সুফী জিকির

তিনারিওয়েন বলে মালির একটা ব্যান্ড আমার বেশ পছন্দ। ২০১০এ ফিফা বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এরা গান করেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ মিউজিকাল ট্রাডিশনেই অধিকাংশ মার্কিন জনরের উৎপত্তি।

তিনারিওয়েনের সদস্যরা অবশ্য কালো নয়, তারা বেরবের বা তুয়ারেগ নামক একটি মিশ্র জাতের। ইউরোপীয় বা মেডিটেরানিয়ান জনগোষ্ঠীতে প্রাচীন বেরবের জিন রয়েছে। অর্থাৎ প্রাগৈতিহাসিক ইউরোপকে জনধ্যুষিত করেছিল এদের পূর্বপুরুষদের একটি অংশ।

আলহাসান আগ তুহামি বলে তিনারিওয়েনের এক গায়ক অদ্ভূত এক চরিত্র। নানারকম অঙ্গভঙ্গি করে লম্ফজম্প দিয়ে দর্শকদের মাতিয়ে রাখে। কখনো মনে হয়, সেই করতে করতে ঘোরের মধ্যে চলে গেছে আলহাসান।

ভদ্রলোকের সাথে ঠিক এক বছর আগে একটা কনসার্টে মোলাকাত হয়, ফরাসীতে কিছু বাতচিতও চলে। এথনিক মিউজিকে আগ্রহ থাকাতে এধরনের কনসার্টের সুযোগ মিললে হাতছাড়া করি না।

আলহাসান আর তার সঙ্গীরা কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান মালিতে স্বজাতির স্বাধীনতার জন্যে প্রথমে অস্ত্র ধরেছিল, পরে গীটার। ছোটবেলা কেটেছে রেফ্যুজি ক্যাম্পগুলিতে। চাদ নামের একটি দেশে গন্ডগোল পাকাতেও লিবিয়ার গাদ্দাফি এদেরকে ব্যবহার করে।

মালির কৃষ্ণাঙ্গদের মত তুয়ারেগরাও মুসলিম। কিন্তু আরবদের সাথে তাদের ভাষা-কালচার মেলে বেশি। আরব দিগ্বিজয়ের যুগে তুয়ারেগরা ‘মাওয়ালি’ বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন সামরিক অভিযানে উমাইয়্যা খেলাফতকে সহায়তা করে। তাদের একজন তারেক ইবনে জিয়াদ, স্পেন অভিযানের সফল সেনানায়ক। অবশ্য উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ জনগণ তখনও মুসলিম হয়নি। সেটি হয়েছে অনেক পরে। আমাদের দেশের মতই সুফী সাধকদের সংস্পর্শে এসে।

আলহাসান যে গানের তালে তালে তিড়িংবিড়িং লাফ দিয়ে ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছে, এটাও আসলে তাদের সুফী ঘরানার একটা ব্যাপার। রুমির ‌অনুসারী তুর্কী-ইরানী মাওলানা সেক্ট যেমন সেমা নৃত্য করে ঈশ্বরের নিকটবর্তী হবার প্রচেষ্টায়, সেরকম উত্তর আফ্রিকার সুফীরাও গানবাজনার তালে তালে শরীর দোলানোর মাধ্যমে ‘ফানা’ বা সেল্ফ-অ্যানাইহিলেশনের একটা অনুভূতির জগতে চলে যায়।

তিনারিওয়েনের আলহাসানের তিড়িংবিড়িং

 

মরক্কোর গানাওয়া সুফী সেক্টটির সদস্যদেরও ফেজ-মারাকেশ-এসাউইয়া শহরের রাস্তাঘাটে কারাকেব নামের করতাল আর সিন্তির বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সম্মোহনী ট্র্যান্স মিউজিক করতে দেখা যায়। বাদ্যের সাথে তারা মাথাটিকে এমনভাবে দোলায় যাতে ফেজটুপির টিকলিটি সমানে ঘুরতে থাকে। বলা বাহুল্য, এরও লক্ষ্য ট্র্যান্স বা মন্ত্রাচ্ছন্ন অবস্থায় পৌঁছনো, যেটাকে রুমির মত কবিরা বলেছেন খোদাপ্রেমের মদে মাতাল হওয়া।

মরক্কোর গানাওয়া সুফী মিউজিক

সুফী তরিকাগুলির এধরনের রিচুয়ালের ধর্মীয় ভিত্তি জিকর বা খোদাকে স্মরণ করা। মূলধারাতে জিকির ফরজ নয়, কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম কেউ যদি কখনো জিকিরে অংশ না নিয়ে থাকে তাহলে অবাক হবো। এ প্রক্রিয়ায় আলো-আঁধারিতে একদল মানুষ জোরে জোরে আল্লাহর বিভিন্ন নাম পাঠ করতে থাকে। কখনো নবীজীর প্রশংসাসূচক দরূদ। কখনো সাধু-সন্ত-সাহাবীদের নাম। পুরো ব্যাপারটিতে একটা আধ্যাত্মিক অনুভূতি আসে, যেটা মনপ্রাণকে হাল্কা করে দেয়। মূলধারায় অবশ্যই নামাজ-রোজার গুরুত্ব জিকিরের থেকে ‌অনেক বেশি।

কিন্তু সুফীদের মধ্যে জিকিরের গুরুত্ব পঞ্চস্তম্ভের সমপরিমাণ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাউল-কাওয়ালী-ধামাল এগুলির কথা না হয় না বললাম। সাবসাহারান আফ্রিকার নাইজেরিয়া, সুদান, সোমালিয়া — এসব দেশগুলিতেও তিড়িংবিড়িংকরা সুফী দলের দেখা মেলে। মিশরে রয়েছে মাওলানাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত তান্নুর। সিরিয়া আর আরবের অন্যান্য স্থানে সেমার পাশাপাশি চলে হাধরা। সেখানে কালিমা-দরূদ-জিকিরের সঙ্গত হয় দারবুকা-ড্রাম, কখনো নে নামক তুর্কী বাঁশি। মাথায় পাগড়ি আঁটা শ্মশ্রুমন্ডিত সুফীরা তার তালে তালে শরীর সামনে পিছে করে।

তুরস্কের সেমা

নাইজেরিয়ার কানোর তিড়িংবিড়িং জিকির

সিরিয়ার নকশবন্দী হাধরা

 

সিরিয়ার আলেভী সেমা আরেক অদ্ভূত জিনিস। শিয়া মিস্টিক এ গ্রুপটা সেদেশে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। এদের ছেলে ও মেয়েরা একসাথে সেমা নৃত্যে অংশ নেয়। জিকির চলে আলী ও অন্যান্য শিয়া সন্তদের নামে। কুর্দীসমাজেও একইরকম মহিলা-পুরুষ মিশ্রিত সেমা করে থাকে। ইরাকের কুর্দী নারী যোদ্ধাদের ছবি খবরে প্রায় আসে। এদের জেন্ডার রোল বহু হাজার বছর ধরে সমানুপাতিক।

সিরিয়া-তুরস্কের আলেভী সেমা

ককেশাসের রুশ প্রজাতন্ত্র চেচনিয়া ও ইঙ্গুশেতিয়ার মানুষও মূলত সুফী মুসলিম। এদের জিকির আতা’য়ী দেখলে মূলধারার মুসলিমরা মূর্ছা যাবে। কলেমা পড়তে পড়তে দু’স্তরে গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষগুলি ড্রামের তালে বানরের মত দু’পায়ে লাফায়, আর হাতে তালি দেয়। মাঝে দলনেতার ইঙ্গিত অনুযায়ী চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। সে ঘোরার দ্রুততা কখনো বাড়ে, কখনো কমে। কারো কিন্তু ছন্দপতন নেই, পুরো দলটি যেন হয়ে গেছে একটিমাত্র দেহ। চেচেন মহিলারাও ভিতরঘরে বসে আলাদা জিকির করে।

