ভারতীয় ভক্তিবাদ – ৩

Featured Video Play Icon

সাব আয়া একহি ঘাটসে, উৎরা একহি বাট, বীছ মে দুৰিধা পাড় গা’ই, হো গায়ি বারা বাট — সন্ত কবীরের পঞ্চদশ শতকের মলৰী ভাষায় গাওয়া ভজন। সবাই আসছিল একই ঘাট থেকে, সবার একই পথ, মাঝে পড়ল দ্বিধায় সকলে, হয়ে গেল বারো পথ।

কবীরের একশ’টি ভজন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ইংরেজী সংকলন বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালে। সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি। রবীন্দ্রনাথ যে কবীরকেই তুলে ধরেছেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস কবীরের দর্শনের মতই নিরাকার একত্ববাদী। এখনও কবীরপন্থা বলে একটি ধর্মবিশ্বাস বহু ভারতীয় অনুসরণ করে।

আগেই বলেছি চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক ভারতের জন্যে ক্রান্তিকাল। উত্তর ভারতে মুসলিম দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ হলেও আগের সেই স্থিতিশীলতা নেই। দিল্লী সুলতানাতের মত বড় রাজ্য ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে অনেক সামন্ত রাজ্য। রাজনৈতিক ভাগ্য ও সামাজিক অধিকারের অবস্থা ক্রমপরিবর্তনশীল।

ইসলাম ধর্ম ভারতীয় স্থানীয় দর্শনগুলোর জন্যে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ভারতে যে সময় ইসলামের আগমন, তখন মোটে বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চলছে। এর পুরোভাগে ছিল বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজবংশ, যাদের মধ্যে পড়ে বাংলার সেনরা।

ইসলাম শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভারতীয় ধর্মগুলির প্রতিযোগী। অন্তত থিওরিতে ইসলামে জাতপাত নেই, সবার জন্যে খোদার করুণা সমান। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মানুসারীদের বাদ দিলে ভারতীয় বর্ণপ্রথার জন্যে এ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মত সীমান্তবর্তী জায়গা, যেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণবাদে নিষ্পেষিত বহু প্রাক্তন বৌদ্ধ ও অসবর্ণ মানুষ রাষ্ট্র ও ধর্মের চোখে অস্পৃশ্য, তাদের জন্যে ইসলাম ছিল আকর্ষণীয় একটি বিকল্প।

যারা নিচু শ্রেণীর খেঁটে খাওয়া মানুষ, তাদের সকলে যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা নয়। ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে মার্কেট এক্সপানশন হয়েছে অনেক কুটিরশিল্পের। ব্রাহ্মণদের চোখে চন্ডাল হলেও নিম্নবর্ণের শূদ্ররা কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এ ধরনের নিম্ন মধ্যবিত্ত অত সহজে ধর্মান্তরিত হয়নি, হলেও তা হয়েছে নামে মাত্র। ইসলামগ্রহণ যদি নাও করে, নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু বর্ণপ্রথায় তাদের তেমন কোন সম্মানজনক স্থান নেই। অর্থাৎ, এরা না ঘরকা, না ঘাটকা। এরকম আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী প্রতিবাদ ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

দরিদ্র তাঁতী পরিবারের কবীর সেই নিষ্পেষিত শ্রেণীরই প্রতিনিধি। তিনি মুসলিম ছিলেন না হিন্দু, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাকে স্ব-স্ব ধর্মের সন্ত বানাতে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সকলে এক পায়ে খাঁড়া। অথচ জীবদ্দশায় সম্ভবত তাকে হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই গঞ্জনা সইতে হয়েছে।

কবীরের ভজন গবেষণা করে যতটুকু মনে হয়, মুসলিম পরিবারে বড় হলেও সে ধর্মের খুব বেশি জ্ঞান তার ছিল না। সম্ভবত তার পরিবার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের কনভার্ট। কিন্তু সাবালক বয়েসে কবীরের হাতেখড়ি বৈষ্ণব ভক্তিবাদের সমসাময়িক সাধক রামানন্দের হাত ধরে।

