চীনের আপৎকালে যুক্তরাষ্ট্র


ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রাক-আধুনিক যুগের বহু সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল করুণ। ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য, পশ্চিম এশিয়ায় ইরানী আব্বাসী সাম্রাজ্য, চীনের চিং, ভারতের মুঘল — এরা সকলেই ইউরোপীয়, মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী, অস্ট্রোহাঙেরীয়, রুশ, কিংবা জাপানী আগ্রাসনের সম্মুখীন। আফ্রিকার পুরনো রাজ্যগুলিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তাদের ভাগাভাগি করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করছে ব্রিটিশ-ফরাসী-জার্মানরা। ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পেনীয়রাও দ্বিতীয় কাতারে।

ফরাসী পত্রিকা ল্য পতি জু্র্নালে চীন ভাগাভাগির কার্টুন, ১৮৯৮

একটা ব্যাপার মাথায় এল যে, মুঘল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূল সুবিধাভোগী হল ব্রিটিশরা। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে অস্ট্রীয়, ব্রিটিশ ও রুশ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা পেল কিংবা বিচ্ছিন্ন হল গ্রীস, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি। কিন্তু চীনের ভাগ্য কেন এমন টুকরোটুকরো হল না? ইউরোপীয় ও জাপানীদের চীন নামের কেক কেটে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কার্টুন তো সে সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু আসলে তো তা হয়নি।

হ্যাঁ, হংকং ও মাকাউ ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। চীনের বিভিন্ন বন্দরে পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীদের বিশেষ সুবিধা ছিল। শাংহাইয়ে ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট। ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের মত এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের মত ফরেন কলোনাইজেশনের সম্মুখীন হয়নি চীন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ তুরস্ক ও অস্ট্রোহাঙেরি যেভাবে বিভক্ত হয়ে “ডিকলোনাইজেশন”ধাঁচের ব্রেকআপের মাধ্যমে নতুন কিছু দেশের জন্ম দিয়েছিল, সেরকম ভাগ্যও চীনের হয়নি। যদিও সেটিও মূলে মাল্টিএথনিক এম্পায়ার রুলড বাই আ মাইনরিটি পীপল। হংকং-মাকাউয়ের মত কলোনি পর্তুগীজদের গোয়া-দমন-দিউ কিংবা ব্রিটিশদের ফোর্ট উইলিয়ামের থেকে তেমন কিছু বেশি ছিল না। বাকি চীনের আয়তনের তুলনায় এ সকল উপনিবেশ নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

তবে ফোর্ট উইলিয়াম যেমন ব্রিটিশ বেঙ্গলের ভবিষ্যতের দিকেই নির্দেশ করছিল, চিং শাসনামলের এক পর্যায়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সেইরকম শেষ পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল চীন। সে থেকে ঘটনাচক্রে তারা রক্ষা পায় এক উঠতি স্থানীয় পরাশক্তির কারণে। সে পরাশক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র!

এ বলছি না যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল শুভানুধ্যায়ী হিসাবে চীনের পাশে এসে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়ায়। সেটা অবশ্যই একটা লেভেলে ছিল। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারের “নিকট” প্রতিবেশী হিসাবে চীনের ভাগ্য নিয়ে কিংবা চীনে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে মার্কিনদের মাথাব্যথা আর সক্ষমতা দুটোই যথেষ্ট ছিল, যেটা তুরস্ক কিংবা ভারতের বেলায় অতটা ছিল না। ইউরোপীয় ও জাপানীদের ওজনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা দাঁড়িপাল্লায় বিশাল এক ব্যালেন্স হিসাবে কাজ করে।

একটু ব্যাখ্যা করে বলি চীনকে সম্পূর্ণ উপনিবেশায়নের হাত থেকে কিভাবে একার্থে মার্কিনরা রক্ষা করে।

চীনের সাথে ইউরোপীয়দের সরাসরি বাণিজ্য শুরুর অনেক পরে মার্কিনদের আবির্ভাব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুয়েকটা সরকারী মিশন সরাসরি যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা চীনে আফিমের ব্যবসায় বেশি জড়িত ছিল। ব্রিটিশরা যেখানে ভারত থেকে একচেটিয়া আফিম রপ্তানী করত, সেখানে মার্কিনরা পারস্য থেকে কিনে সে বস্তু চীনে বিক্রি করত। চীনে এ বাণিজ্যের সিংহভাগ অবশ্য ছিল ব্রিটিশদের হাতে।

চীনে স্থানীয় পোশাকপরিহিত মার্কিন মিশনারি, ঊনবিংশ শতক

এর পাশাপাশি মার্কিন মিশনারিদের আনাগোনা হতে শুরু করে চীনে। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের জনগণের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে তারা। মিশনারিদের অনেকে এখনো খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। আমি, আমার পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষিত হয়েছি ক্যাথলিকপরিচালিত স্কুল বা কলেজে। ধর্মপ্রচারণার বিন্দুমাত্র অন্তত আমি দেখিনি। চীনের কিছু সাধারণ মানুষও মিশনারিদের শিক্ষার সে সুফল ভোগ করে।

আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর চিং সাম্রাজ্যকে অনেক ছাড় দিতে হয় ব্রিটিশদের কাছে। বাণিজ্যে তারা পায় মোস্ট ফেভারড নেশনের সম্মান। পাঁচটি বন্দরে মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা পায়। এর আগে সরকারীভাবে চীনের অভ্যন্তরের সাথে সরাসরি বাণিজ্য ছিল নিষিদ্ধ, তবে চোরাকারবারী ঠিকই চলত। ব্রিটিশরা এই লাভজনক সরকারী সুবিধাটি পাওয়ার কারণে ‌অন্যান্য বাণিজ্যিক শক্তিরাও একই ন্যায্য দাবি নিয়ে চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠায়। সামরিক হুমকি দিয়ে হোক, উপঢৌকনের বিনিময়ে হোক, সে দাবি আদায় করে নেয় ফরাসী, রুশ, জাপানী, ও অন্যান্য দেশ। সাথে মার্কিনরাও।

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় রেললাইন তৈরিতে নিযুক্ত চীনা শ্রমিক, ঊনবিংশ শতক

মার্কিন বণিকরা যখন চীনা বন্দরে ব্যবসারত, তখন চীনা শ্রমিকদেরও আগমন হতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়াসহ অন্যান্য মার্কিন টেরিটরিতে। প্যাসিফিক রেলওয়ে লাইনে কাজ করে অনেকে, আবার নতুন আবিষ্কৃত স্বর্ণখনিতেও। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি চীনা আসে যে অনেক মার্কিন নাগরিক চীনাবিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে চীনা শ্রমিকদের প্রবেশ কয়েক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তারপরও এখনো সান ফ্রান্সিস্কোতে অনেক পরিবারের দেখা মিলবে যারা সেই চীনাবংশোদ্ভূত।

শুধু যে শ্রমিকের আগমন হয় তা নয়। ১৮৫০ ও ১৮৬০এর দশকে তাইপিং নামে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ হয় চীনে। চিং সাম্রাজ্য ছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। মার্কিন ও ইউরোপীয়দের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সহযোগিতায় সে যাত্রা বেঁচে যায় হান জনগোষ্ঠীর ওপর শাসনরত বহিরাগত মাঞ্চুরিয়ান রাজপরিবার। এর পর তাদের উপলব্ধি হয় যে পশ্চিমা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ না পেলে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। চায়নিজ এডুকেশন মিশন নামে একটি প্রজেক্টে দেড়শ’র মত টীনেজ বয়েসী চীনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসে। এসব সাংস্কৃতিক লেনদেনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন আদিতে চীনে বাণিজ্যকরা মার্কিন ব্যবসায়ীরা আর তদকালীন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

কানেকটিকাটে চায়নিজ এডুকেশন মিশনের চীনা ছাত্রদের বেসবল টীম, ১৮৭৮
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চিং সম্রাটের রাষ্ট্রদূত লিয়াং চেং, চায়নিজ এডুকেশন মিশনে শিক্ষিত, বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ডের প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন, বিংশ শতকের প্রথমভাগ

চায়নিজ এডুকেশন মিশনে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, এদের অধিকাংশ আর ফিরে যায়নি। চিং সম্রাট এদের পাঠালেও সম্রাটের হর্তাকর্তাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলই। এরা তাইপিং বিদ্রোহের জন্যে তাইপিং নেতার পশ্চিমা মিশনারি শিক্ষা, আর তার খ্রীষ্টান সিনক্রেটিক ধর্মকে দোষারোপ করে। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনাবিদ্বেষী মনোভাব থেকে ইমিগ্রেশনের ওপর কড়াকড়ি হবার কারণেও চায়নিজ এডুকেশন মিশন বন্ধ করার একটা চাপ আসে। ছাত্ররা বেশি বেশি পশ্চিমা ও “বিলাসী” হয়ে যাচ্ছে এমন জজবা তোলা হয়। তবে এদের মধ্যে যারা ফিরে গেছিল, তাদের অনেকেই চীনে পজিটিভ একটা অবদান রাখে। প্রজাতন্ত্রী চীনের একাধিক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রনেতা ছিলেন মার্কিনশিক্ষিত। সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে নারীদের পা-বাঁধার কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও আমাদের দেশের বিদ্যাসাগরের মত ভূমিকা রাখেন এসকল মার্কিনশিক্ষিত চীনারা।

১৯০৫এ কোরিয়ায় মোতায়েন জাপানী সৈন্য, লক্ষ্য করুন পশ্চিমা পোশাক ও অস্ত্রসজ্জা

জাপান সাগরের অপর পারে কিন্তু চলছিল চিংদের সংস্কারবিমুখতার বিপরীত চিত্র। জাপানীরা খুব দ্রুত পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পাশ্চাত্যদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। নইলে তারা ১৮৫০এর দশক নাগাদ চীনের মতই বন্ধ দেশ ছিল। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও কম্পানিকেও পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখে তারা নিজেদের আখেরটা গুছিয়ে নেয়। খুব দ্রুত একটা রাজনৈতিক ও শিল্পসংস্কার ঘটে যায় সে দেশে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয় জাপান।

পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চীনে “অধিকার আদায়ের” প্রতিযোগিতায় শামিল হয় জাপানও। নানা ছুঁতোয় কোরিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুদ্ধ হয় জাপানের। সেটা ১৮৯৪/৯৫ সাল। পরাজিত চীন কোরিয়ায় জাপানের অধিকার মেনে নেয়, সাথে আরো কিছু সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়।

কাঁচি দিয়ে চীনের মানচিত্র কাটতে উদ্যত জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স। মাঝখানে ওপেন ডোর পলিসির কাগজ হাতে বাগড়া বেঁধে দাঁড়িয়েছে আংকল স্যাম, পাক ম্যাগাজিন, ১৮৯৯

এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অবতীর্ণ হয় চীনের অখন্ডতা রক্ষায়। চীনের এই দুর্বল অবস্থার সুযোগে মুখিয়ে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, জাপানী, রুশ সকলে। ল্য পতি জু্র্নাল নামের ম্যাগাজিনে তখনই সেই কেক কাটার কার্টুন প্রকাশিত হয়। এ সকল পরাশক্তি চীনকে টুকরো টুকরো করে যার যার নিজের “স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স” বানানোর স্বপ্নে গোপনে এক অন্যের সাথে মোলাকাত করতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকার মত বড় একটা ভূখন্ড নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন ডোর পলিসি নিয়ে ব্রিটিশ কার্টুন যে রুশ ভল্লুক ভদ্রভাবে মার্কিন ফ্রী ট্রেড লেডিকে চীনের ওপেন ডোর দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেবে (সার্কাজম অর্থে!), ১৮৯৯ পাঞ্চ ম্যাগাজিন

কিন্তু বাদ সাঁধে মার্কিনরা। তাদের নীতি ছিল “ওপেন ডোর পলিসি।” সে নীতি অনুযায়ী চীনে মুক্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল দেশ সমান অধিকার ভোগ করবে। চীনের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অখন্ডতা বজিয়ে থাকবে। বাণিজ্যকর আদায়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণ চিং সরকারের। বাংলায় ব্রিটিশরা যেমন মুঘল সম্রাটকে ঘুষ দিয়ে সে লাভজনক দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছিল, সেটি হবে না। অন্যান্য পরাশক্তি মার্কিনদের এই ওপেন ডোর পলিসির সাথে একমত না হলেও নতুন পরাশক্তিটির ভৌগোলিক নিকটতা আর সামরিক শক্তির ভয়ে চুপচাপ সেটা মেনে নেয়। সে যাত্রা বেঁচে যায় চীন।

জাপানের সাথে যুদ্ধে হারার পর আবার একটা বোধোদয় ঘটে চীনের নেতৃত্বের মধ্যে। তরুণ সম্রাট গুয়াংশু রাজ্যের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একটি ছোট দল নিয়ে নতুন করে একটি সংস্কার আন্দোলন দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি! একশ’ দিনের মাথায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল আমলা ও সেনানায়করা বিধবা রাণীমাতা সিশিএর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থীদের ক্যুয়ের মাধ্যমে পদচ্যুত করে। অনেক বুদ্ধিজীবী নিহত হন, গুয়াংশু হন প্যালেস প্রিজনার। আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যায় চীন।

চীনের অশীতিপর বৃদ্ধা বিধবা রাণীমাতা সিশি, চীনের সকল আধুনিকায়ন ও সংস্কার রহিত করেন, বক্সারদের উস্কানি দেন, ফলশ্রুতিতে চিং সাম্রাজ্যের শেষ ঘন্টা বেজে ওঠে, ১৯০০

প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ আর বিদেশীবিদ্বেষ। শহরে শহরে গড়ে ওঠে কুংফুএর মুগুরভাঁজা “বক্সার” ষন্ডাদের ক্লাব — অনেকটা অনুশীলন সমিতির মত। এবার চিং সাম্রাজ্যের প্রকাশ্য সমর্থন ও সহায়তায় প্রতিটি প্রদেশে এসকল বক্সার মব আক্রমণ করতে থাকে বিদেশী যে কোন কিছু। হোক খ্রীষ্টান মিশন, দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল। এ অবস্থায় চিং সম্রাট ইচ্ছাকৃতভাবে হাত গুঁটিয়ে বসে থাকার কারণে বিদেশী চৌদ্দটি দেশ একসাথে একটি শান্তিরক্ষীবাহিনী পাঠায় চীনে। অনুপ্রবেশের দোহাই দেখিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে সিশির প্রতিক্রিয়াশীল সরকার। যেসব সংস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন সিশি, সেগুলির অভাবেই দ্রুত পরাজিত হয় কুস্তিগীর বক্সার বিপ্লবী আর চিং সেনাদল।

