ক্রমান্বয়ে যেটা করল, তা চীনাদের ঠিক উল্টো।

নতুন করে বৈশ্বিক সম্পর্কস্থাপনের শুরুর ক’টি বছরে স্বাভাবিক কারণেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছিল। ১৮৬৮তে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া শেষে চোশু ও সাৎসুমা নামক প্রগতিশীল দু’টি দাইমিয়ো তোকুগাওয়াদের রাজনৈতিক শক্তিকে হারিয়ে পনেরোবছরবয়েসী সম্রাট মিৎসুহিতোকে প্রকৃত রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী এশিয়া-প্যাসিফিকের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের চেহারা — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

চীনাদের মত পশ্চিমাদের বর্বর বলে গালিগালাজ করে আরো গুটিয়ে যাবার পরিবর্তে মেইজি সম্রাট আর তাঁর অনুসারীরা অভিজাত শিক্ষানুরাগীদের পশ্চিমে পাঠাতে শুরু করেন। বিদেশের চালচলন দেখেশুনে এসে এসব শিক্ষানবিশ অল্প সময়ের মধ্যে জাপানকে পশ্চিমা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করে তোলে। চীনাদের মুখস্থ-বুলি-কপচানো, উপর-থেকে-চাপানো ‘নৈতিকতার’ পরিবর্তে যুক্তিতর্কভিত্তিক আলোচনার পরিবেশ গড়ে ওঠে। ১৮৬০ সালেই নিজেদের স্টীমশিপে করে আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল জাপানীরা। জার্মানি-ফ্রান্স-ইতালি-ব্রিটেনেও দূত প্রেরিত হয়। চুক্তিসম্পাদনের পাশাপাশি রাষ্ট্রদূতদের কাজ ছিল এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাষ্ট্রপরিচালনা, সেনাবাহিনী, ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হল জাপানে। বিশেষ করে জাপানীদের সামরিক শিক্ষা, ইউনিফর্ম, নিয়মানুবর্তিতা — এসবের উপর জার্মান রাজ্য প্রুশিয়ার সেনাধ্যক্ষদের ‌অনেক বড় প্রভাব ছিল।

এসব সংস্কার অবশ্য খুব সহজে হয়নি। তোকুগাওয়াপন্থী বিদ্রোহীদেরকে প্রথমে দমন করতে হয় মেইজিপন্থীদের (বোশিন যুদ্ধ, ১৮৬৮)। তারপর সামন্ততন্ত্রের অবসানের পরে ভূমিসংস্কারবিরোধী দাইমিয়োরা বিদ্রোহ করে বসে (সাৎসুমা বিদ্রোহ, ১৮৭৭)। জমির মালিকানা কৃষকদের বুঝিয়ে দেয়া হলেও তারা ভূমিকর আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে (চিচিমা বিদ্রোহ, ১৮৮৪)। বিপুল সংখ্যায় সামুরাই যোদ্ধাও ছিল সরকারের ভাতাভোগী হিসাবে। তাদের সে ভাতা বন্ধ করে দেয়া শুরু হলে তাদের থেকেও বিরোধিতা আসে (আকিজ়ুকি ও অন্যান্য বিদ্রোহ, ১৮৭৬) । কিন্তু এসবের প্রতিটায় পশ্চিমা সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে তৈরি নতুন সেনাবাহিনী বিজয়ী হয়। পরাজিত পক্ষগুলি অনন্যোপায় হয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়। যেসব দাইমিয়ো মুৎসুহিতোকে সাহায্য করেছিল, তারা পুরস্কৃত হয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদমর্যাদা আর অভিজাত পদবী পেয়ে।

১৮৮৯ সালে রাষ্ট্রতন্ত্র প্রনয়ণের মাধ্যমে জাপান পরিণত হয় কনস্টিট্যুশনাল মনার্কিতে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়, শুরু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। প্রথমে ধনবান পুরুষ নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয়, আর বিশের দশকের মধ্যে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয় সকল নাগরিকদের জন্যে। সামুরাইদের অস্ত্রধারণের এতদিনের একচেটিয়া অধিকার সকল স্বাধীন নাগরিককে দেয়া হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার ফলে স্বাক্ষরতার হারও দ্রুত বাড়তে থাকে। আধুনিক অস্ত্র বানানোর স্থানীয় কারখানা গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়। আর কনফুশিয়ান পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়।

বাণিজ্যের অগ্রগতির সাথে জাপানের স্টীমশিপের বহরও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কূটনীতিক মিশন পাঠিয়ে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে অসম চুক্তিগুলিকেও সংশোধন করতে সমর্থ হয় মেইজি সরকার। রেশমশিল্পের আধুনিকায়নে বৈদেশিক অর্থায়ন আসা শুরু করে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অংশ নিয়ে বনেদী কিছু সামুরাই পরিবার অর্থবান ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মিৎসুই-মুৎসুবিশি সেরকমই দুটো পরিবার। এধরনের পরিবারের মালিকানাধীন কম্পানিগুলিকে বলা হয় জ়াইবাৎসু। শিল্পায়নের সাথে দ্রুত নগরায়ন ঘটে, গ্রামাঞ্চলের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলি শহরমুখী হয়।

