সিরিয়া ও সাইকস-পিকো

নিচের তিনটি ডাকটিকেট সিরিয়ার জন্মলগ্নের। প্রথমটা আসলে তুর্কী সাম্রাজ্যের, কিন্তু ১৯১৯ সালে এর উপরে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার)। দ্বিতীয়টা ১৯২০এর, নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা এর প্রকাশের উপলক্ষ্য। আর শেষটা ১৯২১এর, আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর এবার ছাঁপ ফরাসীতে — ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার।

তুর্কী সাম্রাজ্যের ডাকটিকেটের উপরে ১৯১৯ সালে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ম্যাপে ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র দেখানো হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে সংঘাতের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি যতটুকু ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সমরাঙ্গনে। ইউরোপের থিয়েটারে সার্বিয়ার পক্ষ নিয়ে রুশ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে অস্ট্রিয়ার মিত্র জার্মানি ও রাশিয়ার মিত্র ফরাসী-ব্রিটিশরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সেরকম, তুরস্ক-জার্মানির গোপন আঁতাঁতের পরে একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ তুর্কী সহায়তায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ওডেসা বন্দরের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনা ছিল তুর্কী যু্দ্ধমন্ত্রী আনওয়ার পাশার যুদ্ধ বাঁধানোর ষড়যন্ত্র, কারণ সুলতানসহ ওসমানী সরকারের অনেকের যুদ্ধে সায় ছিল না। এরপর রুশদের আহ্বানে আবার সেই ফরাসী-ব্রিটিশদের তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা।

ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সুয়েজ় প্রণালী সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যের যুধ্যমান সকল পক্ষের চোখের মণি। সুয়েজ়বিজয়ের লক্ষ্যে জার্মান উপদেশ নিয়ে তুর্কীরা সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সুয়েজ়ের প্রতিরক্ষার খাতিরে ব্রিটিশ ক্যাম্পেন শুরু করার পাশাপাশি মক্কার ‘শরীফ’ হুসেইন বিন আলীর সাথে গোপন পত্রযোগাযোগ শুরু করেন মিশরের ব্রিটিশ হাই কমিশনার ম্যাকম্যাহন।

১৯২০এর সিরিয়া আরব রিপাবলিকের এই ডাকটিকেটের প্রকাশের উপলক্ষ্য নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

শরীফ হুসেইন ছিলেন বিখ্যাত বনি হাশেম গোত্রের গোত্রপতি । সাতশ বছর ধরে তাঁর বংশ মক্কা ও মদিনার শাসন পরিচালনা করে আসছিল — অবশ্য ওসমানী সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে। তাঁর রাজ্যের নাম ছিল হেজাজ়।

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপর হেজাজ়ের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। তুর্কীদের সাথে হুসেইন বিন আলীর বহুদিনের ভাল সম্পর্ক থাকার পরেও যখন মক্কায় হজ্জ্বযাত্রীদের আগমনে ভাঁটা পড়া শুরু করলো, মিশর থেকে খাদ্যশস্য আসা গেল বন্ধ হয়ে, আর শেষে যখন তিনি খবর পেলেন ওসমানীরা তাঁকে সরানোর মতলব করছে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেবার।

১৯২১এর আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর ফরাসীতে ছাঁপ ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, যার অর্থ ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার

তিনি ম্যাকম্যাহনের সাথে চুক্তি করলেন যে তুরস্কের বিরুদ্ধে বেদুইন সৈন্যদলের সাহায্যের বিনিময়ে ব্রিটিশরা উত্তরে হালাব (আলেপ্পো) থেকে দক্ষিণে আদেন পর্যন্ত আরব এলাকায় তাঁকে স্বাধীন রাজ্যগঠনে সমর্থন দেবে। অবশ্য মধ্যোপসাগর তীরের সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চল, আর দক্ষিণ আরবের আদেন-কাতার-কুয়েত ইত্যাদি ইউরোপীয়দেরই থাকবে। হুসেইন আরো দাবি করলেন বেদুইনদের সমর্থন কেনার জন্য লাখ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, যাতে ম্যাকম্যাহন রাজি হলেন। (এসময় এই এলাকায় তেল আবিষ্কার হয়নি।) সে চুক্তির পরে টি.ই. লরেন্স বা ‘লরেন্স অফ আরাবিয়া’ ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহীদের উপদেষ্টা হিসাবে এসে হাজির হন।

এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিদের সহায়তায় আরব স্বাধীনতাকাংক্ষীদের ডি ফ্যাক্টো প্রতিনিধি হয়ে যান হুসেইন। ওসমানী সাম্রাজ্যের মধ্যবিত্ত আরব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ১৯১৩ সালে প্রথম আরব কংগ্রেসের মাধ্যমে যে আরব জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনা করেন, রাতারাতি তার রাজনৈতিক ঝান্ডা হাইজ্যাক হয়ে যায়। ওসমানী আরব প্রদেশগুলিতে যেসকল বেদুইন গোত্রের আবাস ছিল, তারাও উৎকোচ নিয়ে তু্র্কীদের সাহায্য করে। অর্থাৎ আরবের নেতা হিসাবে হুসেইন বিন আলীর সমর্থন সব জায়গায় ছিল না। এসুযোগে এক সময় ওসমানীরা মক্কা দখল করে নেয় আর পবিত্র শহরটির বিপুল ধ্বংসসাধন করে।

ম্যাপে দেখানো হেজাজ় রেলওয়ে ছিল ইস্তাম্বুল থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ওসমানী সেনাবাহিনীর সাপ্লাই লাইন। ব্রিটিশ ও ফরাসীদের অর্থ ও প্রযুক্তির সাহায্যে হুসেইন বিন আলীর পুত্র ফয়সাল এই রেললাইনের ওপর চোরাগোপ্তা মাইন হামলা, লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর গেরিলাদল ছিল ট্রাইবাল বেদুইন আর ওসমানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দী আরবদের নিয়ে সংগঠিত। টি.ই. লরেন্স ছিলেন যুদ্ধ পরিকল্পনায় তাঁর শরিক। পূর্বদিকে ফয়সালের এক ভাই আব্দুল্লাহ তুর্কী মিত্র রাশিদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করেন। আরেক ভাই আলী দক্ষিণে মদিনায় তুর্কীদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন।

এভাবে হেজাজ় রেলওয়ে ধরে ধীরে ধীরে উত্তরদিকে অগ্রসর হয় আরব সেনাদল। ফয়সাল একে একে জেদ্দা, ইয়ানবো, আকাবা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নগর জয় করেন। অন্যদিকে মিশর থেকে ব্রিটিশ-ফরাসী ফৌজও সিনাই হয়ে ফিলিস্তিন-লেবাননে ঢুকে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ১৯১৮এর সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ঈজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স সিরিয়ার দামেস্ক দখল করে নেয়। ফয়সালও তাদের পিছু পিছু দামেস্কে প্রবেশ করে আরবদের জন্যে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। সে রাজ্যে ধর্মনির্বিশেষে সকল আরবদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

কিন্তু এর পরপরই ফয়সাল ও হুসেইন একের পর এক দুঃসংবাদ পাওয়া শুরু করলেন। জানতে পারলেন ১৯১৭তে ব্রিটিশদের ঘোষিত বালফুর ডিক্লারেশনের কথা — যাতে ফিলিস্তিনের অংশবিশেষে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইহুদীদের জন্যে আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার অধিকার স্বীকৃত হয়। আরো তাঁদের কানে এলো ব্রিটিশ-ফরাসীদের গোপন সাইকস-পিকো চুক্তির কথা। এর শর্তানুযায়ী সিরিয়া-লেবানন আর ইরাক হবে যথাক্রমে ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্যের ঔপনিবেশিক বলয়ের অংশ, স্বাধীন আরব বাসভূমি নয়। ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে বিশ্বাস হারালেন না অবশ্য ফয়সাল। ভাবলেন, সাইকস-পিকোর বাস্তবায়ন হবে যুদ্ধের সমাপ্তিতে, ততদিনে তিনি ব্রিটিশদের মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন।… এর এক মাস পরেই অক্ষশক্তি আত্মসমর্পণের ফলে যুদ্ধের যবনিকাপাত হয়ে যায়।

যুদ্ধের পরে তুরস্কের দখলকৃত এলাকাগুলির কি হবে সে নিয়ে প্যারিসে মিত্রশক্তির আলোচনা বসে। তাতে যোগ দেন ফয়সাল। মার্কিনরা ব্রিটিশ আর ফরাসীদের রাজি করায় স্বাধীন কিং-ক্রেইন কমিশনের মাধ্যমে ফয়সালের সমস্যাটি সমাধান করতে। সে কমিশন ১৯২০এ সিরিয়ায় এসে পৌঁছায় এবং বিভিন্ন শহরে গিয়ে আরব জনগোষ্ঠীর মতামত নেয়া শুরু করে। তাদের মতে পৌঁছতে বছর খানেক সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত যখন সে কমিশনের রিপোর্টও এল যে এসব এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী কোন না কোন প্রকার স্বাধীনতা চায় আর এদের সকলে স্বাধীন আবাসভূমির যোগ্য না হলেও সিরিয়াতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব, ততদিনে ব্রিটিশ-ফরাসীরা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছে, আর লীগ অব নেশন্সের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সাইকস-পিকো চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাগিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র লীগের সদস্য হয়নি, কংগ্রেসের বাগড়া দেয়ার কারণে। তাই কিং-ক্রেইন কমিশনের রিপোর্টও বস্তাবন্দি হলো।