চেচনিয়ার জিকির আতা’য়ী

সুফীদের ছোঁয়া কিন্তু পূর্বে বাংলাদেশে এসে শেষ হয়নি। ইন্দোনেশিয়া ও চীনে কখনো কোন মুসলিম সৈনিক পদার্পণ করেনি। সেসকল স্থানে ইসলাম গেছে সুফী মতবিশ্বাসের ওপর ভর করে। বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে এরাও জিকিরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়।

ইন্দোনেশিয়ার সুফী দরূদ-জিকির

চীনের সুফী জিকির

 

বিশ্বের অন্যান্য অনেক ধর্মেও আধ্যাত্মিকতাবাদ রয়েছে। খ্রীষ্টানধর্মের উৎপত্তিই গ্নস্টিক আর ডায়োনাইসিয়ান মিস্টিসিজমের মধ্যে। ইহুদীদের রয়েছে কাবালা। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে মন্ত্রপাঠ আর ভূত তাড়ানোর নাচের মধ্যে একই বিষয়। বর্তমানকালের খ্রীষ্টান ইভানজেলিস্ট অনেক গ্রুপকেও দেখা যায় নাচগান করতে করতে একটা একস্ট্যাটিক স্টেটের মধ্যে চলে যায়। তাতে নাকি ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরে। সত্যমিথ্যা বলা মুশকিল।

যাই হোক, অন্য ধর্মের আধ্যাত্মিকতাবাদে সুফী জিকিরের কোন সমান্তরাল খুঁজে পেলাম না। একমাত্র যেটার সাথে মিলল তা হলো নামিবিয়া-বতসওয়ানার বুশম্যান বা খয়সান জনগোষ্ঠীর হিলিং সেরেমনি। এরা বহু প্রাচীন এক জাত। ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসার আগে এরা হাজার বছর ধরে প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। এদের ধর্মবিশ্বাস অ্যানিমিস্ট, অর্থাৎ প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু-প্রাণীর স্পিরিট আর পূর্বপুরুষদের আত্মার শক্তিতে এরা বিশ্বাসী। ট্রাইবের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে ভূত তাড়ানোর হিলিং সেরেমনি হয়। সেখানে এরা লাইন ধরে মাটিতে পদাঘাত করতে করতে মন্ত্রপাঠ করে। তাদের নেতৃত্ব দেয় মেডিসিনম্যান বা শামান। মন্ত্রপাঠ করতে করতে একসময় ঘোরের মধ্যে চলে যায় শামান। তার মুখ থেকে তখন অবোধ্য সব কথা বের হতে থাকে। সারারাত এরকম অনুষ্ঠানের পরদিন অসুস্থ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলে বলে সে সুস্থ হয়ে গেছে।

নামিবিয়ার খয়সান হীলিং সেরেমনি

‌একইরকম ব্যাপার আলাস্কা-আমেরিকার নেটিভদের কালচারে রয়েছে। উদ্দেশ্য একই, হীলিং।

এটা অবাক করার মত ব্যাপার নয়। মানুষ দলগতভাবে হাজার হাজার বছর ধরে এ ধরনের রিচুয়াল করে আসছে। গ্রুপ সাজেশনের মত একটা মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার এর মধ্যে আছে। মুসলিম জিকির নিয়ে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, জিকিররত মানুষদের হৃদস্পন্দন একে অপরের সাথে সিনক্রনাইজড হয়ে যায়। এক সাথে উত্থানপতন হয়। পুরো এক্সপেরিয়েন্সটা থেকে একটা পরিপূর্ণতা নিয়ে ফেরে অংশগ্রহণকারীরা। অর্থাৎ এর থেরাপিউটিক একটা ভ্যালু রয়েছে। এটাকেই হয়ত রুমির মত সুফীরা বলেছেন ডিভাইন ইনটক্সিকেশন।

সুফীদের এসব নাচগানবাদ্য অবশ্য মূলধারার অনেকের যেমন পছন্দ নয়, তেমন প্রগতিশীলদেরও নয়। বিশের দশকে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক আইন করে সুফী অনেক দরগা বন্ধ করে দেন। কারণ তারা নাকি পশ্চাদমুখী। শুধু পর্যটকদের মনোরঞ্জনের জন্যে বেঁচে থাকে সেমা সেরেমনি। বর্তমানকালের সৌদী-সালাফীদেরও এসব অপছন্দ। সে ধারাটির পয়সা ঢালার কারণে যেসব দেশে সুফী ইসলাম ছিল মূলধারা, তারা এখন কোনঠাঁষা হয়ে গেছে। ব্যাপারটা ইন্দোনেশিয়া থেকে মরক্কো পর্যন্ত সত্য। তবে কুরআন-হাদীসে এ ভাবে জিকির করার কোন ইনস্ট্রাকশন আসলেই নেই।

যেভাবে এসকল রীতি রিজিওনাল ইসলামে এসেছে, তাকে বলে সিনক্রেটিজম। ধর্মপ্রচারকরা দেশে দেশে গিয়ে একটা কমন থীম বের করে সেটার ইসলামীকরণ করেছেন। তাতে স্থানীয়দের আদি ধর্মবিশ্বাস থেকে ইসলামে প্রবেশের পথ পরিষ্কার হয়ে গেছিল। সাধারণ মানুষ গভীর ধর্মতত্ত্ব বোঝে না, কিন্তু জিকির বা হিলিং সেরেমনির সোশাল-পারসোনাল বেনেফিটগুলি ঠিকই বোঝে। যদি সুফী ধর্মপ্রচারকরা বতসওয়ানাতে পৌঁছতেন, তাহলে খয়সান জনগোষ্ঠী গা-টা ঢেকেঢুকে খোদারসুলের নামেই জিকির করত।

অর্থাৎ মুসলিম লোকাল সংস্কৃতিগুলির ওপরের স্তরটাকে ঘষে তুলে ফেললে যেটা দেখি, সেটা অনেক প্রাচীন একটা সাবস্ট্রেট। আর পূর্ব থেকে পশ্চিমে সে সাবস্ট্রেট একই। প্রস্তরযুগের মানুষ যে অ্যানিমিস্ট শামানিজমে বিশ্বাস করত, সেটাই এই সাবস্ট্রেট। মানুষ হিসাবে আমাদের ফিজিকাল-সাইকলজিকাল ক্যারেক্টারের খুব একটা রূপান্তর হয়নি। সেই পরিচয়ে নাচগানবাদ্য এন্টারটেইনমেন্ট নয়, বরং প্রকৃতি আর আত্মাদের বশে আনার প্রচেষ্টার ম্যাজিক।

লাস্কো গুহার শিকারের চিত্র সেই একই ম্যাজিক। গুহাচিত্র অবশ্য গুহাতেই রয়ে গেছে, কিন্তু এসকল জিকির-হিলিং সেরেমনি গুহা থেকে আমাদের সাথেই বেরিয়ে এসেছে। আর এখনো বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে আমাদের ধর্ম-সংস্কৃতিতে।

জেসমিন ফুল

Featured Video Play Icon

মোলিহোয়া, জেসমিন ফুল, নামের এই চীনা গানটা আমার বেশ পছন্দ।

খুঁজে খুঁজেও অনেক আগে দেখা অন্য আরেকটা ক্লাসিকাল অর্কেস্ট্রা সংস্করণ পেলাম না। আজকাল চীনা সরকারের দাপটে গুগল-অ্যাপল সবাই ‘সংবেদনশীল’ ইন্টারনেট পাতা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত। এ যেন আরেক কালচারাল রেভোল্যুশন!

