সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন

চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসকগোষ্ঠী তাদের পূর্বসূরী জাতীয়তাবাদী কুমিন্টাংয়ের বিরুদ্ধে ১৯৪৯এ গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। দাবি করা হয় যে, কম্যুনিস্ট শাসন শুরুর মাধ্যমে তারা চীনের “সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের” যবনিকাপাত করেছে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই টার্মটি আসলে চীনের কুমিন্টাং জাতীয়তাবাদীদেরই তৈরি ও ব্যবহৃত। অর্থাৎ চীনা কম্যুনিস্টরা কম্যুনিজমের শ্রমিক-চাষী-সৈনিক ইত্যাদি খেঁটে খাওয়া মানুষের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব কপচালেও পেতি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সোশালিস্ট মার্কেট পলিসি ছেড়ে দিলেও ঐ পেতি-বুর্জোয়া ন্যাশনালিজম রয়ে গেছে। এটা বলতে গেলে রাশিয়ার মত অবস্থা, স্তালিনের মৃত্যুর পর কম্যুনিজম চলেছে ন্যাশনালিজমের ওপর ভিত্তি করে। আর কম্যুনিজমের পতনের পর সোশালিজম নাই হয়ে গেলেও ন্যাশনালিজম ষোল আনা বর্তমান।

দং শিওয়েনের অংকিত “জাতির গোড়াপত্তন অনুষ্ঠান” চিত্রকর্মে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণারত মাও জেদং, বর্তমান চীনা ন্যারেটিভে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি একই সাথে।

যা হোক, আজকে চীন ও রাশিয়া আপাত মিত্র। তবে সে মিত্রতায় চীনের পাল্লা অসামঞ্জস্যপূর্ণরকম ভারি। আর কোন বাজার না থাকায় রাশিয়া ধীরে ধীরে পরিণত হতে পারে চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে। সেটা অবশ্য একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রান্তিক সম্ভাবনা। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে চীনের ওপর রাশিয়া অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ও ভোক্তাপণ্যের জন্য। দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে সন্তুষ্ট রাখার জন্য।

কিন্তু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে অন্য একটা ব্যাপারে খটকা লাগা স্বাভাবিক। সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি কি চীনা কম্যুনিস্টরা সম্পূর্ণ করেছে? তাইওয়ান তো এখন আর ভিনদেশীদের কলোনি নয়। আর হংকং-মাকাউ তো নব্বই দশকেই ফিরে গেছে, তাও তদকালীন কলোনিয়াল প্রভুদের ইচ্ছায় — সেসব স্থানের মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটে নয়।

সবুজ দাগে দেখানো “নাইন-ড্যাশ” লাইন বরাবর চীনা সমুদ্রসীমার দাবি, যেটা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের লংঘন ও প্রতিবেশী দেশগুলির ন্যায্য হিস্যার পদদলন
চিং সাম্রাজ্যের শিখরে চীনের সীমান্তরেখা, ঊনবিংশ শতকের পূর্বার্ধ

এখনো নাইন ড্যাশ লাইন, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে চীন লেগে থাকে। চীনাদের দাবি অন্যায্যভাবে চিং রাজত্বকালে ও রিপাবলিক অফ চায়না শাসনামলে এসব এলাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি নাকি গলাধঃককরণ করেছে। আসুন একটু সে অন্যায্যতার ফিরিস্তিটা দেখি। খেয়াল করে দেখবেন, ১৮৫৮ সালের ঘটনাটা!

১৮৩৯-৪২ঃ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। পাঁচটি বন্দরে বিশেষ শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশদের। হংকং ব্রিটিশদের দখলে (শুধু হংকং দ্বীপটি, আয়তন ৮০ বর্গ কিমি)। পরে লীজকৃত নিউ টেরিটরিসহ হংকং চীনের কাছে ফিরে যায় ১৯৯৭ সালে। সকল ট্রিটী পোর্টের বিশেষ সুবিধা ত্রিশের দশকের মধ্যে পশ্চিমারা হারায়, প্রথমে মার্কিন মধ্যস্থতায়, পরে চীন-জাপান সংঘাতের ডামাডোলে। অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা আসার আগেই। ট্রিটি পোর্টগুলিতে চীনা সার্বভৌমত্বই জারি ছিল, কিন্তু পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীরা বিশেষ সুবিধা পেত।

হংকং ও আশপাশের ব্রিটিশ উপনিবেশ পুরো চীনের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষু্দ্র

১৮৪৪ঃ ফরাসীদের সাথে ব্রিটিশদের মত একই প্রকার আনইকুয়াল ট্রিটীর মাধ্যমে সে পাঁচটি বন্দরে বিশেষ সুবিধাপ্রদান।

১৮৫৬-৬০ঃ ব্রিটিশ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। হংকংয়ের সাথে কাউলুন যুক্ত, ৭০ বর্গ কিমি। এ সুযোগে রুশরা সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে জায়গা দখলের ষড়যন্ত্র করে।

১৮৬০ সালে আফিম যুদ্ধপরবর্তী চিং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

১৮৫৮ঃ ট্রিটী অফ আইগুনের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের হাতে চিং সম্রাটকে ছেড়ে দিতে হয় আউটার মাঞ্চুরিয়া নামক এক বিশাল এলাকা। আমুর-উসুরি নদী দ্বারা সীমানা নির্ধারিত হয়। এলাকা ৬,০০,০০০ বর্গ কিমি, বর্তমান ইউক্রেন সাইজের। এ অঞ্চল এখনো রাশিয়ার হাতে। ভ্লাদিভস্তক মূল শহর, আরেক বড় শহর খাবারস্ক। অধিকাংশ জনসাধারণ মাঞ্চুরিয়ান, রুশ নয়। চীন এখনো এই বিশাল সম্পদশালী এলাকা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কবে চীনের এ হিউমিলিয়েশনের শেষ হবে তাও কারো জানা নেই। ষাটের দশকে সোভিয়েতদের সাথে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সকলে মুখ চেপে আছে।

১৮৫৮ সালে বিনা যুদ্ধে সামরিক হুমকি-ধামকি দিয়ে উত্তরপূর্ব মাঞ্চুরিয়ার বিশাল এলাকা চীনের থেকে হস্তগত করে রুশ সাম্রাজ্য, এলাকাটি এখনো রাশিয়ার অংশ

১৮৫৮ঃ ট্রিটি অফ তিয়েনৎসিনের মাধ্যমে ট্রিটি পোর্টের সংখ্যা ও সুবিধা আরো বৃদ্ধি। ব্রিটিশ-ফরাসীদের পাশাপাশি রুশ-মার্কিন নাগরিকদের এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। রুশরাও পাবে ট্রিটি পোর্টের সুবিধা। প্লাস যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ।

১৮৮৪-৮৫ঃ ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ। ভিয়েতনামের তিনটি অঞ্চলের (আনাম — ১,৩০,০০০ বর্গ কিমি, তংকিন — ১,০৩,০০০ বর্গ কিমি, কোচিনচিন — ৬৯,০০০ বর্গ কিমি) ওপর ফরাসীদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার। তবে এ ভিয়েতনাম অতীতে বহুবার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। চীনই তাদের প্রাচীনতম শত্রু। ভিয়েতনাম স্বাধীনদেশ হিসাবে আবির্ভূত হয় ১৯৪৮ সালে। ফরাসী-মার্কিনদের বিরুদ্ধে পরে যুদ্ধ করলেও চীন তাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ।

ভিয়েতনামের উত্তরাংশ চিং সাম্রাজ্যের প্রভাববলয়ে থাকায় ফ্রান্স ও চীনের মধ্যে ১৮৮০র দশকে যুদ্ধের মাধ্যমে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়

১৮৮৮ঃ ব্রিটিশ ভারতের সিক্কিম অভিযান। তিব্বতের সাথে পাল্লা দিয়ে এ ছোট রাজ্যটির সাথে প্রটেক্টরেটের সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারত। সিক্কিমের আয়তন ৭,০০০ বর্গ কিমি। ওদিকে কিন্তু তিব্বতকে চিং সম্রাট সে অধিকার দেয়নি ইত্যাদি বলা হয়। তিব্বত নাকি চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও তিব্বত ছিল এ এলাকার সার্বভৌম একটি সাম্রাজ্য। কম্যুনিস্ট চীন ১৯৫০ সালে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তিব্বতের ক্ষুদ্র প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে “হিউমিলিয়েশনের” সমাপ্তি ঘটায়। এখনো দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের একটি নির্বাসিত সরকার আছে ভারতে। তিব্বতের আয়তন ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি।

১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন তিব্বতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে “শান্তিপূর্ণ মুক্তি” এনে দেয় চীনের লালবাহিনী

