হাসিদী ইহুদী

জেরুজালেমে উবার ডাকা মানে আসলে ট্যাক্সিই ব্যবহার করা, সেগুলি উবারের পার্টনার। যে চারজন ট্যাক্সি ড্রাইভারের সার্ভিস নিলাম, তাদের মোটে একজন ছিল হিব্রু, বাকিরা আরব।

সিটি অফ ডেভিডে সংরক্ষিত খ্রীষ্টপূর্ব জেরুজালেমের প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ দেখে তাড়াহুড়ো করে বেরুলাম। হোটেল থেকে চেকআউট করতে হবে। কিন্তু পুরো রাস্তা গাড়িভর্তি, উবার ডাকলে কখন এসে পৌঁছবে, খুঁজে পাব কিভাবে নানা চিন্তা। বুদ্ধি করে চলমান ট্যাক্সি দেখে হাত উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেলাম। সে ব্যাটা থেমে ইশারা করল ঢোকার জন্য।

পেছনের দরজা খুলতে গিয়ে দেখলাম সেখানে তখনো যাত্রী। কালো-সাদা পোশাক, মাথায় ফেদোরা টুপি, দাঁড়িওয়ালা, লম্বা জুলফি দুই আল্ট্রা-অর্থডক্স ইহুদী বসে আছে, কোলে বড় টুপির বাক্স। গিয়ে বসলাম সামনের সীটে ড্রাইভারের পাশে। পেছনের সীটের যাত্রীদের জানালাম “শালোম”, হাস্যমুখে উত্তর এল “শালোম আলেইখেম” — আমাদের সালাম আলাইকুম।

ড্রাইভার কয়েক ফীট গিয়ে পেছনের যাত্রীদের নামিয়ে দিল। বিদায়ী সম্ভাষণ জানালাম — “শানা তোভা”, শুভ নববর্ষ। এরা নামল মসজিদুল আকসার প্রবেশদ্বার লায়ন্স গেটের বিপরীত দিকে। সম্ভবত ওয়েস্টার্ন ওয়াল বা জুয়িশ কোয়ার্টারে যাবে।

ড্রাইভার যে আরব তার চেহারা দেখেই বুঝেছি শুরুতে। এবার সেই শুরু করল কথোপকথন। কোথা থেকে এসেছি, নাম কি ইত্যাদি। নাম শোনার পর প্রশ্ন, তুমি খ্রীষ্টান না মুসলিম? একটু ভ্রু কুঁচকেছিলাম, কারণ এ প্রশ্ন লেভ্যান্টের হচপচের বাইরে আর কেউ আমাকে করবে না! মুসলিম জানার পর ড্রাইভার স্বপরিচয় দিল, মাহমুদ, আরব মুসলিম। ওয়েস্ট ব্যাংকে চলমান সমস্যা নিয়ে কিছু কথা হল, সমব্যথিতা জানালাম।

কিন্তু সাথে সাথে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে পেছনের সীটে “হাসিদী” ভদ্রলোকেরা বসে ছিল, তাদের সাথে তোমাদের সমস্যা নেই? উত্তর এল, এরা? নাহ এরা কোন সমস্যা করে না, রাতদিন আল্লাবিল্লা করে। আমাদের সমস্যা “রেগুলার” ইসরাইলিদের সাথে।

তো সেই “রেগুলার” ইসরাইলি বলতে সে কি বোঝে, তা সুন্দরমত ব্যাখ্যা করে বলতে পারল না। তার পরিবার চার প্রজন্ম ধরে জেরুজালেমের বাসিন্দা, আট সন্তান ঘরে। ট্যাক্সি-উবার চালিয়ে অর্থসংস্থান ভালই হচ্ছে। জেরুজালেমে তেমন কোন ঝামেলা পোহাতে হয় না, কিন্তু তার মন টানে জেনিন-নাবলুসে নিপীড়িত স্বজাতির জন্যে। না, সেসব শহরে তার কোন নিকট স্বজন বা বান্ধব নেই।

যা হোক, এই “হাসিদীরা” আসলে কারা? এদের চেনার সবচেয়ে সোজা উপায় তাদের বেশভূষা। সবসময় সাদা-কালো জামা পরে থাকবে, লম্বা কোট টেল, মাথায় অধিকাংশ সময় ফেদোরা হ্যাট, ইয়া লম্বা বেনি করা জুলফি, মুখভর্তি দাড়ি। পোস্ট করা ভিডিওতে শাবাতের সন্ধ্যায় ওয়েস্টার্ন ওয়ালে গমনরত হাসিদীদের দেখিয়েছি। রোশ হাশানার মত বিশেষ দিনগুলিতে এরা বড় বড় পশমী টুপিও পরে, যাদের নাম শ্ট্রেইমেল। বংশপরম্পরায় এসব টুপি পায় অনেকে, আবার অনেকে বিয়ের সময় “যৌতুক” হিসাবে পায় শ্বশুরের কাছে। মহা দামী টুপি এগুলি। তাই বাঁছা বাঁছা “ঈদের” দিনগুলিতে পরে।

জেরুজালেমে প্রথম দিন ঢোকার সময়ই রাস্তাঘাটে প্রচুর হাসিদী পুরুষ-মহিলা দেখেছিলাম। তেল আবিবের কসমোপলিটান পরিবেশে এদের একদম দেখা যায় না বললেই চলে। যে ইউক্রেনীয় রুশ ড্রাইভার অ্যালেক্স তেল আবিব থেকে নিয়ে এল আমাদের, সে এদের ডাকনাম দিয়েছে “পিনগিন” — পেঙ্গুইন, ভিডিওতে শুনবেন। আমি হাল্কা ডিসক্রিমিনেশনের আঁচ পেলাম। রুশ সমাজে এ ঘৃণা অধুনা পর্যন্ত চলে এসেছে। বের হল, অ্যালেক্স আমাদের আরেক রুশবংশোদ্ভূত ইউক্রেনিয়ান চালক বোয়াজ/বোরিসের মত ইহুদী নয়, রুশ অর্থডক্স খ্রীষ্টান। সে অবশ্য ইংরেজী ভাল পারে না। আমার সিরিলিক জ্ঞান আর গুগলের মাধ্যমে বেশি জটিল কথোপকথন চলল।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




হাসিদীদের জন্মস্থলও সপ্তদশ শতকের পোল্যান্ড ও পশ্চিম ইউক্রেন। এখনো ইউক্রেনের উমান শহরে বহু হাসিদী ইহুদী ফিরে যায়, কারণ সেখানে রয়েছে এক বড়সড় গুণী রাবাইয়ের মাজার। আগে এ ব্যাপারে একটা পোস্ট করেছি। আমেরিকার নিউ ইয়র্কেও এদের বড় একটা সংখ্যা বসবাস করে। আমেরিকায় দারিদ্রের হার সবচে বেশি যে শহরে, সেই কিরিয়াস জোয়েল মূলত হাসিদীঅধ্যুষিত।

হাসিদী মেয়েরাও পোশাকআশাকে মডেস্টি চর্চা করে। স্কার্ট পরে ফুল লেংথ, লং স্লীভ জামা। বিবাহিত হলে মাথা ঢাকে। কম দৈর্ঘের স্কার্ট যদি পরে তো পুরু স্টকিং পরবে। ছবি ভিডিওতে এদেরও দেখিয়েছি। এ সমাজে নারীরাই যা অর্থোপার্জন করার করে। পুরুষদের অধিকাংশ সারাদিন তোরা’-তালমুদ পড়ে। সরকারের অর্থপুষ্ট ইয়েশিভা (মাদ্রাসা) থেকে ভর্তুকি পায়। এরা দেশের দরিদ্রতম জনগোষ্ঠী, বাইরের দানখয়রাতের ওপর নির্ভরশীল। সরকারী ভর্তুকি নিলে ধর্মগ্রন্থ পাঠ ছাড়া অন্য কোন কাজ এরা করতে পারে না। প্রতিরক্ষা বাহিনীতেও এরা এগজেম্পশন পায়, আর ঠেলে পাঠাতে চাইলেও যাবে না। এই নিয়ে ইসরাইলে রাজনৈতিক শোরগোল রয়েছে।

হাসিদীদের তুলনা করা যেতে পারে মুসলিম তবলীগ জামাতের সাথে, কিংবা সুফীদের সাথে। এরা বেশ কম্যুনাল, নিজেদের সমাজের বাইরে মেশে না, অন্য মতের ইহুদীদের সাথেও না। এদের হুজুরদের নাম “রেব্বে”, তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় শ’ থেকে হাজারখানেক পরিবার নিয়ে তৈরি “ডাইনেস্টি।” বছরের বিশেষ দিনগুলিতে এরা একত্রিত হয়ে জিকর মাহফিল ধরনের প্রার্থনা করে, সুফীদের মত ঘুরে ঘুরে নাচে। মহিলাদের নাচা বারণ, বসতে হয় আলাদা। অনেকটা সুফী আধ্যাত্মিকতাবাদ ও গূঢ়তত্ত্বের চর্চা করে এরা।

