আফ্রিকার দাসবাণিজ্য

হাতির দাঁতে বানানো অসাধারণ এ মুখোশটি প্রদর্শিত হচ্ছে নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়ামে। তৈরির স্থান পশ্চিম আফ্রিকার বেনিন সাম্রাজ্য, কাল আনুমানিক ১৫২০। মডেল, সাম্রাজ্যের অধিকর্তার (ওবা) রাণীমাতা স্বয়ং। মাতৃকুলীন সমাজব্যবস্থায় তাঁর অপরিসীম প্রভাব ছিল, যেটা নিখুঁতভাবে উঠে এসেছে তাঁর প্রতিচ্ছবিতে।

হাতির দাঁতে তৈরি বেনিনের রাণীমাতার আদলে মুখোশ, নিউ ইয়র্ক মেট মিউজিয়াম, ষোড়শ শতক।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপীয়দের ধারণা ছিল আফ্রিকার মানুষ উন্নত সভ্যতা স্থাপনের উপযুক্ত নয়। এ চিন্তার মূলে দাসপ্রথা আর বহু শতক পূর্বের দু’জাতের সমতাপূর্ণ সম্পর্কের বিস্মরণ। তারপর আবিষ্কৃত হয় কিছু অসাধারণ ব্রোঞ্জ মূর্তি, আর বেনিন রাজ্য থেকে লুটতরাজ করে ব্রিটিশরা নিয়ে আসে এরকম কিছু প্রাচীন নিদর্শন। এসব মন্দ কাজের ভাল প্রতিফলও আসে। পশ্চিমা গবেষকরা ত্রিশের দশক থেকে নতুন করে আফ্রিকার প্রাচীন ইতিহাস উদ্ঘাটনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

ফিরে আসি মুখোশ প্রসঙ্গে। একটু খেয়াল করে দেখলে মুখোশের চারধারে একটা অদ্ভূত জিনিস চোখে পড়বে। রাণীমাতার কোঁকড়ানো চুলের একেকটি বিনুনি কিন্তু চুল নয়! অদলাবদলি করে মাডফিশ নামে এক মাছের প্রতিকৃতি, আর এক পর্তুগীজ নাবিকের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়ব! (২য় ছবি)

বেনিনের রাণীমাতার মুখোশের ডিটেইল।

আইবেরিয়ান উপদ্বীপে মুসলিম শাসনের অবক্ষয়ের মধ্যে উত্থান স্বাধীন পর্তুগাল রাজ্যের। চতুর্দশ শতকে আরব প্রযুক্তি সম্বল করে একটি নাবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেন প্রিন্স হেনরি দ্য ন্যাভিগেটর। নতুন নতুন দূরপাল্লার সব জাহাজ তৈরি শুরু হয়। সেগুলি নিয়ে আটলান্টিকের তীর ধরে দক্ষিণে যাত্রা শুরু করে তারা। মূল লক্ষ্য, ইতালির জেনোয়িজ আর তুরস্কের অটোমানদের একচেটিয়া প্রাচ্যদেশীয় বাণিজ্যের বিকল্প পথ বের করা।

সেই অভিযানের প্রথম পর্ব আমেরিকা-ভারত নয়, ছিল আফ্রিকার আবিষ্কার। ১৪৬০ থেকে শুরু করে ১৪৯০এর দশক পর্যন্ত পর্তুগীজরা একে একে কাবো ভের্দে দ্বীপপুঞ্জ, সেনেগাল, গাম্বিয়া, সিয়েরা লেওন, নাইজেরিয়া, বেনিন প্রভৃতি অধুনা আফ্রিকান দেশগুলির উপকূলে অবতরণ করে।

এসব সাবসাহারান দেশগুলি মোটেও অনুন্নত ছিল না, কোন কোনটি ছিল পুরোদস্তুর সাম্রাজ্য। এদের মধ্যে মালি, বেনিন, সোনিনকে, মালিনকে ইত্যাদির নাম উল্লেখযোগ্য। কিছু কিছু জাতি সাক্ষর ছিল যেমন মালির তিমবাক্তু ইসলামী-আরবী সংস্কৃতির ধ্বজাধারী ছিল। আর বেনিন-নাইজেরিয়ার রাজ্যগুলি সাক্ষর না হলেও কাঠ, আইভরি, ব্রোঞ্জ শিল্পে অগ্রসর ছিল।