মেইজি জাপানের সফলতার কারণ বোধ করি তাদের দূরদর্শিতা। পেরির জোরাজুরির প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে করিৎকর্মা জাপানীরা পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে দ্রুত তাল মিলিয়ে পা ফেলতে শুরু করে। ফন্দিবাজ পশ্চিমাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত চুক্তি সম্পাদন আর সেসব রক্ষা করতে সক্ষম হয় তারা। সংস্কারের ধাঁপে ধাঁপে জাপানের শাসকগোষ্ঠী ও প্রিভিলেজড ক্লাস আর তাদের সাথে জড়িত পশ্চিমা শিল্পপতিদের ইনসেন্টিভ ছিল বলে তারা এ প্রক্রিয়ায় অর্থবহ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। পশ্চিমা ধ্যানধারণাগুলি ভালভাবে নিরীক্ষা করে জাপানীরা সেসবের ভালগুলি বেছে নিজেদের দেশে চালু করে, নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আগলে রেখেই।

আর এই দ্রুত প্রগতির পথে পদার্পণের কারণেই আমার মনে হয় জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছিল অবধারিত। সে আলোচনা হবে পরে কোন এক সময়।


(১) চীনাদের কাছে সম্রাট ছিলেন তিয়ানজ়ি বা স্বর্গীয় পুত্র। তাঁর শাসন করার অধিকার স্বর্গ থেকে আরোপিত। যদি সম্রাট অন্যায্য কাজ করেন ও যুদ্ধ বা বিদ্রোহে তাঁর পরাজয় ঘটে, তাহলে ধরে নেয়া হত তিনি সে স্বর্গীয় অধিকার হারিয়েছেন। চীনের রাজকীয় নাম ছিল তিয়েন মিং, স্বর্গীয় সাম্রাজ্য। তিয়েন শিয়া, বা স্বর্গের নিচে যা কিছু রয়েছে, এসকলের ওপর স্বর্গপুত্রের অধিকার।
একইভাবে জাপানের সম্রাটকে ডাকা হত তেন্-নো বলে। তিনি স্বয়ং সূর্যদেবী আমাতেরাসুর বংশধর। ভিয়েতনামের সম্রাটের পদবী সেরকম ছিল তিয়েন-তু।
আমাদের দেশের মুঘল রাজদরবারের থেকে খুব একটা আলাদা নয় ব্যাপারটা! মুঘল সম্রাটের অন্যতম পদবী ছিল ফিরদাউস আশিয়ানা — ডোমেইন অফ প্যারাডাইজ়।
চীনের প্রথম সম্রাটকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা নিয়ে ‘হিরো’ বলে একটা মুভি দেখেছিলাম। তাতে দেখেছি এই তিয়েন শিয়া ধারণার মাধ্যমে চীনের বর্তমান টপ-ডাউন সিংগল-পার্টি শাসনব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। [Mandate of Heaven]

(২) চ্যংহো ছিলেন মিং ইয়ংল্য সম্রাটের দরবারের প্রভাবশালী মুসলিম খোঁজা। তিনি সাতবার সম্রাটের নির্দেশে সাগরপাড়ি দেন। সাথে ছিল বিশাল বিশাল ট্রেজ়ারশিপ। দক্ষিণ চীন সাগর আর ভারতীয় মহাসাগরের উপকূলের বিভিন্ন দেশে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য নয়, এসব দেশের শাসকদের কাছ থেকে চীনসম্রাটের প্রতি আনুগত্য আর উৎকোচ আদায় করা। বাংলার সুলতানের দরবার থেকেও চীনসম্রাটকে উপহার পাঠানো হয় চ্যংহোর জাহাজে। আফ্রিকা থেকে জিরাফসহ বেশ কিছু অদ্ভূত বুনোপ্রাণী চীনে নিয়ে যাবার পর সেদেশে বেশ সাড়া পড়ে যায়। শ্রীলংকা আর মালাক্কার শাসকরা চীনসম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করে চ্যংহোকে আক্রমণ করায় তাদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করে মিং সম্রাটের দরবারে হাজির করা হয় নাকে খত দেবার জন্যে। ইয়ংল্য সম্রাটের মৃত্যুর পর খোঁজামহল তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারায় ম্যান্ডারিন আমলাদের কাছে। ম্যান্ডারিনদের মন্ত্রণায় নতুন সম্রাট নৌবহর ধ্বংস করে দিয়ে ‘হাইজিন’ বা ভারতীয়দের মত কালাপানির আইন চালু করেন। [Ming treasure voyages]

(৩) জাপানীদের ‘রেড সীল’ বা ‘লালমোহর’ নৌবহরের এরকম নামের কারণ তারা তোকুগাওয়া শাসকের প্রদত্ত লাল রঙের মোহরাংকিত খামে বাণিজ্যের অনুমতি নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করত। তোকুগাওয়ার পত্রে বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। জাপানী শোগুনের পাশাপাশি ইউরোপীয়রাও রেড সীল জাহাজদেরকে জলদস্যুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহায্য করত। জাহাজগুলির কাপ্তানদের মধ্যে জাপানী যেমন ছিল, সেরকম চীনা, ডাচ, ইংরেজ, পর্তুগীজরাও ছিল। জাহাজের পাল-হাল ইত্যাদির গড়নও ছিল চীনা আর ইউরোপীয় সংকর। সাথে ছিল আত্মরক্ষার জন্য কামান। ১৬০০ থেকে ১৬৩৫এর মধ্যে এরকম ৩৫০টি জাহাজ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ফিলিপিন, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন রাজ্যে যাত্রা করে। [Red seal ships]