কবীরের দর্শনকে সহজিয়া বলা যেতে পারে। সহজ ভাষায় তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন তা হলো, বাইরে দিয়ে ধার্মিক হয়ে কোন মোক্ষ নেই, অন্তরে থাকতে হবে ভক্তি। দেবমূর্তি তো কোন কথা বলে না, তাকে কেন পূজবো? ঈশ্বরের বাস সে তো মন্দির-কাবায় নয়, মানুষের অন্তরে। মুসলিম কাজী সে একদিকে কুরআন বাঁছে, আরেকদিকে কেড়ে নেয় গরীব মানুষের জমি। তেমন তিলকছাঁপা হিন্দু ব্রাহ্মণ যতই বেদপাঠ করুক না কেন, আত্মার মধ্যে যদি সেটা সে ধারণ না করে, তারও নেই পাপমোচন। অন্তর ভাল না হলে বাইরের পাকপবিত্রতার কোন মূল্য নেই।

দু’হাজার বছর আগে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গৌতমবুদ্ধের যে বিপ্লব, সে ছিল আর্য উচ্চবর্ণের ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের বিরুদ্ধে আরেক উচ্চবর্ণেরই প্রগতিশীল প্রতিবাদ। আর কবীরের প্রতিবাদ একেবারে তৃণমূল থেকে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে, তাদের দুর্নীতি-অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। তার দর্শনে রয়েছে সাম্যবাদের ইউটোপিয়া, যেখানে কোন নিষ্পেষন নেই, জাতপাত নেই, সরকার-রাষ্ট্র নেই, কর নেই।

এভাবে কবীর ভারতীয় মানুষের মোহভঙ্গ হওয়া একটা বিশাল অংশের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। আর তার পথ ধরেই আবার হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ভারতীয় সিনক্রেটিজম-সিনথেসিসের বীজ বপন হয়। পরবর্তী সন্ত-সাধু সন্ন্যাসী-ফকির ইসলামের নামেই হোক, আর হিন্দু ধর্মের নামেই হোক, একই রকম হৃদয়গ্রাহ্য সার্বজনীন মানবিক ধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন।

কবীরপন্থার একটা বৈশিষ্ট্য অনেকান্তবাদ, অর্থাৎ মোক্ষলাভের উপায় কেবল একটি নয়, বহু — কিন্তু সকলের লক্ষ্য ঐ একই।

কবীরের ভক্তিবিপ্লব প্রসঙ্গে আরো দুটি জিনিস মাথায় এল, যা না বললে নয়। এক, মধ্যযুগের শেষে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন কিছু ভিন্ন ছিল না। ক্যাথলিক পাদ্রীকূলও ছিলেন মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানেও খ্রীষ্টান জগতে কবীরের মতই এক জ্ঞানবিপ্লব সংঘটিত হয়, যার নাম প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন। জার্মানির বেনেডিক্টবয়ার্ন মঠে খুঁজে পাওয়া রিফর্মেশনপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের কারমিনা বুরানা নামের পান্ডুলিপি ঘাঁটালে একই রকম প্রতিবাদী ভক্তিবাদ চোখে পড়বে। এব্যাপারে এখানে আগে লিখেছি।

আর দুই, অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভক্তিবাদ! হ্যাঁ, এ বস্তুও আছে। তার একটা ধারা সাদার্ন কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের থেকে এসেছে, যাকে বলে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলিকে সমসাময়িক দাসত্বশৃংখলের সাথে যুক্ত করে একটা খোদাভক্তি ও প্রতিবাদ সেখানে উঠে এসেছে। ওয়েড ইন ওয়াটার গানটা মনে আসল। এ গানটি বাপ্টিজমের রেফারেন্সে ভক্তিমূলক হলেও দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ রয়েছে। পানিতে সাঁতরালে পলায়নপর দাসের গায়ে আর কোন গন্ধ থাকে না, মনিবের কুকুরও তাকে আর অনুসরণ করতে পারে না।

Let’s wade in the water,
Wade in the water,
Listen to me now, wade in the water.
I wanna know that you’re mine,
Because your love is so fine.