হাসিদী ছাড়াও সকল ধার্মিক ইহুদী ঘুমানো-গোসল বাদে চব্বিশ ঘন্টা মাথা ঢাকে। সে টুপি হতে পারে কিপ্পার মত ছোট, শুধু চান্দি ঢাকে। হতে পারে মুসলিম কুফী টুপির মত, সেটা অনেক বুখারী ইহুদী পরে। আর পূর্ব ইউরোপ থেকে আসা এই হারেদী-হাসিদীরা কিপার ওপরেও পরবে ফেদোরা-হমবুর্গ ধাঁচের ব্রিমসহ টুপি, আর বিশেষ দিনে শ্ট্রেইমেল। বাক্সের মধ্যে বহন করে এসকল দামি ফ্যামিলি হেয়ারলুম। যেগুলি বহন করছিল আমার ক্ষণিকের সহযাত্রীরা।

শুধু সাদা-কালো রঙের পোশাক পরার মাজেজা হচ্ছে বেশি ফ্যাশন না করে, আর বেশি ক্যাজুয়াল না পরে সাধারন মডেস্ট পরিধান করা। জেরুজালেমে গেলে খেয়াল রাখবেন যে শুধু মুসলিম ধর্মালয় নয়, খ্রীষ্টান-ইহুদী ধর্মস্থলেও শর্টস পরা বারণ। ইহুদীদের মাথা ঢাকা, জুলফি বড় রাখা, দাড়ি না কাটা — এসব ব্যাপারে তাদের ধর্মগ্রন্থেই পরিষ্কার নির্দেশ আছে। তবে ইতিহাসবিদদের দৃষ্টিতে এমন পরিধান ও আচারের কারণ ভিনদেশে প্রবাসজীবনে ভিন্ন আচারের মানুষ থেকে নিজেদের আলাদা পরিচয় টিকিয়ে রাখা। অন্য জাতির বা ধর্মের চিহ্নধারণ মহাপাপ।

বর্তমান ইসরাইল রাষ্ট্রে আল্ট্রা-অর্থডক্স এ সকল ইহুদীদের সংখ্যা আগের থেকে অনেক বেশি — প্রায় দশ শতাংশ। আর ক্রমবর্ধমান। এদের পরিবারগুলো হয় আরবদের মতই বড়। অনেকে হয়ত জানেন, ইসরাইলে অসংখ্য রাজনৈতিক দল রয়েছে এবং গত পাঁচ বছরে চারটি নির্বাচন হয়েছে সেখানে। সেকুলার, জায়নিস্ট দলগুলির পাশাপাশি রয়েছে ধর্মীয় দল — কনজারভেটিভ ও রিফর্ম ইহুদীদের পাশাপাশি রয়েছে এই হারেদী বা আল্ট্রা-অর্থডক্সদের একাধিক দল।

ওয়েস্টার্ন ওয়ালের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পরিচালনার অধিকার রয়েছে কেবল হারেদীদের। এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্যান্য দল থেকে ভিন্ন রাজনৈতিক মত পোষন করে। জায়নিস্ট আদর্শতেও এরা বিশ্বাস করে না। ইহুদী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা নয়, এদের মতে সেটা হওয়া উচিত ছিল খোদার দৈব হস্তক্ষেপের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে। অর্থাৎ বর্তমান ইসরাইল রাষ্ট্রের ভিত্তিটাকেও এরা প্রকারান্তরে প্রশ্নবিদ্ধ করে রেখেছে।

এ কারণে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের খাঁপ খায় না। বর্তমান ইসরাইল সরকারের মোর্চায় আরব দলসহ বাম-ডান-কেন্দ্র সকল দল রয়েছে, কিন্তু হারেদীদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই।

সব মিলিয়ে ইহুদীদের মধ্যে আলাদা একটা সেগ্রেগেটেড সমাজ বানিয়ে রয়েছে হারেদী-হাসিদীরা। তাদের প্রায়রিটি ধর্মকর্ম, দেশের রাজনীতিতে কি হল, কার সাথে কার গোলমাল এ নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা বেশির ভাগ আল্ট্রা-অর্থডক্স ইহুদীদের নেই। সারাদিন আল্লাবিল্লা করতে পারলেই এরা মহাখুশি।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




সদাকা আর ৎজেদাকা

আমাদের কম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা আরউইন জেকবস ছিলেন এমআইটি পাশ ইলেক্ট্রিকাল ইনজিনিয়ার আর অধ্যাপক, পরে অন্টরপ্রনর। বিলিওনিয়ার এই ভদ্রলোক ও তার পরিবার সান ডিয়েগোসহ ‌অনেক জায়গায় প্রচুর দানখয়রাত করেন। ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া সান ডিয়েগোতে ১০০ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি দান করেন, বিশ্ববিদ্যালয়টির কলেজ অফ ইনজিনিয়ারিংয়ে তার নাম অংকিত। সান ডিয়েগো সিম্ফনির পাবলিক রেডিও অনুষ্ঠানও হয় তার অনুদান ও নাম নিয়ে।

সান ডিয়েগোর এমন আরেক দানবীর আর্নেস্ট রেডি। এখানকার শিশু হাসপাতালে ১৪০ মিলিয়ন ডলার দান করেন। সে থেকে হাসপাতালের নাম রেডি চিলড্রেনস। ইউসিএসডির কলেজ অফ ম্যানেজমেন্ট একইভাবে তার দাননামধন্য। তিনি ধনী হয়েছেন ব্যাংকিং ও রিয়েল এস্টেট থেকে।

এ দুজনের কেউই পিতামাতার কাছ থেকে উচ্চশিক্ষার একটা লেগ্যাসি ছাড়া কোন পারিবারিক ধন নিয়ে যাত্রা শুরু করেননি। দুজনের মধ্যে আরেকটা কমন ব্যাপার হল তারা এসেছেন ইহুদী পরিবার থেকে।

এত বড় অবতারণা করলাম পোস্টের প্রথম ছবি কটি নিয়ে বলার জন্য। একটি ছবি ইসরাইলের মধ্যোপসাগরতীরবর্তী তেল আবিব-জাফা শহরের আল-বাহর মসজিদের প্রবেশদ্বারে তোলা। এ এলাকায় খুব কাছাকাছি চার-পাঁচটি মসজিদ। বেশ মানুষ হয়। ওয়েস্ট ব্যাংক থেকে গাড়ি আসছে উইকেন্ডে, নারী-পুরুষ নামাজ পড়ছে। নামাজের পর হেজাবপড়া মহিলাদের দেখা যাচ্ছে সাগরতীরে হাওয়া খেতে। মসজিদটি ১৬৭৫এ প্রতিষ্ঠিত হয়ে এখনো টিকে আছে। দানবাক্সে “সদাকার” আবেদন করা হয়েছে।

ইসলাম অনুসারে জাকাত ফরজ দান আর সদাকা ঐচ্ছিক। সাধারণত জনসাধারণের মঙ্গলের জন্যে সদাকার দানখয়রাত যায় মসজিদ, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল প্রভৃতিতে। দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন পরিচিত-অপরিচিত যে কাউকে সে দানটি যে কোন সময় করা যায়, জাকাতের মত ধরাবাঁধা সময় নেই। তবে জাকাত-সদাকা গ্রহণযোগ্য হবার কিছু নিয়ম আছে, যথাযথ প্রাপক কিংবা উদ্দেশ্য থাকতে হবে। ইসলামের ইতিহাসবিদদের মতে অবশ্য সদাকা ও জাকাত উভয়েই নাকি আদি ইসলামী রাষ্ট্রে বাধ্যমূলক ছিল।

ওদিকে যারা রাব্বিনিকাল জুডাইজম অনুসরণ করেন, অর্থাৎ তোরা’র ওরাল ল’ মানেন, তারাও মুসলিমদের মত ৎজেদাকা বা সেদাকা নামে দানখয়রাত করেন। এটি অবশ্য জাকাতের মত ফরজ। ছবিতে যে ৎজেদাকা বাক্স দেখছেন, সেটি রাখা ওয়েস্টার্ন ওয়ালের কম্পাউন্ডে ঢোকার কাছে, জুয়িশ কোয়ার্টার থেকে নেমে আসা পাথরের সিঁড়ির ধারে। দরিদ্র পরিবারদের কল্যাণার্থে অর্থ সাহায্য চাওয়া হয়েছে। হিব্রুতে এমন দানবাক্সের নাম “পুশকা।” মসজিদের মত সিনাগগেও বাক্স চালাচালি করে অর্থসংগ্রহ হয়।

ইসলামের মত ইহুদী ধর্মেও সদাকা দেবার বিশেষ নিয়ম মানতে হয়। সবাই সদাকা পাবার যোগ্য নয়। প্রাচীন ইসরাইল ও জুদা’র ইহুদী গেরস্তরা ক্ষেত থেকে ফসল তোলার পর যেটা উদ্বৃত্ত থেকে যেত, সেটা দান করে দেয়াটা ছিল বাধ্যতামূলক। সে উদ্বৃত্ত যে দরিদ্র মানুষদের কাছে যাবে, ক্ষেত থেকে সেটা সংগ্রহের জন্যে তাদের খাটানোটাও ছিল কড়া বারণ। দান করতে হবে এমন মানুষকে যারা সে দানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে। দরিদ্রদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া তো যাবেই না, বরং ৎজেদাকার প্রাপ্য টাকার মালিক আসলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পক্ষে খোদা স্বয়ং!