(৪) শোগুন অর্থ সামরিক শাসক। শোগুনের সম্পূর্ণ জাপানী পদবীর অর্থ ‘বর্বরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সর্বাধিনায়ক’। জাপানের ইতিহাসে বহুবার বিভিন্ন সামুরাই পরিবার সম্রাটকে প্রতীকী স্থানে রেখে নিজেরাই রাষ্ট্রচালনা করত। তোকুগাওয়া শোগুনদের আগে কামাকুরা-আশিকাগা প্রমুখ শোগুনাতও জাপান শাসন করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে এরকমই সামরিক উগ্রপন্থীরা সম্রাটকে সিম্বলিক লীডার মেনে নিজেরাই পররাষ্ট্র ও আভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করত। [Shōgun]

(৫) অদ্ভূত ছন্দ আর শব্দস্বল্পতার অভিনবত্বের কারণে জাপানী হাইকু কাব্য এখন পশ্চিমে বেশ জনপ্রিয়। ১৬৭০এর দশকে তোকুগাওয়া আমলে হাইকুর উদ্ভব।
জাপানের সবচে’ খ্যাতিমান উডব্লক প্রিন্টেড শিল্পকর্ম ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ অফ কানাগাওয়া’ (১৮৩০)। এর শিল্পী হোকুসাইয়ের জীবতকাল ছিল তোকুগাওয়াদের শেষভাগে। বেলজিয়ামের আন্টওয়ের্প বন্দরে জাপানীদের উডকাট শিল্প দেখে আকৃষ্ট হন ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকর ভ্যানগগ। তাঁর সংগ্রহে প্রচুর জাপানী শিল্পকর্ম ছিল। ভ্যানগগের ছবিতেও জাপানী প্রভাব উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে ‘আইরিসেস’ সিরিজ দেখলে বোঝা যায় জাপানী প্রকৃতিপ্রেম আর অংকনশৈলী ছিল ভ্যানগগের অনুপ্রেরণা। [The Great Wave off Kanagawa]

(৬) এই লেখাটি পড়ুন। [Opium Wars]

(৭) ১৮৪০এর প্রথম আফিম যুদ্ধের আগে চীনের একমাত্র ক্যান্টন (গুয়াংচৌ) বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্যের অনুমতি ছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়ে চিং সাম্রাজ্য ‘চিরতরে’ হংকং হারায় (১৯৯৭ পর্যন্ত)। একইসাথে শাংহাইসহ পাঁচটি বন্দরে ঘাঁটিস্থাপনের অধিকার আদায় করে নেয় ব্রিটিশরা। এগুলিকেই বলা হত ‘ট্রিটি পোর্ট’। ব্রিটিশদের পরে ফরাসী আর মার্কিনরাও এ ধরনের অসম চুক্তি করে চীনের সাথে। এসব চুক্তির একটা শর্ত ছিল একস্ট্রাটেরিটরিয়ালিটি, অর্থাৎ কোন বিদেশী অপরাধ করলে স্থানীয় আইনে তার বিচার করা যাবে না, করতে হবে তার স্বদেশে। এভাবে প্রচুর বড় বড় অপরাধী নিস্তার পেয়ে যেত। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের পর ১৮৬০এ আরো প্রায় আশিটি বন্দর এভাবে ট্রিটি পোর্টে পরিণত হয়। এসব পোর্টে বিদেশীজের জন্যে বিশেষ এলাকা আলাদা করে দেয়া ছিল। সেখানে তারা স্বদেশী সৈন্যদের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে আরামের জীবন কাটাত। পরে লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ, অস্ট্রিয়া, ইতালি, পর্তুগাল, নরওয়ে, রাশিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি, জাপানও এধরনের সুবিধাভোগ করে। বিশেষ করে জাপান অত্যন্ত অন্যায্য কিছু সুবিধাভোগের জন্যে চীনকে জোরাজুরি করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমারা তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের জার্মানদের পক্ষে যোগ দেয়ার এটা একটা কারণ। [Treaty ports]

(৮) ‘দ্য লাস্ট সামুরাই’ নামে ২০০৩এ টম ক্রুজের অভিনীত একটি হলিউডি চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে স্বাধীনচেতা সামুরাইদের অন্তিম চিত্র। চলচ্চিত্রটির অনুপ্রেরণা সাৎসুমা অঞ্চলের সামুরাই বিদ্রোহের সত্য ইতিহাস। আর টম ক্রুজের মত জাপানে নানবান ও মেইজি যুগে প্রচুর পশ্চিমা ‘কাউবয়’ অ্যাডভেঞ্চারার জাপানীদের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে, তাদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। [The Last Samurai]

আইসিন জোরো পু-য়ী

ডাকটিকেটে যাঁর ছবি, তাঁর নাম আইসিন জোরো পু-য়ী। চীনের উথাল-পাথাল সময়ে দু’বার শিশুসম্রাট হয়েছেন, একবার পরেছেন মানচুকোর রাজমুকুট। আলোকচিত্রে তাঁকে দেখা যাচ্ছে বেজিংএর বোটানিক্যাল গার্ডেনে মালীর কাজ করতে !

