ব্লুগ্রাস!

Featured Video Play Icon

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিমে প্যাসিফিক মহাসাগরের পাশে দুটো সুন্দর স্টেট আছে — ওরেগন আর ওয়াশিংটন। এই এলাকার রেইন ফরেস্টের সুউচ্চ চিরহরিৎ গাছপালা, নয়নাভিরাম তুষারাবৃত পর্বত আর পাথুরে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিস্কো পর্যন্তও বিস্তৃত। ওরেগনে বেশ ক’বছর আগে গ্রীষ্মের কয়েক মাস কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেসময়ের অন্যতম স্মৃতি হল এক মার্কিন সহকর্মী বন্ধুর সাথে প্রশস্ত কলাম্বিয়া নদীর তীরে ক্যাম্প করে দু’রাত্রি কাটানো — স্কামানিয়া ফ়োক ফ়েস্টিভাল উপভোগ করার উসিলায়।

সে উৎসবে গেছিলাম মূলত আইরিশ স্টেপ ড্যান্সিং সামনাসামনি দেখার লোভে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই এনিয়াচীফটেইনস প্রমুখ শিল্পীর গান আর স্টারটিভিতে রিভ়ারড্যান্স শো দেখে আইরিশকেল্টিক ঐতিহ্যের প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। হাতে আঁকা ছবির মত নিসর্গের মাঝে খোলা আকাশের নিচে সেই আইরিশ নৃত্য-গীতি-বাদ্য দেখা-শোনা তো হলোই, উপরি হিসাবে পেলাম মার্কিনদেশের নানারকম উপভোগ্য লোকগীতির পরিবেশনা। তার মধ্যে ছিল ফ়োক, ব্লুজ়, জ্যাজ় — আর ব্লুগ্রাস!

এর আগে ব্লুগ্রাস সম্পর্কে আমার ধারণা খুব বেশি ছিল না। শুধুমাত্র যেখানে এর নমুনা পেয়েছিলাম, সেটা হল কোয়েন ব্রাদারস পরিচালিত, জর্জ ক্লুনি অভিনীত অনবদ্য মিউজ়িক্যাল চলচ্চিত্র ‘ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ’। এ লেখার অনুসঙ্গ হিসাবে তার থেকে একটা গান জুড়ে দিলাম।

গানের কথায় বুঝতে পারছেন, গায়ক (বা গীতিকার) দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় উজাড় করে দিচ্ছে। আমেরিকার দক্ষিণের পাহাড়ী আপালাচিয়া অঞ্চলের কেন্টাকি স্টেটে তার জন্ম। সারাজীবন নানারকম ঝুটঝামেলা তার সঙ্গী। মানে, হয়ত সে সমাজচ্যুত আউটক্যাস্ট, অথবা আইন থেকে পলাতক আউটল’। তার নেই কোন বন্ধু-নিকটজন, যে তার ছন্নছাড়া জীবনে সহায় হতে পারে। পথে হয়ত প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সেখানেও পিছু ছাড়েনি তার অতীত। তাই আবার সে পলায়নপর, হয়ত তার মরণ হবে সে প্রচেষ্টায়। হয়ত প্রেমিকা তাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালবাসবে, কিন্তু তাতে তার হাঁহুতাশ নেই! কারণ এ সুনিশ্চিত, যে একসময় না একসময় স্বর্গের স্বর্ণালী সৈকতে আবার দেখা মিলবে দু’জনার!… গানটা যতটা না দুঃখের, তার থেকে বেশি বোধহয় দুর্ভাগ্যপীড়িত অনন্যোপায় গায়কের সান্ত্বনালাভের প্রয়াস। (মুভ়িটা দেখলেই বুঝবেন গানের মাজেজা!)

এখানে গানটা পুরোপুরি ব্লুগ্রাস স্টাইলে গাওয়া হয়নি, কারণ একমাত্র সঙ্গত গীটার। সাধারণত ব্লুগ্রাস গানে গীটারের সাথে ব্যাঞ্জো, ফ়িড্ল, ম্যান্ডোলিন, স্ট্রিং বাস, ইত্যাদি জুড়ি থাকে। কিন্তু মুভ়িতে ক্লুনির কল্পিত ব্যান্ড সগি বটম বয়েজ় নামের সাথে প্রখ্যাত ব্লুগ্রাস ব্যান্ড ফ়গি মাউন্টেইন বয়েজ়ের সুস্পষ্ট মিল। তিরিশ-চল্লিশের দশকে রেডিও আর গ্রামোফ়োন জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হওয়া শুরু করে যখন, তখন ১৯১৩তে লেখা এ গানটি আরো অনেকের পাশাপাশি ব্লুগ্রাস শিল্পীরাও রেকর্ড করেন। অধুনাযুগের সবচে’ খ্যাতিমান ব্লুগ্রাসগায়ক রাল্ফ় স্ট্যানলিও এটা গেয়েছিলেন, অ্যালিসন ক্রাউসও। সুতরাং ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র ব্লুগ্রাস যোগাযোগ অনস্বীকার্য।

কিভাবে ব্লুগ্রাসের উৎপত্তি হলো, সে কাহিনী ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মতই মর্মস্পর্শী। আমেরিকায় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত দাসত্বপ্রথা ছিল সে আমরা ভালমতই জানি। যেটা অত ভালমত জানি না, সেটা হলো একই শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ কিভাবে একরকম দাস হিসাবেই মার্কিনে এসেছিল। এখনকার ভাষায় এদেরকে বলে ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট, বা চুক্তিবদ্ধ চাকর।

ইউরোপীয় জাহাজী আর দালালের দল ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের সহায়সম্পত্তিহীন কর্মক্ষম মানুষ পেলে তাদেরকে নতুন বিশ্বের উন্নত জীবন আর সুযোগের কথা দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে চুক্তিনামায় সই করাত, তারপর আমেরিকায় এনে টাকার বিনিময়ে তুলে দিত তাদের মালিকের কাছে। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে পরপর কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কারণে জীবন বাঁচাতে গরিবদের চুক্তিস্বাক্ষরব্যতীত আর তেমন কোন উপায় ছিল না। চুক্তি অনু্যায়ী যতদিন না সেই চাকর গতর খেঁটেই হোক আর অন্য কোনভাবে হোক, অন্তত তার জাহাজভাড়া না পরিশোধ করছে, ততদিন সে মালিকের আজ্ঞাবাহী। যদি পালায় তো কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মতই তাকে খুঁজে বের করে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম

তো, এসকল দরিদ্র শ্বেতাঙ্গরা মুক্তির ঋণ পরিশোধ করার পরে যে সাথে সাথে সমৃদ্ধি, জমিজমা পেয়ে যেত, তা নয়! উত্তরের তেরো কলোনির অধিকাংশ ইতিমধ্যে জনবহুল হয়ে গেছে, জায়গাজমির মালিকানা দলিল-দস্তাবেজ হয়ে গেছে। অতএব এরা সুযোগের সন্ধানে যাওয়া শুরু করে দক্ষিণের কৃষিকাজনির্ভর স্টেটগুলিতে। আপালাচিয়ার দক্ষিণাংশের কেন্টাকি, টেনেসি, জর্জিয়া ইত্যাদি স্টেটে কাজ পায় অনেকে। কিন্তু জমির মালিকানা যারা খুঁজছিল, তাদের জন্যে বাকি ছিল অনূর্বর পাহাড়ী জমি। সেসবেই কোনরকমে বসতি গেঁড়ে সাবসিস্টেন্স ফার্মিং আর শিকার করে জীবননির্বাহ শুরু করে তারা।

আর যাদের এতে মন ভরলো না, তারা আর তাদের বংশধরেরা কাউবয়-আউটল’ হিসাবে গিয়ে হাজির হল ওয়াইল্ড ওয়েস্টে। কখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায়, কখনো সরকারের আইনি বিরোধিতা গায়ে না মেখে, নেটিভ আমেরিকানদের হটিয়ে নিজেরাই নিজেদের জায়গা করে নিল। কেউ কেউ ওরেগন ট্রেইলের পাইওনিয়ারদের পথ অনুসরণ করে পশ্চিমের স্টেটগুলিতে হাজির হয়ে গেল।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




যারা আপালাচিয়াতে রয়ে গেছিল, অতীতের দারিদ্র্য, স্বল্পশিক্ষা, বর্ণবাদ আর কুসংস্কার এখনো তাদেরকে ছাড়েনি। গৃহযুদ্ধের সময়ে এরা দাসপ্রথার রক্ষক কনফ়েডারেট সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, কারণ কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্তি পেলে তাদের সীমিত জীবিকায় ভাগীদার বাড়বে। যারা জমির মালিকানাহীন কুলি ছিল তাদেরকে ডাকা হত পো’বয় (পুওর বয়) নামে, ক্রীতদাসদের মত তাদেরও ভোটাধিকার দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ছিল না। সে আইনের পরিবর্তন হয় গৃহযুদ্ধে ফ়েডারেল সরকারের জয়লাভের পরে।

হিলবিলি আর রেডনেক নাম দিয়ে অন্যান্য শিক্ষিত সাদারা এদেরকে এখনো কটাক্ষ করে। এদের ভুল বানান, অদ্ভূত উচ্চারণ, কাজ়িন বিয়ে করার রীতি, তাপ্পিমারা পোশাক, আর ঘরে বানানো মদের বোতল সত্তর-আশির দশকেও চলচ্চিত্রে দেখানো হত তাদের স্টেরেওটাইপ বুঝানোর জন্যে। ডেলিভ়ারেন্স মুভিটা দেখতে পারেন উদাহরণ হিসাবে। বলতে পারেন, এধরনের স্টেরেওটাইপিংও একরকম রেসিজ়ম, আর তা না হলেও অনেক নিচু চোখে দেখা। আবার আপালাচিয়ার ধনাঢ্য সাদা চাষী আর ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতিতে ঢুকত, তারা সরল হিলবিলিদের বর্ণবাদ আর অন্যান্য ভয়-বিদ্বেষ উস্কে দিত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্যে। এ কৌশল এখনও খাঁটে।

আইনকানুন মানার ব্যাপারেও হিলবিলিরা একটু অমনোযোগী, আর একরোখা-স্বাধীনচেতা হওয়ায় ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মত ট্রাবলে জড়াতেও সময় লাগে না। দক্ষিণের স্টেটগুলির কড়া আইন অনেকের জীবনে একবার এসে ধরলে বাকি জীবন পিছে লেগেই থাকে।

বুঝতে পারছেন, এ যুগে এরাই সম্ভবত আদর্শ ট্রাম্প সাপোর্টার! অপরদিকে রাল্ফ় স্ট্যানলির মত নামীদামী শিল্পীরা কখনোই রাজনীতিতে ঝোঁক দেখাননি!

ব্লুগ্রাসের সুরের পিছনে এখনো ফ়োক ইংলিশ কিংবা আইরিশ-স্কটিশ একটা ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। ফ়িডলের দ্রুত তালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের জিগসরীলসের ছন্দের প্রভাব রয়ে গেছে। খুব দ্রুততার সাথে কর্ড পরিবর্তন করার জটিল ইমপ্রোভ়াইজ়েশনও ব্লুগ্রাসের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এমনকি, যতই বর্ণবাদী বলি না কেন হিলবিলিদের, কৃষ্ণাঙ্গদের ব্লুজ়-জ্যাজ় থেকে তারা অনেক কিছু শিখে মিলিয়ে নিয়েছে ব্লুগ্রাসের মধ্যে। বিষয়বস্তুর মধ্যে বিয়োগবেদনার পাশাপাশি রয়েছে অতীতের স্মৃতিচারণ, পূর্বপুরুষদের বীরত্বের জয়গাঁথা, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে বাকবিতন্ডা বা মারামারির উপাখ্যান, কিংবা বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আক্ষেপ-ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আর সর্বোপরি, গ্রাম্য আপালাচিয়ার সীমিত জীবিকা আর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনের কঠিন চিত্র।

ব্লুজ়ের মধ্যে যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের জাতিগত বেদনার স্মৃতি রূপান্তরিত হয়ে গেছে সার্বজনীন একটা আবেগপ্রবণতায়, আমি বলবো সেরকম ব্লুগ্রাসও শ্বেতাঙ্গ খেঁটে-খাওয়া মানুষের শ্রেণীগত আশা-নিরাশা-বীরত্ব-ভয়-সুখ-দুঃখ ইত্যাদির ভাবপ্রবণ সরল অভিব্যক্তি।