আরবী সদাকা আর হিব্রু ৎজেদাকা মূলে একই শব্দ। এদের উভয়ের অর্থ সদাচার। ইসলামী স্বর্ণযুগে গাজ্জালী-ইবনেরুশদের প্রায় সমসাময়িক ইহুদী মহামনীষী মুসা ইবনে মাইমুন বা মাইমনিডেস ৎজেদাকা ও অন্যান্য ধর্মাচার নিয়ে বেশ বিস্তারিত ব্যাখ্যা লিখে গেছেন। সে তালিকায় ৎজেদাকার মধ্যে পড়ে অর্থদান, সুদবিহীন ঋণ, দরিদ্রের কর্মসংস্থান, প্রভৃতি। দানটি হতে পারে স্বনামে কিংবা বেনামে, প্রাপক জানতে পারে কে দানটি দিচ্ছে, নাও জানতে পারে।

বর্তমান যুগের ইহুদীরা তাদের উপার্জনের একটা বড় অংশ দান করে দেয়, ৎজেদাকা নামে হোক বা না হোক। বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের দিনগুলিতে একাধিক দরিদ্র মানুষকে অর্থ বা অন্নদান একই কাতারে পড়ে। ৎজেদাকার জন্যে অর্থটিও বেশ বুঝেশুনে বরাদ্দ করতে হয়, যেন সেটি অগ্রহণযোগ্য উপায়ে অর্জিত না হয়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




জেকবস-রেডিদের দানখয়রাতকে তারা নিজেরা কেউ ৎজেদাকা/সদাকা দাবি করেনি। কিন্তু তারা যে পটভূমি থেকে উঠে এসেছেন, সেখানে অবশ্যই এমন দানখয়রাতের পরিবেশ দেখে এসেছেন। উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্যে ইহুদী পরিবারে যেমন উৎসাহ দেয়া হয়, তেমন বদান্যতাও শেখানো হয়। ইসলামেও এ দুটির মর্যাদা বেশ উচ্চে। বহু ধর্মপ্রাণ মুসলিম একই জীবনাচার অনুসরণ করেন। যারা ধর্মপরায়ণ ইহুদী ও মুসলিম, তাদের মধ্যে এ ব্যাপারে পার্থক্য খুব কম।

এডিটঃ আরো কিছু জায়গার ছবি দিলাম যারা দানখয়রাতের ওপর নির্ভরশীল কিংবা অনুদানে প্রতিষ্ঠিত। জেরুজালেমের মাকাস্সেদ ইসলামী চ্যারিটি হাসপাতাল, জুয়িশ কোয়ার্টারের ভোহল জাদুঘর, জাতিসংঘের পরিচালিত জেরুজালেম গার্লস স্কুল। প্রথমটি ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্যসেবা চ্যারিটি, বহু হাসপাতাল আছে তাদের। দ্বিতীয়টিতে বহু মানুষ দানখয়রাত করেছে, যাদের উল্লেখযোগ্যদের নাম ফলকে লেখা। যাদের নাম দেখা যাচ্ছে তারা নিউ ইয়র্কের ইহুদী পরিবার। তৃতীয়টি জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠিত পশ্চিম তীরের বহু স্কুলের একটি। এদের ফান্ডিং আসে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান ও গাল্ফ আরব দেশগুলির সরকার থেকে। ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে মাথাপিছু অনুদানের হিসাবে এই আনরয়া প্রজেক্টের খরচ সর্বোচ্চ।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ইসরাইল ও জর্দান ভ্রমণঃ ভূমিকা

কাজের সুবাদে গত সপ্তাহ ঘুরে এলাম ইসরাইলের তেল আবিব। আর ব্যক্তিগত সময় কাটালাম পবিত্র শহর জেরুজালেম আর জর্দানের প্রাচীন পেত্রা নগরীর ধ্বংসাবশেষে। এ এক অনন্য অভিজ্ঞতা!

শুধু যে স্থানগুলি দেখা হল তা নয়, উপস্থিত ছিলাম একেবারে সঠিক সময়ে। সাথে ছিল কয়েকজন চীনা ও ভারতীয় সহকর্মী।

ডোম অফ দ্য রকের পাদদেশে ওয়েস্টার্ন ওয়ালে শুক্রবার মধ্যরাতে শুরু হয় ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের প্রার্থনা। নতুন বছরের প্রথম দিন রোশ হাশানা’র আগমনের দিনখানেক আগ থেকেই সন্ধ্যার পর এখানে লোকসমাগম শুরু হয়। লাগোয়া সিনাগগে প্রার্থনা-বিলাপ চলে। কাগজে লেখা অনুশোচনার প্রার্থনা কেউ গুঁজে দেয় দেয়ালের পাথরের ফাঁকে ফাঁকে। বেশ আবেগঘন পরিবেশে ইসলামী মাহফিলের মত সুর করে “সেলিকোত” প্রার্থনা চলে। গত ২৬ তারিখ ছিল রোশ হাশানা। দশম দিন ইয়ম কিপ্পুরের সাথে আশুরার মিল উল্লেখযোগ্য। হাদীস ঘাঁটালে পাওয়া যাবে, এক সময় দুটো দিন একই ছিল।

শুক্রবার দুপুরে জুম্মার নামাজে অংশ নিলাম পবিত্র মসজিদুল আকসার কম্পাউন্ডে। হাজারে হাজারে মুসলিম জেরুজালেমের পুরনো শহরের অলিগলি বেয়ে এই প্রাচীন প্রান্তরে এসে প্রার্থনা করল, অনেকে খোলা আকাশের নিচে কড়া রৌদ্রের মধ্যে। বেশ কয়েকটি অজুর স্থান আছে। অবাক হতে পারেন যে ওয়েস্টার্ন ওয়ালের সামনেও এমন দুটো অজুখানা, ইহুদীরা প্রার্থনার আগে ব্যবহার করে। মসজিদুল আকসায় মহিলাদের নামাজের জন্য আলাদা করে বরাদ্দ কুব্বাত আস-সাখরার (ডোম অফ দ্য রক) উঁচু প্ল্যাটফর্ম। আগের রাতে দেখেছি ইহুদী মহিলাদের জন্যেও পাশে আলাদা পার্টিশন করা জায়গা বরাদ্দ। নামাজের পর পুরো কম্পাউন্ড প্রদক্ষিণ করলাম। হোটেলের রিসেপশনিস্ট যুগল যে আরব সেটা বুঝেছিলাম। তাদের জিজ্ঞেস করাতে তারাই সাহস যুগিয়েছিল যে শুক্রবারের নামাজে এখানে আসা সবচেয়ে নিরাপদ। ঢোকার সময় দু’দু’বার সূরা ফাতিহা পাঠ করে প্রমাণ দিতে হয়েছে যে আমি মুসলিম। তারপরেও বোধহয় পেছনে আঁঠার মত ফেঁউ লেগে ছিল। অমুসলিম সহকর্মীদের সাথে পরে আরেকবার ঢুকেছি। সেটা অন্য রাস্তায়, আরো মহা কড়া নিরাপত্তা। সে বিষয়ে পরে বলব। ওয়েস্টার্ন ওয়াল কম্পাউন্ডে ঢোকার সময়েও সিকুরিটি চেক পার করে যেতে হয়েছিল।

