লাইবেরিয়া – ৫, গৃহযুদ্ধ, ১৯৩০-

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত লাইবেরিয়ার ইতিহাসকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি। ১৯৮০ পর্যন্ত প্রথমভাগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে মার্কিন ও ডাচ বিনিয়োগের ফলে। ফায়ারস্টোন টায়ারের রাবারশিল্প, ডাচ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনা ও লৌহআকরিক উত্তোলনশিল্প, আর মার্কিনদের তৈরি গভীর সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের সুবাদে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসে লাইবেরিয়াতে। সরকারী পয়সায় পশ্চিম আফ্রিকার তথাকথিত ‘সুইজারল্যান্ডের’ প্রচুর যুবক উচ্চশিক্ষার্থে মার্কিনে পাড়ি জমায়।

প্রেসিডেন্ট টাবম্যান ১৯৪৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত দেশশাসন করেন। টাবম্যান চাটুকারপরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করতেন। তার আমলে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়, সবের কৃতিত্ব নিজে দাবি করতেন। মতবিরোধীদের যৎসামান্য কৃতজ্ঞতাবোধও নেই, একথা বলে বেড়াতেন সবার কাছে। তার জন্মদিন পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় ছুটির দিনে। আমেরিকো সেটলার ঐতিহ্যের প্রতীকগুলির ‘পূজো’ তো চলতই।

লাইবেরিয়ার ঊনিশতম প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম টাবম্যান (১৮৯৫-১৯৭১)। রাষ্ট্রপতি ছিলেন ১৯৪৪ থেকে মৃত্যু পর্যন্ত।
ডাচ রাজপরিবারের সাথে প্রেসিডেন্ট টাবম্যান, ১৯৫৫।

মার্কিন সিভিল রাইটস আন্দোলনের জোয়ারে অবশ্য টাবম্যান ১৯৬৪তে ‘ইউনিফিকেশন অ্যাক্ট’ স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। ফলে দেশের যে ৯৮ শতাংশ মানুষ এতদিন ভোটাধিকারবঞ্চিত ছিল, তারা সে অধিকার পায়। ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস, যে দেশ ছেড়ে আমেরিকোদের লাইবেরিয়ায় আসা মুক্তির সন্ধানে, সেদেশের উদাহরণ অনুসরণ করেই সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হয়, স্বাধীনতার একশ’ কুড়ি বছর পর!

১৯৭১এ টাবম্যানের মৃত্যুর পর তার উপরাষ্ট্রপতি টলবার্ট হন প্রেসিডেন্ট। এসময় ভিন্নমুখী পরিবর্তন আসতে শুরু করে লাইবেরিয়াতে। মার্কিনফেরত ছাত্ররা লাইবেরিয়ায় ফিরে চাকরি পেতে বেশ বেগ পায়। কারণ ততদিনে ইকনমির বুম শেষ হয়ে বাস্টের দিকে চলছে। এসকল ছাত্রদের অনেকেই মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী রাজনীতিতে দীক্ষিত হয়।

তাছাড়া আফ্রিকার অন্যান্য অনেক দেশও তখন ঔপনিবেশিকতা থেকে মুক্তি পাচ্ছে। প্রতিবেশী দেশ ঘানার নেতা কওয়ামে ন্ক্রুমা সোভিয়েত সমর্থিত ছিলেন, স্বদেশে তিনি সমাজতন্ত্র আর বিদেশে প্যান-আফ্রিকানিজমের জজবা তোলেন। লাইবেরিয়ার যুবসমাজ সমাজতন্ত্র আসলে কতটুকু বুঝত, তা প্রশ্নবিদ্ধ। কিন্তু দেশের বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্যে মার্কসবাদের বাণীতেই তারা থিওরিটিকাল সমাধান খুঁজে ফেরে।

