লাইবেরিয়া – ৪, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, ১৮৬০-১৯৩০

১৮৬০/৭০এর দশকের মধ্যে লাইবেরিয়ার সমাজ স্পষ্টত কয়েকটি স্তরে বিভক্ত হয়ে যায়। সবার ওপরে পলিটিকাল এলিট — যারা রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রীসভা, সেনেট, সরকারী কর্মকর্তা, গভর্নর, পুলিশপ্রধান প্রভৃতি উচ্চপদে গদ্দিনশীন। এরা নিজেদের মধ্যে বিয়েশাদী করে একটা আলাদা শাসকশ্রেণী তৈরি করে ফেলেছে।

মাঝের স্তরে এদের শাসনক্ষমতাকে খুঁটি দিতে দাঁড়িয়ে যায় ইন্টেলেকচুয়াল ও মার্ক্যান্টাইল এলিট — অনেকে স্থানীয় আফ্রিকান গোত্র থেকে আসা ‘ওয়ার্ড’, যারা পশ্চিমা সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থাকে হিতকর হিসাবে গ্রহণ করে নেয়। বণিকদের অনেকেই রাজনীতিতে অংশ নিয়ে সফল হয়। আর এদের নিচের লেভেলে থাকে পরে আসা সম্বলহীন রিক্যাপচার্ড স্লেভ আর ক্যারিবিয়ান অভিবাসী। এদের অনেকে গ্রামাঞ্চলে পাড়ি জমায় অধিক সুযোগসুবিধার সন্ধানে।

আর সবার নিচে স্থানীয় গোত্রভিত্তিক উপজাতীয় জনসাধারণ। অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, কৃষিজীবী, শ্রমজীবী, এরা সবাই ওপরওয়ালাদের মেজাজমর্জির অধীন। লাইবেরিয়ার পঁচানব্বই শতাংশ এরাই। এদের বসতি আভ্যন্তরীণ ‘টেরিটোরিগুলোতে’। সরাসরি ভোটাধিকার এদের ছিল না। তাদের হয়ে আমেরিকো সরকারের শাসনব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্ব করত রাজা আর গোত্রপতিরা। এ অনেকটা আপার্টহাইড সাউথ আফ্রিকার ‘স্বাধীন’ ব্ল্যাক হোমল্যান্ডের মত ব্যবস্থা।

এমন বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতিবাদ যে হয়নি তা নয়। ১৮৭০এর দশকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি রো সংস্কারের প্রচেষ্টা চালান। কিন্তু মতবিরোধ বাঁধে অভিজাত সেনেটরদের সাথে। তার ওপর ইংল্যান্ড থেকে উন্নয়নের নামে কঠিন শর্তে ঋণ নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েন রো আর তার দলবল। তার জের ধরে প্রেসিডেনশিয়াল টার্ম লিমিট নিয়ে বিরোধীদের সাথে গোলমাল বেঁধে যায়। গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবার মত অবস্থা দাঁড়ায়, শেষপর্যন্ত সেনেট ভোট নিয়ে রোকে সরিয়ে দেয়। ঘটনাচক্রে তাঁর মৃত্যুও ঘটে। অবসান হয় সংস্কার প্রচেষ্টার। সব ফিরে যায় আগের অবস্থায়।

আমেরিকার উত্তরপশ্চিমে লিউয়িস-ক্লার্ক অভিযানের মত লাইবেরিয়ান অভিযাত্রীদল ১৮৬০এর দশকে দেশের অভ্যন্তরে পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে মান্দিঙ্গো গোত্রের কিছু উন্নত শহরের সন্ধান পায়। মধ্যযুগের মুসলিম সংহাই সাম্রাজ্যের এসকল উত্তরসূরীদের সাথে সোনা ও হাতির দাঁতের বাণিজ্য শুরু হয়। লোহার খনিও আবিষ্কৃত হয়। এ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল অবশ্য লাইবেরিয়ার হয়ে আরও ভূমির রাষ্ট্রীয় মালিকানা দাবি করা। কিন্তু এসব অঞ্চল পরবর্তীতে ফরাসী আগ্রাসনের কবলে পড়ে আইভরি কোস্ট আর গিনির অংশ হয়ে যায়। এসময় লাইবেরিয়ার মূল মিত্র ছিল ব্রিটেন।