মানচুকোর ১৯৩২ সালের ডাকটিকেটে শেষ চিং সম্রাট আইসিন জোরো ওরফে হেনরি পু-য়ীর ছবি — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

পু-য়ীর অবিশ্বাস্য কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে চীনের সমস্যাসংকুল সময়ে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের ইতিহাস।

ঊনবিংশ শতকের শেষে জাপান ইউরোপীয়প্রধান ‘উপনিবেশী ক্লাবে’ যোগ দেয়। রুদ্ধদ্বার সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জাপানে মেইজি যুগ আরম্ভ হয় ১৮৬৮তে। মেইজি রাষ্ট্রনায়করা সনাতনী ঐতিহ্য ধরে রেখেই স্বদেশের ‘পশ্চিমাকরণ’ শুরু করেন। সে সূত্রে আসে ভূমিসংস্কার, সীমিত গণতন্ত্র, বৈদেশিক বাণিজ্য আর ভাড়াটে সামুরাইদের পরিবর্তে নিয়মিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রচলন।

জাপানে কাঁচামালের প্রাচুর্য ছিল কম, জনসংখ্যার অধিকতার কারণে অন্ন ও কর্মসংস্থানও ছিল সীমিত। পশ্চিমাদের দেখাদেখি শিল্পায়ন শুরু হলে জাপানী শাসকগোষ্ঠীর চোখ পড়ে চীনের ওপর। বিশেষ করে চীনের ‌অধীন কোরিয়া আর মানচুরিয়া, দুটোই ছিল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা।

চীন সেসময় ছিল রক্ষণশীল, পশ্চাদপর, সামন্ততান্ত্রিক একটি সাম্রাজ্য। চীনের সমসাময়িক চিংবংশীয় শাসকরা ছিল দুর্বলচিত্ত, অন্দরমহলের রাজমাতা আর খোঁজাদের প্রভাবে চালিত, আর জনবিচ্ছিন্ন। তদোপরি, চিংরা ছিল বহিরাগত। মিং নামক একটি স্থানীয় হান রাজবংশ সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীন শাসন করে। এরপর পূর্ব সাইবেরিয়ার মানচুরা নুরহাচির নেতৃত্বে চীনের বিভিন্ন অংশ একে একে জয় করে চিংএর গোড়াপত্তন করে।

১৯০৬ সালে নুরহাচির আইসিন জোরো বংশে জন্ম পু-য়ীর। ১৯০৮এ চীনসম্রাট ওয়ারিশহীন অবস্থায় মারা যাবার পর রাজমাতা তিনবছরবয়সী পু-য়ীকে ঘোষণা করেন পরবর্তী সম্রাট হিসাবে। বিধবা-সম্রাজ্ঞী ৎসিশির জবরজং পোশাক আর কুঁকড়ে-যাওয়া চেহারা দেখে পু-য়ী বেদম কান্না করেছিলেন সবার সামনে। এর কিছুদিন পর ৎসিশিও মারা যান

১৯১২ সালে হান জাতীয়তাবাদীদের শিনহাই বিদ্রোহের মুখে পু-য়ীর বাবা রাজসিংহাসনের ওপর তাঁর অধিকার রদ করে দেন। সুন-ইয়াত-সেন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেও তাঁর দলের সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বিশৃংখলা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলির গভর্নর কিংবা সেনাপ্রধানরা নিজ এলাকায় প্রকারান্তরে স্বাধীন শাসন শুরু করেন। ছবির ম্যাপে চীনের চেহারা তাই দেখা যাচ্ছে পাজ়ল পীসের মত

এই সময়টা তক্কে তক্কে ছিল জাপানের সামরিক উগ্রপন্থীরা। ইতিমধ্যেই ১৮৯৭ সালে কোরিয়া জাপানী সাম্রাজ্যের আওতায় এসেছে। চীনের ওপর রুশদের লোলুপ দৃষ্টিকে জাপানীরা অন্ধ করে দেয় ১৯০৫এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে তাদেরকে হারিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকার সুবাদে জার্মানির চীনা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কলোনিগুলি জাপানের হস্তগত হয়।

এভাবে প্রতিযোগীদের হারিয়ে জাপান ইউরোপীয়দের মতই চীনসম্রাটের কাছ থেকে ‘কনসেশন’ আদায় করা শুরু করে। তারা চিংদের আদিনিবাস মানচুরিয়া অঞ্চলে রেলরোড গড়ার আর পরিচালনার লীজ় বাগিয়ে নেয়।

কোমিনটাংদের সময় চীনের অবস্থা। কোরিয়া, তাইওয়ান জাপানের অংশ, মানচুকো তাঁবেদার রাষ্ট্র, ১৯৩৭এ উত্তর চীনের বাকি অংশও জাপানের দখলে। — মানচিত্র ইন্টারনেট থেকে।

এরকম সময়ে পু-য়ী তাদের হাতে এসে পড়েন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে।

বালক পু-য়ী সম্রাট না হলেও রাজদরবার তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়নি। ১৯১৭এ এক জেনারেল বেজিং দখল করে পু-য়ীকে আবার সম্রাট ঘোষণা করে। দ্বিতীয় দফা নামমাত্র সম্রাট হবার বারো দিন পর আরেক ওয়ারলর্ডের বিরোধিতার মুখে সে দাবি পরিত্যক্ত হয়। তখন পু-য়ীর বয়স এগারো।

১৯২৪ সালে পু-য়ীকে ফরবিডেন সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসময় পু-য়ীর বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তাঁর ব্রিটিশ শিক্ষক রেজিনাল্ড জনস্টন। পু-য়ী চেয়েছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে। জাপানপ্রেমী জনস্টনই তাঁকে সুপারিশ করেন ব্রিটেনে না গিয়ে তিয়ানজিন শহরে আশ্রয় নিতে, সেখানে জাপানীদের প্রভাব রয়েছে। তিয়ানজিনে পৌঁছনোর পর চিনিতে মাছি পড়ার মত সুবিধাবাদী জাপানী-চীনাদের ভীড় জুটে গেল পু-য়ীর চারপাশে। সম্রাটের মত জীবনযাপন করতে তাঁর কোন সমস্যা হল না।