পর্তুগীজদেরকে এসব জাতি প্রথমে ভেবেছিল তাদের মৃত পূর্বপুরুষদের প্রত্যাবর্তিত আত্মা হিসাবে। তাদের ধর্মে সাগর ছিল জীবিত-মৃতের মধ্যে পৃথককারী পর্দা। পর্তুগীজদের শ্বেত বর্ণও তাদের সে ধারণার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ প্রথম সে মোলাকাতে আমেরিকার অ্যাজটেক-ইংকাদের মত শ্বেতাঙ্গদের দৈবশক্তির প্রতিনিধি হিসাবে ভাবার যথেষ্ট কারণ ছিল।

তারপর ধীরে ধীরে যত সময় গেছে দু’জাতির মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। পর্তুগীজ বণিকরা বেনিন, সাপি, কোংগো রাজ্যে তৈরি আইভরি বা হোয়াইট গোল্ড নিয়ে স্বদেশে বিক্রি করেছে। বিনিময়ে আফ্রিকার রাজ্যগুলি কিনেছে পর্তুগীজ আগ্নেয়াস্ত্র।

আজকে অনেকে আফ্রিকান বলতে একটি অভিন্ন জাতি ভেবে থাকলে ভুল ভাববেন। বিভিন্ন ভাষাপরিবারের বিভিন্ন গোষ্ঠী কালের পরিক্রমায় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হয়েছে। এদের মধ্যে সংঘাতও হয়েছে। উপকূলীয় রাজ্যগুলির জন্যে অভ্যন্তরের সাম্রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে বন্দুক ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

বিনি পর্তুগীজ সল্ট সেলারে চিত্রিত হয়েছে ইউরোপীয় যোদ্ধা, ষোড়শ শতক, ম্যুজে দ্য কে-ব্রঁলি

এছাড়াও পর্তুগালে ছিল সোনা, মরিচ ও রকসল্টের বিশাল চাহিদা। সেগুলিরও সাপ্লাই আসে পশ্চিম আফ্রিকার উপকূল থেকে। ৩য় ছবির বেনিন আইভরিতে তৈরি সল্টসেলারটিতে পর্তুগীজ যোদ্ধাকে চিত্রিত করা হয়েছে।

আরো যে রসদটির যোগান দেয় পর্তুগীজদের নেটিভ দোসররা তা হলো কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস। আটলান্টিকের দাসবাণিজ্যের শুরু কিন্তু এটা নয়। আফ্রিকার রাজ্যগুলিতে আগে থেকেই দাসপ্রথা ছিল। ভিন্নজাতের শত্রুদের পরাজিত করে দাস বানিয়ে তাদের গতর খাঁটানো হত। তাছাড়াও উত্তরের ‘বারবারি কোস্টের’ মুসলিম রাজ্যগুলি দাসব্যবসা করত। একই রকম অবস্থা বিরাজমান ছিল ভারত মহাসাগরের উপকূলে। সেখানে জানজিবার দ্বীপ ছিল আরবে দাস রপ্তানির ঘাঁটি।

পর্তুগীজ-স্প্যানিশ ও পরবর্তীকালের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা কিন্তু চাইলেই হৈচৈ করে আফ্রিকান দাস ধরে নিয়ে যেতে পারত না। আফ্রিকার অভ্যন্তর অঞ্চলে ঢোকার সাধ্য তাদের ছিল না। কারণ জলাজঙ্গলের ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগশোককে তারা ভীষণ ভয় পেত। আর কম লোকবল নিয়ে বিশাল সেনাশক্তির সাম্রাজ্যগুলির মোকাবিলা করার সাহস-সামর্থ্যও তাদের ছিল না। আফ্রিকার কলোনিয়ালাইজেশন তুলনামূলক অধুনার ইতিহাস — মোটে ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। ততদিনে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতকের পশ্চিমাদের মত মধ্যযুগীয় পর্তুগীজরা যে কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এরকম মনোভাব পোষণ করেনি। বরং তারা নিজেদের পড়শী গ্রানাদার মুসলিম রাজ্যগুলিতে দেখেছে শ্বেতাঙ্গ খ্রীষ্টানদের ধরে দাস বানানো হয়েছে। কোন ক্ষেত্রে অনেক ইউরোপীয় দেশে ঋণগ্রস্তরাও দাসে পরিণত হত। অপরদিকে তুরস্ক ও উত্তর আফ্রিকার সুলতানরাও দরিদ্র শ্বেতাঙ্গ দেশগুলি থেকে ক্রীতদাস পাচার করত। তাদের অনেকে ছিল সেক্সুয়াল স্লেভ যাদের স্থান হত সুলতানের হারেমে — ছেলে-মেয়ে দুইই।

