এক বছর আগের সূর্যাস্তের স্মৃতি — ইজরাইলের তেল আবিব শহরের নিকটস্থ পুরনো জাফা শহরতলীতে। পর্যটকদের জন্যে পাথরে তৈরি পুরনো সব ঘরবাড়ি, দুই তিন তলা সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়া অলিগলি সব অক্ষত রাখা হয়েছে।
সারি বেঁধে তিন চারটে কামান সমুদ্রের দিকে মুখ করে রাখা। অটোমান তু্র্কী আমলের সিটাডেলের প্রতিরক্ষাব্যূহের অংশ। ১৭৯৯ সালে স্বয়ং নাপোলেওনের জাহাজবহর সে প্রতিরক্ষাভেদ করে জাফা শহরে সফল আক্রমণ চালায়।
ঊনবিংশ শতকে স্থানীয় ও নবাগত অভিবাসী ইহুদীরা যখন অনতিদূরে তেলআবিব শহরের গোড়াপত্তন করছে, তখন জাফা নগরী কমপক্ষে ৩৭০০ বছরের পুরনো। ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী জাফার বন্দর থেকেই ইউনুস নবী — বাইবেলের জোনাহ — সাগরপাড়ি দিতে গিয়ে বৃহৎকায় মাছের পেটস্থ হন।
মিশরের নিউ কিংডম আমলেও জাফা ছিল কৌশলগত একটি অবস্থান। সেসময়ের জাফাকে ঘিরে একটি ঘটনাই হয়তবা রূপকথার পাতায় স্থান করে নিয়েছে। আরব্যরজনীর আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্পটি। খ্রীষ্টের জন্মের ১২০০ বছর আগে ফারাও তৃতীয় তুথমোসের শক্তিমান সেনাপতি জেহুতি ইজরাইল-কানানের স্বাধীন নগররাজ্যগুলোর ওপর সাম্রাজ্য কায়েম করেন। তখনো ইহুদী রাজ্য ইজরাইল-জুদার গোড়াপত্তন হয়নি। মিশরীদের তদকালীন শত্রু ছিল উত্তরে তুরস্কের হিট্টাইটরা। ইজরাইল-প্যালেস্টাইনের নগররাজ্যগুলি দুই সাম্রাজ্যের মাঝে এক রকম চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যায়।
জাফা দখলের জন্য এক অভিনব কৌশল অবলম্বন করেন জেহুতি। নগরপতিকে নিজের ক্যাম্পে দাওয়াত করে নিয়ে এসে আটকে ফেলেন। তারপর দু’শ সৈন্যকে গমের বস্তার মত সাজিয়ে গাধার পিঠে চাপিয়ে দুর্গের দরজায় পাঠানো হয়। ঘোষণা করা হয়, রাজ্যপালের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন জেহুতি। আর নগরবাসীদের উপঢৌকন পাঠানো হয়েছে গাধায় করে। উল্লসিত জনগণ দরজা খুলে গাধার কাফেলাকে বরণ করে নেয়ার পর রূপকথার চিচিঙ ফাঁক!
এ গল্প রয়েছে মিশরে প্রাপ্ত বিখ্যাত হ্যারিস প্যাপিরাস ৫০০তে, যেটি এখন ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত। প্রাক-আধুনিক যুগেই এই প্যাপিরাসসহ অনেক বস্তু মিশরীয় কোন না কোন রাখাল খুঁজে পেয়ে বিক্রি করে দেয় ইউরোপীয় ধনাঢ্য সংগ্রহকারীর কাছে।
বর্তমান জাফায় রয়েছে অটোমান যুগের বহু নিদর্শন। কিছুই ধ্বংস করা হয়নি। একটা ক্লক টাওয়ার। লাইটহাউজ, জেলখানা — সেটি এখন ফাইভস্টার হোটেল। তিনটা মসজিদঃ মাহমুদিয়া মসজিদ, আল বাহর মসজিদ, আজামি মসজিদ। সবগুলি সাগরতীরে প্রাইম প্রপার্টিতে। আরো আছে সেন্ট পিটার্স ক্যাথলিক চার্চ, সেন্ট অ্যান্টনিস ম্যারোনাইট চার্চসহ অগণিত ছোটবড় গীর্জা-ক্যাথেড্রাল। এগুলিতে উপাসনা করে মূলত আরব ফিলিস্তিনীরাই। বিশেষত লেবাননী আরবরা ম্যারনাইট তরিকার খ্রীষ্টান। এতগুলি চার্চ থাকার কারণ, যীশু খ্রীষ্টের অন্যতম শিষ্য সেন্ট পিটার নাকি এখানে মৃতকে পুনরুজ্জীবিত করার মাজেজা ঘটিয়েছিলেন।
রূপকথা আর মাজেজার শেষ এখানেই নয়। বন্দর থেকে সামান্য দূরে সাগরের বুকে জেগে থাকা একটা বড় পাথরের নাম অ্যান্ড্রমেডা রক। গ্রীক মিথে জাফার রাজা সিফিয়াস, তার কন্যা অ্যান্ড্রমিডা — যার নামে একটা গ্যালাক্সির নাম। আর তার বউ ক্যাসিওপিয়া — যার নামে একটি তারকামন্ডলের নাম। সিফিয়াস গর্ব করত এ দুজন নাকি জলকন্যাদের থেকেও রূপবতী। জলকন্যারা তাদের বাপ দেবতা পসাইডনের কাছে বিচার দিলে পসাইডন বিশাল এক সমুদ্রদানব পাঠিয়ে জাফাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হন। তখন অনন্যোপায় সিফিয়াস শহরবাসীদের সাথে ষড় করে ঠিক করেন পসাইডনের কাছে বলি দিতে হবে অ্যান্ড্রমিডাকে। তারপর এই পাথরেই শৃংখলাবদ্ধ করে রাখা হয় অ্যান্ড্রমিডাকে। তাকে দানবের হাত থেকে বাঁচায় পার্সিয়াস — গ্রীক মিথের অন্যতম হিরো।
রূপকথার এ নগরে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে এসব খেলে গেল মাথার ভেতরে। রোমহর্ষক ব্যাপার! আধুনিক কালে ফিরিয়ে আনল মোটে চৌদ্দশ বছরের পুরনো আযানের ধ্বনি। মাগরিবের পরে দেখা গেল বহু আরব মুসলিম নরনারী — অনেকে আবায়া পরে — সাগরতীরে হাওয়া খাচ্ছে, সেলফি তুলছে। এসইউভির নাম্বারপ্লেট ওয়েস্ট ব্যাংকের। কে বলবে মোটে এক ঘন্টার রাস্তার ওপারে পবিত্র ভূমি নিয়ে এরা এবং এদের প্রতিবেশীরা বাস করছে অনিশ্চয়তার অন্য এক জগতে?
ইরাকী কুর্দিস্তান যেমন মার্কিন কোয়ালিশনের যুদ্ধের কারণে উপকৃত হয়েছে, তেমনি আরেকটি দেশের কুর্দীরাও সেখানকার গৃহযুদ্ধ থেকে লাভবান হয়েছে। সে দেশটি সিরিয়া। সেখানে মার্কিনরা তেমন কোন বড় মাপের হস্তক্ষেপ করেনি। তারপরও কুর্দীরা নিজেদের একটা স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকার নিয়ন্ত্রণ পেয়েছে।
সিরিয়ায় কুর্দী জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। অধিকাংশ বিংশ শতকের শুরুতে তুরস্কের কুর্দীনিধন অভিযান থেকে পালিয়ে আসা অভিবাসী। সিরিয়ার উত্তরের স্বল্প জনঘনত্বের পাহাড়ী এলাকাগুলিতে বসবাসের অনুমতি তারা পায় ফরাসী ম্যান্ডেট সরকারের কাছ থেকে। স্বাধীনতার পরিবর্তে ফরাসীদের অধীনে স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাংক্ষা ছিল তাদের বেশি, আলাউয়ীদের মতই। কারণ সিরিয়ার স্বাধীনতা মানে সংখ্যাগুরু আরবদের লাথি-গুঁতো খাওয়া!