১৯৩১ সালে রেলপ্রতিরক্ষায় নিয়োজিত জাপানী বাহিনীর একটি উগ্রপন্থী অংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের অজান্তে মানচুরিয়াকে তাঁবেদারি রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা মুকদেন শহরের কাছে রেললাইনের ওপর ডায়নামাইট ফাঁটিয়ে তার দোষ চাপায় চীনা ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ ওপর । অফিসার্স ক্লাব থেকে জাপানীরা চীনা সেনানিবাসে গোলানিক্ষেপ করে। স্থানীয় চীনা ওয়ারলর্ড কোন অর্থবহ প্রতিরোধ না করায় কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর চীনের তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ জাপানী সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।

চীন এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লীগ অফ নেশন্সে। লীগ ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর্ল লিটনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন পাঠায়। তদন্ত শেষ না হতেই জাপানের চররা পু-য়ীকে অনুরোধ করে ‘স্বাধীন’ মানচুরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হতে। ২৫ বছরবয়সী পু-য়ী ছোটবেলা থেকেই পরিচারকদের কাছে শুনে এসেছেন নিজ রাজবংশের গৌরবের ইতিহাস। জেনেছেন আইসিন জোরোরা স্বর্গীয় অধিকারবলে চীনের সম্রাট। অপরিপক্ব সরলমনা পু-য়ী জাপানীদের আসল মতলব বোঝার পরিবর্তে ভাবলেন, এবার তিনি ন্যায্য স্থানে পুনরোধিষ্ঠিত হবেন।

জাপানীরা অবশ্য তাঁকে শুরুতেই সম্রাট না বানিয়ে নতুন ‘পাপেট’ রাষ্ট্র মানচুরিয়ার ‘চীফ এগজেকিউটিভ’ পদে বসায়। সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম জাপানীদেরই হাতে ছিল। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই হাজারে হাজারে জাপানী এসে হাজির হলো মানচুরিয়াতে, কাজ শুরু করলো নতুন কয়লাখনি, স্টীল ফ্যাক্টরিতে। চীনাদের রাজনৈতিক স্বাধিকার পায়ে দলে তাদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করলো জাপানী শিল্পপতিরা।

১৯৩২এ লিটনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পর আসল সত্য বেরিয়ে এল। লীগসদস্যরা জাপানকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব আনল। অপরাধস্বীকারের পরিবর্তে জাপানের প্রতিনিধি উল্টো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কী অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করছে জাপান, চীন তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনে কী পরিমাণ অবহেলা করছে, ইত্যাদির ফিরিস্তি দেবার পর দলবলসহ সম্মেলনকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। ছবিতে দেখানো টিনটিন ‌অ্যান্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকসের কার্টুন স্ট্রিপে এই সত্যি ঘটনাটি অমর করে রেখেছেন কার্টুনিস্ট এরঝ়ে।

টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে দেখানো হয়েছে লীগ অফ নেশন্স থেকে জাপানের ওয়াক-আউটের ঐতিহাসিক দৃশ্য, যদিও এখানে কাহিনী আসল ইতিহাসের থেকে শেষমেশ একটু আলাদা। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপর ১৯৩৭এ জাপান চীনের বাকি উত্তরাংশও দখল করে নেয়। চীনাদের ওপর অভূতপূর্ব সিভিলিয়ান বমিং ও হত্যাযজ্ঞ ‘রেপ অফ নানকিং’ সংঘটিত হয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পু-য়ী হন সোভিয়েতদের রাজবন্দী। তারা আরামেই রাখে প্রাক্তন সম্রাটকে। টোকিওতে জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বাক্ষ্য দেন পু-য়ী। এরপর ১৯৫০এ চীনের নতুন কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে পু-য়ীকে হস্তান্তর করে সোভিয়েতরা। পু-য়ী ভেবেছিলেন রুশ কম্যুনিস্টরা যেমন ৎসার নিকোলাসকে সপরিবারে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল, তেমনটাই হবে তাঁর ভাগ্যলিখন। কিন্তু মাও আর চৌএনলাইয়ের ছিল অন্য ধান্ধা।

পু-য়ীকে একটি রিএডুকেশন ক্যাম্পে রাখা হল নয় বছর। এই প্রথমবার তিনি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। এতদিন তাঁর দাঁতব্রাশ থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করে দিত কোন না কোন চাকর, এখন সব নিজের দায়িত্ব। এছাড়াও তাঁকে দেখানো হলো তাঁর পূর্বজীবনের অত্যাচারের চিত্র। দুর্বল মনস্তত্ত্বের সুযোগে সমাজতন্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হল তাঁকে। ১৯৫৯এ পেলেন মুক্তি, সম্রাট হিসাবে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসাবে। মাও-চৌএনলাই প্রমুখের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হল তাঁর।

বেজিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিচর্যাকারীর কাজ করছেন সম্রাট আইসিন-জোরো পু-য়ী — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

