সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশন

চীনের বর্তমান কম্যুনিস্ট শাসকগোষ্ঠী তাদের পূর্বসূরী জাতীয়তাবাদী কুমিন্টাংয়ের বিরুদ্ধে ১৯৪৯এ গৃহযুদ্ধে জয়লাভ করে। দাবি করা হয় যে, কম্যুনিস্ট শাসন শুরুর মাধ্যমে তারা চীনের “সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের” যবনিকাপাত করেছে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল, এই টার্মটি আসলে চীনের কুমিন্টাং জাতীয়তাবাদীদেরই তৈরি ও ব্যবহৃত। অর্থাৎ চীনা কম্যুনিস্টরা কম্যুনিজমের শ্রমিক-চাষী-সৈনিক ইত্যাদি খেঁটে খাওয়া মানুষের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্বের তত্ত্ব কপচালেও পেতি-বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। সোশালিস্ট মার্কেট পলিসি ছেড়ে দিলেও ঐ পেতি-বুর্জোয়া ন্যাশনালিজম রয়ে গেছে। এটা বলতে গেলে রাশিয়ার মত অবস্থা, স্তালিনের মৃত্যুর পর কম্যুনিজম চলেছে ন্যাশনালিজমের ওপর ভিত্তি করে। আর কম্যুনিজমের পতনের পর সোশালিজম নাই হয়ে গেলেও ন্যাশনালিজম ষোল আনা বর্তমান।

দং শিওয়েনের অংকিত “জাতির গোড়াপত্তন অনুষ্ঠান” চিত্রকর্মে ১৯৪৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণারত মাও জেদং, বর্তমান চীনা ন্যারেটিভে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি একই সাথে।

যা হোক, আজকে চীন ও রাশিয়া আপাত মিত্র। তবে সে মিত্রতায় চীনের পাল্লা অসামঞ্জস্যপূর্ণরকম ভারি। আর কোন বাজার না থাকায় রাশিয়া ধীরে ধীরে পরিণত হতে পারে চীনের অর্থনৈতিক উপনিবেশে। সেটা অবশ্য একটা দীর্ঘমেয়াদী প্রান্তিক সম্ভাবনা। কিন্তু স্বল্প মেয়াদে চীনের ওপর রাশিয়া অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। প্রযুক্তি ও ভোক্তাপণ্যের জন্য। দেশের মানুষকে তুলনামূলকভাবে সন্তুষ্ট রাখার জন্য।

কিন্তু ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে অন্য একটা ব্যাপারে খটকা লাগা স্বাভাবিক। সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের সমাপ্তি কি চীনা কম্যুনিস্টরা সম্পূর্ণ করেছে? তাইওয়ান তো এখন আর ভিনদেশীদের কলোনি নয়। আর হংকং-মাকাউ তো নব্বই দশকেই ফিরে গেছে, তাও তদকালীন কলোনিয়াল প্রভুদের ইচ্ছায় — সেসব স্থানের মানুষের গণতান্ত্রিক ভোটে নয়।

সবুজ দাগে দেখানো “নাইন-ড্যাশ” লাইন বরাবর চীনা সমুদ্রসীমার দাবি, যেটা আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের লংঘন ও প্রতিবেশী দেশগুলির ন্যায্য হিস্যার পদদলন
চিং সাম্রাজ্যের শিখরে চীনের সীমান্তরেখা, ঊনবিংশ শতকের পূর্বার্ধ

এখনো নাইন ড্যাশ লাইন, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ, অরুণাচল প্রদেশ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে চীন লেগে থাকে। চীনাদের দাবি অন্যায্যভাবে চিং রাজত্বকালে ও রিপাবলিক অফ চায়না শাসনামলে এসব এলাকা প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি নাকি গলাধঃককরণ করেছে। আসুন একটু সে অন্যায্যতার ফিরিস্তিটা দেখি। খেয়াল করে দেখবেন, ১৮৫৮ সালের ঘটনাটা!

১৮৩৯-৪২ঃ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। পাঁচটি বন্দরে বিশেষ শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার ব্রিটিশদের। হংকং ব্রিটিশদের দখলে (শুধু হংকং দ্বীপটি, আয়তন ৮০ বর্গ কিমি)। পরে লীজকৃত নিউ টেরিটরিসহ হংকং চীনের কাছে ফিরে যায় ১৯৯৭ সালে। সকল ট্রিটী পোর্টের বিশেষ সুবিধা ত্রিশের দশকের মধ্যে পশ্চিমারা হারায়, প্রথমে মার্কিন মধ্যস্থতায়, পরে চীন-জাপান সংঘাতের ডামাডোলে। অর্থাৎ কম্যুনিস্টরা আসার আগেই। ট্রিটি পোর্টগুলিতে চীনা সার্বভৌমত্বই জারি ছিল, কিন্তু পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীরা বিশেষ সুবিধা পেত।

হংকং ও আশপাশের ব্রিটিশ উপনিবেশ পুরো চীনের তুলনায় ক্ষুদ্রাতিক্ষু্দ্র

১৮৪৪ঃ ফরাসীদের সাথে ব্রিটিশদের মত একই প্রকার আনইকুয়াল ট্রিটীর মাধ্যমে সে পাঁচটি বন্দরে বিশেষ সুবিধাপ্রদান।

১৮৫৬-৬০ঃ ব্রিটিশ-ফরাসীদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ ও পরাজয়। হংকংয়ের সাথে কাউলুন যুক্ত, ৭০ বর্গ কিমি। এ সুযোগে রুশরা সীমান্তে সৈন্য জড়ো করে জায়গা দখলের ষড়যন্ত্র করে।

১৮৬০ সালে আফিম যুদ্ধপরবর্তী চিং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

১৮৫৮ঃ ট্রিটী অফ আইগুনের মাধ্যমে রুশ সাম্রাজ্যের হাতে চিং সম্রাটকে ছেড়ে দিতে হয় আউটার মাঞ্চুরিয়া নামক এক বিশাল এলাকা। আমুর-উসুরি নদী দ্বারা সীমানা নির্ধারিত হয়। এলাকা ৬,০০,০০০ বর্গ কিমি, বর্তমান ইউক্রেন সাইজের। এ অঞ্চল এখনো রাশিয়ার হাতে। ভ্লাদিভস্তক মূল শহর, আরেক বড় শহর খাবারস্ক। অধিকাংশ জনসাধারণ মাঞ্চুরিয়ান, রুশ নয়। চীন এখনো এই বিশাল সম্পদশালী এলাকা নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। কবে চীনের এ হিউমিলিয়েশনের শেষ হবে তাও কারো জানা নেই। ষাটের দশকে সোভিয়েতদের সাথে একটি যুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে সকলে মুখ চেপে আছে।

১৮৫৮ সালে বিনা যুদ্ধে সামরিক হুমকি-ধামকি দিয়ে উত্তরপূর্ব মাঞ্চুরিয়ার বিশাল এলাকা চীনের থেকে হস্তগত করে রুশ সাম্রাজ্য, এলাকাটি এখনো রাশিয়ার অংশ

১৮৫৮ঃ ট্রিটি অফ তিয়েনৎসিনের মাধ্যমে ট্রিটি পোর্টের সংখ্যা ও সুবিধা আরো বৃদ্ধি। ব্রিটিশ-ফরাসীদের পাশাপাশি রুশ-মার্কিন নাগরিকদের এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। রুশরাও পাবে ট্রিটি পোর্টের সুবিধা। প্লাস যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ।

১৮৮৪-৮৫ঃ ফ্রান্সের সাথে যুদ্ধ। ভিয়েতনামের তিনটি অঞ্চলের (আনাম — ১,৩০,০০০ বর্গ কিমি, তংকিন — ১,০৩,০০০ বর্গ কিমি, কোচিনচিন — ৬৯,০০০ বর্গ কিমি) ওপর ফরাসীদের সার্বভৌমত্ব স্বীকার। তবে এ ভিয়েতনাম অতীতে বহুবার চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। চীনই তাদের প্রাচীনতম শত্রু। ভিয়েতনাম স্বাধীনদেশ হিসাবে আবির্ভূত হয় ১৯৪৮ সালে। ফরাসী-মার্কিনদের বিরুদ্ধে পরে যুদ্ধ করলেও চীন তাদের ঘরের শত্রু বিভীষণ।

ভিয়েতনামের উত্তরাংশ চিং সাম্রাজ্যের প্রভাববলয়ে থাকায় ফ্রান্স ও চীনের মধ্যে ১৮৮০র দশকে যুদ্ধের মাধ্যমে তার ভাগ্য নির্ধারিত হয়