১৯১১ সালের পূর্বের মাঞ্চুরিয়ার মুগুরভাজা বক্সারদের চিত্র
১৮৯৯ সালের বক্সার বিদ্রোহের সময় বক্সার ও চিং সেনাদল পশ্চিমা, সন্দেহজনক পশ্চিমা চর ও খ্রীষ্টানদের ওপর বেধড়ক হত্যাকান্ড চালায়, ধ্বংস হয় তাদের জীবিকা

কিন্তু যে বিদেশী কনসার্নগুলির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বক্সার বিদ্রোহ থেকে হয়, তার পুরো ক্ষতিপূরণের দাবি থেকে মুক্তি পেলেন না সিশি। চিং সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে বিশাল পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হতে হল। এ ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেল’স ব্যাক। চিং সাম্রাজ্যের বাকি দিন ছিল হাতেগোনা।

বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাকি পরাশক্তিগুলোর থেকে ভিন্ন একটা পন্থা অবলম্বন করে। বক্সারের ক্ষতিপূরণ থেকে একটা বিশাল অংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। ১৯০৮ সালে কংগ্রেস ঠিক করে যে এ টাকা চীনকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ চিন্তাটি আর কোন পরাশক্তি করেওনি। যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ নামে একটি বিখ্যাত এডুকেশন ফান্ড। এর মাধ্যমে প্রচুর চীনা ছাত্র আবারও পড়তে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের অনেকেই পরে প্রজাতন্ত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী কম্যুনিস্ট চীনা মূল ভূখন্ড আর তাইওয়ানে বিদ্বান ও বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ড থেকে বেজিংএ একটি প্রযুক্তি কলেজও শুরু হয়, যার নাম ছিংহুয়া। এটি কিন্তু এখনও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এক নাম্বার বিদ্যাপীঠ।

বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ পাওয়া প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রী, ১৯০৯ সাল। সামনের সারিতে বসা ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট চৌ জিচি।
বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপের টাকায় প্রতিষ্ঠিত চীনের নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছিংহুয়ার বর্তমান চিত্র

ওদিকে ১৯০৫এ রুশ-জাপানী যুদ্ধের পর আবারও জাপান মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর-পূর্ব চীনে রুশদেরকে সরিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়। তখনো মার্কিনরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কূটনীতির মাধ্যমে চীনের অখন্ডতা নিশ্চিত করে। চীনের চলমান সংস্কারেও মার্কিন সাহায্য আসতে থাকে। ১৯১২ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। একই সাথে ওপেন ডোর পলিসির প্রতি নতুন করে আস্থা ব্যক্ত করে।

১৯১১ সালের শিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের চিং সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্রী সরকার
চীনা বিপ্লবের পুরোধা সুন ইয়াত সেন, ১৯১০, ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত হাওয়াইয়ে মার্কিন শিক্ষায় শিক্ষিত হন
ইউয়ান শিকাই, চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, ১৯১৫। সুন ইয়াত সেনের পরিবর্তে তাকে আপোষে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতে গিয়ে পুরো দেশে বিশৃংখলা অরাজকতার জন্ম দেন এই পুরনো ধাঁচের চিং জেনারেল।

তবে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আবার বিপদে পড়ে যায় চীন। ব্রিটিশদের অনুরোধে জাপান মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। কারণ আর কিছুই না। চীনের যে স্বল্প কিছু অংশে জার্মান কলোনি ছিল সেগুলি কব্জা করা। ব্রিটিশরা সেটা মেনে নেয়। কিন্তু জাপানীদের লোভ ছিল আরো বিস্তৃত। একুশ দফা নামে ১৯১৫ সালে তারা একটি আলটিমেটাম দেয়। এর সারবত্তা ছিল চীনের সকল কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক আর প্রশাসনিক দায়িত্ব জাপানের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সোজা কথায় চীন পরিণত হবে জাপানীপ্রশাসিত চীনে। যেখানে চীন নামটা ঠিক থাকবে, কিন্তু আসলে পরিচালিত হবে জাপানীদের দ্বারা।

ইউরোপের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা জাপানীদের সুযোগ নিয়ে এমন খাইখাই করাটা একদম সহ্য করেনি। তারা এই আল্টিমেটাম পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিনরা উল্টো চীনা সরকারকে বলে দেয় যেকোন মূল্যে জাপানকে রুখতে, যুক্তরাষ্ট্রের তাতে সমর্থন থাকবে। অবস্থা বেগতিক দেখে জাপানীরা পিছপা হয়। খুব সামান্য অর্জনের বিনিময়ে তারা খোয়ায় ব্রিটিশ ও মার্কিনদের বিশ্বাসভাজনতা। এ ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ঘটনাবলীতে প্রভাব রাখে।

অর্থাৎ এ যাত্রাও চীন বেঁচে যায়। তবে তাদের মূল্যও দিতে হয়। ১৯১৭ সালে সেদেশে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সেসব এলাকা স্থানীয় “ওয়ারলর্ডদের” শাসনাধীন হয়। তারা নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নামে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করতে থাকে। এই অবস্থায় মার্কিনদের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে। আর রুশ-জাপানীদের পলিসি ছিল একেক ওয়ারলর্ডকে পয়সা খাইয়ে নয়ত একের বিরুদ্ধে আরককে লড়িয়ে নিজেদের সুবিধা উদ্ধার।

১৯১৯এর ভের্সাই ট্রীটিতেও চীন ব্যর্থ হয় শানদং উপদ্বীপে প্রাক্তন জার্মান, এখন জাপানের শাসনাধীন কলোনি পুনরুদ্ধার করতে। এর জন্য বহু চীনা নাগরিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে দোষারোপ করে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, চীনা সরকার ভের্সাই ট্রীটির আগেই জাপানীদের সাথে আলদা গোপন চুক্তি করে সে দাবি ছেড়ে দেয়ায় উইলসনের আর কিছু করার ছিল না।

১৯২০/৩০এর দশকে শাংহাইয়ে মার্কন ধাঁচের জ্যাজ ব্লুজ সঙ্গীত ছিল জনপ্রিয়। চীনা সঙ্গীতের সাথে মিলে নতুন ধরনের মিশ্র গীতিবাদ্যের জন্ম হয়।

তবে বিশের দশকে কূটনীতির জোরে জাপানের এসকল আগ্রাসী কার্যকলাপকে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয় মার্কিনসহ অন্যান্য পরাশক্তি। বিশ-ত্রিশের দশক ছিল পাশ্চাত্য আর চীনা প্রগতিশীল নেতৃত্বের সুসম্পর্কের স্বর্ণযুগ। শাংহাই ছিল চীনা জ্যাজ-ব্লুজ সিনক্রেটিজমের ক্যাপিটাল, আর পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল। হংকংয়ের সাথে পাল্লা দেবার মত শহর ছিল সেটি।

১৯২৭-২৮ সালের মধ্যে প্রায় পুরো চীনকে একত্রিত করতে সক্ষম হয় কুওমিনতাং পার্টি। তাদের রাজধানী ছিল নানজিংয়ে। নতুন করে এরা পাশ্চাত্য ও মার্কিনদের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু হয় জাপানের চক্ষুশূল। ১৯৩১ সালে জাপানী সেনাবাহিনীর একদল ষড়যন্ত্র করে মাঞ্চুরিয়াতে মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের ছুঁতোয় চীনের ওপর একতরফা আক্রমণ করে। জাপানের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে আসে ব্রিটিশ লর্ড লিটনের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানকারী দল। চীনের পক্ষে তাদের রায় গেলে লীগ অফ নেশনস থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে জাপান। এসব ঘটনা টিনটিনের কমিক পাতাতেও এসেছে।

১৯৩৩ সালে লীগ অফ নেশনস থেকে জাপানের ওয়াক আউটের দৃশ্য এভাবে কমিক বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন বেলজিয়ান শিল্পী এর্জে।

মাঞ্চুরিয়ায় একতরফা জাপানী দখলদারিত্ব আর প্রাক্তন চীনা সম্রাট পু’য়ীর পুতুল সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক মহলে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জাপান বাণিজ্যিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে তাদের অনেক লাভজনক লেনদেন ছিল। জাপানের এমন কট্টরপন্থার পেছনে ছিল তাদের আর্মির এক অতি-জাতীয়তাবাদী ফ্যাকশন, যারা ত্রিশের দশকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থ হয়।

১৯৩৭ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে চীনা রাজধানী নানকিংয়ে ব্যাপক জাপানী বোমাবাজির ক্ষয়ক্ষতিতে আহতদের সহায়তায় কিভাবে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় মার্কিনরা।

মাঞ্চুরিয়ান ইনসিডেন্টের কপি-পেস্ট ১৯৩৭ সালে মার্কো পোলো ব্রিজ ইনসিডেন্ট ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। চীনে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা চীনা সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাণ প্রচেষ্টার আয়োজন করে। বহুর্বিশ্বে জাপানীদের নিষ্ঠুরতাকে হেডলাইনে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। “নানজিংয়ের ধর্ষণের” মত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আন্তর্জাতিক মহলের আর ভাবনার অবকাশ থাকে না যে, সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষুধিত ক্ষমতালিপ্সু জাপানী মিলিটারি হুন্তা কতদূর যেতে পারে। পরবর্তীতে অ্যাটম বোমা ফেলার মত সিদ্ধান্তে এসব ঘটনা ভীষণ প্রভাব ফেলে।

জাপানের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে চীনের প্রজাতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী সরকার নয় শুধু, মাওজেদংয়ের কম্যুনিস্টদেরও সহায়তা দেয় মার্কিনরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও রুশদের যে লেন্ডলীজ পদ্ধতিতে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেয়া হয়েছিল, তার শুরু আসলে এই চীনা সহায়তার মধ্য দিয়ে। সামরিক রসদের চালান যেত দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে। ব্রিটিশ কনভয়ে যেত মার্কিন অস্ত্র। জাপানীরা বার্মা দখল করলে সে কাজের দায়িত্ব নেয় ফ্লায়িং টাইগারস নামে ব্রিটিশ ও মার্কিন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক পাইলটদের দল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই চীনের সাথে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অসম চুক্তি রদ করা হয়, সকল ট্রীটি পোর্ট ফিরে যায় চীনের কাছে। শাংহাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল লেগেশনও। যুদ্ধের পর মার্কিন সমর্থনের কারণেই জাতিসংঘে স্থায়ী আসনটি পায় প্রজাতন্ত্রী চীন।

দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ রসদ যেত জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত চীনা সেনাবাহিনীর কাছে, ১৯৪১
বার্মা জাপানী দখলে চলে যাবার পর দুর্গম পর্বতের প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে চীনাদের কাছে রসদ নিয়ে পৌঁছে দিত ফ্লায়িং টাইগার্স নামে এই মার্কিন স্বেচ্ছাসেবক পাইলটের দল, ১৯৪৩

কম্যুনিস্টদের সাথে জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধেও মধ্যস্থতার একটা ইনিশিয়াল প্রচেষ্টা হয় মার্কিনদের থেকে। কিন্তু সোভিয়েত প্রভাব আর কোল্ড ওয়ার ডায়নামিক্সের কারণে সেগুলি সাফল্য পায়নি। কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ফলে ওপেন ডোর পলিসির আর কোন প্রয়োজন থাকে না। বাকি বিশ্ব থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চীনের মূল ভূখন্ড।

কোরিয়ান যুদ্ধে প্রথম চীনা কম্যুনিস্ট লালফৌজ আর মার্কিন সামরিক শক্তি মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া আর কখনো দেশ দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েনি। চীনাদের হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণের বিরুদ্ধে জেনারেল ম্যাকার্থার অ্যাটম বোমা আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। তার পাগলামো থামানোর জন্য তাকে পদচ্যুত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান স্বয়ং — জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলার দায় চাপানো হয় যার ওপর।

সত্তর দশকে চীন-সোভিয়েত শত্রুতা চরমে উঠলে তার সুবিধাটা বাগিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক মানবিক অবস্থানটি ভেতরে ভেতরে থাকলেও নিক্সন প্রশাসন গোপনে চীনের সাথে চ্যানেল তৈরি করে ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যস্থতায়। সে কারণে সকল ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরাসরি বিরোধিতা তারা করতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের অবস্থান ছিল খোলাখুলিরকম স্বাধীনতাবিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমনটা ছিল না।

চীন-মার্কিন এই দেতঁতের কারণেই কম্যুনিস্ট চীন জাতিসংঘে প্রজাতন্ত্রী চীনের স্থায়ী আসনটি পায়। নইলে সে ভোটটি ছিল তাইওয়ানের হাতে। সেই ওপেন ডোর পলিসির উত্তরাধিকার ধরেই তাইওয়ানকে এখনও অখন্ড চীনের অংশ হিসাবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের কোন দূতাবাস ও অফিশাল কূটনৈতিক মিশন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। আছে কেবল কালচারাল মিশন।

সারমর্মে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের নাম ধরে যে মড়াকান্নাটা চীনারা এখনো দেয়, সে সেঞ্চুরিটি আরো খারাপ হতে পারত তাদের জন্য। বেঁচে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। এর কারণ যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ শুধু দেখতে পেয়েছে তা নয়। ১৮৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত প্রাক্তন স্পেনীয় কলোনিগুলিকে হস্তগত করে নিজেদের একটা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বানানোর অবস্থানে ছিল। অন্যান্য পরাশক্তির সাথে যোগসাজশে চীনকেও কেটেছিঁড়ে খাবার একটা সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ছিল। সেটা ঘটেনি। অষ্টাদশ শতকে ওরিয়েন্টাল সভ্যতা বিশেষত চীনা সভ্যতার ব্যাপারে মার্কিনদের একটা ফ্যাসিনেশন ছিল। রোমান বা গ্রীক সভ্যতার প্রতি আকর্ষণের থেকে সেটা কম ছিল না। ফাউন্ডিং ফাদারদের অনেকেই চীনা সভ্যতার প্রশংসা করে গেছেন। এ সম্মানটার কারণেই চীন প্রচুর সহমর্মিতা সমবেদনা আর সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়।

বর্তমান যুগের চীনা-মার্কিন শত্রুতার নেপথ্যে চীনা সংস্কৃতি-সভ্যতা বাঁধা নয়। বাঁধা কম্যুনিজম, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, চীনা সম্প্রসারণবাদ ও বাণিজ্যে অসম সুবিধাভোগ। যদি চীনে কোন এক স্বপ্নের যুগে সিসিপি’র বিনাশ ঘটে, যুক্তরাষ্ট্র আর সে দেশটি নিঃসন্দেহে বন্ধুতার বহু প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই!