কম্যুনিস্টরা পু-য়ীর পরিবর্তনকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের ঢোল বাজাতে ব্যবহার করলেও পু-য়ীর তাতে তেমন কিছু যায়-আসেনি। সাধারণ মানুষের সাথে সহজে মিশেছেন, তারাও তাঁকে ভালবেসেছে। বেজিংয়ে মালীর কাজ করেও লজ্জিত হননি। নিজের পুরনো রাজপ্রাসাদের ট্যুরিস্ট গাইডও হয়েছিলেন কিছুদিন। সম্রাটজীবনে বার চারেক রাজনৈতিক বিয়ের পর শেষ স্ত্রীর সাথে সুখেই ঘর বাঁধেন ১৯৬২তে। ১৯৬৭ সালে ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগে মারা যান শেষ চীনসম্রাট।

মারা যাবার আগে স্বদেশের প্রগতিশীল সংস্কার দেখে যান পু-য়ী। তাঁর নিজেরও যে মোক্ষলাভ হয়েছিল, তা ফুঁটে উঠেছে তাঁর বইয়ের এই উক্তির মধ্যেঃ
“I was the number one prisoner of my palaces. Today, I enjoy real freedom and equality. I can go anywhere — something I never dreamed possible in the first fifty years of my life.”


(১) মাও আর চৌএনলাইএর উৎসাহ পাওয়ার পর নিজের একটা জীবনী লিখেন পু-য়ী। ‘দ্য ফার্স্ট হাফ অফ মাই লাইফ’ নামে এই বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। ইতালীয় পরিচালক বেরতোলুচ্চি ১৯৮৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানান, নাম ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’। [The Last Emperor]

(২) মানচু (আরেক নাম জুরচেন) জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা মোঙ্গলদের কাছাকাছি। মানচুরিয়া বলে কখনো কোন আলাদা দেশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে জাপানী ‘গবেষণার’ উপর ভিত্তি করে মানচুরিয়া আর তার অধিবাসীদের আলাদা পরিচয় বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ‘মানচুরিয়ার’ অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল হান চীনা, মানচুরা ছিল সংখ্যালঘু। তাছাড়াও মানচুরা ইতিমধ্যে হান চীনা ভাষা-সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছিল। পু-য়ী মানচু ভাষায় কথা বলতে একদমই পারতেন না, ম্যান্ডারিন আর ইংরেজী পারতেন অল্প অল্প। [Manchu people]

(৩) ৎসিশি ১৮৫০এর দশকে চীনা সম্রাটের রক্ষিতা ছিলেন। সম্রাট মারা যাবার পর তিনি হন এম্প্রেস-ডাউএজার। প্রথমে ছেলে, তারপর ভাগ্নেকে সম্রাট বানিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন ৎসিশিই। নানা রকম অন্তর্কলহ, ষড়যন্ত্র ছিল চিং দরবারে দৈনন্দিন ঘটনা। চীনের বহির্দেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের সম্রাটদের আমলের রক্ষণশীলতা চলে আসছিল। কয়েকটি বিদ্রোহ-বিপ্লবের পর ৎসিশি শেষের দিকে চেষ্টা করলেও চীনের উদারীকরণ করতে ব্যর্থ হন। [Empress Dowager Cixi]

(৪) ১৯১২ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত চীন ছিল গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। সুন-ইয়াত-সেন কিছুদিন রাষ্ট্রপতি থাকার পরে তাঁকে সরিয়ে ইউয়েন-শি-কাই নিজে সম্রাট হবার চেষ্টা করেন। বিশের দশকে কুওমিনটাং পার্টিকে সুসংহত করেন চিয়াং-কাই-শেক, সে জন্যে নতুন রাজনৈতিক দল কম্যুনিস্টদের সাথেও হাত মেলান। এসময় চীনের বড় বড় প্রদেশ, যেমন সিনকিয়াং, তুরকেস্তান, ইয়ুনান, তিব্বত, প্রভৃতি এলাকায় প্রাইভেট মিলিশিয়া দল একরকম চাঁদাবাজি করে বেড়াত, আর একে অন্যের সাথে আঁতাত করে অন্যান্য ওয়ারলর্ডদের সাথে যুদ্ধে লেগে থাকত। ১৯২৮এ চিয়াং-কাই-শেক চীনের অধিকাংশ এলাকা একীভুত করে ওয়ারলর্ড যুগের সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু তারপরও উত্তরে বহু দুর্গম অঞ্চলে ওয়ারলর্ডরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজিয়ে রাখে। [Warlord Era]

(৫) উত্তর চীনের উন্নয়নের নামে রুশরা মাঞ্চুরিয়াতে রেলরোড গড়ে দেয়। তার সকল আয় ছিল রুশ সরকারের। তাছাড়াও রেলরোডের আশপাশের অঞ্চলে প্রতিরক্ষার নামে সৈন্য মোতায়েন করার অধিকার বাগিয়ে নেয় তারা। রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতার পর রেলরোডের দক্ষিণাংশ জাপানীদের দখলে আসে। ১৯২৯ সালে চীনারা সোভিয়েতদের কাছ থেকে রেলওয়ে ফেরত চায়। তারা দাবি করে যে ১৯১৭এর বিপ্লবের সময় এক রুশ সেনানায়কের সাথে চুক্তি হয়েছিল রেলওয়ে বিনা খরচে চীনকে ফিরিয়ে দেবে রাশিয়া। সোভিয়েতের সাথে এক দফা যুদ্ধে হারার পর চীন রেলরোডের পূর্বাংশের ওপর রুশদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। [Chinese Eastern Railway]