১৮৮৮ঃ ব্রিটিশ ভারতের সিক্কিম অভিযান। তিব্বতের সাথে পাল্লা দিয়ে এ ছোট রাজ্যটির সাথে প্রটেক্টরেটের সম্পর্ক স্থাপন করে ব্রিটিশ ভারত। সিক্কিমের আয়তন ৭,০০০ বর্গ কিমি। ওদিকে কিন্তু তিব্বতকে চিং সম্রাট সে অধিকার দেয়নি ইত্যাদি বলা হয়। তিব্বত নাকি চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তবে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও তিব্বত ছিল এ এলাকার সার্বভৌম একটি সাম্রাজ্য। কম্যুনিস্ট চীন ১৯৫০ সালে বিশাল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তিব্বতের ক্ষুদ্র প্রাচীন অস্ত্রে সজ্জিত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে “হিউমিলিয়েশনের” সমাপ্তি ঘটায়। এখনো দালাই লামার নেতৃত্বে তিব্বতের একটি নির্বাসিত সরকার আছে ভারতে। তিব্বতের আয়তন ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি।

১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে স্বাধীন তিব্বতের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে “শান্তিপূর্ণ মুক্তি” এনে দেয় চীনের লালবাহিনী

১৮৯৪-৯৫ঃ নব্য পরাশক্তি জাপানের সাথে যুদ্ধ ও পরাজয়। তাইওয়ান দ্বীপটি (৩৬,০০০ বর্গ কিমি) জাপানের কাছে সোপর্দ। কোরিয়া উপদ্বীপের ওপর জাপানী প্রটেক্টরেট, যদিও সেটির পোশাকি নাম এম্পায়ার অফ কোরিয়া। কোরিয়া স্ব অধিকারে একটি সার্বভৌম সাম্রাজ্য ছিল, তবে মোঙ্গল দিগ্বিজয়ের পর পর চীনের ইউয়ান, মিং ও চিং সাম্রাজ্যের লেজুড় হয়ে রয়। তবে সে সম্পর্কটা ছিল করদ রাজ্যের। ১৮৮০র দশকে কোরিয়ার সার্বভৌমত্ব হরণ করে চিং সাম্রাজ্য। ফলশ্রুতিতে জাপানী আক্রমণ। এখন দুই দেশে বিভক্ত কোরিয়া উপদ্বীপ (উত্তরঃ ১২০,০০০ বর্গ কিমি, দক্ষিণঃ ১০০,০০০ বর্গ কিমি)। চীন উত্তর কোরিয়ার ওপর বলতে গেলে এখনো সেরকম প্রাচীন প্রভাব খাঁটিয়ে চলেছে। তাইওয়ান ষোড়শ-সপ্তদশ শতকেও ছিল ডাচ-পর্তুগীজ ঘাঁটি। তাইওয়ানের মূল অধিবাসীরা চীনা নয়। চিং সাম্রাজ্যের আমলে চীনের অন্তর্গত হলেও সেখানে স্থানীয়রা বিদ্রোহ করেছে, জাপানী শাসনের প্রাক্কালে ১৮৮০র দশকে একটি ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। শেষ পর্যন্ত জাপানের দখলে থাকে ১৯৪৫ পর্যন্ত। ১৯৪৯এ রিপাবলিক অফ চায়না সরকার গৃহযুদ্ধে হেরে সেখানে পালিয়ে যায়।

১৮৯৪-৯৫ সালে চীন-জাপান যুদ্ধে তাইওয়ান ও কোরিয়াসহ উত্তরের বেশ কিছু এলাকা চীনের প্রভাবমুক্ত হয়

১৮৯৫ঃ জাপান যুদ্ধে জিতে চীনের লিয়াওদং উপদ্বীপের পোর্ট আর্থার ও সংলগ্ন অঞ্চলের (৩৫০,০০০ বর্গ কিমি) লীজ পেলেও তিন ইউরোপীয় শক্তি জার্মানি, রাশিয়া ও ফ্রান্স জবরদস্তি করে সে এলাকা লীজে তুলে দেয় রুশদের হাতে। ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের শেষ মাথা বানানোর তাগিদে রুশরা জাপানীদের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে ১৯০৫এ তাদের মধ্যে যুদ্ধে এবং রুশদের পরাজয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর সোভিয়েত দখলদারিত্ব। তারপর মাওয়ের কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে ফিরে যায় এ এলাকা।

১৯০৩ সালের রুশ ম্যাপে দেখা যাচ্ছে ট্রান্স-সাইবেরিয়া রেলওয়ের সাথে ট্রান্স-মাঞ্চুরিয়া রেললাইনের সংযুক্তি

১৮৯৯-০১ঃ বক্সার বিদ্রোহ। বিদেশীবিরোধী, খ্রীষ্টানবিরোধী এক পপুলিস্ট মিলিশিয়া যাদের নাম বক্সার, সমানে কচুকাটা করে পশ্চিমা আর তাদের স্থানীয় মিত্রদের। চিং সম্রাজ্ঞী সিশি গোপনে তাদের সমর্থন দেন। বিদ্রোহ দমনে আটটি দেশ অভিযান চালায়, যাদের মধ্যে রুশ ও জাপানীও ছিল। রাশিয়া এ সময় পুরো মাঞ্চুরিয়া (৯৮০,০০০ বর্গ কিমি) দখল করে রাখে ও লুটতরাজ চালায়। বিদ্রোহের পরও তারা সৈন্য প্রত্যাহার করেনি, ফলশ্রুতিতে জাপানের সাথে ১৯০৫এর যুদ্ধ। জার্মানি দখল নেয় চিংদাওয়ের (৫০০ বর্গ কিমি) আর ফরাসীরা কুয়াংচৌওয়ান (৫০০ বর্গ কিমি)। আর বিপুল পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দিতে হয় চিং সম্রাটকে। প্রসঙ্গত, মার্কিনদের যে ক্ষতিপূরণের ভাগ ছিল তা থেকে পরে আমেরিকায় চীনা ছাত্রদের পড়াশোনার ফান্ড তৈরি করে দেয়া হয়, বর্তমান ছিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ও সে টাকায় শুরু।

১৯০১ সালে বক্সার বিদ্রোহদমনে চীনে অনুপ্রবেশ করে ৮ জাতির শান্তিরক্ষীবাহিনী

১৯০৫ঃ রুশ-জাপান যুদ্ধে জাপানের জয়। মাঞ্চুরিয়া থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহার ও লিয়াদংয়ের দখল জাপানের হাতে। মাঞ্চুরিয়ার আদিবাসীদের নাম জুরচেন, এরা হান গোষ্ঠীর চীনা নয়।

১৯১১ঃ সপ্তদশ শতক থেকে “আউটার মঙ্গোলিয়া” (১,৫০০,০০০ বর্গ কিমি) চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য হলেও ১৯১১তে বিপ্লবের গোলমালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯১৯এ চীনের প্রজাতন্ত্রী সরকার তাদের একটু নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হলেও রুশ বিপ্লবের জোয়ার এসে পড়ে এখানে। ফলশ্রুতিতে রুশ সোভিয়েত পাপেট একটি পীপলস রিপাবলিক গঠিত হয়। সেই থেকে দুই দেশের বাফার হয়ে রয়েছে বর্তমান মঙ্গোলিয়া দেশটি। যদিও ইনার মঙ্গোলিয়া (১,২০০,০০০ বর্গ কিমি) এখনো চীনের অধীনস্থ তথাকথিত “স্বায়ত্ত্বশাসিত” অঞ্চল। তিব্বতের মত তাদেরও স্বাধীনতা আন্দোলন চলমান। আর মঙ্গোলিয়া দেশটি ধীরে ধীরে প্রকারান্তরে চীনের ইকনমিক কলোনিতে পরিণত হচ্ছে।

বর্তমান মঙ্গোলিয়া চীন থেকে স্বাধীন হলেও ইনার মঙ্গোলিয়া বলে একটি বিশাল এলাকা এখনো চীনের অধীন

১৯১১ঃ তিব্বতেও একই সময়ে স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। সিক্কিম নিয়ে ব্রিটিশ ভারতের সাথে গোলমালের কারণে দক্ষিণ তিব্বতে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ভারত। কিন্তু তিব্বতের স্বাধীনতা অক্ষুন্ন থাকে। নামমাত্র স্বাধীন দেশ হিসাবে এরপর তিব্বত ১৯৫০ পর্যন্ত চীনের প্রভাবমুক্ত থাকে। কিন্তু তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়নি অন্য কোন দেশ।

১৯২৯ঃ চীনের সাথে সোভিয়েতের প্রথম যুদ্ধ। নতুন চীনা রিপাবলিক মাঞ্চুরিয়ায় চায়নিজ ঈস্টার্ন রেলওয়েতে যে যৌথ প্রশাসন থাকার চুক্তি তা অগ্রাহ্য করে। সোভিয়েত সেনাদল দ্রুত চীনাদের হারিয়ে আগের লীজের চুক্তি পুনর্বহাল করে। এ সুযোগে উসুরি নদীতে একটি বড় দ্বীপ জবরদখল করে নেয়। বলশয় উসুরিস্কি নামের এ দ্বীপ (৩৫০ বর্গ কিমি) মোটে ২০০৪ সালে রাশিয়া ফিরিয়ে দেয় চীনকে।