শুক্রবার বিকেলেই যীশু খ্রীষ্টের ক্রুশবহন করে চলার পথ ভিয়া দোলোরোসা ধরে একে একে চৌদ্দটা স্টেশনে চক্কর মারতে গিয়ে ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেলাম ফ্রান্সিসকান ক্যাথলিক ফ্রায়ারদের দৈনিক শোভাযাত্রা। তাদের অনুসরণ করছে খ্রীষ্টান তীর্থযাত্রীর দল। মুসলিম কোয়ার্টারের অলিগলি বেয়ে একে একে নয়টি স্টেশন স্পর্শ করার পর শোভাযাত্রা গিয়ে ঢুকল খ্রীষ্টান ধর্মজগতের কেন্দ্র চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকারের ভেতর। চৌদ্দ স্টেশনের পাঁচটিই এর ভেতর। সেখানে ফ্রান্সিস্কান পাদ্রীদের প্রার্থনাগীতির অনুরনণ মনোমুগ্ধকর। খ্রীষ্টান ধর্মমতে যীশু খ্রীষ্টকে যে পাথরের সমাধিতে শায়িত করা হয়েছিল, তারপর সেখান থেকে তিনদিন পর পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠেছিলেন, সেই সেপালকারের সামনে চলল ধর্মগীতি। ওপরের লেভেলে গলগোথা টিলার ওপর যেখানে যীশু খ্রীষ্টকে রোমানরা ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, সেখানেও গেলাম এর পর। ফ্রানসিস্কান মংকদের পর সেখানে এল আর্মেনিয়ান অর্থডক্স পাদ্রীদের দল, চলল তাদের প্রার্থনাগীতি। জেরুজালেম শহর নিয়ে তিন ধর্মের ঐতিহাসিক সংঘাতই যে শুধু হয়েছে তা নয়, চার্চ অফ দ্য হোলি সেপালকারের বিভিন্ন অংশের দখল নিয়েও নানা খ্রীষ্টান ধর্মমতের মাঝে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ইতিহাস আছে। এখন টাইম আর স্পেস শেয়ার করে স্থিতিশীলতা বজিয়ে রাখা হয়েছে।

সব মিলিয়ে ওয়ান্স ইন এ লাইফটাইম এক্সপেরিয়েন্স। সামনের দিনগুলিতে অল্প অল্প করে আরো তথ্য দেব। আপাতত ঐ তিনটি ধর্মাচার নিয়ে ‌ধারণ করা অল্প কটি ভিডিও শেয়ার করছি।

 



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




আদি ইসলামী মুদ্রা – ৩

আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে সিরিজের তৃতীয় লেখা এটি। প্রথম পর্বে ছিল উমাইয়া খেলাফতের পতন ও আব্বাসিয়াদের উত্থানের ইতিহাস। দ্বিতীয় পর্বে ছিল আরব-বিজ্যান্টিন মুদ্রার কথা, যেগুলিতে ক্রুশ, মানব অবয়ব ও অন্যান্য অনৈসলামিক প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে বিসমিল্লাহ ইত্যাদি লেখা।

আজকের পাঁচটি রৌপ্যমুদ্রা বা দিরহাম আর একটি তাম্রমুদ্রা বা ফালস সাসানী রাজবংশ থেকে শুরু করে উমাইয়া খলীফাদের গভর্নরদের আমলের — ইরাক ও ‌অন্যান্য প্রদেশের। সাসানীদের সাম্রাজ্যের দ্রুত অধঃপতনের পেছনের কাহিনীর পাশাপাশি লিখছি নতুন আরব প্রশাসনিক নীতির সংক্ষিপ্ত বিবরণী।

ছয়টি মুদ্রা দেখা যাচ্ছে ছবিতে। আপাতদৃষ্টিতে সবগুলি দেখতে প্রায় একই। কিন্তু এরা আলাদা আলাদা সময়ের। প্রথম দুটি সাসানী সাম্রাজ্যে আর শেষের চারটি উমাইয়া খেলাফতের পূর্বাংশের প্রাক্তন সাসানী প্রদেশগুলিতে প্রচলিত ছিল।

১। সাসানী শাহেনশাহ দ্বিতীয় খসরুর দিরহাম, ৬২০ খ্রিষ্টাব্দ
২। সাসানী শাহেনশাহ তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের দিরহাম, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ

সাসানী মুদ্রাগুলো যথাক্রমে শাহেনশাহ দ্বিতীয় খসরু (মুদ্রার তারিখ ৬২০ খ্রীষ্টাব্দ) আর তার পৌত্র তৃতীয় ইয়াজদেগার্দের (৬৫০ খ্রীষ্টাব্দ)। দুটোতেই তাদের প্রোফাইল অংকিত। মাথার ওপর ‘ফারাভাহার’ — পাখাওয়ালা সূর্য — জোরোয়াস্ত্রিয়ান মঙ্গল দেবতা আহুরা মাজদা অথবা শাহেনশাহের গার্ডিয়ান এঞ্জেল ফেরেশতার প্রতীক। চার ধারে চাঁদতারা — ঊর্বরতা ও জ্ঞানের দেবী অনাহিতার (ভারতের সরস্বতী) প্রতীক। সম্রাটের শ্মশ্রুমন্ডিত মুখাবয়বের সামনে পিছনে পাহলভী হরফে তার নাম-পদবী লেখা। অপরপিঠে দুই গদাধারী রক্ষকের মাঝে জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্মমতের পবিত্র অগ্নিপ্রজ্জ্বলিত মশালের বেদী। সাথে পাহলভী হরফে টাঁকশালের নামের আদ্যাক্ষর।

৩। ইরাকের মুসলিম গভর্নর আবদুল্লাহ ইবনে আমিরানের দিরহাম, ৬৬৩/৬৬৮ সাল
৪। ইরাকের মুসলিম গভর্নর জিয়াদ ইবনে আবি সুফিয়ানের দিরহাম, ৬৬৮/৬৬৯ সাল

তৃতীয় ও চতুর্থ মুদ্রার ডিজাইন আগেরগুলোর মতই। কিন্তু একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখবেন, সম্রাটের ছবির ফ্রেমের ঠিক বাইরে আরবী কুফী হরফে বিসমিল্লাহ লেখা। চতুর্থটিতে বিসমিল্লাহ রাব্বী। সম্রাটের মুখচ্ছবির আশপাশ দিয়ে লেখা নাম আর সাসানী সম্রাটের নয়, আরব গভর্নরদের! প্রথমটায় পাহলভী হরফে লেখা ‘প্দুল ‘জিজ ঈ প্দুল ঈ মীল’ন’ — আব্দুল আজিজ ই আব্দুল্লাহ ই আমিরান (৬৬৩/৬৬৪)। দ্বিতীয়টিতে জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান (৬৬৮/৬৬৯)।

দু’জনেই বেশ পরাক্রমশালী উমাইয়া গভর্নর। আব্দুল্লাহ ইবনে আমির তৃতীয় খলীফা উসমানের সময় থেকে মুয়াবিয়ার আমল পর্যন্ত সে আসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তুতো ভাই উসমানের গুপ্তহত্যার পর শুরু হওয়া প্রথম গৃহযুদ্ধের সময় (৬৫৬-৬৬১) হযরত আয়েশা, তালহা ও জুবায়েরের আলীবিরোধী দলকে বসরাতে আশ্রয় দেন তিনিই। আর জিয়াদ ইবনে আবু সুফিয়ান ছিলেন আলীর মনোনীত গভর্নর, তার হত্যার পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধের প্রাক্কালে শুরুতে আলীপন্থীদের সমর্থন দিলেও মুয়াবিয়া তাকে সৎভাইয়ের মর্যাদা দিয়ে দলে টেনে নেন।

৫। দ্বিতীয় খসরুর দিরহামের চার ধার কেটে তাকে খেলাফতের মাপে নিয়ে আসা হয়েছে
৬। ইরাকের মুসলিম গভর্নর হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফের তামার ‘পাশিজ’ বা ‘ফালস’, ৬৯৪/৬৯৫ সাল

আর শেষ দুটি মুদ্রার প্রথমটির চারধার থেকে বাড়তি ধাতু কেটে ফেলা হয়েছে। যদি তা না করা হত, আলাদা করে আরব মুদ্রা হিসাবে বোঝা সম্ভব ছিল না। চারধার কাটার কারণ তার ওজনটাকে নতুন আরব খেলাফতের দিরহামের ওজনের স্ট্যান্ডার্ডে নিয়ে আসা। আর শেষ মুদ্রাটি তামার ‘ফালস’ (৬৯৪/৬৯৫)। হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ নামে আরেক শক্তিশালী ইরাকী গভর্নরের। তিনি ছিলেন উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের খুবই বিশ্বাসযোগ্য এক সেনাপতি। মুদ্রার এক পিঠে সাসানী সম্রাটের প্রতিকৃতি, অপর পিঠে একটি ঘোড়ার ছবি!