১৮৯৪-৯৫ঃ নব্য পরাশক্তি জাপানের সাথে যুদ্ধ ও পরাজয়। তাইওয়ান দ্বীপটি (৩৬,০০০ বর্গ কিমি) জাপানের কাছে সোপর্দ। কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর জাপানী প্রটেক্টরেট, যদিও সেটির পোশাকি নাম এম্পায়ার অফ কোরিয়া। কোরিয়া স্ব অধিকারে একটি সার্বভৌম সাম্রাজ্য ছিল, তবে মোঙ্গল দিগ্বিজয়ের পর পর চীনের ইউয়ান, মিং ও চিং সাম্রাজ্যের লেজুড় হয়ে রয়। তবে সে সম্পর্কটা ছিল করদ রাজ্যের। ১৮৮০র দশকে কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব হরণ করে চিং সাম্রাজ্য। ফলশ্রুতিতে জাপানী আক্রমণ। এখন দুই দেশে বিভক্ত কোরিয়া উপদ্বীপ (উত্তরঃ ১২০,০০০ বর্গ কিমি, দক্ষিণঃ ১০০,০০০ বর্গ কিমি)। চীন উত্তর কোরিয়ার ওপর বলতে গেলে এখনো সেরকম প্রাচীন প্রভাব খাঁটিয়ে চলেছে। তাইওয়ান ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও ছিল ডাচ-পর্তুগীজ ঘাঁটি। তাইওয়ানের মূল অধিবাসীরা চীনা নয়। চিং সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অন্তর্গত হলেও সেখানে স্থানীয়রা বিদ্রোহ করেছে, জাপানী শাসনের প্রাক্কালে ১৮৮০র দশকে একটি ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দখলে থাকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। ১৯৪৯এ রিপাবলিক অফ চায়না সরকার গৃহযুদ্ধে হেরে সেখানে পালিয়ে যায়।

১৮৯৪-৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে তাইওয়ান ও কোরিয়াসহ উত্তরের বেশ কিছু এলাকা চীনের প্রভাবমুক্ত হয়

১৮৯৫ঃ জাপান যুদ্ধে জিতে চীনের লিয়াওদং উপদ্বীপের পোর্ট আর্থার ও সংলগ্ন অঞ্চলের (৩৫০,০০০ বর্গ কিমি) লীজ পেলেও তিন ইউরোপীয় শক্তি জার্মানি, রাশিয়া ও ফ্রান্স জবরদস্তি করে সে এলাকা লীজে তুলে দেয় রুশদের হাতে। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শেষ মাথা বানানোর তাগিদে রুশরা জাপানীদের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯০৫এ তাদের মধ্যে যুদ্ধে এবং রুশদের পরাজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সোভিয়েত দখলদারিত্ব। তারপর মাওয়ের কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে ফিরে যায় এ এলাকা।

১৯০৩ সালের রুশ ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ট্রান্স-সাইবেরিয়া রেলওয়ের সাথে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়া রেললাইনের সংযুক্তি

১৮৯৯-০১ঃ বক্সার বিদ্রোহ। বিদেশীবিরোধী, খ্রীষ্টানবিরোধী এক পপুলিস্ট মিলিশিয়া যাদের নাম বক্সার, সমানে কচুকাটা করে পশ্চিমা আর তাদের স্থানীয় মিত্রদের। চিং সম্রাজ্ঞী সিশি গোপনে তাদের সমর্থন দেন। বিদ্রোহ দমনে আটটি দেশ অভিযান চালায়, যাদের মধ্যে রুশ ও জাপানীও ছিল। রাশিয়া এ সময় পুরো মাঞ্চুরিয়া (৯৮০,০০০ বর্গ কিমি) দখল করে রাখে ও লুটতরাজ চালায়। বিদ্রোহের পরও তারা সৈন্য প্রত্যাহার করেনি, ফলশ্রুতিতে জাপানের সাথে ১৯০৫এর যুদ্ধ। জার্মানি দখল নেয় চিংদাওয়ের (৫০০ বর্গ কিমি) আর ফরাসীরা কুয়াংচৌওয়ান (৫০০ বর্গ কিমি)। আর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় চিং সম্রাটকে। প্রসঙ্গত, মার্কিনদের যে ক্ষতিপূরণের ভাগ ছিল তা থেকে পরে আমেরিকায় চীনা ছাত্রদের পড়াশোনার ফান্ড তৈরি করে দেয়া হয়, বর্তমান ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও সে টাকায় শুরু।

১৯০১ সালে বক্সার বিদ্রোহদমনে চীনে অনুপ্রবেশ করে ৮ জাতির শান্তিরক্ষীবাহিনী

১৯০৫ঃ রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয়। মাঞ্চুরিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার ও লিয়াদংয়ের দখল জাপানের হাতে। মাঞ্চুরিয়ার আদিবাসীদের নাম জুরচেন, এরা হান গোষ্ঠীর চীনা নয়।

১৯১১ঃ সপ্তদশ শতক থেকে “আউটার মঙ্গোলিয়া” (১,৫০০,০০০ বর্গ কিমি) চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য হলেও ১৯১১তে বিপ্লবের গোলমালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৯এ চীনের প্রজাতন্ত্রী সরকার তাদের একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও রুশ বিপ্লবের জোয়ার এসে পড়ে এখানে। ফলশ্রুতিতে রুশ সোভিয়েত পাপেট একটি পীপলস রিপাবলিক গঠিত হয়। সেই থেকে দুই দেশের বাফার হয়ে রয়েছে বর্তমান মঙ্গোলিয়া দেশটি। যদিও ইনার মঙ্গোলিয়া (১,২০০,০০০ বর্গ কিমি) এখনো চীনের অধীনস্থ তথাকথিত “স্বায়ত্ত্বশাসিত” অঞ্চল। তিব্বতের মত তাদেরও স্বাধীনতা আন্দোলন চলমান। আর মঙ্গোলিয়া দেশটি ধীরে ধীরে প্রকারান্তরে চীনের ইকনমিক কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।

বর্তমান মঙ্গোলিয়া চীন থেকে স্বাধীন হলেও ইনার মঙ্গোলিয়া বলে একটি বিশাল এলাকা এখনো চীনের অধীন

১৯১১ঃ তিব্বতেও একই সময়ে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সিক্কিম নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাথে গোলমালের কারণে দক্ষিণ তিব্বতে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ভারত। কিন্তু তিব্বতের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। নামমাত্র স্বাধীন দেশ হিসাবে এরপর তিব্বত ১৯৫০ পর্যন্ত চীনের প্রভাবমুক্ত থাকে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি অন্য কোন দেশ।

১৯২৯ঃ চীনের সাথে সোভিয়েতের প্রথম যুদ্ধ। নতুন চীনা রিপাবলিক মাঞ্চুরিয়ায় চায়নিজ ঈস্টার্ন রেলওয়েতে যে যৌথ প্রশাসন থাকার চুক্তি তা অগ্রাহ্য করে। সোভিয়েত সেনাদল দ্রুত চীনাদের হারিয়ে আগের লীজের চুক্তি পুনর্বহাল করে। এ সুযোগে উসুরি নদীতে একটি বড় দ্বীপ জবরদখল করে নেয়। বলশয় উসুরিস্কি নামের এ দ্বীপ (৩৫০ বর্গ কিমি) মোটে ২০০৪ সালে রাশিয়া ফিরিয়ে দেয় চীনকে।

দখলকৃত কোমিনতাং পতাকা হাতে রুশ লালবাহিনীর সৈন্য

১৯৩১-৩২ঃ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের আগ্রাসন। জার্মানি কর্তৃক ১৯৩৯এ পোল্যান্ড আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট এই আক্রমণ। মাঞ্চুরিয়ায় একটি “স্বাধীন” পাপেট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জাপান। ক্ষমতাসীন করে ১৯১২তে ক্ষমতাচ্যুত চীনা চিং সম্রাটকে। ১৯৪৫এ সোভিয়েতরা জাপানীদের দুর্বলতার সুযোগে দখলদার শাসন প্রতিষ্ঠা করে ও পরে মাওয়ের কম্যুনিস্টদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সঁপে দেয়। এখানকার ঘাঁটি থেকেই চীনা কম্যুনিস্টরা কোমিনতাংয়ের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালায়।

মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের পর রেললাইনে “ক্ষয়ক্ষতি” পরিদর্শনে এসেছে জাপানী পরিদর্শকদল

১৯৩৪ঃ শিনজিয়াং বা পূর্ব তুর্কেস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন। এ সময় চীনে ছিল “স্বাধীন” বিভিন্ন ওয়ারলর্ডদের আধিপত্য। শিনজিয়াং বা উইগুর প্রদেশে কোমিনতাং সমর্থিত এক মুসলিম হুই চীনা ওয়ারলর্ড ও সোভিয়েত পাপেট আরেক ওয়ারলর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। উইগুর খানদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন পূর্ব তুর্কেস্তান রিপাবলিকও আবির্ভূত হয়, যেটা আসলে ছিল ইসলামিস্ট আখরা। কোমিনতাং ওয়ারলর্ড জিতে যাবার প্রাক্কালে সোভিয়েতরা আগ্রাসন চালিয়ে দ্বিতীয়জনের মাঞ্চু সৈন্যদলকে সহায়তা করে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পাঠানো লিটল গ্রীন মেনের মত উইগুরে পাঠানো এ সকল রুশ সৈন্যদের পোশাকে কোন পরিচয়ধারী প্রতীক ছিল না। মুসলিম সেই ওয়ারলর্ড যুদ্ধে পরাজয়ের পর সোভিয়েতের অভ্যন্তরে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিনজিয়াংয়ে অপর ওয়ারলর্ডের সোভিয়েত পাপেট শাসন চলে ১৯৪২ পর্যন্ত।