অর্থাৎ পর্তুগীজদের সাথে প্রথম মোলাকাতের পর আফ্রিকার একাধিক প্রভাবশালী রাজ্যই তাদের দাস সাপ্লাই দিয়েছে। আর কৃষ্ণাঙ্গ মানেই দাস এটাও ইউরোপে ছিল না। ৪র্থ ও ৫ম ছবিতে রেনেসাঁস যুগে অংকিত চিত্রকর্মে বনেদী কৃষ্ণাঙ্গ দুই ব্যক্তির ছবি দিয়েছি। সত্যি বলতে একটা সময় দাস আর বনেদীবংশ মিলে কৃষ্ণাঙ্গরা লিসবন শহরের জনসংখ্যার দশ শতাংশ হয়ে যায়।

১৫৭০ থেকে ১৫৮০র মধ্যে আঁকা এ ছবিতে পর্তুগালের লিসবন বন্দরের দৈনন্দিন দৃশ্য দেখানো হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গ ঘোড়সওয়ারের পাশাপাশি আরো বেশ কিছু কসমোপলিটান ব্যাপারস্যাপার চলে এসেছে।
১৫২০/২৫এ ডাচ চিত্রকর ইয়ন মোশতারতের আঁকা পোরট্রেট অফ অ্যান আফ্রিকান ম্যান।

দাসবাণিজ্যে জোয়ার আসতে শুরু করে আমেরিকার আবিষ্কার ও স্প্যানিশদের প্রতিপত্তি বাড়ার সাথে সাথে। একটি ত্রিমুখী বাণিজ্যের সূচনা হয় ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে। আফ্রিকা থেকে ‘কাঁচামাল’ নিয়ে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে খালাস। সে ‘কাঁচামালের’ শ্রমে উৎপন্ন চিনি, রাম ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে ইউরোপের বাজারে বিক্রি। তারপর ইউরোপের বন্দুক ও ফিনিশড গুডস নিয়ে আফ্রিকায় যাত্রা, বিনিময়ে আবার ‘কাঁচামাল’ জাহাজে উঠানো।

আফ্রিকান শ্রমের এরকম এবিউজ হয়ত হত না যদি না কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তন পশ্চিম আফ্রিকার রাজ্যগুলিকে ওলটপালট করে দিত। প্রাচীন মালি সাম্রাজ্য ভেঙে তৈরি ছোট ছোট রাজ্যগুলির সাথে নতুন বড় সাম্রাজ্যগুলির সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। সপ্তদশ শতকে ঘানার আশান্তি সাম্রাজ্য বেশ প্রতাপশালী হয় ওঠে। কৃষিতে কিছু উন্নত প্রযুক্তি আবিষ্কারের ফলে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণের ফলে তারা উত্তরে ও পশ্চিমে মালিংকে রাজ্যগুলির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এর ফলশ্রুতিতে যুদ্ধলব্ধ দাসদের একটা বিশাল বাজার তৈরি হয়।

একই ঘটনা ঘটে আরেকটু পূর্বে। নবাগত দাহোমে জাতি মূল জনগোষ্ঠী এদোদের ওপর শাসন কায়েম করে। সে ব্যবস্থায় বিজিতরা ছিল দাস। দাহোমের উপকূলেও দাসরপ্তানিকেন্দ্র গড়ে ওঠে।

অর্থাৎ আফ্রিকার পলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপ ছিল আটলান্টিক দাসব্যবসার বিশাল আকারের অন্যতম বড় কারণ। ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচরা হয় সেই মার্কেটের এন্ড ইউজার। যদি আফ্রিকান মিডলম্যানরা বলত দাস সাপ্লাই বন্ধ, তাহলে ইউরোপীয়দের পক্ষে শ্রম আমদানির উপায় হত হয় ইনডেনচার্ড সার্ভিচ্যুড — যেটার শিকার দাসপ্রথাপরবর্তীকালে দরিদ্র আইরিশ-স্কটিশ-ইংলিশরা হয়েছে। নয়ত পেইড লেবার।

ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ব্রিটিশ আর মার্কিনরাই আবার প্রথম দাসব্যবসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে শুরু করে। প্রথমে নিজেদের বন্দরে ক্রীতদাস রপ্তানি নিষিদ্ধ করে এই শতকের প্রথমভাগে। এরপর ব্রিটিশরা জোরপূর্বক স্প্যানিশ-পর্তুগীজ জাহাজে হামলা চালিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্ত করত। ব্রিটিশ-ফরাসীরা উত্তর আফ্রিকার বারবারি কোস্টের সুলতানদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেসব রাজ্যের জলদস্যুতা আর শ্বেতাঙ্গ নাবিকদের ধরে দাস বানানোর প্রতিশোধ হিসাবে। (৬ষ্ঠ ছবি)

অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়ার তুর্কিসমর্থিত দা’ইয়ির রাজ্যে শ্বেতাঙ্গ দাসত্বের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় দেশগুলি শোরগোল তোলে। ব্রিটিশ এক কাপ্তানের বর্ণনা সম্বলিত এই পুস্তিকাটি প্রকাশিত হয় তখন। ১৮১৬ সালে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আলজিয়েরস আক্রমণ করে।

উনবিংশ শতকের মাঝামাঝি নতুন দাস রপ্তানি বন্ধ হলেও মার্কিনদের স্বদেশে এতদিনে যেসব কৃষ্ণাঙ্গ দাসের আগমন হয়েছে, তাদের দাস বংশধরদের মুক্তির কোন ব্যবস্থা হয়নি। তার জন্যে তাদের অপেক্ষা করতে হয় আরো কয়েক দশক ও একটি যুদ্ধের জন্য। পশ্চিমা ও পশ্চিমাশাসিত দেশগুলির মধ্যে সবচে’ শেষে দাসপ্রথা রহিত হয় পর্তুগীজ ব্রাজিলে — ১৮৮০র দশকে।

আরব দেশগুলিতে দাসবাণিজ্য চলে ত্রিশের দশক পর্যন্ত। প্রকারান্তরে এখনো তা চলছে। ৭ম ছবিতে মক্কার এক বণিকের পাশে তার শ্বেতাঙ্গ দাসকে দেখা যাচ্ছে। তার চেহারাতে পূর্ব ইউরোপীয় স্লাভিক ছাঁচ দৃশ্যমান। এরা অটোমান সাম্রাজ্যে পরিচিত ছিল সিরকাসিয়ান হিসাবে।

মক্কার হেজাজী সওদাগরের সাথে তার শ্বেতাঙ্গ সিরকাসিয়ান দাস, ১৮৮৬-৮৭

আফ্রিকান আমেরিকানদের বেদনাময় ইতিহাস এখনো মার্কিন রাজনীতিতে অহরহ আসে। এই বিতর্কে কতটা হিস্টরিকাল কনটেক্সট টানা হয় তা খুবই প্রশ্নসাপেক্ষ। এতে কোন সন্দেহ নেই, মার্কিনদের দাসপ্রথার ক্ষণস্থায়ী ও তুলনামূলক অধুনা ইতিহাসে এর আগের একাধিক শতকের ব্রিটিশ-ফরাসী-ডাচ-স্প্যানিশ-পর্তুগীজ ইতিহাস ঢাকা পড়ে গেছে।

আরো ঢাকা পড়ে গেছে আটলান্টিক দাসব্যবসার কৃষ্ণাঙ্গ মদদকারীদের ইতিহাস। পোস্ট কলোনিয়াল আফ্রিকার প্রথম স্বাধীন দেশ ঘানা। তার প্রথম প্রেসিডেন্ট কয়ামে ন্ক্রুমা প্যান-আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা (৭ম ছবিতে চে গেবারার সাথে)। তার হাত ধরেই আরো বহু সাবসাহারান দেশ স্বাধীন হয়। সেসব দেশের স্কুল কারিকুলামে পড়ানো হয় প্রাচীন আফ্রিকান দেশগুলির প্রতিপত্তি-অগ্রগতির কথা। বলা হয়, শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক শক্তিদের অত্যাচারের কথা। সবই খাঁটি কথা। কিন্তু শুধু চেপে যাওয়া হয় ন্ক্রুমার স্বগোষ্ঠী আশান্তিরাই যে ছিল অন্যতম মদদকারী দাসরপ্তানীকারী রাজ্য সে কথা। চেপে যাওয়া হয় পশ্চিম আফ্রিকার এলিট বংশগুলির কথা, যারা দাসব্যবসা করে স্বদেশে বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে ভাল একটি ভবিষ্যত দিয়ে গেছে।

কিউবার বিপ্লবী চে গেবারার সাথে ঘানার প্রেসিডেন্ট কওয়ামে ঙ্ক্রুমা, ১৯৬৫। চে সে যাত্রায় আটটি আফ্রিকান দেশ সফর করে বাছবিচার করেন কোন কোনটিতে বিপ্লবের উর্বর ক্ষেত্র রয়েছে।