দখলকৃত কোমিনতাং পতাকা হাতে রুশ লালবাহিনীর সৈন্য

১৯৩১-৩২ঃ মাঞ্চুরিয়ায় জাপানের আগ্রাসন। জার্মানি কর্তৃক ১৯৩৯এ পোল্যান্ড আক্রমণের ব্লুপ্রিন্ট এই আক্রমণ। মাঞ্চুরিয়ায় একটি “স্বাধীন” পাপেট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে জাপান। ক্ষমতাসীন করে ১৯১২তে ক্ষমতাচ্যুত চীনা চিং সম্রাটকে। ১৯৪৫এ সোভিয়েতরা জাপানীদের দুর্বলতার সুযোগে দখলদার শাসন প্রতিষ্ঠা করে ও পরে মাওয়ের কম্যুনিস্টদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সঁপে দেয়। এখানকার ঘাঁটি থেকেই চীনা কম্যুনিস্টরা কোমিনতাংয়ের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালায়।

মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের পর রেললাইনে “ক্ষয়ক্ষতি” পরিদর্শনে এসেছে জাপানী পরিদর্শকদল

১৯৩৪ঃ শিনজিয়াং বা পূর্ব তুর্কেস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন। এ সময় চীনে ছিল “স্বাধীন” বিভিন্ন ওয়ারলর্ডদের আধিপত্য। শিনজিয়াং বা উইগুর প্রদেশে কোমিনতাং সমর্থিত এক মুসলিম হুই চীনা ওয়ারলর্ড ও সোভিয়েত পাপেট আরেক ওয়ারলর্ডের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। উইগুর খানদের নেতৃত্বে একটি স্বাধীন পূর্ব তুর্কেস্তান রিপাবলিকও আবির্ভূত হয়, যেটা আসলে ছিল ইসলামিস্ট আখরা। কোমিনতাং ওয়ারলর্ড জিতে যাবার প্রাক্কালে সোভিয়েতরা আগ্রাসন চালিয়ে দ্বিতীয়জনের মাঞ্চু সৈন্যদলকে সহায়তা করে। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে পাঠানো লিটল গ্রীন মেনের মত উইগুরে পাঠানো এ সকল রুশ সৈন্যদের পোশাকে কোন পরিচয়ধারী প্রতীক ছিল না। মুসলিম সেই ওয়ারলর্ড যুদ্ধে পরাজয়ের পর সোভিয়েতের অভ্যন্তরে লাপাত্তা হয়ে যায়। শিনজিয়াংয়ে অপর ওয়ারলর্ডের সোভিয়েত পাপেট শাসন চলে ১৯৪২ পর্যন্ত।

১৯৩৪ সালে প্রথম “স্বাধীন” পূর্ব তুর্কেস্তান (শিনজিয়াং) সরকার

১৯৩৭-৪৫ঃ চীন-জাপান যুদ্ধ, যেটা পরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও চলমান থাকে। এ সময়ে চীনের প্রায় ২৫ শতাংশ এলাকা ছিল জাপানের দখলে — প্রায় ২,৫০০,০০০ বর্গ কিমি। প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জাপানী নিষ্ঠুরতায় প্রাণ হারায় অন্তত ৩৮ লাখ মানুষ। চীনকে জাপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অর্থ ও অস্ত্র সহযোগিতা দেয় যুক্তরাষ্ট্র — কম্যুনিস্ট ও কোমিনতাং উভয়কেই।

দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধে জাপানীরা ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করে চীনাদের বিপক্ষে

১৯৪৫ঃ জাপানের পাপেট রাষ্ট্র মাঞ্চুরিয়া দখল করে সোভিয়েতরা, ‌হিরোশিমা-নাগাসাকির ঠিক পরপর। তারা জাপানী পাপেট সরকারের সৈন্যদের নিরস্ত্রীকরণ করতে করতে সেখানে সোভিয়েতঅধিকৃত উত্তর কোরিয়া থেকে ঢুকে পড়ে বহু চীনা কম্যুনিস্ট, যারা রাশিয়া কিংবা কোরিয়ায় আত্মগোপনে ছিল। তাদের হাতে পড়ে মাঞ্চুকোর সেনাবাহিনীর অস্ত্র। কোমিনতাং সরকারের কাছে সোভিয়েতরা নামমাত্র মাঞ্চুরিয়াকে ফিরিয়ে দিলেও কম্যুনিস্ট দোসরদের একটা যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করে দিয়ে যায়। মাও সেতুং উত্তরের ঘাঁটি থেকেই কোমিনতাং সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। সোভিয়েতরা সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে চীনের সবচে শিল্পায়িত এলাকাটির কারখানার কলকব্জা ইত্যাদি খুলে লুট করে নিয়ে যায়। জাপান বা মাঞ্চুকো থেকে সরাসরি সোভিয়েতের ওপর যুদ্ধ ঘোষিত না হলেও সোভিয়েতরা জাপানীদের সাথে সংযুক্ত সকল কম্পানিকে এমন “গনিমতের মাল” হিসাবে লুট করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে “নিরপেক্ষ” সোভিয়েতরা ঘোষণাব্যতিরেকে আক্রমণ চালিয়ে জাপানের নিয়ন্ত্রণাধীন মাঞ্চুকো’র দখল নেয়

১৯৪৪-৪৯ঃ শিনজিয়াং উইগুর প্রদেশে আরেকটা “স্বাধীন সোভিয়েত” পাপেট রাষ্ট্র গঠন করে সোভিয়েতরা। ১৯৪৯এ চীনের গৃহযুদ্ধে কম্যুনিস্টদের বিজয়ের পর সোভিয়েত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করে এ রাষ্ট্রের নেতারা। প্রদেশটি অংশ হয় চীন গণপ্রজাতন্ত্রের।

ছোটখাটর মধ্যে এই ফিরিস্তি আশা করি এ ধারণাটা আপনাদের দেবে যে পশ্চিমারা চীনকে যতটা হিউমিলিয়েট করেছে তার থেকে হাজার গুণে বেশি করেছে তাদের নিকট দুই প্রতিবেশী জাপান ও রাশিয়া — যাদের কোনটিকেই সে আমলে ঠিক পশ্চিমা কাতারে ফেলা সম্ভব নয়। আর পশ্চিমাদের হাতে যে সকল ক্ষুদ্র এলাকা ছিল সব ফিরে পেয়েছে চীন। পায়নি কেবল রাশিয়ার দখলীকৃত বেশিরভাগ এলাকাগুলি। যেটুকু ফিরে পেয়েছে, তাও কম্যুনিস্ট আদর্শগত কারণে, ১৯৪৯এর পর, যখন মাও-স্তালিন দুই দিন পরপর হ্যান্ডশেক করতে ব্যস্ত, আর কোরিয়ার ভাগ্যনির্ধারণে জাতিসংঘের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত।

হ্যাঁ, রাশিয়ার সাথে সীমানা নিয়ে কিছু শান্তি চুক্তি চীন সম্প্রতি করেছে। কিন্তু ভাবুন ইউক্রেনের সাথে দুই বার সার্বভৌমত্বের গ্যারান্টি সত্ত্বেও রাশিয়া সেখানে আগ্রাসন চালিয়েছে “ঐতিহাসিক সংযোগ ও ভ্রাতৃত্বের” দোহাই দিয়ে — চুক্তিভঙ্গ করে। চাইলে চীন একইভাবে উত্তর মাঞ্চুরিয়ার “নিপীড়িত ‘চীনা’ বেরাদরদের” সাহায্যে এগিয়ে এসে ইউক্রেন সাইজের এলাকাটি বেদখল করে নিতে পারে। এ মুহূর্তে চীনের যা লাগে সব পুতিনের রাশিয়া না চাইতেই দিয়ে দিচ্ছে। যদি পুতিনের মৃত্যু হয়, রাশিয়ান ফেডারেশন আলগা হয়ে আসে, তাহলে চীন সেসব এলাকা ফিরে চাইতেই পারে। ১৯১৭ সালের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও বিপ্লবের পরেও রুশ সাম্রাজ্য আলগা হয়ে এসেছিল। সেসময় সুযোগের সদ্ব্যবহারের অবস্থানে চীন ছিল না, ছিল জাপান।

কদিন আগে একটা খবরে এসেছে যে চীন উত্তর মাঞ্চুরিয়ার বিভিন্ন শহরের নাম নিজেদের সরকারী মানচিত্রে দেখানো শুরু করেছে চীনা নামে, সাথে ইংরেজী নাম, কিন্তু রুশে নয়। চীনের টেরিটরিয়াল ক্লেইম করার পন্থা এটাই। যে এলাকায় নিজেদের “ঐতিহাসিক সংযোগ” দাবি করতে চায়, সেখানকার একটি “প্রাচীন” চীনা নাম দেবে, এবং তারপর সেটিকে নিজেদের বলে দাবি করবে। এই কাজটি চীন করেছে ভারতের সাথেও — আকসাই চীন আর অরুণাচল প্রদেশে।

সুতরাং চীনের হিউমিলিয়েশনের শতক নিয়ে বেশি কুম্ভীরাশ্র বর্ষণ না করে তার প্রতিবেশীদের তক্কে তক্কে থাকা উচিত। ভিয়েতনাম, কোরিয়াকে অতীত বহু শতকে যেভাবে করদ বা ঔপনিবেশিক রাজ্যের হিউমিলিয়েশন সহ্য করতে হয়েছিল, কিংবা মাঞ্চুরিয়া-তিব্বত-ইনার মঙ্গোলিয়া-শিনজিয়াংকে এখনো সহ্য করতে হয়, সেরকম হিউমিলিয়েশনের গিভিং এন্ডে না থাকলে রিসিভিং এন্ডে থাকতে হবে। এ শিক্ষাটা রাশিয়া অতি শীঘ্রই পাবে।

জেসমিন ফুল

Featured Video Play Icon

মোলিহোয়া, জেসমিন ফুল, নামের এই চীনা গানটা আমার বেশ পছন্দ।

খুঁজে খুঁজেও অনেক আগে দেখা অন্য আরেকটা ক্লাসিকাল অর্কেস্ট্রা সংস্করণ পেলাম না। আজকাল চীনা সরকারের দাপটে গুগল-অ্যাপল সবাই ‘সংবেদনশীল’ ইন্টারনেট পাতা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। এ যেন আরেক কালচারাল রেভোল্যুশন!

