ইউ পম গানা?

Featured Video Play Icon

“ইউ পম গানা?” মনে আছে নিশ্চয় অনন্ত জলিলের সেই ইন্টারভিউটার কথা? ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিংবা ‌অবচেতন মন থেকে হোক, জলিল সাহেব হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে বাঙ্গালীর বর্ণবাদী মানসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন।

বাঙ্গালী কতটা-কেন কৃষ্ণাঙ্গদের নিচুচোখে দেখে — সেটা নিয়ে বিতর্ক-গবেষণার অবকাশ আছে। হয়ত সুলতানি আমলে হাবশি ক্রীতদাসদের কূটচালে রাজা হওয়া দেখে প্রাথমিক খারাপ ধারণাটা তৈরি হয়েছে। তারপরে সম্ভবত ব্রিটিশ শাসকদের মাংকি-সী-মাংকি-ডু করে আফ্রিকানরা নিম্নগোত্রীয়, এই বিশ্বাসটা প্রগাঢ় হয়েছে। দ্য গডস্ মাস্ট বি ক্রেজ়ির মত ছবি আমার ছোটবেলায় সেই বিরূপ ধারণা ভাঙতে খুব একটা সাহায্য করেনি। (এর বিপরীতে অবশ্য ছিল কিং সলোমন’স মাইনসএর মত রোমাঞ্চকর উপন্যাস!)

আজকের ট্র্যাকটা পছন্দ করলাম বাঙ্গালী স্টেরেওটাইপিংটাকে যদি কিছুটা নড়বড়ে করে দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্যে। গানের কণ্ঠশিল্পী ভ়িও ফ়ার্কা তুরে মালির অধিবাসী। বাবা আলি ফ়ার্কা তুরেও ছিলেন বিশ্বখ্যাত মিউজিশিয়ান। বিশ্বের কাছে মালির ট্র্যাডিশন্যাল গানবাজনাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পিছনে তুরে সিনিয়র আর সিদকি ও তুমানি দিয়াবাতে বলে পিতা-পুত্র ‘কোরা’-বাদকের অনেক অবদান আছে।

যারা মার্কিন ব্লুজ় শুনেছেন, বিশেষ করে জন লী হুকারের গান, তারা এটা শোনামাত্রই বুঝবেন কতটা মিল! এর কারণ পশ্চিম আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সাথে এই ধরনের সঙ্গীত আমেরিকায় আসে। তাদের সুরগুলি গীটারের জন্যে খুবই মানানসই ছিল। নতুন দেশে নিজেদের ভাষা-ধর্ম হারিয়ে ফেললেও তারা সঙ্গীতকে হারায়নি।

এ ঐতিহ্য পশ্চিম আফ্রিকায় এক-দুই শতাব্দীর পুরনো নয়, কমপক্ষে আড়াই হাজার বছর ধরে তারা সভ্যতার সাথে পরিচিত। মালির জেন্নে শহরে ৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের নগরসভ্যতার ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এ সভ্যতা অন্যান্য সভ্যতার মত নদীতীরে গড়ে উঠেছিল; সে নদীর নাম নিঝ়ের বা নাইজার — যার নামে নিঝ়ের ও নাইজেরিয়া দেশদু’টির নাম। আরবরা এই নদীর ডাকনাম দিয়েছিল ‘কৃষ্ণাঙ্গদের নীলনদ’।

অনন্ত জলিল যে গানা দেশটার নাম আমাদের কাছে সুপরিচিত করলেন, সেটা আসলে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী জুড়ে বিরাজমান একটা শক্তিশালী সাম্রাজ্যের নাম। ব্রিটিশ ঔপনেবিশকতা থেকে সর্বপ্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত আফ্রিকার স্বর্ণসমৃদ্ধ দেশটির নাম গোল্ড কোস্ট থেকে পরিবর্তন করে রাখা হয় গানা। অষ্টম শতকে আরবরা উত্তর আফ্রিকাবিজয়ের পরে তাদের বাণিজ্যের কাফেলা সাহারার দক্ষিণেও বিস্তৃত হয়েছিল। গানা সাম্রাজ্যের শহরগুলি এ সময় ছিল সোনা-লবণ রপ্তানির মূল কেন্দ্র। গানার শাসকরা পরে ইসলামগ্রহণ করে নিজেদের রাজবংশকে আরো বৈধতা দেয়। তা হলেও অনেক প্রাক-ইসলামিক নিয়ম রয়ে গেছিল। যেমন মাতৃবংশীয় উত্তরাধিকার ব্যবস্থা, যে কারণে এক রাজার পরের রাজা হত তার ভাগ্নে, ছেলে নয়!