সিরিয়ায় কুর্দী ভাষা দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ, কিন্তু দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি নেই। ১৯৬২ সালে বাথিস্ট ক্যুএর পর দেশটির কুর্দী জনগোষ্ঠীর ২০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় দেড় লাখ মানুষকে নাগরিকতাবঞ্চিত করা হয়। কারণ তারা নাকি তুরস্ক থেকে আগত “বিদেশী।” ফরাসী ঔপনিবেশিক প্রশাসনের দেয়া বৈধ কাগজ ছিল অগ্রহণযোগ্য। এর ফলে বহু রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত হয়। শিক্ষা, রাজনীতি, সম্পত্তির মালিকানা, পাসপোর্টের আবেদন — ইত্যাদি সব কিছুই জটিল হয়ে যায় তাদের জন্যে। তাদের “পতিত জমি” বেহাত করে সুন্নী আরব ও অ্যাসিরীয় খ্রীষ্টানরা।
তুরস্কের সীমানা থেকেও কুর্দীদের উচ্ছেদ করে সেখানে একটি “আরব বেল্ট” তৈরির চেষ্টা করে বাথিস্ট সরকার। অজুহাত যে সীমান্তে শত্রুভাবাপন্ন “বিদেশী” থাকাটা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য ভাল নয়। বহু স্থানের নাম কুর্দী থেকে আরবী করা হয়। জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করা হয় সাধারণ কৃষকদেরকে। কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নিষেধাজ্ঞা আসে নবজাতকের কুর্দী নামকরণের ওপর। জনসমক্ষে কুর্দী ভাষা ব্যবহার আর প্রাইভেট স্কুল পরিচালনাও হয় নিষিদ্ধ।
আশির দশকেও সিরিয়ায় কুর্দী বই, ক্যাসেট ইত্যাদি প্রকাশ ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বিয়ের অনুষ্ঠানে কুর্দী ঐতিহ্যবাহী পোশাকপরিধান বা গান গাওয়া ছিল নিষেধ। ১৯৮৬ সালে কুর্দী নববর্ষ নওরোজের জনসমাবেশে এমন নিষেধাজ্ঞা না মানার কারণে সিরীয় পুলিশ গুলি চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে।
ইরাক যুদ্ধ শুরুর পরপরই ২০০৪ সালে কামিশলি শহরে কুর্দী ও আরবদের মধ্যে বুশ বনাম সাদ্দামকে সমর্থন নিয়ে দাঙ্গা বেঁধে যায়। কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপে আবারও রক্ত দিয়ে অসম মূল্য দিতে হয় কুর্দী সাধারণ মানুষকে। ২০১১ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হলে কুর্দী নেতাদের শুরুতেই গুপ্তহত্যার মাধ্যমে নিকেশ করে আসাদবাহিনী। কিন্তু দেশের অন্যত্র আরো ভয়াবহ বিদ্রোহ ঠেকাতে কুর্দী অঞ্চল থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়ে আসতে হ্য় বাশার আসাদকে।
সেই শূন্যতার সুযোগেই উত্তর সিরিয়ার বিশাল এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয় কুর্দী ন্যাশনাল কাউন্সিল। আমুদা-কামিশলি-আফরিন-কোবানি প্রভৃতি শহরে সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন স্থাপিত হয় তাদের নব্যপ্রতিষ্ঠিত সামরিক বাহিনী ওয়াই,পি,জি’র সহায়তায়। এই ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দী অঞ্চলের নাম “রোজাভা।”
নিজের লেজিটিমেসি ধরে রাখার জন্যেই হয়ত বাশার আসাদ রোজাভায় শক্ত হাতে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেনি। ২০১১ সাল থেকে কুর্দীদের পাসর্পোট ও নাগরকিত্বের সনদও দিতে শুরু করে তার সরকার। অন্যান্য শত্রুর থেকে কুর্দীরা তার কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য। তাই রোজাভার বেশ কিছু শহরে আসাদ সরকারের সাথে সহাবস্থান করতে সংকোচ করছে না কুর্দী প্রশাসন।
২০১৪ সালে কোবানি শহরের কুর্দী অবস্থানের চারদিকে অবরোধ বসায় আইসিস। শহরটির স্বল্পসংখ্যক ওয়াই,পি,জি সদস্য রিইনফোর্সমেন্ট না আসা পর্যন্ত তাদের অবস্থান ধরে রাখে। রক্ষা করে শহরটির সিভিলিয়ানদের। শেষ পর্যন্ত কুর্দী পাল্টা আক্রমণে আইসিস পিছু হটতে বাধ্য হয়। তাদের ধাওয়া দিয়ে রাক্কা পর্যন্ত দখল করে নেয় ওয়াই,পি,জি। এ কাজে তাদের সাথে শরিক ছিল ওয়াই,পি,জে নামে নারীযোদ্ধাদের মিলিশিয়াও। পুরো সিরিয়াতে যদি কোন প্রশিক্ষিত ডিসিপ্লিনড ফোর্স থেকে থাকে তো সে এই ওয়াই,পি,জি, এটা মার্কিন ডিফেন্স ডিপার্টমেন্টের মন্তব্য। এয়ারস্ট্রাইকের মাধ্যমে কোবানির অবরোধ ভাঙতে তাদের সহায়তা করে মার্কিন বিমানবাহিনী।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
আইসিসের পতনের পর সিরিয়ার আরো বিশাল এলাকা আসে রোজাভার নিয়ন্ত্রণে। শুধু কুর্দী নয়, আরব, অ্যাসিরীয়, ইয়াজিদী প্রভৃতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সাথে সমঝোতা করতে হয় তাদের। রোজাভার নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় অটোনমাস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অফ নর্থ এন্ড ঈস্ট সিরিয়া (আনেস)।
বহুজাতিক এই স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চলে লিবার্টারিয়ান সোশালিজম হচ্ছে আদর্শ। প্রতিটা শহরের স্থানীয় মানুষ স্থানীয় সরকারের নেতৃত্বে। আনেস কাগজেকলমে কুর্দী জাতীয়তাবাদ সমর্থন করে না, আর সিরিয়ার মাঝেই ফেডারেল সিস্টেমে স্বায়ত্ত্বশাসন চায়। অর্থাৎ ইরাকি কুর্দিস্তানের মত। ইরাকী কুর্দীদের মত এরা রক্ষণশীল না হলেও দজলা নদের ওপারের বন্ধুদের থেকে রসদ সরবরাহ তারা পায়।
ইরাকের মত সিরিয়াতে আরেকটি স্বায়ত্ত্বশাসিত কুর্দিস্তান হয়ে যার বাড়া ভাতে ছাঁই ঢেলেছে সে হল তুরস্ক। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান স্বয়ং মার্কিনদের দোষারোপ করেন “ভুল ফরেন পলিসির” জন্য। এটা যতটা না ইরাক যুদ্ধের সাথে জড়িত, তার থেকে বেশি তুরস্কের কুর্দী সমস্যাটিকে বাড়িয়ে দেবার জন্য। ওদিকে সিরিয়ার কুর্দীরা আইসিস বা আসাদকে যতটা শত্রু ভাবে, তার থেকে অনেক বেশি ভাবে তুরস্ক ও “সুলতান” এরদোয়ানকে। কারণ ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত একাধিক তুর্কী সামরিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছে অগণিত সাধারণ সিরিয়ান কুর্দী।
গত পোস্টে বলেছি ইরাকের বাথিস্ট সরকার কি পরিমাণ অত্যাচার কুর্দীদের ওপর করেছে। আরেকটি যে দেশে দশকের পর দশক এমন অত্যাচার চলেছে সেটি তুরস্ক। ১৯২৩ সালে ওসমানী খেলাফতের সমাপ্তি হয়। সে জায়গায় কামাল আতাতুর্ক যে আদর্শের ওপর ভিত্তি করে আধুনিক তুরস্কের গোড়াপত্তন করেন সেটা তুর্কী জাতীয়তাবাদ। তাতে তুর্কী ব্যতীত অন্য জাতিসত্তার পরিচয়ের স্থান ছিল না। আগে অন্তত যে মুসলিম পরিচয়ের কারণে “খলীফা” তার কুর্দী প্রজাদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম ছিলেন, সেটি রাতারাতি বিলুপ্ত হল। যে মিল্লি সিস্টেমের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজাতি ও ধর্মের মানুষকে নিজেদের সমাজে নিজেদের অনুশাসন অনুযায়ী চলার স্বাধীনতা দেয়া ছিল, তার জায়গা নিল কেন্দ্রীয় সরকারের আরোপিত সেক্যুলার সিস্টেম।
কামাল আতাতুর্কের প্রগতিশীল কিন্তু স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে একের পর এক মাদ্রাসা, সুফী দরগা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কুর্দী সংবাদপত্র প্রভৃতি বন্ধ হতে শুরু করে। তার প্রতিক্রিয়ায় ১৯২৫এ সুফী ঘরানার একটি কুর্দী বিদ্রোহ হয়। সেটিকে কঠোর হাতে দমন করে তুর্কী বাহিনী। স্বল্প কয়েকটি উপজাতির বাইরে অবশ্য এ আন্দোলনের নেতার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। যুদ্ধবিমান ও মেশিন গানের সাহায্যে তার মধ্যযুগীয় সৈন্যদের কচুকাটা করে তুর্কীরা। বিদ্রোহের পতনের পর হাজারে হাজারে কুর্দীদের বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।