কেন জেসমিন ফুল গানটার ভাল সংস্করণটা পেলাম না, এ ভাবতেই মনে পড়ল ২০১১তে তুনিসিয়াতে যে আরব স্প্রিংয়ের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার নাম দেয়া হয়েছিল জেসমিন বিপ্লব। আর তার কিছুমাত্র ছোঁয়া চীনেও লেগেছিল।

গণতন্ত্রের দাবিতে কিছু চীনা যে ইন্টারনেটভিত্তিক বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তার অন্যতম মাস্কট হিসাবে তারা এই জেসমিন ফুল গানটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। গানটা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এর মধ্যে বিক্ষোভ-বিপ্লবের নামমাত্র নেই।

গানটির বিষয়বস্তু হলো জেসমিন ফুলের সুগন্ধ-সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা।

তাহলে কেন এ গান চীনের কমুনিস্ট সরকারের টনক নড়ালো? কেন গানটির শিরোনামের চীনা অক্ষরগুলি সেদেশের মোবাইল সেটে ফিল্টার করে নিষিদ্ধ করা হলো ২০১১তে? শুধু তাই না, এমনকি জেসমিন কালচারাল ফেস্টিভাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনও সে বছর বাতিল করে দেয়া হয়।

বুঝাই, ধৈর্য ধরুন।

মোলিহোয়ার উৎপত্তি চীনের চিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। যে কাব্যের মাধ্যমে ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে, তার বিলাসিতা কেবল অবস্থাপন্ন বনেদী পরিবারদের পক্ষেই সম্ভব। যেকোন দেশের সংস্কৃতিতে ধনাঢ্য জমিদারী পরিবার কিংবা বণিকগোষ্ঠী যে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকে, সেটা আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসেও ষোল আনা সত্য।

মোলিহোয়া গানটা একসময় চিং সাম্রাজ্যের বেসরকারী জাতীয় সঙ্গীতও ছিল এবং পশ্চিমেও ধীরে ধীরে অপেরা পীসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়। আমি যোগাযোগটা ঠিক জানি না, কিন্তু আন্দাজ লাকমে অপেরার ফ্লাওয়ার ডুয়েট (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের মিউজিক ছিল) হয়তবা, হয়তবা…. মোলিহোয়া দিয়ে প্রভাবিত।

সে যাই হোক, বিংশ শতকের শুরুর ভাগে চিং সাম্রাজ্যের পতন হয়। নানা ওয়ারলর্ডের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যুগের অবসান ঘটান কোমিনতাং পার্টির জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াংকাইশেক

কিন্তু তাঁর শাসনামলেই চীন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম ক্যাজু্য়ালটি — ১৯৩৯এ যুদ্ধের অফিশাল শুরুর আগেই। একদিকে উত্তরপশ্চিমে মাওয়ের কম্যুনিস্ট গেরিলা, আরেকদিকে উত্তরপূর্বে জাপানের আগ্রাসন।

তারপরও চীনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন অনেক পরিবর্তন আসে। অনেক ছাত্র মার্কিন-ইউরোপ থেকে নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে এসে চীনা সংস্কৃতিকে আধুনিক রূপ দেন।

মার্কিনদের দীর্ঘকালীন সহযোগিতা আর মাওয়ের সাথে চুক্তি করে জাপানীদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন চিয়াংকাইশেক (সোভিয়েতদের মাঞ্চুরিয়া দখল একেবারে শেষের সুবিধাবাদী ঘাত।)

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই মাও তার লংমার্চ বিপ্লব ইত্যাদি শুরু করেন। ১৯৪৯এ কোমিন্তাংওয়ালাদের তাইওয়ানে ভাগিয়ে দিয়ে মেইনল্যান্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কায়েম হয়।

প্রথম বিশ-পঁচিশ বছর কম্যুনিস্ট শাসনামলে ধেঁয়ে ধেঁয়ে ভারিশিল্পের বিস্তার, শিক্ষা-চিকিৎসাক্ষেত্রের উন্নতি সাধিত হয়। নিঃসন্দেহে তা ছিল সমাজতন্ত্রী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফসল, এর বিপরীতে কী মূল্য দিতে হয়েছিল, তা না বললাম।

ষাটের দশকে মাওয়ের মাথায় ভূত চাপে যে যত দুনিয়ার ইউরোপীয় সংস্কৃতি উচ্ছেদ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে চীনা গণমানুষের সংস্কৃতি। সব পুরাতনের ধ্বংস করে গড়তে হবে নতুন ইন্সটিটিউশন।

ষাটের দশকে কালচারাল রেভোলুশনের সময় ধ্বংস করা হয় বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের পুরনো পাণ্ডুলিপি আর মূর্তি।

তাঁর নামে দাঁড়িয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিজান পাইওনিয়ার ছাত্রগোষ্ঠী। চললো মবরুল। তারা যেখানেই পশ্চিমা কিছু কিংবা চীনা চিংযুগের বা সামন্তযুগের কিছু পেলো, সব পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলল। পান্ডুলিপিহীন হলেন গবেষক, যন্ত্রবিহীন বাদ্যযন্ত্রী, ভগ্নমন্দিরের নিচে ভগ্নহৃদয় পুরোহিত।

 

কালচারাল রেভোলুশনে নিগৃহীত হন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ

এসময়ে চিংযুগের অনেক চীনা সঙ্গীতের লিপি হারিয়ে যায় বা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কেউ কেউ মাটিতে পুঁতে লুকিয়ে ফেলে। কিছু অনেক পরে বেরিয়েছে আবার, বেশিরভাগই বেরোইনি।

বলা বাহুল্য, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬এর এই নৈরাজ্যকর সময়ে প্রচুর মানুষ বিনা কারণে বিনা বিচারে শুধু মাত্র পশ্চিমা চর বা কোমিন্তাং-চিংদরদী ইত্যাদি রাজাকারী অভিযোগের সন্দেহে প্রাণ হারায়। অনেক গবেষকের হিসাবে সে সংখ্যা প্রায় দু’কোটি।

চীনা সঙ্গীতের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে। আগে পশ্চিমা কিংবা চিং প্রভাবে ‘শিল্পের খাতিরেই ছিল শিল্প’। এখন আর্ট হয়ে দাঁড়ালো ‘উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার’, তথা নিষ্পেষিত জনগণের নামে মাও ও কম্যুনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন। আর তাও যদি না হয়, লোকসঙ্গীতকে তুলে ধরা হলো অপেরা ফর্মে — এ যেন এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ‘ওহে গ্রাম্যবালিকা, কোথা যাও একটু দাঁড়াও…’ ইত্যাদি হলো অপেরা-অর্কেস্ট্রার বিষয়বস্তু। নয়ত, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ক্ষেতে কাজ করি চল’, নয়ত টাইগার টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই নিয়ে লাফালাফির স্মৃতিচারণ।

তো এসবের মধ্যে মোলিহোয়ার মত স্বল্প কিছু পুরনো গান বেঁচে রয়েছিল। কারণ, এসব গানের কথায় নেই কোন সম্রাট-বুর্জোয়ার নাম, নেই বিদ্রোহ-বিক্ষোভের আভাষ। শুধুই একটি নিষ্পাপ ফুলের গুণকীর্তন।

আর ঠিক এ কারণেই নিষ্পেষক কমুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতীক হিসাবে ২০১১তে এ গানটি বেঁছে নেয়া হয়। সে বিপ্লব বেশি দূর যায়নি। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে মোবাইল-ইন্টারনেটের সকল কলকব্জা। টের পাওয়া মাত্রই মোলিহোয়ার যাত্রাভঙ্গ।

এখনও হংকংশিনজিয়াংয়ে স্বগোত্রীয়-অন্যগোত্রীয়দের ওপর একই কলকব্জা শানিয়ে তাদের জায়গামত পুরো দিচ্ছে কমুনিস্ট রাষ্ট্র। যারা রাষ্ট্রের সুফলভোগী তাদের কোন বিকার নেই। কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, কবে জেসমিন ফুল মোলিহোয়ার মুক্তি আসবে চীনে।

আইসিন জোরো পু-য়ী

ডাকটিকেটে যাঁর ছবি, তাঁর নাম আইসিন জোরো পু-য়ী। চীনের উথাল-পাথাল সময়ে দু’বার শিশুসম্রাট হয়েছেন, একবার পরেছেন মানচুকোর রাজমুকুট। আলোকচিত্রে তাঁকে দেখা যাচ্ছে বেজিংএর বোটানিক্যাল গার্ডেনে মালীর কাজ করতে !