২০১৯এ ওয়াল স্ট্রীট জার্নালে একটি সাড়াজাগানো আর্টিকেল লিখে আফ্রিকান জাতীয়তাবাদীদের রোষের শিকার হন আদাওবি নওয়াউবানি নামের এক নাইজেরিয়ান পুরস্কারবিজয়ী লেখক। আজকের পলিটিকাল ক্লাইমেটে কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অবিচার নিয়ে যারা সঙ্গত কারণেই সোচ্চার, আশা করি সেটা করার পাশাপাশি মুদ্রার এপিঠটাও তারা একটু উল্টে দেখবেন। আদাওবির লেখাটি পড়তে নিচের ছবিতে ক্লিক করুন।

ইউ পম গানা?

Featured Video Play Icon

“ইউ পম গানা?” মনে আছে নিশ্চয় অনন্ত জলিলের সেই ইন্টারভিউটার কথা? ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিংবা ‌অবচেতন মন থেকে হোক, জলিল সাহেব হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে বাঙ্গালীর বর্ণবাদী মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন।

বাঙ্গালী কতটা-কেন কৃষ্ণাঙ্গদের নিচুচোখে দেখে — সেটা নিয়ে বিতর্ক-গবেষণার অবকাশ আছে। হয়ত সুলতানি আমলে হাবশি ক্রীতদাসদের কূটচালে রাজা হওয়া দেখে প্রাথমিক খারাপ ধারণাটা তৈরি হয়েছে। তারপরে সম্ভবত ব্রিটিশ শাসকদের মাংকি-সী-মাংকি-ডু করে আফ্রিকানরা নিম্নগোত্রীয়, এই বিশ্বাসটা প্রগাঢ় হয়েছে। দ্য গডস্ মাস্ট বি ক্রেজ়ির মত ছবি আমার ছোটবেলায় সেই বিরূপ ধারণা ভাঙতে খুব একটা সাহায্য করেনি। (এর বিপরীতে অবশ্য ছিল কিং সলোমন’স মাইনসএর মত রোমাঞ্চকর উপন্যাস!)

আজকের ট্র্যাকটা পছন্দ করলাম বাঙ্গালী স্টেরেওটাইপিংটাকে যদি কিছুটা নড়বড়ে করে দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যে। গানের কণ্ঠশিল্পী ভ়িও ফ়ার্কা তুরে মালির অধিবাসী। বাবা আলি ফ়ার্কা তুরেও ছিলেন বিশ্বখ্যাত মিউজিশিয়ান। বিশ্বের কাছে মালির ট্র্যাডিশন্যাল গানবাজনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পিছনে তুরে সিনিয়র আর সিদকি ও তুমানি দিয়াবাতে বলে পিতা-পুত্র ‘কোরা’-বাদকের অনেক অবদান আছে।

যারা মার্কিন ব্লুজ় শুনেছেন, বিশেষ করে জন লী হুকারের গান, তারা এটা শোনামাত্রই বুঝবেন কতটা মিল! এর কারণ পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সাথে এই ধরনের সঙ্গীত আমেরিকায় আসে। তাদের সুরগুলি গীটারের জন্যে খুবই মানানসই ছিল। নতুন দেশে নিজেদের ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেললেও তারা সঙ্গীতকে হারায়নি।

এ ঐতিহ্য পশ্চিম আফ্রিকায় এক-দুই শতাব্দীর পুরনো নয়, কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর ধরে তারা সভ্যতার সাথে পরিচিত। মালির জেন্নে শহরে ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নগরসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতার মত নদীতীরে গড়ে উঠেছিল; সে নদীর নাম নিঝ়ের বা নাইজার — যার নামে নিঝ়ের ও নাইজেরিয়া দেশদু’টির নাম। আরবরা এই নদীর ডাকনাম দিয়েছিল ‘কৃষ্ণাঙ্গদের নীলনদ’।