১৯২৭ সালে আরো বিশাল আকারে বিদ্রোহের সূচনা করেন আরেক নেতা ইহসান নুরী, তার সমর্থনে ছিল খয়বুন নামে কুর্দী জাতীয়তাবাদী একটি দল। আগের ধর্মীয়-উপজাতীয় মোটিভটাকে ধর্ম ও জাতিনিরপেক্ষ রূপ দেয়ায় তাদের সমর্থন আরো জোরালো হয়। “রিপাবলিক অফ আরারাত” নামে একটি স্বঘোষিত কুর্দী দেশ তৈরি হয় দক্ষিণপূর্ব তুরস্কে। আগেরবারের থেকে বেশি প্রখরতায় এদের ওপর বিমানহামলা চালানো হয়। মোস্তাফা কামালের মেয়ে সাবিহা গুকচেন স্বয়ং ফাইটার থেকে বোমানিক্ষেপ করে এসকল “দস্যুর” ওপর। ১৯৩০ সালে এ বিদ্রোহের সমাপ্তি হয়।
এরপর ১৯৩৭এ দেরসিম (বর্তমান তুঞ্জেলি) প্রদেশের সীমান্তবাসী কুর্দীদের সিরিয়ার মত “তুর্কীকরণের” প্রচেষ্টা চলে। সেসব স্থানে কুর্দীদের সরিয়ে কসোভার আলবেনিয়ান ও বসনিয়ানদেরকে পুনর্বাসন করা হয়। কুর্দী শিশুদের বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে তাদের তুর্কী নাম দিয়ে তুর্কী শিখিয়ে কুর্দী পরিচয় বিলোপের চেষ্টা চলে। সেখানে যে পরিমাণ হত্যাযজ্ঞ চলে, তা আর্মেনি গণহত্যাকেও হার মানায়। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান আর্মেনী গণহত্যা স্বীকার না করলেও ২০১১ সালে দেরসিম গণহত্যার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন।
ষাটের দশক পর্যন্ত দক্ষিণপূর্ব তুরস্ক ছিল বিদেশীদের জন্য অফ লিমিট। কারণ সে অঞ্চলে সামরিক শাসন জারি ছিল। দমবন্ধকরা একটা পরিস্থিতি। ত্রিশের দশক থেকেই কুর্দী নামকরণ, ভাষা, উপকথা, ঐতিহ্যবাহী পোশাক, রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ। ডিকশনারি থেকেও কুর্দ-কুর্দিশ-কুর্দিস্তান শব্দগুলি এক্সপাঞ্জ! তুর্কী নেতারা কুর্দীদের সম্বোধন করত “মাউন্টেন টার্ক” অর্থাৎ পাহাড়ী তুর্কী নামে। সোজা কথায়, কুর্দী বলে কোন কিছু নেই, ছিল না — থাকবে না।
এ ধরনের পরিস্থিতিতে নেটো সদস্য তুরস্কের মধ্যে গন্ডগোল পাকানোর মালমশলা হিসাবে কুর্দী জননেতৃত্ব সোভিয়েতের জন্য রেডি হয়ে বসে ছিল। সত্তরের দশকে তুরস্কে অতিবাম অতিডান দুই দলের মধ্যে ভয়াবহ রকমের সড়কযুদ্ধ চলত। এ পটভূমিতে আব্দুল্লাহ ওজালান নামে অর্ধ-কুর্দী এক ইউনিভার্সিটি ড্রপআউট শুরু করেন তার কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি বা পিকেকে দলটি। প্রথম প্রথম তাদের লক্ষ্য ছিল কুর্দীদের সমাধিকারের জন্য লড়াই। পরে সেটা হয়ে যায় সমাজতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা। বলা বাহুল্য, তার বামপন্থী রাজনীতি সকল কুর্দীকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়।
তবে ১৯৮০র তুর্কী সামরিক অভ্যুত্থানের পর পিকেকে’র সুযোগ আসে আবেদন বৃদ্ধির। সামরিক জান্তার ধরপাকড় থেকে বাঁচতে কুর্দী তো বটেই বহু তুর্কী লেখক-সাহিত্যিক-গায়কও ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমায়। এ শূন্যস্থানে পিকেকে সামরিক বাহিনীর ওপর চোরাগোপ্তা সন্ত্রাসী হামলা করে নিজেদের নেতৃত্বের একটা স্থান তৈরি করে নেয়। এমন না যে তারা ধোয়া তুলসী পাতা, কুর্দী বহু ল্যান্ডওনার আর উপজাতীয় নেতারাও তাদের জিঘাংসার শিকার হয়। পিকেকের চোখে এরা ছিল রাজাকার, শ্রেণীশত্রু।
১৯৮৪ সালে পিকেকের শুরু করা ইনসার্জেন্সিতে এ পর্যন্ত পয়ত্রিশ হাজারের মত তুর্কী মানুষ মারা গেছে যাদের সিংহভাগ কুর্দী সাধারণ নাগরিক। বহু সন্ত্রাসবাদী হামলা চলেছে তুরস্ক-ইস্তাম্বুলের ট্রেন-বাস টার্মিনাল, এয়ারপোর্ট, বাজার, ট্যুরিস্ট স্পটে। নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধ ছিল পিকেকে বনাম তুরস্কের বিবাদের পটভূমি। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে তাই তখন থেকেই পিকেকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসাবে স্বীকৃত। আয়রন কার্টেন ধ্বসে পড়তে শুরু করলে তুরস্ক ধীরে ধীরে কুর্দী ভাষা-সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে শুরু করে। রাষ্ট্রপতি তুরগুত ওজালের সাথে একটা শান্তি আলোচনা শুরু হলেও তার অকালমৃত্যুতে আবার ছক উল্টে যায়।
১৯৯৯ সালে মোসাদ স্টাইলে কেনিয়া থেকে আব্দু্ল্লাহ ওজালানকে ধরে নিয়ে আসে তুর্কী গোয়েন্দাবাহিনী এম,আই,টি। তখন প্রথম যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে পিকেকে। তারপরও থেমে থেমে এখনো সংঘাত চলছে। পিকেকে পালিয়ে ইরাকী কুর্দিস্তানের দুর্গম কান্দিল পর্বতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রায়শই ইরাকী কুর্দিস্তানের সরকার পিকেকে উচ্ছেদে তুর্কীদের সহায়তা করে।
পিকেকে তুরস্কের কুর্দী সংগ্রামের হেডলাইন কেড়ে নিলেও আসলে বহু ঘরানার রাজনীতি প্রচলিত আছে সেখানের কুর্দীদের মাঝে। তবে ১৯৯০ পর্যন্ত কুর্দী জাতীয়তাবাদী রাজনীতি সেখানে ছিল নিষিদ্ধ। প্রায়ই কোন না কোন কুর্দীপ্রধান দলকে বিচ্ছিন্নতাবাদের দায়ে তুরস্কের সুপ্রীম কোর্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। জনপ্রিয় নেতা সালাউদ্দিন দেমিরতাশ সেই অভিযোগে দশ বছর ধরে জেলে। আরেক সংসদসদস্য লেলা জানা শপথ গ্রহণের শেষে তুর্কী-কুর্দী ভ্রাতৃত্বের আকাংক্ষা প্রকাশ করেন। ফলঃ দশ বছরের জেল।
তাই ২০০৪ সালে প্রথম কুর্দী টি,আর,টি টিভি চ্যানেল যাত্রা শুরু করলেও তাতে প্রচারিত ইরানী দল রাস্তাকের সঙ্গীতের কথায় “কুর্দিস্তান” শব্দটি প্রতিস্থাপন করতে হয় “হাউরামান” প্রদেশের নাম দিয়ে। মোটে সে বছরই নবজাতকদের কুর্দী নামকরণের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়।
আয়রনিক ব্যাপার হল, ২০০৩ সালে প্রধানমন্ত্রী হবার পর এরদোয়ানই এমন উদারপন্থা অবলম্বন শুরু করেন। মার্কেট রিফর্মের পাশাপাশি কুর্দী-তুর্কী সম্পর্ক নর্মালাইজেশনের একটা চেষ্টা চলে। সেসব ওলট পালট হয়ে যায় সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের কারণে। অতীতে সিরিয়ার সরকার পিকেকে দলটিকে নানা সময় আশ্রয় দিয়েছে। রোজাভার কুর্দীরাও ওজালানের অনুসারী বামপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত। গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়া থেকে আগত অভিবাসীদের সাথে স্বাধীনতাকামী সন্ত্রাসবাদীরাও তুরস্কে ঢুকে পড়েছে। অন্তত এমনটাই এরদোয়ানের দাবি।
তুরস্কে ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিরিশটির মত সন্ত্রাসী বোমা হামলায় মারা গেছে সাড়ে পাঁচশর বেশি মানুষ। আক্রমণের দাবিদারদের মধ্যে ইসলামিক স্টেটের সন্ত্রাসবাদী আছে যেমন, তেমন বিভিন্ন ক্ষুদ্র অপরিচিত কুর্দী জাতীয়তাবাদী দলও আছে। তবে তুরস্কের সরকার প্রায়ই ঢালাওভাবে পিকেকে’কে এসবে মূল হোতা হিসাবে দাবি করে। আর যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র সিরিয়ার ওয়াই,পি,জি নাকি পিকেকেরই একটা শাখা, এটা তাদের দাবি।
এ কিছুটা সত্য। ওয়াই,পি,জির সমাবেশের ব্যানারে-পোস্টারে ওজালানের ছবি শোভা পায়। এ সকল কারণে ট্রাম্প প্রশাসন আইসিস উৎপাটন অভিযান সফল হবার পরপর সিরিয়ান কুর্দিস্তান থেকে মার্কিন সৈন্যদের আংশিক প্রত্যাহার করে নেয়। তবে এখনো একটা ভাল মার্কিন উপস্থিতি সেখানে রয়েছে।
মার্কিনরা সরে আসার পরপরই তুর্কীরা তিনটি বড় সামরিক অভিযান চালিয়ে সিরিয়ার উত্তরাংশ দখল করে রেখেছে। কুর্দী সন্ত্রাসবাদী দল যাতে তুরস্কে ঢুকতে না পারে সে কারণে বর্ডারের দশ-পনেরো কিলোমিটারে তারা সেফ জোন বানাচ্ছে। হয়তবা ভবিষ্যতে সিরিয়ান রেফ্যুজিদের সেখানে ফেরত পাঠাবে। আবার এক দফা কুর্দীদের সম্পত্তি বেদখল হবে।
এসব কারণে সিরিয়ার রোজাভার জনমানসে আইসিস নয়, বরং তুর্কীবিদ্বেষ। সীমানার অপর পারে তুর্কী কুর্দীরাও অসন্তুষ্ট। এদের সকলের ধারণা কুর্দীবিরোধী অভিযানে তুর্কী সেনাবাহিনীর সাথে আইসিস শরীক রয়েছে। ২০১৪ সালে কোবানি অবরোধের সময় যুক্তরাষ্ট্রই তাদের সাহায্য করে, আইসিসবিরোধী জজবা তুলেও এরদোয়ান কোন সাহায্য করেনি।