এসব ঘটনার বিপরীতে সিরিয়ায় ফয়সালপন্থী বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান আর দক্ষিণ সিরিয়ার দ্রুজরা অবশ্য ফয়সালবিরোধী ছিল। ফরাসীরা সেনাদল পাঠিয়ে জোরপূর্বক নিজেদের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করে। তাদের সাথে এক দফা যুদ্ধে ফয়সালের সেনাদল পরাজিত হয়। ফয়সাল হার মেনে যুক্তরাজ্যে নির্বাসন চলে যান। এখানে শুরু হয় তৃতীয় ডাকটিকেটটির ইতিহাস।

অবশ্য ফয়সালকে বেশিদিন রাজ্যবিহীন রাজা থাকতে হয়নি। ব্রিটিশরা তাদের ম্যান্ডেটরাজ্য ইরাকে তাঁকে রাজসিংহাসনে বসায়। আর ট্রান্সজর্ডান ম্যান্ডেটের রাজা হন তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ। হেজাজ় রাজ্যে তাঁদের বড় ভাই আলী কিছুদিন রাজা থাকার পর সৌদী আক্রমণের মুখে ১৯২৫এ তাঁকে গদি ছাড়তে হয়। সেখানে শুরু হয় ইতিহাসের নতুন এক পাতা।


(১) মিডল ঈস্ট থিয়েটার ছিল পাঁচটি সমরাঙ্গন জুড়ে: সিনাই-ফিলিস্তিন, মেসোপটেমিয়া, ককেশাস, পারস্য, আর গালিপোলি। মেসোপটেমিয়া বা ইরাক অভিযানে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা অংশগ্রহণ করে। বিদ্রোহী কবি নজরুল এ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে লাহোর সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নেন, কিন্তু সে যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হয়নি। [Middle Eastern theatre of World War I]

(২) ইজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স বা ই.ই.এফ. ছিল মিশরভিত্তিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, ফ্রান্স ও ইতালীর সম্মিলিত সেনাদল। কমনওয়েলথ সেনাদলের অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ডার কোরের ডাকনাম আনজ়াক — এরা গালিপোলি সমরাঙ্গনে সাহসিকতার সাথে লড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরেক ক্যাজুয়াল্টি ছিল মিশর। ১৮৬৭ থেকে নামে মাত্র তুরস্কের অধীন ছিল মিশরের স্বাধীন শাসক খদিভরা, ইউরোপীয়দের সাথে তাদের ভাল সম্পর্ক ছিল। ১৯১৪ সালে খদিভ আব্বাসকে অপসারণ করে ব্রিটিশরা সরাসরি মিশরের শাসন ক্ষমতা দখল করে, এর মূল কারণ ছিল ভারতের সাথে যোগাযোগের অবলম্বন সুয়েজকে রক্ষা করা। [Egyptian Expeditionary Force]

(৩) মক্কার শরাফা বা আমিরাত, এ ছিল হুসেইন বিন আলীর রাজ্যের আনুষ্ঠানিক নাম। হেজাজ়ের আগে এটি সার্বভৌম রাজ্য ছিল না। ৯৬৮ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত এই রাজ্যটি নানা আকারে বহাল ছিল। [Sharifate of Mecca]

(৪) বনি হাশেম গোত্র প্রাচীন কুরাইশ বংশের অন্তর্গত, এর নাম হযরত মুহম্মদের(স.) প্রপিতামহের নামে। অর্থাৎ হুসেইনের একটা ধর্মীয় বংশগত মর্যাদা ছিল। তিনি সৌদী ছিলেন না। সৌদীরা এসময় ছিল মরুভূমির সীমিত গুরুত্বের বেদুঈন গোত্রমাত্র। আর তাদের শত্রুতা ছিল হুসেইনের সাথে। হুসেইনের তিন পুত্র আলী, ফয়সাল ও আবদুল্লাহ পর্যায়ক্রমে হেজাজ, সিরিয়া-ইরাক আর জর্দানের রাজা হন। ১৯২৫এ ইবন সৌদ নজদ রাজ্য থেকে আক্রমণ চালিয়ে হেজাজ় দখল করে নিয়ে সৌদী আরব রাজ্যের সূচনা করেন। আলী জর্দানে ফিলিস্তিন আততায়ীর হাতে মারা যান ১৯৫১তে। আর ফয়সালের পৌত্র ইরাকের রাজা দ্বিতীয় ফয়সাল মিলিটারি কুতে ১৯৫৮ সালে নিহত হন। এখন একমাত্র জর্দানে হাশেমী রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে অনেকদিন হুসেইন ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাঁর পুত্রদের রাজমুকুট পড়িয়েও ব্রিটিশরা তাঁর রাগ ভাঙ্গাতে পারেনি। শেষে তাঁকে ছেড়ে সৌদবংশের সাথে মিত্রতাচুক্তি করে ব্রিটিশরা। [Hussein bin Ali, Sharif of Mecca]

(৫) টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স তাঁর ডাকনাম অর্জন করেন ব্রিটিশ খবরের কাগজে আরব বেদুঈনদের স্বাধীন একরোখা জীবনের রোমান্টিক চিত্র অঙ্কন করে। গুপ্তচর-কূটনীতিক-সেনাপ্রধানের পাশাপাশি শখের প্রত্নতত্ত্ববিদও ছিলেন। ১৯৬২তে তাঁর জীবনের ঘটনা নিয়ে তৈরি অনবদ্য ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের রূপ দেন অভিনেতা পিটার ও’টুল। ফয়সালের সাথে তাঁর ভাল সখ্য থাকলেও বাকি দু’ভাইকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেননি লরেন্স। [T. E. Lawrence]

(৬) (৬) ওসমানী সাম্রাজ্যের আরবদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয়দের তুলনায় অধুনার ধারণা। ১৯০৮এ বিপ্লবের মাধ্যমে তুরস্কের শাসনক্ষমতা নেয় ইয়াং টার্ক বলে একদল প্রগতিশীল কর্মজীবী নেতা। তাদের শাসনামলে সংসদীয় প্রথার পুনর্প্রবর্তন হলেও বেশিরভাগ মানুষের জীবনে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তার ওপর বাল্কানের যুদ্ধের ডামাডোল। ফলে ১৯১৩তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তিন পাশার ত্রিনায়কতন্ত্র। প্রতি ক্ষেত্রেই তুর্কীরা স্বহস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় ইউরোপে অবস্থানরত একদল বীতশ্রদ্ধ আরব শিক্ষার্থী ১৯১৩তে প্যারিসে একটি আরব কংগ্রেস ডাকে। এতে ওসমানী সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি এলাকার বুদ্ধিজীবীরা যোগ দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে আরবদের সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়, বরং স্বাধিকার। ফিলিস্তিনে তুর্কী অভিবাসন আইনের সদ্ব্যবহার করে ইহুদীদের আগমন আর ব্রিটিশ-ফরাসীদের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল আরবদের সংগঠিত হবার আরেক কারণ। আরব কংগ্রেস থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুড, বাথ পার্টি, ফ্রী অফিসারস, প্রভৃতি মুভমেন্টের ধারার বিবর্তন। অর্থাৎ হাশেমী-সৌদী রাজতন্ত্রের ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা বাহুল্য, এসময় অধিকাংশ অশিক্ষিত বেদুঈন গোত্রীয় যোদ্ধার দল এত কিছু বুঝত না। প্রাচীনকালের নিয়মানুযায়ী যে দল বেশি উৎকোচ দিত, তাদেরই পক্ষ নিত তারা। [Arab Congress of 1913]

হাওয়াই’য়ি রাজতন্ত্রের গোধূলি

প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে নয়নাভিরাম চিরসবুজ দ্বীপপুঞ্জ হাওয়াই’য়ি। এখন হাওয়াই’য়ি যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টেট, পর্যটনের জন্যে ভূবনবিখ্যাত।

হাওয়াই’য়ি একটা সময় স্বাধীন রাজ্য ছিল। এই লেখায় বলছিলাম তুভা নামের ছোট্ট একটি দেশ বেদখল হয়ে যাবার কাহিনী। আজকে বলি হাওয়াই’য়ি কিভাবে সার্বভৌমত্ব হারালো।

বড় মানচিত্রে হাওয়াই’য়ির দ্বীপগুলি দেখানো হয়েছে, আর ছোট ইনসেট ম্যাপে যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে তুলনামূলক অবস্থান। (ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

নিচের ডাকটিকেটগুলো যথাক্রমে ১৮৮২, ১৮৯৩ ও ১৮৯৪ সালের। প্রথমটিতে রাজা পঞ্চম কামেহামেহার ছবি, তাঁর সময় হাওয়াই’য়ি ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ। দ্বিতীয়টির ছবি হাওয়াই’য়ির শেষ রাণী লিলি’উওকালানির, তার ওপর ‘প্রভিশনাল’ ছাপমারা, অর্থাৎ রাজ্যের শাসনভারে পরিবর্তন এসেছে। তৃতীয়টি স্বাধীন হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের, ১৮৯৮ সালে সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় তার একটি ‘টেরিটোরি’তে, যা স্টেটের থেকেও কম স্বাধীনতা রাখে।

১৮৮২ সালের এই ডাকটিকেটে রাজা পঞ্চম কামেহামেহার ছবি, তাঁর সময় হাওয়াই’য়ি ছিল স্বাধীন রাজতান্ত্রিক দেশ। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

ব্রিটিশ পরিব্রাজক ক্যাপ্টেন কুক ১৭৭৮ সালে হাওয়াই’য়ি দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ইউরোপীয় হিসাবে নোঙর ফেলেন। সে দ্বীপগুলিতে দেড় হাজার বছর ধরে বসতি ছিল পলিনেশিয়ান জনপদের একটি গোত্রের । ক্যাপ্টেন কুকের দলের সাথে ঝগড়াঝাঁটির জের ধরে হাওয়াই’য়িবাসীর হাতে শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যু হয়।