আরেকটি হলো শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিকাল খ্রীষ্টান মূলধারার ফোক গসপেল সঙ্গীত। এটিও সাউথের। এর উদাহরণ মনে হলো ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ ছবির একটা গান:

As I went down in the river to pray
Studying about that good ol’ way
And who shall wear the robe & crown?
Good Lord show me the way

সুতরাং কবীরের ঐ অনেকান্তবাদ আসলে লার্জার কনটেক্সটে খুবই সত্য। পৃথিবীতে আজ ‘বারো’ পথ, কিন্তু সবার সেই একই ঘাট, একই পথ, একই গন্তব্য। কাহাঁ সে আয়া কাঁহা যাওগে, খাবার কারো আপনে তান কি, কোয়ি সাদগুরু মিলে তো ভেদ বাতাৰে, খুল যাৰে অন্তর খিড়কী…

ভারতীয় ভক্তিবাদ – ২

Featured Video Play Icon

মধুর সুর বোল রে কাগা, মীরা রো মন রাম সে লাগা — ষোড়শ শতকের ভারতীয় ভক্তিবাদের অন্যতম পথিকৃত মীরাবাঈয়ের রাজস্থানী ভজন। রাম এখানে ভগবানের নাম, আদতে শ্রীকৃষ্ণ। রাম-কৃষ্ণ উভয়েই ভগবান বিষ্ণুর অবতার।

মীরাবাঈ কৃষ্ণের প্রেমে মত্ত। তার এই বার্তার বাহক কাক — কাকের কর্কশ কন্ঠ কিভাবে মধুর হয় সেটা বুঝতে হয়ত আবার উলটপুরাণ ঘাঁটতে হবে! কৃষ্ণের প্রেমে মজাটাও এখানে আধ্যাত্মিক। মাওলানা রূমী যখন বলেন, আমি তোমার প্রেমে মত্ত হতে চা‌ই নীরবতায়, কারণ নীরবতায় নেই কোন প্রত্যাখ্যান — তখন তাতে সেই একই একতরফা প্রেম-ভক্তি ধরা পড়ে। এই প্রেম ঈশ্বরের সাথে ভক্তের।

কাওয়ালীতে যেমন প্রথমে একজন একটা লাইন গাওয়ার পর বাকিরা একসাথে তার জবাব দেয়, কীর্তনে ঠিক একই রকম কল এন্ড রেসপন্স রয়েছে। এসব ভজন-কীর্তন ভারতবর্ষে নতুন নয়। কীর্তনের উল্লেখ বেদে পর্যন্ত আছে। আর ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে দক্ষিণ ভারত থেকে এই বৈষ্ণব-শৈব ভক্তিবাদ ধীরে ধীরে উত্তর ও পূর্ব ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। শুধু হিন্দু ধর্ম নয়, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের ওপরও ভক্তিবাদ ও আধ্যাত্মিকতাবাদের একটা প্রভাব শুরু হয়, তাদেরও ভজন-কীর্তন রয়েছে।

তবে দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে ভারতে ইসলাম আসার সাথে সাথে ‌অনেক কিছু উল্টেপাল্টে যেতে থাকে। ইসলামে যে নিয়মিত দৈনিক প্রার্থনা, আর কোন যজ্ঞ বা নৈবেদ্যের ঝামেলা নেই, অর্থাৎ ঈশ্বরের সাথে একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক, এ ব্যাপারটা সম্ভবত হিন্দু ও অন্যান্য ধর্মকে প্রভাবিত করে। আগের রিচুয়ালভিত্তিক মন্দির ও ব্রাহ্মণ্যকেন্দ্রিক ধর্মচর্চাকে টিকিয়ে রাখতে ভারতের জবাব হয় ঐ ভক্তিবাদ। তাতে মন্দির অপরিহার্য নয়। ভারতের সব মন্দির নতুন তুর্কী মুসলিম শাসকরা ধ্বংস করে ফেললেও ভক্তের মনের দৃঢ় নিষ্ঠা বিলুপ্ত করার সামর্থ্য তাদের নেই। অর্থাৎ কঠিন একটা সময়ে ভক্তিবাদের মাধ্যমে নতুন বাস্তবতার সাথে খাঁপ খাইয়ে নেয় ভারতীয় দর্শনগুলি।