এই রোববার বোঝা যাবে এরদোয়ানের ভবিষ্যৎ কি, আর রোজাভার অধিকৃত এলাকার ভবিষ্যতও। তার বিরুদ্ধে যে প্রার্থী জনমত জরিপে এগিয়ে আছেন তার নাম কামাল ক্রিচদারোউলু। একাধিক কুর্দী রাজনৈতিক দলও তাকে সমর্থন দিচ্ছে।
এরদোয়ান যে সুইডেন-ফিনল্যান্ডের নেটো সদস্যপদ ঝুলিয়ে রেখেছেন, তার মূলেও এ কুর্দী সংঘাত। কুর্দীদের একটা বড় জনসংখ্যা ইউরোপে অভিবাসী। এরা সেসব দেশ থেকে অর্থ সাহায্য পাঠায় ইরাক-সিরিয়া-তুরস্ক-ইরানের কুর্দীদের। অনেক বিরোধী মতের কুর্দী নেতারাও রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে রয়েছে সেসব দেশে। সুইডেনে-ফিনল্যান্ডের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয়প্রদানের অভিযোগের মূল সেটাই। ওদিকে তুরস্কের বহু গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা এখন প্রশ্নবিদ্ধ, বিশেষ করে বিচারব্যবস্থার। সে কারণে তুরস্কের কোর্ট কাউকে “সন্ত্রাসবাদী” তকমা দিলেও সুইডেন-ফিনল্যান্ডের মত দেশ সাথে সাথে সেটা বিশ্বাস করবে না।
এই একই কারণে তুরস্ক সহজে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সদস্য হতে পারবে না। প্রথম পোস্টে আমি বলেছিলাম কেন কিভাবে মাইনরিটি রাইটস এর ব্যাপারটা ইউরোপীয় রাষ্ট্রসংজ্ঞার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে গেছে। তার মূলে রয়েছে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রক্তস্নাত ইতিহাস। ইইউএর সদস্যপদ লাভের জন্য একটি দেশকে অবশ্যই স্বদেশের জাতিগত, ধর্মীয় ও ভাষাগত সংখ্যালঘুদের অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে হবে। ঐ লেঠা না চুকিয়ে ইইউতে ঢুকলে আবারও সে পুরনো ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা। তাই যতদিন না কুর্দী প্রশ্নের একটা যথাযথ উত্তর তুরস্ক বের করতে না পারছে ততদিন ইউরোপীয় দেশ তারা নয়।
আর এ প্রসঙ্গে আমার মত যারা পশ্চিমা দেশে আরামে শান্তিতে বসবাস করছেন, তাদেরও মনে করিয়ে দিতে চাই যে আমরা কিন্তু ঐ মাইনরিটি রাইটসের সংজ্ঞাটির সুবিধাভোগী হয়েই উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি পাচ্ছি! যদি ভাবেন স্বদেশে বাঙালী বা মুসলমানরাই হবে সব ক্ষমতার মালিক, কিংবা ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী নস্টালজিয়াই সকল সমস্যার উত্তর, তো সেটা হবে চরম হিপোক্রেসি!
ইউরোপ-আমেরিকা উন্নতি করেছে শুধু টেকনোলজির বদৌলতে নয়, তারা স্বদেশের মানুষকে, আই মীন আপামর সকল মানুষকে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটা গ্রহণযোগ্য সমাধিকার দেয়। স্বদেশের অর্থনৈতিক-সামরিক সকল প্রকার নিরাপত্তা ও উন্নতির জন্য সে ডাইভার্সিটিটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যতদিন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে এটা সঠিকভাবে স্বীকৃত না হবে, ততদিন জনগোষ্ঠীর একটা বড় পটেনশিয়াল থেকে বঞ্চিত হবে দেশ ও জাতি। সোভিয়েতের পতন হয়েছে, কিন্তু এখানে এখনও একটা বিশাল মানসিক ডিভাইড রয়ে গেছে ঈস্ট আর ওয়েস্টের মধ্যে। এই আয়রন কার্টেনের পতন না ঘটলে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি কোথাও নেই।
“ইরাক ওয়ার ওয়াজ এ গুড থিং!” ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আপনি নিশ্চয় এমন উত্তর দেবেন না? কিন্তু ইরাকের কেউ না কেউ এমন উত্তর আপনাকে দেবেই। এবং নব্বই শতাংশ সম্ভাবনা সে একজন কুর্দী!
ইরাকের বাথিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ রেজোল্যুশন ১৪৪১ লংঘনের অভিযোগে যে যুদ্ধটি ২০০৩এ শুরু হয়, তার সবচেয়ে বড় বেনেফিশিয়ারি ইরাকী কুর্দিস্তান আর তার পলিটিকাল ক্লাস। সাদ্দামের আমলে যে আরবিল ছিল মফস্বলের অনুন্নত প্রাদেশিক একটি শহর, সেটি আজ তেলের পয়সায় সম্পদশালী। বাকি ইরাকের তুলনায় কুর্দিস্তান রিজিওন তুলনামূলক নিরাপদ এলাকা। কুর্দী যে সকল নেতারা ইরাক-ইরানের সীমান্ত বরাবর অতীতে পালিয়ে বেড়াত, তারা আজ বাগদাদে শক্তিমান পাওয়ার ব্রোকার। যে ইরাকে কখনো সুন্নি আরব ছাড়া রাজা বা রাষ্ট্রপতি কেউ হয়নি, সেখানে এখন অলিখিত আইন যে রাষ্ট্রপতি হবেন একজন কুর্দী। আর একজন নয় চারজন রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সে নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে।
প্রতিবেশী দেশের কুর্দীদের জন্যে ইরাকী কুর্দিস্তান আশার আলোকবর্তিকা, কিন্তু তাদের সরকারগুলির জন্যে একটা গাত্রদাহের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকী কুর্দীদের সমর্থন পেয়েছে ও দিয়েছে, সেটা আশপাশের দেশগুলিকে, বিশেষ করে তুরস্ককে, মার্কিন মিত্রতা নতুন করে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছে।
ইরাকী কুর্দিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি যে উপজাতির নেতা, সেটিই বহু দশক ইরাকে কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিল। ত্রিশের দশকে মাসুদের চাচা আহমেদ বারজানি রাজতন্ত্রী সরকারের কেন্দ্রীকরণ আর উপজাতীয় অধিকার হরণ নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিফল হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাসুদের বাবা মুস্তাফা নতুন করে আরেকটি বিদ্রোহের সূচনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পালিয়ে সীমান্তের অপর পারে ইরানী কুর্দীদের সাথে হাত মেলান।
গত পোস্টে বলা সোভিয়েত পাপেট রাষ্ট্র রিপাবলিক অফ মাহাবাদকে মু্স্তাফা বারজানির উপজাতীয় সৈন্যদল সামরিক সহায়তা দেয়। কিন্তু সোভিয়েতরা কেটে পড়লে তাদের সাথে সাঙ্গপাঙ্গসহ আজারবাইজানে চলে যান মু্স্তাফা। কম্যুনিস্ট পার্টির পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নেন তিনি ও তার অনুগতরা। তাঁর লক্ষ্য স্বাধীন কুর্দিস্তান। আর সোভিয়েতের লক্ষ্য, যদি স্বাধীন কুর্দিস্তান হয়ই তো তা হবে সমাজতান্ত্রিক রুশঅনুগত কুর্দিস্তান।
বিভিন্ন রুশ নেতাদের সাথে মোলাকাত করলেও দ্রুত বারজানির সাথে পৃষ্ঠপোষকদের বিরোধ দেখা দেয়। উজবেকিস্তানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একরকম নির্বাসনে পাঠানো হয় স্বাধীনতাযোদ্ধাদের। সোভিয়েতরা এরপর বারজানির উপযোগিতা পায় ১৯৫৮ সালে ইরাকে আরব জাতীয়তাবাদী সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজতন্ত্রের রক্তক্ষয়ী পতনের পর।
নতুন প্রধানমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার আব্দুল করিম কাসিমের আশ্বাসে বারজানি নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন। কুর্দিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যাপারে কাসিমের সাথে সমঝোতাও হয়। কুর্দিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টিকে বৈধতা দেয়া হয়। কিন্তু কাসিম বারজানির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেন। বারজানি শুধু সোভিয়েত নয়, মার্কিন, ইরানী, ইসরায়েলী যে কোন উৎস থেকে সহায়তা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। অপরদিকে বারজানিবিরোধী সোভিয়েতসমর্থিত কুর্দী নেতাদেরকে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়। ফলে ১৯৬১ সালে ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কুর্দী মিলিশিয়া গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কাসিমের সেনাবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারা সমর্থন পায় ইরান ও ইসরায়েল থেকে। বহু সাধারণ কুর্দী এ সংঘাতে ইরাকী সেনাবাহিনীর কনভেনশনাল অস্ত্রের ব্যবহারে মারা যায়।