গানা সাম্রাজ্যের অধঃপতনের পরে সেখানে অভ্যুদয় ঘটে মালি বা মান্দে সাম্রাজ্যের। দ্বাদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর এ রাজ্য সমৃদ্ধির শিখরে ছিল মোঙ্গলদের পরেই সেসময়ের সবচে’ বিস্তৃত সাম্রাজ্য। ইবনে খালদুন-ইবনে বতুতা মালি ভ্রমণের সময় তাদের বিপুল সামরিক লোকবল দেখে যেমন অভিভূত হয়েছিলেন, তেমনি অবাক হয়েছিলেন নারীপুরুষের একত্রে ওঠাবসা দেখে। মালির এক রাজা, বা মান্সা, মুসা কেইতা হজ্জ্বে গিয়েছিলেন বিশাল দলবল আর প্রচুর সোনা নিয়ে। তিনি যাত্রাপথে যেখানেই থেমেছেন সেখানেই বিলাসদ্রব্য কিনতে, এমনকি ভিক্ষা দিতেও, সোনা ব্যয় করেছিলেন। তাতে তখনকার পৃথিবীর সোনার সাপ্লাই রাতারাতি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ায় বারো বছর ধরে নাকি সোনা অবমূল্যায়িত ছিল! মধ্যযুগীয় ইউরোপীয়রাও এই কাহিনী অবগত ছিল, তাই তাদের তৈরি মানচিত্রে তিম্বাক্তু শহরের অবস্থান দেখানো শুরু হয়।

মালি সাম্রাজ্য স্থাপত্যশৈলী আর জ্ঞানবিজ্ঞানেও এগিয়ে ছিল। তাদের তৈরি অসাধারণ মসজিদ-মাদ্রাসা-মিনারগুলি এখনো তিম্বাক্তু, গাও শহরে দেখা যায়। সাঙ্কারে বলে এক মাদ্রাসায় গোটা বিশ্ব থেকে মনীষীরা আসতেন জ্ঞান আদান-প্রদানের জন্যে। মিশরের প্রাচীন আলেকজ়ান্দ্রিয়া লাইব্রেরির সাথে টেক্কা মারার মত পান্ডুলিপির সংগ্রহ ছিল সেখানে।

মালি সাম্রাজ্যের অবনতির কারণ ছিল তাদের শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ, যেটার সুযোগ নিয়ে পড়শী সঙায় সাম্রাজ্য তাদেরকে পরাজিত করে। সেই যুদ্ধে মালির শাসকরা নব্য পরাশক্তি পর্তুগীজদের সাহায্য চেয়েছিল। জেনে হয়ত অবাক হবেন যে ইউরোপীয়রা সাম্রাজ্যবিস্তারের সুযোগটা তখন নেয়নি, তারা এটাকে মালির আভ্যন্তরীণ সমস্যা ভেবে পাশ কাটিয়ে গেছিল। অবশ্য সমুদ্রউপকূলে পর্তুগীজদের কেল্লা ছিল, সেসব থেকে তারা ইউরোপে ক্রীতদাস রপ্তানি করত। তাদেরকে লোক্যাল সাপ্লাই দিত কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ দালালরাই!

মালির পরে সঙায় সাম্রাজ্য বেশিদিন টেকেনি। পর্তুগীজ নয়, মরক্কোর সুলতানের পাঠানো সেনাবাহিনীর গোলন্দাজদের কাছে তারা হার মানে। সেই পরাজয়ের পরে গোটা সাম্রাজ্য ভেঙে অসংখ্য টুকরো হয়ে যায়, যারা নিজেদের মধ্যে অনেক যুদ্ধবিগ্রহ করে। ঊনবিংশ শতকে ফরাসীরা এদেরকে বশে এনে উপনিবেশ বানায়। তারপর ষাটের দশকে একে একে অনেকগুলি দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। গানা, সেনেগাল, গাম্বিয়া, মরিতানিয়া, গিনি, গিনি-বিসাউ, বুরকিনা ফাসো, নাইজেরিয়া, নিঝ়ের — এদের সকলেই গানা-মালি-সঙায়দের প্রাচীন ঐতিহ্যের দাবিদার।

‘পম গানা?’ প্রশ্নের উত্তর একটু লম্বা-চওড়া হয়ে গেল, অতএব ক্ষান্ত হলাম!
***

[সাফারে গানটার বিষয়বস্তু অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেও বের করতে পারিনি। ফরাসী কোন ওয়েবসাইটেও লিরিক-ট্রান্সলেশন নেই। ইচ্ছে ছিল এ‌ই গানটার বদলে আলি ফ়ার্কা তুরের ‘আল্লা উইয়া’ গানটা শেয়ার করার, কিন্তু সেটার কোন লাইভ পারফর্ম্যান্স পেলাম না। লাইভে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার যেভাবে দেখা যায়, স্টুডিও রেকর্ডিংয়ে সেটা সম্ভব নয়। আগ্রহী হলে এখানে শুনুন ‘আল্লা উইয়া’।]

‘ডিকেন্জিয়ান ডিস্টোপিয়া’

Featured Video Play Icon

আজকের গানটা ১৯৬৮ সালের ব্রিটিশ মিউজিক্যাল ‘অলিভার!’ থেকে। মনে হয় ৯২-৯৩এর দিকে এটা বিটিভিতে পরিবেশিত হয়েছিল। চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ‘অলিভার টুইস্ট’ পড়ার আগেই এটা দেখেছিলাম। আর গানগুলির কথা না বুঝেই গল্পটা আর সুরগুলি খুব মনে ধরেছিল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অনেক খুঁজে ডিভিডি সংগ্রহ করি।

এটা সেলেক্ট করার কারণ মোটামুটি একটা ধারণা দেয়া, ঊনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কেমনতর ছিল। ডিকেন্স এ কাহিনী লিখেন ১৮৩৭এ। রাণী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের বছর সেটা। যুক্তরাজ্য সাম্রাজ্যের উচ্চতম শিখরে তখন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না, কথাটা এই সময়েই চালু হয়; কারণ তাদের কোন না কোন উপনিবেশে যখন সূর্য অস্তগামী, অন্য কোনটাতে তখন সূর্যোদয়। ভারতে ১৮৫৭র সিপাহি বিদ্রোহের পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানিকে সরিয়ে সম্রাজ্ঞী হিসাবে সরাসরি শাসনক্ষমতা হাতে তুলে নেন ভিক্টোরিয়া।