মানচুকোর ১৯৩২ সালের ডাকটিকেটে শেষ চিং সম্রাট আইসিন জোরো ওরফে হেনরি পু-য়ীর ছবি — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

পু-য়ীর অবিশ্বাস্য কাহিনীর সাথে জড়িয়ে আছে চীনের সমস্যাসংকুল সময়ে জাপানের সাম্রাজ্যবাদী উচ্চাভিলাষের ইতিহাস।

ঊনবিংশ শতকের শেষে জাপান ইউরোপীয়প্রধান ‘উপনিবেশী ক্লাবে’ যোগ দেয়। রুদ্ধদ্বার সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে জাপানে মেইজি যুগ আরম্ভ হয় ১৮৬৮তে। মেইজি রাষ্ট্রনায়করা সনাতনী ঐতিহ্য ধরে রেখেই স্বদেশের ‘পশ্চিমাকরণ’ শুরু করেন। সে সূত্রে আসে ভূমিসংস্কার, সীমিত গণতন্ত্র, বৈদেশিক বাণিজ্য আর ভাড়াটে সামুরাইদের পরিবর্তে নিয়মিত আধুনিক সামরিক বাহিনীর প্রচলন।

জাপানে কাঁচামালের প্রাচুর্য ছিল কম, জনসংখ্যার অধিকতার কারণে অন্ন ও কর্মসংস্থানও ছিল সীমিত। পশ্চিমাদের দেখাদেখি শিল্পায়ন শুরু হলে জাপানী শাসকগোষ্ঠীর চোখ পড়ে চীনের ওপর। বিশেষ করে চীনের ‌অধীন কোরিয়া আর মানচুরিয়া, দুটোই ছিল খনিজসমৃদ্ধ এলাকা।

চীন সেসময় ছিল রক্ষণশীল, পশ্চাদপর, সামন্ততান্ত্রিক একটি সাম্রাজ্য। চীনের সমসাময়িক চিংবংশীয় শাসকরা ছিল দুর্বলচিত্ত, অন্দরমহলের রাজমাতা আর খোঁজাদের প্রভাবে চালিত, আর জনবিচ্ছিন্ন। তদোপরি, চিংরা ছিল বহিরাগত। মিং নামক একটি স্থানীয় হান রাজবংশ সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত চীন শাসন করে। এরপর পূর্ব সাইবেরিয়ার মানচুরা নুরহাচির নেতৃত্বে চীনের বিভিন্ন অংশ একে একে জয় করে চিংএর গোড়াপত্তন করে।

১৯০৬ সালে নুরহাচির আইসিন জোরো বংশে জন্ম পু-য়ীর। ১৯০৮এ চীনসম্রাট ওয়ারিশহীন অবস্থায় মারা যাবার পর রাজমাতা তিনবছরবয়সী পু-য়ীকে ঘোষণা করেন পরবর্তী সম্রাট হিসাবে। বিধবা-সম্রাজ্ঞী ৎসিশির জবরজং পোশাক আর কুঁকড়ে-যাওয়া চেহারা দেখে পু-য়ী বেদম কান্না করেছিলেন সবার সামনে। এর কিছুদিন পর ৎসিশিও মারা যান

১৯১২ সালে হান জাতীয়তাবাদীদের শিনহাই বিদ্রোহের মুখে পু-য়ীর বাবা রাজসিংহাসনের ওপর তাঁর অধিকার রদ করে দেন। সুন-ইয়াত-সেন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করলেও তাঁর দলের সদস্যদের অন্তর্দ্বন্দ্ব ও ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে বিশৃংখলা আরো বৃদ্ধি পায়। প্রদেশগুলির গভর্নর কিংবা সেনাপ্রধানরা নিজ এলাকায় প্রকারান্তরে স্বাধীন শাসন শুরু করেন। ছবির ম্যাপে চীনের চেহারা তাই দেখা যাচ্ছে পাজ়ল পীসের মত

এই সময়টা তক্কে তক্কে ছিল জাপানের সামরিক উগ্রপন্থীরা। ইতিমধ্যেই ১৮৯৭ সালে কোরিয়া জাপানী সাম্রাজ্যের আওতায় এসেছে। চীনের ওপর রুশদের লোলুপ দৃষ্টিকে জাপানীরা অন্ধ করে দেয় ১৯০৫এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে তাদেরকে হারিয়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও মিত্রশক্তির পক্ষে থাকার সুবাদে জার্মানির চীনা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কলোনিগুলি জাপানের হস্তগত হয়।

এভাবে প্রতিযোগীদের হারিয়ে জাপান ইউরোপীয়দের মতই চীনসম্রাটের কাছ থেকে ‘কনসেশন’ আদায় করা শুরু করে। তারা চিংদের আদিনিবাস মানচুরিয়া অঞ্চলে রেলরোড গড়ার আর পরিচালনার লীজ় বাগিয়ে নেয়।

কোমিনটাংদের সময় চীনের অবস্থা। কোরিয়া, তাইওয়ান জাপানের অংশ, মানচুকো তাঁবেদার রাষ্ট্র, ১৯৩৭এ উত্তর চীনের বাকি অংশও জাপানের দখলে। — মানচিত্র ইন্টারনেট থেকে।

এরকম সময়ে পু-য়ী তাদের হাতে এসে পড়েন অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে।

বালক পু-য়ী সম্রাট না হলেও রাজদরবার তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়নি। ১৯১৭এ এক জেনারেল বেজিং দখল করে পু-য়ীকে আবার সম্রাট ঘোষণা করে। দ্বিতীয় দফা নামমাত্র সম্রাট হবার বারো দিন পর আরেক ওয়ারলর্ডের বিরোধিতার মুখে সে দাবি পরিত্যক্ত হয়। তখন পু-য়ীর বয়স এগারো।

১৯২৪ সালে পু-য়ীকে ফরবিডেন সিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়। এসময় পু-য়ীর বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন তাঁর ব্রিটিশ শিক্ষক রেজিনাল্ড জনস্টন। পু-য়ী চেয়েছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করতে। জাপানপ্রেমী জনস্টনই তাঁকে সুপারিশ করেন ব্রিটেনে না গিয়ে তিয়ানজিন শহরে আশ্রয় নিতে, সেখানে জাপানীদের প্রভাব রয়েছে। তিয়ানজিনে পৌঁছনোর পর চিনিতে মাছি পড়ার মত সুবিধাবাদী জাপানী-চীনাদের ভীড় জুটে গেল পু-য়ীর চারপাশে। সম্রাটের মত জীবনযাপন করতে তাঁর কোন সমস্যা হল না।

১৯৩১ সালে রেলপ্রতিরক্ষায় নিয়োজিত জাপানী বাহিনীর একটি উগ্রপন্থী অংশ কেন্দ্রীয় নেতাদের অজান্তে মানচুরিয়াকে তাঁবেদারি রাষ্ট্র বানানোর ষড়যন্ত্র পাকায়। তারা মুকদেন শহরের কাছে রেললাইনের ওপর ডায়নামাইট ফাঁটিয়ে তার দোষ চাপায় চীনা ‘দুষ্কৃতিকারীদের’ ওপর । অফিসার্স ক্লাব থেকে জাপানীরা চীনা সেনানিবাসে গোলানিক্ষেপ করে। স্থানীয় চীনা ওয়ারলর্ড কোন অর্থবহ প্রতিরোধ না করায় কিছুদিনের মধ্যেই উত্তর চীনের তিনটি প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ জাপানী সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়।

চীন এ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে লীগ অফ নেশন্সে। লীগ ব্রিটিশ কূটনীতিবিদ আর্ল লিটনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন পাঠায়। তদন্ত শেষ না হতেই জাপানের চররা পু-য়ীকে অনুরোধ করে ‘স্বাধীন’ মানচুরিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান হতে। ২৫ বছরবয়সী পু-য়ী ছোটবেলা থেকেই পরিচারকদের কাছে শুনে এসেছেন নিজ রাজবংশের গৌরবের ইতিহাস। জেনেছেন আইসিন জোরোরা স্বর্গীয় অধিকারবলে চীনের সম্রাট। অপরিপক্ব সরলমনা পু-য়ী জাপানীদের আসল মতলব বোঝার পরিবর্তে ভাবলেন, এবার তিনি ন্যায্য স্থানে পুনরোধিষ্ঠিত হবেন।