এর কয়েক বছরের মধ্যেই করিৎকর্মা রাজা প্রথম কামেহামেহা ইউরোপীয়দের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে তাদের অস্ত্রপ্রযুক্তি করায়ত্ত করেন, আর যুদ্ধাভিযান করে সব দ্বীপকে বশ করেন। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় কিংডম অফ হাওয়াই’য়ি।

দু’বার ক্ষণস্থায়ী ব্রিটিশ শাসন চললেও এ রাজ্যটি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় পুরোভাগে ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন, কিন্তু প্রাসাদষড়যন্ত্র ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। রাজা আর বনেদী হাওয়াইয়ানরা অবশ্য ইউরোপীয়-মার্কিনদের সাথে নিয়মিত উঠবোস করত। ইংরেজীও পারত তারা সকলে। এর একটা বড় কারণ মার্কিন প্রটেস্ট্যান্ট মিশনারীদের ধর্মপ্রচার। হাওয়াই’য়িএর নেটিভরা নিজ সংস্কৃতির খোলসটাকে রেখেই স্বেচ্ছায় খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করে। অনেকে মার্কিন-ইউরোপীয়দের সাথে বিয়ের সম্পর্কে মিলে যায়। (প্রশান্ত মহাসাগরের বেশ অনেকগুলো দ্বীপরাজ্যের ইতিহাস একইরকম।)

১৮৩৫ সাল থেকে হাওয়াই’য়ি হয়ে ওঠে আমেরিকায় চিনি আমদানির মূল উৎস। ইউরোপীয়-মার্কিন ব্যবসায়ীরা, আর অল্প কিছু স্থানীয়, রাজার অনুমতিক্রমে বিশাল এলাকা অধিগ্রহণ করে আখ চাষ শুরু করে । ক্ষেতের কাজ করতে চীন, জাপান, ফিলিপিন থেকেও এসময় ‌অভিবাসী শ্রমিক আসতে শুরু করে।

১৮৯৩ সালের এই ডাকটিকেটে হাওয়াই’য়ির শেষ রাণী লিলি’উওকালানির ছবি, তার ওপর ‘প্রভিশনাল’ ছাপমারা, অর্থাৎ রাজ্যের শাসনভারে পরিবর্তন এসেছে। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

ব্যবসার স্বার্থে ধীরে ধীরে হাওয়াই’য়িয়ের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন আখচাষীদের নাক গলানো শুরু হয়ে যায়। খ্রীষ্টধর্মের প্রভাবে আর চিনিরপ্তানির অর্থে বিত্তবান রাজা তৃতীয় কামেহামেহা তাঁর সরকারে অনেক ইউরোপীয়-মার্কিনদের স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন গ্যারেট জাড নামে এক মার্কিন মিশনারী। এই ভদ্রলোক অবশ্য বেশ বিশ্বস্ত ছিলেন, মার্কিন নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করে হাওয়াই’য়িয়ের নাগরিক হয়ে যান। হাওয়াই’য়িবাসীর মঙ্গল চিন্তা করেই বেশ কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেন, কিন্তু সেসবের ফল হয়েছিল উল্টো। তার একটি হলো ‘গ্রেট মাহেলে’।

গ্রেট মাহেলে সংস্কারের মাধ্যমে বিদেশীদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়ার আগেই হাওয়াই’য়িয়ের অধিবাসীদের মাঝে জমি পুনর্বন্টন শুরু করা হয়। আমরা আজ জমি-সম্পত্তির মালিকানাকে ধরেই নিই স্বাভাবিক মানবিক অধিকার, হাওয়াই’য়িবাসীর প্রাচীন প্রথানুযায়ী তা কিন্তু ছিল না। নেটিভ আমেরিকানদের মত তাদেরও প্রাচীন বিশ্বাস অনুযায়ী বসবাসের আর আবাদযোগ্য জমি কমিউনিটি প্রপার্টি, প্রকৃতি তার ভরণপোষণের প্রকৃত মালিক, আর রাজা তার কাস্টোডিয়ানমাত্র।

প্রজাদের বেশিরভাগ গ্রেট মাহেলে ফরমানের লিখিত ভাষা পড়তে জানত না। আর জমির মালিকানা দাবি করার জন্যে ন্যূনতম সরকারি কর দেবারও সামর্থ্য ছিল না তাদের। তার ওপর চলছিল বিদেশীদের নিয়ে আসা রোগজীবাণুর মহামারি। ফলে অনেকেই এ সংস্কারের আওতা থেকে বাদ পড়ে যায়।

এতে করে বেশির ভাগ পতিত জমি পাঁচটি বড় বড় চিনি কম্পানির হাতে চলে যায়, এরা অধিকাংশই ছিল মার্কিনপরিচালিত। গ্রেট মাহেলে সংস্কারের বছর কয়েকের মধ্যে কামেহামেহা আর জাডের বিদেশসফরের সুযোগ নিয়ে মার্কিনী প্রধান বিচারপতি এমন একটি আইন পাশ করেন, যার ফলে বিদেশীরাও হাওয়াই’য়িতে জমি কিনতে পারে। সে আইনের বিরোধিতা করলেও শেষ পর্যন্ত রাজা ও জাড হার মানেন।

আভ্যন্তরীণ ব্যাপারস্যাপারে হাওয়াই’য়িনিবাসী মার্কিনীরা ব্যক্তিগতভাবে যখন এভাবে নাক গলাচ্ছে, তখন মার্কিন সরকারও হাওয়াই’য়িয়ে স্টীমশিপ রিফুয়েলিংয়ের সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে তার সামরিক তাৎপর্য বোঝা শুরু করে। পার্ল হারবারের জায়গাটি লীজ় নেয়ার প্রস্তাব দিলেও হাওয়াই’য়িয়ানদের আপত্তির কারণে রাজা লুনালিলো তাতে রাজি হন না। কিন্তু পরবর্তী রাজা কালাকাউয়া মার্কিনদের চাপে সেই লীজ় দিতে রাজি হন (১৮৮৭ সাল থেকে এর মেয়াদ শুরু হয়)। কালাকাউয়া তাঁর রাজ্যের সামরিক গুরুত্ব ভালভাবেই জানতেন, এবং ভয় করেছিলেন যে এই লীজ় না দিলে যুক্তরাষ্ট্র হাওয়াই’য়িকে জোরপূর্বক দখল করে নেবে। অবশ্য এর বিনিময়ে তিনি মার্কিন কংগ্রেসের কাছ থেকে কিছু অস্থায়ী বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন।

১৮৮৭তে কালাকাউয়ার বিরুদ্ধে তাঁরই ক্যাবিনেটের উগ্রপন্থী সদস্যরা বিদ্রোহ করে বসে। মার্কিন ইন্টেরিয়র মিনিস্টার থার্স্টন ইউরোপীয়, মার্কিন আর কিছু ধনাঢ্য নেটিভদের সমর্থন নিয়ে রাজাকে বাধ্য করে নতুন একটি শাসনতন্ত্র চালু করতে । আইন পরিবর্তন করে হাওয়াই’য়িয়ের বিদেশী নাগরিকদের ভোটাধিকার দেয়া হয়, আর ভোটাধিকারের জন্যে বার্ষিক ন্যুনতম ছয়শ ডলার আয়ের শর্ত আরোপিত হয়। এর ফলে হাওয়াই’য়িয়ের নেটিভদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়, আর প্রচুর ইউরোপীয়-মার্কিন বিদেশী হওয়া স্বত্ত্বেও সে অধিকার পায়। চীনা-জাপানী বংশোদ্ভূতদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়।

এ ঘটনার পরপরই রাজপরিবারের অসন্তুষ্ট কিছু সদস্য রাজাকে অপসারণের চেষ্টা করেন। কালাকাউয়ার বোন লিলি’উওকালানি আর তুতোভাই রবার্ট উইলকক্স এদের মধ্যে ছিলেন। কিন্তু সে বিদ্রোহের কথা আগেই ফাঁস হয়ে যায়, আর উইলকক্স নির্বাসনে যেতে বাধ্য হন।

১৮৯১এ কালাকাউয়ার মৃত্যু হলে রাণী হন লিলি’উওকালানি। লিলি’উওকালানি চেষ্টা করেন শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে নেটিভদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ফলস্বরূপ তার বিরুদ্ধে সেই একই থার্স্টন গ্রুপের ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। এবার তাদের লক্ষ্য হল সশস্ত্র কুএর মাধ্যমে লিলি’উওকালানিকে অপসারণ। মূল ষড়যন্ত্রকারীদের পাঁচজন ছিল মার্কিন, একজন ব্রিটিশ আর এক জার্মান।

১৮৯৪ সালের এই ডাকটিকেটটি স্বাধীন হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের, ১৮৯৮ সালে সার্বভৌমত্ব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছেড়ে দিয়ে পরিণত হয় তার একটি ‘টেরিটোরি’তে, যা স্টেটের থেকেও কম স্বাধীনতা রাখে। (ব্যক্তিগত সংগ্রহ)

কুয়ের পরিকল্পনার কথা হাওয়াই’য়িয়ের মার্কিন(!) পুলিশপ্রধানের কানে আসে। ষড়যন্ত্রকারীদের গ্রেপ্তারের ওয়ারেন্ট চাইলে মার্কিন(!) অ্যাটর্নি জেনারেল বারবার তা প্রত্যাখ্যান করেন। পুলিশপ্রধান রাণীর প্রতিরক্ষার জন্যে লোক জড়ো করা শুরু করেন।

কু ইতিমধ্যে শুরু হয়ে যায়, এবং লিলি’উওকালানির শত্রুরা তাদের সমর্থক ইউরোপীয়-মার্কিন-নেটিভদের সম্মিলিত সৈন্যদল নিয়ে তাঁকে রাজপ্রাসাদে গৃহবন্দী করে রাখে। মার্কিন সরকারের প্রতিনিধিও স্বদেশী নাগরিকদের রক্তপাতের আশংকায় আর জাপানের হস্তক্ষেপের ভয়ে বন্দরের জাহাজ থেকে মেরিন সেনাদের একটি দলকে শহরে ডেকে পাঠান।