আমরা ভাবতে পারি যে এসময় ভারতসহ ব্রিটিশ কলোনিগুলিকে শোষণ করে ব্রিটেনের আপামর জনসাধারণ বিপুল সমৃদ্ধি ‌অর্জন করেছিল। বাস্তবতা এই সরল সত্যের থেকে জটিলতর! ভিক্টোরিয়ান যুগ যেমন ব্রিটিশ আভিজাত্যের নাক-উঁচু এটিকেটের জন্যে পরিচিত, ঠিক ততটা পরিচিত ‘ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়া’ হিসাবে! ডিকেন্সের আবাসস্থল লন্ডনে তখন শিল্পবিপ্লবের হাওয়া লেগেছে। শহরের বায়ু ভারি, আকাশ কালো — কয়লা পুড়িয়ে ফ্যাক্টরি-রেল চালানোর ধোঁয়ায়।

সে শহরের নিম্নবিত্ত আর উঠতি মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ছিল সেরকম নিম্নমানের। তাদের পোশাকআশাক ছেঁড়া, তাপ্পিমারা, ধূলিধূসরিত, বে-সাইজের। যাদের ভাগ্যে খাদ্য-পানীয় নিয়মিত জুটত, তাও ছিল অস্বাস্থ্যকর আর নোংরা। অনেকে থাকত পরিত্যক্ত বাড়িতে বস্তি করে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর যারা অসুস্থ হয়ে পড়ত, তাদের ডাক্তার পাঠাত সমুদ্রতীরের বিশুদ্ধ বায়ু সেবনের জন্যে। কর্মস্থলে দুর্ঘটনা আর ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় প্লেগ-মহামারি ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। সরকারি নিয়মকানুনও অতটা চটপটে হয়ে উঠেনি যে দ্রুত পতনমুখী জীবনযাত্রার মান আর উচ্চগামী আয়বৈষম্যকে আয়ত্তে আনবে।

এই দৃশ্যে দেখবেন এতিম অলিভার কপালের ফেরে ফেগিন নামে এক পকেটমার সর্দারের আস্তানায় এসে পড়েছে। ডিকেন্সের নিজের ছোটবেলার একটা ছায়া আছে অলিভারের মধ্যে। তাঁর ১২ বছর বয়সে তাঁর বাবাকে জেল খাটতে হয় অপরিশোধিত ঋণের কারণে। তখন পরিবারের ঘানি টানতে স্কুল ছেড়ে ফ্যাক্টরিতে কাজে যেতে হয় ডিকেন্সকে।

এই গানটিতে অলিভার ভাবছে ফেগিনদের লন্ড্রির ব্যবসা, কারণ একটা ধ্বংসপ্রায় বাড়িতে তাদের গোপন আখড়ায় অনেকগুলি সিল্কের রুমাল শুকাতে দেয়া হয়েছে। নিষ্পাপ-সরল অলিভারকে খেলাচ্ছলে ফেগিন আর তার বালক সাঙ্গপাঙ্গরা বুঝাচ্ছে কিভাবে পকেট কাটতে হয়। সে দৃশ্যে ফেগিন সেজেছে অভিজাত উচ্চবিত্ত ব্রিটিশ — কিছুটা কমিক তার সেই ভোল, কারণ উচ্চবিত্তের এটিকেট থাকলে কী হবে, সত্যিকার অর্থে তারাও ছিল লোভী-হিংসুক গোছের! অলিভারকে শিখাতে ফেগিনকে বোকা বানিয়ে আর্টফুল ডজার আর তার দোস্তরা সমানে মাল সরিয়ে চলেছে!

ডিকেন্স ছিলেন মানবচরিত্রের ভাল পর্যবেক্ষক, আর জটিল ক্যারিকেচার তৈরির বিশেষজ্ঞ। তাঁর কাহিনীগুলির কোন ক্যারেক্টারই সোজাসাপ্টা খারাপ বা ভাল ছিল না — সাদাও নয়, কালোও নয়, ধূসর। যেমন এই মুভির ফেগিন চরিত্রটা — সে লোভাতুর বটে, কিন্তু সে যে সেটা করছে পেটের দায়ে! বুড়ো বয়েসে তাকে দেখার কেউ নেই, এসব চিন্তায়। আর বালকবয়সী চামচাদের সে বাবা না হলেও গার্জেনের মত, আগলে রাখার মত কিছুটা দায়িত্ববোধ আছে।

ভিক্টোরিয়ান সমাজে এত শ্রেণীবিভেদ, এত অসমতা থাকা সত্ত্বেও সোশ্যাল মোবিলিটি ছিল। ডিকেন্সের ক্যারেক্টারগুলি কখনো কখনো সৌভাগ্যবানও হত। বাস্তবেও যারা সুযোগসন্ধানী ছিল, তারা খোদ ব্রিটেনে না পারলেও জাহাজের খালাসী হিসাবে আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে, নয়ত ভারতে — যেখানে ভদ্রলোকে যেতে চাইত না — সেখানে সেনা-নৌ অফিসার হিসাবে গিয়ে রাতারাতি একটা কূলকিনারা করে ফেলতে পারত। তারপর বাড়ি ফিরে জমিজমা কিনে, ব্যবসা বানিয়ে ভবিষ্যতটা আরেকটু পাকাপোক্ত করে ফেলত।