আধুনিক জাতিরাষ্ট্র

যখন ছোট ছিলাম, তখনকার দুটো ভূরাজনৈতিক ঘটনা আমাদের প্রজন্মের স্মৃতিপটে গেঁথে আছে। এক, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিকরণ ও তার জায়গায় একসাথে পনেরটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি। দুই, সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাকী সেনাবাহিনীর কুয়েত আক্রমণ ও অ্যানেক্সেশন।

ছোটবেলায় তাই মনে একটা প্রশ্ন ছিল, একটা দেশ দেশ হয় কিভাবে? স্কুলের বইপুস্তক থেকে শেখা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল সে প্রশ্নের তখন জানা একমাত্র উত্তর। কিভাবে পনেরটি দেশ যুদ্ধ ছাড়া হুঁট করে স্বাধীন হয়ে গেল, কিংবা কেন একটি বড় দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করে আরেকটি ছোট দেশের স্বাধীনতা হরণ করে নিল, সে সব ছিল জানা উত্তরের বিপরীত। এসব নিয়ে জানতে বুঝতে উইকিপিডিয়ায় লেজুড় ধরে ধরে একের পর এক আর্টিকেল পড়ার মত পরবর্তী দশ বছরে পড়ে ফেললাম পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া, কম্যুনিজম, মার্ক্সিজম প্রভৃতির ইতিহাস। আমার খোঁজা উত্তরটা কিন্তু অন্য কোথাও।

একটি রাষ্ট্র কিভাবে রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়? এটা আসলে একটা ক্লাবে ঢোকার মত। এক্সক্লুজিভ ক্লাব। চাইলেই আমি আপনি নিজেদের প্রাইভেটলি ওনড জায়গাজমি নিয়ে নতুন একটা স্বাধীন দেশ ঘোষণা করলাম, আর অন্যান্য সকল রাষ্ট্র আমাদের বাহবা দিয়ে তাদের ক্লাবে ঢুকিয়ে নেবে, এ এত সহজ নয়।

বর্তমান রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে আগত — আপনি যতই সে সংজ্ঞাকে “ঔপনিবেশিক” বলে গালি দেন না কেন, আপনি সে সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত একটি রাষ্ট্রেই বসবাস করছেন। এটা‌ই বাস্তবতা। আর এ সংজ্ঞাটা যথেষ্ট কার্যকর।

ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্র সংজ্ঞার পেছনে প্রচুর রক্তপাতের ইতিহাস আছে। ঊনবিংশ শতকের শুরুর ভাগে নাপোলেওঁ বোনাপার্ত সমগ্র ইউরোপের মানচিত্র তছনছ করে ফেলেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নামমাত্র রাষ্ট্র বানিয়ে দেন তিনি, সেগুলির মাথায় ছিল তার পরিবারের কোন না কোন সদস্য। ১৮১৫তে নাপোলেওনের পরাজয়ের পর মানচিত্র আগের জায়গায় ফিরে যায়। কিন্তু নাপোলেওনের সময়ের বিপ্লবী চিন্তাধারণাটা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়ে যায়। প্রচুর রাষ্ট্রনীতিবিদ ও দার্শনিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন যুক্তিসংগত সংজ্ঞা দিতে শুরু করেন, বাস্তব অবস্থাটা যেমনই হোক না কেন। জাতীয়তাবাদী দর্শনগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিপর্যয় আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরও ব্যাপক মারণযজ্ঞের পরই ইউরোপ তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ একটা সময় পায় রাষ্ট্রের ক্রমাগত রিফাইনড ডেফিনিশনের কারণে। সে ইতিহাস এখনো চলমান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে রাষ্ট্র গঠনের পেছনে ছিল সাম্রাজ্যের ধারণা। সেখানে জোর যার মুলুক তার। সকল রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হবে বড় সাম্রাজ্যগুলির ক্লাবে আলোচনার মাধ্যমে। এ ধরনের ভূরাজনীতির কারণেই অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্য বহু দশক দুর্বলতায় ভুগেও বেঁচে থাকে। এক একটি সাম্রাজ্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সংগঠিত, যার নেতৃত্বে একটি সংখ্যাগুরু জাতির একনায়কতন্ত্রী বা গণতান্ত্রিক শাসক অধিষ্ঠিত। এক সাম্রাজ্য ‌অন্য সাম্রাজ্যের সাথে নানা রকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। তার অন্তর্গত জাতিগোষ্ঠীগুলির ইচ্ছা ও অধিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে গৌণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ বড় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা। কলোনি, রিসোর্স, কৌশলগত এলাকার দখল প্রভৃতি নিয়ে। যুদ্ধপরবর্তী পরাজিত বিধ্বস্ত দেশগুলির ভাগ্য নির্ধারণের একটা মূলমন্ত্র ছিল ন্যাশনাল সেল্ফ-ডিটারমিনেশন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উডরো উইলসনের চৌদ্দ দফা এই মূলমন্ত্রের ধারক।

ইউরোপের বড় দুটি সাম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বিতীয়টি ছিল বহু জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত। সেটিকে ভেঙে বহু জাতিগত সীমানা নির্ধারিত হয়। ইউগোস্লাভিয়া গড়ে ওঠে তাদের থেকে অধিকৃত এলাকাকে সার্বিয়া-মন্টেনেগ্রোর সাথে যুক্ত করে। কিছু এলাকা পায় রোমানিয়া-ইতালিও। চেকোস্লোভাকিয়া-পোল্যান্ড বহু শতক পর আবার স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

ওদিকে রুশ সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির সদস্য হলেও বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে তারা অক্ষশক্তির সাথে আলাদা শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। তাদের আত্মসমর্পণ থেকেও কিছু স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। বাল্টিকের দেশগুলি, ককেশাসের তিনটি দেশ, আর ইউক্রেন-বেলারুশ বিভিন্ন মেয়াদে স্বাধীন থাকে — সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে পুনর্দখলের আগ পর্যন্ত। তবে পোল্যান্ড-ফিনল্যান্ডকে আর আগের মানচিত্রে ফেরাতে পারেনি ত্রতস্কির লালবাহিনী।

নতুন গঠিত দেশগুলির যারা যারা বিজয়ী মিত্রশক্তিকে সাহায্য করে, যাদের ইতিমধ্যে একটি ক্লিয়ারলি ডিফাইনড বর্ডার, আর যথেষ্ট জনপ্রতিনিধিত্বপূর্ণ নেতৃত্ব রয়েছে, এবং বেশ আগে থেকেই যারা বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তারা সহজেই জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাদের রাষ্ট্রপরিচয়কে স্বীকৃতি দেয় প্রথমে পরাশক্তিগুলির ক্লাব, পরে লীগ অফ নেশনসের কালেক্টিভ কনসেনসাস। শুধু তাই নয়, যেসব ছোট জাতিগত রাষ্ট্র শত্রুভাবাপন্ন বড় রাষ্ট্রের প্রতিবেশী, তাদের স্বাধীনতার গ্যারান্টর হয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি। পোল্যান্ড-চেক এর উদাহরণ। এর থেকে লাভবান হয় ছোট রাষ্ট্রগুলি আর মিত্রশক্তির পরাশক্তি দেশগুলিও। এর বিপরীতে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের থেকে ভেঙে বের হওয়া বেশ কিছু ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র শুরুতে বলা ঐ শর্তগুলি পুরোপুরি পূর্ণ করে স্থায়ী রাষ্ট্র স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে, সাম্রাজ্যের পরিচয় থেকে জাতিগত পরিচয়ের এ ভূরাজনৈতিক প্রথায় আসতে গিয়ে উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী দর্শনের ক্যান অফ ওয়ার্মস খুলে আসে। চেক-পোলিশ রাষ্ট্রগুলি প্লুরালিস্ট ডেমোক্রেসি হিসাবে যাত্রা শুরু করলেও খুব শীঘ্রি জাতীয়তাবাদী পরিচয়টি বেশি আঁকড়ে ধরে। এর মূল কারণ ইতালি-জার্মানিতে ফ্যাশিজমের উত্থান। কোন কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তাদের বিপরীত জাতীয়তাবাদের উগ্রপন্থী প্রতিক্রিয়া হিসাবেই শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাই জার্মান-অস্ট্রিয়ান-ইতালিয়ান জাতীয়তাবাদী ইরেডেন্টিজমের চূড়ান্ত ফল। সে যুদ্ধের পর ইউরোপের পুনর্গঠনের সময় দেশগুলির রাষ্ট্রতন্ত্রে নতুন কিছু সাংবিধানিক ধারা যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে একেকটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেয়া হবে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার। তারা অন্য জাতির ভূখন্ডে বাস করলেও পাবে সমাধিকার ও সমনিরাপত্তা। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদ লাভের অন্যতম শর্ত করা হয় এই ধারাটিকেই। সোজা কথায় জাতীয়তাবাদ যেন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার অর্জনের পথে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়। আগের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।

তবে পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে এই থিওরিটা প্র্যাক্টিসে রূপান্তরিত হয়, পূর্ব ইউরোপে সে প্র্যাক্টিসটি হয়নি। তার মূল কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সেসকল অঞ্চল ছিল রুশ অধিকৃত। তাছাড়াও এ দেশগুলি জাতিবিভেদের সবচে বেশি নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার স্বাক্ষী। এ সকল কারণে, পোল্যান্ড জার্মানি থেকে দখল করা নতুন অঞ্চল থেকে জার্মানভাষীদের বহিষ্কৃত করে। চেকোস্লোভাকরা করে একই কাজ। খোদ রাশিয়া পোল্যান্ডের যে এলাকাটি বেদখল করে, সেখানকার পোলিশদের পাঠায় নির্বাসনে। পূর্ব ইউরোপে এ ধরনের জাতিগত বিশুদ্ধিকরণ চলে পুরো স্নায়ুযুদ্ধের সময়টা জুড়ে। বলতে গেল বর্তমান ইইউ সদস্য হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী জনমতের মূলে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপীয় মূলধারার রাষ্ট্রসংজ্ঞা থেকে ভিন্ন অতীত ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু উপনিবেশ স্বাধীনতা পায়। তাদের সীমানা কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যবাহী জাতিগত পরিচয়ের সীমানা দিয়ে নির্ধারিত হয়নি। হয়েছে কলোনিয়াল ইম্পেরিয়ালিস্ট লেগ্যাসির ওপর ভিত্তি করে। যার ফলে নাইজেরিয়ার মধ্যে পড়েছে দু তিনটি প্রাচীন রাজ্যের উত্তরসূরীরা, যাদের একাংশ খ্রীষ্টান, একাংশ মুসলিম, একাংশ এনিমিস্ট। ভাষাপরিচয়েও সেরকম বৈচিত্র। ভারতও সেরকম। তবে যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই পুরনো জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টটা দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্র দাঁড়া করিয়েছে, তারা স্বভাবতই একটা বড় প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটা হল, তাদের সীমানার ভেতরের সংখ্যালঘু জাতিদের পরিচয় কি হবে। এই অবস্থার সবচে বড় উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। বাথিস্ট ইরাক-সিরিয়া তাদের সকল সংখ্যালঘুদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করত। আরব পরিচয় না গ্রহণ করলে তাদের সমাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত।

এ প্রশ্ন থেকে বেঁচে গেছে প্রাচ্যের কিছু দেশ, যারা তাদের সাম্রাজ্য হারিয়ে “হোমোজেনাস হোম নেশনে” পরিণত হয়েছে। জাপান একটা উদাহরণ। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপের মত সংখ্যালঘুদের অধিকার যারা নিশ্চিত করতে পেরেছে, কোল্ড ওয়ারের সময়টা কিছু অস্থিতিশীলতা পোঁহাতে হলেও তারা শেষ পর্যন্ত তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে এ কাতারে কিছুটা ফেলতে পারি।

বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংজ্ঞা বাংলাভাষী মানুষের জাতিগত হোমোজেনিটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সেটা। স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্লাবে ঢোকার স্বীকৃতি পাবার জন্য যা যা দরকার ছিল বাংলাদেশ সেসব শর্তও পূর্ণ করে। ডিফাইনড বর্ডার আর আইডেন্টিটি। সত্তরের নির্বাচনের কারণে একটি লেজিটিমেট গণপ্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব। কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পরাশক্তিগুলির সাথে লবিইং। ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির যে বিবর্তন হয়েছে, যেখানে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে, সেটা প্রাচ্যের অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। ট্রাইবালিজম, ন্যাশনালিজম ইত্যাদি জনমানসে ষোল আনা বিদ্যমান। আর সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ইচ্ছাটাই সেসব দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রে প্রতিফলিত। ইউরোপের বাইরে বর্তমানে চলমান সংঘাতগুলির অধিকাংশেরই মূল কারণ সেটা।

যা হোক! এত তাত্ত্বিক কথাবার্তা আসলে অন্য আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণার উদ্দেশ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় জাতি রয়েছে যারা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সকল শর্তই বলতে গেলে পূরণ করে। তাদের গৌরবময় ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু তাদের কোন রাষ্ট্র নেই। বহুবার চেষ্টাচরিত হয়েছে। কিন্তু এখনো সফলতা আসেনি। তাদের কাহিনীটাই বলব পরের খন্ডে। কারো ধারণা আছে কি, কোন জাতিটির কথা বলতে চাইছি?

.
.
.
.
.