এরকম হুমকির মুখে ব্যাপক রক্তপাতের আশংকায় লিলি’উওকালানি তাঁর অনুগত সৈন্যদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেন। দু’পক্ষে তারপরও কিছু নেটিভ আর মার্কিন মানুষ মারা যায়। অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সংযুক্ত হবার লক্ষ্যে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট গ্রভার ক্লীভল্যান্ড এই বিতর্কিত কাজটি করতে রাজি হলেন না। তাই তারা শেষ পর্যন্ত একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে। এরপর উইলকক্স ১৮৮৯এ সান ফ্রানসিস্কো থেকে গোপনে অস্ত্রভান্ডারসহ ফিরে এসে চেষ্টা করেন লিলি’উওকালানিকে পুনরোধিষ্ঠিত করতে। কিন্তু তাঁরা বিফল হন, উল্টো লিলি’উওকালানিকে ‘বিচার’ করে জেলে পুরে দেয় তাঁরই প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল

ক্লীভল্যান্ডের পরে প্রেসিডেন্ট হন ম্যাকিনলি । তাঁর নৈতিক বাছবিচার একটু কমই ছিল। তাছাড়া স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধে জয়ের পরে হঠাৎ করে মার্কিনদের হাতে এসে পড়ে প্যাসিফিকের ‘সিকম্যান’ স্পেইনের ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জ, কিউবা, গুয়াম, পোর্তো রিকো প্রভৃতি কলোনি। স্পেনের কলোনিগুলি হস্তগত করার সময় এতদিনের জর্জ ওয়াশিংটনের অ্যান্টিকলোনিয়ালিস্ট দর্শন বিস্মৃত হয় মার্কিনরাষ্ট্র!

অবশ্য এনিয়ে প্রচুর তর্কবিতর্ক হয়েছিল সেসময়। বিশেষ করে ডেমোক্রেটিক পার্টি চেষ্টা করে ম্যাকিনলির ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তিকে চেক দেবার। কিন্তু এ ছিল এক ভিন্ন জনমনস্তত্ত্বের সময়। সারা বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী রণসঙ্গীত চলছে। আর্মস রেস চলছে জার্মানি ও ব্রিটেনের মধ্যে । মরোক্কান ক্রাইসিস, আগাদির ক্রাইসিস ঘটে যাবে পরের দশকেই। অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের যবনিকা উঠল বলে। জাপানেরও আনাগোনা বেড়ে গেছে প্যাসিফিকে ১০। এসব মিলিটারিজম যুক্তরাষ্ট্রকেও প্রভাবিত করে।

তাই ফিলিপিন ইত্যাদিকে শুরুতে স্বাধীন প্রজাতন্ত্র করা হবে বললেও শেষ পর্যন্ত সেসব যুক্তরাষ্ট্রেরই রয়ে গেল। স্প্যানিশ-আমেরিকান যুদ্ধ শেষ হবার ঠিক এক মাস আগে ১৮৯৮এর জুলাইতে কংগ্রেস হাওয়াই’য়িকে টেরিটোরি হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত করার বিল পাশ করে দেয়, এবং ম্যাকিনলি তা স্বাক্ষর করেন।

এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পার্ল হারবারের স্বাক্ষী হয় হাওয়াই’য়ি। সে যুদ্ধে প্রচুর নেটিভ হাওয়াইয়ানও অংশ নেয়। ১৯৫৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশতম স্টেট হিসাবে হাওয়াই’য়িকে স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার। ১৯৯৩ সালে কংগ্রেস রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকার করে যে ১৮৯৩-৯৪এ হাওয়াই’য়িয়ের রাজসরকারের বিরুদ্ধে মার্কিনীদের অভ্যুত্থান ছিল বেআইনী, আর তার জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। ক্লিনটন সেই রেজল্যুশন স্বাক্ষর করেন।

ষাটের দশকে হাওয়াই’য়িয়ান ভাষাসংস্কৃতি পুনরুজ্জীবন পায়। স্ল্যাক-কী গীটার, স্টীল গীটার, উকুলেলে — এসব হাওয়াইয়ান বাদ্যযন্ত্রের সাথে সারা বিশ্ব এখন পরিচিত। হাওয়াই চপ্পল কে না চিনে! সার্ফিঙও হাওয়াই’য়িয়ান আবিষ্কার। কোনা দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র জায়গা যেখানে কফির চাষ হয়। লাইলো এন্ড স্টিচ, মোয়ানা, ইত্যাদি মুভিতেও হাওয়াই’য়িয়ের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। মাউনা কেয়া পর্বতের ওপর রয়েছে ভূবনবিখ্যাত টেলিস্কোপ অবজারভেটরি ১১

আর হাওয়াই’য়িতে গেলে কোন নেটিভ, কোন শ্বেতাঙ্গই গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণ করবে না আপনাকে। সবাই বলবে আলোহা! — যার অর্থ হতে পারে শুভ সকাল, কিন্তু এর আরো গভীরতা রয়েছে আন্তরিক ভালোবাসার অনুভূতির মধ্যে।

এসব দেখে অবশ্য লিলি’উওকালানি, উইলকক্স গর্ববোধ করতেন বলে মনে হয় না! কারণ, হাওয়াই’য়িয়ের জনসংখ্যার মোটে দশ শতাংশ আজ নেটিভ হাওয়াইয়ান। কিছু প্রভাবশালী নেটিভ হাওয়াইয়ান পরিবার থাকলেও আয় ও সম্পত্তির হিসাবে হাওয়াই’য়িয়ের জনপদগুলির মধ্যে তাদের দারিদ্র্যমাত্রা সর্বাধিক। অবশ্য হাওয়াই’য়িয়ের স্টেট সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার নেটিভ হাওয়াইয়ানদেরকে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অবস্থার উন্নতি করতে চেষ্টা করছে। এতে তারা লাভবান হবে নাকি আলস্যে নিপতিত হবে, তা সময়ই বলে দেবে।


(১) প্যাসিফিকের একপ্রান্ত ইন্দোনেশিয়া-ফিলিপিনস-পাপুয়া থেকে আরেক প্রান্ত সুদূর ঈস্টার আইল্যান্ড পর্যন্ত পলিনেশিয়ানদের ব্যাপ্তি। এমনকি তাইওয়ান আর মাদাগাস্কারের আদিবাসীদের সাথেও এদের ভাষাগত মিল রয়েছে। প্রায় তিন হাজার বছর আগে তারা বড় বড় ক্যানু নিয়ে প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যাকে পুঁজি করে প্রশান্ত মহাসাগরের বেশিরভাগ বাসযোগ্য দ্বীপ একে একে জয় করে ফেলে (মোয়ানা!)। নিউজিল্যান্ডের মাওরিরাও পলিনেশিয়ান। এদের সংস্কৃতি বেশ সমৃদ্ধ, আর যোদ্ধাজাত হিসাবে ইউরোপীয়দের কাছে ছিল সম্মানিত।কিছু গোত্র ছিল নরখেকো! [Polynesians]

(২) আখের রস থেকে সেন্ট্রিফ্যুজের মাধ্যমে চিনি আলাদা করার যান্ত্রিক প্রক্রিয়াও হাওয়াই’য়িবাসী এক মার্কিন আখচাষীর ঊর্বরমস্তিষ্কের ফসল। [Inventor David M. Weston]

(৩) এ শাসনতন্ত্র পরিচিত ‘বেয়োনেট কন্সটিট্যুশন’ হিসাবে কারণ জোরপূর্বক এটি হাওয়াই’য়িয়ের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। এসময় যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ঘটনার সাথে সরাসরি যুক্ত না থাকলেও তাদের মেরিন সেনাদল তৈরি রেখেছিল আর গুপ্তচর মারফত খবরাখবর সংগ্রহ করছিল। যদি মার্কিন সম্পদ ও জীবনহানির সম্ভাবনা দেখা দিত, তাহলে সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল তাদের লক্ষ্য। ১৮৮৭তে তারা তা করেনি, কিন্তু ১৮৯৩এ কিছুটা করে। [1887 Constitution of the Kingdom of Hawaii]

(৪) রবার্ট উইলকক্সের আরেক নাম আয়রন ডিউক অফ হাওয়াই। বিসমার্কের নাম ছিল আয়রন চ্যান্সেলর। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড একরোখা এই নেটিভ হাওয়াইয়ান! বিচার করে তাঁকে ফাঁসির রায় দিলেও লিলি’উওকালানির সিংহাসনের দাবি ছেড়ে দেয়ার শর্তে তিনি বেঁচে যান। পরে সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ ছেড়ে হাওয়াইয়ান টেরিটোরির সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে তাঁর লক্ষ্যগুলি বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। সে উদ্দেশ্যে হোমরুল পার্টি শুরু করেন এবং ১৯০১এ হাওয়াই’য়ি সেনেটে মেজোরিটি অর্জন করতেও সমর্থ হন, কিন্তু টেরিটোরির মার্কিন বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট ডোলের ভেটোর কারণে অনেক কিছু করতে পারেননি। একসময় তিনি নেটিভদের জনপ্রিয়তাও হারানো শুরু করেন। ১৯০৩এ তাঁর মৃত্যু হয়, কিন্তু সে পার্টি ও তার উত্তরসূরী দলগুলি এখন পর্যন্ত হাওয়াই’য়িয়ের স্বাধীনতা দাবি করে চলেছে — যদিও স্টেট সংসদে প্রতিনিধিত্ব পাবার মত ভোট এখন তারা পায় না। [Robert William Wilcox]