কেন জেসমিন ফুল গানটার ভাল সংস্করণটা পেলাম না, এ ভাবতেই মনে পড়ল ২০১১তে তুনিসিয়াতে যে আরব স্প্রিংয়ের বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার নাম দেয়া হয়েছিল জেসমিন বিপ্লব। আর তার কিছুমাত্র ছোঁয়া চীনেও লেগেছিল।

গণতন্ত্রের দাবিতে কিছু চীনা যে ইন্টারনেটভিত্তিক বিক্ষোভ শুরু করেছিল, তার অন্যতম মাস্কট হিসাবে তারা এই জেসমিন ফুল গানটাকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালায়। গানটা খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু এর মধ্যে বিক্ষোভ-বিপ্লবের নামমাত্র নেই।

গানটির বিষয়বস্তু হলো জেসমিন ফুলের সুগন্ধ-সৌন্দর্যের কাব্যিক বর্ণনা।

তাহলে কেন এ গান চীনের কমুনিস্ট সরকারের টনক নড়ালো? কেন গানটির শিরোনামের চীনা অক্ষরগুলি সেদেশের মোবাইল সেটে ফিল্টার করে নিষিদ্ধ করা হলো ২০১১তে? শুধু তাই না, এমনকি জেসমিন কালচারাল ফেস্টিভাল নামে একটি আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক সম্মেলনও সে বছর বাতিল করে দেয়া হয়।

বুঝাই, ধৈর্য ধরুন।

মোলিহোয়ার উৎপত্তি চীনের চিং সাম্রাজ্যের শাসনামলে, অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি। যে কাব্যের মাধ্যমে ফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করা হচ্ছে, তার বিলাসিতা কেবল অবস্থাপন্ন বনেদী পরিবারদের পক্ষেই সম্ভব। যেকোন দেশের সংস্কৃতিতে ধনাঢ্য জমিদারী পরিবার কিংবা বণিকগোষ্ঠী যে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায় থাকে, সেটা আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ইতিহাসেও ষোল আনা সত্য।

মোলিহোয়া গানটা একসময় চিং সাম্রাজ্যের বেসরকারী জাতীয় সঙ্গীতও ছিল এবং পশ্চিমেও ধীরে ধীরে অপেরা পীসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পায়। আমি যোগাযোগটা ঠিক জানি না, কিন্তু আন্দাজ লাকমে অপেরার ফ্লাওয়ার ডুয়েট (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিজ্ঞাপনের মিউজিক ছিল) হয়তবা, হয়তবা…. মোলিহোয়া দিয়ে প্রভাবিত।

সে যাই হোক, বিংশ শতকের শুরুর ভাগে চিং সাম্রাজ্যের পতন হয়। নানা ওয়ারলর্ডের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। সে যুগের অবসান ঘটান কোমিনতাং পার্টির জাতীয়তাবাদী নেতা চিয়াংকাইশেক

কিন্তু তাঁর শাসনামলেই চীন হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম ক্যাজু্য়ালটি — ১৯৩৯এ যুদ্ধের অফিশাল শুরুর আগেই। একদিকে উত্তরপশ্চিমে মাওয়ের কম্যুনিস্ট গেরিলা, আরেকদিকে উত্তরপূর্বে জাপানের আগ্রাসন।

তারপরও চীনের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তখন অনেক পরিবর্তন আসে। অনেক ছাত্র মার্কিন-ইউরোপ থেকে নতুন ধ্যান-ধারণা নিয়ে এসে চীনা সংস্কৃতিকে আধুনিক রূপ দেন।

মার্কিনদের দীর্ঘকালীন সহযোগিতা আর মাওয়ের সাথে চুক্তি করে জাপানীদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন চিয়াংকাইশেক (সোভিয়েতদের মাঞ্চুরিয়া দখল একেবারে শেষের সুবিধাবাদী ঘাত।)

যুদ্ধচলাকালীন সময়েই মাও তার লংমার্চ বিপ্লব ইত্যাদি শুরু করেন। ১৯৪৯এ কোমিন্তাংওয়ালাদের তাইওয়ানে ভাগিয়ে দিয়ে মেইনল্যান্ডে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন কায়েম হয়।

প্রথম বিশ-পঁচিশ বছর কম্যুনিস্ট শাসনামলে ধেঁয়ে ধেঁয়ে ভারিশিল্পের বিস্তার, শিক্ষা-চিকিৎসাক্ষেত্রের উন্নতি সাধিত হয়। নিঃসন্দেহে তা ছিল সমাজতন্ত্রী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ফসল, এর বিপরীতে কী মূল্য দিতে হয়েছিল, তা না বললাম।

ষাটের দশকে মাওয়ের মাথায় ভূত চাপে যে যত দুনিয়ার ইউরোপীয় সংস্কৃতি উচ্ছেদ করতে হবে। প্রতিষ্ঠা করতে হবে চীনা গণমানুষের সংস্কৃতি। সব পুরাতনের ধ্বংস করে গড়তে হবে নতুন ইন্সটিটিউশন।

ষাটের দশকে কালচারাল রেভোলুশনের সময় ধ্বংস করা হয় বৌদ্ধ ও অন্যান্য ধর্মের পুরনো পাণ্ডুলিপি আর মূর্তি।

তাঁর নামে দাঁড়িয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্টিজান পাইওনিয়ার ছাত্রগোষ্ঠী। চললো মবরুল। তারা যেখানেই পশ্চিমা কিছু কিংবা চীনা চিংযুগের বা সামন্তযুগের কিছু পেলো, সব পুড়িয়ে-গুঁড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলল। পান্ডুলিপিহীন হলেন গবেষক, যন্ত্রবিহীন বাদ্যযন্ত্রী, ভগ্নমন্দিরের নিচে ভগ্নহৃদয় পুরোহিত।

 

কালচারাল রেভোলুশনে নিগৃহীত হন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের মানুষ

এসময়ে চিংযুগের অনেক চীনা সঙ্গীতের লিপি হারিয়ে যায় বা ধ্বংস করে ফেলা হয়। কেউ কেউ মাটিতে পুঁতে লুকিয়ে ফেলে। কিছু অনেক পরে বেরিয়েছে আবার, বেশিরভাগই বেরোইনি।

বলা বাহুল্য, ১৯৬৬ থেকে ১৯৭৬এর এই নৈরাজ্যকর সময়ে প্রচুর মানুষ বিনা কারণে বিনা বিচারে শুধু মাত্র পশ্চিমা চর বা কোমিন্তাং-চিংদরদী ইত্যাদি রাজাকারী অভিযোগের সন্দেহে প্রাণ হারায়। অনেক গবেষকের হিসাবে সে সংখ্যা প্রায় দু’কোটি।

চীনা সঙ্গীতের রাতারাতি পরিবর্তন ঘটে। আগে পশ্চিমা কিংবা চিং প্রভাবে ‘শিল্পের খাতিরেই ছিল শিল্প’। এখন আর্ট হয়ে দাঁড়ালো ‘উচ্চতর লক্ষ্য অর্জনের হাতিয়ার’, তথা নিষ্পেষিত জনগণের নামে মাও ও কম্যুনিস্ট পার্টির গুণকীর্তন। আর তাও যদি না হয়, লোকসঙ্গীতকে তুলে ধরা হলো অপেরা ফর্মে — এ যেন এক ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। ‘ওহে গ্রাম্যবালিকা, কোথা যাও একটু দাঁড়াও…’ ইত্যাদি হলো অপেরা-অর্কেস্ট্রার বিষয়বস্তু। নয়ত, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা, ক্ষেতে কাজ করি চল’, নয়ত টাইগার টিলার মাথায় দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান মাওয়ের লাল বই নিয়ে লাফালাফির স্মৃতিচারণ।

তো এসবের মধ্যে মোলিহোয়ার মত স্বল্প কিছু পুরনো গান বেঁচে রয়েছিল। কারণ, এসব গানের কথায় নেই কোন সম্রাট-বুর্জোয়ার নাম, নেই বিদ্রোহ-বিক্ষোভের আভাষ। শুধুই একটি নিষ্পাপ ফুলের গুণকীর্তন।

আর ঠিক এ কারণেই নিষ্পেষক কমুনিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের প্রতীক হিসাবে ২০১১তে এ গানটি বেঁছে নেয়া হয়। সে বিপ্লব বেশি দূর যায়নি। কারণ, রাষ্ট্রের হাতে মোবাইল-ইন্টারনেটের সকল কলকব্জা। টের পাওয়া মাত্রই মোলিহোয়ার যাত্রাভঙ্গ।