১৯৩৪ সালে প্রথম “স্বাধীন” পূর্ব তুর্কেস্তান (শিনজিয়াং) সরকার

১৯৩৭-৪৫ঃ চীন-জাপান যুদ্ধ, যেটা পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চলমান থাকে। এ সময়ে চীনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা ছিল জাপানের দখলে — প্রায় ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি। প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাপানী নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারায় অন্তত ৩৮ লাখ মানুষ। চীনকে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র — কম্যুনিস্ট ও কোমিনতাং উভয়কেই।

দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানীরা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করে চীনাদের বিপক্ষে

১৯৪৫ঃ জাপানের পাপেট রাষ্ট্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে সোভিয়েতরা, ‌হিরোশিমা-নাগাসাকির ঠিক পরপর। তারা জাপানী পাপেট সরকারের সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ করতে করতে সেখানে সোভিয়েতঅধিকৃত উত্তর কোরিয়া থেকে ঢুকে পড়ে বহু চীনা কম্যুনিস্ট, যারা রাশিয়া কিংবা কোরিয়ায় আত্মগোপনে ছিল। তাদের হাতে পড়ে মাঞ্চুকোর সেনাবাহিনীর অস্ত্র। কোমিনতাং সরকারের কাছে সোভিয়েতরা নামমাত্র মাঞ্চুরিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও কম্যুনিস্ট দোসরদের একটা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। মাও সেতুং উত্তরের ঘাঁটি থেকেই কোমিনতাং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। সোভিয়েতরা সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে চীনের সবচে শিল্পায়িত এলাকাটির কারখানার কলকব্জা ইত্যাদি খুলে লুট করে নিয়ে যায়। জাপান বা মাঞ্চুকো থেকে সরাসরি সোভিয়েতের ওপর যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও সোভিয়েতরা জাপানীদের সাথে সংযুক্ত সকল কম্পানিকে এমন “গনিমতের মাল” হিসাবে লুট করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে “নিরপেক্ষ” সোভিয়েতরা ঘোষণাব্যতিরেকে আক্রমণ চালিয়ে জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঞ্চুকো’র দখল নেয়

১৯৪৪-৪৯ঃ শিনজিয়াং উইগুর প্রদেশে আরেকটা “স্বাধীন সোভিয়েত” পাপেট রাষ্ট্র গঠন করে সোভিয়েতরা। ১৯৪৯এ চীনের গৃহযুদ্ধে কম্যুনিস্টদের বিজয়ের পর সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে এ রাষ্ট্রের নেতারা। প্রদেশটি অংশ হয় চীন গণপ্রজাতন্ত্রের।

ছোটখাটর মধ্যে এই ফিরিস্তি আশা করি এ ধারণাটা আপনাদের দেবে যে পশ্চিমারা চীনকে যতটা হিউমিলিয়েট করেছে তার থেকে হাজার গুণে বেশি করেছে তাদের নিকট দুই প্রতিবেশী জাপান ও রাশিয়া — যাদের কোনটিকেই সে আমলে ঠিক পশ্চিমা কাতারে ফেলা সম্ভব নয়। আর পশ্চিমাদের হাতে যে সকল ক্ষুদ্র এলাকা ছিল সব ফিরে পেয়েছে চীন। পায়নি কেবল রাশিয়ার দখলীকৃত বেশিরভাগ এলাকাগুলি। যেটুকু ফিরে পেয়েছে, তাও কম্যুনিস্ট আদর্শগত কারণে, ১৯৪৯এর পর, যখন মাও-স্তালিন দুই দিন পরপর হ্যান্ডশেক করতে ব্যস্ত, আর কোরিয়ার ভাগ্যনির্ধারণে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

হ্যাঁ, রাশিয়ার সাথে সীমানা নিয়ে কিছু শান্তি চুক্তি চীন সম্প্রতি করেছে। কিন্তু ভাবুন ইউক্রেনের সাথে দুই বার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি সত্ত্বেও রাশিয়া সেখানে আগ্রাসন চালিয়েছে “ঐতিহাসিক সংযোগ ও ভ্রাতৃত্বের” দোহাই দিয়ে — চুক্তিভঙ্গ করে। চাইলে চীন একইভাবে উত্তর মাঞ্চুরিয়ার “নিপীড়িত ‘চীনা’ বেরাদরদের” সাহায্যে এগিয়ে এসে ইউক্রেন সাইজের এলাকাটি বেদখল করে নিতে পারে। এ মুহূর্তে চীনের যা লাগে সব পুতিনের রাশিয়া না চাইতেই দিয়ে দিচ্ছে। যদি পুতিনের মৃত্যু হয়, রাশিয়ান ফেডারেশন আলগা হয়ে আসে, তাহলে চীন সেসব এলাকা ফিরে চাইতেই পারে। ১৯১৭ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও বিপ্লবের পরেও রুশ সাম্রাজ্য আলগা হয়ে এসেছিল। সেসময় সুযোগের সদ্ব্যবহারের অবস্থানে চীন ছিল না, ছিল জাপান।

কদিন আগে একটা খবরে এসেছে যে চীন উত্তর মাঞ্চুরিয়ার বিভিন্ন শহরের নাম নিজেদের সরকারী মানচিত্রে দেখানো শুরু করেছে চীনা নামে, সাথে ইংরেজী নাম, কিন্তু রুশে নয়। চীনের টেরিটরিয়াল ক্লেইম করার পন্থা এটাই। যে এলাকায় নিজেদের “ঐতিহাসিক সংযোগ” দাবি করতে চায়, সেখানকার একটি “প্রাচীন” চীনা নাম দেবে, এবং তারপর সেটিকে নিজেদের বলে দাবি করবে। এই কাজটি চীন করেছে ভারতের সাথেও — আকসাই চীন আর অরুণাচল প্রদেশে।

সুতরাং চীনের হিউমিলিয়েশনের শতক নিয়ে বেশি কুম্ভীরাশ্র বর্ষণ না করে তার প্রতিবেশীদের তক্কে তক্কে থাকা উচিত। ভিয়েতনাম, কোরিয়াকে অতীত বহু শতকে যেভাবে করদ বা ঔপনিবেশিক রাজ্যের হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছিল, কিংবা মাঞ্চুরিয়া-তিব্বত-ইনার মঙ্গোলিয়া-শিনজিয়াংকে এখনো সহ্য করতে হয়, সেরকম হিউমিলিয়েশনের গিভিং এন্ডে না থাকলে রিসিভিং এন্ডে থাকতে হবে। এ শিক্ষাটা রাশিয়া অতি শীঘ্রই পাবে।

পেপার ট্রেইল

“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও” — ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি এটা নাকি নবীজী বলেছেন। সত্যি কথা হলো, এটি একটি দা’য়ীফ (দুর্বল) হাদীস, সম্ভবত বানোয়াট। ইসলাম ও আরবের আদি ইতিহাসে চীনের সাথে তেমন কোন প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।

অবশ্য ইসলামের শুরুতে আরব দিগ্বিজয়ের ঝান্ডা পশ্চিমে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হতে বেশি সময় লাগেনি। নবীজীর প্রয়াণের বিশ বছরের মধ্যে দুই বড় পড়শী বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের একটা বড় অংশ আর সাসানীদের পুরো রাজ্য আরবদের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যে ইরানের উত্তরপূর্বের খোরাসান (বর্তমান আফগান-ইরানের উত্তর সীমান্তে) মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ। এ এলাকার উত্তরের দুর্গম গিরিপথের মধ্যে দিয়েই প্রাচীন পরিব্রাজকরা চীনে যেতেন।

অর্থাৎ চীন ও আরব এ দুইয়ের মোলাকাত ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

চীনের তাং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

এসময় চীনে তাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী অন্যান্য রাজবংশের মত অন্তর্মুখী এরা ছিল না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সমান অংশগ্রহণ ছিল রাজকার্য পরিচালনায়। এরকম কসমোপলিটান রাজ্যে পূর্বের কোরিয়ান, উত্তরের মোঙ্গোল, পশ্চিমের তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দেয়া হত। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চীনের সম্রাট ‘স্বর্গপুত্রকে’ উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করত।

মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সিল্করোডের বাণিজ্যপথ এসময় ভারতকে চীনের সাথে যুক্ত করে। মধ্য এশিয়া ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলনস্থল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরী গ্রেকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা যেমন ছিল আফগানে, সেরকম ফারগানা-তাশখন্দ-বুখারা-কাশগর-সমরখন্দ এসব শহরেও সগডিয়ানভাষী ইরানীশাসিত নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল বংশপরম্পরায় বণিক। আর নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, মানিকিয়ান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান ইত্যাকার নানা ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের আবাস ছিল এ রাজ্যগুলিতে।