কিন্তু এই কুর্দী অভিযান নিয়েই কাসিমের সাথে তার সেনানায়কদের বিরোধ দেখা দেয়। ক্যুতে তিনি নিহত হন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কর্নেল আব্দুস সালাম আরিফ আর তার ভাই লেফটেনেন্ট জেনারেল আব্দুর রহমান আরিফ কেউই কুর্দী পেশমের্গা গেরিলার বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ১৯৬৬ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে নতুন করে স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়ে বারজানিকে।
কিন্তু তাতে বাদ সাধে ১৯৬৮ সালে ইরাকে বাথ পার্টির ক্যু। আরব জাতীয়তাবাদীদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসে বাথ সমাজতন্ত্রী জাতীয়তাবাদীরা। এ পার্টির আদর্শ নাৎসি পার্টির থেকে এমন কিছু ভিন্ন নয়। সাদ্দাম হোসেন তখন বড় মাপের বাথিস্ট নেতা না হলেও তাকে ১৯৭০এ পাঠানো হয় কুর্দীদের সাথে নতুন করে শান্তিস্থাপনের জন্যে। স্বায়ত্ত্বশাসন আর কুর্দীকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদার দেবার প্রস্তাবে ইরাক রাজি হয়।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
কিন্তু সে চুক্তি বাস্তবায়নেও কেন্দ্রীয় সরকার নানা টালবাহানা করে। ততদিনে কুর্দী এলাকার মসুল ও কিরকুক শহরের আশপাশে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেসবের ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার এলাকাটির “আরবীকরণ” শুরু করে। এর অর্থ হল, আদি অধিবাসী কুর্দী, অ্যাসিরীয়, ইয়াজিদী এদেরকে সরিয়ে সে জায়গায় আরব বেদুইন উপজাতিগুলিকে প্রতিস্থাপন করা। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটি বাথ পার্টির একদলীয় নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
বারজানি এ নীতির বহু প্রতিবাদ করেও ফল পাননি। তার ওপর একটি ব্যর্থ আততায়ী হামলা হয় বারজানির ওপর, যার পেছনে সাদ্দামের হাত ছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কুর্দিস্তানে। বারজানিকে ইরান ভারি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে অভ্যস্ত পেশমের্গা কনভেনশনাল অস্ত্র দিয়ে ইরাকের সুপেরিয়র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারেনি। ওদিকে ১৯৭৫এ ইরাক-ইরানের শাত-ইল-আরব ভূমিবিরোধ আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা হয়ে যায়। ইরানের শাহ তখন সহায়তা বন্ধ করে দিলে বারজানিকে আবার পালাতে হয়ে সীমান্তের ওপারে।
এ সময় বারজানির অবর্তমানে কেডিপির প্রগতিশীল সদস্যদের নিয়ে নতুন পার্টি পেট্রিওটিক ইউনিয়ন অফ কুর্দিস্তান পি,ইউ,কে সংগঠিত করেন তারই সহযোদ্ধা জালাল তালাবানি। ১৯৭৬এ লো-লেভেল ইনসার্জেন্সি চালু রাখে তারা। কিন্তু শীঘ্রি কেডিপির সাথে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন সাদ্দাম হোসেন। উত্তর ইরাকের বড় শহরগুলিতে সামরিক শক্তিবলে পুরোদমে চলে আরবীকরণ অভিযান।
১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর পরই মৃত্যুবরণ করেন মুস্তাফা বারজানি। তার স্থান নেন ছেলে মাসুদ। পরের বছরই শাত-আল আরবের পুরনো বিবাদের দোহাই দিয়ে ইরান আক্রমণ করে বসেন সাদ্দাম। সুযোগ পেয়ে কেডিপি ও পিইউকে উভয়েই উত্তর ইরাকে আবার বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল বারজানির দল সরাসরি ইরান থেকে সাহায্য পায়। আর তালাবানির দল সাহায্য পায় বাথিস্ট সিরিয়া আর লিবিয়ার থেকে।
কিন্তু ইরানের সাথে যুদ্ধরত অবস্থাতেও ইরাকের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর যথেষ্ট অস্ত্রবল ছিল উত্তরের বিদ্রোহ সামাল দেবার। ১৯৮৩ সালে বিশাল অভিযান চালিয়ে আরবিল প্রদেশে মাসুদের উপজাতি বারজানিদেরকে প্রায় নিঃশেষ করে দেয়া হয়। তার পরিবারের বহু সদস্যকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইরাকী বাহিনী। পরবর্তীতে সেসময়ে নিহত পাঁচশর ওপর মানুষের গণকবর খুঁজে পায় কুর্দীরা।
১৯৮৮ সালে ইরানঅধিকৃত হালাবজা শহরে গোলানিক্ষেপ করে সাদ্দামের বাহিনী। আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই কেয়ার করে মার্চে সে শহরে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তারা। স্থানীয় ইরাকী কুর্দী বৃদ্ধ-নারী-শিশু হাজারে হাজারে কঠিন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। “কেমিকাল আলি” ডাকনাম দেয়া হয় সে ঘটনার নেতৃত্বে থাকা সাদ্দামের তুতোভাইকে। মানব ইতিহাসে এই প্রথম ঘটনা যেখানে স্বদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে উইপন অফ মাস ডিস্ট্রাকশন ব্যবহার করল কোন একটি দেশ। বৃহত্তর “আল-আনফাল” অভিযানের অংশ ছিল এ আক্রমণ। কুরআনের একটি সূরার নামে অভিযানটির নামকরণ। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ কুর্দী মানুষের মৃত্যু হয় এ অভিযানে, যাকে এখন অনেকে কুর্দী জেনোসাইড নামে অভিহিত করে। একই কারণে ইসরাইলের সাথে কুর্দীরা একটা ঐতিহাসিক সংযোগ বোধ করে।
দাবার ছক পাল্টাতে শুরু করে ১৯৯১ সালে। সাদ্দামের কুয়েত দখলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল কোয়ালিশন নিয়ে ইরাকে আক্রমন চালায়। উত্তর ইরাকে ঘোষিত হয় নো ফ্লাই জোন। নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে তালাবানি ও বারজানিরা সেখানে ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসন শুরু করেন। বুশের আহ্বানে দক্ষিণে শিয়া-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাতেও সাদ্দামবিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়ে যায়। দু জায়গাতেই নিষ্ঠুরভাবে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বিদ্রোহ মোকাবেলা করে নিজের গদি রক্ষা করেন সাদ্দাম। কিরকুক থেকে হটে পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নেয় কুর্দী স্বায়ত্ত্বশাসিত কাউন্সিল।
একতাবদ্ধ ইরাকী কুর্দিস্তান নিজেদের অধিকৃত এলাকায় সংসদ নির্বাচন করে ১৯৯২ সালে। উত্তরে বারজানির কেডিপি আর দক্ষিণে তালাবানির পিইউকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ইরাকী সরকার এদের ওপর অবরোধ আরোপ করে। পিকেকে নির্মূলের লক্ষ্যে তুরস্কের সেনাবাহিনীও পশ্চিমে একটি অভিযান চালায়। কঠিন এ সময়টিতে কুর্দীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। গৃহযুদ্ধ চলে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ইরাক সরকার ও ইরান যথারীতি উভয় পক্ষকে নিজের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করে। ১৯৯৭এ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সহিংসতা বন্ধ করে দুই কুর্দী পক্ষ।
২০০৩এ বুশ দুই’য়ের ইরাক আক্রমণে শরিক হয় কুর্দী সৈন্যরাও। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র আগের বারের মত মিত্র দেশগুলির সহায়তা পায়নি। বিশেষত তুরস্ক তাদের ভূমি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। এ কারণেই উত্তর ইরাকে কুর্দীদের ওপর নির্ভর করতে হয় মার্কিনদের। আয়রনিকালি তুরস্ক এভাবেই “শত্রু” জাতিটিকে সাহায্য করে বসে, যেখানে একটা সুযোগ ছিল “ক্লীনাপ অপারেশন” চালানোর। সাদ্দামসমর্থিত বাহিনীগুলির ওপর কুর্দী পেশমের্গা সহজেই বিজয় পায়। কিরকুক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ফিরে আসে তাদের হাতে।
২০০৬এ দখলদার মার্কিনদের বিরুদ্ধে যখন ইরাকের বাকি সকল অংশে ইনসারজেন্সি চলেছে, তখন কুর্দিস্তান ও দক্ষিণের শিয়া-অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত হয় গৃহযুদ্ধচলাকালীন সময়েই। তাতে ইরাকী প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন কুর্দী নেতা জালাল তালাবানি স্বয়ং। ২০১১-১২র দ্বিতীয় সুন্নি ইনসারজেন্সি আর ২০১৩-১৭র আইসিস যুদ্ধ ইরাকি কুর্দিস্তানের একাংশে হলেও নিজেদের শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ হারায়নি কুর্দিস্তান রিজওনাল সরকার।