এখনও হংকংশিনজিয়াংয়ে স্বগোত্রীয়-অন্যগোত্রীয়দের ওপর একই কলকব্জা শানিয়ে তাদের জায়গামত পুরো দিচ্ছে কমুনিস্ট রাষ্ট্র। যারা রাষ্ট্রের সুফলভোগী তাদের কোন বিকার নেই। কোন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না, কবে জেসমিন ফুল মোলিহোয়ার মুক্তি আসবে চীনে।

মুঘল চিত্রশিল্পে ইউরোপীয় প্রভাব

আজকে লিখছি মুঘল আমলের চিত্রকর্মের ওপর ইউরোপীয় প্রভাব নিয়ে। ব্রিটিশ কলোনিয়াল আমলের বহু আগ থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে যে পর্তুগীজ, স্প্যানিশ, ওলন্দাজদের আগমন ঘটেছে, আর সে বাণিজ্যের ফলে স্বভাবতই নতুন ধ্যানধারণার মুক্তবিস্তার হয়েছে, সে ইতিহাস আজ ঢাকা পড়ে গেছে শুধুমাত্র ঊনবিংশ-বিংশ শতকের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার রাজনৈতিক ইতিহাসের পুরু প্রলেপে। আমার বিচারে সেটা ইউরোপীয় প্রভাব পরিপূর্ণ ন্যায়সঙ্গত মূল্যায়নের পথে একটা অন্তরায়।

মুঘল আমলে অংকিত এই চিত্রে কাগজের ওপর রঙ ও সোনার ব্যবহার। নবাব পরিচারকসহ প্রাতভ্রমণে বেরিয়েছেন। ১৭৩০-৪০। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

প্রথম ছবিটা স্মিথসোনিয়ান মিউজিয়ামের ফ্রিয়ার গ্যালারি অফ আর্টে সংরক্ষিত। মোটরগাড়ির ব্যবসা করে বড়লোক এক শিল্পপতি চার্লস ফ্রিয়ার বিশের দশকে তাঁর সমস্ত এশিয়ান আর্ট দান করে দেন স্মিথসোনিয়ানকে। এমনকি সেগুলি রাখার জন্যে দালান বানানোর খরচটাও দিয়ে দেন। ওয়াশিংটন ডিসিতে এ মিউজিয়াম দেখার সৌভাগ্য হয় আমার। বাকি ছবিগুলোর অনেকগুলিও একই স্থানে সংরক্ষিত।

মূল কথায় ফিরে আসি। প্রথম ছবিটি ১৭৩০-৪০এ আঁকা। অশ্বারোহী এক নবাব ফুল শুঁকতে শুঁকতে পরিচারকসহকারে প্রমোদভ্রমণ করছেন। ছবিটি উল্লেখযোগ্য এ কারণে যে, এতে অনেকখানি রিয়ালিজম ও ন্যাচারালিজম উঠে এসেছে, যা মুঘলপূর্ববর্তী আমলে দেখা যায়নি। পার্স্পেকটিভ, ডেপথ অফ ফীল্ড, ধর্মীয় ও পৌরাণিক সাবজেক্ট ছেড়ে দৈনন্দিন কার্যকলাপকে ফুঁটিয়ে তোলা — এসবই ভারতীয় শিল্পকলায় নতুন ব্যাপারস্যাপার। পারসিক শিল্পীদের অনুপ্রেরণায় মুঘল চিত্রকলা প্রথম প্রথম সনাতনই ছিল। ন্যাচারালিস্টিক ছবি না আঁকার কারণ, অনেক শিল্পরসিক বলেন, ইসলাম ধর্মের বিধিনিষেধ যে একেবারে প্রাণবন্ত ছবি আঁকা হলে খোদার ওপর খোদকারি করার প্রচেষ্টা হবে সেটা, আর ফলাফল জাহান্নামের আগুন!

এখন বলি রিয়ালিজমে রূপান্তরের পিছনে ইউরোপীয় মিশনারী ও মুঘলদের অবদানের কথা।

সম্ভবত বিজাপুরের শিল্পী ফররুখ বেগের আঁকা এই চিত্রে মাতা মেরি ও যীশু। ১৫৮০-১৬১৯। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

১৫৪২ সালে গোয়াতে এসে উপস্থিত হন সেন্ট ফ্রান্সিস জাভিয়ের। তাঁর লক্ষ্য ছিল সেখানকার পর্তুগীজ খ্রীষ্টানদের বিপথগামী হওয়া থেকে রক্ষা করা, আর তার লেজুড় ধরে নেটিভদের কাছে ধর্মপ্রচার। গোয়ার পার্শ্ববর্তী রাজ্য বিজাপুর ছিল আদিলশাহী সুলতানদের শাসিত। সেখানেও মিশনারীদের কার্যক্রম বিস্তার পায়। এর সাথে সাথে চলে আসে ধর্মীয় চিত্রকলা। যেমন, দ্বিতীয় ছবিটা বিজাপুরের ফররুখ বেগের আঁকা মাতা মেরী ও যীশুর ছবি। এ যতটা না ধর্মবিশ্বাস থেকে আঁকা, তার থেকে বেশি নতুন বিষয় নতুন ভঙ্গি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা। ফররুখ বেগ অবশ্যই এ ছবির নাম ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ড দেননি, কিন্তু বিষয়বস্তু রেনেসাঁস যুগের ম্যাডোনা অ্যান্ড চাইল্ডের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়। তৃতীয় ছবিটিও সেরকম মুঘল আমলে করা হোলি ফ্যামিলির চিত্রায়ন। ফররুখ বেগ পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের শিল্পকলা কর্মশালার সদস্য হন।

ইউরোপীয় চিত্রের অনুকরণে ভারতীয় শিল্পী এঁকেছেন হোলি ফ্যামিলির ছবি। সপ্তাদশ শতক। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

সম্রাট আকবর ছিলেন সকল প্রকার চিত্রকলা ও স্থাপত্যশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। তার আমলে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বোচ্চ শৈল্পিক শিখরে ওঠে। আকবর একই সাথে ছিলেন নানা ধর্মবিশ্বাস সম্পর্কে আগ্রহী, আর সুফীবাদে বিশ্বাসী। এমনকি প্রচলিত ধারার চিত্রকলার পরিবর্তনের ব্যাপারেও তাঁর মতামত ছিল বেশ প্রগতিশীল। বিশেষ করে, তাঁর মতে চিত্রকররা যদি লাইফলাইক ছবি আঁকেও, তাদের অবশ্যই এই অনুধাবন অবশ্যম্ভাবী যে, তাদের ন্যুনতম ক্ষমতা নেই স্রষ্টার মত জড় বস্তুতে জীবন দেবার। একার্থে, এভাবে চিত্রকর্মের মাধ্যমে মানুষের পক্ষে আত্মগরিমা পরিত্যাগ করে স্রষ্টার অপার মহিমার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া সম্ভব। সুতরাং চিত্রকর্ম ধর্মীয় দিক থেকেও শিক্ষণীয় একটি কাজ। এ ছিল আকবরের সুফী ঘরানার চিন্তা।

সুফী ধর্মানুরাগী আকবর নতুন রাজধানী ফতেপুর সিক্রিতে ইবাদতখানা বলে একটি সম্মেলনকেন্দ্র বানিয়ে সেখানে মুসলিম-সুফী-হিন্দু-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ প্রভৃতি ধর্মের গুরুদের আমন্ত্রণ জানান। গোয়ার পর্তুগীজ জেসাইটরাও বাদ পড়লো না নিমন্ত্রণ থেকে। তারা আকবরের ধর্মীয় ঔদার্যের ব্যাপারে ভালমতই জানত। দু’জন পাদ্রী আকবরের ইবাদতখানায় গেলেন আলোচনায় অংশ নিতে। তাদের আশা, আকবর কোন না কোনভাবে যীশুর দেবত্ব মানবেনই।

সে আশা গুঁড়ে বালি। আকবর তাদের থাকার জায়গা দিলেন, নিয়মিত তাদের সাথে আলোচনা করলেন। এমনকি, একটি বিদ্রোহ দমনের যুদ্ধেও এদের একজনকে নিয়ে গেলেন। আকবরের বহু কৌতূহল নিবৃত করার পরও পাদ্রীদের লক্ষ্য বিফল হলো। আকবর নিজেরই এক সুফী তরিকা চালু করলেন, দ্বীন-ই-ইলাহী নামে। তাতে যীশু নয়, স্বয়ং আকবরই একরকম দেবত্বের আসনে আসীন!