অনন্ত জলিল যে গানা দেশটার নাম আমাদের কাছে সুপরিচিত করলেন, সেটা আসলে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান একটা শক্তিশালী সাম্রাজ্যের নাম। ব্রিটিশ ঔপনেবিশকতা থেকে সর্বপ্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত আফ্রিকার স্বর্ণসমৃদ্ধ দেশটির নাম গোল্ড কোস্ট থেকে পরিবর্তন করে রাখা হয় গানা। অষ্টম শতকে আরবরা উত্তর আফ্রিকাবিজয়ের পরে তাদের বাণিজ্যের কাফেলা সাহারার দক্ষিণেও বিস্তৃত হয়েছিল। গানা সাম্রাজ্যের শহরগুলি এ সময় ছিল সোনা-লবণ রপ্তানির মূল কেন্দ্র। গানার শাসকরা পরে ইসলামগ্রহণ করে নিজেদের রাজবংশকে আরো বৈধতা দেয়। তা হলেও অনেক প্রাক-ইসলামিক নিয়ম রয়ে গেছিল। যেমন মাতৃবংশীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থা, যে কারণে এক রাজার পরের রাজা হত তার ভাগ্নে, ছেলে নয়!

গানা সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পরে সেখানে অভ্যুদয় ঘটে মালি বা মান্দে সাম্রাজ্যের। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর এ রাজ্য সমৃদ্ধির শিখরে ছিল মোঙ্গলদের পরেই সেসময়ের সবচে’ বিস্তৃত সাম্রাজ্য। ইবনে খালদুন-ইবনে বতুতা মালি ভ্রমণের সময় তাদের বিপুল সামরিক লোকবল দেখে যেমন অভিভূত হয়েছিলেন, তেমনি অবাক হয়েছিলেন নারীপুরুষের একত্রে ওঠাবসা দেখে। মালির এক রাজা, বা মান্সা, মুসা কেইতা হজ্জ্বে গিয়েছিলেন বিশাল দলবল আর প্রচুর সোনা নিয়ে। তিনি যাত্রাপথে যেখানেই থেমেছেন সেখানেই বিলাসদ্রব্য কিনতে, এমনকি ভিক্ষা দিতেও, সোনা ব্যয় করেছিলেন। তাতে তখনকার পৃথিবীর সোনার সাপ্লাই রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বারো বছর ধরে নাকি সোনা অবমূল্যায়িত ছিল! মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়রাও এই কাহিনী অবগত ছিল, তাই তাদের তৈরি মানচিত্রে তিম্বাক্তু শহরের অবস্থান দেখানো শুরু হয়।

মালি সাম্রাজ্য স্থাপত্যশৈলী আর জ্ঞানবিজ্ঞানেও এগিয়ে ছিল। তাদের তৈরি অসাধারণ মসজিদ-মাদ্রাসা-মিনারগুলি এখনো তিম্বাক্তু, গাও শহরে দেখা যায়। সাঙ্কারে বলে এক মাদ্রাসায় গোটা বিশ্ব থেকে মনীষীরা আসতেন জ্ঞান আদান-প্রদানের জন্যে। মিশরের প্রাচীন আলেকজ়ান্দ্রিয়া লাইব্রেরির সাথে টেক্কা মারার মত পান্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল সেখানে।

মালি সাম্রাজ্যের অবনতির কারণ ছিল তাদের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, যেটার সুযোগ নিয়ে পড়শী সঙায় সাম্রাজ্য তাদেরকে পরাজিত করে। সেই যুদ্ধে মালির শাসকরা নব্য পরাশক্তি পর্তুগীজদের সাহায্য চেয়েছিল। জেনে হয়ত অবাক হবেন যে ইউরোপীয়রা সাম্রাজ্যবিস্তারের সুযোগটা তখন নেয়নি, তারা এটাকে মালির আভ্যন্তরীণ সমস্যা ভেবে পাশ কাটিয়ে গেছিল। অবশ্য সমুদ্রউপকূলে পর্তুগীজদের কেল্লা ছিল, সেসব থেকে তারা ইউরোপে ক্রীতদাস রপ্তানি করত। তাদেরকে লোক্যাল সাপ্লাই দিত কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ দালালরাই!

মালির পরে সঙায় সাম্রাজ্য বেশিদিন টেকেনি। পর্তুগীজ নয়, মরক্কোর সুলতানের পাঠানো সেনাবাহিনীর গোলন্দাজদের কাছে তারা হার মানে। সেই পরাজয়ের পরে গোটা সাম্রাজ্য ভেঙে অসংখ্য টুকরো হয়ে যায়, যারা নিজেদের মধ্যে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করে। ঊনবিংশ শতকে ফরাসীরা এদেরকে বশে এনে উপনিবেশ বানায়। তারপর ষাটের দশকে একে একে অনেকগুলি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। গানা, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মরিতানিয়া, গিনি, গিনি-বিসাউ, বুরকিনা ফাসো, নাইজেরিয়া, নিঝ়ের — এদের সকলেই গানা-মালি-সঙায়দের প্রাচীন ঐতিহ্যের দাবিদার।