তবে কেন্দ্রের সাথে তেল-উত্তোলন ও পরিবহন নিয়ে পরবর্তীতে নানা বিবাদে জড়িয়েছে কুর্দীরা। সে নিয়ে সংঘাত হয়েছে উভয় পক্ষের মধ্যে। কেন্দ্রের শাসানি আর মার্কিনসহ অন্যান্য মিত্রদের সাবধানবাণী সত্ত্বেও ২০১৭ সালে স্বাধীনতা নিয়ে গণভোট করেন বারজানি। ৯২ শতাংশ ভোট পড়ে স্বাধীনতার পক্ষে। তবে এটা কোন বাইন্ডিং রেফারেন্ডাম ছিল না। স্বাধীনতা দূরে থাক, উল্টো কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী কুর্দিস্তানের অধিকৃত এলাকার ২০ শতাংশের পুনর্দখল নেয়। এ ছিল বারজানির আদর্শিক কিন্তু ভুল একটি পদক্ষেপ।
সাদ্দাম বা কাসিমের সময়কার থেকে ইরাকী কুর্দীদের বর্তমান চিত্র বেশ উন্নত। কিন্তু এখনো সেই পুরনো কেন্দ্রবিরোধী সংঘাতের বীজ রয়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারে তাদের যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব আছে। কুর্দিশ পাইপলাইনের তেলগ্যাস থেকে ভাল আয় আছে। আর স্বায়ত্ত্বশাসন এখন সরকারীভাবে স্বীকৃত। যতদিন এমন একটা পাওয়ার ব্যালান্স টিকিয়ে রাখতে পারবে কুর্দীরা, ততদিন ভবিষ্যতের একটা আশা আছে স্বাধীন রাষ্ট্রের।
আশা করি এখন বুঝতে পারছেন, কেন একজন ইরাকী জাতীয়তাবাদী কুর্দী আপনাকে বলবে ইরাক ওয়ার ওয়াজ এ গুড থিং! আরও বুঝেছেন, আশপাশের দেশগুলির কেন কুর্দী ইস্যু নিয়ে গাত্রদাহ বেড়েছে।
আমাদের স্থানীয় মিডল ঈস্টার্ন গ্রসারি স্টোরের প্রতিটি চেক আউট কাউন্টারে রাখা এই ছবিটি। উইমেন-লাইফ-ফ্রীডম স্লোগানলেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে প্রতিবাদী মিছিল। প্ল্যাকার্ডে মাহসা আমিনির ছবি। ২২ বছর বয়েসী মেয়েটি ইরানে নৈতিকতা পুলিশের হাতে প্রাণ হারানোর পর থেকে সারা বিশ্বে পরিচিত মুখ।
মাহসাকে নিয়ে সারা ইরান বিক্ষোভে ফেটে পড়লেও কতজন জানেন যে মেয়েটির জন্ম কুর্দী পরিবারে? তার আবাস যে শহরটিতে প্রথম বিক্ষোভ শুরু হয়, সেই সানান্দাজ কিন্তু ইরানী কুর্দিস্তান প্রদেশের রাজধানী। আমি আরেকটু পরে এ প্রতিবাদী আন্দোলনের গভীর কুর্দী যোগাযোগটা তুলে ধরব। যদিও মাহসা বা তার মত অনেক কুর্দীই হয়ত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিল না।
গ্রাজুয়েট স্কুলে ইরানী-আমেরিকান অধ্যাপকের সাথে কাজ করতাম। তাঁর স্ত্রী মার্কিন হলেও অধ্যাপকের আত্মার সংযোগ ইরানী সংস্কৃতির সাথে। ফার্সীতে কবিতা লেখেন বেনামে। কিন্তু ইরানের সাথে সে যোগাযোগটা নেই। ইসলামী বিপ্লবের ঠিক আগ দিয়ে ইরান ছেড়ে এদেশে আসেন। তাঁর ল্যাবে আমি যে কয়েক বছর কাটিয়েছি, সে সময়টা অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের বাকিরা ছিল ইরানী। কিন্তু এদের মধ্যে দু’জন ছিল একটু ব্যতিক্রমী।
একজনের প্রথম নাম খোলাখুলিরকম তুর্কী, আর পারিবারিক নামেই বোঝা যায় তার জাতিপরিচয় আজেরি। অর্থাৎ সে ইরানের উত্তর পশ্চিমে ককেশাসের নিকটবর্তী এলাকার মানুষ। তাব্রিজ সেখানকার মূল শহর। বাকি ইরানীদের মত এদের মাতৃভাষা ফার্সী বা অন্য কোন ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা নয়। বরং তু্র্কী গোষ্ঠীর আজেরি ভাষা।
আরেকজনের নাম দেখে ধারণা হয়েছিল সে বুঝি বাকিদের মতই ফার্সীভাষী। কিন্তু কোন এক স্ট্রেসফুল সময়ে ডিপার্টমেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে স্বীকার করেছিল, সে আসলে কুর্দী। ঐ প্রথম, ঐ শেষ। এরপর নিজের জাতিগত পরিচয়ের ব্যাপারে আর কোন টুঁ শব্দটিও সে করেনি। তবে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছি যে ইরানী অন্যান্য যে মেয়েরা ল্যাবে ছিল বা যাওয়া-আসা করত তারা হেজাব পড়ুক বা না পড়ুক একটু মাথা ঢাকত, কিন্তু এ ছেলেটির বউ তেমন ছিল না।
নিজের কুর্দী পরিচয়টা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে না চাওয়াটাই হয়ত স্বাভাবিক। ইরানী মূলধারার সমাজে কুর্দীদের নিজস্ব পরিচয় বিলিয়ে দেয়াটা সহজ। ফার্সী ও কুর্দী একই ভাষা পরিবারের। কুর্দী অনেকের নামও ফার্সীপ্রভাবিত। কুর্দী সঙ্গীত-সংস্কৃতিও ইরানী অন্যান্য উপজাতির কাছাকাছি। বাংলার প্রভাবে যেমন বাংলাদেশের ইন্দো-আর্য নিকটাত্মীয় ভাষাগুলি (যেমন রাজবংশী) দুর্গতির সম্মুখীন, তেমন কুর্দী ভাষাও ফার্সীর অসম প্রভাবের কারণে কোণঠাঁষা। শিক্ষা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক মই বেয়ে ওপরে উঠতে চাইলে কুর্দী যে কেউই ফার্সীকে গ্রহণ করে নেবে। সহজে কুর্দীতে মুখ খুলবে না। ইরানী কু্র্দিস্তান ভৌগলিক সৌন্দর্যের জন্য পরিচিত হলেও সেখানকার মাথা পিছু আয় দেশের সবচে কম (মানচিত্র দেখুন)।
অতীতের পারস্য সাম্রাজ্য আসলে বহুজাতিক ইন্দো-আর্য গোষ্ঠীর সমন্বয়ে সংগঠিত ছিল। এখনো প্রকারান্তরে তাই। মাজান্দারানী, কেরমানী, খোরাসানী প্রভৃতি বিভিন্ন ভাষা স্থানীয়ভাবে প্রচলিত। কুর্দীরা সে সাম্রাজ্যে তুলনামূলক নতুন সংযোজন। এদের সকল উপজাতি শিয়াও নয়। আর প্রাচীনকালে তাদের নিজেদেরই সাম্রাজ্য ছিল, যার নাম মিডিয়া।
আধুনিক ইরানে কাজার রাজবংশের আমলে বিভিন্ন অঞ্চলে উপজাতীয় স্বায়ত্ত্বশাসন প্রচলিত ছিল। তার পরিবর্তন হতে শুরু করে বিংশ শতকে। ১৯০৭ সালের ক্যু পরবর্তী রাষ্ট্রতন্ত্রে ফার্সীকে দেয়া হয় একমাত্র রাষ্ট্রভাষার স্থান। কুর্দীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী দুর্বল রাজতন্ত্রকে হটিয়ে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করেন রেজা শাহ পাহলভী (শেষ শাহের বাবা)। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপজাতীয় বিদ্রোহগুলি শক্ত হাতে দমন করে তার সেনাবাহিনী। কুর্দীরাও তার শিকার হয়। রেজা শাহ ছিলেন একনিষ্ঠ পারসিক জাতীয়তাবাদী। তুরস্কের মুস্তাফা কামালের ইরানী সমকক্ষ ধরা যেতে পারে তাকে। তুরস্কের মত ইরানেও প্রচলিত হয় সংখ্যাগুরু জাতীয়তার একনায়কতান্ত্রিক শাসন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ ও সোভিয়েতরা ইরানের দক্ষিণ ও উত্তর অংশ দখল করে রাখে। তার একটা কারণ জার্মানদের সাথে রেজা শাহের সখ্যতা। দেশটির তেল সম্পদ আরেকটা কারণ। তবে মূল কারণ ব্রিটিশ ভারত থেকে নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুধ্যমান রুশদেরকে রসদ সরবরাহের একটা নিরাপদ রাস্তা খোলা রাখা। কথা ছিল যে, যুদ্ধের পর রুশ ও ব্রিটিশ উভয়েই তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
১৯৪৬এ সে সময়টা চলে এলেও সোভিয়েতরা প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করে। এ ছিল স্নায়ুযুদ্ধের প্রাক্কালে প্রথম বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রের শাসানির কারণেই শেষ পর্যন্ত ইরান ছাড়তে বাধ্য হয় সোভিয়েতরা। নিজেদের দখলদারিত্বকে বৈধতা দেবার জন্যে তারা দুটি পাপেট রাজ্য তৈরি করেছিল ইরানের উত্তর পশ্চিমে। একটি আজারবাইজান পীপলস গভার্নমেন্ট। আরেকটি রিপাবলিক অফ মাহাবাদ। দ্বিতীয়টি ছিল মূলে কুর্দী রাষ্ট্র। তাদের সাহায্য করতে ইরাকী কুর্দিস্তান থেকে উপজাতীয় সৈন্যসহ এসে হাজির হন মুস্তাফা বারজানি।
তবে সোভিয়েত সেনাদল ইরান ছাড়ার সাথে সাথে এ সকল পাপেট রাষ্ট্র অস্তিত্বসংকটে পড়ে যায়। তাদের নবজাত “স্বাধীনতা” মুখ থুবড়ে পড়ে রেজা শাহের সেনাদলের সামনে। তবে ইতিমধ্যেই অনেক কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ট্রাইবাল লয়াল্টি ছাঁপিয়ে জাতীয়তাবাদী আদর্শ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। আরেকটি যে আদর্শ সেটি সোভিয়েত সমর্থনের কারণে। কেডিপি বা কুর্দিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টি আর কোমালা পার্টি (কোমালা=কামলা!) তাদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে সাম্যবাদ, সমাজতন্ত্র।