এসব বাজে অভিজ্ঞতা থেকে দেশের প্রতিরক্ষার জন্যে ১৯১০এর দশকে একটা ফ্রন্টিয়ার ফোর্স তৈরি করা হয়। তাদের প্রশিক্ষণের জন্যে মার্কিন থেকে আসেন কৃষ্ণাঙ্গ এক ক্যাপ্টেন। দাসের সন্তান এই অফিসার অবশ্য লাইবেরিয়ার ঘাপলাগুলি ঠিকই ধরে ফেলেন! যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাবার পর তিনি রিপোর্টে লেখেন যে, লাইবেরিয়ার বৈষম্যমূলক সমাজকে পরিবর্তন করতে হলে বাইরের হস্তক্ষেপ জরুরী।

নতুন তৈরি ফ্রন্টিয়ার ফোর্স শাসকশ্রেণীর স্বার্থোদ্ধারের অস্ত্রে পরিণত হতে বেশি সময় লাগে না। ১৯২৭ সালে অনুষ্ঠিত লাইবেরিয়ার নির্বাচনে যে কারচুপি হয়, তা গিনেস বুকে এখনো রেকর্ডধারী। একদলীয় শাসনের দুর্নীতি, সরকারী ক্ষমতার অপব্যবহার, ইত্যাদি নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। লাইবেরিয়ার নতুন রাষ্ট্রপতি চার্লস কিং নিজের একটা কাল্ট ইমেজ দাঁড়া করান। তিনি লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রীয় আদর্শকে কৃষ্ণাঙ্গ জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তি থেকে দূরে সরিয়ে লাইবেরিয়ার রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদে নিয়ে যান। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের নিয়মিত বিলাসবহুল ভোঁজে নিমন্ত্রণ করে আন্তর্জাতিক সম্মাননা জোগাড় করা ছিল তাঁর কাজ। এসবের খরচপাতির টাকা অবশ্য আসত ধার করা পয়সায়।

চার্লস ডি.বি. কিং (১৮৭৫-১৯৬১), লাইবেরিয়ার ১৭তম রাষ্ট্রপতি, ১৯২০-৩০।
লাইবেরিয়ার ডাকটিকেট রাষ্ট্রপতি চার্লস কিংয়ের ছবি, ১৯২৩।

সরকারী আয়ের আরেকটা উৎস ছিল আন্তর্জাতিক আদমপাচার ব্যবসা! পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলে ফার্নান্দো পো দ্বীপটি ছিল স্প্যানিশ কলোনি। ত্রিশের দশকে সেখানে কোকা প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে। কিন্তু স্প্যানিশরা দ্বীপটির স্বল্প সংখ্যক আদিবাসীদের চেষ্টা করেও সেসব খামারে কাজে লাগাতে পারেনি। তারা শ্রমিক খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় লাইবেরিয়াতে।

লাইবেরিয়ার নিজেরই গতরখাঁটা শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। তাই সরকার নিয়ম করে দেয় যে জনপ্রতি সরকারকে পাঁচ ডলার করে দিলে আর দেড়শ ডলার করে বন্ধক রাখলে ফার্নান্দো পোতে শ্রমিক পাঠানো যাবে। আর তার ওপর থাকবে সরকারী নজরদারি।

পরিবার ও দেহরক্ষীসহ প্রেসিডেন্ট কিং, নেদারল্যান্ডের হেগের পীস প্যালেসের সামনে, ১৯২৭। ঘটনাচক্রে এখানেই আইসিসির কোর্টে ঠিক পঁচাশি বছর পরে লাইবেরিয়ার আরেক রাষ্ট্রপতি চার্লস টেইলরের বিচার হয় যুদ্ধাপরাধের দায়ে।
ফার্নান্দো পোয়ের কোকা খামারে বিদেশী শ্রমিক, সম্ভবত লাইবেরিয়া থেকে আগত, ১৯২০এর দশক।

সে ভাল কথা। কিন্তু ১৯২৯ সালে লাইবেরিয়ার এক প্রাক্তন রাজনীতিবিদ মার্কিনে এসে বিশাল এক গুমোর ফাঁস করে দেন! তিনি অভিযোগ করেন যে লাইবেরিয়ার আমেরিকো সরকার স্থানীয় গোত্রের মানুষদের নিয়ে আধুনিক দাসব্যবসা ফেঁদে বসেছে! তার অভিযোগের ভিত্তিতে লীগ অফ নেশনস তদন্ত কমিটি পাঠায় লাইবেরিয়াতে।

তদন্তের রিপোর্টে যা বেরুল, তাতে লাইবেরিয়ার শত বছরের দাসপ্রথাবিরোধী মানসম্মান সব ধূলোয় লুটিয়ে গেল। কমিটিতে ব্রিটিশ, মার্কিন ও লাইবেরিয়ান তদন্তকারী ছিলেন। তারা বের করেন যে, লাইবেরিয়ার কমপক্ষে তিনটি কাউন্টির গভর্নর ও সরকারী কর্মকর্তা ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ব্যবহার করেছে স্থানীয় রাজা ও গোত্রপতিদের ওপর অত্যাচার ও জবরদস্তি করে শ্রমিক বাগানোর জন্য। এসব কাজে জড়িত এক প্রাক্তন কর্মকর্তা আবার বর্তমানের ভাইস প্রেসিডেন্ট ইয়ান্সি। শ্রমিক সরবরাহ থেকে সরকারের যে পয়সা পাবার কথা, সেটাও মাঝখান দিয়ে লোপাট করেছে এরা!