আশা করি তুলনামূলক স্বল্পপরিচিত একটি মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতিকে কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পেরেছি, আর পাঠকরা সামান্য হলেও এদের সহমর্মী হতে পারছেন। ও হ্যাঁ, ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ — দেখতে ভুলবেন না!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




লাল মৃত্যু ও অন্যান্য

Featured Video Play Icon

দশ-বারো বছর বয়েসে মফস্বলে নানাবাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। প্রায় প্রতি শীতের ছুটিতেই যাওয়া হত, কিন্তু সেবার বিদেশ থেকে খালা, খালাত বোনরাও এসেছিল। আশপাশে সর্বসাকুল্যে যে একটামাত্র ভাল বইয়ের দোকান ছিল সে সময়, ছোট মামা আমাদেরকে সেটায় নিয়ে গেছিলেন।

দুর্লভ বিদেশী অতিথি হওয়ার সুবাদে বোনের ভাগ্যে জুটলো রঙচঙে চীনা বা রুশ প্রিন্টের সুন্দর একটা বই। আমারও মনে ধরেছিল সেটা। কিন্তু শেষমেষ মিললো বাংলা একাডেমীর সাদামাটা ‘লাল মৃত্যু’ নামে হায়াৎ মামুদের অনুবাদকৃত একটা ছোটগল্পের সংকলন।

প্রথমে মনটা একটু দমে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর যখন বইটা পড়ে শেষ করে উঠলাম আর ঘোর কাটলো, মনে হলো সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরলাম! রনবীর ইলাস্ট্রেশনগুলো তো দারুণ ছিলই, অনুবাদও বলিহারি। ছোটগল্পগুলির সেলেকশনও সেরকম। অস্কার ওয়াইল্ডের হ্যাপি প্রিন্স, সেলফ়িশ জায়ান্ট, নাইটিংগেল অ্যান্ড দ্য রোজ়। আনেরসেনের লিটল ম্যাচগার্ল, আগলি ডাকলিং, দ্য এঞ্জেলহ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। অসাধারণ এই বইটা তালি-তাপ্পি নিয়ে বহুদিন আমার সংগ্রহে ছিল। বন্ধুরা-ভাইয়েরা-বোনেরা পড়েছে। তারপর কিভাবে হারিয়ে গেছে আমি প্রবাসী হবার পড়। আবার খুঁজে পেলে কিনতে চাই।

বইটা ছোটবেলাতে আমার মননশীলতার উপর একটা গভীর দাগ কেটেছিল। পরে ওয়াইল্ডআনেরসেনের গল্পগুলি ইংরেজী মূল আর অনুবাদেও পড়েছি। তরুণ বয়েসে সেও ছিল আরেক মাত্রার অনুভূতি।

যে গল্পটার কথা এখনো বলিনি সেটা হলো বইয়ের শীর্ষনামেরটা — লাল মৃত্যু — এডগার অ্যালান পো’র মাস্ক অফ় দ্য রেড ডেথ়। যতবার পড়তাম গল্পটা, গা ছমছম করে উঠত! ইংরেজী মূলটাও কম যায় না।

মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্লেগের সময় প্রিন্স প্রস্পেরো নামে এক রাজকুমার তাঁর বন্ধুবান্ধব, পরিবার, আর সমশ্রেণীর অভিজাতদের নিয়ে বহু বছরের রসদসমেত চলে গেলেন দূরের এক দুর্গে। সে দুর্গে অতন্দ্র প্রহরা, কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানে প্লেগের জীবাণু নিয়ে ঢোকে। বহির্বিশ্বের মৃত্যুর বাস্তবতাকে ভুলতে আর দৈনন্দিন জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্যে প্রস্পেরো একটা পার্টি দিলেন। যেনতেন পার্টি নয়, দুর্গবাসী অতিথিরা সেখানে আসবেন ছদ্মবেশে, রহস্যাবৃত হয়ে — যাকে ইংরেজীতে বলে মাস্কারেড

সে দুর্গে সাতটা বিশেষ ঘরকে সাজানো হলো, একেকটার রঙ একেক রকম। শেষটা লাল জানালা আর কালো দেয়ালের বিমর্ষ এক ঘর, কেউ পারতপক্ষে সেথায় ঢোকে না। শেষ বিকেলের আলো লাল কাঁচের জানালা দিয়ে কালো দেয়ালে পড়লে লাল-কালো মিলে এক ত্রাসের আবহ তৈরি হয়। আর সেখানে একটা বড় গ্রান্ডফাদার ক্লক। সেটা যখন গুরুগম্ভীর ঢংঢং শব্দ করে সময় জানান দেয়, কারো মুখে টুঁ শব্দটা হয় না। ঢংঢং শেষ হয়ে গেলে আবার সবাই যেমনকার তেমন।

পার্টির রাতে খুব হুল্লোড়। মদ-রুটি, আয়েশী খাবারের ছড়াছড়ি, গানবাজনা-জেস্টিং চলছে সমানে। দু্র্গপ্রাচীরের বাইরে সাধারণ প্রজারা রোগাক্রান্ত, মৃত্যুপথযাত্রী, প্রিয়জনের বিয়োগবেদনায় শোকাতুর। এরকম বৈপরীত্যের মধ্যে পার্টি যখন তুঙ্গে, তখন এক অদ্ভূত অতিথির আগমন ঘটলো।

নবাগতের মুখে মৃতের মুখোশ, আপাদমস্তক আবৃত কাফনের মত লাল কাপড়ে। অতিথিদের ভীড় সরে আপনি তাকে জায়গা করে দিল, আর সেই রহস্যময় মূর্তি হেঁটে হেঁটে — নাকি ভেসে ভেসে — এক ঘর থেকে আরেক ঘরে এগিয়ে যেতে থাকলো। রাজকুমারের বন্ধুরা একটু ঘাবড়ে গেলেন আর প্রস্পেরো গেলেন রেগে। কার এত বড় স্পর্ধা যে তাঁর ফূর্তির রাতে তামাশা করতে এরকম পোশাকে পার্টিতে আসে!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




প্রস্পেরো তেড়ে গেলেন বেয়াদবের পরিচয় বের করতে। খোলা তলোয়ার হাতে দৌড়তে দৌড়তে অবশেষে তাকে ধরলেন শেষ কালো ঘরটাতে। মধ্যরাতের ঘন্টা বাজা তখনও শেষ হয়নি। নবাগতকে ছোঁয়ামাত্রই ভয়ে-বিভীষিকায় সাদা হয়ে প্রস্পেরোর আত্মা দেহত্যাগ করলো!