ষাটের দশকে লগিং ছিল লাইবেরিয়ার বিদেশী বিনিয়োগের অন্যতম শিল্প।
লৌহআকরিক উত্তোলনে লাইবেরিয়া ষাটের দশকে ছিল অগ্রগণ্য একটি দেশ।
সত্তরের দশকে আখমাড়াই করে চিনি প্রস্তুত ও রপ্তানি হত লাইবেরিয়া থেকে।

দু’টি ‘প্রগতিশীল’ সংগঠন গড়ে ওঠে রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্যে। সত্তরের দশকের শেষে চালের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গিয়ে এদের একটির সমর্থকরা মনরোভিয়াতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায়। তাদের প্রতিবাদ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে সত্তরজনের মত মারা যায়।

পুরো দেশে থমথমে একটা অবস্থা বিরাজ করছিল। টলবার্ট ভেবেছিলেন একটা বামপন্থী বিপ্লব হবে আর তার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। যেটা হল, তা বোধহয় কারো আন্দাজে ছিল না। বামপন্থী সংগঠনগুলি স্বজাতির মজলুমদের কথা বললেও গ্রামাঞ্চলে তাদের তেমন কোন প্রভাব ছিল না। শহরকেন্দ্রিক রাজনীতির অঙ্গন থেকে তারা একটা পরাবাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গোত্রীয় উপজাতিগুলিকে বিচার করত। আর লাইবেরিয়ান আর্মির অর্ধশিক্ষিত উপজাতীয় পেটি অফিসার, জওয়ান এদেরকে দীক্ষিত করত প্রগতিশীল চেতনায়। এসকল সেনাসদস্য বেশির ভাগই ছিল ক্রান গোত্রের।

বিদেশী অর্থায়নে মনরোভিয়া আধুনিক রাজধানীতে পরিণত হলেও ১৯৬৯এ এটি ছিল বিশ্বের সবচে কম জনবহুল রাজধানী।
লাইবেরিয়ার প্রেসিডেন্ট টলবার্ট (বামে) জাইর বা বর্তমান ডিআর কংগোর একনায়ক প্রেসিডেন্ট মবুতুর সাথে। এদের মাথায় সিভিল রাইটস আন্দোলনের প্রতীকী টুপি।
১৯৭৩এর মনরোভিয়া।

এই সেনাবাহিনীর একটা দল ১৯৮০র এপ্রিলে দেশের ক্রান্তিলগ্নে রক্তাক্ত একটি ক্যুদেতা করে বসে। প্রেসিডেন্ট টলবার্টকে তার প্রাসাদে হত্যা করা হয়। জনসমক্ষে তার ক্যাবিনেটের তেরজন সদস্যকে মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা করে ফেলে সেনাসদস্যরা। সেটা দেখে স্থানীয় জনগণ আনন্দ-উল্লাস করে। স্যামুয়েল ডো বলে এক মাস্টার সার্জ্যান্ট হয়ে বসেন দেশের রাষ্ট্রপতি। তিনি হন স্থানীয় উপজাতীয় গোত্রগুলো থেকে নিযুক্ত প্রথম রাষ্ট্রপতি।

সংবিধান রহিত করে সামরিক শাসন জারি করেন ডো। বামপন্থী দলগুলির একটিকে নিজের আজ্ঞাবহ রাজনৈতিক দলে পরিণত করলেও আসলে তিনি ছিলেন মার্কিন আর সিআইএর সাথে বেশি ঘনিষ্ঠ। ক্রান উপজাতীয়রা এসময় তার পৃষ্ঠপোষকতায় সরকারী চাকরি থেকে শুরু করে সব জায়গায় অগ্রাধিকার পায়। একটি বিফল ক্যু সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে। ১৯৮৫তে কারচুপির নির্বাচন করে ডো রাষ্ট্রপতির আসনে পাকাপোক্তভাবে বসেন।

লাইবেরিয়াতে ১৯৭৯ সালে চালের দাম নিয়ে রায়টে সত্তরের মত মানুষ পুলিশের গুলিতে মারা যায়।
১৯৮০তে ক্ষমতার দখল করে ক্রান উপজাতীয় সেনানায়ক স্যামুয়েল ডো
যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগনের সামনে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ডো