‘পম গানা?’ প্রশ্নের উত্তর একটু লম্বা-চওড়া হয়ে গেল, অতএব ক্ষান্ত হলাম!
***

[সাফারে গানটার বিষয়বস্তু অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও বের করতে পারিনি। ফরাসী কোন ওয়েবসাইটেও লিরিক-ট্রান্সলেশন নেই। ইচ্ছে ছিল এ‌ই গানটার বদলে আলি ফ়ার্কা তুরের ‘আল্লা উইয়া’ গানটা শেয়ার করার, কিন্তু সেটার কোন লাইভ পারফর্ম্যান্স পেলাম না। লাইভে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যেভাবে দেখা যায়, স্টুডিও রেকর্ডিংয়ে সেটা সম্ভব নয়। আগ্রহী হলে এখানে শুনুন ‘আল্লা উইয়া’।]

সাহারার তুয়ারেগ

Featured Video Play Icon

উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরোক্কো — এই দেশগুলিকে আমরা জানি আরব-অধ্যুষিত হিসাবে। কিন্তু এই এলাকার আদিবাসীরা আরব নয়, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানও নয়। গ্রীক-রোমান-যুগ থেকে তাদেরকে ভিনদেশীরা চেনে ‘বেরবের’ নামে; যদিও তারা নিজেদের বলে ‘আমাজ়িগ’ — যার অর্থ মুক্ত মানুষ। এখন মূলত আরবী বা ফরাসীতে কথা বললেও উপরের দেশগুলির একটা বড় জনসংখ্যা বেরবের।


জ়িনেদিন জ়িদানের বাবা-মা আলজেরিয়ার কাবিল উপজাতির আমাজ়িগ। মরোক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতাও ছিলেন আমাজ়িগ বংশোদ্ভূত। খ্রীষ্টান সেন্ট অগাস্টিনও তাই। রোমসম্রাট সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের ধমনীতেও ছিল বেরবের বংশধারার রক্ত। রোমের সৈন্যদলের একটা অংশও একসময় ছিল বেরবের মাউরি যোদ্ধাদের দিয়ে তৈরি, যাদের নাম থেকে পরে মুর বা মোরো শব্দটা এসেছে।


তারিক ইবনে জ়িয়াদ ছিলেন আরব-বিজিত ইফ্রিক্বিয়া (এখনকার তিউনিসিয়ায়) প্রদেশের গভর্নর মুসা ইবনে নুসাইরের ক্রীতদাস। জ়ানাতি বেরবের বংশে তার জন্ম, তাঁকে মুক্তিদানের পরে অষ্টম শতকে আরব-বেরবের সৈন্যদল নিয়ে উমাইয়্যা খলিফাদের হয়ে স্পেনবিজয় করেন। তার নামেই জিব্রাল্টার (জাবাল-আল-তারিক)।


স্পেনের দ্বাদশ শতাব্দীর রাজবংশ আলমোহাদ-আলমুরাবিতরা ছিল আরবীকৃত বেরবের। এসময় স্পেনের জামিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউরোপীয়রা দর্শন-বিজ্ঞানের শিক্ষা পেয়েছে মাইমোনিডিস-ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের মত মনীষীদের লেখা পড়ে। আলহামরা প্রাসাদের মুরিশ শিল্পশৈলী বেরবের-আরবদের যৌথ অবদান। আরব-বেরবের রান্নাও বিশ্বখ্যাত, যেকোন মরোক্কান রেঁস্তোরাতে সেটা আস্বাদন করতে পারবেন।


উমাইয়্যা আরব শাসনের সময় এই মুক্ত জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে আরবী কৃষ্টি আর অনারব দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে ফরাসী-ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী চাপিয়েছে ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতি। প্রতিবারই তারা বিদ্রোহ করেছে।


নিচের গানটা তু্য়ারেগ নামে আমাজ়িগদের একটা বড় উপজাতির শিল্পীদের গাওয়া, সাথে মার্কিন ব্লুজ মিশানো, মালির কৃষ্ণাঙ্গ ঘরানারও প্রভাব আছে। দলটার নাম তিনারিওয়েন, গানের ভাষা তামাশেক। তুয়ারেগদের বাস আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, মালি, নিঝ়ের, বুরকিনা ফাসোর দেশসীমাবিহীন সাহেল নামে সাহারা মরুভূমির পশ্চিমাংশে। যাযাবর এই গোত্রের অন্নসংস্থানের উপায় গোচারণ আর ‘সাবসিস্টেন্স ফার্মিং’।