[উত্তরঃ কুর্দিস্তান]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের ইউরোপ, ১৯১৪
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের ইউরোপ, ১৯১৯
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ইউরোপ, ১৯৩৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপ, মাঝ বরাবর আয়রন কার্টেন, ১৯৫৫
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপ, ১৯৯১

হাইতি – ৩, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে হাইতি, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেরও, সম্মানজনক অবস্থান ঊনবিংশ শতকে ছিল না। দুটি দেশই দুই পরাশক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধ করেছে। বিশেষত, হাইতিতে ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকরা সপরিবারে গণহত্যার শিকার হয়। ফ্রান্স তাই হাইতিকে তাদের উপনিবেশই ধরত, আর বাকি ইউরোপীয় শক্তিগুলি ফ্রান্সের আগ বাড়িয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কস্থাপনে আগ্রহী ছিল না।

তাই হাইতির বন্দরগুলিতে মার্কিন, জার্মান আর ব্রিটিশ জাহাজের আনাগোনা থাকলেও বড় ধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যচুক্তি করার সামর্থ্য হাইতি সরকারের ছিল না। এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে ফ্রান্স হাইতিতে দূত পাঠায়। তাদের শর্ত, স্বাধীনতাযুদ্ধে যে ফরাসী সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, তার জরিমানা দিলে ফ্রান্স হাইতিকে স্বীকৃতি দেবে।

উত্তর হাইতির রাজা ক্রিস্তফ ফরাসীদের একদমই বিশ্বাস করতেন না। তার দরবারে পাঠানো ফরাসী দূতকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি। ঠিক তখনই দূতের হাত থেকে গোপন ফরাসী সরকারী নির্দেশনা এসে পড়ে ক্রিস্তফের কাছে। তার ভয় অমূলক ছিল না! দূতের কাছে নির্দেশ ছিল, শর্তে রাজি না হলে নিকটস্থ ফরাসী নৌবাহিনীকে সংকেত পাঠাতে, যেন তারা ক্রিস্তফের বন্দরগুলিতে আক্রমণ চালায়।

এসব নাটকীয়তার ফলে ফরাসীদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ব্যাপারটা পিছিয়ে এসে পড়ে ১৮২৫ সালে। রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরের কাছে ফরাসীরা আবার দূত পাঠায়। ক্ষতিপূরণের অংক তারা ঠিক করে পনের কোটি ফ্রাংক — আজকের হিসাবে ৩৫০ কোটি ডলার! সামর্থ্যে না কুলালে ফরাসী ব্যাংকও প্রস্তুত রয়েছে দীর্ঘকালীন ঋণ দিতে!

হাইতির সরকারী বাজেট কমিশন এই ব্যাপারে না আগাতে বোয়াইয়েরকে সুপারিশ করে। কিন্তু একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের তার তোয়াক্কা না করে এতে রাজি হয়ে যান। এই একতরফা সিদ্ধান্তের মাশুল হাইতিবাসীকে গুনতে হবে প্রায় একশ বিশ বছর! সুদে-মূলে যত টাকা এতে খরচ হবে, তাতে হাইতিতে উন্নতমানের জনপথ-নৌবন্দর-বিশ্ববিদ্যালয়-হাসপাতাল হতে পারত অনেক।

ফরাসী দূতের সাথে ইনডেমনিটি সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়ের, ১৮২৫। ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত ফরাসী বইয়ে দেখানো চিত্র।

হাইতির সরকারী কোষাগারের সীমিত সম্পদের সিংহভাগই খরচ হয়ে যেত সেনাবাহিনী পালতে। তাদের মূল কাজটা আবার দেশরক্ষার চেয়ে বেশি বিপ্লবীদের ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা। হাইতির বাজেটের ১ শতাংশেরও কম খরচ হত শিক্ষাক্ষেত্রে। বোয়াইয়ের চাইলে ফরাসী দাবি কানে না তুলে সরাসরি তাদের প্রতিযোগী জার্মানি আর আমেরিকার সাথে সম্পর্কস্থাপনে মনোযোগ দিতে পারতেন। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির রাস্তা কার্যত তৈরি হয়ে যেত।

বোয়াইয়েরের তো জাতীয়তাবাদী অহংকার ছিলই, তাছাড়াও তিনি হিসাব কষেছিলেন যে ফ্রান্সের স্বীকৃতি পেলে হাইতিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়বে। তা বেড়েছিল কিছুটা, কিন্তু তার সাথে সাথে নতুন নতুন সমস্যার সম্মুখীন হয় হাইতি। মুক্তবাণিজ্যের রাস্তা ধরে হাইতিতে বিভিন্ন দেশ থেকে অভিবাসন বৃদ্ধি পায়। জার্মান বণিকরা হাইতির বন্দরগুলিতে আমদানি-রপ্তানির কারখানা খুলে বসে। আইনানুযায়ী তারা সম্পত্তির মালিক হতে না পারলেও, স্থানীয় নাগরিক বিয়ে করে সে আইন পাশ কাটানো সম্ভব ছিল।

তাও যদি হাইতিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকত, মুক্তবাণিজ্য আর শিক্ষাদীক্ষার মাধ্যমে নাগরিকদের মুক্তি আর সমৃদ্ধি আসতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি বোয়াইয়েরকে তাড়িয়ে সম্রাট সুলুক, তারপর ১৮৫৯এ তাঁকেও খেদিয়ে রাষ্ট্রপতি জেফ্রার — এভাবে ১৮৪৩ থেকে ১৮৮৯এর মধ্যে ১২জন রাষ্ট্রনায়ক দেশ পরিচালনা করেন, আর গঠনতন্ত্র পরিবর্তিত হয় ৮বার। কিন্তু আসল সমস্যাগুলির কোন পরিবর্তন হয় না।

মার্কিন ম্যাগাজিন হার্পারস উইকলিতে হাইতির নতুন প্রেসিডেন্ট সালনাভের ছবি, ১৮৬৭। একই পৃষ্ঠার নিচে ডানের চিত্রঃ আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গরা ভোট দিচ্ছে ওয়াশিংটন ডিসির একটি স্থানীয় নির্বাচনে।

প্রদেশগুলিতে সেনাশাসকরাই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিল। বড় খামারগুলো তাদের অফিসারদের দখলে। নির্বাচন হলেও সেগুলি নামেমাত্র, আর ফলাফল পছন্দ না হলে তো বিপ্লব আর অভ্যুত্থানের রাস্তা আছেই! রাষ্ট্রপতি গদিতে বসামাত্রই প্রাসাদে গিয়ে সৈন্যসামন্ত নিয়ে এমন ঘাঁটি গাড়তেন, যেন স্বদেশীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছেন তিনি!

এসব গোলমালের ফলে বৈদেশিক সম্পত্তির ক্ষতি হওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জার্মান বা ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থের ক্ষতি সাধিত হলে, সেসব দেশের যুদ্ধজাহাজ হাইতির সাগরে টহল দিত আর বন্দরগুলির দিকে কামান তাগ করে থাকত। ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত হুমকির মুখে থাকত হাইতির বন্দর ও বাণিজ্য।

হাইতির আরও বড় মাথাব্যথার কারণ ছিল আন্তর্জাতিক ঋণ। ফ্রান্সের সেই ইনডেমনিটির কিস্তি শোধ করতে গিয়ে আরো পর্যায়ক্রমিক ঋণ হাইতি নেয় যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ব্রিটেনের কাছ থেকে। ১৮৬০এর দশকে বাজেটের ৩০% যেত সামরিক খাতে আর ২৫% ধারের কিস্তি পরিশোধ করতে। ১৮৯৮ নাগাদ ধারশোধের ভাগ হয়ে দাঁড়ায় ৫০%, ১৯১৩ নাগাদ ৬৭%। এক পর্যায়ে ফরাসী একটি ব্যাংক হাইতির কোষাগারের ‘ইজারা’ নেয়, তারাই ছাঁপাত হাইতির ব্যাংকনোট, আর সেভাবে দেশটির অর্থনীতিতে একটা বড় প্রভাব বিস্তার করে ফ্রান্স।

জার্মান অ্যালবামে ছাঁপানো হাইতির অনুপম দৃশ্যাবলী, ঊনবিংশ শতকে বহু জার্মান অভিবাসী হাইতিতে আবাস গাড়ে। ১৮৯৭ সালে ছাঁপানো এনগ্রেভিং।
১৮৯৭ সালে জার্মান এক নাগরিককে হাইতির আইনশৃংখলাবাহিনী চুরির দায়ে গ্রেপ্তার করলে জার্মানি শার্লট নামে এই যুদ্ধজাহাজ পাঠায় হাইতিতে, শক্তিপ্রয়োগের ভয় দেখিয়ে তার নাগরিককে মুক্ত করার প্রয়াস। ইউরোপীয় পরাশক্তিগুলি এরকম নানাভাবে ব্ল্যাকমেইল করে এসেছে হাইতিকে। ফিরম্যাঁর মত কূটনীতিবিদদের লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্রের মত শক্তিশালী দেশের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্কস্থাপন করে ইউরোপীয়দের প্রভাবহ্রাস।

এ সময়টা অবশ্য পৃথিবীর আরো অন্যান্য জায়গার মত হাইতির শিল্প-সংস্কৃতির জন্যেও একটা রেনেসাঁর যুগ ছিল। আমেরিকা-ইউরোপে শিক্ষিত গুণীজন আর অভিবাসীদের সমাগমে হাইতির শহরগুলিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। এরাই নানা সময়ে হাইতির একনায়কদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়, যদিও তাদের বিপ্লবগুলিতেই নিহিত ছিল নতুন কোন একনায়কতন্ত্রের বীজ।

১৮৭০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ধর্মপ্রচারক জোসেফ হোলি দানের টাকায় মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাসদের হাইতিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কিন্তু গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে অভ্যাস না থাকায় রোগে-জরায় এদের অনেকে মারা যায়।

একই সময়ে ইউরোপীয় খ্রীষ্টান মিশনারিরা পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থাও নিয়ে আসেন হাইতিতে। গ্রামাঞ্চলের দিকে তারা ছড়িয়ে পড়তে থাকলে সংঘাতের ক্ষেত্র তৈরি হয় সনাতন বিশ্বাসীদের সাথে। সহজ-সরল গ্রাম্য হাইতিবাসী ছিল কুসংস্কারাচ্ছ্ন্ন, ভুডুতে বিশ্বাসী। বহুবিবাহেরও প্রচলন ছিল। খ্রীষ্টান পাদ্রীরা এসবের পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। ভুডুবিশ্বাসীদের নরবলি-নরমাংসভক্ষণের গুজব হাইতির শহরগুলিতেও শোরগোল তোলে। স্বদেশের পশ্চাদপসরতা নিয়ে একটা হীনমন্যতা গড়ে ওঠে শহরবাসী দোআঁশলা সুধীসমাজের মধ্যে। তারাও উঠে পড়ে লাগে অবস্থার পরিবর্তনের জন্যে। রাজনীতিতেও সেসবের প্রভাব এসে পড়ে।

হাইতির নতুন শিক্ষিত কাতারের একজন ছিলেন অঁতেনর ফিরম্যাঁ। পেশায় সাংবাদিক, ফ্রান্সে কাটিয়েছেন যুবাবয়স। ইউরোপে তখন ‘রেইস থিওরি’ নামে একটি সিউডোসায়েন্টিফিক তত্ত্ব বেশ চালু। এ তত্ত্বের প্রবক্তরা যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, ককেশিয়ান আর্যজাত মানবজাতির শ্রেষ্ঠতম, আর কৃষ্ণাঙ্গরা গায়েগতরে শক্তি ধরলেও মগজের জোরে সকলের অধম। ফিরম্যাঁ কয়েকটি প্রবন্ধ ও একটি বই প্রকাশ করে এদের যুক্তিখন্ডন করেন। এসব গবেষণা করতে গিয়ে হাইতির বহু লোকসংস্কৃতির সাথে পরিচিত হন তিনি। এভাবে পুরোদস্তুর নৃতত্ত্ববিদ বনে যান।

১৮৮৯ সালে ফিরম্যাঁ দেশে ফিরে রাজনীতিতে জড়িত হয়ে পড়েন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাইতির বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক আরো দৃঢ় করতে আগ্রহী ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ সংস্কৃতির পুরোধা হলেও ফিরম্যাঁ পপুলিস্ট রাজনীতিতে একদম বিশ্বাস করতেন না। তার দর্শন ছিল, দেশ পরিচালনার জন্যে দরকার হাতেগোনা কিছু অভিজ্ঞ দেশপ্রেমী নেতা। ফিরম্যাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারা হাইতির শিক্ষিত যুবকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

অঁন্তেনর ফিরম্যাঁ (১৮৫০-১৯১১), হাইতিয়ান রাজনীতিবিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, দার্শনিক, নৃতত্ত্ববিদ, সাংবাদিক।

যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য ১৮৮০র দশকের আগে হাইতিকে নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। পার্শ্ববর্তী ডমিনিকান রিপাবলিকের ঋণলাঘবের বিনিময়ে নতুন স্টেট হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে যোগদানের একটা কথাবার্তা অনেকদিন চলে। কিন্তু মার্কিন সেনেট সে প্রস্তাবনা ১৮৭৪এ নাকচ করে দেয়।

হিস্পানিওলা দ্বীপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ আরো বাড়তে শুরু করে স্টীমশিপের কারণে। স্টীমশিপ তখনকার বিশ্বকে সংযুক্ত করে ফেলেছে, আরেক গ্লোবালাইজেশনের যুগ চলছে তখন (জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ রচনার সময়কাল ১৮৭২)। আটলান্টিক অতিক্রম করতে সময় লাগে মোটে ৭ দিন! কিন্তু স্টীমশিপের জন্যে যেটা বেশ জরুরী সেটা হল কোলিং স্টেশন — এঞ্জিনে কয়লা ভরার বন্দর। প্রশান্ত মহাসাগরে এর প্রয়োজন থেকেই জাপানের বন্দরগুলি উন্মুক্ত করতে ১৮৫৪তে মার্কিন অ্যাডমিরাল পেরিকে পাঠানো হয়। হাইতিও ছিল ক্যারিবিয়ান এলাকায় কোলিং স্টেশনের একটা উত্তম অবস্থান।

ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে টাকা ধার করে হাইতি সময়মত পরিশোধ করতে পারছে না। বছরে বছরে বিপ্লবের ফলে বিনিয়োগকারীদেরও কোন নিশ্চয়তা নেই। সব মিলিয়ে হাইতির রাজনীতিতে নাক না গলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কোলিং স্টেশনের চাহিদাপূরণের তেমন কোন উপায় ছিল না, বিশেষ করে যখন ফিরম্যাঁর মত রাজনীতিবিদ ও তাঁর সমর্থকরা যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি সমর্থন চাইছে। হাইতিতে হস্তক্ষেপের যত অজুহাত ও লেভারেজ দরকার, সবই যুক্তরাষ্ট্রের ছিল।

১৮৮৯ সালে হাইতির মোল-স্যাঁ-নিকোলা দ্বীপে নৌঘাঁটি করার জন্যে যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রপতি লেজিতিমকে পীড়াপিড়ি করে। তাতে কাজ না হওয়ায়, উত্তর হাইতির বিদ্রোহীদেরকে তারা ইন্ধন দিতে শুরু করে — ফিরম্যাঁ ছিলেন এদলে। উত্তরের সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়। নির্বাচিত নতুন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন অঁতেনর ফিরম্যাঁ।

যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিবিদরা ফিরম্যাঁকে বেশ সম্মান করত। দ্বিপাক্ষিক সংলাপে সরাসরি অংশ নেন ফিরম্যাঁ ও মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ মুক্তির পথিকৃত ফ্রেডরিক ডগলাস। প্রাক্তন দাস ডগলাস হাইতিতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। শুধু হাইতির সাথে ভ্রাতৃপ্রতিম কূটনৈতিক সম্পর্ক নয়, ডমিনিকান রিপাবলিক মার্কিন স্টেট হলে কিংবা ক্যারিবিয়ানের কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান ছোট দ্বীপগুলোর নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নিলেই তাদের মঙ্গল হবে, এটা ছিল ডগলাসের দৃঢ় বিশ্বাস। অর্থাৎ এসব কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দেশগুলির একরকম মার্কিন ‘উপনিবেশায়ন’ ফ্রেডরিক ডগলাস নিজেই সমর্থন করতেন।

ফ্রেডরিক ডগলাস (১৮১৭-৯৫), প্রাক্তন দাস, মার্কিন কূটনীতিক, বিশিষ্ট বক্তা, লেখক, অ্যাবলিশনিস্ট, ১৮৭২ সালের নির্বাচনে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী, হাইতিতে প্রেরিত মার্কিন দূত (১৮৮৯-৯১)।

ফিরম্যাঁ ডগলাসের সাথে সংলাপ চালিয়ে গেলেও তাকে মিথ্যে আশ্বাস দেননি, কারণ সংবিধান অনুযায়ী হাইতির সীমানায় বিদেশীদের কাছে জমিবিক্রি বারণ। ডগলাসও ওয়াশিংটনে বার্তা পাঠান হাইতিকে চাপাচাপি না করার জন্যে। সে কথা গায়ে না মেখে যখন যুক্তরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা সাতটি যুদ্ধজাহাজ পাঠান হাইতির সাগরে, তখন ফিরম্যাঁই প্রথম মার্কিন নৌবন্দরের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তার লেখা প্রতিবাদলিপির বাগ্মীতার কাছে হার মেনে মার্কিন নৌবাহিনী জাহাজ ফিরিয়ে নেয়। ডগলাসও বেশ মনোক্ষুন্ন হন।

এরপর ফিরম্যাঁ রাষ্ট্রের গঠনতন্ত্রে বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব আনেন। মার্কিনদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের খাতিরে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সহজ করার জন্যে কিছু প্রস্তাবও তোলা হয়। তার একটি ছিল শ্বেতাঙ্গদের সম্পত্তির মালিকানার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। রাষ্ট্রপতির সেনেটর মনোনয়নের ক্ষমতা রহিত করা হয়। আরো বহু মানুষকে ভোটাধিকারের আওতায় আনা হয়।

সংস্কারের বিষয়গুলিতে সামরিক বাহিনীর অবশ্য সায় ছিল না। শীঘ্রই আবার হাইতির উত্তরাঞ্চলে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। ১৯০২ সালে নতুন নির্বাচনের দাবিতে সরকার অপসারিত হয়। এবার ফিরম্যাঁ স্বয়ং নির্বাচনে দল নিয়ে অংশ নিলেন। তার সমর্থকরা অধিকাংশ ছিল যুবাবয়সী ও পেশাজীবী শহুরে মানুষ। তার মূল প্রতিপক্ষ উত্তরের সেনাশাসক জেনারেল নোর্-অ্যালেক্সিসের বিরুদ্ধে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠে। তার রেশ ধরে অ্যালেক্সিস ফিরম্যাঁপন্থীদের মার্কিন তাঁবেদার আখ্যা দিয়ে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন।

ফিরম্যাঁপন্থীদের সাথে একদফা সংঘর্ষে জয়লাভ করে অ্যালেক্সিসপন্থীরা। ফিরম্যাঁ প্রাণভয়ে নিকটবর্তী সেন্ট টমাস দ্বীপে পালিয়ে যান। তাঁর বসতবাড়ি-লাইব্রেরি তছনছ করে ফেলে অ্যালেক্সিসের সৈন্যরা। নির্বাচনের যেটুকু ফলাফল বেরিয়েছিল, তাতে ফিরম্যাঁর দল বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে ছিল। ১৯১১ সালে ফিরম্যাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গুণীজনের সম্ভাবনাময় নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় হাইতির জনগণ।

জেনারেল পিয়ের নোর্-অ্যালেক্সিস (১৮২০-১৯১০), হাইতির রাষ্ট্রপতি (১৯০২-১৯০৮), যুদ্ধ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ফিরম্যাঁকে জোর করে রাষ্ট্রপতি হতে না দিলেও শেষমেশ বিপ্লবের মুখে গদি ছাড়তে হয় তাকেও।

আসলে হাইতির জন্মলগ্ন থেকেই বাইরের মানুষকে তাদের গভীর অবিশ্বাস। তারা প্রচন্ড স্বাধীনচেতা, এতটাই যে স্বদেশী সরকারের শাসনেও অবদমিত হয় না তারা। নিজেদের অন্তর্দ্বন্দ্ব আর অহংকারী অকর্মণ্য নেতাদের কারণে দায়িত্বশীল পররাষ্ট্র ও বাণিজ্য নীতি হাইতির ছিল না। এসবের কর্মফল ফিরম্যাঁ নিজেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছিলেন।

ফিরম্যাঁ বলেছিলেন, উত্তরের ‘দানব’ যুক্তরাষ্ট্রই হাইতির ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। হাইতিবাসীর সামনে একটাই পথ: নিজেদের বিবাদ-বিভক্তি ছেড়ে সময় থাকতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা-সহমর্মিতার সম্পর্ক গড়ে তোলা। যদি তারা তা করতে না পারে, তাহলে সে দানবই হাইতিকে আপাদমস্তক গিলে খাবে। ফিরম্যাঁপন্থীদের বিফলতায় প্রমাণ হয়ে গেল, হাইতি বেছে নিয়েছে দ্বিতীয় পথটিই।

১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য।
১৯০১ সালে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসের দৃশ্য, একশ বছরেও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
বন্দরে মার্কিন বাণিজ্যজাহাজ থেকে ময়দার বস্তা নামাচ্ছে খালাসীরা, ১৮৯০ থেকে ১৯০০র মধ্যে তোলা ছবি।

হাইতি – ১, স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

হাইতির ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক বিবরণী, বড় করে দেখার জন্যে ক্লিক করুন।

মানচিত্রে ক্যারিবিয়ান সাগরের দিকে নজর দিলে যে তিনটি বড় দ্বীপ প্রথমেই চোখে পড়বে, সেগুলি হলো কিউবা, জামেইকা আর হিস্পানিওলা। শেষটি অনন্য, কারণ একটি দ্বীপের মধ্যে দুটি রাষ্ট্র — পূর্ব ৫/৮ অংশে ডমিনিকান রিপাবলিক, আর পশ্চিম ৩/৮ অংশে হাইতি।

হাইতি অনেক দিক থেকেই বাকিদের থেকে আলাদা। দুনিয়ার মানুষ তাকে চেনে ভুডু ম্যাজিকের আখড়া হিসাবে। তাছাড়াও এ অঞ্চলের অল্প যে কটি দেশে ফরাসী ভাষা চলে, হাইতি তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য। দোআঁশলা ক্রেওল ভাষাও এখন সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত।

হাইতির যাত্রা শুরুও ব্যতিক্রমী। চিনি উৎপাদক ফরাসী উপনিবেশে ক্রীতদাসদের অভ্যুত্থান থেকে তার অভ্যুদয় অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে। যুক্তরাষ্ট্রের পর পরই আমেরিকা মহাদেশে দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনকারী রাষ্ট্র হাইতি।

হাইতির জনসংখ্যার অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের বংশধর আর একটা বড় অংশ দোআঁশলা মুলাটো জাত। মূল আমেরিকান অধিবাসী উপজাতিগুলি কলোম্বাসের পদার্পণের কয়েক দশকের মধ্যে মহামারী আর যুদ্ধের কবলে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

১৭৯১এ শুরু স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে এখন পর্যন্ত হাইতি প্রচুর উত্থানপতন দেখেছে। দেখেছে জনসংগ্রাম আর যুদ্ধের মুখে দুজন সম্রাট আর ডজনখানেক রাষ্ট্রপতির অপসারণ। পার্শ্ববর্তী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিককে দখল করে রেখেছে কয়েক বছর। আর নিজে দখলীকৃত হয়েছে দু’বার।

ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান দ্বীপরাষ্ট্রের সাথে তুলনা করলে আজকের হাইতি বিফল রাষ্ট্র বলা চলে। হাইতি যে উচ্চাভিলাষ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তার থেকে ক্রমাগত দূরে সরে গেছে। পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম দেশ হাইতি। এমনকি পর্যটনের আকর্ষণ প্রতিবেশী দেশ ডমিনিকান রিপাবলিকের মানুষের মাথাপিছু আয় হাইতির পাঁচ-ছয় গুণ — যদিও দেশ দুটি প্রায় একই ধরনের ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে গেছে।

পঞ্চাশের দশক থেকে আশির দশক পর্যন্ত পাপাডক-বেবিডকের পরিবারতান্ত্রিক স্বৈরাচারী শাসনের পরবর্তী অরাজকতা আর ২০১০এ ৭ রিখটারের সর্বনাশা ভূমিকম্পের পর জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সাথে বাংলাদেশী সেনাদলও হাইতিতে গিয়েছিল। সেখানকার অভিজ্ঞতা যে খুব একটা সুখপ্রদ নয়, এটা শান্তিরক্ষীদের অসামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে উঠে এসেছে। শ্রীলংকা সরকার একটি ক্ষেত্রে আর্থিক ক্ষতিপূরণও দেয়।

অর্থাৎ দেশটা এমন হয়ে গেছে যেখানে অমানবিকতা প্রতিদিনকার ব্যাপার। সেখানে বিদেশীরা বেশিদিন থাকলে তাদেরও অধঃপতন অবশ্যম্ভাবী।

কিভাবে হাইতি এমন অবস্থায় এসে পড়লো, তাই নিয়ে পাঁচখন্ডের এবারের সিরিজ।

প্রথম পর্ব: স্বাধীনতাসংগ্রাম, ১৭৯০-১৮১০

দ্বিতীয় পর্ব: রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

তৃতীয় পর্ব: আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, ১৮৬০-১৯১০

চতুর্থ পর্ব: দখলদার মার্কিন, ১৯১০-৫০

পঞ্চম পর্ব: রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ১৯৫০-


হিস্পানিওলা নামের যে দ্বীপটিতে হাইতি অবস্থিত, ১৪৯২ সালে আমেরিকা অভিযানের শেষভাগে কলোম্বাস সেখানে অবতরণ করেন। কলোনিস্থাপনের প্রথম কয়েক দশকে আদিবাসীরা স্প্যানিশদের সাথে সংঘর্ষে, মহামারীতে আর দাসত্বশৃংখলের কঠোর পরিশ্রমে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ধীরে ধীরে স্প্যানিশদের মনোযোগ মূল ভূখন্ডের দিকে যত বেশি নিবিষ্ট হয়, হিস্পানিওলার সান্তো দোমিংগো কলোনির গুরুত্ব তত কমতে থাকে। সপ্তদশ শতকের শেষ নাগাদ দ্বীপটির পশ্চিমাংশ থেকে স্প্যানিশরা সরে যায়, তার জায়গা নেয় ফরাসী-ইংরেজ জলদস্যুরা। এই জলদস্যুদের রাস্তা ধরেই ফ্রান্স পশ্চিম হিস্পানিওলার পূর্ণ দখল নেয় ১৬২৫ সালে।

কলাম্বাসের হিস্পানিওলাতে অবতরণের দৃশ্য উডকাট করেছেন ডাচ শিল্পী থিওডর দ্য ব্রি, ১৫৯৪
ক্যারিবিয়ানের ফরাসী বাকেনিয়ার (জলদস্যু) ফ্রঁসোয়া লোলোনোয়া স্প্যানিশ জাহাজ লুটতরাজ করতেন, ১৬৮৪ সালের চিত্র

নতুন নামকৃত স্যাঁ-দোম্যাঙ্গ উপনিবেশটি ফরাসীদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ক্যারিবিয়ানের গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ুতে আখ, তামাক, কফি ইত্যাদি অর্থকরী শস্যের চাষাবাদ ও ফলন ভালই হয়। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের খামারে খাঁটুনির কাজের জন্যে হাজারে হাজারে আফ্রিকান ক্রীতদাস আনা শুরু হয়।

ফরাসীরা ক্রীতদাসদের অমানবিকভাবে খাঁটাত। অন্যান্য ইউরোপীয় উপনিবেশগুলিতে ক্রীতদাসরা কিছুটা হলেও মূল্য পেত। কিন্তু ফরাসী রাজতন্ত্রের সেকেলে নিয়মে ক্রীতদাসরা বলতে গেলে ছিল একটিবার ব্যবহারের পণ্য। ফলে প্রতি বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে হাজার হাজার জওয়ান ক্রীতদাস মৃত্যুবরণ করত। ১৭৯০ সাল নাগাদ সেখানে ছিল প্রায় পাঁচ লাখ দাস আর হাজার পঞ্চাশেক ফরাসী শ্বেতাঙ্গ খামার মালিক।

আরো একটি ‘বর্ণ’ ছিল, যাদের নাম মুলাটো বা মিশ্রজাত। আর ছিল অল্প কিছু মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ। এরা মূলত কারিগর, খেতশ্রমিকের তদারককারী, পুলিশ, পেয়াদা, ইত্যাদি অবকাঠামোভিত্তিক পেশায় জড়িত ছিল।

স্পেনের আমেরিকান কলোনিগুলিতে শ্বেতাঙ্গ খামারমালিকের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের মিলনে প্রচুর মুলাটো বা মিশ্র সন্তানের জন্ম হয়, কারণ ভদ্র পরিবারের ইউরোপীয় মেয়েরা সাধারণত আমেরিকায় যেতে চাইত না, ১৭৭৫এর ‘কাস্তা’ চিত্র, স্প্যানিশ চিত্রকার ফ্রান্সিস্কো ক্লাপেরা, ১৭৪৬-১৮১০, ডেনভার আর্ট মিউজিয়াম
১৮২৩ সালে ক্যারিবিয়ান সাগরের দ্বীপ অ্যান্টিগাতে ক্রীতদাসদের আখ খামারে কাজ করার অ্যাকুয়াটিন্ট বানিয়েছেন ব্রিটিশ শিল্পী উইলিয়াম ক্লার্ক

ফ্রান্সে ১৭৮৯ সালে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব শুরু হয়। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজা-রাজড়া আর অভিজাত বংশগুলির শোষণের প্রতিবাদে জেগে ওঠে পেশাজীবী মধ্যবিত্ত থেকে দরিদ্র কৃষক। বাস্তিল দুর্গের পতন হয়। রাজা ষোড়শ লুইকে প্রথমে গদি ছাড়তে হয়, তারপর তার আর রাণী মারি অঁতোয়ানেতের গর্দান যায় গিলোটিনে। দশ বছরব্যাপী অন্তর্ঘাতে নিমজ্জিত হয়ে যায় ইউরোপের শক্তিশালী দেশটি।