এরও ফল যা হবার হলো। ১৯৮৯ সালে চার্লস টেইলর বলে আরেক ওয়ারলর্ড অন্যান্য উপজাতির সহায়তায় আইভরি কোস্ট থেকে বিদ্রোহীবাহিনী নিয়ে লাইবেরিয়াতে ঢোকেন। পুরো দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। টেইলর ডো’র সরকারকে হঠাতে সক্ষম হন। ডো’র ভাগ্যও হয় তার পূর্বসূরীর মত। তার নগ্ন মৃতদেহ প্রদর্শিত হয় জনপথে।

টেইলর হয়ে বসেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু যে ‘ক্যান অফ ওয়ার্মস’ একবার খোলা হয়ে গেছে, তা আর বন্ধ করার উপায় নেই। টেইলরের বিরুদ্ধেও দু’তিনটি ভিন্নগোত্রীয় উপজাতি যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৯৭ পর্যন্ত ত্রিমুখী প্রথম যুদ্ধটি চলার পর আবার ১৯৯৯এ শুরু হয় দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। ২০০৩এ চার্লস টেইলর নাইজেরিয়ায় পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। তারপর জাতিসংঘের পীসকিপিং মিশনের মাধ্যমে দেশটিতে শান্তি আসে। সেটা এখনো চলছে।

মনরোভিয়া, ২০০৯
চার্লস টেইলর, আইসিসির ট্রিব্যুনালে বিচারকালে, ২০০৯
২০১৮ সাল পর্যন্ত লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রপতি ছিলেন নোবেল শান্তিজয়ী এলেন জনসন সারলীফ

চৌদ্দ বছরের গৃহযুদ্ধের শুরুতেই যারা দেশটি ছেড়ে প্রথমে ভাগে, তারা হলো আমেরিকো পরিবারগুলি। দেড়শ বছর ধরে নানাভাবে যে দেশটিকে তারা শাসন করে এসেছে, তার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে যেখানে আশ্রয় নেয় তারা, সে তাদের ক্রীতদাস পূর্বপুরুষদের মনিবের ভিটা আমেরিকা! ঈস্ট কোস্টের যেসব প্ল্যান্টেশন থেকে তাদের বাপদাদাদের মুক্তি ও লাইবেরিয়া যাত্রা, ভাগ্যচক্রে সেখানেই তারা ফিরে যায় দেড়শ বছর পর।

আর আমেরিকোরা পেছনে ফেলে রেখে যায় অন্ধকারে নিমজ্জমান একটি দেশ। ষোলটি যুধ্যমান উপজাতি, পনের হাজার শিশুসৈন্য, আড়াই থেকে নয় লাখ মৃত, ষাট থেকে নব্বই শতাংশ নারী জনসংখ্যা ধর্ষিত — এসব পরিসংখ্যান দিয়ে ঢাকা পড়ে যায় আমেরিকো ক্রীতদাসবংশধরদের অত্যাচারের কাহিনী, স্বজাতিকে অধিকারবঞ্চিত করার ইতিহাস, আর গণতান্ত্রিক প্রথার আড়ালে-আবডালে ক্ষমতালিপ্সা আর দুর্নীতির খেলা।

তাদের এই অধঃপতনের পেছনে কোন পশ্চিমা সরকার, কোন ঔপনিবেশিক শক্তির তেমন কোন হাত ছিল না। পুরো দেড়শ বছর ধরে মু্ক্ত দাসের বংশধররাই স্বাধীন দেশে নিজেদের পতন ডেকে এনেছে একটু একটু করে।