কিন্তু যে তিন-চার বছর জেসাইট পাদ্রীরা আকবরের দরবারে কাটালেন, সে সময়ের মধ্যে তারা বহু মেরী-যীশুর ছবি, রেনেসাঁস শিল্পীদের মাস্টারপীসের প্রতিলিপি, ইত্যাদি আকবরকে স্বাড়ম্বরে দেখিয়েছেন। আকবরও সেসব দেখতে যাবার সময় নিজের শিল্পীগোষ্ঠীকে সাথে নিতে ভোলেননি। তাঁরাই সেসব দেখে এসে আঁকা শুরু করলেন নতুন ধরনের ছবি। সেসবে যীশুর জায়গা নিলেন মুঘল সম্রাট নিজেই।

তুলনার জন্য চতুর্থ ও পঞ্চম ছবি দিলাম। এগুলি চতুর্দশ শতকের প্রাকরেনেসাঁস যুগের ইতালীয় চিত্রকর জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা ফ্রেস্কো। প্রথমটি যীশুর জন্মের চিত্র, দ্বিতীয়টি মৃত্যুর। দু’টিততেই লক্ষ্য করুন, আকাশে ফেরেশতার দল, আর পবিত্র আলোকচ্ছটা বা হেলো যীশু-মেরী প্রমুখের মাথার চারদিকে।

১৩২০ সালের আশপাশ দিয়ে আঁকা জোত্তো দি বোন্দোনের অ্যাডোরেশন অফ দ্য মেজাই। মেট মিউজিয়াম

১৩০৫ সালের আশপাশ দিয়ে জোত্তো দি বোন্দোনের আঁকা দ্য ল্যামেন্টেশন অফ ক্রাইস্ট। স্ক্রোভেনি চ্যাপেল

এর সাথে মেলান ষষ্ঠ ছবিটি, যাতে সম্রাট আকবরের মাথার চারপাশেও সেই একই আলোকচক্র। আর ওপরে ছবির ফ্রেমে দুই ফেরেশতা (ইতালীয় ভাষায় পুত্তি)। সন্দেহাতীতভাবে রেনেসাঁস আর্টের প্রভাব!

এই স্টাইল যে শুধু সম্রাটের ছবির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়। সাত নম্বর ছবিটিতে এক মোল্লার ছবিতেও একই ব্যাপার।

১৬৫০ সালের দিকে মুঘল সম্রাট আকবরের ছবি, মাথার চারপাশে ইউরোপীয় ধাঁচে হেলো।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

উনবিংশ শতকে মুঘল চিত্রকরদের আঁকা এক সুফি সাধকের ছবি। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

পরবর্তী সম্রাট জাহাংগীরের সময় ভারতে ব্রিটিশদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। রেনেসাঁস আর্টের সাথে কিছুটা হলেও এসে মিলে উত্তর ইউরোপীয় প্রভাব। আট নম্বর ছবিটি বাদশা জাহাংগীরের। এতে দেখানো হয়েছে সম্রাট ইংল্যান্ডের রাজা জেমসের বন্ধুতার প্রস্তাব পাশে ফেলে এক সুফী সন্তের নিকট থেকে পুস্তক গ্রহণ করছেন। ‘হেলো-পুত্তিও’ আছে জায়গামতই। জেমসের পোশাক-আষাকও নিখুঁত ইংরেজ।

১৬১৫ থেকে ১৬১৮এর মধ্যে শিল্পী বিচিত্রের আঁকা ছবিতে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গির দরবারে সুফি সন্তদের স্বাগত জানাচ্ছেন। নিচে বাম কোনায় ইংরেজ রাজা জেমস অপেক্ষমান। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

নয় নম্বর ছবিটি ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথের। এতে রাণী হাতে নিয়েছেন রাজদন্ড আর ‘গ্লোবাস ক্রুসিজের’। এই ব্রহ্মাণ্ডগোলক  বা সেলেস্টিয়াল অর্ব হলো বিশ্বব্রহ্মান্ডের রূপক, আর ক্রসটি যীশুর। অর্থাৎ এলিজাবেথ হলেন যীশুর স্বর্গীয় রাজক্ষমতার লৌকিক প্রতিনিধি। শুধু এলিজাবেথ নয়, বহু ইউরোপীয় রাজরাজড়াদের একইরকম পোর্ট্রেট ছবি আছে।

এর সাথে মিলান দশ নম্বর ছবিটিকে। জাহাংগীর বসে আছেন চেয়ারে, এ কিন্তু পুরোপুরি ইউরোপীয় ভঙ্গিমার চেয়ার। তার ওপর, জাহাংগীরের হাতে সেই সেলেস্টিয়াল অর্ব। ব্রহ্মান্ডের প্রতীক।

আনুমানিক ১৬০০ সালে নাম-না-জানা শিল্পীর আঁকা ইংল্যান্ডের রাণী প্রথম এলিজাবেথ। হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের। ইংল্যান্ডের ন্যাশনাল পোরট্রেট গ্যালারী।

মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ইউরোপীয় ঘরানার চেয়ারে বসে আছেন, হাতে ব্রহ্মাণ্ড-গোলক। সপ্তদশ শতকের প্রথমভাগ।

লেখা শেষ করি তিনটি মুঘল ছবি দিয়ে। এ তিনটিতেই রেনেসাঁস আর্টের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি দৃশ্যমান। এক, আলোছায়ার খেলা, এমনকি কালো পটভূমিতেও সঠিক রং ব্যবহার করে রাতের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আর দুই, পারস্পেক্টিভ, ফোরগ্রাউন্ড-ব্যাকগ্রাউন্ডের ইলিউশন। একটিতে নৈশকালীন হরিণশিকারের দৃশ্য, আরেকটিতে ইব্রাহীম ইবনে আদম বল্খী নামক এক আদি সুফির ধ্যানের দৃশ্য, তাঁর আহারাদির ব্যবস্থা করছে ফেরেশতার দল।

আর শেষ ছবিটিতে আকবরের স্কেচ। লিওনার্দো দা ভিঞ্চির করা বলেও ভুল হয়ে যেতে পারত কারো! অর্ধনিমিলিত চোখে আকবর বিভোর হয়ে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করছেন। চেহারায় খুব প্রশান্তির ছাপ। জুলফি-গোঁফ খুব পরিচর্যা করে স্কেচ করা।

রাতের আঁধারে হরিণ শিকারের দৃশ্য, এঁকেছেন মুঘল শিল্পী মীর কালান খান। অষ্টাদশ শতক।ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

বলখের সুলতান ইব্রাহিম ইবনে আযাম জঙ্গলে ধ্যান করছেন, তার জন্যে খাদ্য নিয়ে এসেছে ফেরেশতার দল। মুঘল মিনিয়েচার, অষ্টাদশ শতকের প্রথমভাগ। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অফ এশিয়ান আর্ট।

মুঘল শিল্পীদের আঁকা মহামতি আকবরের স্কেচ, আনুমানিক ১৬০৫ সাল।

ফার্সী-তুর্কীদের চিত্রকর্মও এসময় নানাভাবে ইউরোপীয় আর্ট দিয়ে প্রভাবিত হয়েছিল। মুঘলদের যাত্রা যদিও শুরু ইরানী-মধ্য এশীয় ঐতিহ্যের ছত্রছায়ায়, খুব দ্রুত তারা ভারতীয় আর ইউরোপীয় উপাদান গ্রহণ করে, আর জন্ম দেয় নতুন একটি ধারার, যা পরে বিভিন্ন স্থানীয় রাজা ও নবাবদের শিল্পরস আর রুচিকে প্রভাবিত করে।

সুতরাং, কলোনিয়ালিজমের দোষ দেবার পরেও বেশকিছু পজিটিভ ব্যাপারে ইউরোপীয়দের সামান্যতম ক্রেডিট না দিলেই নয়!