এই অরাজকতার সুযোগ নিয়ে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অবস্থাপন্ন মুলাটো ও মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গ যারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক, তারা আরো রাজনৈতিক অধিকার দাবি করে বসে। প্রথমে তাদের লক্ষ্য স্বাধীন দেশ কিংবা দাসপ্রথার উচ্ছেদ ছিল না। এমনকি এদের অনেকে কালে খামার মালিক বনেছে, দাসদেরও মনিব হয়েছে, তুলা-নীল-কফি রপ্তানী করে বেশ সম্পদশালী হয়েছে। কিন্তু রক্ষণশীল রাজতন্ত্রবাদী ফরাসী খামারমালিকদের প্রশাসন তাদের দাবি প্রত্যাখ্যান করলে, এরা হাত মেলায় সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের সাথে।

এই দাসরা কিন্তু আফ্রিকার আবাসভূমিতে ছিল সশস্ত্র যোদ্ধা! আফ্রিকার গৃহযুদ্ধগুলিতে পরাজিত হবার পর শত্রুরা এদেরকে বেচে দিয়েছিল ইউরোপীয়দের কাছে। এসকল কৃষ্ণাঙ্গ যোদ্ধাদের সাহায্যে একটা শক্তিশালী সামরিকতন্ত্র দাঁড়া হয়ে যায় স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে।

১৭৯৪ সালে ফরাসী জনতা তাদের প্রাক্তন রাজা ষোড়শ লুইকে গিলোটিনে মৃত্যুদন্ড দেয়, লুই ব্লঁ-এর ইস্তোয়ার দ্য লা রেভোল্যুসিওঁ বইএর এনগ্রেভিং
হাইতির ১৭৯৩ সালের রক্তাক্ত বিপ্লবের চিত্র দেখানো হয়েছে ১৮২০ সালের ফরাসী বইয়ে
১৮৩৩ সালে ফ্রঁস মিলিতের বইয়ে অংকিত হাইতি বিপ্লবের হত্যাকাণ্ডের চিত্র

স্যাঁ-দোম্যাঙ্গে ত্রিমুখী গোলমাল চলে ১৭৯১ থেকে ১৮০৪ পর্যন্ত। প্রথমে কৃষ্ণাঙ্গসংগ্রামের একক কোন নেতা ছিল না। বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দল একেক প্রদেশে স্বাধীন শাসন কায়েম করে বসেছিল। ক্রমে এদের নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন তুস্যাঁ লুভেরত্যুর নামে এক মুক্ত মুলাটো। বাল্যকালে দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবার পর কোচচালক পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তারপর শিক্ষিত হয়ে নিজেই খামার দেন, দাস পালেন। বিপ্লবের সময় বিদ্রোহী সেনাপ্রধান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। স্বাধীন হাইতির প্রতিষ্ঠাতা ধরা হয় লুভেরত্যুরকেই।

১৮০৪/০৫ সালে ফরাসী শিল্পী জিরার্দ্যাঁর আঁকা তুস্যাঁ ল্যুভেরতুরের পোর্ট্রেট

১৭৯৪ সালে ফ্রান্সে প্রজাতন্ত্রবাদীরা ক্ষমতাদখল করে ফরাসীশাসিত সকল দেশে দাসপ্রথা রদ করে দেয়। বিদ্রোহী লুভেরত্যুর তখন পক্ষপরিবর্তন করে ফরাসী সরকারের গভর্নর হিসাবে নামেমাত্র ফরাসীঅধীন কলোনিটির শাসনভার দখল করেন। প্রজাতন্ত্রবিরোধী খামার মালিকদের প্রতিরোধযুদ্ধ তখনও চলছিল। তাদের আহ্বানে ব্রিটিশ নৌবাহিনী পাঁচ বছর স্যাঁ-দোম্যাঙ্গের অধিকাংশ এলাকা দখল করে রাখে।

কিছু দাসপ্রথাবিরোধী শ্বেতাঙ্গ অবশ্য লুভেরত্যুরের সাথে যোগ দেয়। লুভেরত্যুর ছিলেন সাদা-কালোর মধ্যে আপোষকামী, তাঁর অধীনে শ্বেতাঙ্গ সেনাপ্রধান ও সচিবও ছিল। সাদা বন্দীদের সাথে ভাল আচরণের উদাহরণও প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

কিন্তু ফরাসী বিপ্লবের লাগাম টেনে ধরেন নাপোলেওঁ বোনাপার্ত স্বয়ং। ফ্রান্সে ১৭৯৯ সালে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে প্রথমে কনসাল ও পরে সম্রাট পদবী গ্রহণ করেন তিনি। স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে পুনরায় কব্জা করার জন্যে এক বিশাল নৌবাহিনী পাঠানো হয় ক্যারিবিয়ান সাগরে। তাদের সেনাপ্রধান লক্লের্কের চালাকির শিকার হয়ে লুভেরত্যুর ফ্রান্সে বন্দী হিসাবে প্রেরিত হন, সেখানেই মৃত্যু হয় তার। তার সহযোদ্ধা জঁ-জাক দেসালিন ও অন্যান্যরা উপায়ান্তর না দেখে নাপোলেওনের পক্ষে যোগ দেন আর লড়াই চালান স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে।

অবশ্য নাপোলেওনের দাসপ্রথা পুনর্বহাল করার গোপন পরিকল্পনা যখন ফাঁস হয়ে যায়, তখন আবার দেসালিন পক্ষপরিবর্তন করেন। স্পেন ও ব্রিটেন থেকে আমদানি করা অস্ত্রের সাহায্যে কঠিন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ফরাসীদের ১৮০৩ সালে তাঁড়াতে সক্ষম হয় দেসালিনের সেনাদল। সে যুদ্ধের খরচ ওঠাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লুইজিয়ানা টেরিটোরির বিশাল ভূখন্ড বিক্রি করে দেয় ফ্রান্স।

১৮০৪ সালে ফরাসী জেনারেল নাপোলেওঁ বোনাপার্ত নিজের মাথায় নিজেই মুকুট পরে ফ্রান্সের সম্রাট বনে বসেন, জাক লুই-দাভিদের অংকিত চিত্র, ১৮০৮।
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদলের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত হাইতির সেনাদল। পেছনে মুক্ত কৃষ্ণাঙ্গের নির্দেশনায় সামনে এগিয়ে যাচ্ছে সশস্ত্র দাসের দল, ১৮০৩। ১৮৩৯ সালে প্রকাশিত ইস্তোয়ার দ্য নাপলেওঁ বই থেকে
নাপোলেওনের পাঠানো সেনাদল প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিকামী কৃষ্ণাঙ্গদের হত্যা করে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।
নাপোলেওনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হাইতির কৃষ্ণাঙ্গরাও নেয় খুব নৃশংসতার সাথে, ১৮০০। ১৮০৫ সালে প্রকাশিত অ্যান ইস্টরিকাল অ্যাকাউন্ট অফ দ্য ব্ল্যাক এম্পায়ার অফ হেইতি বই থেকে।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

দেসালিন ১৮০৪ সালে স্বাধীনতা ঘোষণা করে স্যাঁ-দোম্যাঙ্গকে নতুন নাম দেন হাইতি। এ ছিল লোককথা অনুযায়ী দ্বীপটির জন্যে আমেরিকান আদিবাসীদের ব্যবহৃত নাম। দেসালিন লুভেরত্যুরের মত আপোষকামী ছিলেন না, তার আমলে হাজার হাজার শ্বেতাঙ্গ খামারমালিককে সপরিবারে হ্ত্যা করা হয়। গর্ব করে হাইতিকে ফরাসীদের সমাধি ডাকনাম দেন দেসালিন। কিছু শ্বেতাঙ্গ মিত্রের প্রতিরক্ষার নিশ্চয়তা অবশ্য দেয়া হয়।

স্বাধীন হাইতির গঠনতন্ত্রে দাসপ্রথা রহিত করার পাশাপাশি দেশের সকল নাগরিককে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘কৃষ্ণাঙ্গ’ ঘোষণা করা হয়, যদিও কিছু পোলিশ শ্বেতাঙ্গ সেনা অফিসারকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। আরো যে ধারাটি লেখা হয়, সেটি হাইতিকে অনেক দিন ভোগাবে। সেধারা হলো, হাইতিতে বহির্দেশীয়, বিশেষত শ্বেতাঙ্গ কারো সম্পত্তির মালিকানা নিষিদ্ধ।

দাসপ্রথা রহিত করা হলে কি হবে, লুভেরত্যুর-দেসালিন দু’জনই পূর্ববর্তী খামার ব্যবস্থাকে অটুট রাখেন! তাদের হিসাবে বড় প্ল্যান্টেশনের মাধ্যমে চিনি রপ্তানি করে অর্থনীতিকে সচল রাখতে না পারলে আবার হাইতির স্বাধীনতা বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়বে। আর বাকি বিশ্বকে দেখাতে হবে না, কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কম নয়?

স্বাধীন হাইতির প্রথম নেতা ও সম্রাট জঁ-জাক দেসালিন, পোর্তো প্র্যান্সের ম্যুরাল চিত্র
নাপোলেওনের সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে যোগ দেয় অধিকৃত পোল্যান্ডের সৈন্যদল, ১৮০০

 

 

 

 

 

 

 

 

ফরাসীদের কাছ থেকে লুইজিয়ানা টেরিটরি কিনে যুক্তরাষ্ট্রের আকার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, ১৮০৩

ফলশ্রুতিতে, সাধারণ কৃষ্ণাঙ্গরা ক্রীতদাস থেকে এবার পরিণত হলো ভূমিদাসে! খামার ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার ও বসবাস করার অনুমতি এদের ছিল না। শহরে যেতে হলে তাদের লাগত পাসপোর্ট। খামার থেকে পালালে দেসালিনের পুলিশবাহিনী খুঁজে এনে আবার খামারে সোপর্দ করত। বলা বাহুল্য, খামারগুলোর মালিক তখন দেসালিনের সেনাবাহিনীর অফিসার আর সৈন্যের দল। আর যেসকল চাষী তাদের ক্ষুদ্র জমিতে স্বাধীনভাবে চাষাবাদ করত, তাদেরও যাতায়াতের স্বাধীনতা ছিল না। উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ কর হিসাবে সরকারকে দিয়ে দিতে হত।

অন্যদিকে প্রজাদের উন্নয়নের জন্যে যে শিক্ষা আর অবকাঠামো যেকোন নতুন রাষ্ট্রের প্রয়োজন, তার দিকে কোন নজর দেসালিন দেননি। সাধারণ হাইতিয়ানদের জন্যে দরকার ছিল ভূমিসংস্কার আর বড় খামারগুলো ভেঙে ছোট স্বাবলম্বী চাষাবাদযোগ্য জমি তৈরি। সেসব না করার কারণে প্রাক্তন দাসরা লুভেরত্যুর আর দেসালিন দুজনের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। এগুলি কঠোর হাতে দমন করেন দুজনেই।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃতি অর্জন করতে ব্যর্থ হয় হাইতি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলির সাথে প্রাইভেট সেক্টরে বাণিজ্য চললেও ফ্রান্স স্বাধীনতার স্বীকৃতি না দেয়ায় পাশ্চাত্যের বাকি সরকারগুলিও একই পথ অবলম্বন করে। বিশেষ করে ‘অগ্রজ’ যুক্তরাষ্ট্রের এহেন আচরণে সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়ে হাইতির শাসকগোষ্ঠী। ‘স্লেভ লেবারের’ ব্যবহারে উৎপন্ন চিনি-কফির রপ্তানির পয়সায় দেসালিন বিপুল অস্ত্রশস্ত্র কিনেন, আর স্থানে স্থানে দুর্গ তৈরি করা হয় ভবিষ্যত কোন এক যুদ্ধের প্রতিরক্ষার জন্যে।

স্বাধীনতার পর হাইতির শহুরে জনগণ কয়েক বছর উৎসব করে। গ্রামের কর্মঠ কৃষক জনগণের থেকে এদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে।
স্বাধীনতার পর খামার বা প্ল্যান্টেশন ব্যবস্থার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। ক্রীতদাসরা পরিণত হয় ভূমিদাসে, তাদের খামারের নতুন মালিক বনে দেসালিন-লুভেরত্যুরের অনুগত সেনা অফিসাররা। আর তাদের খাঁটনির পয়সায় সরকার সারা দেশে গড়ে তোলে অনেকগুলি অস্ত্রাগার ও দুর্গ।

এভাবে হাইতির সামরিকতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠী আর প্রাক্তন দাস প্রজাদের মধ্যে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। সাধারণ হাইতিয়ানরাও সন্দেহবাতিকে ভুগতে শুরু করে, যুক্তরাষ্ট্র বা ফ্রান্সকে নিয়ে নয়। নিজের স্বাধীন জীবনাচরণ নিয়ে, আর তাতে ক্রমাগত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের নাকগলানো নিয়ে।

দেসালিনের ইচ্ছে ছিল দুনিয়াবাসীকে দেখিয়ে দেবেন যে কৃষ্ণাঙ্গরা রাজনীতি-অর্থনীতি ও কর্মক্ষেত্রে শ্বেতাঙ্গদের থেকে কোন অংশেই কম নয়। কিন্তু তার এই তত্ত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে জনসাধারণের যে স্বাধীনতাটা বিসর্জন দিতে হলো, তাই হাইতির অরিজিনাল সিন। আর সেই পাপের ভার আরেক দফা বাড়ালেন দেসালিন নিজেই — হাইতির স্বাধীনতার নয় মাসের মাথায় নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে!