তাদের বিদ্রোহ আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে ষাটের দশকে। সীমানার ওপারে তখন চলছিল ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ। পাহাড়ী সীমান্ত জুড়ে বহু সহযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটে। তবে ইরানে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের আপাতত সমাপ্তি ঘটায় ইরানী সামরিক অভিযান।
১৯৭৯র সফল বিপ্লবের পর শাহবিরোধী কুর্দীদের আশা ছিল যে এবার তারা ইরানে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু সে বিপ্লব দ্রুত ছিনতাই করে নেয় খোমেনী গং। শাহের মত তাদের কাছেও মুসলিম ব্যতীত অন্য কোন জাতিপরিচয় ছিল অবান্তর। সেটা বোঝার সাথে সাথে আরো কড়া বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় ইরানী কুর্দিস্তানে। ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে বিশ হাজারের ওপর মানুষ প্রাণ হারায় সেখানে। কেডিপি ও কোমালা ছিল এ সকল বামঘেঁষা সংগ্রামের নেতৃত্বে। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত নানা প্রখরতায় এ সংগ্রাম চলে। শেষ হয় সংস্কারপন্থী নমনীয় রাষ্ট্রপতি খাতামির আমলে। ১৯৮০ থেকে ৮৯ ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যেও বিভিন্ন কুর্দী দল একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
২০১১ থেকে ইরানী কুর্দিস্তানে নতুন করে সংঘাতের সূচনা হয়। কুর্দিস্তান ফ্রী লাইফ পার্টি (জিয়ানা আজাদ পার্টি) নামে নতুন একটি দল এর পুরোভাগে। আগের দলগুলির মত এটিও পুরোমাত্রায় বামপন্থী প্রগতিশীল। তুরস্কের পিকেকে বা কুর্দিশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে এদের যোগাযোগ রয়েছে।
এখানেই ঐ উইমেন-লাইফ-লিবার্টি শ্লোগানটির উৎপত্তি। তুরস্কের কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা আব্দুল্লাহ ওজালানও বামপন্থী আদর্শের অনুসারী। বহু বামপন্থী তাত্ত্বিক লেখালেখিও আছে তার। তার তত্ত্ব অনুযায়ী কুর্দী সমাজ ও সংস্কৃতির ধারক-বাহক তাদের মেয়েরাই। নিজেদের সমাজে ছেলে ও মেয়ের সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে পারলেই তাদের উত্তরণ। চলমান ইরানী বিপ্লবের জান-জিন্দেগী-আজাদী শ্লোগানটি ফার্সী, কিন্তু শ্লোগানটি মূলে কুর্দী — জিন, জিয়ান, আজাদী। বিচ্ছিন্নতাবাদী জিয়ান-এ আজাদী পার্টির নামের সাথেও এর মিল। ওজালানের লেখা বইয়েও এ শ্লোগানের উৎস পাওয়া যায়।
২০১৫-১৬ সালে সিরিয়া-ইরাকে আইসিসের বিরুদ্ধে মার্কিন মিত্র কুর্দী পেশমের্গা মিলিশিয়ার যুদ্ধের ক্লিপ যদি টিভিতে দেখে থাকেন, তাহলে নিশ্চয় পেশমের্গার মহিলা সদস্যরা আপনার চোখ এড়িয়ে যায়নি। তাদের এমন অবস্থানের কারণ কু্র্দীদের প্রগতিশীল বিপ্লব। আর সীমানার ওপারে সিরিয়া-তুরস্ক-ইরাকে কুর্দী মেয়েদের শক্তিমত্তায় অনুপ্রেরণা পেয়েই হয়তবা ইরানী কুর্দিস্তানে শোর উঠেছে জিন-জিয়ান-আজাদী। আর এর জোয়ারে এখনো ভেসে যাচ্ছে পুরো ইরান।
ইরানে কুর্দীদের ওপর তুরস্কের মত অত্যাচার করা হয়নি এটা ঠিক। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদ আসে নানা খোলসে। ইরানের ক্ষেত্রে সেটা সংখ্যাগুরু ভাষা ও সংস্কৃতি আর কেন্দ্রের জবরদস্তির প্রশাসন। ওদিকে এদের বিরুদ্ধে অসন্তোষের প্রকাশটাও যখন কুর্দী ভাষার মধ্য দিয়ে হচ্ছে, তখন ফার্সীতেও সেটা সংক্রমিত হতে সময় লাগেনি। কারণ দুটো নিকটাত্মীয় ভাষা। তুরস্ক-ইরাকে কুর্দীদের যে ইতিহাস, ইরানে সেরকমটা না হলেও, স্বাধীনতার দাবি বেশ শক্তিশালী না হলেও, পুরো সমাজটাকে নাড়িয়ে দেবার ক্ষমতা যে তারা রাখে, বর্তমান ঘটনাবলী তারই চাক্ষুষ প্রমাণ।
(শেষ ছবিটির মার্সিডিজ সান ডিয়েগোতে আমাদের নেইবারহুডে মাসখানেক আগে দেখা)
আগের পোস্টে বলছিলাম রাষ্ট্রবিহীন এক বিপুল জনসংখ্যার জাতির কথা। কুর্দীরা সে জাতি। বর্তমান তুরস্কের জনসংখ্যার বিশ শতাংশ কুর্দী, ইরাকের বিশ শতাংশ, সিরিয়ার দশ, আর ইরানের দশ। সব মিলিয়ে তিন থেকে সাড়ে চার কোটির মত। সঠিক সংখ্যাটা বলা খুবই মুশকিল কারণ তারা যেসব রাষ্ট্রের বাসিন্দা সেসবের জাতীয়তাবাদী নীতির কারণে অনেকে তাদের মূল পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে, নয়ত খোলাখুলি প্রকাশ করে না। আর সরকারি গণশুমারিতে কুর্দীদের জাতিগত অস্তিত্ব স্বীকার করা হয় না।
কুর্দীদের আবাসস্থল ঐ চারটি দেশের সীমানায় একটি পাহাড়ী অঞ্চলে, যার নাম জাগ্রোস মাউন্টেনস। কুর্দী প্রবাদে, পাহাড় ছাড়া তাদের কোন বন্ধু নেই। পাহাড় তাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হয়ত পাহাড়ের দুর্গমতার কারণেই কুর্দীদের বৈচিত্রপূর্ণ ভাষাগত বিবর্তন ঘটে। সোরানি, কুরমাঞ্জি আর খওয়ারিন বলে কুর্দির অন্তত তিনটি উপভাষা। কিন্তু এদের মধ্যে মুচুয়াল ইন্টেলিজিবিলিটি বেশি নয়। ফার্সীর সাথেও নেই, যদিও কুর্দী ফার্সীর মতই ইন্দোইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। তুরস্ক ও সিরিয়ায় কুর্দী লিখিত হয় লাতিন হরফে, ইরাক-ইরানে ফার্সী-আরবী হরফে। আজকের কুর্দী জনসংখ্যার মধ্যে ভাষার মত ধর্মের বৈচিত্রও লক্ষণীয়। শিয়া-সুন্নী ইসলামের পাশাপাশি খ্রীষ্টান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান আর আলাউয়ী, ইয়াজিদী, ইয়ারসানী প্রভৃতি সুফী ও সুফীপ্রভাবিত ধর্মবিশ্বাস কুর্দীরা অনুসরণ করে।
অনেকের হয়ত জানা আছে, একাদশ শতকে লেভ্যান্ট ও জেরুজালেম থেকে ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করতে সক্ষম হন যে মুসলিম সেনাপতি, সে সালাহ-আল-দ্বীনও জাতিগত কুর্দী। আইয়ুবী রাজপরিবারের সূচনা করেন তিনি। ক্রুসেডারদের বিতাড়িত করাটা ছিল সোজা কাজ, কিন্তু তাদের দূরে রাখাটা ছিল অপেক্ষাকৃত জটিল কাজ। পূর্ববতী শিয়া ফাতিমী শাসকদের রিলিজিয়াস ইনটলারেন্স পলিসি আইয়ুবীরা পরিত্যাগ করে। ক্রুসেডারদের সাথেও খ্রীষ্টানদের অধিকার নিয়ে একটা সমঝোতায় আসা হয়। জেরুজালেমে পুনরায় ইহুদীদের বসবাসের অধিকার দেয়া হয়। আইয়ুবী শাসনামলে পরে বেশ কিছু ক্রুসেড হলেও সেগুলি নানা কারণে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। শিল্প ও বিজ্ঞানেও ইসলামী জগতে একটা পুনরুজ্জীবন আসে আইয়ুবী শাসনামলে।
প্রাক-আধুনিক যুগে অবশ্য কুর্দীরা দুটি বড় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে, যদিও নানা সময়ে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামও চলে। একটি অটোমান সাম্রাজ্য, অন্যটি ইরানের সাফাভী সাম্রাজ্য। সেটা ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের কথা। ধর্মীয়ভাবে সুন্নী হওয়ায় অটোমানরা শিয়া সাফাভীদের দুর্বল করার জন্য নানাভাবে কুর্দীদের ব্যবহার করে। সেভাবে সাফাভী ইরানের পশ্চিমের একটা বড় এলাকা কব্জা করতে সক্ষম হয় অটোমান তুরস্ক। কয়েক বছর পর পর বিভিন্ন কুর্দী বিদ্রোহেরও সম্মুখীন হয় সাফাভীরা। তবে সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি তাদের নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় তারা। জোরপূর্বক শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেয়া হয় দেশের অন্যান্য জাতির মত।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগ দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য অনেক জাতির মত শিক্ষিত কুর্দীরাও জাতীয়তাবাদী আদর্শের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তবে তাদের জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশ তখনও ট্রাইবাল লয়ালটির অনুসারী। সে কারণে দুয়েকটি জাতীয়তাবাদী কুর্দী বিদ্রোহ হলেও সেগুলি ছিল স্বল্প কিছু উপজাতির মধ্যে সীমাবদ্ধ। তবে বিশ্বযুদ্ধের সময়ে দুটি বড় বিদ্রোহে গোপন সমর্থন দেয় তুর্কীদের শত্রু রুশরা। সেগুলির মূল কারণ ছিল যুদ্ধের জন্যে করবৃদ্ধি ও কনস্ক্রিপশন।