প্রস্পেরোকে রক্ষা করতে তাঁর পারিষদবর্গ ছুটে এলেন, আক্রমণ করলেন রক্তিম আগন্তুককে। তার আলখেল্লা ধরে টান দিতেই তাঁরা দেখলেন প্রহেলিকা — পোশাকের নিচে নেই কেউ! তারপর একে একে সকলে রক্তিম ত্বক নিয়ে প্লেগের আক্রমণে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। দুর্গের প্রাচীরের ভেতরে চলল লাল মৃত্যুর রাজত্ব!

এই গল্পটা ছোটদের জন্যে একটু শিক্ষামূলকও। মৃত্যুর করাল গ্রাস কাউকে ছাড়ে না। অহংকারী মানুষ কোন না কোনভাবে যদি ভাবে তারা মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, তখনই তাদের গ্রান্ডফাদার ক্লকে ঢংঢং করে বারোটা বেজে ওঠে।

আমার হিসাবে, এডগার অ্যালান পো খুবই আন্ডাররেটেড একজন লেখক। তিনি কিন্তু একাধারে ডিটেক্টিভ় নভ়েল, সাই-ফাই আর গথিক ম্যাকাবার শৈলীর লিখনের জনক। তাঁর লেখা দ্য গোল্ড বাগও আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর ছোট গল্প। তাতে এনক্রিপশনের ব্যাপারে যেসব আইডিয়া দেয়া হয়েছে, সেগুলি পরে মার্কিন এক সেনাপ্রধানকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল সিগনালিং কোর তৈরিতে। তার ওপর আছেন মার্ডারস ইন দ্য র‌্যু মর্গের খ্যাতিমান ফরাসী ডিটেক্টিভ় দ্যুপ্যাঁ! এগুলি এইচ জি ওয়েলস আর আর্থার কোনান ডয়েলের জন্যেও প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা ছিল।

কিন্তু পো মূলত পরিচিত তাঁর গথিকশৈলীর ছোটগল্পের জন্যে। সেগুলিতে তিনি মানুষের সবচে’ নীচ স্বভাবের মনোবৃত্তিগুলি তুলে ধরেছেন খুবই সাবলীলভাবে, কোনটা শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন নিয়ে, আবার কোনটা তার সাথে ডার্ক হিউমার মিলিয়ে একটু কৌতুকপ্রদ। সবগুলিই ফিরে ফিরে মৃত্যু বিষয়টাকে টেনে নিয়ে এসেছে। আর প্রতিটা ভিলেইনই মানবিক — তাদের প্রতি যতটা না ঘৃণা জাগে, তার থেকে বেশি হয় করুণা।

কাস্ক অফ় আমন্টিলাডোতে রয়েছে প্রতিশোধপরায়ণ বন্ধু কর্তৃক এক দুর্ভাগার খুনের কাহিনী। মন্ত্রেসর তার বন্ধু ফরতুনাতোকে দেয়াল তুলে এক ছোট কামরার মধ্যে জীবন্ত কবর দিয়ে দেয় এ কাহিনীতে। ফ়ল অফ় দ্য হাউজ় অফ় আশারেও মানসিক রোগগ্রস্ত এক ভাই তার বোনকে সেরকম জীবন্ত সমাধিতে বন্ধ করে ফেলে।

পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম গল্পে বলা হয়েছে স্প্যানিশ ইনকুইজ়িশনের সময়ে ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক সংস্কারপন্থীদের নিপীড়নের লোমহর্ষক বৃত্তান্ত। টেল-টেইল হার্টে রয়েছে ঠান্ডা মাথায় এক রগচটা বৃদ্ধকে খুন করে তার দেহাবশেষকে টুকরো টুকরো করে বাড়ির মেঝের নিচে গুম করে ফেলার কাহিনী — যার শেষ খুনীর পাপবোধের ফলস্বরূপ তার মনস্তত্ত্বে মেঝের ফ্লোরবোর্ডের নিচ থেকে আসা বুড়োর চলমান হৃদপিন্ডের ধকধক আওয়াজ। আর কেউ শুনতে না পেলেও সে আওয়াজ তাকে পাগল করে ফেলে। আর পুলিশের সামনে সে মেঝে খুঁড়ে বের করে ফেলে নিজের কীর্তিকলাপের প্রমাণ!

অ্যালান পো মৃত্যু নিয়ে অবসেসড ছিলেন তার কারণ বোধহয় কয়েকটা। ১৮০৯এ বস্টনে তাঁর জন্ম। এক বছর বয়েসে বাবা পরিবারকে পরিত্যাগ করেন, মা মারা যান দু’বছর বয়েসে। জন অ্যালান নামে ধনাঢ্য এক ভদ্রলোকের পরিবারে পালকপুত্র হিসাবে বড় হন, ভারজিনিয়ার রিচমন্ডে — সেখানে এডগার অ্যালান পো মিউজ়িয়াম দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।

ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনায় বেশি মন টেকেনি, লেখালেখি আর জুয়াখেলায় ঝোঁক ছিল পো’এর। সে নিয়ে পরে পালকপিতার সাথে মনোমালীন্য আর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিছুদিন সেনাবাহিনীতেও কর্মরত ছিলেন পো। পালকমাতার অসুখের কথা গোপন রাখা হয়েছিল পো’র কাছ থেকে। তাঁর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে পো রিচমন্ডে ফেরেন, কিন্তু সমাধির একদিন পর। জন অ্যালান এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করলে সে নিয়েও ঝগড়া হয়। দু’বছর পর বড় ভাইয়েরও অকালমৃত্যু দেখতে হয় পো’কে।

১৮৩৫এ ২৬ বছর বয়েসী পো বিয়ে করেন তুতো-বোন ১৩ বছরের ভারজিনিয়াকে। তাঁকে যে ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৮৪২এ ভারজিনিয়ার যখন যক্ষ্মা ধরা পড়ল, পো তখন বুঝে নিলেন যা বোঝার। বিষণ্ণতা আর নিয়তিবাদ তাঁর লেখায় ছাপ ফেলা শুরু করলো। ১৮৪৭এ মারা গেলেন ভারজিনিয়া। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগেই ভবিষ্যতদ্রষ্টা  পো লেখেন তাঁর সবচে’ কালজয়ী কবিতা দ্য রেভ়েন