পুরানো সেই দিনের কথা…

Featured Video Play Icon

“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”

রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।

রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।

সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।

আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।

পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।

সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে ‌অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।

এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।

এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।

আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। ‌এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। ‌অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।

শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।

আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!

অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!

একশৃঙ্গ অভিযান

সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর রোমাঞ্চকর সব অভিযানের মধ্যে একটা ছিল একশৃঙ্গ অভিযান। তাতে শঙ্কু আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা তিব্বতের দুর্গম এলাকায় গিয়ে সন্ধান পান অদ্ভূত এক স্থানের। সেখানে দুনিয়ার যাবতীয় রূপকথার প্রাণী আর বৃক্ষের আবাস — এদের মধ্যে একটা হচ্ছে ইউনিকর্ন, যার বাংলা সত্যজিৎ করেছেন একশৃঙ্গ।

এই গল্পটা আজ মনে পড়ল একটা খবর দেখে। বিজ্ঞানীরা পুরনো কিছু ফসিল পুনরায় নিরীক্ষণ করেছেন, যেগুলি এলাস্মোথেরিয়াম বলে এক অতিকায় গন্ডারজাতীয় প্রাণীর। গন্ডারের শিংয়ের থেকেও লম্বা একটিমাত্র শিং ছিল এই আদি স্তন্যপায়ী প্রাণীটির। কিছুদিন আগেও ধারণা করা হত যে এলাস্মোথেরিয়াম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক থেকে দু’লাখ বছর আগে।

নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন যে পশ্চিম রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া ও উত্তর চীন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এলাস্মোথেরিয়াম বেঁচে ছিল ৩৬,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ এলাস্মোথেরিয়াম সিবিরিকাম নামক এ প্রজাতিটির সাথে আদি হোমো স্যাপিয়েন্সের মোলাকাত অসম্ভব কিছু ছিল না। হয়ত কোন কোন দুর্গম এলাকায় আরো কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে এই ইউনিকর্ন।

স্বভাবতই আমরা ভাবতে পারি এই এলাস্মোথেরিয়ামই রূপকথার ইউনিকর্ন কিনা। প্রাচীনকালের মানুষ হয়ত সে জানোয়ারকে নিয়েই বর্তমানের রূপকথা ফেঁদেছে। যদিও রূপকথার ইউনিকর্ন দেখতে ঘোড়ার মত, তার শিং প্যাঁচানো। আর এলাস্মোথেরিয়াম দেখতে গন্ডারের মত। তবে তাপির, গন্ডার আর ঘোড়া একই বর্গের খুরসহ প্রাণী — তাদেরকে বলে অড-টোড্ আঙ্গালেটস

যদি ধরে নিই এলাস্মোথেরিয়ামই আদিকালের ইউনিকর্ন, তাহলে প্রস্তরযুগের মানুষ তার চিত্র ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় এঁকেছে ১৩,০০০ বছর আগে। আবার ২,৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতার টেরাকোটা সীলেও পাওয়া গেছে এর মত এক ছবি। চীনা আর তুর্কী-মোঙ্গল মিথলজিতেও এরকম ঘোড়া আছে। আবার অনেক ক্লাসিক গ্রীক লেখক ইউনিকর্নের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের বইয়ে। কিন্তু সন্দেহ নেই তাদের সে বিবরণ সেকেন্ড-হ্যান্ড, পূর্ববর্তী কোন মৌখিক গল্প শুনে তাতে আরো মনের মাধুরী মিশিয়ে মুখরোচক বানিয়েছেন একশৃঙ্গ ঘোটককে।

মধ্যযুগে আরব আলকেমিস্টরা ইউনিকর্নের শিংয়ের ভেষজ গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। আবার বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ নাকি ফ্রাংক সম্রাট ও প্রথম হোলি রোমান এম্পেরর শার্লমেইনকে ইউনিকর্নের শিং উপহার পাঠিয়েছিলেন, যেগুলো এখন ফ্রান্সের এক জাদুঘরে সংরক্ষিত। কিন্তু এগুলো আসলে নারহয়াল নামে এক শিংওয়ালা তিমির। এখনো চীনের হোমিওপ্যাথি মেডিসিনে গন্ডারের শিংয়ের ওষধি গুণ আছে বলে কুসংস্কার চালু আছে। যেকারণে আফ্রিকার প্রচুর দেশে পোচাররা বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক রাইনো মেরে তাদের শিং চীনা-অধ্যুষিত দেশগুলিতে মোটা দামে পাচার করেছে।

রূপকথার প্রাণী নিয়ে যে জীববিদ্যা তাকে বলে ক্রিপ্টোজুওলজি। যারা এতে আগ্রহ পান, তারা নানাভাবে অতীতের বিলুপ্ত প্রাণীর সাথে রূপকথার জীবের যোগাযোগ বের করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে তাদের থিওরিগুলি প্রমাণ করা সহজ কাজ নয়। মানুষের আদিমতম স্মৃতিগুলি সোজাসাপ্টা লিখিত ভাষায় কেউ বলে যায়নি। যদি থেকে থাকে তো তা মৌখিকভাবে বংশপরম্পরায় ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ টাইপ ঘুমের গান অথবা ঠাকুরমার ঝুলির মত গল্পের মাধ্যমে কালে কালে অনেক ফিল্টার হয়ে আমাদের কাছে এসেছে।

কিন্তু রূপকথা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা বলবেন যে পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির রূপকথাগুলির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। আমাদের দেশের ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতবর্ষের রূপকথার সাথে পূর্ব ইউরোপের রূপকথার যোগাযোগ নিয়ে কিছু গবেষণা করেছিলেন বলে মনে পড়ে। তাঁর আগ্রহ যোগানোর জন্যে বোধহয় তাঁর গুরু ময়মনসিংহগীতিকার সংকলক দীনেশচন্দ্র সেন কৃতিত্বের দাবিদার। দীনেশচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় উপকথার পাইওনিয়ার, যদিও তিনি তুলনামূলক লোককথা নিয়ে শহীদুল্লাহর মত কাজ করেননি।

এখানে এটাও উল্লেখ না করে পারছি না যে, শহীদুল্লাহ ধর্মপরায়ণ মুসলিম ছিলেন, একই সাথে বৌদ্ধ চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা-অনুবাদ করেছেন, সংস্কৃত-তিব্বতীসহ বহু প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় তাঁর দখল ছিল। পশ্চিমা শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়েও আরবী-ফারসী থেকে অনেক সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যার মধ্যে রুবাইয়াতে ওমর খইয়াম রয়েছে। আজকের যুগে আমাদের তরুণপ্রজন্ম তাঁর নাম শুনেছে কিনা আমার সন্দেহ!