জাপানীরা অবশ্য তাঁকে শুরুতেই সম্রাট না বানিয়ে নতুন ‘পাপেট’ রাষ্ট্র মানচুরিয়ার ‘চীফ এগজেকিউটিভ’ পদে বসায়। সরকারের যাবতীয় কার্যক্রম জাপানীদেরই হাতে ছিল। তাদের অঙ্গুলিহেলনেই হাজারে হাজারে জাপানী এসে হাজির হলো মানচুরিয়াতে, কাজ শুরু করলো নতুন কয়লাখনি, স্টীল ফ্যাক্টরিতে। চীনাদের রাজনৈতিক স্বাধিকার পায়ে দলে তাদের সস্তা শ্রমিক হিসাবে ব্যবহার করলো জাপানী শিল্পপতিরা।

১৯৩২এ লিটনের অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশের পর আসল সত্য বেরিয়ে এল। লীগসদস্যরা জাপানকে আগ্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে আখ্যা দিয়ে একটি প্রস্তাব আনল। অপরাধস্বীকারের পরিবর্তে জাপানের প্রতিনিধি উল্টো বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় কী অসহনীয় কষ্ট স্বীকার করছে জাপান, চীন তার রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপালনে কী পরিমাণ অবহেলা করছে, ইত্যাদির ফিরিস্তি দেবার পর দলবলসহ সম্মেলনকক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন। ছবিতে দেখানো টিনটিন ‌অ্যান্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকসের কার্টুন স্ট্রিপে এই সত্যি ঘটনাটি অমর করে রেখেছেন কার্টুনিস্ট এরঝ়ে।

টিনটিন এন্ড দ্য ব্লু লোটাস কমিকে দেখানো হয়েছে লীগ অফ নেশন্স থেকে জাপানের ওয়াক-আউটের ঐতিহাসিক দৃশ্য, যদিও এখানে কাহিনী আসল ইতিহাসের থেকে শেষমেশ একটু আলাদা। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপর ১৯৩৭এ জাপান চীনের বাকি উত্তরাংশও দখল করে নেয়। চীনাদের ওপর অভূতপূর্ব সিভিলিয়ান বমিং ও হত্যাযজ্ঞ ‘রেপ অফ নানকিং’ সংঘটিত হয়

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পু-য়ী হন সোভিয়েতদের রাজবন্দী। তারা আরামেই রাখে প্রাক্তন সম্রাটকে। টোকিওতে জাপানী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে স্বাক্ষ্য দেন পু-য়ী। এরপর ১৯৫০এ চীনের নতুন কম্যুনিস্ট সরকারের কাছে পু-য়ীকে হস্তান্তর করে সোভিয়েতরা। পু-য়ী ভেবেছিলেন রুশ কম্যুনিস্টরা যেমন ৎসার নিকোলাসকে সপরিবারে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছিল, তেমনটাই হবে তাঁর ভাগ্যলিখন। কিন্তু মাও আর চৌএনলাইয়ের ছিল অন্য ধান্ধা।

পু-য়ীকে একটি রিএডুকেশন ক্যাম্পে রাখা হল নয় বছর। এই প্রথমবার তিনি সত্যিকারের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলেন। এতদিন তাঁর দাঁতব্রাশ থেকে শুরু করে টয়লেট পরিষ্কার করে দিত কোন না কোন চাকর, এখন সব নিজের দায়িত্ব। এছাড়াও তাঁকে দেখানো হলো তাঁর পূর্বজীবনের অত্যাচারের চিত্র। দুর্বল মনস্তত্ত্বের সুযোগে সমাজতন্ত্রের শিক্ষাও দেয়া হল তাঁকে। ১৯৫৯এ পেলেন মুক্তি, সম্রাট হিসাবে নয়, সাধারণ নাগরিক হিসাবে। মাও-চৌএনলাই প্রমুখের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হল তাঁর।

বেজিংয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে পরিচর্যাকারীর কাজ করছেন সম্রাট আইসিন-জোরো পু-য়ী — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

কম্যুনিস্টরা পু-য়ীর পরিবর্তনকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎকর্ষের ঢোল বাজাতে ব্যবহার করলেও পু-য়ীর তাতে তেমন কিছু যায়-আসেনি। সাধারণ মানুষের সাথে সহজে মিশেছেন, তারাও তাঁকে ভালবেসেছে। বেজিংয়ে মালীর কাজ করেও লজ্জিত হননি। নিজের পুরনো রাজপ্রাসাদের ট্যুরিস্ট গাইডও হয়েছিলেন কিছুদিন। সম্রাটজীবনে বার চারেক রাজনৈতিক বিয়ের পর শেষ স্ত্রীর সাথে সুখেই ঘর বাঁধেন ১৯৬২তে। ১৯৬৭ সালে ৬১ বছর বয়সে ক্যান্সার ও হৃদরোগে ভুগে মারা যান শেষ চীনসম্রাট।

মারা যাবার আগে স্বদেশের প্রগতিশীল সংস্কার দেখে যান পু-য়ী। তাঁর নিজেরও যে মোক্ষলাভ হয়েছিল, তা ফুঁটে উঠেছে তাঁর বইয়ের এই উক্তির মধ্যেঃ
“I was the number one prisoner of my palaces. Today, I enjoy real freedom and equality. I can go anywhere — something I never dreamed possible in the first fifty years of my life.”


(১) মাও আর চৌএনলাইএর উৎসাহ পাওয়ার পর নিজের একটা জীবনী লিখেন পু-য়ী। ‘দ্য ফার্স্ট হাফ অফ মাই লাইফ’ নামে এই বইটি বহু ভাষায় অনূদিত হয়। ইতালীয় পরিচালক বেরতোলুচ্চি ১৯৮৭ সালে তাঁর জীবন নিয়ে একটি অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র বানান, নাম ‘দ্য লাস্ট এম্পেরর’। [The Last Emperor]

(২) মানচু (আরেক নাম জুরচেন) জাতির সংস্কৃতি ও ভাষা মোঙ্গলদের কাছাকাছি। মানচুরিয়া বলে কখনো কোন আলাদা দেশ ছিল না। ঊনবিংশ শতকে জাপানী ‘গবেষণার’ উপর ভিত্তি করে মানচুরিয়া আর তার অধিবাসীদের আলাদা পরিচয় বানানোর চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ‘মানচুরিয়ার’ অধিবাসীদের অধিকাংশই ছিল হান চীনা, মানচুরা ছিল সংখ্যালঘু। তাছাড়াও মানচুরা ইতিমধ্যে হান চীনা ভাষা-সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গেছিল। পু-য়ী মানচু ভাষায় কথা বলতে একদমই পারতেন না, ম্যান্ডারিন আর ইংরেজী পারতেন অল্প অল্প। [Manchu people]

(৩) ৎসিশি ১৮৫০এর দশকে চীনা সম্রাটের রক্ষিতা ছিলেন। সম্রাট মারা যাবার পর তিনি হন এম্প্রেস-ডাউএজার। প্রথমে ছেলে, তারপর ভাগ্নেকে সম্রাট বানিয়ে পেছন থেকে কলকাঠি নাড়তেন ৎসিশিই। নানা রকম অন্তর্কলহ, ষড়যন্ত্র ছিল চিং দরবারে দৈনন্দিন ঘটনা। চীনের বহির্দেশীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আগের সম্রাটদের আমলের রক্ষণশীলতা চলে আসছিল। কয়েকটি বিদ্রোহ-বিপ্লবের পর ৎসিশি শেষের দিকে চেষ্টা করলেও চীনের উদারীকরণ করতে ব্যর্থ হন। [Empress Dowager Cixi]

(৪) ১৯১২ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত চীন ছিল গৃহযুদ্ধে লিপ্ত। সুন-ইয়াত-সেন কিছুদিন রাষ্ট্রপতি থাকার পরে তাঁকে সরিয়ে ইউয়েন-শি-কাই নিজে সম্রাট হবার চেষ্টা করেন। বিশের দশকে কুওমিনটাং পার্টিকে সুসংহত করেন চিয়াং-কাই-শেক, সে জন্যে নতুন রাজনৈতিক দল কম্যুনিস্টদের সাথেও হাত মেলান। এসময় চীনের বড় বড় প্রদেশ, যেমন সিনকিয়াং, তুরকেস্তান, ইয়ুনান, তিব্বত, প্রভৃতি এলাকায় প্রাইভেট মিলিশিয়া দল একরকম চাঁদাবাজি করে বেড়াত, আর একে অন্যের সাথে আঁতাত করে অন্যান্য ওয়ারলর্ডদের সাথে যুদ্ধে লেগে থাকত। ১৯২৮এ চিয়াং-কাই-শেক চীনের অধিকাংশ এলাকা একীভুত করে ওয়ারলর্ড যুগের সমাপ্তি ঘটান। কিন্তু তারপরও উত্তরে বহু দুর্গম অঞ্চলে ওয়ারলর্ডরা তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি বজিয়ে রাখে। [Warlord Era]