সিল্ক রোডের ভারতীয়, পারসিক, চীনা অংশ

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রথম যায় এ পথেই। সম্ভবত অতীশ দীপংকরও এই রাস্তার পূর্বভাগ যেটা পাকিস্তানের গিলগিটের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেদিক দিয়ে তিব্বতে গেছেন। চীন থেকেও হিউয়েন সাং এ পথেই ভারত ও বাংলায় এসেছিলেন সংস্কৃত বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তার সে অভিযানের গল্প পরবর্তীতে চীনা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যার ইংরেজী নাম ‘এ জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। আর তার অন্যতম প্রধান চরিত্র বানররাজা সুন উখোং। ছোটবেলায় আমরা এই কাহিনীর চীনা ছবিবই পড়েছি।

সিল্ক রোডের অন্যতম স্থলবন্দর চীনের দুনহুয়াংএর গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে দেয়ালচিত্র। এখানে ভারতীয় প্রভাবে আঁকা বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী চিত্রিত।
বানর রাজা সুন উখোং, সম্ভবত চরিত্রটি ভারতের হনুমানজির অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট

তাং সাম্রাজ্যের শত্রু অবশ্য কম ছিল না। ইরানীরা যেমন তুরানের যাযাবরদের একরোখা বর্বর বলে তুলে ধরেছে শাহনামার মত মহাকাব্যে, তেমন চীনারাও এদেরকে ‘পশ্চিমের ডাকাত’ নামে ডাকত। বিভিন্ন ট্রাইবের তুর্কীভাষী এসকল জনপদ আবার নিজেদের মধ্যেও লড়ত। চীনাদের সাথে মিত্র হিসাবেও যোগ দিত, কখনো হত শত্রু। এসকল যাযাবরদের ঠান্ডা রাখার জন্যে তাদের সাথে তাং সম্রাটরা নানা কূটনৈতিক চুক্তি সাক্ষর করে। সে অনুযায়ী একে অন্যের পরিবারের সাথে বিবাহসূত্রে তারা আবদ্ধ হয়।

নতুন একটি সাম্রাজ্য অবশ্য চীনের দক্ষিণপশ্চিমে এ সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সেটি তিব্বত। এরাও মূলত যাযাবর। আর সপ্তম শতক থেকে শুরু করে এরা চীনাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারিম বেসিন পুরোপুরি তিব্বতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনাদের পশ্চিমে যাবার রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে তাং বাণিজ্যপ্রভাব ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচে বড় প্রতিবন্ধক ছিল তিব্বত সাম্রাজ্য।

আরব সেনাদল এসময় মধ্য এশিয়ার মারি-সমরখন্দ জয় করে বেশি পূর্বে আর অগ্রসর হয়নি। এরপরে মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপভূমি আর গোবি-তাকলামাকান মরুভূমি। জনশূন্য বিশাল এলাকার মাঝে একটি-দুটি মরূদ্যান শহর। কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে করারোপের মত যথেষ্ট জনসংখ্যা নেই। বিশাল সাম্রাজ্যও নেই জয় করার মত। তখন ইউরোপের সাথে সিল্ক রোড বাণিজ্যও তেমন বেশি নয়। সব মিলিয়ে উমায়্যা খলীফাদের তেমন কোন অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভ ছিল না মধ্য এশিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢোকার।

সিল্ক রোডের পশ্চিম চীন প্রান্তের তুরপান শহরের প্রাচীন ভবন। তাকলা মাকান মরুভূমি পেরিয়ে চীনা তুর্কীস্তান কিংবা শিনজিয়াংএ এসে এই মরুদ্যান শহরে পৌঁছত সওদাগরি কাফেলা।

চীনাদের অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি প্রাচীনতা থেকে আগ্রহ ছিল। প্রথম চীনা সম্রাট শিহুয়াংতি মধ্য এশিয়াতে এক রাজপ্রতিনিধি পাঠান ‘রক্তঘর্ম’ অশ্ব খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। যুদ্ধে নাকি ভীষণ দ্রুততা দিত এ ঘোড়া। আরো নানা ভারতীয় বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত এখানকার বাজারে।

পূর্ব-পশ্চিমের মিলনস্থলের এ রাষ্ট্রগুলো তাই কখনো স্বাধীন, কখনো চীনা প্রটেক্টরেট, এভাবে চলছিল। নবাগত প্রতিবেশী উমাইয়্যা খিলাফতকে এরা চীনের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং অ্যাক্টের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ৭১৫তে একবার আর ৭১৭তে আরেকবার উমাইয়্যা সেনাদল তাংদের মিত্র তুর্কী জাত তুর্গেশদের মুখোমুখি হয়।

৭৪৭এ উমাইয়্যাদের পতন ঘটে আব্বাসী অভ্যুত্থানের মুখে। ক্ষমতার কেন্দ্র সিরিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসে ইরাক-ইরানে। সাসানী সাম্রাজ্যেরই একরকম পুনরুত্থান ঘটে পারসিক প্রভাব বাড়ার সাথে। বাগদাদের আব্বাসী খলীফাদের দৃষ্টি হয় প্রাচ্যমুখী। আর নতুন ‘সাম্যবাদী’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাথে বেশ একটা জিহাদী জোশও চলে আসে আরব-অনারব দু’জাতের মুসলিমদের মধ্যে।

আব্বাসী খেলাফতের মানচিত্র

৭৫১তে মধ্য এশিয়ার দুই রাজ্য ফারগানা আর শাশ (তাশখন্দ) একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শাশের বিরুদ্ধে তাং সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে ফারগানা। কোরিয়ান তাং জেনারেল গাও শাশে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার অধিকর্তাকে হত্যা করেন। শাশের রাজপুত্র পালিয়ে গিয়ে আব্বাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা মারি-সমরখন্দের গভর্নর আবু মুসলিমের দরবারে গিয়ে হাজির হন। এভাবে আব্বাসীদের সাথে তাং সাম্রাজ্যের সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

আব্বাসী খেলাফতের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বৌদ্ধ তিব্বত সাম্রাজ্য। অমুসলিম তুর্কী যাযাবর তুর্গেশরাও সাহায্যের হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক সৈন্য নিয়ে বর্তমান কাজাকস্তানের তালাস নদীর উপত্যকায় সমবেত হয় আব্বাসী সেনাদল। চীনাদের সেনাশক্তিও কম ছিল না। অবশ্য এ সব সংখ্যার অনেক কমবেশি হতে পারে।

তিব্বতী সাম্রাজ্য, ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ
বর্তমান কাজাখস্তানে অবস্থিত তালাস নদী

তিনদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয় দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধের শেষভাগে তাংদের মিত্র কারলুক তুর্কী যাযাবররা দলত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেয়। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চীনা সেনাশক্তি। সেনাপতি গাও পশ্চিম থেকে জান নিয়ে পালিয়ে ফেরেন মূল তাং ভূমিতে। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নতুন সেনাদল গড়ে তুলতে না তুলতেই ৭৫৫তে খোঁজ আসে যে বেজিংয়ের দিকে এক বিশাল বিদ্রোহীদল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তাং সেনাপতি আন লুশান। নিজেকে তিনি ইয়ান নামে নতুন এক বংশের সম্রাট দাবি করে বসেছেন। আব্বাসীদের কথা ভুলে সেনাপতি গাওকে উল্টোদিকে রওনা দিতে হয় তাং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।

আন লুশান বিদ্রোহে পরবর্তী আট বছর বিপর্যস্ত হয় সমগ্র উত্তর চীন। পশ্চিমে সাম্রাজ্যপ্রসারের স্বপ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয় তাংদের।

তালাসের যুদ্ধ, ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ

অপরদিকে আবু মুসলিমের জিহাদী জোশেও ব্রেক কষে দেন নতুন আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা আর বিশেষত শিয়া মতাদর্শীদের অন্ধ সমর্থনের কারণে শত্রুতা বেড়ে চলে খলীফার সাথে। ষড়যন্ত্র করে ‘জিন্দিক’ বা ধর্মপরিত্যাগকারী সাব্যস্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন আল-মনসুর। এরপর আব্বাসীরাও মধ্য এশিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যই মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতায় আসে। শ’দুয়েক বছর ধরে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের একটা সীমানা দাঁড়া হয়ে যায় এ অঞ্চলে। এ সীমানা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতে পদদলিত করে চেঙ্গিস খান আর তার মোঙ্গোল হোর্ড।

তালাসের যুদ্ধ নিয়ে আজকালকার মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। চীনারা এর কিছু বিবরণ লিখে গেছে। তাতে নিজেদের পরাজয়ের সাফাই গেয়েছে। আর আরব ইতিহাসবিদরাও দুয়েক জায়গায় এর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।