পারস্য সাম্রাজ্যে আরব সেনাভিযানের প্রাক্কালে সেখানকার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বেশ নাজুক। মুদ্রায় দেখানো দ্বিতীয় খসরুকে সিংহাসনে বসার সাথে সাথে বাহরাম চোবিন নামে এক সেনাপতির বিদ্রোহ সামাল দিতে হয়। বিদ্রোহ মোকাবেলা করতে জাতশত্রু বিজ্যান্টিনদের সাহায্যের জন্যে হাত পাতেন তিনি। সিংহাসন পুনরুদ্ধারে সফলতার পর বিজ্যান্টিনদের হাতে মেসোপটেমিয়ার কয়েকটি সমৃদ্ধ শহর ছেড়ে দেন খসরু।

দ্বিতীয় খসরুর সময় সাসানী সাম্রাজ্যের বিস্তার, আনুমানিক ৬১০ সাল

বিজ্যান্টিনদের সাথে শান্তির সুযোগ নিয়ে নিজের গদি পাকাপোক্ত করতে মনোনিবেশ করেন খসরু। যে দুই চাচা তাকে রাজক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সাহায্য করেছিল, তাদেরকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা করেন খসরু। তার ফলে এতদিনের যে সাসানী-আর্শাকী রাজবংশের একতার ওপর ইরানী সাম্রাজ্য দাঁড়িয়েছিল, তাতে চিঁড় ধরতে শুরু করে। অভিজাতবংশীয় সেনানায়ক ও জমিদাররা (দেহগান) দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




একই সময়ে নিজের হাতে রাজ্যের সকল ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে ইরাকের পাপেট রাষ্ট্র আল-হিরার আরব লাখমীবংশীয় রাজা আল-নুমানকে বন্দী করে হত্যা করেন খসরু। এই রাষ্ট্রের যাযাবর ও অর্ধযাযাবররা এতদিন শত্রু বিজ্যান্টিনদের বিরুদ্ধে সৈন্য-সামন্ত ও সামরিক বাফার এলাকার নিয়ন্ত্রণ যুগিয়ে এসেছে সাসানীদের। এভাবে বিজ্যান্টিন ও মরু এলাকার আরব ট্রাইবগুলির বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যূহ রাতারাতি ধূলিসাৎ হয়ে যায়।

খসরুর ভাগ্য পাল্টে যেতে শুরু করে ৬০২ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ। তার মিত্র বিজ্যান্টিন সম্রাট মরিস নিজ সেনাপতি ফোকাসের হাতে খুন হন। ফোকাস নিজেকে সম্রাট দাবি করলে মরিসের পুত্রকে সিংহাসনে আসীন করার ‘ন্যায়সঙ্গত’ লক্ষ্য নিয়ে খসরু বিজ্যান্টিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। প্রথম প্রথম খুব দ্রুততার সাথে আগের হারানো শহরগুলি পুনরুদ্ধার করে ফেলেন। ঈজিয়ান সাগরে নৌযুদ্ধেও সফলতা পায় সাসানীরা, মিশরও তাদের দখলে আসে। বিজ্যান্টিন সম্রাটের প্রাসাদে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। ফোকাসকে সরিয়ে সম্রাট হন হেরাক্লিয়াস আর খসরুকে শান্তির প্রস্তাব পাঠান। খসরু তাতে কান না দিয়ে উল্টো মরিসের পুত্র থিওডসিয়াসকে সাম্রাজ্য ফিরিয়ে দেবার দাবি করেন। তার সেনাপতি শহরবরাজ/সরফরাজ দামেস্ক ও জেরুজালেম দখল করে যীশুখ্রীষ্টের ট্রু ক্রস লুট করে নিয়ে যান।

৬২৬এ হেরাক্লিয়াস সাসানীদের কনস্ট্যান্টিনোপল অবরোধ ভেঙে দিতে সক্ষম হন। এ সময় থেকে যুদ্ধের মোড় বিপরীত দিকে ঘুরে যায়। পূর্ব ফ্রন্টে তুর্কী ও হেফথালাইটদের সাথে মিত্রতাস্থাপনের পর দ্রুত সিরিয়া-মেসোপটেমিয়ায় বেশ কিছু যুদ্ধে বিজয় পান হেরাক্লিয়াস। এরপর একেবারে সাসানী রাজধানী ক্টেসিফোনে এসে হাজির হয় বিজ্যান্টিন সেনাদল। এবার খসরুর সময় এল অতীতের সব অত্যাচারের মাসুল দেবার। তার বিরোধী পাহলভী বনেদী পরিবারগুলো বিদ্রোহ শুরু করে। এদের মধ্যে ছিলেন শাহনামাখ্যাত রুস্তম ও তার পরিবার। তারা খসরুর কারাবন্দী পুত্র শেরোয়েকে মুক্ত করে তাকে শাহেনশাহ ঘোষণা করে। শেরোয়ে রাজকীয় নাম নেন কাভদ। বিজ্যান্টিনদের হারানো রাজ্যগুলি ফিরিয়ে দেন, পাশাপাশি উত্তর ইরাক তাদের কাছে ছেড়ে দেন। বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণের বিনিময়ে শান্তি পুনর্প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। কিন্তু ক্ষমতার তাড়নায় নিজ পিতাকে তো হত্যা করেনই, স্বপরিবারের আপন ভাই, সৎ ভাই সকলকে নিকেশ করে নিজের আসন পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেন। ফলে সাসানী পরিবার প্রায় নির্বংশ হয়ে যায়, রাজা হবার যোগ্য কোন বংশধর আর থাকে না।

কাভদকেও অচিরেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হতে হয়। তাকে সরানোর পর চার বছরে দশবার সম্রাট পরিবর্তন হয়। শেষমেশ শাহেনশাহ হন খসরুর এক নাতি তৃতীয় ইয়াজদেগার্দ। ৬৩২ সালে রাজাভিষেকের সময় তার বয়স ছিল মোটে আট বছর। তিনিই ছিলেন ইসলামী বিজয়াভিযানের সময় সাসানী সম্রাট। তার রাজত্বের শুরুতে পুরো সাম্রাজ্যের ওপর তার তেমন কোন নিয়ন্ত্রন ছিল না। অর্থনৈতিক সমস্যায় জর্জরিত তার দেশ। নানা প্রদেশে প্রায় স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করছে বিভিন্ন গভর্নররা। ধীরে ধীরে যুদ্ধ ও চুক্তির মাধ্যমে আবার সাসানী সাম্রাজ্যকে একীভূত করতে হয় তাকে। কিন্তু ততদিনে আরবদের উত্থান শুরু হয়ে গেছে। ৬৫১ সালে পলায়নরত অবস্থায় এক মিলার তাকে চিনে ফেলে, তাকে হত্যা করে মুসলিম সেনাদল নয়, বরং বিরোধীবংশীয় এক সামন্ত।

এ হলো সাসানীদের সমসাময়িক অবস্থা। আরব মুসলিমদের মাঝে এ সময়ে কি ঘটছিল তা বুঝতে হলে শুরু করতে হবে ইরাক ও তার ডেমোগ্রাফি দিয়ে।

এ সময়ের এক হাজার বছর আগের আকিমেনিদ আমল থেকেই ইরাক বা মেসোপটেমিয়া ইরানী গোত্র ও রাজবংশগুলির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু অতীতে টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস নদীর মাঝে ছিল অ্যাসিরীয়-ব্যাবিলোনীয় সাম্রাজ্যের জন্মভূমি। এদের মহান রাজা নেবুকাদনেজার বা বখত-নসর ইন্দোআর্য পারসিক ছিলেন না, ছিলেন আরব ও হিব্রুদের মতই সেমিটিক গোত্রীয়। পারসিকরা যখন অতীতে ছিল স্তেপের শিকারী ও মেষপালক গোত্র, তখন ব্যাবিলোনিয়ার সাম্রাজ্য ছিল নাগরিক সভ্যতার পুরোধা। কৃষিকাজ ও বাণিজ্যের ওপর নির্ভর করে এরা ছিল পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি।

অর্থাৎ ইরানী বনেদী বংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও ইরাকের অধিকাংশ সাধারণ মানুষ তখনো সেমিটিক আরামাইক ভাষায় কথা বলত, ঠিক যেমনটা ছিল বিজ্যান্টিন সিরিয়ার সিরিয়াকভাষীরা। এদের ভাষার সাথে ফারসীর মিল নেই, মিল আছে আরবী ও হিব্রুর।