কোকা বীন বহন করছে লাইবেরিয়ার দাসশ্রমিক, ১৯২০এর দশক।
ফার্নান্দো পোয়ের ১৯২৯এর ডাকটিকেটে স্পেনের রাজা আলফন্সোর ছবি।

এসব আধুনিক যুগের ‘দাসদের’ তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, সারি বেঁধে জাহাজে গাদাগাদি করে ওঠানো হয়। ফার্নান্দো পোতে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রায় বিনা মজুরীতে, যৎসামান্য খাবারে, দিনে বারো ঘন্টা করে কাজ করতে হত এসব শ্রমিকদের। কথা না শুনলে চাবুকপেটা আর জিঞ্জিরে বন্দী করে রাখত কোকাখামারের ফোরম্যানরা। আরো সব শারীরিক নির্যাতন পোহাতে হত এসকল ‘দাসদের’। ঠিক এমনটাই আমেরিকো-লাইবেরিয়ান এলিটদের পূর্বপুরুষকে ভোগ করতে হয়েছে মার্কিন শ্বেতাঙ্গ মনিবের হাতে!

লীগ অফ নেশনস কড়া কড়া সব শর্ত দেয় লাইবেরিয়ার সরকারকে। লাইবেরিয়ার সাধারণ মধ্যবিত্ত এ খবরে যারপরনাই হতবাক হয়ে যায়। এ কিনা তাদের ‘কৃষ্ণাঙ্গ প্রাক্তন দাসদের’ রিপাবলিক! প্রেসিডেন্ট কিং করেন পদত্যাগ। ফোর্সড লেবারসংক্রান্ত আদেশজারি হয়। কিন্তু এই স্ক্যান্ডালে জড়িত বেশির ভাগের পলিটিকাল কানেকশন থাকায় তারা সাজা ছাড়াই পার পেয়ে যায়। কিং ষাটের দশকে পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বপালন করেন।

লীগ অফ নেশন্সের লাইবেরিয়ার দাসপ্রথাসংক্রান্ত রিপোর্টের মুখবন্ধ, ১৯৩০
সেপ্টেম্বর ১৯৩০এ জাতিসংঘের রিপোর্ট বেরুনোর পর, অক্টোবরে রাষ্ট্রপতি কিং আদেশবলে কন্ট্রাক্ট লেবার নিষিদ্ধ করেন। পদত্যাগ করেন ডিসেম্বরে।

কাগজে কলমে লীগ অফ নেশনসের সুপারিশ বাস্তবায়ন করে সে যাত্রা লীগের অধীন ম্যান্ডেট টেরিটরি হওয়া থেকে বেঁচে যায় লাইবেরিয়া। লাইবেরিয়ার সুধীসমাজ ছি ছি করলেও এরা দায়ী শত বছরের এই বৈষম্যমূলক সমাজকে জিইয়ে রাখার জন্যে। একদলীয় শাসনের অবক্ষয় ও দুর্নীতির ঐতিহ্য মূলত তাদেরই চোখ বুঁজে থাকার ফল।

এসব আন্তর্জাতিক স্ক্যান্ডালের মাঝে দূরদেশের দ্বীপে বন্দী স্বামী-বাবা-ভাই-ছেলেকে হারিয়ে শোকাহত, বিপর্যস্ত ওয়েদাবো উপজাতীয় কৃষ্ণাঙ্গিনীরা বাঁধে নিচের মত গান — তারা এ গান গাইতে থাকবে আরো পঞ্চাশ-ষাট বছর, আর শিখিয়ে যাবে পরবর্তী প্রজন্মকে।

“He [Yancy] caught our husbands and brothers,
Sail them to ‘Nana Poo [Fernando Poo]
And there they die!
And there they die!
Tell us,
Yancy, why?
Yancy, why?
Wedabo women have no husbands,
Yancy, why?
Wedabo women have no brothers,
Yancy, why?
Mothers, fathers, sons have died,
Waiting for the return.
Yancy, why?”

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!