শেষ করি একটা কন্ট্রাস্ট দেখিয়ে। সোশ্যালিজম-কম্যুনিজমের পিতৃদেব কার্ল মার্ক্সও ১৮৫০ থেকে ১৮৬০ অব্দি লন্ডনে ছিলেন। ডিকেন্জ়িয়ান ডিস্টোপিয়ার প্রতক্ষদর্শী তিনিও। তাঁর ১৮৬৭তে লেখা ‘ডাস কাপিটাল’এ ব্যাখ্যা করেছেন শ্রমিকশ্রেণীর ওপর পুঁজিবাদী শোষণের পদ্ধতি, আর সেই শ্রেণীবিষম সিস্টেম ভাঙার লক্ষ্যে প্রলেতারিয়ান বিপ্লবের ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। কিন্তু সেই বিপ্লব ব্রিটেনে হয়নি। হয়েছিল শিল্পবিপ্লবে পিছিয়ে থাকা ইউরোপের সবচে’ কৃষিপ্রধান দেশ রাশিয়াতে, যেখানে তা হবারই কথা নয়, তাও আরো ৫০ বছর পরে। মার্ক্সের থিওরি নানা প্যাঁচঘোঁচ মেরে তৈরি হলেও অনেক ক্ষেত্রেই ‌অতিরিক্ত সিম্প্লিস্টিক ছিল, তাই ভুলও ছিল। হয়ত বৈষম্য নিয়ে অভিযোগ করে আর গলা হাঁকড়িয়ে নিম্নবিত্তগোষ্ঠীর ‘সায়েন্টিফিক প্রফেট’ হওয়াটাই ছিল তাঁর মূল উদ্দেশ্য!

সেখানে কিন্তু ডিকেন্স শুধু উপন্যাস-বই লিখেই দমে থাকেননি। রাজনীতিতে সরাসরি যোগ না দিয়েও লেখনী দিয়ে সংগ্রাম করেছেন। সিস্টেমের মধ্যে থেকেই সিস্টেমটার উৎকর্ষসাধন করেছেন। খাদ্য-পানীয় আর শিশুশ্রম সংক্রান্ত অনেক মানবিক আইন তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর অক্লান্ত অ্যাকটিভিজমের কারণেই হয়। অনেকগুলি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠাতেও তিনি সহায়তা করেন। সেসব কর্মকান্ডের সুফল তাঁর পরবর্তীপ্রজন্ম এখনো ভোগ করছে। তাঁর ভাষায়, ‘দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হেড, অ্যান্ড… দেয়ার ইজ় এ উইজ়ডম অফ দ্য হার্ট!’ উচিত কথা!

(এখানে পাবেন গানটির কথা।)

শুকনো পাতার নুপূর পায়ে…

Featured Video Play Icon

নিচের গানটির সুর বাঙ্গালী সবারই জানার কথা। বিদ্রোহী কবি নজরুলের ‘ত্রিভূবনের প্রিয় মোহাম্মদ’ আর ‘শুকনো পাতার নুপূর পায়ে’ গান দু’টি একই সুরে বাঁধা। কিন্তু কাতালান কন্ডাক্টর জোর্ডি সাভালের হেসপেরিওন অনসম্বলের এই পারফরম্যান্সে সেই সুরটার সাথে যে ভাষাগুলিতে গান গাওয়া হচ্ছে, সেটা বাংলা নয় — তুর্কী, আরবী, হিব্রু, গ্রীক, আর লাদিনো!

এধরনের ভৌগোলিকসীমাহীন জনপ্রিয় সুরকে মিউজিকোলজিস্টরা ডাকনাম দিয়েছে ওয়ান্ডারিং মেলোডীজ — যাযাবর সুর। উপরের ভাষাগুলি ছাড়াও সার্বিয়ান, বসনিয়ান, বুলগেরিয়ান, রোমানিয়ান, ম্যাসিডোনিয়ান, আর্মেনিয়ান ভাষার গানেও এই সুর ব্যবহার হয়েছে। মার্কিন জ্যাজ় শিল্পী আর্থা কিটও পঞ্চাশের দশকে গানটা গেয়েছিলেন।

সুদূর নিকট-প্রাচ্য থেকে এই সুরটা বাংলা গানে আনা নজরুলের কৃতিত্ব। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির হাবিলদার হিসাবে তিনি ১৯১৭ থেকে ১৯২০ করাচি সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু প্রাচ্যের যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়া হয়নি তাঁর। তাও কোন না কোনভাবে সুরটি তাঁর সামনে এইসময়ই এসে পড়ে ধারণা করলে মনে হয় না খুব একটা ভুল করব।

গানটার বিষয়বস্তুও এক ভাষা থেকে আরেক ভাষাতে গিয়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। হিব্রুতে সেটা প্রার্থনাগীতি, গ্রীক, লাদিনো আর আরবীতে সেটা প্রেমের গান বা চপলা কিশোরীর স্তুতি; আবার আর্মেনিয়ান-বুলগেরিয়ানে দেশাত্মবোধক। ওসমানলি সাম্রাজ্যের সময় লেখা মূল তুর্কী গানটার কথা পড়লে মনে হবে, তরুণী গায়িকা তার সুদর্শন ‘কতিব’ বা কেরানির সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে। বেচারার লেজওয়ালা কোট জলেকাঁদায় নোংরা হয়ে গেছে বলে তার বিমর্ষবদন দেখে তরুণী পুলকিত বোধ করছে।