এসকল আরামায়িকভাষী মানুষের বসবাস ছিল ইরাকের বড় শহরগুলিতে। তাদের পাশাপাশি ছিল ফারসীভাষী সরকারী কর্মচারী ও সৈনিক। শ্রেণী ও গোত্রভিত্তিক বিভাজন ছিল সেসব শহরে। জোরোয়াস্ত্রিয়ান ফায়ার টেম্পল ছিল পারসিকদের শক্তির প্রতীক। কিন্তু অধিকাংশ জনগণের ধর্ম ছিল নেস্টরিয়ান ক্রিশ্চিয়ানিটি। পাশাপাশি কিছু ইহুদী ছিল যারা ড্যানিয়েল-এজেকিয়েলের সময় থেকে ইরাকের বাসিন্দা।

আর দুই নদীর উপত্যকার ঠিক পশ্চিমে যেখানে ঊর্বরভূমির সাথে মরুভূমির মিলন ঘটেছে, সেখানে আবাস ছিল বহু অর্ধ-যাযাবর মেষপালক আরব গোত্রের। এদের অধিপতি ছিল বনু লাখম বলে একটি বড় গোত্র, ঠিক যেমন সিরিয়াতে বনু ঘাসান ছিল বিজ্যান্টিনদের মনোনীত আরব নেতৃত্বস্থানীয় গোত্র। ভিনদেশী সাসানীদের হয়ে আরব গোত্রগুলো থেকে করসংগ্রহের দায়িত্ব ছিল লাখমীদের। এছাড়াও দক্ষিণে পারস্যোপসাগরের তীরবর্তী খুজেস্তান থেকে শুরু করে উত্তরের জাগ্রোস পর্বত পর্যন্ত আরো নানা আরব গোত্রের বসবাস ছিল, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শাইবান, তাগলীব, তানুখ প্রমুখ। এদের অধিকাংশ ছিল নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান। ইরাকের অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে ছিল জরথুস্ত্রবাদ থেকে বিবর্তিত নিষিদ্ধঘোষিত মাজদাকী-মানিকেয়ান, আর আধ্যাত্মিক ভক্তিবাদী মান্দিয়ানরা।

আরব গোত্রদের কাছে হযরত মুহাম্মদ(সা)এর ইসলাম প্রচারের অন্যতম মূল লক্ষ্য ছিল তাদেরকে একতাবদ্ধ করা। তার জীবদ্দশায় কুরাইশশাসিত মক্কা ও মুসলিমশাসিত মদীনার প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফসল হিসাবে আরবের বেদুঈন ও শহরবাসী ট্রাইবগুলোর কনসলিডেশনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে। মক্কাবিজয়ের পরও একই প্রক্রিয়া আরো বড় মাপে চলতে থাকে, আর তার বিস্তার হয় দক্ষিণে ইয়েমেন-ওমান, উত্তরে আল-ইয়ামামা, আর পূর্বে বাহরাইন পর্যন্ত। হযরত মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আবু বকরের খলীফা হবার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল তিনি সকল আরব ট্রাইবের পুংক্ষানুপুংক্ষ বংশপরিচয় জানতেন, অর্থাৎ তাদের সাথে কূটনীতিতে সফলতার চাবিকাঠি ছিল তার হাতে। তাই রিদ্দা নামক বিদ্রোহগুলিকে যুদ্ধ ও চুক্তির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে তার দু’বছরের বেশি সময় লাগেনি।

আবু বকরের শাসনামলেই ইয়ামামার ‘ভন্ডনবী’ মুসায়লামাকে পরাজিত করতে সেনাদল পাঠানো হয়। সে সংগ্রাম চলাকালীন অবস্থাতেই ইরাকে অভিযান চালান মুসলিম সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ। তিনি দক্ষিণ ইরাকের বনু শাইবান গোত্রের নেতাকে তার সাথে হাত মেলানোর প্রস্তাব দেন। ততদিনে বনু শাইবান নিজেরাই মরুভূমি থেকে আক্রমণ চালিয়ে দজলা-ফোরাতের পশ্চিম তীরে মোটামুটি একটা স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ফেলেছে। সাসানীরা হয় তখনো সামরিক দুর্বলতার শিকার, নয়ত শাইবানদের ছোটখাট আক্রমণে গা না করে বড় কোন সমস্যা নিয়ে তারা ব্যতিব্যস্ত।

খালিদ বিন ওয়ালিদ ৬৩৩/৬৩৪ খ্রীষ্টাব্দে ইরাকের স্থানীয় বেদুঈন আরবদের সাহায্য নিয়ে মরুসংলগ্ন এলাকা আর বসরার কাছে আল-উবুল্লা আর কুফার নিকটবর্তী আলহিরার মত আরবঅধ্যুষিত শহরগুলিকে ইসলামী রাজত্বের আওতায় আনেন। এ সময়ে সাসানী সেনাবাহিনীর কোন প্রতিরোধ তাদের বিরুদ্ধে আসেনি। খালিদ সিরিয়া বিজয়ের যুদ্ধে অংশ নিতে ইরাক ত্যাগ করে বিশাল মরুযাত্রা করেন আর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে যান শাইবানদের গোত্রপতি আল-মুসান্নার হাতে।

ইসলামী নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা ‌অবশ্য আসে স্থানীয় আরব গোত্রগুলোর থেকে। এদের অনেকে লাখমীদের জায়গায় অধিষ্ঠিত ছিল। নতুন পাওয়া ক্ষমতা ছাড়তে তারা ছিল নারাজ। এদের বিরুদ্ধে আল-মুসান্না ইসলামী খেলাফতের নামে দু’একটা সফল অভিযান চালালেও শীঘ্রই সরাসরি সাসানী বিরোধিতার সম্মুখীন হন। আল-জিসরের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হন তিনি।

এর প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয় খলীফা উমার স্বল্পকিছু রিইনফোর্সমেন্ট পাঠান বাজিলা গোত্রের জারীর ইবনে আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে। তাদের সাথে পরে যোগ দেন সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের বড় সৈন্যদল। ৬৩৬ খ্রীষ্টাব্দে এরা সকলে মিলে ঘাঁটি গাড়ে আলহিরার নিকটবর্তী আল-ক্বাদিসিয়ার প্রাঙ্গনে। সেখানে পারসিক সেনাবাহিনীর সাথে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সংখ্যায় অপ্রতুলতা সত্ত্বেও আরবরা কয়েকদিনের প্রচেষ্টায় যুদ্ধে জয়লাভ করতে সক্ষম হয়। এখানেই নাকি রুস্তমের সাথে মোলাকাত হয় আরবদের, আর রুস্তম তাদের চরম অপমান করেন।

ক্বাদিসিয়ার যুদ্ধে সাসানীরা হারার পর তাদের তেমন কোন প্রতিরক্ষা আর অবশিষ্ট থাকে না। তারা পিছু হটে আশ্রয় নেয় মাদাইন শহরে তাদের রাজধানীতে, তারপর সেখান থেকে পালিয়ে চলে যায় জাগ্রোস পর্বতের পাদদেশে। সেখানে ৬৩৭ খ্রীষ্টাব্দে জালুলার যুদ্ধে আরেকবার শোচনীয় পরাজয় ঘটে সাসানীদের। ইয়াজদেগার্দ তার নিকটস্থদের নিয়ে আরো পূর্বে খোরাসান ও সগডিয়ার দিকে পালিয়ে যান, আর সুযোগ খুঁজতে থাকেন তার হারানো সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের। সে উদ্দেশ্যে চীনাদেরও সাহায্য প্রার্থনা করেন তিনি। কিন্তু তার সেই সংগ্রাম ৬৫১ পর্যন্ত বিভিন্ন মাপে চললেও শেষ পর্যন্ত সাসানী সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা বিফল হয়। তার পুত্র চীনের সম্রাটের দরবারে আশ্রয় নেন নির্বাসিত রাজা হিসাবে। আর কখনোই ইরানে ফিরে যেতে পারেনি সাসানীদের বংশধররা।

পারসিক সেনাদলের সংখ্যাধিক্য আর প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও আরবদের যুদ্ধে বিজয়ের কারণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। কারো ধারণা পারসিকদের হস্তীবাহিনীকে আরব তীরন্দাজরা দূর থেকে ধরাশায়ী করে ফেলে। আবার তাদের সাংগঠনিক একতার কারণও দেন অনেকে। তাদের বিপরীতে সাসানী বাহিনী ছিল বহু জাতি-গোত্রে বিভক্ত আর তারা মোটে জটিল গৃহবিবাদ কাটিয়ে উঠেছে। আর ইরানী সেনাদলের স্বাভাবিক আকারের তুলনায় তারা ছিল স্বল্প। আরবরা যে সংখ্যায় দুর্বল ছিল আর তাদের তীরন্দাজ, পদাতিক আর ঊষ্ট্রারোহী ছাড়া তেমন কোন সৈন্য ছিল না, তাতে কোন সন্দেহ নেই।