মীরাবাঈ পঞ্চদশ শতকে একই রকম বাস্তবতার সম্মুখীন। মুসলিম-হিন্দু সংঘাত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে নয়ত অন্য কোনভাবে দৃশ্যমান। দিল্লী সুলতানাত আফগানদের থেকে হাত বদলে এসেছে মুঘলদের হাতে। আগের শত্রুতা-মিত্রতার সম্পর্কগুলি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। রাজপুত এলিট পরিবারের মীরাবাঈ সেসবের প্রতক্ষ্য সাক্ষী। হয়ত এসব চ্যালেঞ্জের মুখে তার কৃষ্ণভক্তি তাকে অবিচল থাকতে সাহায্য করেছে।

মীরাবাঈয়ের পাশাপাশি আরো বহু সন্ত-সাধক এ সময়ে ভক্তিবাদের চর্চা করেন। শিখ গুরু নানক একই সময়ের, একই ঘরানার। নবদ্বীপের শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আর বৈষ্ণব পদাবলী বৈষ্ণবভক্তির বঙ্গীয় নমুনা। রাধা-কৃষ্ণের লীলা এদের জন্যে ঈশ্বরপ্রেম কিংবা আধ্যাত্মিকতার রূপক মাত্র। আবার গীতায় অর্জুন-শ্রীকৃষ্ণের যে গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক, তার সমান্তরাল ধরতে পারি শামসে তাব্রিজি আর মাওলানা রূমির পীর-মুর্শিদ সম্পর্ক, কিংবা নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সাথে আমীর খসরুর সম্পর্ক। শুধু তফাত হল শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার।

ইসলামী ভক্তিবাদের কাওয়ালী সঙ্গীতের সাথে একটা দৃশ্যমান পার্থক্য চোখে পড়ে এই ভজনের। সেটা হল মঞ্জিরা-করতালের ব্যবহার। মঞ্জিরা বাদ্যযন্ত্রটি আসলে বহু আদিকাল থেকে পাগান ধর্মগুলির সবটিতে ব্যবহৃত হয়েছে। সেটা তো হিন্দু ও রোমান পাগান মন্দিরে ব্যবহার হয়েছেই, ইসলামপূর্ব আরব পাগানরাও ব্যবহার করে থাকলে অবাক হব না। হয়ত সেকারণে করতালে আদিকাল থেকে মুসলিমদের অ্যালার্জি, আর ভজন-কীর্তন থেকে কাওয়ালীতে আসার পথে সেটি গায়েব হয়ে গেছে।

হিন্দু-মুসলিম সংঘাত যে ভারতবর্ষে বিভাজন তৈরির ব্রিটিশদের অধুনা পন্থা তা নয়, অতীত ঘাঁটালে বহু উদাহরণ চোখে পড়বে। তার প্রতিক্রিয়া হিসাবে মীরাবাঈয়ের আগের শতকেই আরেক ভক্তিবাদী সাধক কবির বহু ভজন লিখে গেছেন। তাতে উভয় ধর্মকেই প্রত্যাখ্যান করে সাধারণ মানুষের বোধগম্য সরল এক পন্থা উঠে এসেছে। তৃতীয় ‌অনুখন্ডে তার একটা উদাহরণ দিয়ে শেষ করব।

ভারতীয় ভক্তিবাদ – ১

Featured Video Play Icon

নুসরাত ফতেহ আলী খান আর তার ভাতিজা রাহাত বলিউডের মাধ্যমে খ্যাতির শীর্ষে উঠে আসলেও তাদের মূলধারা সুফী ভক্তিবাদী কাওয়ালী গান।

ভক্তিবাদের কথা উঠলে বাংলার সবাই বাউল গান চেনে। কিন্তু পুরো উপমহাদেশে ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে নানারকম ভক্তিমূলক সাধনার গান। কাওয়ালী তার অন্যতম, যদিও বোধ করি ধর্মের সীমানা অতিক্রম করে খুব কম মানুষই এসব ভক্তিবাদকে একই ছায়াতলে দেখার চেষ্টা করবে।

গত রাতে নুসরাত ফতেহ আলীর সুদীর্ঘ হাক্ব আলী, আলী মওলা গানটা কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে শুনতে শুনতে চলে গেলাম মীরাবাঈএর রাজস্থানী ভজনে, সেখান থেকে কবিরের নাথপন্থী না-হিন্দু না-মুসলিম পপুলিস্ট প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী ভজনে। এসব মিলিয়ে তিনটা অনুখন্ড লিখতে ইচ্ছে হল।