(৫) লিলি’উওকালানিকে বেশিদিন জেল খাটতে হয়নি।১৮৯৬ সালে তাঁর জন্যে ‘রাষ্ট্রীয় ক্ষমা’ ঘোষণা করা হয়। তিনি তারপর যুক্তরাষ্ট্রে সফর শুরু করেন, মূল লক্ষ্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় আর যুক্তরাষ্ট্রের সাথে হাওয়াই’য়ি প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্তি থামান। এতে প্রায় সফলও হয়েছিলেন, ১৮৯৭এ মার্কিন সেনেটে ম্যাকিনলির অ্যানেক্সেশনের প্রস্তাব প্রথমে প্রত্যাখ্যাত হয়। হাওয়াই’য়িয়ের পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে একটি ইতিহাসের বই লিখে রেখে যান লিলি’উওকালানি। তাছাড়া নেটিভ সঙ্গীত-সংস্কৃতিরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তিনি। [Liliʻuokalani]

(৬) ম্যাকিনলি ছিলেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট। তাঁর আমলে যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক বাণিজ্যে অত্যধিক কর আরোপিত হয়। অর্থনীতির অবস্থা বেশ ভাল হয়। ১৯০১ সালে এক পোলিশ বংশোদ্ভূত স্টীল মিলের শ্রমিকের গুলিতে তিনি নিহত হন। আততায়ীর উগ্র বামপন্থী দলের সাথে যোগাযোগ ছিল আর তার বিশ্বাস ছিল যুক্তরাষ্ট্র সরকার ধনাঢ্যদের সুবিধা দিয়ে খেটে খাওয়া মানুষদের সুবিধাবঞ্চিত করছে। ম্যাকিনলির পরে তাঁর পলিসিগুলিকে অব্যাহত রাখেন থিওডোর রোজাভেল্ট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে অবশ্য ‘কলোনিয়াল এম্পায়ার’ আর ‘ফরেন ওয়ারের’ বিরুদ্ধে জনমতের কারণে মার্কিন সরকার বিশ্ব থেকে আইজোলেশনিস্ট অবস্থান নেয়, এবং তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পার্ল হারবারের আক্রমণ পর্যন্ত চলে। [William McKinley]

(৭) মার্কিন ফাউন্ডিং ফাদাররা যে সহনশীলতা রক্ষা করে চলতেন অন্যান্য জাতের সাথে সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে, সেসবের উল্টোধারা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকে। বিশেষ করে ‘ম্যানিফেস্ট ডেস্টিনি’ নামে পরিচিত চিন্তাধারার মাধ্যমে আমেরিকার নেটিভ-অধ্যুষিত এলাকাগুলির ‘উন্নতি-প্রগতির’ স্বার্থে সেসবের সরকারী নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে জাস্টিফাই করা হ্য়। ফলস্বরূপ, প্রচুর ‘রেড ইন্ডিয়ান’ ট্রাইব যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তাদের প্রচুর নারী-শিশুও সেসবে প্রাণ হারায়, আর পূর্বপুরুষদের ভূমি হারিয়ে তারা রিজার্ভেশনে একরকম বন্দিজীবন শুরু করে। [Manifest destiny]

(৮) ব্রিটেনের সাথে নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের নৌশক্তি ও প্রযুক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে। ব্রিটেনের রাজা এডওয়ার্ডের ভাগ্নে ছিলেন জার্মান কাইজার ভিলহেল্ম। তারপরও স্ব-স্ব দেশের সামরিক এ প্রতিযোগিতা থামাতে তাঁরা ব্যর্থ হন। চার্চিল সেসময় নৌমন্ত্রী ছিলেন, তিনি যুদ্ধজাহাজগুলিকে কয়লার পরিবর্তে জ্বালানিতেল দিয়ে চালানোর সংস্কার করেন, কারণ জ্বালানিতেল অধিক কার্যক্ষম আর সাশ্রয়ী। এছাড়াও ড্রেডনট বলে নতুন একধরনের আরমার্ড যুদ্ধজাহাজও ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়। জার্মানিও নতুন ধরনের প্রযুক্তি দিয়ে আয়রনক্ল্যাড জাহাজ বানানো শুরু করে, আর খুব অল্প সময়ের মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে ব্রিটিশ নৌশক্তির দুই-তৃতীয়াংশ হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পিছনে এ ধরনের প্রতিযোগিতাও ছিল একটা কারণ। [Anglo-German naval arms race]

(৯) মরক্কোতে জার্মানি ও ফ্রান্সের মধ্যে দু’দুবার সম্মুখসংঘর্ষের সম্ভাবনা দেখা দেয়। প্রথমটা ১৯০৬এর মরক্কোসংকট নামে পরিচিত, দ্বিতীয়টা ১৯১১এর আগাদির সংকট। দুই ক্ষেত্রেই ফ্রান্স মরক্কোর ওপর তার ঔপনিবেশিক ‘অধিকারের’ বিরুদ্ধে জার্মানদের ‘আগ্রাসনের’ অজুহাত দিয়ে সৈন্য মোতায়েন করে। জার্মানিও গানবোট পাঠিয়ে সামরিক পেশী প্রদর্শন করে। দু’বারই ব্রিটেন ফ্রান্সের পক্ষ নেয়ায় জার্মানি বিফল হয়। কিন্তু জাতিগতভাবে আর দুই রাজপরিবারের রক্তসম্পর্কের বিচারে জার্মানরা ভেবেছিল ব্রিটেন তাদের পক্ষ নেবে। তা না হওয়ায় তারা অপমানিত বোধ করে, এবং শেষ পর্যন্ত ইউরোপের অন্য শক্তি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও তুরস্কের সাথে সামরিক মিত্রতার চুক্তি করে। এসব ‘গানবোট ডিপ্লোমেসি’ তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ড্রেস রিহার্সাল। [Moroccan Crisis]

(১০) মেইজি রিস্টোরেশনের সময় জাপানে সামন্ততন্ত্রের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা চালু হয় আর সম্রাটের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। পশ্চিমাদের দেখাদেখি সংসদীয় আইন প্রনয়ণ শুরু হয়। নৌশক্তি বাড়ানোর জন্যে বিপুল ‌অর্থ বরাদ্দ করা হয়। স্পেনের প্যাসিফিক কলোনিগুলির দিকে ম্যাকিনলির যেমন নজর ছিল, জাপানেরও ছিল। ম্যাকিনলি আগেই সে লক্ষ্য অর্জন করতে সমর্থ হন। জাপান তখন চীন-কোরিয়া-রাশিয়ার দুর্বলতার দিকে মনোনিবেশ করে। ১৮৯৪এ চীনের সাথে যুদ্ধে জিতে তার করদ রাজ্য কোরিয়ার দখল নেয়, আর ১৯০৫এ রুশদেরকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়ে পশ্চিমাবিশ্বকে স্তব্ধ করে দেয়। রুশদের এ পরাজয়ের ফলে নিকোলাসের বিরুদ্ধে প্রথম বিপ্লব দেখা দেয় রাশিয়াতে। এ ছিল ১৯১৭এর বলশেভিক বিপ্লবের ড্রেস রিহার্সাল। [History of the Imperial Japanese Navy (1882-1893)]

(১১) মাউনা কেয়া একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। হাওয়াইয়ানদের প্রাচীন ধর্মানুসারে পবিত্রভূমি, দেবতাদের আবাস। তাই এখনো টেলিস্কোপ স্থাপনার বিরুদ্ধে নেটিভরা প্রতিবাদ করে। টেলিস্কোপগুলি অবশ্য বৈজ্ঞানিক অনেক সত্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে বিশাল অবদান রেখেছে। [Mauna Kea]

তান্নু তুভা

আজ যে দেশটির ডাকটিকেট দেখাচ্ছি ত্রিশ দশকের ম্যাপসহ, তার স্বাধীন অস্তিত্ব আর নেই। ১৯২১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নামমাত্র স্বাধীন দেশটির নাম তুভা।

১৯৩৬ সালের তুভার এই ডাকটিকেটে দেখা যাচ্ছে রেলের সাথে উটের দৌড়। প্রকৃতপক্ষে তুভায় কোন রেললাইন ছিল না। তুভার ‘উন্নয়নের’ মিথ্যে প্রচারনার উদাহরণ এ ডাকটিকেট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

মোঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার মাঝে স্যান্ডইউচ দেশটি এখন রাশিয়ার একটি স্টেট। ১৯১১ পর্যন্ত এটি চীনের চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য মোঙ্গোলিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার অনেকগুলি স্বাধীন রাজ্যকে ‘কলোনাইজ’ করে। তাদের মধ্যে রয়েছে কাজ়াখ়, বুখা়রা, খ়িভ়া, কোকন্দ প্রভৃতি খা়নাত আর তুর্কমেন-কিরগিজ় যাযাবরদের একাধিক গোত্র। এর আগেই অবশ্য ষোড়শ শতকে ইভ়ান দ্য টেরিবলের সময় সাইবেরিয়ার সিবির খা়নাতকে বশ করার মাধ্যমে মস্কোর ছোট্ট স্লাভিক রাজত্বটি রুশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

উপরের দেশগুলি যখন স্বাধীন ছিল, তখন সভ্যদেশে ডাকটিকেটের প্রচলন থাকলেও এরা অনগ্রসর মধ্যযুগীয় রাজ্য হওয়ায় টিকেট ছাড়ত না। তাই রুশ ‘কলোনাইজেশনের’ প্রমাণ হিসাবে সেসব জাহির করতে পারছি না। কাছাকাছি যেটা পড়ে, সেটা এই তুভার স্ট্যাম্প। কলোনাইজেশনের ফর্মুলাটা বলছি। এর সাথে ১৮৩৬এ টেক্সাসের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হবার ফর্মুলার মিল আছে — বেমিলও আছে।