লাইবেরিয়া – ১, শুরুর কথা, ১৮০০-১৮২০

জালিম ও মজলুমের কোন গাত্রবর্ণ নাই, জাতপাত নাই। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে সামাজিক ঠিকই, কিন্তু কেবলমাত্র প্রাকৃতিক কিংবা কৃত্রিমভাবে তৈরি নিজস্ব আইডেন্টিটি গ্রুপের মধ্যে। পারিপার্শ্বিকতা ও প্রয়োজন তৈরি করে দেয় তার এই পরিচয়।
আফ্রিকার মানচিত্রে লাইবেরিয়ার স্থান
লাইবেরিয়ার পতাকার অনুপ্রেরণা মার্কিন পতাকা
এ কথাগুলি মনে এল লাইবেরিয়া দেশটির কথা চিন্তা করে। ছোট করে শুরুতে বলি, ঊনবিংশ শতকে মার্কিন থেকে আগত মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাস ও দাসদের বংশধরদের আবাসস্থল হিসাবে দেশটির যাত্রা শুরু। তাদের শাসনতন্ত্র প্রায় হুবহু মার্কিন শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে লেখা, তিনটি প্রশাসনিক বিভাগ, মতপ্রকাশের-ধর্মপালনের স্বাধীনতা, ইত্যাদি।

আর গোড়াপত্তনের দেড়শ বছরের মাথায় লাইবেরিয়াতে হয়ে যায় দু’-দু’টি গৃহযুদ্ধ। ষোলটি জাতিগোষ্ঠী চিন্তাতীত নির্মমতার সাথে একে-অপরের ওপর চড়াও হয়। লাইবেরিয়ার যুদ্ধের খবর ঘাঁটালেই হত্যা-ধর্ষণের পাশাপাশি চোখে পড়বে চাইল্ড সোলজার, ব্লাড ডায়মন্ড, ইত্যাদি হেডলাইন। ১৯৮৯ থেকে শুরু করে ২০০৩ পর্যন্ত বিরতি দিয়ে দিয়ে গৃহযুদ্ধ হয়, আর তাতে প্রাণ হারায় নয় লাখেরও বেশি মানুষ। ২০০৩এ বেশ কিছু বাংলাদেশী সেনাসদস্যও সেদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেয়, সেটা ছিল এযাবত জাতিসংঘের সর্ববৃহৎ শান্তিরক্ষা মিশন। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রিপ্রাপ্ত চার্লস টেইলর নামক এক লাইবেরিয়ান ওয়ারলর্ড ও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হন হেগের আন্তর্জাতিক কোর্টে বিচারপ্রাপ্ত প্রথম কোন প্রাক্তন রাষ্ট্রনেতা।

কেন কিভাবে এ অধঃপতন তার কাহিনীই লিখতে বসেছি।

লাইবেরিয়ার স্বাধীনতাঘোষণার প্রাক্কালে কনস্টিটিউশনাল কনভেনশনে স্পষ্টভাবে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকদের আসল পরিচয় যে মার্কিন, তা উল্লেখ করা হয় (১৮৪৭)।
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার
লাইবেরিয়ান গৃহযুদ্ধের চাইল্ড সোলজার

লাইবেরিয়া কনসেপ্টটার যাত্রাশুরু ১৮১০এর দশকে। ইংরেজ ও মার্কিনরা আন্তর্জাতিক দাসবাণিজ্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ১৮০৭ সালে। যেসকল কৃষ্ণাঙ্গ ইতিমধ্যে দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ক্রীতদাস, তাদের মুক্তি আসে আরো পরে। কিন্তু উত্তরে তখন যথেষ্ট মুক্তিপ্রাপ্ত ও শিক্ষিত কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের বসবাস। সেসময় মিসৌরী নদী থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত যে প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন জনসংখ্যা, তাদের প্রায় ১.৭৫ মিলিয়ন কৃষ্ণাঙ্গ, আর এদের প্রায় ২৩০,০০০, অর্থাৎ ১৩ শতাংশ, মুক্ত মানুষ। এদের অনেকে ‘মুলাটো’ বা মিশ্রজাত। কারো বাবা কৃষ্ণাঙ্গ দাস, তো মা শ্বেতাঙ্গ আইরিশ ইনডেঞ্চারড সারভ্যান্ট — যার স্টেটাস ক্রীতদাসের থেকে এমন একটা উঁচুতে নয়। ১৮০০ শতকের শুরুতে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গরা ছিল আমেরিকার ফাস্টেস্ট গ্রোয়িং ডেমোগ্রাফি।

মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অনেকে ব্যবসাবাণিজ্যে সাফল্য পায়। এদের অনেকেই ছিল শিক্ষিত, কর্মঠ, অন্টরপ্রনরশিপে বিশ্বাসী, এমনকি অ্যাডাম স্মিথপড়া পুঁজিবাদী লোক। পল কাফি বলে এদের একজন, কৃষ্ণাঙ্গ তিমিশিকারী বণিক তিনি, ঠিক করেন যে কৃষ্ণাঙ্গদের আফ্রিকায় পুনর্বাসিত হওয়াটাই সমীচীন। সে লক্ষ্যে একটি জাহাজে করে প্রায় আশিজন মুক্তমানুষ পরিবারসহ আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে এসে হাজির হয়। সিয়েরা লিওন ছিল ব্রিটিশ কলোনি, এবং ব্রিটিশরা এর গোড়াপত্তনই করে ব্রিটেনের মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের স্বেচ্ছাপুনর্বাসনের স্থান হিসাবে।

পল কাফি, ১৭৫৯-১৮১৭
নিউ ইয়র্কের কলোনাইজেশন সোসাইটির মেম্বারশিপ সার্টিফিকেট, ১৮৩৭

কাফির চিন্তাটা অবশ্য নতুন নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদাররাও ভেবেছিলেন, মালিকদের মৃত্যুর পর যেসকল ক্রীতদাস মুক্তি পাচ্ছে, কিংবা নিজেদের উপার্জনের মাধ্যমে স্বাধীনতা কিনে নিচ্ছে, তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেয়াটাই উত্তম। আমেরিকায় যদি তারা থেকে যায়, তাহলে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ দু’জাতের মধ্যে অত্যাচার ও অপব্যবহারের যে সম্পর্কের শত বছরের ইতিহাস, সেটা ফিরে ফিরে এসে রাষ্ট্রীয় সমস্যা তৈরি করবে। তাছাড়াও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকাংশ সহায়-সম্বলহীন হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে যে তারা আবার ক্রীতদাসে পরিণত হবে না, তারও গ্যারান্টি নেই।

জেফারসন-মনরো প্রমুখ গোপনে এ ব্যাপারে কথাবার্তা চালান, তাদের ইচ্ছে ছিল কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে কলোনিস্থাপনের। সেটা আমেরিকার নতুন ওহাইয়ো টেরিটরিতেও হতে পারে, কিংবা লাতিন আমেরিকা নতুবা আফ্রিকাতেও। এমনকি লিংকনও মধ্য আমেরিকা কিংবা হাইতিতে কৃষ্ণাঙ্গপুনর্বাসনের চিন্তা করেন। কিন্তু তাদের এসকল আইডিয়া নিয়ে বেশিদূর না আগানোর কারণ, ঐ ‘কলোনি’ শব্দটা! মার্কিনরা হবে কিনা তাদের প্রাক্তন মালিক ব্রিটেনের মত সাম্রাজ্যবাদী! এ ব্যাপারটা সে আমলে কারোরই মনঃপূত হয়নি।

এ অবস্থার একটা সুরাহা হয় আমেরিকান কলোনাইজেশন সোসাইটি (এসিএস) নামে একটি দাতব্য সংস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। সাদার্ন স্টেটগুলির কিছু নামীদামী ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় এটি শুরু হয়। এদের কারো কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি সত্যিকার সহানুভূতি, আবার কারো কারো জাতিগত মিশ্রণ নিয়ে অ্যালার্জি থাকায় তারা চান কৃষ্ণাঙ্গরা ‘ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাক!’

যে উদ্দেশ্যেই এসিএসের যাত্রা শুরু হোক না কেন, বেশ কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ আইডিয়াটা গ্রহণ করে নেয়।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!