তিনারিওয়েনের সদস্যরা উত্তর মালির সাহারার বাসিন্দা। ষাটের দশকে মালি স্বাধীন হবার সময়ে তামাশেকরা চেয়েছিল নিজেদের জন্যে আলাদা দেশ — আজ়াওয়াদ। তার পরিবর্তে সোভিয়েত-সমর্থিত মালির কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান একদলীয় শাসকরা তুয়ারেগদের অধিকার পদদলিত করার ফলে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রাণ হারায় অনেক নির্দোষ তুয়ারেগ, গৃহহারা হয় আরো অনেক।


এই গানটার ভোক্যাল ইব্রাহিম আগ্ আলহাবিবের চার বছর বয়সে তার বাবা সেই বিদ্রোহে প্রাণ হারায়। পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে এই এতিমরা ঘুরে বেড়ায় আলজেরিয়া-লিবিয়ার এক রেফ্যুজি ক্যাম্প থেকে আরেকে। গীটার শিখে পশ্চিমাগানের সাথে তুয়ারেগ সঙ্গীত মিলিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সাথে সাথে হাতে অস্ত্রও তুলে নেয় নব্বইয়ের দশকের আরেক বিদ্রোহে। ২০০০এর দশকেও আরেকটা বিদ্রোহ হয়। এরপরে একটা শান্তিচুক্তির ফলে তুয়ারেগদের অধিকার মালিতে মোটামুটি স্বীকৃত এখন। এই শান্তিচুক্তির পিছনে তিনারিওয়েনের মত দলের সাংস্কৃতিক গ্লোবাল আউটরীচের অবদান অনেক বড়।


তারপরেও ইউরেনিয়ামের মত খনিজ পদার্থ সংগ্রহ আর খরা-মরুকরণের ফলে চাষের সামান্যতম জমি ধ্বংস হওয়ায়, আর অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে, দরিদ্র সুন্নি সুফীমতানুসারী তুয়ারেগদের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক অভিযোগ আর কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে ফেরত সালাফী ইসলামী জিহাদীরা গাদ্দাফীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত-অস্ত্রসজ্জিত স্বাধীনতাকামী তুয়ারেগদের সাথে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে আরেকটা বিদ্রোহ করে, যার ফলে ঘরবাড়ি ছাড়া হয় ৬ লাখ মূলত তুয়ারেগই।


সেসময় ইসলামী কট্টরপন্থীরা মালির ঐতিহাসিক তিমবাক্তু শহর দখল করে নেয়, ‘শরিয়া আইন’ চাপিয়ে দেয় আর শহরটির ইউনেস্কোচিহ্নিত ঐতিহ্যবাহী মসজিদ-মিনার-মাজার এগুলোর ধ্বংসসাধন করে। ২০১০এ দক্ষিণ আফ্রিকার ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গানপরিবেশনকারী তিনারিওয়েনের এক সদস্যকেও তারা গ্রেফতার করে নির্যাতন করে আর গানবাজনা বন্ধ করে দেয়। ফরাসী সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মালির সরকার অবশেষে এদের হটাতে সমর্থ হয়। আর আজ়াওয়াদপন্থী স্বাধীনতাকামীরাও দল বদলে মালির সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এখনো মালিতে ফরাসী আর নিঝ়েরে মার্কিন সৈন্য আছে এসব দুর্গম অঞ্চলে জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রাখার জন্যে।


এই গানটিতে দেখবেন মুসলিম তুয়ারেগ পুরুষদের মুখ ঢাকা, কারণ তাদের আদি ঐতিহ্যে নারী নয়, পুরুষরাই মুখ ঢাকে! তুয়ারেগ নারীরা মাথায় কাপড় দিলেও সাধারণত পুরো মুখমন্ডল আবৃত করে না, আর সকল ধরনের কর্মকান্ডে সমান অংশগ্রহণ করে। অতীতের কোন এক সময় তুয়ারেগ পরিবারব্যবস্থা মাতৃকুলভিত্তিক ছিল বলেই নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা। এই গানে তেনেরে বলে সাহারার এক এলাকার অপার্থিব সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে মরুবাসী তুয়ারেগের অসহায়ত্ব বর্ণিত হয়েছে দুই শব্দে — আমান ইমান, পানিই জীবন।

গানের কথা আর অর্থ এখানে পাবেন।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!