এই সৈন্যসংখ্যা কম হবার কারণেই উমার রিদ্দার সময়কার বিদ্রোহী আরব গোত্রগুলিকে না চাইতেও ইরাকের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান। ‘ভন্ডনবী’ তুলায়হাকেও তার ট্রাইবসহ ইরাকে পাঠান তিনি। তুলায়হাকে সেনানেতৃত্বের মত গুরুত্বপূর্ণ পদ তিনি দেননি, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে তার কৌশলগত উপদেশ ঠিকই মুসলিমদের কাজে লেগেছে। এ ছিল সাসানীদের অন্তর্কলহের ঠিক বিপরীত। আরব সেনাদলে যে সকলে মুসলিম ছিল তাও নয়, ইরাকের খ্রীষ্টান ট্রাইবগুলোর কিছু সদস্যও যুদ্ধে আরব পক্ষ নেয়। সিরিয়ার যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ ও মদীনার আনসারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকলেও দেখা যায় যে ইরাকে সে প্রক্রিয়াটায় বেশি অংশ নিয়েছে মধ্য আরব ও ইরাকের অ-কুরাইশ স্থানীয় আরব ট্রাইবগুলি।

এভাবে ইরাকবিজয় ছিল নেহাত আরব ট্রাইবগুলির কনসলিডেশনের একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। সিরিয়াতে মক্কার কুরাইশদের ব্যবসায়িক স্বার্থ ছিল, জেরুজালেমের কারণে সেখানকার একটা ধর্মীয় গুরুত্বও ছিল। সেসব কোন কিছু ইরাকের বেলায় ছিল না। আরব কনসলিডেশন ও এসট্যাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে যখনই সাসানী বা তাদের সমর্থকদের বাঁধা এসেছে, তখনই আরবদের সুযোগ চলে এসেছে আরো এলাকা হস্তগত করার। এভাবে ইরাক থেকে শুরু করে ক্রমে সাসানী সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের খোরাসান-হেরাতে ছড়িয়ে পড়ে আরব সেনাদল। আর সেভাবে তারা এসে হাজির হয় সিন্ধু উপত্যকায় — ঠিক ভারতের দোরগোড়ায়।

সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাসের জীবদ্দশাতেই ইরাকের রাজধানী ক্টেসিফোন বা আল-মাদাইন থেকে সরিয়ে নিয়ে আসা হয় আলহিরার নিকটবর্তী নতুন সৃষ্ট গ্যারিসন টাউন কুফাতে। এর মূল কারণ সম্ভবত মরু এলাকার নিজস্ব পাওয়ার বেসের কাছাকাছি থাকা, আর মরুর ট্রাইবগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার সুবিধা। এতে বোঝা যায়, ইরাকে সাম্রাজ্যবিস্তারের মূল লক্ষ্য সাসানী সাম্রাজ্যের ক্ষমতাকেন্দ্র দখল করা নয়, বরং ছিল আরব গোত্রগুলিকে একীভূত করে একই সিস্টেমের আওতাধীন করা।

উমার ও পরবর্তী খলীফারা ইরাকে বিভিন্ন আরব যাযাবর ট্রাইবকে ‘হিজরত’ কিংবা ‘স্বেচ্ছা নির্বাসন’ হতে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবে হিজরত ব্যাপারটা এখন দাঁড়িয়ে গেছে ইসলামের একটি অনানুষ্ঠানিক স্তম্ভ হিসাবে। হিজরতে উদ্বুদ্ধ করার পেছনে খেলাফতের নেতৃত্বস্থানীয়দের মূল লক্ষ্য ছিল পরিবর্তনশীল মানসিকতার বেদুঈনদেরকে আরবের ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে রাখা, আর সম্ভব হলে সাসানীদের অবশিষ্ট সেনাদলের বিরুদ্ধে এদের ব্যবহার করা। এসকল বেদুঈন ট্রাইব কুফা কিংবা বসরার মত নতুন শহরে এসে বসতি গাড়ে। একেকটি ট্রাইবের জন্যে নির্ধারিত ছিল একেকটি মহল্লা। কোন ক্ষেত্রে বনেদী পারসিক মিত্র ‘দেহগান’ জমিদার আর ‘সাওয়ারী’ অশ্বারোহীদের জন্যেও নতুন এলাকা ছেড়ে দিতে তাদের বাধ্য করা হয়।

আরব ট্রাইবগুলি মরুতে বসবাসরত অবস্থায় মদীনায় ট্যাক্স পাঠাত, আর ইরাকে অভিবাসনের পর এখন তারা উল্টো পায় সরকারী ভর্তুকি। এরা কিন্তু ইরাকের আদি অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে তাদের জমিজমা দখল করেনি। চাষাবাদে আরব বেদুঈনদের কোন আগ্রহ ছিল না, আগের চাষীদের থেকে কর আদায় করেই তারা ক্ষান্ত হয়েছে। যে করটা এসব আরামায়িকভাষী চাষীরা ইরানিদের দিত, তা এখন পাওয়া শুরু করে আরব গোত্রগুলো। আরবদের জনসংখ্যা বাড়া শুরু করলে কুফা-বসরা শহরে ধীরে ধীরে অশান্তি-অরাজকতা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম ও দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধে তার একটা বিশেষ গুরুত্ব ছিল। সে ব্যাপারে পরে বলব।

ইসলামী সরকার কেবল সেসব জমিগুলির অধিগ্রহণ করে যেগুলি শান্তিচুক্তিঅনুযায়ী স্থানীয়রা তাদের কাছে ছেড়ে দেয়, নয়ত যেগুলি আগে ছিল সাসানী সরকারের মালিকানাধীন, নতুবা তাদের মালিক যুদ্ধে নিহত হয়েছে কিংবা দেশান্তরী হয়েছে। সেসব জমির চাষাবাদ থেকে পাওয়া কর দিয়ে সরকার পরিচালিত হত।

সরকারী কাজে যেসব ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও অন্যান্য জাত-ধর্মের কর্মচারী ছিল, তাদের অবস্থানও অটুট থাকে। সরকারী ভাষা তখনও পাহলভী। উমারের সময় থেকে আশি বছর পরে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাষাসংস্কারের আগে কোন খলীফা বা গভর্নর এসব প্রক্রিয়ার ওপর কোন হস্তক্ষেপ করেননি। সে ব্যাপারটা এই মুদ্রাগুলির মধ্যেও উঠে এসেছে।

সাসানী সম্রাটের মুখাবয়বওয়ালা এই মুদ্রা রাশিদুন খেলাফতের আমলে চালু তো ছিলই, উমাইয়া শাসনামলেও তার পরিবর্তন হয়নি। উমাইয়া খলীফা আব্দুল মালিক সিরিয়ার মুদ্রার সংস্কার করে তার থেকে মানব অবয়ব বাদ দিয়ে দেন ৬৯৬ সালে। কিন্তু ইরাকের এই মুদ্রার কোন পরিবর্তন তিনি করেননি। উমাইয়াদের পর আব্বাসিয়া খেলাফতের বেশ কিছু প্রদেশেও এমন মুদ্রা চালু ছিল। অর্থাৎ ৬৩৪ থেকে শুরু করে ৭৮৬ পর্যন্ত দেড়শ বছর ইসলামী সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের মুদ্রায় শুধু রাজার মুখচ্ছবি নয়, জোরোয়াস্ত্রিয়ান ধর্মের চাঁদতারা প্রতীক ও অগ্নিবেদী শোভা পেয়েছে।

আজ এ পর্যন্ত। আগামী পর্বে আসবে স্ট্যান্ডিং কালিফ অর্থাৎ দন্ডায়মান খলীফার অবয়ব ও বিকৃত ক্রুশ অংকিত সিরিয়ার তামার ফালস, যেটা ছিল প্রথম ইসলামী মৌলিক ডিজাইনের মুদ্রা। ঐ যে আব্দুল মালিকের কথা বললাম, তারই নির্দেশে মুদ্রিত। মানুষের ছবি তো বটেই, বিজ্যান্টিন বা সাসানী সম্রাটের নয়, স্বয়ং ইসলামের খলীফার! আর সাথে লিখব তার সেই সংস্কারের পটভূমি।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




ভারতীয় ভক্তিবাদ – ৩

Featured Video Play Icon

সাব আয়া একহি ঘাটসে, উৎরা একহি বাট, বীছ মে দুৰিধা পাড় গা’ই, হো গায়ি বারা বাট — সন্ত কবীরের পঞ্চদশ শতকের মলৰী ভাষায় গাওয়া ভজন। সবাই আসছিল একই ঘাট থেকে, সবার একই পথ, মাঝে পড়ল দ্বিধায় সকলে, হয়ে গেল বারো পথ।