উত্তর ভারতে ইসলামের আগমনের সাথে সাথে বহু পারসিক-তুর্কী মুসলিম কর্মচারী ও সেনাপতি ভারতে আসেন। এদের সেকেন্ড থার্ড জেনারেশনের বংশধররা আমাদের মত অধুনা ইমিগ্র্যান্টদের স্টাইলে স্থানীয় ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে তাদের জাতিগত ঐতিহ্যের মিলন ঘটিয়ে জন্ম দেন নতুন এক সঙ্গীত ঘরানার, যার নাম হিন্দুস্তানী। আর দক্ষিণ ভারতের কর্নাটী সঙ্গীতে তখনও চলতে থাকে আদি ঘরানার ধারাবাহিকতা।

উত্তর ভারতের এই সুরকারদের মধ্যে সবচে অগ্রগণ্য আমীর খসরু। নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সান্নিধ্যে সুফী ভক্তিবাদে শিক্ষা পান তিনি। প্রাচীন ভারতীয় সুরকলাকে সংস্কার করে নতুন রূপ দেন আমীর খসরু। এই কাওয়ালীর সুর ও বিষয়বস্তুর ঐতিহ্য আমীর খসরু পর্যন্ত ট্রেস করা যায়।

আলী মওলা গানটার মূল প্রতিপাদ্য ইসলামের অন্যতম হিরো হযরত আলীর গুণকীর্তন। এটা মূল ধারার সুন্নী ঐতিহ্যের সাথে খুব একটা যায় না। অর্থডক্স ইসলামে মানুষ হিসাবে যদি কাউকে অনুসরণ করা কর্তব্য সে একমাত্র হযরত মুহাম্মদ(সা)।

কিন্তু ইরানী জোরোয়াস্ত্রিয়ান ও শিয়া প্রভাবে হিরো ওয়ারশিপের যে ইন্দোআর্য ট্রাডিশন (তুলনা করুন শাহনামা-রামায়ণ-মহাভারতের সাথে), সেটা চলে এসেছে ভারতীয় ফোক ইসলামে। শিয়া ঐতিহ্য অনুযায়ী হযরত মুহাম্মদ(সা) নাকি গাদির খুম বলে বিদায়হজ্জ্বপরবর্তী এক ভাষণে সরাসরি আলীকে তার উত্তরাধিকারী ঘোষণা করে বলেন, যে কেউ আমাকে যদি মাওলা মানে, সে আলীকেও মাওলা মানে। মাওলা শব্দের অর্থ নিয়ে বহু বিতর্ক আছে। কিন্তু সুফী সাধনার পরিপ্রেক্ষিতে মাওলা মানে ধরতে পারি ইন্টারসেসর — অর্থাৎ যার কিনা উচ্চতর দৈব শক্তির কাছে কারো পক্ষে সুপারিশের ক্ষমতা রয়েছে।

অপরদিকে ইসলামী সাম্রাজ্যের চতুর্থ খলীফা হিসাবে আলী শক্তিরও একটি প্রতীক। তার তরবারি জুলফিকার খোদা-রাসুলের আশীর্বাদমন্ডিত, কিন্তু অত্যাচারী নয়, ন্যায়বিচারী। সেই লাইন ধরে আলী শেরে-ইয়াজদান — খোদার সিংহ। উল্লেখ্য, ইয়াজদান শব্দটা আরবী নয়, পুরনো ফারসীতে জোরোয়াস্ত্রিয়ান দেবতাদের নাম ছিল ‘ইয়াজাতা’। সেখান থেকে ইয়াজদান=খোদা।

তো এই গানটিতে ঘুরে ফিরে আলী, তার শক্তিমহিমা ও আধ্যাত্মিক গরিমার গুণকীর্তন হচ্ছে। পারসিককৃত ভারতীয় রাগ-সুরের ব্যবহারের পাশাপাশি কখনো কখনো ধুম-তানানা ধরনের অর্থহীন শব্দ ব্যবহার করে তাল দেয়া হচ্ছে। হয়তবা শব্দগুলোর লুক্বায়িত কোন অর্থ আছে, নয়ত সেগুলি আলীভক্ত শ্রোতার মনে একটা ইনটক্সিকেশন কিংবা ফানা তৈরির সহায়ক।