তুভায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই রুশ বণিক, র‍্যাঞ্চার, আর শিকারীরা চিং সাম্রাজ্যের ফরমান নিয়েই আনাগোনা করত। তারা বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফার্ম গড়ে তোলে। শিকারীরা সেখানকার লোমশ জানোয়ার মেরে তাদের ফার নিয়ে বেঁচতো রাশিয়ার বনেদী পরিবারগুলির কাছে।

১৯১১তে চীনের মানুষ চিং সাম্রাজ্যের উপর যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ ছিল। বিদেশীদের কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া ছিল তাদের অসন্তুষ্টির মূল কারণ (বক্সার বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০১)। ফলে চিংদের বিরুদ্ধে শিনহাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়, প্রতিবাদের মুখে ‘বিধবা-সম্রাজ্ঞীর’ হাতের পুতুল ছয়বছরবয়েসী পুত্র সম্রাট পু-য়ী রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেন । পরিশেষে সুন-ইয়াত-সেনের নেতৃত্বে চীনা জাতীয়তাবাদী দল কোমিনতাং প্রভিশনাল প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করে।

ত্রিশ দশকের এই মানচিত্রে তুভার অবস্থান দেখানো হয়েছে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

১৯১১তে চীনের এই দুর্বলতার সুযোগে মোঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এসময় মোঙ্গোলদের মত তুভার জনগণও অনেকটা হাভাতে জীবনযাপন করছিল। একটা কারণ রুশ ফারশিকারীদের অতিশিকারের কারণে তাদের অন্নসংস্থান কমে যাওয়া, তার ওপর অজন্মা খরা। একদল তুভান নেতা চাইলো মোঙ্গোলিয়ার সাথে যোগ দিতে, আরেকদল চাইলো রুশদের ‘প্রোটেকশন’। কারণ মোঙ্গোলদের থেকে তাদের তুর্কীজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন, শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মে দু’জাত মিলে।

রুশ সম্রাট নিকোলাস প্রথমে মনোস্থির করতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত রুশ কলোনিস্ট আর ট্রেডারদের চাপে অজুহাত দাঁড়া করালেন যে তুভায় রুশদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, আর তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাঁর সেনাবাহিনীর। রুশ সেনাদল প্রথমে একটা ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করলো রুশপন্থী তুভানদের, পরে সে প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার অংশ হয়ে গেল।

এখানেই কাহিনী শেষ নয়। ১৯১৭তে রুশ সাম্রাজ্যের বহুদিনের নড়বড়ে ভিত ভেঙে পড়ল বলশেভিক বিপ্লবের আঘাতে। মস্কো-পেত্রোগ্রাদসহ অল্পকিছু শহরে কম্যুনিস্টরা সরকারের দখল নিলেও প্রাদেশিক অঞ্চলগুলি ৎসারপন্থী ‘শ্বেত রুশ’ জেনারেলদের দখলে ছিল। সেসব অঞ্চলে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত স্বাধীন সরকার গঠন করা শুরু করে

সেই রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে ১৯১৮তে তুভা প্রথমে দখল করে এক শ্বেতফৌজ জেনারেল কোলচাক। কিন্তু এক বছর পরেই তুভার দখল চলে যায় চীনা ও মোঙ্গোল সেনাদলের কাছে। কম্যুনিস্ট লালফৌজ ধীরে ধীরে যখন শ্বেতরুশদের হারিয়ে দেয়া শুরু করে, তখন তারা ১৯২১এ তুভায় ঢুকে চীনাদের হটিয়ে দেয়। আর তুভার বলশেভিক কমরেডদেরকে দিয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় — তুভান পিপলস রিপাবলিক

তান্নু-তুভা নামে নতুন ‘স্বাধীন’ দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মোঙ্গোলিয়া। ছোট দেশটি এত সুদূর আর বিচ্ছিন্ন যে তারা স্বাধীন না পরাধীন নাকি পাপেট, তাতে বাকি বিশ্বের কিছু যেত-আসত না। কিন্তু তুভা ডাকটিকেট ইস্যু করত। আর সেগুলিও ছিল নানা রঙের, আর ত্রিভুজ, প্যারালেলোগ্রাম, ডায়মন্ড, ইত্যাদি অদ্ভূত আকারের। তাই যখন বহির্বিশ্বের মানুষের হাতে এসে পড়ত, সবাই তখন আহা-উহু করত

তুভার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কু’লার দোন্দুকের মাথায় স্বাধীন চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া অবশ্য রুশরা থামাতে পারেনি। প্রাক্তন বৌদ্ধ শ্রমণ সেই রাষ্ট্রনায়ক চেষ্টা করেন মোঙ্গোলিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে, আর বৌদ্ধ ধর্ম ও লামাদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। সমাজতান্ত্রিক পলিসিকেও পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করেন তিনি।

১৯২৬এ দোন্দুক বৌদ্ধ ধর্মকে যখন রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তখন স্তালিনের টনক নড়ল। মস্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ তুভান ছাত্রকে দেশে ফেরত পাঠালেন। তারা তুভায় এসে ‘জনসংগ্রাম’ সংগঠিত করতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ১৯২৯এ কু’র মাধ্যমে দোন্দুককে অপসারণ করা হয়। পাঁচ জনে মিলে সোভিয়েত স্টাইল সরকার দাড়া করায়। জোরপূর্বক যৌথখামারব্যবস্থা চালু করে; মোঙ্গোল বর্ণমালা উচ্ছেদ করে প্রথমে লাতিন ও পরে সিরিলিক অক্ষরের ব্যবহার চালু করে ; রুশদের নাগরিকত্বপ্রদান শুরু করে; আর বৌদ্ধ ধর্মের লামা আর প্রাচীন ধর্মের শামানদের জেলে পোরা শুরু করে। ১৯৩২ সালে দোন্দুককে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

উপরের স্ট্যাম্পটি তার পরবর্তী সময়ের। ১৯৩৬ সালের। বাইরের মানুষ যদিও ভাবত এসব ডাকটিকেট তুভা থেকে প্রকাশিত, তারপরও পারতপক্ষে এগুলি তুভার আলোবাতাস আদৌ পেয়েছে কিনা সন্দেহ! কারণ এগুলি প্রিন্ট করা হয়েছে মস্কোর অফিশাল সোভিয়েত প্রেসে! হয়ত কিছু তুভাতে পাঠানো হয়েছে — তুভার মত বিস্তীর্ণ কম জনধ্যুষিত দেশে সেগুলির কি ব্যবহার ছিল স্তালিনই বলতে পারতেন ভাল! কিন্তু বাকি বিশ্বের ফিলাটেলিস্টদের কাছে এসব স্ট্যাম্প বিকোত বেশ, আর তার থেকে দু’পয়সা কামাই করে নিত সোভিয়েতরা (তখনও তারা সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠেনি)।

এ ডাকটিকেটে দেখানো হচ্ছে যে রেলগাড়ির সাথে রেইস দিচ্ছে ব্যাক্ট্রিয়ান ঊট। ভাবখানা এমন যে, তুভায় এতই প্রগতির বন্যা বইছে যে ঊটকে নিজের চাকরি বহাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে!

বাস্তবতা হলো, তুভাতে সে আমলে কোন রেললাইনই ছিল না, আর এই একবিংশ শতকেও নেই!

তুভাকে অবশ্য বেশিদিন এই ড্রামার ভিক্টিম হতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে স্তালিন যখন ১৯৪৪এর অক্টোবরে জার্মান বাহিনীকে সাঁড়াশি অভিযান করে ইউক্রেইন, বেলারুশ, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া থেকে উৎখাত করছেন, আর একে একে এ দেশগুলিকে ‘এসএসআর’ নাম দিয়ে ‘মুক্ত’ করে দিচ্ছেন, আর তারা বেজায় খুশি হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছে, তখন কোন এক সকালে উঠে তুভাবাসী দেখে তারাও কোন ফাঁকে ‘এসএসআর’ নয়, রুশ এসএসআরের ‘ওব্লাস্ত’ (প্রদেশ) হয়ে গেছে! তাদের সংসদ ‘খুরালে’ কোন ভোটাভুটি ছাড়াই রাবারস্ট্যাম্প মেরে রাশিয়ার কাছে যা স্বাধীনতা ছিল — স্ট্যাম্প ইস্যু করার অধিকারসহ — দেশনেতারা বেঁচে দিয়েছে!

আজ তুভা রুশ ফেডারেশনের ৮৫টি ফেডারেল সাবজেক্ট, যার মধ্যে ২২টি রিপাবলিক, তাদের একটি রিপাবলিক। এখনো দেশটি বিচ্ছিন্ন, প্রত্যন্ত। রেললাইন একটা চালু হবার কথা ২০২০ সালে।

তুভানদের সংস্কৃতি, বিশেষ করে মোঙ্গোলদের মত থ্রোট সিঙ্গিং
, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ মনোযোগ কেড়েছে। সেটা শোনার জন্য ইউটিউবে হুন-হুর-তু (Huun Huur Tuu) কিংবা কোঙ্গার-ওল ওন্দার (Kongar-ol Ondar) খুঁজে দেখুন


(১) খা়নাত হলো ‘খা়ন’শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য। এরা মুসলিমও হতে পারে, বৌদ্ধও হতে পারে, শামানও হতে পারে। খা়ন শব্দটি মূলে তুর্কী-মোঙ্গোল, আরবী নয়। চেঙ্গিস খা়ন মুসলিম ছিলেন না! [Khanate]

(২) এখানে অবশ্য পু-য়ীর কাহিনী শেষ না, আবার তাঁকে দেখা যাবে জাপানের পাপেট স্টেট মাঞ্চুরিয়ার নামমাত্র ‘সম্রাট’ হিসাবে! [Henry Puyi]

(৩) বিভিন্ন শ্বেতফৌজ জেনারেলও রাশিয়ার সাম্রাজ্যের কোন না কোন এলাকায় ৎসার নিকোলাসকে রাজা মেনে স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ডাকটিকেট ছাড়ত, সেগুলি বেশ চমকপ্রদ আইটেম! [White Movement]

(৪) মোঙ্গোলিয়াতেও লালফৌজের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় গঠিত হয় কম্যুনিস্ট সরকার। সোভিয়েত রাশিয়া বাদে তাই মোঙ্গোলিয়া একটি মাত্র দেশ যেখান সাত দশক কম্যুনিজম চলেছে। [Mongolian People’s Republic]

(৫) পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানও তান্নু-তুভার পোস্টেজ স্ট্যাম্প দেখে খুবই শখ করেছিলেন সেখানে যাবার। কিন্তু মার্কিনদের জন্যে সোভিয়েতের সুদূর একটি অঞ্চলে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়, বিশেষ করে যখন সোভিয়েতদের পর্যটনশিল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের প্রগতিশীলতা জাহির করা, তুভার মত প্রত্যন্ত পশ্চাদপর সমাজব্যবস্থা দেখালে উল্টোফল। ১৯৮৮ সালে ফেইনম্যানের স্বপ্ন পুরো হবার আগেই তিনি ক্যান্সারে মারা যান। তার ঠিক পরপরই তার তুভা যাবার ভিসা হাজির হয়। [Tuva or Bust!]