কিন্তু এ যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এরপর মধ্য এশিয়ার পশ্চিমভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে, যদিও এরা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে আরো শ’খানেক বছর পর। চীনা বাণিজ্য যায় কমে।

মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত থেকে চীনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের যে সাপ্লাই লাইন সেটা কেটে যায়। অবশ্য এসময় ভারতে নতুন করে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যে চীনা-জাপানী-কোরিয়ানদের তাই খুঁজে নিতে হয় স্বকীয়তা। এর ফলে শুরু হয় শাওলিন, চান, জেন, প্রভৃতি স্থানীয় জাতের বৌদ্ধধর্ম। তাদের শিল্পসংস্কৃতিও ভারতীয় প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে থাকে।

চীনা ‘চান’ বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম নিদর্শন ‘হাস্যরত বুদ্ধ’। আসলে ইনি লোককাহিনীতে বর্ণিত এক চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মে এরকম কিছু নেই। অর্থাৎ চীনা বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে গেছে স্বতন্ত্র।

এ হল তালাস যুদ্ধের কালচারাল ইমপ্যাক্ট। এর থেকেও বড় যে ইমপ্যাক্ট তা টেকনোলজিকাল। সেটা হলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। নবম শতকের আগে শুধুমাত্র চীনারা জানত কিভাবে তুঁত গাছের বাকল থেকে মালবেরি পেপার প্রস্তুত করা যায়। এ ছিল তাংদের রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট জ্ঞান। সিল্ক রোডের কোন বণিকের সাধ্য ছিল না কাগজ তৈরির কারখানায় ঢোকার। চীনের বাইরে বাকি বিশ্বের লেখাপড়া চলত ভাঙা মাটির পাত্রের টুকরায় (শার্ড) আঁকিবুঁকি করে, নয়ত পশুর চামড়ার পার্চমেন্টে লিখে। এসবই ছিল খুব কঠিন প্রক্রিয়া।

চীনের ফাং মাতানে আবিষ্কৃত প্রাচীনতম কাগজের নিদর্শন, আনুমানিক দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দ।

তালাস যুদ্ধে আব্বাসীরা হাজার কয়েক তাং সৈন্য ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধবন্দী করে। এদের মধ্যে ছিল কাগজওয়ালারাও। প্রথমে সমরখন্দে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাগজ বানানোর কৌশল তাদের কাছ থেকে শিখে নেয় স্থানীয় শিল্পীরা। এর বছর পঞ্চাশেক পরেই বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কাগজের প্রযুক্তিলাভের ফলে আব্বাসী খেলাফতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারে বিশাল একটা বিপ্লব আসে। শুধু কুরআন-হাদীস নয়, দর্শন-বিজ্ঞানেরও চর্চা সহজলভ্য করে দেয় কাগজ। এ জোয়ারে সওয়ার হয়ে আসে নবম-দশম শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। কাগজে যেভাবে কালিকলমে লেখার প্রক্রিয়া, ক্যালিগ্রাফি একমাত্র সে মিডিয়ামেই সম্ভব। চীনাদের ক্যালিগ্রাফি সর্বজনবিদিত। সম্ভবত একইভাবে আরবী ক্যালিগ্রাফিরও যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরিগুলিও প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফতে।

১১৮০তে পূর্ব ইরানে কাগজে তৈরি কুরআনের ক্যালিগ্রাফিক ফোলিও (নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়াম)
ডানে একাদশ শতকের চীনা সং রাজবংশের সময়কালীন কাগজে আঁকা ক্যালিগ্রাফি (তাইওয়ানের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম)

একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে কাগজ পৌঁছে যায় স্পেনের উমায়্যা খেলাফতে। সেখানে পড়তে আসা ইউরোপীয়রাও পায় কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তারপর পঞ্চদশ শতকে গুটেনবের্গ, বাঁধানো বই, রেনেসাঁস, এজ অফ রিজন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ‘পেপার ট্রেইল’ ধরে সামনে হাঁটলে আমরা এরকম বৈপ্লবিক অনেক কিছুই পাই। আজকে কাগজ নষ্ট করতে আমাদের বাঁধে না। অথচ ছোটবেলায় শিখেছি কাগজ অমূল্য একটা জিনিস। আসলেই তাই! প্রমিথিউসের আগুন চুরির মত কাগজের রহস্যটাকেও ভেদ করে কেড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল বাকি বিশ্বের জন্যে। যদি না এরকমটা হত, তালাসের যুদ্ধ না হত, আর যুদ্ধে আব্বাসীরা না জিতত, তাহলে হয়ত কাগজের জন্যে ইউরোপকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত আরো একশ’ বছর। সেই অল্টারনেট হিস্টরি কল্পনার কাজটা আপনাদের হাতে সমর্পণ করে আজকের মত শেষ করলাম।

আফিম যুদ্ধ

(জাপানের মেইজি যুগ সম্পর্কে এ লেখাটি লিখতে গিয়ে চীনা-ভারতীয় আফিমের ডালপালা গজিয়ে গেল!)

ব্রিটিশদের সাথে চিং সাম্রাজ্যের দু’দু’টো যুদ্ধ হয়েছিল আফিমব্যবসাকে কেন্দ্র করে (প্রথম, ১৮৩৯-৪২; দ্বিতীয়, ১৮৫৬-৬০)। এর আগে চীনের জিডিপি ছিল বিশ্বের সর্বাধিক, আর ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে অসম অর্থনৈতিক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে তা হয়ে যায় অর্ধেক। চীনের মানুষ এখনও মনে করে যে তারা এসময় পশ্চিমের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। আফিম যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস আর ফলশ্রুতি অবশ্য এভাবে এক লাইনে বর্ণনা করলে দু’পক্ষের প্রতিই অবিচার করা হবে। তাই আমি আরেকটু বড় করে ঘটনাটার বিবরণ দিচ্ছি।

(এখানে এটাও বলে রাখা দরকার যে, দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝের সময়টায় জাপানের একতরফা আগ্রাসনের মুখে চীনের নতুন প্রজাতন্ত্র পশ্চিমা সরকারদের থেকে যথেষ্ট সাহায্য আর সহানুভূতিশীলতা পেয়েছিল।)

আফিমের ওষধি গুণাগুণ আর আসক্তিকর প্রভাবের কথা প্রাচীন চীন ও ভারত দুই এলাকারই মানুষ জানত। আমরা রান্নায় যে পোস্তদানা ব্যবহার করি, তা আসলে পপি সীড বা আফিম গাছেরই বীজ। মধ্যযুগে চীনে স্থানীয়ভাবে আফিমের চাষ তেমন একটা হত না। মূলত ভারতের বিভিন্ন এলাকায় চাষাবাদের পর চীনে রপ্তানি হত আর কালোবাজারে চড়াদামে বিক্রি হত। আকবরের সময় মুঘলরা ছিল চীনে আফিমব্যবসার একচেটিয়া সত্ত্বাধিকারী। মুঘলদের কাছ থেকে ব্রিটিশ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি (ইআইসি) উত্তরাধিকারসূত্রে এ ব্যবসা পায়। অবশ্য সপ্তদশ শতকে ইআইসি নয়, ভিওসি (ডাচ ঈস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি) ছিল চীনের মূল আফিম সরবরাহকারী।

১৯০৮ সালে মার্কিন আলোকচিত্রী ভারতের সরকারী ফ্যাক্টরিতে আফিম ওজন করার দৃশ্য ধারণ করেছেন — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

সপ্তদশ শতকের শেষে চিবিয়ে খাবার বদলে ধূম্রপানের মাধ্যমে আফিমসেবনের নতুন প্রক্রিয়া আবিষ্কৃত হয়। আফিমের ধোঁয়া ছিল আরো বেশি আসক্তিকর। ভারতের থেকে চীনেই বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এভাবে আফিমসেবন। এ কারণে চিংসম্রাট ফরমান জারি করে ১৭২৯ সালে আফিমের ব্যবহার ও কেনাবেচা নিষিদ্ধ করে দেন। প্রথম প্রথম তাতে আফিমের আমদানি কমলেও দাম আকাশচুম্বি হয়ে যায়। সরকারি দুর্নীতি আর চোরাকারবারির মাধ্যমে আফিম ব্যবসা বেশ লাভজনক হয়ে ওঠে।