যারা নুসরাত ফতেহ আলীর গান বা কাওয়ালী পছন্দ করেন, তারা অবাক হতে পারেন যদি বলি কাওয়ালী আসলে ভারতীয় কীর্তন-ভজনের ঐতিহ্যেরই একটা এক্সটেনশন। দ্বিতীয় পর্বে দেব মীরাবাঈয়ের সেরকম একটা ভক্তির গান

ভাইকিং বেদ

Featured Video Play Icon

প্রাচীন ভারতের অথর্ববেদ আর ভাইকিং ওল্ড নর্স সাগার (মহাকাব্য) মধ্যে শুধু যোজন যোজন দূরত্ব নয়, কমপক্ষে এক হাজার বছরের বিভক্তি।

তারপরও এই গানটিতে গাওয়া ওল্ড হাই জার্মান আর ওল্ড নর্স ভাষার মন্ত্রগুলি শুনে আমার বেদের কথা মনে পড়ে গেল।

গানটিতে দুটি ভাষা আর তিনটি আলাদা মন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি অষ্টম শতকের প্রাচীন জার্মানিক ভাষায় শত্রুর বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভের মন্ত্র। মন্ত্রের যাদুকরী শক্তির বলে উত্থিত ‘ইদিসি’ নামক নারীদৈবশক্তির সাহায্যে হাতের বন্ধন আলগা করে পালানোর তাল করছে বন্দী যোদ্ধারা।

অষ্টম শতকে লেখা এ মন্ত্র ভাগ্যক্রমে মের্সেবুর্গ নামে এক পুরনো জার্মান শহরের ক্যাথলিক মনাস্টেরির লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকে। মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টান প্রেয়ারবুকের মাঝে আলগা কাগজে লেখা ছিল দুটি মন্ত্র। একটার কথা বললাম, আর অন্যটার বিষয়বস্তু আহত ঘোড়ার খুরের পরিচর্যা। প্রাক-ভাইকিং জার্মানিক দেবতা উওটান তার পুত্র বাল্ডরের ঘোড়ার ডিসলোকেটেড হাড় ঠিক করার জন্যে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন: Bone to bone, blood to blood, limb to limb, as if they were mended!

গানের দ্বিতীয় মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে নেক্রোম্যান্সি বা মৃতব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলার ওল্ড নর্স মন্ত্র। আইসল্যান্ড আর নরওয়েতে পাওয়া ভাইকিং আমলের ‘পোয়েটিক এডার’ কাহিনীর সাথে জড়িত গ্রোগাল্ডর মহাকাব্যের নায়ক তার মৃত মা গ্রোয়ার সমাধিস্তূপে গিয়ে তার প্রেতাত্মাকে উত্থিত করেছে। উদ্দেশ্য, বিপদসংকুল যাত্রার আগে গ্রোয়ার উপদেশগ্রহণ। গ্রোয়ার আত্মা গুনে গুনে নয়টি মন্ত্র দিয়ে ছেলের ওপর রক্ষাকবচ দিয়ে দিচ্ছে। তার একটি ঐ মের্সেবুর্গ মন্ত্রের হাতের বন্ধন আলগা করার হুবহু সমান্তরাল। আর নয় সংখ্যাটি ওল্ড নর্স ধর্মে একটি পুণ্যকর সংখ্যা।

আর গানের কোরাসে পুরুষকন্ঠে যে মন্ত্র তাকে বলে ওয়াশিং ভার্স। এটাও ভাইকিং যুগের। শত্রুর দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন যোদ্ধা বলে উঠছে: I wash from me my enemies’ hatred, the greed and wrath of powerful men। ধরে নিতে পারি, এর সাথে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করার একটা রিচুয়াল ছিল। প্রার্থনাটির মূল উদ্দেশ্য নিজের মনস্তত্ত্বকে পরিষ্কার করা। যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক, আর দৈনন্দিন জীবনেই হোক, যেন নিষ্কলুষ মনে প্রতিশোধপ্রবণতা পরিহার করে যেটা করণীয় সেটা করা যায়।