(৬)কামাল আতাতুর্কের তুর্কী-আরবী থেকে লাতিনে যাবার মত। খোলস পাল্টে কিছু একটার চেহারা পরিবর্তনই ছিল এসকল ‘রিফর্মার’দের প্রগতিশীলতার উদাহরণ। এতে সামাজিক বাস্তবতার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। [Turkish Alphabet Reform]

(৭) সোভেতস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া রেসপুবলিকা — এ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নামেমাত্র স্বতন্ত্র ১৫টি প্রজাতন্ত্রের গালভরা অফিশাল নাম, সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক। [Republics of the Soviet Union]

(৮) থ্রোট সিঙ্গিং এক অদ্ভূত ‘এলিয়েন’ টাইপের গান, ফুসফুস থেকে গলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা চেম্বারের রেজোন্যান্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে আওয়াজ তুলতে পারলে মনে হয় যে একই মানুষ দুই বা ততোধিক টোনের শব্দ করছে! একে ওভারটোন সিঙ্গিংও বলে। তিব্বতী বৌদ্ধ শ্রমণরাও এভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে। মোঙ্গলদের পাশাপাশি তুভান আর আরো কিছু পূর্ব সাইবেরীয় গোত্রের এ ঐতিহ্য রয়েছে। [Overtone Singing]

(৯) টেড-এক্সের একটা তুভান থ্রোট সিঙ্গিং ভিডিও [Tuvan Throat Singing | Alash | TEDxBaltimore]

ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস

১৯১৪ সালে সার্বিয়া নামের ছোট্ট, কিন্তু দাম্ভিক, স্লাভিক জাতীয়তাবাদী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যৌথ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসে। আর তার ফলে শুরুতে ইউরোপ, পরে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় কলোনিগুলি, আর শেষে নব্যপরাশক্তি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র, জড়িয়ে পড়ে সাড়ে তিন বছর দীর্ঘ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)।

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে এথনিক-লিংগুইস্টিক জাতীয়তাবাদ ছিল বেশ জনপ্রিয়। এর ফলশ্রুতিতে ছোট-মাঝারি কয়েকটি রাজ্য নিয়ে উত্তরে ও দক্ষিণে দু’টি নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা হয় — বিসমার্কের জার্মানি (১৮৭১) ও গারিবাল্দির ইতালি (১৮৬১)।

ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি বামপন্থী অ্যানার্কিজ়ম, বিপ্লবী কম্যুনিজ়মও যে জনপ্রিয় হচ্ছিল বলা বাহুল্য। পুরনো সাম্রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে তাদেরও সফল ও বিফল উত্থান ঘটে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে (বলশেভিক বিপ্লব, ১৯১৭; সোভিয়েত হাঙ্গেরি, ১৯১৯; জার্মানির স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ, ১৯১৯)। আর জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মুলত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া ভেঙ্গে নতুন কয়েকটি দেশ ইউরোপের মানচিত্রে স্থান পায় (চেকোস্লোভাকিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া)।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের রাজপরিবারগুলি নাপোলেওনের সময়কার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (১৮০৩-১৮১৫) এড়ানোর জন্যে একে অন্যের সাথে সামরিক সমঝোতা চুক্তি করা শুরু করে। নানা চুক্তির জালের বুনটে সংরক্ষিত হয় ছোট রাজ্যগুলির নিরাপত্তা, স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স, ইত্যাদি। তার ওপর রাজপরিবারগুলি একে অন্যের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে আরেক লেভেলের ‘নিরাপত্তা’ তৈরি করে। যেমন, রুশ ৎসার নিকোলাস ছিলেন ব্রিটিশরাজ পঞ্চম জর্জের আপন খালাত ভাই, তাঁদের ছবি দেখলে তাঁদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এধরনের ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচিত ছিল ‘ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস’ বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামানো তো দূরের কথা, এ ব্যবস্থা একদিক থেকে দায়ী ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির জন্যে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ অনেক গভীর, একটি কারণ জার্মানির উচ্চাকাংক্ষা। উডরো উইলসনের ভাষায় “ব্রিটেন হ্যাজ় দ্য আর্থ, এন্ড জার্মানি ওয়ান্টস ইট।” এটুকু কথার পিছনে অনেক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। শিল্পায়ন যুগের শেষভাগে কাঁচামাল আর বাজারের জন্যে প্রতিযোগিতা, বাণিজ্যিক ও সামরিক সাম্রাজ্য গড়ার প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। সে চিত্রে জার্মানি ছিল লেইটকামার। শেষে এসেও যুদ্ধবিগ্রহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়া ছিল জার্মান শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এধরনের “রেয়ালপলিটিক” (“বাস্তবতাভিত্তিক কূটনীতি”) জার্মানির রূপকার বিসমার্কেরই সিগনেচার কৌশল। এর সফলতার কারণেই প্রুশিয়া নামক সামরিক রাষ্ট্র থেকে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয় (১৮৭১-১৯১৯)।

অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তার যথেষ্ট বারুদ তৈরি ছিল।

আর সে বারুদে যে স্ফূলিঙ্গটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে, তা হলো বসনিয়ায় সার্ব আততায়ীর হাতে ডাকটিকেটে দেখানো অস্ট্রীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়ার মৃত্যু (জুন ২৪, ১৯১৪)।

১৯১৭ সালে বসনিয়ায় অস্ট্রীয় সামরিকবাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রকাশিত এই ডাকটিকেটে স্মরণ করা হয়েছে ১৯১৪ সালে সার্ব আততায়ীর হাতে নিহত আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়াকে — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের যুবরাজ হবার কথা ছিল না। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রক্ষণশীল সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের একমাত্র পুত্র রুডল্ফ ত্রিশ বছর বয়সে পরকীয়া প্রেমের সূত্র ধরে প্রেমিকার সাথে আত্মহত্যা করেন ১৮৮৯ সালে। সেসময় নাকি তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই কার্ল লুডভ়িগ হন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ১৮৯৬ সালে তাঁরও মৃত্যু হয় — প্যালেস্টাইনের ‘পবিত্র’ জর্দান নদীর নোংরা পানি খেয়ে টাইফয়েডে ভুগে। তখন তাঁরই ছেলে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ওপর যুবরাজ হবার গুরুদায়িত্ব বর্তায়।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সেকারণে অনেক দেরিতে রাজশাসনের উপযোগী শিক্ষালাভ শুরু করেন। বৃদ্ধ সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের সাথেও ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। ‘বুড়ো ভামকে’ অতিরিক্ত রক্ষণশীল ভাবতেন তিনি। বিয়েও করেন রাজপরিবারের ঐতিহ্যের বাইরে। তাতে সম্রাট সায় দেন শুধুমাত্র একটি শর্তে, যে বিয়েটি হবে ‘মর্গানিটিক’। অর্থাৎ রাজকার্য, উপাধি, ইত্যাদিতে সোফিয়া আর তাঁর ছেলেমেয়েদের কোন দাবি থাকবে না। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড মারা গেলে তাঁর বংশধরের পরিবর্তে সম্রাট হবেন ফ্রানৎস ইয়োসেফের আরেক ভাতিজা কার্ল।

শিকারপাগল ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ১৮৯২-৯৩এর ভারতভ্রমণের সময়কার ছবি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

জার্মানির সমস্যা ছিল তার শাসকগোষ্ঠীর জার্মান-জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সমস্যা ছিল তার উল্টো। জাতিগতভাবে জার্মান, আর ধর্মে ক্যাথলিক, হাবসবুর্গ গোষ্ঠীর সম্রাটরা কয়েক শতাব্দী ধরে সার্ব, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান, চেক, স্লোভাক, ইউক্রেনিয়ান, রোমানিয়ান, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইত্যাদি নানা ভাষা ও জাতের প্রজাদেরকে শক্ত হাতে শাসন করে চলছিল। ১৮৪৮ সালে সে ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসে হাঙ্গেরির মাগিয়ার জাতিগোষ্ঠীর বিপ্লবের মাধ্যমে। অস্ট্রিয়ার শাসকরা রাজি হন সাম্রাজ্যকে দু’টি সমকক্ষ রাজত্বে ভাগ করে একভাগের শাসনভার মাগিয়ারদের দিতে, অবশ্য রাজা-সম্রাট থাকবেন একই হাবসবুর্গ উত্তরসূরী।