সে কাব্যে বিমর্ষ এক পন্ডিত বইয়ের মাঝে ডুবে আছেন, প্রিয়তমা লেনোরকে হারানোর বেদনা ভুলে যাওয়ার প্রয়াসে। এমন সময় এক বিশাল দাঁড়কাকের আবির্ভাব ঘরের দরজার চৌকাঠের ওপরে। সে যখন ডেকে ওঠে, পন্ডিতপ্রবর ভাবেন কাক বলছে সে নামটি যেটা তিনি ভুলতে চান — লেনোর। কাককে অনুনয় করতে সে আবার ডেকে ওঠে — লেনোর নয়, সে আসলে বলছে নেভ়ারমোর! প্রেয়সীর দেখা তুমি আর কখনো পাবে না! যতবার বিদ্বান চান সে কথা ভুলতে, ততবার রেভ়েন ডেকে ওঠে — নেভ়ারমোর! এ এক উদ্ভ্রান্ত দ্বন্দ্ব! একদিকে বিরহবেদনা নিরসণের মানবিক প্রয়াস, আর অন্যদিকে প্রেমিকার স্মৃতির প্রতি অকপট বিশ্বস্ততা! (নিচের গানটা রেভ়েন কাব্য অবলম্বনে পো’এর প্রতি প্রগ রক গ্রুপ অ্যালান পারসনস প্রজেক্টের ট্রিবিউট।)

দ্য রেভ়েন লিখে পো মজুরি পেয়েছিলেন মোটে নয় ডলার। তাঁর ‘লেনোর’ ভারজিনিয়ার অকালমৃত্যুর দু’বছর পরে হতদরিদ্র-ক্ষতহৃদয়-ভগ্নশরীর ৪০ বছর বয়েসী এডগার অ্যালান পোও ১৮৪৯এর অক্টোবরের এক স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা রাতে দেহত্যাগ করেন বাল্টিমোরের রাস্তায় — অনেকটা তাঁর গথিক গল্পগুলির মত রহস্যজনকভাবেই!

এই ফ়লের কোন এক গা ছমছমে সন্ধ্যায় পো’এর একটা রোমহর্ষক ছোটগল্প পড়ে ফেলুন! হ্যাপি হ্যালোউইন!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




প্রেতাত্মার রাত্রি

Featured Video Play Icon

হ্যালোউইন সমাগত প্রায়। অক্টোবর শেষের এই উৎসব আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে নানা নামে পালিত হয়। এদেশের বাচ্চারা ভূত-প্রেত-দত্যি-দানোর সাজ পড়ে পাড়ার বাড়ি বাড়ি যায় ভয় দেখাতে। ট্রিক অর ট্রীট বলে টফি-চকলেট আদায় করে নেয়।

এই উৎসব মার্কিনদেশে এসেছে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড থেকে। এখন সেক্যুলার অনুষ্ঠান হিসাবে পালিত হলেও, খ্রীষ্টধর্মের ঐতিহ্যের অংশ এটা। হ্যালোউইন মানে হ্যালোড ইভ়নিং বা পবিত্র রাত্রি, যে রাত সকল সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনার জন্যে উৎসর্গীকৃত। কিন্তু এর শিকড় প্রাক-খ্রীষ্টান কেল্টিক ড্রুইড ঐতিহ্যে, যার ‌বৈশিষ্ট্য পূর্বপুরুষ আর প্রকৃতিদেবীর আরাধনা। বর্তমান যুগে সে ঐতিহ্যের বাহক আইরিশরা হ্যালোউইনকে সাওয়িন নাইট বা পবিত্ররাত্রি হিসাবে পালন করে — শুধু সেটা তাদের ক্যাথলিক ধর্মে এসে নতুন তাৎপর্য পেয়েছে।

হ্যালোউইন আসলে একটা হারভেস্ট ফেস্টিভাল বা নবান্ন পরব। ফসল কাটা শেষে পড়শীদের মধ্যে মিষ্টি-খাবার আদান-প্রদানের উৎসব। সে থেকে পাম্পকিন প্যাচের হোৎকা কুমড়ো আর খড়ের গাঁদা। আবার বছরের একই সময়ে শীতের প্রাক্কালে ঊর্বরতা বিদায় নেয়, আর প্রকৃতিমাতার ঘুম অথবা ‘মৃত্যুর’ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

হ্যালোউইনের সাথে সেজন্যে মৃত্যুরও একটা যোগাযোগ আছে। ভূতপ্রেত সাজার ব্যাখ্যাও সেটা, যদিও এরকম সাজসজ্জা তুলনামূলকভাবে নতুন প্রচলন। অনতিপ্রাচীনকালে এসময় পরলোকগত পূর্বপুরুষদের স্মরণ-সম্মান করা হত। প্রাক-কলাম্বাস যুগের ঐতিহ্য ধরে মেক্সিকোতে হ্যালোউইনের সময়েই পালন করা হয় দিয়া দে লস মুয়ের্তোসকোকো নামের ডিজ়নি ছবির কাহিনী এ নিয়েই।

যারা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা তাদেরকে বোঝানো একটু কঠিন উত্তরের দেশগুলিতে এসময় কি ধরনের ঋতুপরিবর্তন হয়। আবহাওয়া হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে যায়, পর্ণমোচী বৃক্ষ সবুজ পাতা ঝেড়ে ফেলে ধূসর হাতের মত শাখাপ্রশাখা নিয়ে ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা শীতল স্যাঁতসেঁতে বাতাস সেসব উদোম ডালপালার ভেতর দিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ করে বয়ে যায়। দিন ছোট হয়ে আসে আর অনেক জায়গায় ঝাঁপ দিয়ে পাঁচটার সময় থমথমে অন্ধকার হয়ে যায়। গায়ে কাঁটা দেয়ার মত ব্যাপারস্যাপার!