যাক গে, মূল কথায় ফিরে আসি। চীনের মিথে যেমন ড্রাগন আছে, তেমন ইউরোপেও আছে, আবার দক্ষিণ আমেরিকাতেও সর্পরূপী দেবতার উপাসনা করা হত। আমাদের রূপকথায় যেমন পঙ্খীরাজ, তেমন তুর্কী-মোঙ্গল-তিব্বতী রূপকথাতেও আছে উড়ন্ত ঘোড়া। তুর্কীদের পঙ্খীরাজের নাম আবার তুলপারনর্স ভাইকিংদের উপকথার ভালক্যুরিরা উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসত নিহত বীরদেরকে ভালহাল্লা স্বর্গে নিয়ে যেতে। গ্রীকদের পাখাওয়ালা ঘোড়ার নাম পেগাসাস

সেরকম কেল্টিক রূপকথায় আছে ডয়ার্ফগবলিন, লর্ড অফ দ্য রিংসে দেখে বুঝেছেন যে ডয়ার্ফদের অবসেশন মাটি খুঁড়ে ধনরত্ন বের করা, কিন্তু তাদের মত কিপ্টে আর হয় না। সেরকম ভারতের রূপকথায় আছে যক্ষ আর যক্ষের ধন।

কোত্থেকে কি এসেছে সেটা বের করা কঠিন কাজ। তবে কিছু কমন থিম সব রূপকথায় আছে। যেমন জোসেফ ক্যাম্পবেল বলে এক উপকথাবিদ হিরো থিমটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। হিরো থাকবে একজন গল্পে, তার ‘কামিং অফ এইজে’ বা পরিপক্বতার বয়েসে   কোন কঠিন পরীক্ষা বা ফীট থাকবে। উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে গ্রীকদের ‘টুয়েল্ফ টাস্কস অফ হারকিউলিস’। জোসেফ ক্যাম্পবেল এসব কাহিনীকে ইন্টারপ্রেট করেছেন প্রাচীন মানুষের মনস্তত্ত্ব আর তাদের ম্যাজিকে বিশ্বাসের মাধ্যমে। এ থিমটা তাই সব কালচারেই কমন, কারণ সব মানবপ্রজাতির আদি মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন একইভাবে হয়েছিল, পরে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেসবে আরো স্থানীয় ডিটেইল যোগ হয়।

কিছু রূপকথাতে সেক্সুয়াল আন্ডারটোনও রয়েছে। যেমন বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট এবং আরো অনেক। আমি জানি না কোন নৃতত্ত্ববিদ এ প্রমাণ করতে পারবেন কিনা, যে সেসব কাহিনী প্রাচীনকালে যেসব আলাদা আলাদা মানবপ্রজাতি ছিল — যেমন নিয়ান্ডারটাল, হোমোসেপিয়েন্স, ডেনিসভ়ান, আরো একটি অজানা প্রজাতি — তাদের মধ্যে ইন্টারমিঙলিংয়ের অবচেতন স্মৃতি। তারা যে ইন্টারমিঙ্গল করেছিল তা এখন বিজ্ঞানীদের অজানা নেই, আফ্রিকার বাইরের মানুষের কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ জীন নিয়ান্ডারটাল। বলা বাহুল্য নিয়ান্ডারটালদের চেহারা ছিল গাঁট্টাগোট্টা, অনেকটা লর্ড অফ দ্য রিংসের ডয়ার্ফরাজা গিমলির মত! আবার যদি ডেনিসোভানদের আরো পরিপূর্ণ ফসিল বেরোয়, আর তাতে যদি দেখা যায় তারা এল্ফদের মত, তাহলে তো উপকথাবিদ-নৃতত্ত্ববিদ দুয়েরই পোয়াবারো! এখানে আমি সত্যজিতের মত একটু অতিকল্পনার আশ্রয় নিলাম!

অনেক কাহিনীই আছে যেখানে কল্পনার আশ্রয় নেয়ার কোন দরকার নেই। নূহনবীর মহাপ্লাবনের কাহিনী ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সুমেরীয় গল্প থেকে এসেছে। সে কাহিনী পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তার অংশবিশেষের উল্লেখ আছে প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশের বীরত্বগাঁথার মধ্যে। আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ যদি পড়ে থাকেন, তাহলে ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের প্রাচীন মিশরের টেইল অফ দ্য শিপরেকড সেইলর পড়ে মিলিয়ে দেখুন!

আরব্যোপন্যাসের আলিবাবা-চল্লিশ চোরের কাহিনী তো সত্য ঘটনা অবলম্বনে! ১৪৫৬ থেকে ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে হিব্রুদের পূর্বসূরী কানানাইট জাতির জোপা (বর্তমান জাফা) নগররাষ্ট্র ফারাও তৃতীয় থুতমোসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। প্রাচীন মিশরের নাপোলেওঁ হিসাবে পরিচিত থুতমোসে তাঁর জেনারেল জেহুতিকে পাঠান বিদ্রোহদমনে। জেহুতি জোপ্পার রাজকুমারকে শান্তিআলোচনার নামে নগরপ্রাচীরের বাইরে তাঁর ক্যাম্পে দাওয়াত দিয়ে পাঠান। তারপর চালাকি করে তাঁকে বন্দি করে ফেলেন। আর কয়েকশ’ সৈন্যকে বস্তায় ভোর ঘোড়াগাধার পিঠে চাপিয়ে এক রথীকে পাঠান নগরে। সেখানে গিয়ে রথী ঘোষণা করে যে জেহুতি রাজকুমারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন আর নগরবাসীকে শান্তির টোকেনস্বরূপ উপহার পাঠিয়েছেন। মাথামোটা কানানাইটরা যে দরজা খুলে দিয়েছিল বলা বাহুল্য! ট্রোজান হর্সের কাহিনীও একই রকম!

কথায় কথায় ইউনিকর্ন থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। উপসংহারে এটুকুই বলতে চাই যে, মানবসভ্যতার রূপকথা-মিথ-ফেইরিটেল-লেজেন্ডের মধ্যে অনেক ভুলেযাওয়া স্মৃতি আছে যেগুলি মানুষ এখনো ফিরে ফিরে মনে করে, কারণ সেগুলি তার মানসের কাছে এখনও ‌আকর্ষণীয়। কয়েক শতাব্দী পরে স্টার ওয়ারসের ল্যুক স্কাইওয়াকার হয়ে যাবে গিলগামেশ, লর্ড অফ দ্য রিংস হয়ে যাবে রামায়ণ বা ইলিয়াড। এগুলিতে যা রয়েছে, পূর্বসূরীদের মত তাদের একই রসদ! তখনকার মানুষ তাই খাবে, কারণ তার মনস্তত্ত্ব তখনও থাকবে আজকের মতই প্রাচীন।

 

১৮৭৮ সালে শিল্পীর কল্পনায় এলাস্মোথেরিয়াম চিত্রিত হয়েছিল এভাবে। ১৮০৮ সালে প্রাণীটির বিবরণ প্রথম প্রাণীবিদদের কাছে তুলে ধরেন মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরের পরিচালক য়োহান ভ়াল্ডহাইম।

নেদারল্যান্ডের উট্রেখটের রাইকসমিউজিয়ামে সংরক্ষিত ‘ইউনিকর্নের শিং’।

ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর জন্ম পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনায় ১৮৮৫ সালে, মৃত্যু ১৯৬৯এ ঢাকাতে। বহুভাষাবিদ, শিক্ষাবিদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে এম.এ. করার পরে ফ্রান্সের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন, তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল চর্যাপদের প্রাচীন বাংলার বিভিন্ন ডায়ালেক্ট বা আঞ্চলিক ভাষার বিশ্লেষণ। তিনি ছিলেন অখন্ড ভারতবর্ষের মুসলিমদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেটধারী। দেশবিভাগের আগেই পূর্ববঙ্গের নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ৫২র ভাষা আন্দোলনেও তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

কনরাড গেসনার নামক এক সুইস প্রকৃতিবিজ্ঞানী ১৫৫১ সালে তাঁর প্রকাশিত ইস্তোরিঈ আনিমালিয়ুম গ্রন্থে ইউনিকর্নকে কল্পনা করেছেন এভাবে।

ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় পাওয়া ‘ইউনিকর্নের’ স্কেচ, ১০ থেকে ৫০,০০০ হাজার বছরের পুরনো।