তবে কুর্দীদের একটা বড় অংশের মূল সমর্থন ছিল তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্যের প্রতি। মূলত সুন্নী ধর্মবিশ্বাসের কারণে। আর তাছাড়া তুরস্কে ১৯০৮এর ক্যু পরবর্তী সংস্কারের কারণে কুর্দী উপজাতীয় নেতাদের ছিল ভাল সম্মানজনক অবস্থান।
আরব ছাড়াও অটোমান তুরস্কে কুর্দী এবং আর্মেনীরা ছিল আরো দুটি বড় জাতি। এদের মধ্যে রুশদের সাহায্য করার অভিযোগে ১৯১৫তে অটোমানরা আরমেনীদের ওপর গণহত্যা চালায়। কুর্দী সৈন্যদের এ কাজে ব্যবহার করে অটোমান তুর্কীরা। প্রচুর তুর্কী-কুর্দী নাগরিক এ সংঘাতে প্রাণ হারায়।
অটোমানদের পরাজয়ের পর উইলসনের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণ তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে আরবদের জন্যে আলাদা আবাসভূমি প্রস্তাবিত হয়। আরব ট্রাইবাল নেতারা প্যারিসে আলোচনায় অংশ নেয়।
যুদ্ধ শেষে ১৯১৯এ স্যাভর্ চুক্তির আলোচনায় কুর্দী-আরমেনীদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেয়। ১৯১৭তে রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে একটি স্বাধীন আর্মেনিয়া রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে ইতিমধ্যে। পূর্ব তুরস্কবাসী আর্মেনিয়ানদের তার সাথে যুক্ত করে নতুন একটি বৃহত্তর আরমেনিয়ার পরিকল্পনা দেন উইলসন।
আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...
প্যারিস শান্তি আলোচনার অংশ হিসাবে ১৯১৯এ যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুই সেনেটর কিং এবং ক্রেন সিরিয়া-ইরাকে আসেন জাতিগত অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে। ১৯২২এ প্রকাশিত তাদের রিপোর্টে আশা প্রকাশ করা হয় যে, একসময় এ এলাকায় বহুজাতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্বভৌম রাষ্ট্র স্থাপন সম্ভব। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তাদের স্বাধীনতা দেয়া হবে ভুল। মূল কারণ জাতিগত ও উপজাতীয় দ্বন্দ্ব, আর আধুনিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার অভাব। ফিলিস্তিনে ইহুদী আবাসভূমি পুনর্স্থাপনের ব্যাপরটাও তারা সমর্থন করেননি। কারণ সেখানে ইতিমধ্যে অইহুদী একাধিক জাতি রয়েছে যাদের ডিসএনফ্রাঞ্চাইজ করা সম্ভব নয়। সামরিক জোর ব্যতিরেকে সে কাজ অসম্ভব। তবে কুর্দিস্তানের ব্যাপারে কিং-ক্রেন আলাদা আবাসভূমির পক্ষে মত দেন।
কিং-ক্রেন বা উইলসন যাই বলুন বা ভাবুন না কেন, ইতিহাসের চাকা ঘোরে নিজের ইচ্ছেমত। কুর্দী-আরমেনীদের জাতিগত ভাগ্য স্বনির্ধারণের আগেই দুটো ব্যাপার ঘটে যায়। উইলসন পরাজিত হন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, যুক্তরাষ্ট্র সকল আন্তর্জাতিক এনগেজমেন্ট থেকে গুঁটিয়ে আইসোলেশনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয়। লীগ অফ নেশনসে যোগদান দূরের কথা, অটোমান সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের আলোচনা থেকেও সরে আসে।
আর দ্বিতীয় ঘটনাটা হল, তুরস্কে তুর্কী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ। এই নতুন তুর্কী পুনরজ্জীবনের জোয়ারে পশ্চিম উপকূল থেকে গ্রীক দখলদার সেনাবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। আর পূর্বে কুর্দী-আর্মেনী এলাকাও আতাতুর্কের তুর্কী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ততদিনে খোদ রাশিয়া এবং রুশ আর্মেনিয়াতেও বলশেভিকরা ক্ষমতা পুনর্দখল করতে সমর্থ হয়েছে। তারা তুরস্কের সাথে পৃথক শান্তি আলোচনার মাধ্যমে ককেশাসের জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজানের সীমানা নির্ধারণ করে নেয়। বলা বাহুল্য এর ফলে আরমেনীদের যুক্তিসংগত দাবিটিও মাটিচাপা পড়ে যায় আর তুরস্কের আরমেনিয়ান অধ্যুষিত এলাকাটি তুরস্কের অধীনস্থই রয়ে যায়।
এই নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে স্যাভরে অটোমানদের সাথে সইকৃত চুক্তিটি রদ করতে বাধ্য হয় মিত্রশক্তি। নতুন করে লোজান চুক্তি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ফ্রান্স-ব্রিটেন ফিরে যায় তাদের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চেহারায়। যুদ্ধ চলাকালীন সময়েই ১৯১৫তে একটা গোপন চুক্তি করেছিল তারা। সে চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়া-ইরাকের মাঝ বরাবর একটা সোজা লাইন টেনে সীমানা নির্ধারিত হয়। তার একপাশে সিরিয়া-লেবানন থাকবে ফরাসী অধিকৃত। মেসোপটেমিয়া-প্যালেস্টাইন-ট্রান্সজর্দান হবে ব্রিটিশদের অধীন।
১৯১৭ সালে সোভিয়েতরা হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছিল এ গোপন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের। মার্কিনরাও এটি পুরোপুরি অবগত ছিল না। শুধু রুশ ও ইতালীয়রা জানত। ১৯২১ নাগাদ নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই গোপন চুক্তিই প্রকারান্তরে বাস্তবায়িত হয়। ফরাসী-ব্রিটিশরা সিরিয়ার উত্তর ও ইরাকের উত্তরের মোসুলে কুর্দীদের জন্যে জায়গা ছাড়তে ছিল নারাজ। আর আতাতুর্কও তুরস্কের কুর্দী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্বযুদ্ধে অংশ না নেয়ায় ইরানের কুর্দিস্তানেরও ভাগ্য আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। এভাবে কুর্দী আবাসভূমির স্বপ্নটা শুরুতেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটরি ইরাকে ব্রিটিশদের সাথে মিত্রতায় আবদ্ধ কুর্দীরা ব্রিটিশদের পয়সায় দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি করে। কিন্তু তাদের উপজাতীয় নেতা স্বাধীনতা ঘোষণা করে একটি রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে ব্রিটিশরা দ্রুত সে বিদ্রোহ দমন করে।
বিশ ও ত্রিশের দশকে ম্যান্ডেটরি ও রাজতন্ত্রী ইরাক উভয় রেজিমের বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ হয়। একাধিক কুর্দী বিদ্রোহ দমন করতে হয় ইরান ও তুরস্ক উভয়কেই। সিরিয়ায় অবশ্য ফরাসীরা কুর্দীদের স্বাগত জানায়, তাদের আরব সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার বিপরীতে ব্যালান্স আনার জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল ট্রাইবাল লয়ালটির ওপর ভিত্তি করে। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রভাব শিক্ষিত মানুষের ওপর থাকলেও উপজাতীয় নেতারা নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্যই স্বাধীনতার পক্ষে বিপক্ষে অবস্থান নেয়। বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে প্রতিযোগিতাও চলে এ ব্যাপারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে কুর্দী বিচ্ছিন্নতাবাদের চরিত্র পাল্টে যেতে শুরু করে। উপজাতীয় চরিত্রের জায়গা নিতে শুরু করে জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী আদর্শবাদের রাজনীতি। আর তাদের স্বপ্নপূরণের পথে আরও বেশি শক্ত অবস্থান নেয় উপনিবেশপরবর্তী আরব ও তুর্কী রাষ্ট্রগুলি। পরবর্তী খন্ডে তুলে ধরব আধুনিক কালে কুর্দী স্বাধিকার সংগ্রামের খন্ডচিত্র।