সাজপোশাকের পাশাপাশি হন্টেড হাউজ় বা পোড়োবাড়িগুলোর ব্যবসাও এসময় তুঙ্গে ওঠে। সাবার্বের বাড়িগুলিকেও পোড়োবাড়ি সাজানোর হিড়িক পড়ে যায়। পাম্পকিন প্যাচ আর থিম পার্কগুলিতে স্পেশাল ভয়ের রাইডগুলি ছোট-বড় ফ্যান্কেনস্টাইন আর ড্রাকুলার ভীড়ে ভর্তি হয়ে যায়।

কানাডিয়ান শিল্পী লরীনা ম্যাককেনিটের ‘অল সোলস নাইট’ নামের এই গানটা বিভিন্ন সংস্কৃতির হ্যালোউইন কিংবা একই ধরনের উৎসবের মূল প্রাচীন ভাবাবেগটা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে। বোনফায়ারের চারদিকে নেচে চলেছে ছায়ার দল, এরা ইউরোপীয় ভূত। আর মোমবাতি-কাগজের লন্ঠনের কাঁপা-কাঁপা আলোতে জাপানীদের পিতৃপুরুষ-স্মরণের ওবোন উৎসব। অক্টোবরের পরিবর্তে অবশ্য অগাস্টে পালিত হয় ওবোন।

মৃত্যু ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতিতে একরকম টাবু। আমরা সে ব্যাপারে আলোচনা করতে ভয় পাই, বিমর্ষ হয়ে পড়ি। গুরুগম্ভীর টপিক সেটা। সেটা অমূলক নয়। যদিও ইসলামধর্মে মৃত্যুকে খোদার নিকট ফিরে যাওয়া হিসাবে ধরা হয়, অর্থাৎ আসলে টাবু কোন বিষয় এটা নয়। আমার মতে, হ্যালোউইন বা অল সোলস নাইটের মত উৎসব পালনের মাধ্যমে অন্যান্য সংস্কৃতিতে মৃত্যুকে নরমালাইজ় করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরলোকগত পিতৃপুরুষদের সম্মান করে তাঁদের জীবদ্দশার আনন্দের স্মৃতি আর সাফল্যগুলো স্মরণ করা এবং সেসবের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে স্রষ্টার কাছে তাঁদের জন্যে প্রার্থনা করা — মৃত্যুর বিষণ্ণতাকে লাঘব করার জন্যে এ এক অনন্য উৎসব।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...






আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




স্টারি নাইট – ২

Featured Video Play Icon

ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ়ের জন্ম নেদারল্যান্ডের এক উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারে, ১৮৫৩ সালে। বাবা ডাচ রিফর্মড চার্চের পাদ্রী ছিলেন। ভিনসেন্টের ছোটবেলা কেটেছে কড়া ধর্মীয় অনুশাসনে। খুব একটা আনন্দময় ছিল না সেটা।

আর্ট ডীলার ফার্মের চাকরিতে আর্থিক সফলতা পেলেও বেশিদিন সেখানে মন টেকেনি ভিনসেন্টের। সেটা প্রথম প্রেমে বিফলতার কারণে, নাকি সৃজনশীলতার অতিরিক্ত বাণিজ্যিকীকরণ দেখে, তা গবেষণার ব্যাপার! নতুন ঝোঁক এল ধর্মকর্মে।

বাবা-মা-খালুর পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব বিভাগে ভর্তি হতে ব্যর্থ হন ভ্যান গঘ়। কিন্তু তাতে না দমে প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারীর চাকরী নিয়ে পাড়ি জমান বেলজিয়ামের দরিদ্র বোরিনাঝ় এলাকায়। সেখানে কয়লাখনির মজুরদের হাঁড়ভাঙ্গা কষ্টের জীবন দেখে ভিনসেন্টের মনটা আকুল হয়ে পড়ে। কিন্তু চাকরিচ্যুত হতে বেশি সময় লাগল না। চার্চের বরাদ্দ করা আরামদায়ক বাসা এক গৃহহীনকে ছেড়ে দিয়ে নিজে থাকা শুরু করলেন কুঁড়েঘরে। চার্চের হর্তাকর্তাদের হিসাবে এ ছিল মিশনারী পদমর্যাদার অবমাননা!

তারপরও ভ্যানগঘ় থেকে যান গরিব মানুষদের মাঝখানে। তাদের দৈনন্দিন পরিশ্রমের চিত্র আঁকার জন্যে পেন্সিল-চারকোল হাতে তুলে নেন। অনুপ্রেরণা আর সাহায্য আসে স্বচ্ছল আর্ট ডীলার ছোটভাই থিওর কাছ থেকে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাব্যবস্থাকে দু’চোখে দেখতে না পারলেও থিওর উপদেশে ব্রাসেলসের আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হলেন।

ধর্ম থেকে ভিনসেন্টের মন শেষ পর্যন্ত উঠে গেল যাজক খালুর মেয়ে কর্নেলিয়াকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে। সাত বছরের বড় সদ্যবিধবা কর্নেলিয়ার পিছনে এর পরেও অনেকদিন লেগে ছিলেন ভ্যান গঘ়। পরিবারের কারো মনে আর কোন সন্দেহ রইলো না যে ভিনসেন্ট ‘বদ্ধ উন্মাদ’। এ ঘটনার পরে ভ্যান গঘ় পতিতালয়ে যাতায়াত শুরু করেন! অবশ্য শিল্পবিপ্লবের যুগের ইউরোপে নানা যৌক্তিক সামাজিক কারণে এধরনের ব্যাপারস্যাপার হরহামেশা চলত।

চিত্রকলার প্রশিক্ষণ চলতে থাকলো, এবার হেগ শহরে তুতো-বোনজামাই আন্তন মভ়ের কাছে। কিন্তু সে সম্পর্কেও চিড় ধরলো ভিনসেন্টের ছন্নছাড়া জীবনযাত্রার কারণে। বাবার নতুন কর্মস্থল ন্যুনেন গ্রামে চলে আসলেন ভ্যান গঘ়। এখানে দুটো ঘটনা মোটা দাগ কাটে ভিনসেন্টের মনে। মার্গো বলে এক পড়শীকন্যার প্রেমনিবেদনে সাড়া দিলেন তিনি। কিন্তু বিয়েতে বাদ সাধলো দু’পক্ষ। মার্গো বিষ খেয়ে মরতে বসেছিলেন, ভ্যান গঘ় সময়মত তাঁকে হাসপাতালে নেয়াতে প্রাণরক্ষা হল তাঁর। এ ঘটনার কিছুদিনের মধ্যে ভিনসেন্টের বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। ভিনসেন্ট মনে মনে তাঁর মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী করতেন কিনা, তা অবশ্য জানা যায়নি।