(৫) উত্তর চীনের উন্নয়নের নামে রুশরা মাঞ্চুরিয়াতে রেলরোড গড়ে দেয়। তার সকল আয় ছিল রুশ সরকারের। তাছাড়াও রেলরোডের আশপাশের অঞ্চলে প্রতিরক্ষার নামে সৈন্য মোতায়েন করার অধিকার বাগিয়ে নেয় তারা। রুশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতার পর রেলরোডের দক্ষিণাংশ জাপানীদের দখলে আসে। ১৯২৯ সালে চীনারা সোভিয়েতদের কাছ থেকে রেলওয়ে ফেরত চায়। তারা দাবি করে যে ১৯১৭এর বিপ্লবের সময় এক রুশ সেনানায়কের সাথে চুক্তি হয়েছিল রেলওয়ে বিনা খরচে চীনকে ফিরিয়ে দেবে রাশিয়া। সোভিয়েতের সাথে এক দফা যুদ্ধে হারার পর চীন রেলরোডের পূর্বাংশের ওপর রুশদের নিয়ন্ত্রণ মেনে নেয়। [Chinese Eastern Railway]

(৬) নিজেরাই শত্রুর সাজ নিয়ে নিজেদের ওপর আক্রমন করে দোষ শত্রুর উপর চাপিয়ে অন্যায় যুদ্ধ শুরু করার এই কৌশলকে বলা হয় ‘ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক’। জাপানীদের মানচুরিয়ার ঘটনার পরপরই ইতালীয়রা ইথিওপিয়াতে আর জার্মানি পোল্যান্ডে এধরনের আক্রমণের উসিলা দিয়ে যুদ্ধ বাঁধায়। অধুনা সময়ে পুতিনের রাশিয়াও এধরনের আগ্রাসন করেছে। এফএসবি বলে রুশ গোয়েন্দা-সংস্থার এক সদস্য ১৯৯৯ সালে মস্কোর অ্যাপারট্মেন্টে বোমা পাতার সময় নাকি ধরা পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেসব তথ্য প্রমাণ গায়েব করে দেয়া হয়। বোমা হামলার দোষ চাপানো হয়েছিল চেচেন সন্ত্রাসবাদীদের উপর, আর এই উসিলায় দ্বিতীয় চেচেন যুদ্ধ শুরু হয়। সে যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে পুতিনের গদি পাকাপোক্ত হয়। ইউক্রেনের বিরুদ্ধেও একই ধরনের কৌশল খাটিয়েছে রুশরা। [False flag]

(৭) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পর সিংগাপুর, মালয়, বার্মা, ইন্দোনেশিয়া, ইন্দোচীনও জাপানের কব্জা হয়। ১৯৪১এ পার্ল হারবার আক্রমণ, তারপর জাপানীদের বিরুদ্ধে মার্কিনদের বিপুল রক্তক্ষয়ী একেকটা দ্বীপযুদ্ধ। তারপর মিত্রদের সাথে গোপন চুক্তি অনুযায়ী স্তালিনের জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। পশ্চিম দিকে সামরিকভাবে দুর্বল জাপানী সেনাশক্তির বিরুদ্ধে রুশদের জয়যাত্রা শুরু হয় মানচুরিয়া থেকে, আর শেষ হয় উত্তর কোরিয়া আর সাখালিন দ্বীপপুঞ্জ দখলের মাধ্যমে। [Soviet invasion of Manchuria]

তান্নু তুভা

আজ যে দেশটির ডাকটিকেট দেখাচ্ছি ত্রিশ দশকের ম্যাপসহ, তার স্বাধীন অস্তিত্ব আর নেই। ১৯২১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নামমাত্র স্বাধীন দেশটির নাম তুভা।

১৯৩৬ সালের তুভার এই ডাকটিকেটে দেখা যাচ্ছে রেলের সাথে উটের দৌড়। প্রকৃতপক্ষে তুভায় কোন রেললাইন ছিল না। তুভার ‘উন্নয়নের’ মিথ্যে প্রচারনার উদাহরণ এ ডাকটিকেট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

মোঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার মাঝে স্যান্ডইউচ দেশটি এখন রাশিয়ার একটি স্টেট। ১৯১১ পর্যন্ত এটি চীনের চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য মোঙ্গোলিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার অনেকগুলি স্বাধীন রাজ্যকে ‘কলোনাইজ’ করে। তাদের মধ্যে রয়েছে কাজ়াখ়, বুখা়রা, খ়িভ়া, কোকন্দ প্রভৃতি খা়নাত আর তুর্কমেন-কিরগিজ় যাযাবরদের একাধিক গোত্র। এর আগেই অবশ্য ষোড়শ শতকে ইভ়ান দ্য টেরিবলের সময় সাইবেরিয়ার সিবির খা়নাতকে বশ করার মাধ্যমে মস্কোর ছোট্ট স্লাভিক রাজত্বটি রুশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

উপরের দেশগুলি যখন স্বাধীন ছিল, তখন সভ্যদেশে ডাকটিকেটের প্রচলন থাকলেও এরা অনগ্রসর মধ্যযুগীয় রাজ্য হওয়ায় টিকেট ছাড়ত না। তাই রুশ ‘কলোনাইজেশনের’ প্রমাণ হিসাবে সেসব জাহির করতে পারছি না। কাছাকাছি যেটা পড়ে, সেটা এই তুভার স্ট্যাম্প। কলোনাইজেশনের ফর্মুলাটা বলছি। এর সাথে ১৮৩৬এ টেক্সাসের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হবার ফর্মুলার মিল আছে — বেমিলও আছে।

তুভায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই রুশ বণিক, র‍্যাঞ্চার, আর শিকারীরা চিং সাম্রাজ্যের ফরমান নিয়েই আনাগোনা করত। তারা বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফার্ম গড়ে তোলে। শিকারীরা সেখানকার লোমশ জানোয়ার মেরে তাদের ফার নিয়ে বেঁচতো রাশিয়ার বনেদী পরিবারগুলির কাছে।

১৯১১তে চীনের মানুষ চিং সাম্রাজ্যের উপর যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ ছিল। বিদেশীদের কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া ছিল তাদের অসন্তুষ্টির মূল কারণ (বক্সার বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০১)। ফলে চিংদের বিরুদ্ধে শিনহাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়, প্রতিবাদের মুখে ‘বিধবা-সম্রাজ্ঞীর’ হাতের পুতুল ছয়বছরবয়েসী পুত্র সম্রাট পু-য়ী রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেন । পরিশেষে সুন-ইয়াত-সেনের নেতৃত্বে চীনা জাতীয়তাবাদী দল কোমিনতাং প্রভিশনাল প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করে।

ত্রিশ দশকের এই মানচিত্রে তুভার অবস্থান দেখানো হয়েছে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

১৯১১তে চীনের এই দুর্বলতার সুযোগে মোঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এসময় মোঙ্গোলদের মত তুভার জনগণও অনেকটা হাভাতে জীবনযাপন করছিল। একটা কারণ রুশ ফারশিকারীদের অতিশিকারের কারণে তাদের অন্নসংস্থান কমে যাওয়া, তার ওপর অজন্মা খরা। একদল তুভান নেতা চাইলো মোঙ্গোলিয়ার সাথে যোগ দিতে, আরেকদল চাইলো রুশদের ‘প্রোটেকশন’। কারণ মোঙ্গোলদের থেকে তাদের তুর্কীজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন, শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মে দু’জাত মিলে।

রুশ সম্রাট নিকোলাস প্রথমে মনোস্থির করতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত রুশ কলোনিস্ট আর ট্রেডারদের চাপে অজুহাত দাঁড়া করালেন যে তুভায় রুশদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, আর তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাঁর সেনাবাহিনীর। রুশ সেনাদল প্রথমে একটা ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করলো রুশপন্থী তুভানদের, পরে সে প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার অংশ হয়ে গেল।

এখানেই কাহিনী শেষ নয়। ১৯১৭তে রুশ সাম্রাজ্যের বহুদিনের নড়বড়ে ভিত ভেঙে পড়ল বলশেভিক বিপ্লবের আঘাতে। মস্কো-পেত্রোগ্রাদসহ অল্পকিছু শহরে কম্যুনিস্টরা সরকারের দখল নিলেও প্রাদেশিক অঞ্চলগুলি ৎসারপন্থী ‘শ্বেত রুশ’ জেনারেলদের দখলে ছিল। সেসব অঞ্চলে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত স্বাধীন সরকার গঠন করা শুরু করে

সেই রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে ১৯১৮তে তুভা প্রথমে দখল করে এক শ্বেতফৌজ জেনারেল কোলচাক। কিন্তু এক বছর পরেই তুভার দখল চলে যায় চীনা ও মোঙ্গোল সেনাদলের কাছে। কম্যুনিস্ট লালফৌজ ধীরে ধীরে যখন শ্বেতরুশদের হারিয়ে দেয়া শুরু করে, তখন তারা ১৯২১এ তুভায় ঢুকে চীনাদের হটিয়ে দেয়। আর তুভার বলশেভিক কমরেডদেরকে দিয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় — তুভান পিপলস রিপাবলিক