আজকের নব্য ওসমানলি জাতীয়তাবাদীরা হয়ত আপনাকে বুঝ দিবে যে, মূল তুর্কী গানটারও উদ্দেশ্য প্রেমনিবেদন, আর তুর্কীদেশ সেসময় মুসলিম সাম্রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও সেদেশে সমসাময়িক পশ্চিমাদেশের তুলনায় নারীস্বাধীনতা বেশি ছিল। কিন্তু ইতিহাস ঘাঁটলে বুঝবেন তা আসলে নয়! ওসমানলি সাম্রাজ্যে কেবল হারেমের মেয়েরা আর রাজমাতারাই ছিলেন ক্ষমতাবান নারী, সাধারণ মেয়েদের অধিকার ছিল পুরুষের অর্ধেক।

‘কতিবিম’ নামে মূল গানটার আসল উদ্দেশ্য ছিল ঊনবিংশ শতকে সুলতান প্রথম আব্দুল মজিদের চাপিয়ে দেয়া সংস্কারকে নিয়ে বিদ্রূপ করা। ১৮৫০এর দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রুশদের আগ্রাসনের মুখে ইউরোপের ‘সিক ম্যান’ তুরস্ককে ইংরেজ, ফরাসী আর সার্ডিনিয়ানরা সহায়তা করে। রুশরা সেযুদ্ধে পরাজিত হয়, আর পশ্চিমাদের অনুকরণে সুলতান তুরস্কে তানজ়িমাত বলে একটা সংস্কার চালু করেন। অন্যান্য অনেক প্রগতিশীল নীতির সাথে সাথে নিয়ম করে রাজকর্মচারীদের পোশাকও পরিবর্তন করে কোট-প্যান্টালুন করা হয়। ঐতিহ্যবাহী ঢোলা জামাকাপড়ে অভ্যস্ত রক্ষণশীল তুর্কীরা সেটা পছন্দ করেনি। তাই এরকম বিদ্রূপাত্মক গান চালু হয়ে গেল, যেন কমবয়েসী মেয়েরা পর্যন্ত সরকারি কেরানিদের পরনের কাপড় নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করছে!

তুর্কী জনগণের অসন্তুষ্টির মুখে তানজ়িমাত সংস্কার বেশিদিন চলতে পারেনি। আব্দুল মজিদের মৃত্যুর পনেরো বছর পরে আবার যেমনকার তেমন। তবে কিছু জিনিস টিকে গিয়েছিল। যেমন, সাম্রাজ্যে ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম-দ্রুজ আরব-তুর্কী-আর্মেনিয়ান নানাগোত্রের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার জন্যে তাদের ওসমানলি দেশভিত্তিক জাতীয়তাবাদী পরিচয়টাকে ভাষা-জাতি-ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের থেকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। নাগরিকত্ব আর সম্পত্তি মালিকানা আইনেও কিছুটা সমাধিকার আনা হয়। (ইতিহাসবিদরা বলবেন, ১৮৮০র দিকে রাশিয়া থেকে তাড়িয়ে দেয়া রুশ ইহুদীরা সেসব আইনের ব্যবহার করে প্যালেস্টাইন প্রদেশে জমি কেনা শুরু করে।) বহুজাতিক দেশ হিসাবে কিছুটা হলেও গ্রহণযোগ্যতা পায় ওসমানলি রাষ্ট্র, সেজন্যেই হয়ত তাদের প্রাক্তন প্রদেশগুলিতে এধরনের তুর্কী সুরসংস্কৃতি এখনো প্রচলিত। শুধু সেসময়ের সাধারণ তুর্কীরা এরকম ইনক্লুজিভিটি পছন্দ করেনি, বিদ্রূপ করেছে।

ইতিহাস যাই হোক না কেন, সুরটা যে ‌অনেক দেশের অনেক ভাষার মানুষের হৃদয়জয় করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এ এক জলজ্যান্ত প্রমাণ যে, ধর্ম-ভাষা-জাত-বর্ণের ওপর সুরসঙ্গীত মনুষ্যত্বের মৌলিক সার্বজনীন পরিচয়গুলির একটি!

***

[পারফর্মারদের গুরুগম্ভীর ভাব দেখে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, তাঁরা রেনেসাঁস বারোক সঙ্গীতের বিশেষজ্ঞ বিধায় বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের ভোল ধরেছেন! ঘুমপাড়ানি লাদিনো গানের মহিলাকণ্ঠ রেকর্ডেড, জোর্ডি সাভালের প্রয়াত স্ত্রী মন্টসেরাত ফিগেরাসের।]

কাতিউশার বিশ্বযুদ্ধ

Featured Video Play Icon

রাশিয়া আর পুতিন নানা কারণে আজকাল হেডলাইন নিউজ। রুশ ইতিহাস-সাহিত্য-সংক্রান্ত বইপত্র পড়ে আর ডকুমেন্টারি দেখে যেটা বুঝি, সেটা হল রুশ জনগণের একটা সামগ্রিক কালচারাল ম্যাসোকিস্ট সাবকনশাস সেন্টিমেন্ট আছে, যেটা তাদেরকে শ্বেত-লোহিত সকল প্রকার ৎসারদের দাসত্বশৃংখল মেনে নিতে প্রবৃত্ত করে (শ্বেত=রোমানভ সম্রাট, লোহিত=কমিউনিস্ট ডিক্টেটর)। রুশবিপ্লব সত্যিকারের অর্থে জনবিপ্লব ছিল না, ছিল মূলত পাওয়ার ভ্যাকুয়ামের সুযোগ নেয়া ক্যু!