ন্যুনেনে থাকার সময়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভ্যান গঘ় প্রায় দু’শো তৈলচিত্র আঁকেন, যার একটা এখনকার সুপরিচিত ‘দ্য পটেটো ঈটারস’। থিও চেষ্টা করেন সেসব বিক্রি করতে। কিন্তু ছবির বিষয়বস্তু আর নিষ্প্রাণ কাঠখোট্টা রঙের কম্বিনেশন ক্রেতাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। থিও ভাইকে উপদেশ দিলেন উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার বাড়াতে।

একটা অপ্রীতিকর ঘটনায় দোষী সন্দেহ করে ন্যুনেনবাসীরা গ্রামছাড়া করে ভ্যান গঘ়কে। বন্দর শহর আন্টওয়ের্প হয় তাঁর পরবর্তী গন্তব্য। জাহাজীদের কাছ থেকে কেনা কিছু জাপানী উডকাট ভিনসেন্টের ভীষণ মনে ধরে। সেসবের কপি এঁকে রঙের কম্বিনশনের প্র্যাকটিসটা আরো জুঁতসই হয় তাঁর। একই সাথে আন্টওয়ের্পের ফাইন আর্ট অ্যাকাডেমিতে ভর্তি হন, পাশও করেন। কিন্তু শিক্ষকদের সাথে অঙ্কনশৈলী নিয়ে বচসা বেঁধে যায়। তারপর সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে ফ্রান্সের পার়িতে থিওর কাছে চলে যান তিনি।

পার়ি ছিল ভ্যান গঘ়ের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। সারা বিশ্বের আর্ট ক্যাপিটাল সেসময় নিউ ইয়র্ক নয়, ছিল পার়ি। থিওর সুবাদে ফের়নঁ কর়মোনের আর্টস্কুলে যাতায়াত শুরু করেন। আর সে সুযোগে পরবর্তীকালের খ্যাতিমান অনেক চিত্রশিল্পীর সাথে পরিচয়-বন্ধুত্ব হয় তাঁর। এঁদের মধ্যে ছিলেন এমিল বেরনার্, অঁর়ি দ্য তুলুজ়-লোত্রেক, কামিয়্যি পিসার়ো, ঝ়র্ঝ় স্যর়া, পোল সিনিয়াক, আর, হয়ত দুর্ভাগ্যক্রমে, পোল গোগ্যাঁ। ইম্প্রেশনিস্ট আর্টের পাশাপাশি স্যরা়র বিশেষত্ব পোয়াঁতিয়িস্মে হাতে-খড়ি হয় ভ্যান গঘ়ের।



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




পার়ির পার্টি লাইফে ভিনসেন্টের হাঁপ ধরতে বেশিদিন লাগলো না। ভাইয়ের সাথেও লেগে যাচ্ছিল প্রায়! ভগ্নস্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারের ‌অজুহাতে ভ্যান গঘ় এবার পাড়ি জমালেন দক্ষিণ ফ্রান্সের ছোট্ট আর্ল শহরে। ভাবলেন, বন্ধু চিত্রশিল্পীদের নিয়ে সেখানকার নির্জনতায় একটা আর্ট কলোনি চালু করবেন। ভূমধ্যসাগরীয় আরামদায়ক আবহাওয়া আর নয়নাভিরাম সিনারিও তাঁর আঁকাআঁকির রঙের জেল্লা খুলে দিল। দুই বছরের কম সময়ে দু’শরও বেশি ছবি আঁকলেন। স্টারি নাইট নিয়ে হাত পাকানোও এসময়ে। র়োন নদীতীর আর কাফে টেরাসের ওপর তারকাখচিত আকাশ নিয়ে দু’টো স্টারি নাইট এসময়েই আঁকা।

সব ভালই চলছিল। আর্লের অধিকাংশ বাসিন্দা বিদেশী লালচুলো ভিনসেন্টকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখলেও দু’একটা বন্ধু ঠিকই জুটেছিল তাঁর, যার একজন পোস্টম্যান রুল্যাঁর ছবি এঁকে দিয়েছিলেন তিনি।

সমস্যার শুরু হলো যখন থিওর অনুরোধে পোল গোগ্যাঁ এসে হাজির হলেন ভ্যান গঘ়ের তথাকথিত আর্ট কলোনির দ্বিতীয় সদস্য হিসাবে। প্রথম কয়েকদিন ভালই কাটল, দু’জনে মিলে ঘুরে ঘুরে বেশ কিছু ছবি আঁকলেন। কিন্তু গোগ্যাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল ভ্যান গঘ়ের পুরোপুরি বিপরীত। দাম্ভিক তো ছিলেনই, পার়ির আরামদায়ক বিলাসী জীবন ফেলে আর্লে এসে ভিনসেন্টের সাথে গরীবী হালে জীবনযাপনও তাঁর মনঃপূত হলো না। ভিনসেন্টকে তাচ্ছিল্য করতেও তাঁর বাঁধলো না। ভিনসেন্টও সহজ পাত্র নন। গোগ্যাঁকে শুরুতে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখলেও শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে পারলেন না অতিরিক্ত সংবেদনশীল ভ্যান গঘ়। ঝগড়াঝাঁটি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। ভ্যান গঘ়ের মানসিক অবস্থারও অবনতি হওয়া শুরু করলো।

১৮৮৮র বড়দিনের দু’দিন আগে এক ঝড়ো রাত। ভিনসেন্ট আর পোলের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। ভিনসেন্ট ছুরি বের করে পোলকে শাসানো শুরু করলেন। পোল ভিনসেন্টের মুখের ওপর হয়ত বলে ফেললেন যে তিনি আর্লে আর এক দন্ডও থাকবেন না। এই জিনিসটারই ভয় করছিলেন যে ভ্যান গঘ়! যে গোগ্যাঁ তাঁকে ছেড়ে চলে যাবেন। তাঁর অন্যান্য সব ব্যর্থতার মত আর্ট কলোনির স্বপ্নটারও অকাল সমাধি হবে। হয়ত মনে মনে ভিনসেন্ট একাকীত্বেরই ভয়ে ছিলেন। তাঁর একমাত্র চাওয়া ছিল ভ্রাতৃতুল্য কোন চিত্রকর তাঁকে সঙ্গ দেবে, অনুপ্রেরণা দেবে, আর তাঁর আঁকা ছবি দেখে বুঝবে তাঁর মনের ভাষা।

এরপর ঠিক কি হয়েছিল তার সঠিক ইতিহাস কারো জানা নেই।কাটা বাম কানটা কাগজে মুড়ে ভ্যান গঘ় দিয়ে এসেছিলেন শহরের পতিতালয়ে এক মেয়ের হাতে। নতুন গবেষণায় বেরিয়েছে সে মেয়ে রেচেল দুশ্চরিত্রা ছিল না, ছিল কর্মচারী মাত্র। ভ্যান গঘ়ের সাথে বন্ধুত্ব ছিল তার। (বাজারে প্রচলিত আছে এক প্রস্টিটিউটকে প্রেম নিবেদন করে ছ্যাঁকা খেয়ে ভ্যান গঘ় কানকাটা হন, সেটা খুব সম্ভব সত্য নয়!)