অষ্টাদশ শতকের শেষে আফিমব্যবসার চাবিকাঠি ইআইসির হাতে এসে পড়ে। সিরাজউদ্দৌলাকে হারিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে আসে ভারতের সবচে’ বেশি আফিমউৎপাদনকারী দুই এলাকা — বাংলা ও বিহার। আর পশ্চিমে ছিল মলওয়া রাজ্য। কলকাতায় বাঙ্গালী জমিদার আর মারোয়াড়ি বণিকরা কম্পানি খুলে বসে ইআইসির জাহাজে আফিম সাপ্লাইয়ের জন্যে। আফিমচাষীদের কাছ থেকে কমদামে ফসল কিনে এসব দালালরা বহুগুণ লাভে ইআইসির কাছে বিক্রি করত (বাংলার ১৭৭০এর দুর্ভিক্ষের একটি কারণ আফিমচাষের ওপর জমিদারদের ভারসাম্যহীন গুরুত্বপ্রদান)। এভাবে বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী বহু জমিদার আর বণিক কলকাতায় প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথের দাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর, বিরলা পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা শিবনারায়ণ, আর অনেক প্রভাবশালী পার্সী শিল্পপতিদের পূর্বপুরুষ। মুজতবা আলীর বই পড়ে আমার মনে হয়েছে বিশ-ত্রিশের দশকে সিলেটেও মুসলিম জমিদাররা আফিমচাষে অর্থলগ্নি করত। অষ্টাদশ শতকের শেষ নাগাদ বাংলায় উৎপন্ন আফিমের এক-তৃতীয়াংশ চীন ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় রপ্তানি হয়েছে।

ইআইসির আফিমভর্তি জাহাজ নোঙর ফেলত চীনের একমাত্র বৈদেশিক বন্দর ক্যান্টনে (গুয়াংচৌ) গিয়ে। সেখান মালখালাসের পর চীনা কালোবাজারিদের কাছে আফিম বিক্রি করে দেয়া হত। তারা সেসব নিয়ে লুকিয়ে বেচত স্থানীয় বাজারে। এভাবে সরাসরি চীনে আফিমের বাজারে ইআইসি যুক্ত না থাকলেও সাপ্লাই লাইনের সুবন্দোবস্ত করে দিয়েছিল তারা। এই কালোবাজারির লাভের মাধ্যমে চীনের সাথে বিশাল ট্রেডগ্যাপের ব্যালেন্স করে ব্রিটিশরা, কারণ চীন থেকে বিলাসদ্রব্য ব্রিটিশরা বিপুল পরিমাণে কিনলেও বিলাতি বিলাসদ্রব্য চীনে বিক্রি করা ছিল নিষিদ্ধ।

১৯০৬ সালে চীনের বেজিংয়ে তামাক ও আফিম সেবন চলছে আফিমের আখড়ায় — উইকিমিডিয়া কমন্স – পাবলিক ডোমেইন

১৮৩০এর দশকে আফিমব্যবসায় ইআইসি ও ভারতীয় আফিমের প্রতিযোগী হিসাবে আবির্ভূত হয় মার্কিন চোরাকারবারীরা (জন কেরি আর ফ্রাংকলিন রোজভেল্টের পূর্বপুরুষ এ ব্যবসায় জড়িত ছিলেন)। তাদের জাহাজ পারস্য-তুরস্ক থেকে আফিম কিনে চীনে বিক্রি শুরু করে। প্রতিযোগিতার ফলে দরপতন হতে থাকে। লাভ ধরে রাখতে তাই জাহাজীরা বাধ্য হয় আরো বেশি পরিমাণে আফিম পরিবহন করতে। চীনাদের মধ্যে মহামারির মত ছড়িয়ে পড়ে আফিম-আসক্তি।

১৮৩১ সালে চীনের সম্রাট নতুন করে আফিমের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। এতেও যখন কাজ হল না, তখন ১৮৩৯এ সম্রাটের নির্দেশে চীনা সরকারী কর্মচারীরা ক্যান্টনের সকল আড়ত থেকে আফিম জব্দ করা শুরু করে। ব্রিটিশ আর অন্যান্য বিদেশীদের মজুদও রেহাই পেল না। বিশাল লোকসানের সম্মুখীন হল ইআইসি ও ভারতীয় লগ্নিকাররা। অপমানের জবাব দিতে ব্রিটিশরা যুদ্ধজাহাজ পাঠাল দক্ষিণ চীন সাগরে। জাহাজের কামান থেকে দূরপাল্লার গোলানিক্ষেপ করা হল উপকূলের বন্দরগুলিতে। ক্যান্টন বন্দর দখল করে নিল তারা। চীনারা বাধ্য হলো শান্তিচুক্তি করতে। সে চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটিশরা পেল হংকংয়ের মালিকানা, আর পাঁচটি সমুদ্রবন্দরে বাণিজ্য করার অধিকার।

কিন্তু আফিম ব্যবসার ব্যাপারে কোন সুরাহা সে চুক্তিতে হয়নি। চীনে তখনও তা বেআইনী। এ সুযোগে হংকংয়ের চীনা কালোবাজারিরা নিজেদের জাহাজে ইউনিয়ন জ্যাক উড়িয়ে ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় আফিম আনানেয়া করতে থাকে। ১৮৫৬ সালে এরকম একটি জাহাজ আটক করে চিং কর্মচারীরা, আর তারা জাহাজের ব্রিটিশ পতাকা ছিন্নভিন্ন করে ফেলে। ফলে শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এতে ফরাসী ও ব্রিটিশদের জয়লাভের পরে আফিমের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন সম্রাট, এবং আরো আশিটির মত বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্য করার অনুমতি দেয়া হয়। ভারত ছাড়াও তুরস্ক, মিশর, পারস্য, বল্কানে উৎপন্ন আফিমে সয়লাব হয়ে যায় চীন।

বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট এরঝ়ে টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে ত্রিশের দশকের চীনের আফিম আখড়ার ছবি এঁকেছেন — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

আফিম আসক্তি নিরসনে চিংদের ভুল পদক্ষেপগুলি জাপানসহ অন্যান্য দেশের জন্য শিক্ষা হয়ে ছিল। যদি চীনা বন্দরগুলিতে সাধারণ বিলাসদ্রব্যের বাণিজ্য করতে দেয়া হত, তাহলে হয়ত আফিম কালোবাজারির খুব একটা দরকার পড়ত না পশ্চিমা ও ভারতীয় ব্যবসায়ীদের। আফিমকে বেআইনী করার কারণেও ‌অনিচ্ছাকৃতভাবে তার দাম বাড়িয়ে ব্যবসাটিকে লোভনীয় রূপ দেয় তারা। তারা চাইলে আফিম ব্যবসায়ীদের লাইসেন্সপ্রদান করে আর উচ্চশুল্ক আরোপ করে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত। শুল্ক থেকে সরকারী আয় নিয়ে স্থানীয় আফিমখোরদের বালাই সারাতে খরচ করতে পারত। শুধু মুনাফাখোর ব্রিটিশদের সকল দোষের ভাগীদার করা মনে হয় ন্যায়সঙ্গত নয়। চীনাদের ভুল পদক্ষেপ আর মিথ্যে সামরিক গর্বের কারণে তারা তো যুদ্ধে হেরে অর্থনৈতিক শক্তি হারায়ই, তার ওপর ঊনবিংশ শতকের শেষ নাগাদ তাদের জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-দশমাংশ হয়ে ওঠে আফিমাসক্ত।

আর আফিম-আসক্তি যে শুধু চীনাদের সমস্যা ছিল তা নয়। পৃথিবীর সকল সভ্য স্থানেই আফিম চলত সে আমলে, কোথাওই বেআইনী ছিল না। বাদশা জাহাংগীর আর তাঁর পুত্র মুরাদ আফিমে আসক্ত ছিলেন। ব্রিটিশ আর মার্কিন প্রচুর বিখ্যাত মানুষেরও এরকম আসক্তি ছিল। যেমন, স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ (অসমাপ্ত ‘কুবলা খান’ মহাকাব্য লিখেছিলেন নেশার প্রভাবে!), চার্লস ডিকেন্স, মেরি শেলী, ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল, এলিজাবেথ ব্রাউনিং, এডগার অ্যালান পো, জন কীটস, লিউয়িস ক্যারল, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখের আফিমসেবনের বদভ্যাস ছিল।

আমেরিকায় এখন আফিমের ডেরিভেটিভ ওপিয়েট পেইনকিলার বড়িতে প্রচুর সাধারণ মানুষ আসক্ত। এর দোষ যদিও মুনাফাখোর ওষুধ কম্পানিগুলিকে দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত আসল ঘটনা তার থেকে জটিলতর — আফিম যুদ্ধের ইতিহাসের মতই।

আইসিন জোরো পু-য়ী

ডাকটিকেটে যাঁর ছবি, তাঁর নাম আইসিন জোরো পু-য়ী। চীনের উথাল-পাথাল সময়ে দু’বার শিশুসম্রাট হয়েছেন, একবার পরেছেন মানচুকোর রাজমুকুট। আলোকচিত্রে তাঁকে দেখা যাচ্ছে বেজিংএর বোটানিক্যাল গার্ডেনে মালীর কাজ করতে !