মের্সেবুর্গ চার্মগুলি অনন্য। তার কারণ, রোমের প্রভাবে ‘বর্বর’ থেকে ‘সভ্য’ জাতিতে পরিণত হবার সময় প্রাচীন জার্মানিক গোত্রগুলো তাদের পাগান ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়। সে প্রক্রিয়া কখনো শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, কখনো ক্রুসেডের মাধ্যমে সহিংসভাবে হয়েছে। ফলে আগের যে মন্ত্রগুলি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, সেগুলি সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মের্সেবুর্গ চার্মগুলি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মনাস্টেরিতে খ্রীষ্টানের ভেঁক ধরে থাকা পাগান বিশ্বাসীর কল্যাণে। সপ্তম-অষ্টম শতকে জার্মানিক জাতিগুলি এভাবে তাদের ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। একই অবস্থা হয় দশম শতকের ভাইকিংদের।

যেখানে ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য বেঁচেবর্তে থাকে সেটা উত্তর ভারত। বেদ আর এডার মধ্যে অনেক মিল। শুধু দেবদেবী আর মিথলজি নয়। থর হচ্ছেন বেদের ইন্দ্র, তার হাতের বজ্র থরের অস্ত্রের সমান্তরাল। ইত্যাদি অনেক মিল রয়েছে।

আরও এ গানটিতে যে মিল পাচ্ছি সেটা হলো অ্যালিটারেশন বা অনুপ্রাস। অর্থাৎ কাব্যের শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর দিয়ে মিল।

উদাহরণস্বরূপ, অথর্ববেদের রোহণী বনস্পতি সুক্ত, যেটা কিনা ঐ দ্বিতীয় মের্সেবুর্গ চার্মের মতই মাংসের সাথে মাংস লাগুক, চর্মের সাথে চর্ম ইত্যাকার মন্ত্রপাঠের পাশাপাশি ক্ষতে অরুন্ধতিচূর্ণ দিতে বলছে, তার কয়েক লাইন দিলাম:

“রোহণ্যসি রোহণ্যস্থচ্ছিন্নস্য রোহণী, রোহয়েদমরুন্ধতি
যৎ তে রিষ্টং যৎ তে দ্যুত্তমস্তি পেষ্ট্রং ত আত্মনি
ধাতা তদ্ ভদ্রয়া পুনঃ সং দধত্ পরুষা পরুঃ…”

আর ওল্ড নর্সে গাইছে:
Þann gel ek þér fyrstan,
– þann kveða fjölnýtan, þann gól Rindi Rani, –
at þú of öxl skjótir, því er þér atalt þykkir;
sjalfr leið þú sjalfan þik.

(থন গেল্ এক্ থের ফ্যুর্শটান,
থন ক্বেদা ফ্যিয়লন্যুতান, থন গোল রিন্দি রানি
অৎ থু ওফ অক্শল শ্যিয়তির, থ্বি এর থের অতল্ত থুক্কির;
শ্যিয়াল্ফর লেইদ থু শ্যিয়াল্ফান থিক…)
ইত্যাদি।

আমরা ছোটবেলায় শিশুতোষ ছড়াতে অ্যালিটারেশন প্রচুর করেছি। এটা ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্যে একটা কমন ব্যাপার। বিশেষ করে, বৈদিক সংস্কৃত, ওল্ড হাই জার্মান, ওল্ড নর্স, অ্যাংলোস্যাক্সন আর ওল্ড আইরিশ ভাষার সাহিত্যে বেশ ভালমতই ব্যবহার হত এই অলংকার।

গানটি শুনলে তাই মনে হয়ে বেদের কোন মন্ত্র আওড়ানো চলছে। আসলেই ভাইকিংরা এভাবে সুর করে মন্ত্র পড়ত কিনা, তা হয়ত ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন না, কারণ তাদের কোন লিখিত সঙ্গীত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কাব্যিক অলংকরণের মিল থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে, যে বৈদিক যজ্ঞ-মন্ত্রের সুর থেকে প্রাচীন জার্মানিক গোত্র আর পরবর্তী ভাইকিংরা খুব বেশি দূরে ছিল না।

আজকাল যে সামান্য পরিমাণ পাগানবিশ্বাসী মানুষ উত্তর ইউরোপে বাস করে, তারা তাই বৈদিক সংস্কৃতের অনুকরণেই মন্ত্রপাঠ করে। আর সেটাই এই গানটাতে ধরা পড়েছে।

সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!