তান্নু-তুভা নামে নতুন ‘স্বাধীন’ দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মোঙ্গোলিয়া। ছোট দেশটি এত সুদূর আর বিচ্ছিন্ন যে তারা স্বাধীন না পরাধীন নাকি পাপেট, তাতে বাকি বিশ্বের কিছু যেত-আসত না। কিন্তু তুভা ডাকটিকেট ইস্যু করত। আর সেগুলিও ছিল নানা রঙের, আর ত্রিভুজ, প্যারালেলোগ্রাম, ডায়মন্ড, ইত্যাদি অদ্ভূত আকারের। তাই যখন বহির্বিশ্বের মানুষের হাতে এসে পড়ত, সবাই তখন আহা-উহু করত

তুভার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কু’লার দোন্দুকের মাথায় স্বাধীন চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া অবশ্য রুশরা থামাতে পারেনি। প্রাক্তন বৌদ্ধ শ্রমণ সেই রাষ্ট্রনায়ক চেষ্টা করেন মোঙ্গোলিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে, আর বৌদ্ধ ধর্ম ও লামাদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। সমাজতান্ত্রিক পলিসিকেও পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করেন তিনি।

১৯২৬এ দোন্দুক বৌদ্ধ ধর্মকে যখন রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তখন স্তালিনের টনক নড়ল। মস্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ তুভান ছাত্রকে দেশে ফেরত পাঠালেন। তারা তুভায় এসে ‘জনসংগ্রাম’ সংগঠিত করতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ১৯২৯এ কু’র মাধ্যমে দোন্দুককে অপসারণ করা হয়। পাঁচ জনে মিলে সোভিয়েত স্টাইল সরকার দাড়া করায়। জোরপূর্বক যৌথখামারব্যবস্থা চালু করে; মোঙ্গোল বর্ণমালা উচ্ছেদ করে প্রথমে লাতিন ও পরে সিরিলিক অক্ষরের ব্যবহার চালু করে ; রুশদের নাগরিকত্বপ্রদান শুরু করে; আর বৌদ্ধ ধর্মের লামা আর প্রাচীন ধর্মের শামানদের জেলে পোরা শুরু করে। ১৯৩২ সালে দোন্দুককে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

উপরের স্ট্যাম্পটি তার পরবর্তী সময়ের। ১৯৩৬ সালের। বাইরের মানুষ যদিও ভাবত এসব ডাকটিকেট তুভা থেকে প্রকাশিত, তারপরও পারতপক্ষে এগুলি তুভার আলোবাতাস আদৌ পেয়েছে কিনা সন্দেহ! কারণ এগুলি প্রিন্ট করা হয়েছে মস্কোর অফিশাল সোভিয়েত প্রেসে! হয়ত কিছু তুভাতে পাঠানো হয়েছে — তুভার মত বিস্তীর্ণ কম জনধ্যুষিত দেশে সেগুলির কি ব্যবহার ছিল স্তালিনই বলতে পারতেন ভাল! কিন্তু বাকি বিশ্বের ফিলাটেলিস্টদের কাছে এসব স্ট্যাম্প বিকোত বেশ, আর তার থেকে দু’পয়সা কামাই করে নিত সোভিয়েতরা (তখনও তারা সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠেনি)।

এ ডাকটিকেটে দেখানো হচ্ছে যে রেলগাড়ির সাথে রেইস দিচ্ছে ব্যাক্ট্রিয়ান ঊট। ভাবখানা এমন যে, তুভায় এতই প্রগতির বন্যা বইছে যে ঊটকে নিজের চাকরি বহাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে!

বাস্তবতা হলো, তুভাতে সে আমলে কোন রেললাইনই ছিল না, আর এই একবিংশ শতকেও নেই!

তুভাকে অবশ্য বেশিদিন এই ড্রামার ভিক্টিম হতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে স্তালিন যখন ১৯৪৪এর অক্টোবরে জার্মান বাহিনীকে সাঁড়াশি অভিযান করে ইউক্রেইন, বেলারুশ, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া থেকে উৎখাত করছেন, আর একে একে এ দেশগুলিকে ‘এসএসআর’ নাম দিয়ে ‘মুক্ত’ করে দিচ্ছেন, আর তারা বেজায় খুশি হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছে, তখন কোন এক সকালে উঠে তুভাবাসী দেখে তারাও কোন ফাঁকে ‘এসএসআর’ নয়, রুশ এসএসআরের ‘ওব্লাস্ত’ (প্রদেশ) হয়ে গেছে! তাদের সংসদ ‘খুরালে’ কোন ভোটাভুটি ছাড়াই রাবারস্ট্যাম্প মেরে রাশিয়ার কাছে যা স্বাধীনতা ছিল — স্ট্যাম্প ইস্যু করার অধিকারসহ — দেশনেতারা বেঁচে দিয়েছে!

আজ তুভা রুশ ফেডারেশনের ৮৫টি ফেডারেল সাবজেক্ট, যার মধ্যে ২২টি রিপাবলিক, তাদের একটি রিপাবলিক। এখনো দেশটি বিচ্ছিন্ন, প্রত্যন্ত। রেললাইন একটা চালু হবার কথা ২০২০ সালে।

তুভানদের সংস্কৃতি, বিশেষ করে মোঙ্গোলদের মত থ্রোট সিঙ্গিং
, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ মনোযোগ কেড়েছে। সেটা শোনার জন্য ইউটিউবে হুন-হুর-তু (Huun Huur Tuu) কিংবা কোঙ্গার-ওল ওন্দার (Kongar-ol Ondar) খুঁজে দেখুন


(১) খা়নাত হলো ‘খা়ন’শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য। এরা মুসলিমও হতে পারে, বৌদ্ধও হতে পারে, শামানও হতে পারে। খা়ন শব্দটি মূলে তুর্কী-মোঙ্গোল, আরবী নয়। চেঙ্গিস খা়ন মুসলিম ছিলেন না! [Khanate]

(২) এখানে অবশ্য পু-য়ীর কাহিনী শেষ না, আবার তাঁকে দেখা যাবে জাপানের পাপেট স্টেট মাঞ্চুরিয়ার নামমাত্র ‘সম্রাট’ হিসাবে! [Henry Puyi]

(৩) বিভিন্ন শ্বেতফৌজ জেনারেলও রাশিয়ার সাম্রাজ্যের কোন না কোন এলাকায় ৎসার নিকোলাসকে রাজা মেনে স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ডাকটিকেট ছাড়ত, সেগুলি বেশ চমকপ্রদ আইটেম! [White Movement]

(৪) মোঙ্গোলিয়াতেও লালফৌজের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় গঠিত হয় কম্যুনিস্ট সরকার। সোভিয়েত রাশিয়া বাদে তাই মোঙ্গোলিয়া একটি মাত্র দেশ যেখান সাত দশক কম্যুনিজম চলেছে। [Mongolian People’s Republic]

(৫) পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানও তান্নু-তুভার পোস্টেজ স্ট্যাম্প দেখে খুবই শখ করেছিলেন সেখানে যাবার। কিন্তু মার্কিনদের জন্যে সোভিয়েতের সুদূর একটি অঞ্চলে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়, বিশেষ করে যখন সোভিয়েতদের পর্যটনশিল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের প্রগতিশীলতা জাহির করা, তুভার মত প্রত্যন্ত পশ্চাদপর সমাজব্যবস্থা দেখালে উল্টোফল। ১৯৮৮ সালে ফেইনম্যানের স্বপ্ন পুরো হবার আগেই তিনি ক্যান্সারে মারা যান। তার ঠিক পরপরই তার তুভা যাবার ভিসা হাজির হয়। [Tuva or Bust!]

(৬)কামাল আতাতুর্কের তুর্কী-আরবী থেকে লাতিনে যাবার মত। খোলস পাল্টে কিছু একটার চেহারা পরিবর্তনই ছিল এসকল ‘রিফর্মার’দের প্রগতিশীলতার উদাহরণ। এতে সামাজিক বাস্তবতার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। [Turkish Alphabet Reform]

(৭) সোভেতস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া রেসপুবলিকা — এ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নামেমাত্র স্বতন্ত্র ১৫টি প্রজাতন্ত্রের গালভরা অফিশাল নাম, সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক। [Republics of the Soviet Union]

(৮) থ্রোট সিঙ্গিং এক অদ্ভূত ‘এলিয়েন’ টাইপের গান, ফুসফুস থেকে গলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা চেম্বারের রেজোন্যান্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে আওয়াজ তুলতে পারলে মনে হয় যে একই মানুষ দুই বা ততোধিক টোনের শব্দ করছে! একে ওভারটোন সিঙ্গিংও বলে। তিব্বতী বৌদ্ধ শ্রমণরাও এভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে। মোঙ্গলদের পাশাপাশি তুভান আর আরো কিছু পূর্ব সাইবেরীয় গোত্রের এ ঐতিহ্য রয়েছে। [Overtone Singing]

(৯) টেড-এক্সের একটা তুভান থ্রোট সিঙ্গিং ভিডিও [Tuvan Throat Singing | Alash | TEDxBaltimore]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!