মানচুকোর ১৯৩২ সালের ডাকটিকেটে শেষ চিং সম্রাট আইসিন জোরো ওরফে হেনরি পু-য়ীর ছবি — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

পু-য়ীর অবিশ্বাস্য কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে চীনের সমস্যাসংকুল সময়ে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের ইতিহাস।

ঊনবিংশ শতকের শেষে জাপান ইউরোপীয়প্রধান ‘উপনিবেশী ক্লাবে’ যোগ দেয়। রুদ্ধদ্বার সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জাপানে মেইজি যুগ আরম্ভ হয় ১৮৬৮তে। মেইজি রাষ্ট্রনায়করা সনাতনী ঐতিহ্য ধরে রেখেই স্বদেশের ‘পশ্চিমাকরণ’ শুরু করেন। সে সূত্রে আসে ভূমিসংস্কার, সীমিত গণতন্ত্র, বৈদেশিক বাণিজ্য আর ভাড়াটে সামুরাইদের পরিবর্তে নিয়মিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রচলন।

জাপানে কাঁচামালের প্রাচুর্য ছিল কম, জনসংখ্যার অধিকতার কারণে অন্ন ও কর্মসংস্থানও ছিল সীমিত। পশ্চিমাদের দেখাদেখি শিল্পায়ন শুরু হলে জাপানী শাসকগোষ্ঠীর চোখ পড়ে চীনের ওপর। বিশেষ করে চীনের ‌অধীন কোরিয়া আর মানচুরিয়া, দুটোই ছিল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা।

চীন সেসময় ছিল রক্ষণশীল, পশ্চাদপর, সামন্ততান্ত্রিক একটি সাম্রাজ্য। চীনের সমসাময়িক চিংবংশীয় শাসকরা ছিল দুর্বলচিত্ত, অন্দরমহলের রাজমাতা আর খোঁজাদের প্রভাবে চালিত, আর জনবিচ্ছিন্ন। তদোপরি, চিংরা ছিল বহিরাগত। মিং নামক একটি স্থানীয় হান রাজবংশ সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীন শাসন করে। এরপর পূর্ব সাইবেরিয়ার মানচুরা নুরহাচির নেতৃত্বে চীনের বিভিন্ন অংশ একে একে জয় করে চিংএর গোড়াপত্তন করে।

১৯০৬ সালে নুরহাচির আইসিন জোরো বংশে জন্ম পু-য়ীর। ১৯০৮এ চীনসম্রাট ওয়ারিশহীন অবস্থায় মারা যাবার পর রাজমাতা তিনবছরবয়সী পু-য়ীকে ঘোষণা করেন পরবর্তী সম্রাট হিসাবে। বিধবা-সম্রাজ্ঞী ৎসিশির জবরজং পোশাক আর কুঁকড়ে-যাওয়া চেহারা দেখে পু-য়ী বেদম কান্না করেছিলেন সবার সামনে। এর কিছুদিন পর ৎসিশিও মারা যান

১৯১২ সালে হান জাতীয়তাবাদীদের শিনহাই বিদ্রোহের মুখে পু-য়ীর বাবা রাজসিংহাসনের ওপর তাঁর অধিকার রদ করে দেন। সুন-ইয়াত-সেন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেও তাঁর দলের সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বিশৃংখলা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলির গভর্নর কিংবা সেনাপ্রধানরা নিজ এলাকায় প্রকারান্তরে স্বাধীন শাসন শুরু করেন। ছবির ম্যাপে চীনের চেহারা তাই দেখা যাচ্ছে পাজ়ল পীসের মত

এই সময়টা তক্কে তক্কে ছিল জাপানের সামরিক উগ্রপন্থীরা। ইতিমধ্যেই ১৮৯৭ সালে কোরিয়া জাপানী সাম্রাজ্যের আওতায় এসেছে। চীনের ওপর রুশদের লোলুপ দৃষ্টিকে জাপানীরা অন্ধ করে দেয় ১৯০৫এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে তাদেরকে হারিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকার সুবাদে জার্মানির চীনা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কলোনিগুলি জাপানের হস্তগত হয়।

এভাবে প্রতিযোগীদের হারিয়ে জাপান ইউরোপীয়দের মতই চীনসম্রাটের কাছ থেকে ‘কনসেশন’ আদায় করা শুরু করে। তারা চিংদের আদিনিবাস মানচুরিয়া অঞ্চলে রেলরোড গড়ার আর পরিচালনার লীজ় বাগিয়ে নেয়।

কোমিনটাংদের সময় চীনের অবস্থা। কোরিয়া, তাইওয়ান জাপানের অংশ, মানচুকো তাঁবেদার রাষ্ট্র, ১৯৩৭এ উত্তর চীনের বাকি অংশও জাপানের দখলে। — মানচিত্র ইন্টারনেট থেকে।

এরকম সময়ে পু-য়ী তাদের হাতে এসে পড়েন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে।

বালক পু-য়ী সম্রাট না হলেও রাজদরবার তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়নি। ১৯১৭এ এক জেনারেল বেজিং দখল করে পু-য়ীকে আবার সম্রাট ঘোষণা করে। দ্বিতীয় দফা নামমাত্র সম্রাট হবার বারো দিন পর আরেক ওয়ারলর্ডের বিরোধিতার মুখে সে দাবি পরিত্যক্ত হয়। তখন পু-য়ীর বয়স এগারো।

১৯২৪ সালে পু-য়ীকে ফরবিডেন সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসময় পু-য়ীর বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তাঁর ব্রিটিশ শিক্ষক রেজিনাল্ড জনস্টন। পু-য়ী চেয়েছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে। জাপানপ্রেমী জনস্টনই তাঁকে সুপারিশ করেন ব্রিটেনে না গিয়ে তিয়ানজিন শহরে আশ্রয় নিতে, সেখানে জাপানীদের প্রভাব রয়েছে। তিয়ানজিনে পৌঁছনোর পর চিনিতে মাছি পড়ার মত সুবিধাবাদী জাপানী-চীনাদের ভীড় জুটে গেল পু-য়ীর চারপাশে। সম্রাটের মত জীবনযাপন করতে তাঁর কোন সমস্যা হল না।

১৯৩১ সালে রেলপ্রতিরক্ষায় নিয়োজিত জাপানী বাহিনীর একটি উগ্রপন্থী অংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের অজান্তে মানচুরিয়াকে তাঁবেদারি রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা মুকদেন শহরের কাছে রেললাইনের ওপর ডায়নামাইট ফাঁটিয়ে তার দোষ চাপায় চীনা ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ ওপর । অফিসার্স ক্লাব থেকে জাপানীরা চীনা সেনানিবাসে গোলানিক্ষেপ করে। স্থানীয় চীনা ওয়ারলর্ড কোন অর্থবহ প্রতিরোধ না করায় কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর চীনের তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ জাপানী সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।

চীন এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লীগ অফ নেশন্সে। লীগ ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর্ল লিটনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন পাঠায়। তদন্ত শেষ না হতেই জাপানের চররা পু-য়ীকে অনুরোধ করে ‘স্বাধীন’ মানচুরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হতে। ২৫ বছরবয়সী পু-য়ী ছোটবেলা থেকেই পরিচারকদের কাছে শুনে এসেছেন নিজ রাজবংশের গৌরবের ইতিহাস। জেনেছেন আইসিন জোরোরা স্বর্গীয় অধিকারবলে চীনের সম্রাট। অপরিপক্ব সরলমনা পু-য়ী জাপানীদের আসল মতলব বোঝার পরিবর্তে ভাবলেন, এবার তিনি ন্যায্য স্থানে পুনরোধিষ্ঠিত হবেন।

জাপানীরা অবশ্য তাঁকে শুরুতেই সম্রাট না বানিয়ে নতুন ‘পাপেট’ রাষ্ট্র মানচুরিয়ার ‘চীফ এগজেকিউটিভ’ পদে বসায়। সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম জাপানীদেরই হাতে ছিল। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই হাজারে হাজারে জাপানী এসে হাজির হলো মানচুরিয়াতে, কাজ শুরু করলো নতুন কয়লাখনি, স্টীল ফ্যাক্টরিতে। চীনাদের রাজনৈতিক স্বাধিকার পায়ে দলে তাদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করলো জাপানী শিল্পপতিরা।

১৯৩২এ লিটনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পর আসল সত্য বেরিয়ে এল। লীগসদস্যরা জাপানকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব আনল। অপরাধস্বীকারের পরিবর্তে জাপানের প্রতিনিধি উল্টো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কী অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করছে জাপান, চীন তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনে কী পরিমাণ অবহেলা করছে, ইত্যাদির ফিরিস্তি দেবার পর দলবলসহ সম্মেলনকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। ছবিতে দেখানো টিনটিন ‌অ্যান্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকসের কার্টুন স্ট্রিপে এই সত্যি ঘটনাটি অমর করে রেখেছেন কার্টুনিস্ট এরঝ়ে।

টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে দেখানো হয়েছে লীগ অফ নেশন্স থেকে জাপানের ওয়াক-আউটের ঐতিহাসিক দৃশ্য, যদিও এখানে কাহিনী আসল ইতিহাসের থেকে শেষমেশ একটু আলাদা। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপর ১৯৩৭এ জাপান চীনের বাকি উত্তরাংশও দখল করে নেয়। চীনাদের ওপর অভূতপূর্ব সিভিলিয়ান বমিং ও হত্যাযজ্ঞ ‘রেপ অফ নানকিং’ সংঘটিত হয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পু-য়ী হন সোভিয়েতদের রাজবন্দী। তারা আরামেই রাখে প্রাক্তন সম্রাটকে। টোকিওতে জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বাক্ষ্য দেন পু-য়ী। এরপর ১৯৫০এ চীনের নতুন কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে পু-য়ীকে হস্তান্তর করে সোভিয়েতরা। পু-য়ী ভেবেছিলেন রুশ কম্যুনিস্টরা যেমন ৎসার নিকোলাসকে সপরিবারে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল, তেমনটাই হবে তাঁর ভাগ্যলিখন। কিন্তু মাও আর চৌএনলাইয়ের ছিল অন্য ধান্ধা।

পু-য়ীকে একটি রিএডুকেশন ক্যাম্পে রাখা হল নয় বছর। এই প্রথমবার তিনি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। এতদিন তাঁর দাঁতব্রাশ থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করে দিত কোন না কোন চাকর, এখন সব নিজের দায়িত্ব। এছাড়াও তাঁকে দেখানো হলো তাঁর পূর্বজীবনের অত্যাচারের চিত্র। দুর্বল মনস্তত্ত্বের সুযোগে সমাজতন্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হল তাঁকে। ১৯৫৯এ পেলেন মুক্তি, সম্রাট হিসাবে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসাবে। মাও-চৌএনলাই প্রমুখের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হল তাঁর।

বেজিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিচর্যাকারীর কাজ করছেন সম্রাট আইসিন-জোরো পু-য়ী — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

কম্যুনিস্টরা পু-য়ীর পরিবর্তনকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের ঢোল বাজাতে ব্যবহার করলেও পু-য়ীর তাতে তেমন কিছু যায়-আসেনি। সাধারণ মানুষের সাথে সহজে মিশেছেন, তারাও তাঁকে ভালবেসেছে। বেজিংয়ে মালীর কাজ করেও লজ্জিত হননি। নিজের পুরনো রাজপ্রাসাদের ট্যুরিস্ট গাইডও হয়েছিলেন কিছুদিন। সম্রাটজীবনে বার চারেক রাজনৈতিক বিয়ের পর শেষ স্ত্রীর সাথে সুখেই ঘর বাঁধেন ১৯৬২তে। ১৯৬৭ সালে ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগে মারা যান শেষ চীনসম্রাট।

মারা যাবার আগে স্বদেশের প্রগতিশীল সংস্কার দেখে যান পু-য়ী। তাঁর নিজেরও যে মোক্ষলাভ হয়েছিল, তা ফুঁটে উঠেছে তাঁর বইয়ের এই উক্তির মধ্যেঃ
“I was the number one prisoner of my palaces. Today, I enjoy real freedom and equality. I can go anywhere — something I never dreamed possible in the first fifty years of my life.”


(১) মাও আর চৌএনলাইএর উৎসাহ পাওয়ার পর নিজের একটা জীবনী লিখেন পু-য়ী। ‘দ্য ফার্স্ট হাফ অফ মাই লাইফ’ নামে এই বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। ইতালীয় পরিচালক বেরতোলুচ্চি ১৯৮৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানান, নাম ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’। [The Last Emperor]

(২) মানচু (আরেক নাম জুরচেন) জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা মোঙ্গলদের কাছাকাছি। মানচুরিয়া বলে কখনো কোন আলাদা দেশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে জাপানী ‘গবেষণার’ উপর ভিত্তি করে মানচুরিয়া আর তার অধিবাসীদের আলাদা পরিচয় বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ‘মানচুরিয়ার’ অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল হান চীনা, মানচুরা ছিল সংখ্যালঘু। তাছাড়াও মানচুরা ইতিমধ্যে হান চীনা ভাষা-সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছিল। পু-য়ী মানচু ভাষায় কথা বলতে একদমই পারতেন না, ম্যান্ডারিন আর ইংরেজী পারতেন অল্প অল্প। [Manchu people]

(৩) ৎসিশি ১৮৫০এর দশকে চীনা সম্রাটের রক্ষিতা ছিলেন। সম্রাট মারা যাবার পর তিনি হন এম্প্রেস-ডাউএজার। প্রথমে ছেলে, তারপর ভাগ্নেকে সম্রাট বানিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন ৎসিশিই। নানা রকম অন্তর্কলহ, ষড়যন্ত্র ছিল চিং দরবারে দৈনন্দিন ঘটনা। চীনের বহির্দেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের সম্রাটদের আমলের রক্ষণশীলতা চলে আসছিল। কয়েকটি বিদ্রোহ-বিপ্লবের পর ৎসিশি শেষের দিকে চেষ্টা করলেও চীনের উদারীকরণ করতে ব্যর্থ হন। [Empress Dowager Cixi]

(৪) ১৯১২ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত চীন ছিল গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। সুন-ইয়াত-সেন কিছুদিন রাষ্ট্রপতি থাকার পরে তাঁকে সরিয়ে ইউয়েন-শি-কাই নিজে সম্রাট হবার চেষ্টা করেন। বিশের দশকে কুওমিনটাং পার্টিকে সুসংহত করেন চিয়াং-কাই-শেক, সে জন্যে নতুন রাজনৈতিক দল কম্যুনিস্টদের সাথেও হাত মেলান। এসময় চীনের বড় বড় প্রদেশ, যেমন সিনকিয়াং, তুরকেস্তান, ইয়ুনান, তিব্বত, প্রভৃতি এলাকায় প্রাইভেট মিলিশিয়া দল একরকম চাঁদাবাজি করে বেড়াত, আর একে অন্যের সাথে আঁতাত করে অন্যান্য ওয়ারলর্ডদের সাথে যুদ্ধে লেগে থাকত। ১৯২৮এ চিয়াং-কাই-শেক চীনের অধিকাংশ এলাকা একীভুত করে ওয়ারলর্ড যুগের সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু তারপরও উত্তরে বহু দুর্গম অঞ্চলে ওয়ারলর্ডরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজিয়ে রাখে। [Warlord Era]

(৫) উত্তর চীনের উন্নয়নের নামে রুশরা মাঞ্চুরিয়াতে রেলরোড গড়ে দেয়। তার সকল আয় ছিল রুশ সরকারের। তাছাড়াও রেলরোডের আশপাশের অঞ্চলে প্রতিরক্ষার নামে সৈন্য মোতায়েন করার অধিকার বাগিয়ে নেয় তারা। রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতার পর রেলরোডের দক্ষিণাংশ জাপানীদের দখলে আসে। ১৯২৯ সালে চীনারা সোভিয়েতদের কাছ থেকে রেলওয়ে ফেরত চায়। তারা দাবি করে যে ১৯১৭এর বিপ্লবের সময় এক রুশ সেনানায়কের সাথে চুক্তি হয়েছিল রেলওয়ে বিনা খরচে চীনকে ফিরিয়ে দেবে রাশিয়া। সোভিয়েতের সাথে এক দফা যুদ্ধে হারার পর চীন রেলরোডের পূর্বাংশের ওপর রুশদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। [Chinese Eastern Railway]

(৬) নিজেরাই শত্রুর সাজ নিয়ে নিজেদের ওপর আক্রমন করে দোষ শত্রুর উপর চাপিয়ে অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার এই কৌশলকে বলা হয় ‘ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক’। জাপানীদের মানচুরিয়ার ঘটনার পরপরই ইতালীয়রা ইথিওপিয়াতে আর জার্মানি পোল্যান্ডে এধরনের আক্রমণের উসিলা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধায়। অধুনা সময়ে পুতিনের রাশিয়াও এধরনের আগ্রাসন করেছে। এফএসবি বলে রুশ গোয়েন্দা-সংস্থার এক সদস্য ১৯৯৯ সালে মস্কোর অ্যাপারট্মেন্টে বোমা পাতার সময় নাকি ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব তথ্য প্রমাণ গায়েব করে দেয়া হয়। বোমা হামলার দোষ চাপানো হয়েছিল চেচেন সন্ত্রাসবাদীদের উপর, আর এই উসিলায় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পুতিনের গদি পাকাপোক্ত হয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশল খাটিয়েছে রুশরা। [False flag]

(৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর সিংগাপুর, মালয়, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীনও জাপানের কব্জা হয়। ১৯৪১এ পার্ল হারবার আক্রমণ, তারপর জাপানীদের বিরুদ্ধে মার্কিনদের বিপুল রক্তক্ষয়ী একেকটা দ্বীপযুদ্ধ। তারপর মিত্রদের সাথে গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্তালিনের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। পশ্চিম দিকে সামরিকভাবে দুর্বল জাপানী সেনাশক্তির বিরুদ্ধে রুশদের জয়যাত্রা শুরু হয় মানচুরিয়া থেকে, আর শেষ হয় উত্তর কোরিয়া আর সাখালিন দ্বীপপুঞ্জ দখলের মাধ্যমে। [Soviet invasion of Manchuria]

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)

শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!