কবীরের একশ’টি ভজন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ইংরেজী সংকলন বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালে। সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি। রবীন্দ্রনাথ যে কবীরকেই তুলে ধরেছেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস কবীরের দর্শনের মতই নিরাকার একত্ববাদী। এখনও কবীরপন্থা বলে একটি ধর্মবিশ্বাস বহু ভারতীয় অনুসরণ করে।

আগেই বলেছি চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক ভারতের জন্যে ক্রান্তিকাল। উত্তর ভারতে মুসলিম দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ হলেও আগের সেই স্থিতিশীলতা নেই। দিল্লী সুলতানাতের মত বড় রাজ্য ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে অনেক সামন্ত রাজ্য। রাজনৈতিক ভাগ্য ও সামাজিক অধিকারের অবস্থা ক্রমপরিবর্তনশীল।

ইসলাম ধর্ম ভারতীয় স্থানীয় দর্শনগুলোর জন্যে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ভারতে যে সময় ইসলামের আগমন, তখন মোটে বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চলছে। এর পুরোভাগে ছিল বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজবংশ, যাদের মধ্যে পড়ে বাংলার সেনরা।

ইসলাম শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভারতীয় ধর্মগুলির প্রতিযোগী। অন্তত থিওরিতে ইসলামে জাতপাত নেই, সবার জন্যে খোদার করুণা সমান। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মানুসারীদের বাদ দিলে ভারতীয় বর্ণপ্রথার জন্যে এ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মত সীমান্তবর্তী জায়গা, যেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণবাদে নিষ্পেষিত বহু প্রাক্তন বৌদ্ধ ও অসবর্ণ মানুষ রাষ্ট্র ও ধর্মের চোখে অস্পৃশ্য, তাদের জন্যে ইসলাম ছিল আকর্ষণীয় একটি বিকল্প।

যারা নিচু শ্রেণীর খেঁটে খাওয়া মানুষ, তাদের সকলে যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা নয়। ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে মার্কেট এক্সপানশন হয়েছে অনেক কুটিরশিল্পের। ব্রাহ্মণদের চোখে চন্ডাল হলেও নিম্নবর্ণের শূদ্ররা কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এ ধরনের নিম্ন মধ্যবিত্ত অত সহজে ধর্মান্তরিত হয়নি, হলেও তা হয়েছে নামে মাত্র। ইসলামগ্রহণ যদি নাও করে, নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু বর্ণপ্রথায় তাদের তেমন কোন সম্মানজনক স্থান নেই। অর্থাৎ, এরা না ঘরকা, না ঘাটকা। এরকম আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী প্রতিবাদ ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

দরিদ্র তাঁতী পরিবারের কবীর সেই নিষ্পেষিত শ্রেণীরই প্রতিনিধি। তিনি মুসলিম ছিলেন না হিন্দু, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাকে স্ব-স্ব ধর্মের সন্ত বানাতে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সকলে এক পায়ে খাঁড়া। অথচ জীবদ্দশায় সম্ভবত তাকে হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই গঞ্জনা সইতে হয়েছে।

কবীরের ভজন গবেষণা করে যতটুকু মনে হয়, মুসলিম পরিবারে বড় হলেও সে ধর্মের খুব বেশি জ্ঞান তার ছিল না। সম্ভবত তার পরিবার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের কনভার্ট। কিন্তু সাবালক বয়েসে কবীরের হাতেখড়ি বৈষ্ণব ভক্তিবাদের সমসাময়িক সাধক রামানন্দের হাত ধরে।

কবীরের দর্শনকে সহজিয়া বলা যেতে পারে। সহজ ভাষায় তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন তা হলো, বাইরে দিয়ে ধার্মিক হয়ে কোন মোক্ষ নেই, অন্তরে থাকতে হবে ভক্তি। দেবমূর্তি তো কোন কথা বলে না, তাকে কেন পূজবো? ঈশ্বরের বাস সে তো মন্দির-কাবায় নয়, মানুষের অন্তরে। মুসলিম কাজী সে একদিকে কুরআন বাঁছে, আরেকদিকে কেড়ে নেয় গরীব মানুষের জমি। তেমন তিলকছাঁপা হিন্দু ব্রাহ্মণ যতই বেদপাঠ করুক না কেন, আত্মার মধ্যে যদি সেটা সে ধারণ না করে, তারও নেই পাপমোচন। অন্তর ভাল না হলে বাইরের পাকপবিত্রতার কোন মূল্য নেই।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




দু’হাজার বছর আগে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গৌতমবুদ্ধের যে বিপ্লব, সে ছিল আর্য উচ্চবর্ণের ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের বিরুদ্ধে আরেক উচ্চবর্ণেরই প্রগতিশীল প্রতিবাদ। আর কবীরের প্রতিবাদ একেবারে তৃণমূল থেকে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে, তাদের দুর্নীতি-অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। তার দর্শনে রয়েছে সাম্যবাদের ইউটোপিয়া, যেখানে কোন নিষ্পেষন নেই, জাতপাত নেই, সরকার-রাষ্ট্র নেই, কর নেই।

এভাবে কবীর ভারতীয় মানুষের মোহভঙ্গ হওয়া একটা বিশাল অংশের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। আর তার পথ ধরেই আবার হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ভারতীয় সিনক্রেটিজম-সিনথেসিসের বীজ বপন হয়। পরবর্তী সন্ত-সাধু সন্ন্যাসী-ফকির ইসলামের নামেই হোক, আর হিন্দু ধর্মের নামেই হোক, একই রকম হৃদয়গ্রাহ্য সার্বজনীন মানবিক ধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন।

কবীরপন্থার একটা বৈশিষ্ট্য অনেকান্তবাদ, অর্থাৎ মোক্ষলাভের উপায় কেবল একটি নয়, বহু — কিন্তু সকলের লক্ষ্য ঐ একই।

কবীরের ভক্তিবিপ্লব প্রসঙ্গে আরো দুটি জিনিস মাথায় এল, যা না বললে নয়। এক, মধ্যযুগের শেষে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন কিছু ভিন্ন ছিল না। ক্যাথলিক পাদ্রীকূলও ছিলেন মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানেও খ্রীষ্টান জগতে কবীরের মতই এক জ্ঞানবিপ্লব সংঘটিত হয়, যার নাম প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন। জার্মানির বেনেডিক্টবয়ার্ন মঠে খুঁজে পাওয়া রিফর্মেশনপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের কারমিনা বুরানা নামের পান্ডুলিপি ঘাঁটালে একই রকম প্রতিবাদী ভক্তিবাদ চোখে পড়বে। এব্যাপারে এখানে আগে লিখেছি।

আর দুই, অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভক্তিবাদ! হ্যাঁ, এ বস্তুও আছে। তার একটা ধারা সাদার্ন কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের থেকে এসেছে, যাকে বলে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলিকে সমসাময়িক দাসত্বশৃংখলের সাথে যুক্ত করে একটা খোদাভক্তি ও প্রতিবাদ সেখানে উঠে এসেছে। ওয়েড ইন ওয়াটার গানটা মনে আসল। এ গানটি বাপ্টিজমের রেফারেন্সে ভক্তিমূলক হলেও দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ রয়েছে। পানিতে সাঁতরালে পলায়নপর দাসের গায়ে আর কোন গন্ধ থাকে না, মনিবের কুকুরও তাকে আর অনুসরণ করতে পারে না।

Let’s wade in the water,
Wade in the water,
Listen to me now, wade in the water.
I wanna know that you’re mine,
Because your love is so fine.

আরেকটি হলো শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিকাল খ্রীষ্টান মূলধারার ফোক গসপেল সঙ্গীত। এটিও সাউথের। এর উদাহরণ মনে হলো ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ ছবির একটা গান:

As I went down in the river to pray
Studying about that good ol’ way
And who shall wear the robe & crown?
Good Lord show me the way

সুতরাং কবীরের ঐ অনেকান্তবাদ আসলে লার্জার কনটেক্সটে খুবই সত্য। পৃথিবীতে আজ ‘বারো’ পথ, কিন্তু সবার সেই একই ঘাট, একই পথ, একই গন্তব্য। কাহাঁ সে আয়া কাঁহা যাওগে, খাবার কারো আপনে তান কি, কোয়ি সাদগুরু মিলে তো ভেদ বাতাৰে, খুল যাৰে অন্তর খিড়কী…



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!