আমার মনে হয়, সাধারণ রুশরা একটু সাদাসিধা টাইপ। তাদের দুর্ভাগ্য তাদের ঘাড়ে কেবল চতুর-ধূর্ত ডিক্টেটররাই চাপে। অথবা খারাপ সময়ে খারাপের এত চরম সীমায় তারা পৌঁছায়, যেখানে তাদের মনে হয় বিশৃংখলার চেয়ে অত্যাচারী শক্ত হাতও ভাল।


নিচের গানটার সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলার এমন একটা সময়ে, যখন সমাজতন্ত্র আর সাম্যবাদ আমাকে টানত। মার্ক্স-এঙ্গেলসের দুর্বোধ্য পুস্তক পড়ে তখন ধনতন্ত্র খারাপ, এই সরল কথাটাই খালি বুঝতাম। পরে অর্থনীতি-সমাজবিজ্ঞান-ইতিহাসের আরো সুবোধ্য বই-পুস্তক পড়ে বুঝেছি যে, সেই দুর্বোধ্যতার উদ্দেশ্য অনেকাংশে মার্ক্সের মেডিয়োক্রিটিকে ঢাকা। যেমনটা ছাইপাঁশ টেকনিক্যাল পেপারের জার্গন!


কাতিউশা নামের এই গানটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লেখা-গাওয়া, এখনো পপুলার। দেশাত্মবোধক এ গণসঙ্গীতের সুর বিপ্লবী ধাঁচের মনে হলেও, এতে বিপ্লবের ব-ও নেই, সুরটাও ফোক্। এতে কাব্যিক ভাষায় বর্ণিত হয়েছে সুদূর যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধরত প্রেমিকের জন্যে কাতিউশা নামের এক তরুণীর ভালবাসার স্বীকারোক্তি।


বিশ্বযুদ্ধের আগের রুশ দেশাত্মবোধক গানগুলি বিপ্লবী হোয়াইটওয়াশে সয়লাব থাকলেও, যু্দ্ধের সময় স্তালিনগোষ্ঠীকে নিজেদের চামড়া বাঁচাতে জনগণের চেতনানিয়ন্ত্রণে কিছুটা ছাড় দিতে হয়েছিল — আমার মনে হয় এ গানটা তার একটা নমুনা, তাই এখনো জনপ্রিয়। যুদ্ধপূর্বযুগে স্তালিনের বিভিন্ন জোর করে চাপিয়ে দেয়া নিয়মের ফলে দুর্ভিক্ষে-লেবার ক্যাম্পে দু’কোটি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। তিরিশের দশকের ইউক্রেনে সোভিয়েত সরকারের তৈরি দুর্ভিক্ষের দিনগুলিকে হলোকস্টের মত বলে হলোদোমোর (যে কারণে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা নাৎসিদের হাতে হাত মিলিয়ে রাজাকারি করেছিল)।


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন নাৎসি আগ্রাসনের ফলেও বিপুল প্রাণহানি-ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, তার অনেকটা তাদের পোড়ামাটি স্ট্র্যাটেজির কারণে। সোভিয়েত সাধারণ জনগণও প্রাণ বাঁচাতে আর প্রতিশোধ নিতে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ইউরোপীয় যুদ্ধের ম্যানু্য়ালের প্রথম নিয়মটা ভেঙ্গে হিটলার নাপোলেওনের মত ভালমত ফেঁসে গেছিলেন — নিয়মটা হলো, নেভার এভার মার্চ অন মস্কো! অপরদিকে, জার্মানি দখলের সময় প্রতিশোধপরায়ণ রুশ সেনারাও সমানে সাধারণ জার্মানদের ওপর হত্যা-ধর্ষণ-লুটতরাজ চালায়।


গানের সাথে যে ভিডিওটা জোড়া লাগানো, সেটা একটা সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা ফিল্ম থেকে নেয়া। শুরুর ফ্রেমের তিন সেনার মাঝখানের জন সম্ভবত ফিল্ড মার্শাল ঝ়ুকভ — টি-৩৪ ট্যাংক আর ‘কাতিউশা’ নামেরই ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্রের সফল ব্যবহার করে জার্মানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের অন্যতম মহানায়ক। স্তালিনের বিরুদ্ধমতে অন্য কেউ কথা বলার সাহস না পেলেও ঝ়ুকভ বলতেন। জার্মানিবিজয়ের সময় রুশ সৈন্যদের প্রতি তিনি বলেছিলেন, নাৎসিবাদকে ঘৃণা করো, কিন্তু জার্মান জনতাকে নয়। পশ্চিমা সেনানায়ক মন্টগোমারি-আইজেনহাওয়ারের সাথেও তাঁর বহুদিন বন্ধুত্ব ছিল। যুদ্ধের পরে স্তালিন নিজের গদি অটুট রাখার জন্যে ঝ়ুকভকে সুদূর উরালে পাঠিয়ে দেন, যাতে রাজনীতিতে অংশ নিতে না পারেন। কমিউনিজমের পতনের পরে পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির মানুষ লেনিন-স্তালিনের মূর্তি ভূপাতিত করলেও ঝ়ুকভকে সরায়নি।