(৬) নিজেরাই শত্রুর সাজ নিয়ে নিজেদের ওপর আক্রমন করে দোষ শত্রুর উপর চাপিয়ে অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার এই কৌশলকে বলা হয় ‘ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক’। জাপানীদের মানচুরিয়ার ঘটনার পরপরই ইতালীয়রা ইথিওপিয়াতে আর জার্মানি পোল্যান্ডে এধরনের আক্রমণের উসিলা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধায়। অধুনা সময়ে পুতিনের রাশিয়াও এধরনের আগ্রাসন করেছে। এফএসবি বলে রুশ গোয়েন্দা-সংস্থার এক সদস্য ১৯৯৯ সালে মস্কোর অ্যাপারট্মেন্টে বোমা পাতার সময় নাকি ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব তথ্য প্রমাণ গায়েব করে দেয়া হয়। বোমা হামলার দোষ চাপানো হয়েছিল চেচেন সন্ত্রাসবাদীদের উপর, আর এই উসিলায় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পুতিনের গদি পাকাপোক্ত হয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশল খাটিয়েছে রুশরা। [False flag]

(৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর সিংগাপুর, মালয়, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীনও জাপানের কব্জা হয়। ১৯৪১এ পার্ল হারবার আক্রমণ, তারপর জাপানীদের বিরুদ্ধে মার্কিনদের বিপুল রক্তক্ষয়ী একেকটা দ্বীপযুদ্ধ। তারপর মিত্রদের সাথে গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্তালিনের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। পশ্চিম দিকে সামরিকভাবে দুর্বল জাপানী সেনাশক্তির বিরুদ্ধে রুশদের জয়যাত্রা শুরু হয় মানচুরিয়া থেকে, আর শেষ হয় উত্তর কোরিয়া আর সাখালিন দ্বীপপুঞ্জ দখলের মাধ্যমে। [Soviet invasion of Manchuria]

মাৎসুরি

Featured Video Play Icon

জাপানের পরব মাৎসুরি বাংলাদেশের মেলার মতই উৎসবমুখর, রঙ্গীন। আর তাতে তাল-সুর দিয়েছে আমাদের ঢাকের মত তাইকো ড্রাম।

ছোটবেলায় গ্রাম্যমেলা রচনা লিখতে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। ঢাকার উত্তরায় থাকতে আব্বা কাছের গ্রামেই বৈশাখী মেলায় নিয়ে যেতেন। চড়কীতে চড়া, বাতাসা খাওয়া, ইত্যাদির মধ্যে ব্যাপক আনন্দ ছিল।

এখন মার্কিনী প্রবাসজীবনে যাই কাউন্টি আর স্টেট ফেয়ারে। সে অভিজ্ঞতা বস্তুত অন্যরকম, কিন্তু ভাবে একইরকম! দূর-দূরান্তের ফার্ম থেকে গরু-ছাগল-ঘোড়া-ভেড়া চলে এসেছে, সাথে ট্রাক্টর-প্লাউ-ওয়্যাগন ইত্যাদিও হাজির। বাচ্চারা চরম মজা পায় সেগুলিতে চড়ে। টার্কি লেগ খাই যত অখাদ্যই হোক। একেক স্টেটের ফেয়ারের ভাবগতিকও তাদের ইতিহাস-সংস্কৃতিমত একেকরকম।

তবে আজকে লিখছি জাপানী মেলা নিয়ে!

জাপানে গ্রাম্য মেলা এখন আর গ্রাম্য নেই। মাৎসুরি নামে পরিচিত এসব অনুষ্ঠান এখন সাধারণত শহরের মূল রাস্তা ধরেই হয়। প্রত্যেকটা পার্বণের পিছনে কোন শিন্তো বা বৌদ্ধধর্মীয় উপাসনার উপলক্ষ্য আছে। কোথাও কোথাও ধর্মীয় উপলক্ষ্য ছাড়াও হয়। একেক এলাকায় অনুষ্ঠান হয় বছরের বিভিন্ন নির্ধারিত সময়ে। বিশেষ করে পৌষপার্বণ বা নবান্নের সময়ে অনেক অঞ্চলেই এ অনুষ্ঠান হয়। হানামি বা চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল তো এখন বিশ্বের যেখানেই চেরি হয়, সেখানেই ছড়িয়ে গেছে! বু্দ্ধের জন্মোৎসবও পালিত হয় হানামাৎসুরির মাধ্যমে।

সেই মেলাতে কখনো কখনো জাপানীরা আমাদের দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের রথযাত্রা বা শিয়া সম্প্রদায়ের তাজ়িয়ার মত পাল্কিতে করে তাদের আঞ্চলিক কামি বা ‘দৈবশক্তির আধার প্রতিমাকে’ নিয়ে মন্দিরে স্থাপন করে। এমন একই জিনিস সামনাসামনি দেখেছি ঢাকার ইস্কন রথযাত্রায়, সেটার আরেকটু অরিজিন্যাল দিনাজপুরের কান্তজীউ মন্দিরে। কৃষ্ণের প্রতিমা বাৎসরিক বাপের-বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি যাওয়া-আসা করে। ক্যাথলিকদের প্যাশন প্লে-ও অনেকটা একই।

মাৎসুরি মেলার দোকানপাটে বড়রা তাকোইয়াকি বলে সীফুড স্ন্যাক খায়, ছোটরা গোল্ডফিশ ধরার খেলা খেলে। চীনের লায়ন ড্যান্স বা ড্রাগন ড্যান্সের মত কাগজের তৈরি নেবুতা ফ্লোট নিয়ে ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিহিত জাপানীরা শোভাযাত্রা করে। হানেতো বলে লম্ফজম্ফের বিশারদ হাতে পাখা নিয়ে তাদের সামনে নাচতে নাচতে যায়।

আর সে উৎসবের প্রাণ ঢাক জিনিসটা বঙ্গীয়-জাপানী দুই কালচারে এক্কেবারে কমন!