এ ঘটনার পরে আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেননি ভ্যান গঘ়। থিও তাঁকে যথাসম্ভব সাহায্য করেন। কাছের সাঁরেমি শহরে এক পাগলা গারদে ভর্তি হন ভিনসেন্ট। নামে অ্যাসাইলাম হলেও জেলখানার থেকে খুব একটা তফাৎ ছিল না সেটার। চলাফেরার না হলেও আঁকাআঁকির স্বাধীনতা সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে দেয়া হয়েছিল। এ সময়েই আধ ঘোরে আধ জাগরণে শেষ স্টারি নাইটটা আঁকেন তিনি। বিষণ্ণতা আর হ্যালুসিনেশনে ভুগতে ভুগতে আরো বেশ কিছু বিখ্যাত ছবি এসময়ে আঁকেন ভিনসেন্ট।

একটু সুস্থ বোধ করা শুরু করলে সাঁরেমি ছেড়ে চলে যান ওভ়ের়-স্যুর়-ওয়াজ় শহরে। পোল গাশে বলে এক হোমিওপ্যাথি ডাক্তারের নাম শুনেছিলেন পিসারোর কাছ থেকে। সে ভদ্রলোক অনেক নামীদামী শিল্পীদের আপ্যায়ন করতেন, আর চিকিৎসা দিয়ে, সঙ্গ দিয়ে মানসিক সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে তাঁদের সাহায্য করতেন। এখানে এসে ভ্যান গঘ় প্রায় সত্তরটা ছবি আঁকেন। ‘থ্যাচড কটেজেস বাই আ হিল’ বলে এখানে আঁকা অসমাপ্ত একটা কাজ — তিন গোয়েন্দার পুরনো শত্রু গল্পের কটেজ পেইন্টিংয়ের সাথে এর সন্দেহাতীত মিল।

প্রথম প্রথম ভাল বোধ করলেও মনে এতকালের যত ক্ষত নিয়ে এসেছিলেন ভ্যান গঘ়, ডাক্তার গাশের কাছে তার কোন প্রতিষেধক আসলে ছিল না। মলমের ক্ষণস্থায়ী প্রভাব কেটে যেতে ভ্যান গঘ় সম্ভবত আবার বিষণ্ণতা, একাকীত্বের ছোবলে দুর্বল হতে শুরু করেন। শেষপর্যন্ত ১৮৯০এর ২৭শে জুলাই রিভলবার দিয়ে নিজের হৃদয় বরাবর গুলি চালিয়ে দেন। বুলেট লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও রক্তক্ষরণের ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুশয্যায় ঢলে পড়েন ভিনসেন্ট। হয়ত স্টারি নাইটের সাইপ্রেস বেয়ে তাঁর আত্মা পৌঁছে যায় স্বর্গপিতার কাছে, শেষ শান্তির নীড়ে!

ভাই থিওও এরপর বেশিদিন বাঁচেননি! ভিনসেন্টের মৃত্যুর ছয় মাস পর ৩৩ বছর বয়সে তাঁরও ডাক চলে আসে। হয়ত তিনি ভিনসেন্টের নন, ভিনসেন্টই তাঁর খুঁটি ছিলেন। যত্ন করে বড়ভাইয়ের যে চিঠিপত্র রেখে দিয়েছিলেন থিও, তার থেকেই আমরা আজ ভিনসেন্টের ব্যক্তিগত জীবন আর মানসিক অবস্থার অনেক বিস্তারিত খুঁটিনাটি জানতে পারি।

ভিনসেন্ট কি রোগে ভুগেছিলেন সে নিয়ে আজও জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। অনেক রকম থিওরি আছে, যার শুরু হ্য়ত বাইপোলার ডিজ়অর্ডার দিয়ে, আর শেষ টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি দিয়ে। ডন ম্যাকলীনের গানের মত আমার ভাবতে ইচ্ছে করে ভ্যান গঘ় আসলে অসুস্থ ছিলেন না। তাঁর মানসপটে পৃথিবী ও মানুষ ছিল অন্যরকম, অনেকটা তাঁর ছবির প্যালেটের মত। তাঁর সাথে অনেকেরই খাপ খায়নি, ঝগড়া বেঁধেছে। কিন্তু খেটে খাওয়া দুর্ভাগা মানুষের পাশে দাঁড়াতে তো তাঁর কখনো বাঁধেনি। তাঁর প্রথাবিরোধী স্বভাব আর বিদেশী পরিচয়কে অনেক স্বদেশী, ফরাসী সন্দেহের চোখে দেখেছে। তারপরও তো নানা শহরে-গ্রামে তাঁর হাতে গোনা হলেও বন্ধু জুটেছে। ভ্যান গঘ়ের কোন মানসিক বিকৃতি ছিল না, তাঁর মন ছিল পরিষ্কার। সেখানে মানুষের আচার, ধর্ম, ধন, সামাজিক অবস্থান তাদের মধ্যে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় না। গরিমা-লালসা-ছলনার স্থান নেই সেখানে। সেখানে ঈশ্বর পথহারা দুর্ভাগাদের নিশ্চিত শেষ আশ্রয়! শিল্পের অনুপ্রেরণা সেখানে খ্যাতি কিংবা অর্থ নয়, বরং অনন্যোপায়ের মর্মপ্রকাশের একমাত্র উপায়! আর সেই নিষ্কলুষ চিত্তেই পরিপূর্ণরূপে অনুভব করা সম্ভব নীল-হলদে স্টারি নাইটের মাহাত্ম্য!



আরও পড়ুন বিজ্ঞাপনের পর...




close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!