মেইজি জাপান

ঊনবিংশ শতকের শেষে এশিয়াতে যে ক’টি স্বাধীন দেশ ছিল, তাদের মধ্যে জাপান সবচেয়ে ব্যতিক্রমী। (নিচে মানচিত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক আগে এশিয়া-প্যাসিফিকের অবস্থা দেখা যাচ্ছে।) পশ্চিমাদের জবরদস্তির মুখে দেশের বদ্ধ দুয়ার খুলতে বাধ্য হলেও জাপান উপনিবেশ তো হয়ই নি, বরং খুব কম সময়ের মধ্যে অর্থনৈতিক আর সামরিকভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, এশিয়ার কয়েকটি এলাকায় নিজেরাই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তুলে।

জাপানের প্রথম ডাকটিকেট (১৮৭১) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

জাপানের চূড়ান্ত রূপান্তর যে সময়টায় হচ্ছিল, তার সাক্ষী ছবিতে দেখানো আমার সংগ্রহের ডাকটিকেট দু’টি। প্রথমটা জাপানের প্রথম ডাকটিকেট (১৮৭১)। এর মাত্র তিন বছর আগে সম্রাট মুৎসুহিতোর সিংহাসনে আরোহণের সাথে ‘মেইজি’ যুগের সূচনা হয়। ১৯১৫তে রাজপুত্র ইয়োশিহিতোর অভিষেক ও তাইশো যুগের প্রারম্ভের স্মারক হিসাবে দ্বিতীয় ডাকটিকেটটি প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ এই দুই ডাকটিকেটের মধ্যে স্যান্ডউইচ হয়ে আছে জাপানের দিগনির্ধারক একটি যুগ।

চিন্তা করছিলাম জাপান কেন ইতিহাসের ব্যতিক্রম।

পশ্চিমা বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের আগমনের ঠিক আগে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি বহুদিন বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক মডেল ছিল চীন। এ ব্যবস্থায় শিক্ষা, বাণিজ্য, ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমে ছিল সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য। সম্রাট ছিলেন দেবতার আসনে আসীন। ছিল ম্যান্ডারিন নামে বিশাল আমলাতন্ত্র। ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকলেও অর্থবহ সমাজজীবন সৌরজগতের গ্রহগুলির মত সূর্যদেবের প্রতিনিধি স্বর্গপুত্র সম্রাটকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হত । নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার হলে সরকারই হত প্রকারান্তরে তার মালিকানাধারী পৃষ্ঠপোষক। বিজ্ঞানী, আবিষ্কর্তা, কবি বা শিল্পীরা ছিলেন রাজদরবারেরই সদস্য।

প্রাচীনকালে সিল্ক রোডের মাধ্যমে বাইরের সাথে যুক্ত থাকলেও চীনে বিদেশী দ্রব্যের প্রয়োজন তেমন একটা ছিল না। সব চাহিদারই স্থানীয় সরবরাহ ছিল। মিং-চিং যুগের চীনাদের অধিকাংশের দৃষ্টিতে বিদেশীরা ছিল বর্বর, আর নিজস্ব বিজ্ঞান-দর্শন ইত্যাদি ছিল সর্বোত্তম। বৌদ্ধধর্মের বিস্তারের পরে বোধ করি বাইরের কোন গুরুত্বপূর্ণ আধুনিক ধ্যান-ধারণাই চীন সাম্রাজ্যে পাকাপোক্ত স্থান পায়নি। আর চংহোর ট্রেজ়ারশিপবহরের অভিযাত্রার (১৪০৫-১৪৩৩) পরে সম্রাটের নির্দেশে বৈদেশিক বাণিজ্য সীমিত করে ফেলা হয়। তদোপরি কনফুশিয়ান সমাজব্যবস্থা ছিল বর্ণকেন্দ্রিক। জন্মসূত্র নয়, সে বিভাজন ছিল পেশাভিত্তিক। এ শ্রেণীবিভাগে বণিকদের স্থান খুব একটা উচ্চ ছিল না।

শুধু চীন নয়, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, জাপান — এদের সবাইই কোন না কোন প্রকারে চীনের শাসনব্যবস্থা অনুকরণ করত।

রাজপুত্র ইয়োশিহিতোর অভিষেক ও তাইশো যুগের প্রারম্ভের স্মারক ডাকটিকেট (১৯১৫) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

জাপান একটু ভিন্ন অবস্থার মধ্য দিয়ে গেছে। ইউরোপে যেমন নানাভাষী অনেক জাতি নিজেদের মধ্যে ছাড়াও ওসমানী তুর্কীদের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় লেগে থেকে নিজেদের প্রযুক্তিগত উৎকর্ষসাধন করেছিল, চীনে তেমনটা বৃহদাকারে হয়নি। কিন্তু জাপানে অনেকটা এ অবস্থা বিরাজমান ছিল। সম্রাটকে দেবতুল্য আসনে রেখেই সেখানকার বিভিন্ন সামন্ত একে অন্যের সাথে প্রভাববিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। অধিকাংশ সময় দেশচালনার শক্তির কেন্দ্র ছিল কোন না কোন সামন্তপরিবার, সম্রাট ছিলেন প্রতীকমাত্র। ষোড়শ শতকের শুরুতে যখন পর্তুগীজরা প্রথম আসে, তখন জাপান ছিল অনেকগুলি দাইমিয়ো বা সামন্তরাজ্যে বিভক্ত, আর একে অন্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত। এ যুগকে বলে ‘সেনগোকু’ বা ‘ওয়ারিং স্টেটস’ যুগ (১৪৬৮-১৬০০)। চীনে বাণিজ্যের দুয়ার তখন জাপানীদের জন্যেও ছিল বন্ধ। আর তাদের দ্বীপপুঞ্জে কাঁচামালের প্রাচুর্য অতটা ছিল না যে বাণিজ্য ছাড়া স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

তাই পর্তুগীজ, ও পরে স্প্যানিশ-ওলন্দাজদের, সংস্পর্শে যখন জাপানীরা আসে, প্রথমে কালচার শক হয় তাদের। চীনাদের দেখাদেখি ইউরোপীয় বণিকদের ‘নানবান’ বা ‘দখিনা বর্বর’ বলে ডাকত জাপানীরা। আর আলকাতরা-মাখানো ইউরোপীয় জাহাজের নাম তারা দিয়েছিল ‘কুরোফুনে’ — কালোজাহাজ। (নিচের ছবিতে ঊনবিংশ শতকের জাপানী চিত্রে একটি কুরোফুনের রাক্ষুসে চেহারা দেখানো হয়েছে।) দক্ষিণ জাপানের দাইমিয়োগুলি কালচার শক দ্রুত কাটিয়ে উঠে ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্যের সম্পর্ক গড়ে তোলে। নাগাসাকি শহরের গোড়াপত্তনই হয় ইউরোপীয় বাণিজ্যঘাঁটি হিসাবে (১৫৭১)। গাদাবন্দুকেরও আমদানি করে পর্তুগীজরা। সে বন্দুক তৈরির প্রযুক্তি ত্রিশ বছরের মধ্যে জাপানীরাই শিখেপড়ে স্বদেশে উৎপাদন-শিল্প গড়ে তোলে। সেসময় ইউরোপের একেকটা দেশে যত না বন্দুক ছিল, জাপানে ছিল তার থেকে অনেক বেশি। চীনের বাণিজ্যপথ বন্ধ থাকায় জাপানীরা নিজেদের স্বার্থেই ইউরোপীয় বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করে, নৌবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে, আর নিজেরাও ‘রেড সীল’ বলে নৌবহর (১৬০০-১৬৩৬) পাঠিয়ে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে লেনদেনের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেসব দেশের বন্দরে জাপানী নাবিকদের দুর্নাম ছিল রুক্ষ মারপিটে স্বভাবের বলে।

জাপানের এ পর্যায় চলেছে প্রায় সত্তর বছর (১৫৪৩-১৬১৪)। এর মধ্যে পর্তুগীজ মিশনারীরা অনেক স্থানীয় মানুষকে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত করেছে। জাপানীরা তাদের সাথে ক্রীতদাস কেনাবেচাতেও অংশ নিয়েছে। দাইমিয়োগুলির মধ্যে যুদ্ধবিবাদে শেষপর্যন্ত বিজয়ী হয় তোকুগাওয়া বলে একটি সামন্ত পরিবার। তাদের নেতা ইয়েইয়াসু খ্রীষ্টধর্ম উৎপাটন অভিযান শুরু করেন এই কারণে যে সে ধর্মে জাপানী সম্রাটের বিশেষ দেবতুল্য স্থান নেই। স্প্যানিশ-পর্তুগীজদের সাথে আঁতাঁত করে খ্রীষ্টানরা জাপানকে বিদেশীদের হাতে তুলে দেবে, এ ভয় ছিল তাঁর। দেশকে সুসংহত করার পর চীনের মত জাপানের দুয়ারও তাই বিদেশীদের জন্যে বন্ধ করে দেয় তোকুগাওয়া শোগুনাত

তোকুগাওয়া আমলে (১৬০৩-১৮৬৭) তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল জাপান। নিষিদ্ধ খ্রীষ্টধর্মের জায়গা নেয় কনফুশিয়ানিজ়ম, সাথে আসে পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজন। মূলত কৃষিভিত্তিক আভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ছিল নগর আর গ্রামাঞ্চলের মাঝে। বন্দুকের বদলে সামুরাই তলোয়ার আবার একটি সম্মানজনক অস্ত্র হিসাবে স্থান পায়। হাইকু কাব্যচর্চা আর উডব্লক প্রিন্টিংয়েরও উৎকর্ষ সাধিত হয়

তোকুগাওয়ারা তাদের এই ‘সাকোকু’ নামক রুদ্ধদ্বারনীতি বেশ শক্তহাতে বাস্তবায়ন করে। জাপানে যদি ভুলেও কোন বিদেশী পদার্পণ করত, এমনকি জাহাজডুবি হয়েও, তাহলে তাদের শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। একই শাস্তি ছিল জাপানীদের কপালেও, যদি তারা স্বদেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশে পা রাখত। শুধুমাত্র ওলন্দাজ়দের সাথে ভাল সম্পর্কের খাতিরে দেজিমা দ্বীপে তাদের বাণিজ্যঘাঁটি রাখার অনুমতি দেয়া হয়।

ঊনবিংশ শতকে কয়েকটি ব্রিটিশ, ফরাসী, রুশ ও মার্কিন কুরোফুনে চেষ্টা করে রুদ্ধদ্বারনীতির পাশ কাটিয়ে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করতে। প্রতিক্ষেত্রেই জাপানীদের আগ্রাসী মনোভাবের কাছে তারা পরাস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত ১৮৫৩ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফিলমোরের কাছ থেকে চুক্তির প্রস্তাবনাপত্র নিয়ে আসে কমোডর পেরির নেতৃত্বে চারটি যুদ্ধজাহাজ।

কুরোফুনে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসময় ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হয়েছে তিন বছরও হয়নি। ক্যালিফোর্নিয়ার বন্দর সান ফ্রান্সিস্কো থেকে তিমিশিকারী জাহাজ উত্তরে বেরিং প্রণালী পর্যন্ত যাওয়াআসা শুরু করে। কিন্তু একবার প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ফেললে তাদের স্টীমশিপের কয়লার মজুদ যেত ফুরিয়ে। প্যাসিফিকের অন্যপারে তাদের কোলিং স্টেশনের দরকার ছিল খুব। ইউরোপীয়রা জাপানে আসতো পশ্চিমদিক থেকে। তাদের যাত্রাপথে এশিয়া-আফ্রিকার নানা বন্দরে জ্বালানি সংগ্রহের বন্দোবস্ত ছিল। মার্কিনদের এমন সৌভাগ্য ছিল না।

পেরি এদো (বর্তমান টোকিও) এসে পৌঁছালে জাপানীদের নির্দেশমত বৈদেশিক বন্দর নাগাসাকিতে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি জাপানী কর্মকর্তাদের বার্তা পাঠান যে তাঁকে তীরে অবতরণ করতে না দেয়া হলে জাহাজের কামান থেকে গোলা মেরে শহরকেন্দ্র ধ্বংস করে দেবেন। শক্তি প্রদর্শনের জন্যে কামান থেকে ফাঁকা আওয়াজের নির্দেশ দেন তিনি। তখনকার শোগুন ছিলেন মৃত্যুপথযাত্রী। যথাযথ নেতৃত্ব দেবার লোক না থাকায় জাপানীরা পেরিকে নোঙর ফেলার অনুমতি দেয়। পেরি চুক্তির প্রস্তাব হস্তান্তর করে সে যাত্রা ক্ষান্ত দেন।

পরের বছর আবার ফিরে আসেন পেরি। ততদিনে জাপানীরা বহির্বিশ্বের চলমান পরিস্থিতির ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়েছে। জেনেছে পশ্চিমাদের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কথা। চীনের মত দানবীয় শক্তিকে সৈন্যসংখ্যার আধিক্য সত্ত্বেও কিভাবে ব্রিটেন কাবু করেছে প্রথম আফিম যুদ্ধে (১৮৩৯-৪২) , তাও তাদের গোচরে এল। বিশেষত দক্ষিণের দু’টি দাইমিয়ো এসব দেখেশুনে তোকুগাওয়াদের রক্ষণশীল নীতির সমালোচনা শুরু করে। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর জাপানীরা সিদ্ধান্ত নেয় জাপানকে বাণিজ্যের জন্য উন্মুক্ত করার। পেরির সাথে দ্বিতীয় মোলাকাতের সময় তোকুগাওয়ারা বাধ্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্ব আর বাণিজ্যের অসম চুক্তি স্বাক্ষর করে। তারপরে ফরাসী, ব্রিটিশ, জার্মানদের সাথেও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এধরনের অসম চুক্তির মাধ্যমেই পশ্চিমা দেশগুলি চীনের বেশ ক’টি বন্দরের লীজ় বাগিয়ে নিয়েছিল । জাপানেরও এমনটা হতে চলছিল।

কিন্তু জাপানীরা ক্রমান্বয়ে যেটা করল, তা চীনাদের ঠিক উল্টো।

নতুন করে বৈশ্বিক সম্পর্কস্থাপনের শুরুর ক’টি বছরে স্বাভাবিক কারণেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছিল। ১৮৬৮তে নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া শেষে চোশু ও সাৎসুমা নামক প্রগতিশীল দু’টি দাইমিয়ো তোকুগাওয়াদের রাজনৈতিক শক্তিকে হারিয়ে পনেরোবছরবয়েসী সম্রাট মিৎসুহিতোকে প্রকৃত রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তী এশিয়া-প্যাসিফিকের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের চেহারা — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

চীনাদের মত পশ্চিমাদের বর্বর বলে গালিগালাজ করে আরো গুটিয়ে যাবার পরিবর্তে মেইজি সম্রাট আর তাঁর অনুসারীরা অভিজাত শিক্ষানুরাগীদের পশ্চিমে পাঠাতে শুরু করেন। বিদেশের চালচলন দেখেশুনে এসে এসব শিক্ষানবিশ অল্প সময়ের মধ্যে জাপানকে পশ্চিমা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করে তোলে। চীনাদের মুখস্থ-বুলি-কপচানো, উপর-থেকে-চাপানো ‘নৈতিকতার’ পরিবর্তে যুক্তিতর্কভিত্তিক আলোচনার পরিবেশ গড়ে ওঠে। ১৮৬০ সালেই নিজেদের স্টীমশিপে করে আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত পাঠিয়েছিল জাপানীরা। জার্মানি-ফ্রান্স-ইতালি-ব্রিটেনেও দূত প্রেরিত হয়। চুক্তিসম্পাদনের পাশাপাশি রাষ্ট্রদূতদের কাজ ছিল এসব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, বিচারব্যবস্থা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানা, রাষ্ট্রপরিচালনা, সেনাবাহিনী, ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা হল জাপানে। বিশেষ করে জাপানীদের সামরিক শিক্ষা, ইউনিফর্ম, নিয়মানুবর্তিতা — এসবের উপর জার্মান রাজ্য প্রুশিয়ার সেনাধ্যক্ষদের ‌অনেক বড় প্রভাব ছিল।