বাংলাদেশে কমপক্ষে বিশ রকমের পারকাশন ইন্স্ট্রুমেন্ট আছে। পাখোয়াজ-তবলা তুলনামূলক অধুনার আবিষ্কার, আরবী-ফারসীদের রপ্তানী। জাপানী বিশেষজ্ঞরা ধারণা করেন যে, তাইকো নামের কয়েকরকম ঢাক প্রাচীনকালে — ষষ্ঠ শতকে — ভারত থেকে বৌদ্ধধর্মের সাথে সাথে সিল্ক রোডের মারফত চীন-কোরিয়া হয়ে আমদানি হয়। বহু বৌদ্ধ সংস্কৃত পান্ডুলিপিও সে পথে পাচার হয়েছে, সাথে সংস্কৃত কিছু প্রপার নাউনও জাপানীতে ঢুকে পড়েছে। যেমন ধ্যান হয়ে গেছে জ়েন, অমিতাভ বুদ্ধ থেকে আমিদা

যে ট্র্যাকটা দিলাম লেখার সাথে, সেটা পরিবেশন করছে কোদো বলে একটা বিশ্বখ্যাত তাইকো ড্রামারদল। সাদো বলে একটা ছোট দ্বীপে তাদের বাস। বাঁশি, করতাল, জয়ঢাক আর দুন্দুভির মত বাদ্যযন্ত্রের সাথে নাচানাচি করে তারা মাৎসুরির চমৎকার একটা আবহ তৈরি করেছে। সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে শোনা ঢাকের তালও মনে করিয়ে দেয় এদের ঢাকের আওয়াজ। শব্দধারণটাও খেয়াল করবেন! ভাল হেডফোনে বা থ্রিডি সাররাউন্ড সিস্টেমে ফুল ভল্যুমে শুনলে আপনার মনে হবে লাইভ শুনছেন।

আর এ লাইভে শোনারই বস্তু! আমি প্রথম তাইকো শুনি বোধহয় ২০০৩এ, ঢাকার শিল্পকলা অ্যাকাডেমিতে ওয়াদাইকো ইয়ামাতো দলটির পরিবেশনায়। সে এক না-ভোলা অভিজ্ঞতা! গগনবিদারী ড্রামের শব্দের ভাইব্রেশনটা আপনার হৃদয়ের গভীর ছুঁয়ে ফেলবে! মুস্তাফা জামান আব্বাসী বোধহয় তখন ডিরেক্টর আর উপস্থাপক ছিলেন, আমাদের দেশের ঢাকঢোলের সমান্তরালটা দর্শকদের কাছে তুলে ধরতে ভুলেননি!

১৯৬৪র টোকিও অলিম্পিকে তাইকোর রিদম শোনার পরে পশ্চিমা বিশ্বও এই ঐতিহ্যকে জাতিনির্বিশেষে আপন করে নিয়েছে। খোদ আমেরিকাতেই মনে হয় এখন আটশ’র বেশি তাইকো ক্লাব। গ্রুপ অ্যাক্টিভিটি আর শারীরিক ব্যায়ামের মজায় অনেকেই এসবে অংশ নেয়। জাপানের ইলেক্ট্রনিক মিউজ়িকের কম্পোজ়ার কিতারোও তাঁর কয়েকটি ট্র্যাকে তাইকো ড্রাম ব্যবহার করেছেন, মাৎসুরি নামে তাঁরও একটা কম্পোজ়িশন আছে।

এখন পপ কালচারে তাইকো জায়গা করে নিলেও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এর ব্যবহারের প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় দ্বাদশ শতকের সামুরাই-সামন্ততান্ত্রিক কামাকুরা পিরিয়ড থেকে। জাপানের অন্যান্য স্বকীয় সংস্কৃতিরও উদ্ভব এসময়ে। তখন সমগ্র জাপান সম্রাটের শাসনে নামমাত্র থাকলেও সামন্তরা ছিল নিজেদের এলাকায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। বিভিন্ন সামন্ত রাজ্য নিজেদের মধ্যে সামুরাই বাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করত। তখন যুদ্ধসঙ্গীতে তাইকোর স্থান ছিল। তারপর নো বা কাবুকি নাটকের উদ্ভবের পরে তার আবহসংগীত তৈরিতে অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের সাথে তাইকোও শামিল হয়।

পুরনো আমলে ঢাকঢোল পেটানোতে ছেলেদের একচেটিয়া মনোপোলি থাকলেও এখন কিন্তু জাপানে মেয়ে তাইকোবাদকের সংখ্যা ছেলেদের থেকে বেশি! জাপানের ট্র্যাডিশনাল সমাজে আরো অনেক কিছুর সাথে এখানেও একটা সমতা চলে এসেছে। টকিং অ্যাবাউট দ্যাট!… বাংলাদেশী মেয়েদের জন্যে ঢাকঢোল পেটানোর অনুপ্রেরণা রইলো!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!