এতে সমস্যার তেমন কোন সমাধান হয়নি। কারণ মাগিয়াররা আরো ক্ষমতাবান হয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। অপরদিকে অস্ট্রীয় জার্মানরাও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে প্রাক্তন তুর্কী প্রদেশ বসনিয়া-হারজেগোভিনাকে হস্তগত করে তাকে ‘প্রতিরক্ষার’ নামে (বসনিয়া-হারজেগোভিনা প্রটেক্টোরেট, ১৮৭৮)।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে প্রদেশে ভাগ করে কিভাবে ফেডারেল পদ্ধতিতে শাসন করা সম্ভব, ১৯০৬এ তার একটা প্রস্তাবনা করেছিলেন এক রোমানিয়ান বুদ্ধিজীবী আউরেল পপভিৎস। ফরাসী ভাষার মানচিত্রে এই বৃহত্তর অস্ট্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক বিভাগ দেখানো হয়েছে। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসব কারণে জার্মান-মাগিয়ার বাদে বাকি সকল এথনিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে স্লাভরা, যারপরনাই অসন্তুষ্ট ছিল। আর দু-দু’টো বল্কান যুদ্ধে ‘ইউরোপের সিক ম্যান’ তুরস্ককে পরাজিত করে সার্বিয়া-বুলগেরিয়ার মত দেশগুলি সে এলাকার সামরিক পরাশক্তিগুলির মাঝে যথোপযুক্ত স্থান করে নেয়। সার্বিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হলো আরেক ‘সিকম্যান’ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর ‘নিষ্পেষিত’ স্লাভিক জনগোষ্ঠীদের ‘মুক্ত’ করে উত্তরের তুতো ভাই রুশদের মত দক্ষিণেও সর্ব-স্লাভিক দেশ ‘ইউগোস্লাভিয়া’ কায়েম করা। সে লক্ষ্যে বসনিয়ার সার্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীদের (বা সন্ত্রাসবাদীদের) গোপনে রসদ সরবরাহ করে সার্বিয়া। সংগঠিত হয় ইয়ং বসনিয়া আর ব্ল্যাক হ্যান্ডের মত গুপ্তদল।

১৯১৪ সালের ২৪শে জুন ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সস্ত্রীক বসনিয়ার সারায়েভো পরিদর্শনে আসেন। সকালেই তাঁর মোটর শোভাযাত্রার ওপর পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা করে ইয়ং বসনিয়ার এক সদস্য। সে যাত্রা বেঁচে যান অস্ট্রিয়ার যুবরাজ, শুধু পিছনের গাড়ির কয়েকজন আহত হয়। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড গভর্নরের প্রাসাদে পৌঁছে বেশ হম্বিতম্বি করেন, তারপর দুঃসাহস দেখিয়ে দিনের বাকি কর্মসূচীপালনের জন্যে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিছু বিভ্রান্তির কারণে গাড়িবহর পথে বিলম্বিত হয়। ভাগ্যের ফেরে সেপথের পাশেই এক কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিল গাভ্রিলো প্রিন্সিপ বলে ইয়ং বসনিয়ার আরেক সদস্য। সকালের বিফল সাথীর কার্যসিদ্ধি করবে কি করবে না সে নিয়ে দোনমনা করতে করতেই গাভ্রিলো কাফে থেকে বের হয়ে সাথে থাকা রিভলভার দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড আর সোফিয়াকে গুলি করে বসে। যথোপযুক্ত পরিচর্যা সাথে সাথে না পাওয়ায় দু’জনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপরে সূচনা হয় ১৯১৪এর জুলাই সংকট — অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি কঠিন শর্তের আল্টিমেটাম দেয় সার্বিয়াকে। আক্রান্ত হলে সার্বিয়াকে তাদের তুতোভাই রুশরা সাহায্য করবে, এ ভরসায় সার্বরা আল্টিমেটামকে পাশ কাটিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। রুশরা ঠিকই আসে সার্বদের সাহায্যে। জার্মানিও আরো সাম্রাজ্যের লোভে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আর রুশদের মিত্র, ত্রিপল-অঁতঁতের অপর দুই দেশ ব্রিটেন-ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তুরস্কও অক্ষশক্তির সাথে যোগ দেয় এই ভেবে যে রুশ আর স্লাভদের কাছে খোঁয়া যাওয়া আগের সাম্রাজ্য পুনরোদ্ধার হবে।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের মৃত্যুতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো, এ ভাগ্যের পরিহাস! কারণ, ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যে জার্মান-মাগিয়ারদের একাধিপত্য খর্ব করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সমাধিকার দেয়ার ব্যাপারে উদারপন্থী ছিলেন। তাতে নিজের সর্বময় ক্ষমতা অবশ্য অটুট রাখতে পিছপা ছিলেন না। বেঁচে থাকলে আর রাজসিংহাসনে বসলে হয়ত কোন না কোন উপায়ে নিজ রাজ্যের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করতেন।

এখানে আরেকটা তুলনা উল্লেখযোগ্য। ওসমানি তুরস্ক আর হাবসবুর্গ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি — এ দুটি দেশের সমস্যাগুলি একই রকম ছিল। দুটোতেই সম্রাট সর্বেসর্বা — সংসদ নামেমাত্র। তাছাড়াও অস্ট্রিয়ার কাইজ়ার একই সাথে হোলি রোমান এম্পেরর — অর্থাৎ ক্যাথলিককূলের ধ্বজাধারী রক্ষক। তুরস্কের সুলতানও সেরকম নমিনাল ‘আমিরুল মুমিনীন’ — তাবৎ মুসলিমদের ঈমানের রক্ষক। দুটো দেশেই ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম আরব-তুর্কী-আর্মানী-ফার্সী চেক-স্লোভাক-ক্রোয়েশীয়-পোলিশ ইত্যাদি নানা জাতি ও ভাষার জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। দুটোই ছিল একরকম ‘সিক ম্যান’ — অর্থাৎ সামরিক প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীলতার বিচারে পশ্চাদপর। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দুটো দেশই টুকরো টুকরো হয় যায়।

তফাত হলো, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টুকরোগুলি দেশে পরিণত হয় তাদের জাতিস্বত্ত্বার ইচ্ছানুযায়ী। সেসব আত্মসমর্পণের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও উডরো উইলসন জড়িত ছিলেন, যাঁর মূল লক্ষ্য ছিল যেন সেসব নতুন দেশে কোন না কোন ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিছুটা সফলও হয়েছিল সে উদ্দেশ্য, চেকোস্লোভাকিয়া ভাল উদাহরণ। আবার উল্টোদিকে ইউগোস্লাভিয়ায় গণতন্ত্রের বদলে সার্বীয় রাজার ৎসারতন্ত্র কায়েম হয়।

তুরস্কের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে মার্কিনদের আসন ছিল না। তুরস্কের জাতিস্বত্ত্বাগুলির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বদলে বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমত ম্যাপ কাটাকুটি করে ভাগ করে নেয়। যার ফলে সিরিয়া ও ইরাকের মত দুটি ‘আর্টিফিশিয়াল’ দেশের উদ্ভব ঘটে, যার প্রজাদের জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। এখানেই কিন্তু তাদের পরবর্তী দুর্ভোগের বীজের বপন। সাথে কুর্দিস্তান-সৌদি-প্যালেস্টাইন-লিবিয়া ইত্যাদিরও ভাগ্যলিখন চূড়ান্ত হয়ে যায়। (সাইকস-পিকো অ্যাগ্রিমেন্ট, ১৯১৬)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এত কিছু লেখার জন্যে শুরুতে বসিনি। চেয়েছিলাম আমার সংগ্রহের ঐ ডাকটিকেটটা জাহির করে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের গল্প বলতে। কান টানতে মাথা চলে এল!


পুনশ্চ: চিন্তা করে দেখলাম সাইকস-পিকোকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দোষ বলা যায় কিনা। মনে হয় যায়। কারণ, সিরিয়া-ইরাকের যেসকল সমস্যা, সেসকল সমস্যা ইউগোস্লাভ জনপদগুলিরও ছিল, আর তাদেরও কপালে একই লিখন ছিল (নব্বই দশকের একাধিক যুদ্ধ ও প্রচুর পৈশাচিকতা ও লোকক্ষয়)। ইউগোস্লাভিয়া সেসকল তুর্কী সমস্যা ইনহেরিট করেছিল, গ্রীক-আলবেনীয়দের প্রচুর পকেট ছিল তাদের রাজ্যে যাদের তেমন কোন অধিকার স্লাভরা দেয়নি। অর্থাৎ সমস্যা একই — সাইকস-পিকো ছাড়াই।

আর ইউরোপের জাতিগোষ্ঠীগুলির জাতীয়তাবাদের কারণে তাদের ইতিমধ্যে স্বদেশের মানচিত্রের ধারণা ছিল। ইরাক-সিরিয়ার আলাউয়ী, শিয়া, সুন্নি, দ্রুজ, ইয়াজিদি, তুর্কমেন, এদের জাতীয়তাবাদের তেমন কোন ধারণাই ছিল না — আরব, আর্মনী আর কুর্দ বাদ দিলে। তাদের জনপদগুলিও ছিল ছড়ানো-ছিটানো, আলাদা করে অর্থবহ ভৌগোলিক ম্যাপ আঁকা মনে হয় না সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে যখন জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে একেক জনপদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তখন থেকেই অধুনাযুগের টেনশনগুলির শুরু।

অর্থাৎ সেসময়ের নিরিখে হয়ত সাইকস-পিকো ছিল আরব স্বদেশভূমির একটি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ঔপনিবেশিক, সমাধান। আর তা না হলেও সাইকস-পিকোর সাধ্যি ছিল না এত কিছু বুঝে (বা না বুঝে) ভবিষ্যদ্দর্শনের।

(আর সাইকস-পিকোর আরেক পার্টনর ছিল রুশরা, পরবর্তী বলশেভিক সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাইকস-পিকোর হাড়ি হাঁটে ভেঙে দেয়।)

[Sykes–Picot Agreement]


close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!