ভিডিওটিতে আরো দেখবেন যে ফ্যাক্টরিতে বাচ্চারা-মেয়েরা কাজ করছে। সোভিয়েতসহ পশ্চিমা দেশগুলিতে ছেলেরা সবাই যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার ফলে মেয়েদের ঘরকন্নাসহ চাকরিবাকরিও করতে হয়েছে। পশ্চিমাদেশে নারীস্বাধীনতা আন্দোলন এ সময়েই হালে পানি পাওয়া শুরু করে। রুশদেশে ততটা নয়।


ভিডিওর শেষে কাতিউশা নামের রকেট লঞ্চার থেকে রকেট উৎক্ষেপণের দৃশ্য শব্দসহ দেখানো হয়েছে। আর্টিলারি হিসেবে এই অস্ত্র ছিল খুবই কার্যকর, কারণ খুব দ্রুত অনেকগুলি রকেট ছুঁড়ে শত্রুর মনে ত্রাস সৃষ্টি করতো এটা। যদিও এদের টিপসই নির্ভুল ছিল না।


গানটা গেয়েছে আলেক্সান্দ্রভ রেড আর্মি কয়ের বলে একটা দল। ১৯২৯ সালে কমিউনিস্ট শাসনামলে দলটির যাত্রা শুরু, মূল লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাশিয়ার সাংস্কৃতিক মুখপাত্র হিসাবে কাজ করা। পূর্ব জার্মানিতে যুদ্ধের পরে একটা পীস কনসার্ট করেও বেশ জনপ্রিয় হয়। ৯০এর দশকে কমিউনিজমের পতনের পরেও টিকে ছিল। ২০১৬র ২৫শে ডিসেম্বরে সিরিয়ায় একটা ক্রিসমাস পারফরম্যান্স করে ফেরার পথে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিমান দুর্ঘটনায় দলটির ৬৪জন সদস্য প্রাণ হারায়।

(এখানে গানটির কথা ও মানে।)

সাহারার তুয়ারেগ

Featured Video Play Icon

উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরোক্কো — এই দেশগুলিকে আমরা জানি আরব-অধ্যুষিত হিসাবে। কিন্তু এই এলাকার আদিবাসীরা আরব নয়, কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানও নয়। গ্রীক-রোমান-যুগ থেকে তাদেরকে ভিনদেশীরা চেনে ‘বেরবের’ নামে; যদিও তারা নিজেদের বলে ‘আমাজ়িগ’ — যার অর্থ মুক্ত মানুষ। এখন মূলত আরবী বা ফরাসীতে কথা বললেও উপরের দেশগুলির একটা বড় জনসংখ্যা বেরবের।


জ়িনেদিন জ়িদানের বাবা-মা আলজেরিয়ার কাবিল উপজাতির আমাজ়িগ। মরোক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতাও ছিলেন আমাজ়িগ বংশোদ্ভূত। খ্রীষ্টান সেন্ট অগাস্টিনও তাই। রোমসম্রাট সেপ্টিমিয়াস সেভেরাসের ধমনীতেও ছিল বেরবের বংশধারার রক্ত। রোমের সৈন্যদলের একটা অংশও একসময় ছিল বেরবের মাউরি যোদ্ধাদের দিয়ে তৈরি, যাদের নাম থেকে পরে মুর বা মোরো শব্দটা এসেছে।


তারিক ইবনে জ়িয়াদ ছিলেন আরব-বিজিত ইফ্রিক্বিয়া (এখনকার তিউনিসিয়ায়) প্রদেশের গভর্নর মুসা ইবনে নুসাইরের ক্রীতদাস। জ়ানাতি বেরবের বংশে তার জন্ম, তাঁকে মুক্তিদানের পরে অষ্টম শতকে আরব-বেরবের সৈন্যদল নিয়ে উমাইয়্যা খলিফাদের হয়ে স্পেনবিজয় করেন। তার নামেই জিব্রাল্টার (জাবাল-আল-তারিক)।


স্পেনের দ্বাদশ শতাব্দীর রাজবংশ আলমোহাদ-আলমুরাবিতরা ছিল আরবীকৃত বেরবের। এসময় স্পেনের জামিয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ইউরোপীয়রা দর্শন-বিজ্ঞানের শিক্ষা পেয়েছে মাইমোনিডিস-ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের মত মনীষীদের লেখা পড়ে। আলহামরা প্রাসাদের মুরিশ শিল্পশৈলী বেরবের-আরবদের যৌথ অবদান। আরব-বেরবের রান্নাও বিশ্বখ্যাত, যেকোন মরোক্কান রেঁস্তোরাতে সেটা আস্বাদন করতে পারবেন।


উমাইয়্যা আরব শাসনের সময় এই মুক্ত জনগোষ্ঠীর ওপর জোর করে আরবী কৃষ্টি আর অনারব দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব ও কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকে ফরাসী-ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকগোষ্ঠী চাপিয়েছে ইউরোপীয় ভাষা-সংস্কৃতি। প্রতিবারই তারা বিদ্রোহ করেছে।