এসব সংস্কার অবশ্য খুব সহজে হয়নি। তোকুগাওয়াপন্থী বিদ্রোহীদেরকে প্রথমে দমন করতে হয় মেইজিপন্থীদের (বোশিন যুদ্ধ, ১৮৬৮)। তারপর সামন্ততন্ত্রের অবসানের পরে ভূমিসংস্কারবিরোধী দাইমিয়োরা বিদ্রোহ করে বসে (সাৎসুমা বিদ্রোহ, ১৮৭৭)। জমির মালিকানা কৃষকদের বুঝিয়ে দেয়া হলেও তারা ভূমিকর আইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে (চিচিমা বিদ্রোহ, ১৮৮৪)। বিপুল সংখ্যায় সামুরাই যোদ্ধাও ছিল সরকারের ভাতাভোগী হিসাবে। তাদের সে ভাতা বন্ধ করে দেয়া শুরু হলে তাদের থেকেও বিরোধিতা আসে (আকিজ়ুকি ও অন্যান্য বিদ্রোহ, ১৮৭৬) । কিন্তু এসবের প্রতিটায় পশ্চিমা সামরিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে তৈরি নতুন সেনাবাহিনী বিজয়ী হয়। পরাজিত পক্ষগুলি অনন্যোপায় হয়ে নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়। যেসব দাইমিয়ো মুৎসুহিতোকে সাহায্য করেছিল, তারা পুরস্কৃত হয় গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদমর্যাদা আর অভিজাত পদবী পেয়ে।

১৮৮৯ সালে রাষ্ট্রতন্ত্র প্রনয়ণের মাধ্যমে জাপান পরিণত হয় কনস্টিট্যুশনাল মনার্কিতে। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়, শুরু হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। প্রথমে ধনবান পুরুষ নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয়, আর বিশের দশকের মধ্যে ভোটাধিকার সম্প্রসারিত হয় সকল নাগরিকদের জন্যে। সামুরাইদের অস্ত্রধারণের এতদিনের একচেটিয়া অধিকার সকল স্বাধীন নাগরিককে দেয়া হয়। বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার ফলে স্বাক্ষরতার হারও দ্রুত বাড়তে থাকে। আধুনিক অস্ত্র বানানোর স্থানীয় কারখানা গড়ে ওঠে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সম্পত্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়। আর কনফুশিয়ান পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিভাজন সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত করা হয়।

বাণিজ্যের অগ্রগতির সাথে জাপানের স্টীমশিপের বহরও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। কূটনীতিক মিশন পাঠিয়ে পশ্চিমা দেশগুলির সাথে অসম চুক্তিগুলিকেও সংশোধন করতে সমর্থ হয় মেইজি সরকার। রেশমশিল্পের আধুনিকায়নে বৈদেশিক অর্থায়ন আসা শুরু করে। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে অংশ নিয়ে বনেদী কিছু সামুরাই পরিবার অর্থবান ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। মিৎসুই-মুৎসুবিশি সেরকমই দুটো পরিবার। এধরনের পরিবারের মালিকানাধীন কম্পানিগুলিকে বলা হয় জ়াইবাৎসু। শিল্পায়নের সাথে দ্রুত নগরায়ন ঘটে, গ্রামাঞ্চলের কৃষিনির্ভর পরিবারগুলি শহরমুখী হয়।

মেইজি জাপানের সফলতার কারণ বোধ করি তাদের দূরদর্শিতা। পেরির জোরাজুরির প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে করিৎকর্মা জাপানীরা পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সাথে দ্রুত তাল মিলিয়ে পা ফেলতে শুরু করে। ফন্দিবাজ পশ্চিমাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত চুক্তি সম্পাদন আর সেসব রক্ষা করতে সক্ষম হয় তারা। সংস্কারের ধাঁপে ধাঁপে জাপানের শাসকগোষ্ঠী ও প্রিভিলেজড ক্লাস আর তাদের সাথে জড়িত পশ্চিমা শিল্পপতিদের ইনসেন্টিভ ছিল বলে তারা এ প্রক্রিয়ায় অর্থবহ অবদান রাখতে সমর্থ হয়। পশ্চিমা ধ্যানধারণাগুলি ভালভাবে নিরীক্ষা করে জাপানীরা সেসবের ভালগুলি বেছে নিজেদের দেশে চালু করে, নিজেদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে আগলে রেখেই।

আর এই দ্রুত প্রগতির পথে পদার্পণের কারণেই আমার মনে হয় জাপানের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ছিল অবধারিত। সে আলোচনা হবে পরে কোন এক সময়।


(১) চীনাদের কাছে সম্রাট ছিলেন তিয়ানজ়ি বা স্বর্গীয় পুত্র। তাঁর শাসন করার অধিকার স্বর্গ থেকে আরোপিত। যদি সম্রাট অন্যায্য কাজ করেন ও যুদ্ধ বা বিদ্রোহে তাঁর পরাজয় ঘটে, তাহলে ধরে নেয়া হত তিনি সে স্বর্গীয় অধিকার হারিয়েছেন। চীনের রাজকীয় নাম ছিল তিয়েন মিং, স্বর্গীয় সাম্রাজ্য। তিয়েন শিয়া, বা স্বর্গের নিচে যা কিছু রয়েছে, এসকলের ওপর স্বর্গপুত্রের অধিকার।
একইভাবে জাপানের সম্রাটকে ডাকা হত তেন্-নো বলে। তিনি স্বয়ং সূর্যদেবী আমাতেরাসুর বংশধর। ভিয়েতনামের সম্রাটের পদবী সেরকম ছিল তিয়েন-তু।
আমাদের দেশের মুঘল রাজদরবারের থেকে খুব একটা আলাদা নয় ব্যাপারটা! মুঘল সম্রাটের অন্যতম পদবী ছিল ফিরদাউস আশিয়ানা — ডোমেইন অফ প্যারাডাইজ়।
চীনের প্রথম সম্রাটকে গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা নিয়ে ‘হিরো’ বলে একটা মুভি দেখেছিলাম। তাতে দেখেছি এই তিয়েন শিয়া ধারণার মাধ্যমে চীনের বর্তমান টপ-ডাউন সিংগল-পার্টি শাসনব্যবস্থাকে রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। [Mandate of Heaven]

(২) চ্যংহো ছিলেন মিং ইয়ংল্য সম্রাটের দরবারের প্রভাবশালী মুসলিম খোঁজা। তিনি সাতবার সম্রাটের নির্দেশে সাগরপাড়ি দেন। সাথে ছিল বিশাল বিশাল ট্রেজ়ারশিপ। দক্ষিণ চীন সাগর আর ভারতীয় মহাসাগরের উপকূলের বিভিন্ন দেশে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য নয়, এসব দেশের শাসকদের কাছ থেকে চীনসম্রাটের প্রতি আনুগত্য আর উৎকোচ আদায় করা। বাংলার সুলতানের দরবার থেকেও চীনসম্রাটকে উপহার পাঠানো হয় চ্যংহোর জাহাজে। আফ্রিকা থেকে জিরাফসহ বেশ কিছু অদ্ভূত বুনোপ্রাণী চীনে নিয়ে যাবার পর সেদেশে বেশ সাড়া পড়ে যায়। শ্রীলংকা আর মালাক্কার শাসকরা চীনসম্রাটের আনুগত্য অস্বীকার করে চ্যংহোকে আক্রমণ করায় তাদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে বন্দি করে মিং সম্রাটের দরবারে হাজির করা হয় নাকে খত দেবার জন্যে। ইয়ংল্য সম্রাটের মৃত্যুর পর খোঁজামহল তাদের রাজনৈতিক প্রতিপত্তি হারায় ম্যান্ডারিন আমলাদের কাছে। ম্যান্ডারিনদের মন্ত্রণায় নতুন সম্রাট নৌবহর ধ্বংস করে দিয়ে ‘হাইজিন’ বা ভারতীয়দের মত কালাপানির আইন চালু করেন। [Ming treasure voyages]

(৩) জাপানীদের ‘রেড সীল’ বা ‘লালমোহর’ নৌবহরের এরকম নামের কারণ তারা তোকুগাওয়া শাসকের প্রদত্ত লাল রঙের মোহরাংকিত খামে বাণিজ্যের অনুমতি নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করত। তোকুগাওয়ার পত্রে বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি তাদের প্রতিরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। জাপানী শোগুনের পাশাপাশি ইউরোপীয়রাও রেড সীল জাহাজদেরকে জলদস্যুদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সাহায্য করত। জাহাজগুলির কাপ্তানদের মধ্যে জাপানী যেমন ছিল, সেরকম চীনা, ডাচ, ইংরেজ, পর্তুগীজরাও ছিল। জাহাজের পাল-হাল ইত্যাদির গড়নও ছিল চীনা আর ইউরোপীয় সংকর। সাথে ছিল আত্মরক্ষার জন্য কামান। ১৬০০ থেকে ১৬৩৫এর মধ্যে এরকম ৩৫০টি জাহাজ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ফিলিপিন, ভিয়েতনাম, ক্যাম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডের বিভিন্ন রাজ্যে যাত্রা করে। [Red seal ships]

(৪) শোগুন অর্থ সামরিক শাসক। শোগুনের সম্পূর্ণ জাপানী পদবীর অর্থ ‘বর্বরদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সর্বাধিনায়ক’। জাপানের ইতিহাসে বহুবার বিভিন্ন সামুরাই পরিবার সম্রাটকে প্রতীকী স্থানে রেখে নিজেরাই রাষ্ট্রচালনা করত। তোকুগাওয়া শোগুনদের আগে কামাকুরা-আশিকাগা প্রমুখ শোগুনাতও জাপান শাসন করে এসেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে এরকমই সামরিক উগ্রপন্থীরা সম্রাটকে সিম্বলিক লীডার মেনে নিজেরাই পররাষ্ট্র ও আভ্যন্তরীণ নীতি পরিচালনা করত। [Shōgun]

(৫) অদ্ভূত ছন্দ আর শব্দস্বল্পতার অভিনবত্বের কারণে জাপানী হাইকু কাব্য এখন পশ্চিমে বেশ জনপ্রিয়। ১৬৭০এর দশকে তোকুগাওয়া আমলে হাইকুর উদ্ভব।
জাপানের সবচে’ খ্যাতিমান উডব্লক প্রিন্টেড শিল্পকর্ম ‘দ্য গ্রেট ওয়েভ অফ কানাগাওয়া’ (১৮৩০)। এর শিল্পী হোকুসাইয়ের জীবতকাল ছিল তোকুগাওয়াদের শেষভাগে। বেলজিয়ামের আন্টওয়ের্প বন্দরে জাপানীদের উডকাট শিল্প দেখে আকৃষ্ট হন ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকর ভ্যানগগ। তাঁর সংগ্রহে প্রচুর জাপানী শিল্পকর্ম ছিল। ভ্যানগগের ছবিতেও জাপানী প্রভাব উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে ‘আইরিসেস’ সিরিজ দেখলে বোঝা যায় জাপানী প্রকৃতিপ্রেম আর অংকনশৈলী ছিল ভ্যানগগের অনুপ্রেরণা। [The Great Wave off Kanagawa]

(৬) এই লেখাটি পড়ুন। [Opium Wars]

(৭) ১৮৪০এর প্রথম আফিম যুদ্ধের আগে চীনের একমাত্র ক্যান্টন (গুয়াংচৌ) বন্দরে বিদেশীদের বাণিজ্যের অনুমতি ছিল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধে পরাজিত হয়ে চিং সাম্রাজ্য ‘চিরতরে’ হংকং হারায় (১৯৯৭ পর্যন্ত)। একইসাথে শাংহাইসহ পাঁচটি বন্দরে ঘাঁটিস্থাপনের অধিকার আদায় করে নেয় ব্রিটিশরা। এগুলিকেই বলা হত ‘ট্রিটি পোর্ট’। ব্রিটিশদের পরে ফরাসী আর মার্কিনরাও এ ধরনের অসম চুক্তি করে চীনের সাথে। এসব চুক্তির একটা শর্ত ছিল একস্ট্রাটেরিটরিয়ালিটি, অর্থাৎ কোন বিদেশী অপরাধ করলে স্থানীয় আইনে তার বিচার করা যাবে না, করতে হবে তার স্বদেশে। এভাবে প্রচুর বড় বড় অপরাধী নিস্তার পেয়ে যেত। দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধের পর ১৮৬০এ আরো প্রায় আশিটি বন্দর এভাবে ট্রিটি পোর্টে পরিণত হয়। এসব পোর্টে বিদেশীজের জন্যে বিশেষ এলাকা আলাদা করে দেয়া ছিল। সেখানে তারা স্বদেশী সৈন্যদের নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্যে আরামের জীবন কাটাত। পরে লাতিন আমেরিকার কিছু দেশ, অস্ট্রিয়া, ইতালি, পর্তুগাল, নরওয়ে, রাশিয়া, বেলজিয়াম, জার্মানি, জাপানও এধরনের সুবিধাভোগ করে। বিশেষ করে জাপান অত্যন্ত অন্যায্য কিছু সুবিধাভোগের জন্যে চীনকে জোরাজুরি করার কারণেই যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমারা তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের জার্মানদের পক্ষে যোগ দেয়ার এটা একটা কারণ। [Treaty ports]

(৮) ‘দ্য লাস্ট সামুরাই’ নামে ২০০৩এ টম ক্রুজের অভিনীত একটি হলিউডি চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে স্বাধীনচেতা সামুরাইদের অন্তিম চিত্র। চলচ্চিত্রটির অনুপ্রেরণা সাৎসুমা অঞ্চলের সামুরাই বিদ্রোহের সত্য ইতিহাস। আর টম ক্রুজের মত জাপানে নানবান ও মেইজি যুগে প্রচুর পশ্চিমা ‘কাউবয়’ অ্যাডভেঞ্চারার জাপানীদের পাশাপাশি যুদ্ধ করেছে, তাদের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করেছে। [The Last Samurai]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!