মহেঞ্জোদারোতে পাওয়া চার হাজার বছরের পুরনো ‘ইউনিকর্নের’ ছাপমারা সীল। এরকম বহু পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পাতে। অবশ্য পাশ থেকে দেখা জ়েবু নামক বৃহদাকার গবাদিপশুও হতে পারে।

দীনেশচন্দ্র সেনের জন্ম ঢাকা জেলায়, ১৮৬৬ সালে; মৃত্যু ১৯৩৯এ কলকাতায়। ঢাকা কলেজ আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া স্কুলের (বর্তমানে কলেজ) প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মৈমনসিংহ গীতিকায় ২১টি গাঁথা সংকলন করেন, চন্দ্রকুমার দে’র সহযোগিতায়। ১৯২৩এ মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশের পরে দেশী-বিদেশী সাহিত্যবোদ্ধামহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মীয় সংস্কৃতি থেকেই এ গানগুলো সংগৃহীত। মৈমনসিংহ গীতিকার সাফল্যের পরে পূর্ববঙ্গগীতিকা বলে আরেকটি সংকলন ১৯২৬এ প্রকাশিত হয়। এতে ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর পালাগানের নমুনা সংরক্ষিত হয়েছে।

নারহয়াল তিমি, ঠান্ডা উত্তর সাগরে এর বাস। এর ‘শিং ’ আসলে তার লম্বা প্যাঁচানো একটি দাঁত।

ব্ল্যাক রাইনো, সারা দুনিয়াতে পাঁচ হাজারেরও কম আছে এখন। পূর্ব ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলে নিরামিশাষী এই প্রাণীর আবাস ছিল।

নিউ ইয়র্কের ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে সংরক্ষিত নিয়ানডারটালের কংকাল। দেড় লাখ বছর আগে আদি মানুষ হোমো ইরেক্টাসের একটি ধারা আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আসে এবং বিবর্তিত হয় হোমো নিয়ান্ডারটালেন্সিসে। ইউরোপ থেকে মধ্য এশিয়া আর মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এরা টিকে ছিল ৪২,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। ৪৫,০০০ বছর আগে হোমো সেপিয়েন্স, যে কিনা আফ্রিকায় ইরেক্টাস থেকে আলাদাভাবে বিবর্তিত হয়, ইউরোপে এসে পৌঁছায়। অর্থাৎ তিন থেকে চার হাজার বছর মানুষের দুটো আলাদা জাত একই এলাকায় পাশাপাশি বসবাস করেছে। সন্দেহ নেই যথেষ্ট মারামারি তারা করেছে খাদ্য ও অন্যান্য চাহিদার জন্যে। তাদের মধ্যে যে ব্রীডিংও হয়েছিল সেটার প্রমাণও আমাদের জেনেটিক ম্যাপে পাওয়া গেছে।

মোঙ্গোলিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতীকে তাদের উপকথার উড়ন্ত অশ্ব তুলপারকে দেখানো হয়েছে এভাবে।

সপ্তদশ শতাব্দীতে আঁকা তেয়্যেরিয়ানো-রেমেনসিস কোডেক্সে মধ্য আমেরিকার অ্যাজটেক সভ্যতার দেবতা কেৎসালকোয়াতলকে দেখানো হয়েছে পালকওয়ালা সর্প হিসাবে। মায়াদের কাছে একই দেব পরিচিত কুকুলকান হিসাবে। মেক্সিকোর বিখ্যাত তেওতিওয়াকানে এই সর্পদেবের উপাসনার প্রমাণ পাওয়া যায়, ২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই শহর গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ফেদারড সারপেন্টের উপাসনা আরো আদিম ওলমেক সভ্যতাতেও ছিল, তাদের বয়স কমপক্ষে সাড়ে তিন হাজার বছর। পূর্ব এশীয় সভ্যতাগুলিতেও ড্রাগন একইরকম সম্মানের আসনে অধিষ্ট।

ইংরেজ চিত্রশিল্পী অশ্বারোহী ভালক্যুরিদের কল্পনা করেছেন এভাবে। নর্স মিথোলজিতে আরেকটা উড়ন্ত ঘোড়া আছে যার নাম হোফৰার্পনির আর আরোহী বার্তাবাহক দেবী গ্না। দেবপিতা ওডিনের আটপেয়ে ঘোড়ার নাম স্লীপনির। কোরিয়ার প্রাচীন রাজাদের সমাধিতেও আটপেয়ে পাখাওয়ালা ঘোড়ার চিত্র পাওয়া গেছে।

ল্যুভরে প্রদর্শিত অ্যাসিরীয় সাম্রাজ্যের আমলে তৈরি বীর গিলগামেশের মূর্তি। গিলগামেশের কাহিনীতে তিনি অমরত্বের সন্ধানে গিয়ে হাজির হন দিলমুন বলে দূরের এক দেশে (বর্তমান বাহরাইন এলাকার সুমেরীয় নাম)। সেখানে উতনাপিশতিম বলে এক সাধুর কাছে আছে অমরত্বের গুপ্তরহস্যের উত্তর। এই উতনাপিশতিম নিজে অমর, দেবতাদের আশীর্বাদে। আর দেবতাদের নির্দেশে নূহনবীর মত বজরা বানিয়ে মহাপ্লাবন থেকে নিজ পরিবারকে রক্ষা করেন, সাথে বিভিন্ন প্রাণী।
Link

৭৮-৮০ খ্রীষ্টাব্দে রোমসম্রাট ডোমিশানের এই মুদ্রার এক পিঠে গ্রীক পুরাণের পেগাসাসের ছবি। হিরো বেলেরোফোন তাকে ধরে পোষ মানায়, তারপর তার সাহায্যে কাইমিরা নামক এক দানবকে হত্যা করে।

সাইবেরিয়ার ডেনিসোভার গুহায় দুয়েকটা দাঁত আর অল্পকিছু হাড়গোড় পাওয়া গেছে বেশিদিন হয়নি। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করতে সমর্থ হয়েছেন যে, এগুলি নিয়ান্ডারটাল আর হোমোসেপিয়েন্স থেকে ভিন্ন আরেকটি মনুষ্যপ্রজাতির, যার নাম দেয়া হয়েছে ডেনিসোভান। এগুহায় অন্যান্য সময়ে নিয়ান্ডারটাল আর হোমোসেপিয়েন্সেরও বসতি ছিল। ১৫০,০০০ থেকে ৪৮,০০০ বছর আগ পর্যন্ত এই গুহায় ডেনিসভানদের বসবাস ছিল। নিয়ান্ডারটাল আর ডেনিসভান সংকর এক কিশোরীর হাড়ের অংশও এখানে আবিষ্কৃত হয়েছে। মেলানেশিয়ান আর অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের ৩% থেকে ৫% জীন তারা পেয়েছে ডেনিসভানদের থেকে।

This tale is the oldest known instance of a story of a castaway on a fabulous island, who returns home laden with riches. The Sinbad, the Sailor stories [1] from One Thousand and One Nights belong to the same tradition and share many of its characteristics.
Link

মিশরের লুক্সরের কারনাক মন্দিরে খোদাই করা ফারাও থুতমোসের যুদ্ধংদেহী কায়া। তিনি একাধিক যুদ্ধবন্দীর চুল মুঠো করে ধরে মুগুর দিয়ে তাদের মাথা গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন। একই সাথে লেখা আছে প্যালেস্টাইনের ১১৯টি শহরের নাম, আর লেবানন থেকে ফোরাত নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ২৪০টি শহরের নাম, যেগুলিকে তিনি মিশরের বশ্যতাস্বীকারে বাধ্য করেন। এ এলাকার লোকজন সবসময়ই সুযোগে থাকত কখন আশপাশের বড় বড় রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে নিজেদের সার্বভৌমত্ব জাহির করবে। কোন ফারাওয়ের মৃত্যুবরণের পরে যদি কমবয়েসী যুবরাজ সিংহাসনে আসীন হত, তখন তারা মোক্ষম সুযোগ ভেবে অন্য বড় সাম্রাজ্যের সহায়তায় বিদ্রোহ করে বসত।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!