নিচের গানটা তু্য়ারেগ নামে আমাজ়িগদের একটা বড় উপজাতির শিল্পীদের গাওয়া, সাথে মার্কিন ব্লুজ মিশানো, মালির কৃষ্ণাঙ্গ ঘরানারও প্রভাব আছে। দলটার নাম তিনারিওয়েন, গানের ভাষা তামাশেক। তুয়ারেগদের বাস আলজেরিয়া, লিবিয়া, মরিতানিয়া, মালি, নিঝ়ের, বুরকিনা ফাসোর দেশসীমাবিহীন সাহেল নামে সাহারা মরুভূমির পশ্চিমাংশে। যাযাবর এই গোত্রের অন্নসংস্থানের উপায় গোচারণ আর ‘সাবসিস্টেন্স ফার্মিং’।


তিনারিওয়েনের সদস্যরা উত্তর মালির সাহারার বাসিন্দা। ষাটের দশকে মালি স্বাধীন হবার সময়ে তামাশেকরা চেয়েছিল নিজেদের জন্যে আলাদা দেশ — আজ়াওয়াদ। তার পরিবর্তে সোভিয়েত-সমর্থিত মালির কৃষ্ণাঙ্গপ্রধান একদলীয় শাসকরা তুয়ারেগদের অধিকার পদদলিত করার ফলে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়, তাতে প্রাণ হারায় অনেক নির্দোষ তুয়ারেগ, গৃহহারা হয় আরো অনেক।


এই গানটার ভোক্যাল ইব্রাহিম আগ্ আলহাবিবের চার বছর বয়সে তার বাবা সেই বিদ্রোহে প্রাণ হারায়। পরিবারের নারী সদস্যদের সাথে এই এতিমরা ঘুরে বেড়ায় আলজেরিয়া-লিবিয়ার এক রেফ্যুজি ক্যাম্প থেকে আরেকে। গীটার শিখে পশ্চিমাগানের সাথে তুয়ারেগ সঙ্গীত মিলিয়ে নিজেদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার সাথে সাথে হাতে অস্ত্রও তুলে নেয় নব্বইয়ের দশকের আরেক বিদ্রোহে। ২০০০এর দশকেও আরেকটা বিদ্রোহ হয়। এরপরে একটা শান্তিচুক্তির ফলে তুয়ারেগদের অধিকার মালিতে মোটামুটি স্বীকৃত এখন। এই শান্তিচুক্তির পিছনে তিনারিওয়েনের মত দলের সাংস্কৃতিক গ্লোবাল আউটরীচের অবদান অনেক বড়।


তারপরেও ইউরেনিয়ামের মত খনিজ পদার্থ সংগ্রহ আর খরা-মরুকরণের ফলে চাষের সামান্যতম জমি ধ্বংস হওয়ায়, আর অন্যান্য অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবে, দরিদ্র সুন্নি সুফীমতানুসারী তুয়ারেগদের জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে পড়েছে। অর্থনৈতিক-সামাজিক অভিযোগ আর কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ থেকে ফেরত সালাফী ইসলামী জিহাদীরা গাদ্দাফীর ক্যাম্পে প্রশিক্ষিত-অস্ত্রসজ্জিত স্বাধীনতাকামী তুয়ারেগদের সাথে যোগ দিয়ে ২০১২ সালে আরেকটা বিদ্রোহ করে, যার ফলে ঘরবাড়ি ছাড়া হয় ৬ লাখ মূলত তুয়ারেগই।


সেসময় ইসলামী কট্টরপন্থীরা মালির ঐতিহাসিক তিমবাক্তু শহর দখল করে নেয়, ‘শরিয়া আইন’ চাপিয়ে দেয় আর শহরটির ইউনেস্কোচিহ্নিত ঐতিহ্যবাহী মসজিদ-মিনার-মাজার এগুলোর ধ্বংসসাধন করে। ২০১০এ দক্ষিণ আফ্রিকার ফিফা ওয়ার্ল্ডকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গানপরিবেশনকারী তিনারিওয়েনের এক সদস্যকেও তারা গ্রেফতার করে নির্যাতন করে আর গানবাজনা বন্ধ করে দেয়। ফরাসী সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় মালির সরকার অবশেষে এদের হটাতে সমর্থ হয়। আর আজ়াওয়াদপন্থী স্বাধীনতাকামীরাও দল বদলে মালির সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। এখনো মালিতে ফরাসী আর নিঝ়েরে মার্কিন সৈন্য আছে এসব দুর্গম অঞ্চলে জঙ্গিদের ঠেকিয়ে রাখার জন্যে।


এই গানটিতে দেখবেন মুসলিম তুয়ারেগ পুরুষদের মুখ ঢাকা, কারণ তাদের আদি ঐতিহ্যে নারী নয়, পুরুষরাই মুখ ঢাকে! তুয়ারেগ নারীরা মাথায় কাপড় দিলেও সাধারণত পুরো মুখমন্ডল আবৃত করে না, আর সকল ধরনের কর্মকান্ডে সমান অংশগ্রহণ করে। অতীতের কোন এক সময় তুয়ারেগ পরিবারব্যবস্থা মাতৃকুলভিত্তিক ছিল বলেই নৃতত্ত্ববিদদের ধারণা। এই গানে তেনেরে বলে সাহারার এক এলাকার অপার্থিব সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়েছে। একইসাথে মরুবাসী তুয়ারেগের অসহায়ত্ব বর্ণিত হয়েছে দুই শব্দে — আমান ইমান, পানিই জীবন।

গানের কথা আর অর্থ এখানে পাবেন।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!