দশ-বারো বছর বয়েসে মফস্বলে নানাবাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। প্রায় প্রতি শীতের ছুটিতেই যাওয়া হত, কিন্তু সেবার বিদেশ থেকে খালা, খালাত বোনরাও এসেছিল। আশপাশে সর্বসাকুল্যে যে একটামাত্র ভাল বইয়ের দোকান ছিল সে সময়, ছোট মামা আমাদেরকে সেটায় নিয়ে গেছিলেন।
দুর্লভ বিদেশী অতিথি হওয়ার সুবাদে বোনের ভাগ্যে জুটলো রঙচঙে চীনা বা রুশ প্রিন্টের সুন্দর একটা বই। আমারও মনে ধরেছিল সেটা। কিন্তু শেষমেষ মিললো বাংলা একাডেমীর সাদামাটা ‘লাল মৃত্যু’ নামে হায়াৎ মামুদের অনুবাদকৃত একটা ছোটগল্পের সংকলন।
প্রথমে মনটা একটু দমে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর যখন বইটা পড়ে শেষ করে উঠলাম আর ঘোর কাটলো, মনে হলো সাত সাগর তের নদী পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরলাম! রনবীর ইলাস্ট্রেশনগুলো তো দারুণ ছিলই, অনুবাদও বলিহারি। ছোটগল্পগুলির সেলেকশনও সেরকম। অস্কার ওয়াইল্ডের হ্যাপি প্রিন্স, সেলফ়িশ জায়ান্ট, নাইটিংগেল অ্যান্ড দ্য রোজ়। আনেরসেনের লিটল ম্যাচগার্ল, আগলি ডাকলিং, দ্য এঞ্জেল। হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। অসাধারণ এই বইটা তালি-তাপ্পি নিয়ে বহুদিন আমার সংগ্রহে ছিল। বন্ধুরা-ভাইয়েরা-বোনেরা পড়েছে। তারপর কিভাবে হারিয়ে গেছে আমি প্রবাসী হবার পড়। আবার খুঁজে পেলে কিনতে চাই।
বইটা ছোটবেলাতে আমার মননশীলতার উপর একটা গভীর দাগ কেটেছিল। পরে ওয়াইল্ড–আনেরসেনের গল্পগুলি ইংরেজী মূল আর অনুবাদেও পড়েছি। তরুণ বয়েসে সেও ছিল আরেক মাত্রার অনুভূতি।
যে গল্পটার কথা এখনো বলিনি সেটা হলো বইয়ের শীর্ষনামেরটা — লাল মৃত্যু — এডগার অ্যালান পো’র মাস্ক অফ় দ্য রেড ডেথ়। যতবার পড়তাম গল্পটা, গা ছমছম করে উঠত! ইংরেজী মূলটাও কম যায় না।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্লেগের সময় প্রিন্স প্রস্পেরো নামে এক রাজকুমার তাঁর বন্ধুবান্ধব, পরিবার, আর সমশ্রেণীর অভিজাতদের নিয়ে বহু বছরের রসদসমেত চলে গেলেন দূরের এক দুর্গে। সে দুর্গে অতন্দ্র প্রহরা, কাকপক্ষীরও সাধ্য নেই সেখানে প্লেগের জীবাণু নিয়ে ঢোকে। বহির্বিশ্বের মৃত্যুর বাস্তবতাকে ভুলতে আর দৈনন্দিন জীবনের একঘেঁয়েমি কাটানোর জন্যে প্রস্পেরো একটা পার্টি দিলেন। যেনতেন পার্টি নয়, দুর্গবাসী অতিথিরা সেখানে আসবেন ছদ্মবেশে, রহস্যাবৃত হয়ে — যাকে ইংরেজীতে বলে মাস্কারেড।
সে দুর্গে সাতটা বিশেষ ঘরকে সাজানো হলো, একেকটার রঙ একেক রকম। শেষটা লাল জানালা আর কালো দেয়ালের বিমর্ষ এক ঘর, কেউ পারতপক্ষে সেথায় ঢোকে না। শেষ বিকেলের আলো লাল কাঁচের জানালা দিয়ে কালো দেয়ালে পড়লে লাল-কালো মিলে এক ত্রাসের আবহ তৈরি হয়। আর সেখানে একটা বড় গ্রান্ডফাদার ক্লক। সেটা যখন গুরুগম্ভীর ঢংঢং শব্দ করে সময় জানান দেয়, কারো মুখে টুঁ শব্দটা হয় না। ঢংঢং শেষ হয়ে গেলে আবার সবাই যেমনকার তেমন।
পার্টির রাতে খুব হুল্লোড়। মদ-রুটি, আয়েশী খাবারের ছড়াছড়ি, গানবাজনা-জেস্টিং চলছে সমানে। দু্র্গপ্রাচীরের বাইরে সাধারণ প্রজারা রোগাক্রান্ত, মৃত্যুপথযাত্রী, প্রিয়জনের বিয়োগবেদনায় শোকাতুর। এরকম বৈপরীত্যের মধ্যে পার্টি যখন তুঙ্গে, তখন এক অদ্ভূত অতিথির আগমন ঘটলো।
নবাগতের মুখে মৃতের মুখোশ, আপাদমস্তক আবৃত কাফনের মত লাল কাপড়ে। অতিথিদের ভীড় সরে আপনি তাকে জায়গা করে দিল, আর সেই রহস্যময় মূর্তি হেঁটে হেঁটে — নাকি ভেসে ভেসে — এক ঘর থেকে আরেক ঘরে এগিয়ে যেতে থাকলো। রাজকুমারের বন্ধুরা একটু ঘাবড়ে গেলেন আর প্রস্পেরো গেলেন রেগে। কার এত বড় স্পর্ধা যে তাঁর ফূর্তির রাতে তামাশা করতে এরকম পোশাকে পার্টিতে আসে!
প্রস্পেরো তেড়ে গেলেন বেয়াদবের পরিচয় বের করতে। খোলা তলোয়ার হাতে দৌড়তে দৌড়তে অবশেষে তাকে ধরলেন শেষ কালো ঘরটাতে। মধ্যরাতের ঘন্টা বাজা তখনও শেষ হয়নি। নবাগতকে ছোঁয়ামাত্রই ভয়ে-বিভীষিকায় সাদা হয়ে প্রস্পেরোর আত্মা দেহত্যাগ করলো!
প্রস্পেরোকে রক্ষা করতে তাঁর পারিষদবর্গ ছুটে এলেন, আক্রমণ করলেন রক্তিম আগন্তুককে। তার আলখেল্লা ধরে টান দিতেই তাঁরা দেখলেন প্রহেলিকা — পোশাকের নিচে নেই কেউ! তারপর একে একে সকলে রক্তিম ত্বক নিয়ে প্লেগের আক্রমণে ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। দুর্গের প্রাচীরের ভেতরে চলল লাল মৃত্যুর রাজত্ব!
এই গল্পটা ছোটদের জন্যে একটু শিক্ষামূলকও। মৃত্যুর করাল গ্রাস কাউকে ছাড়ে না। অহংকারী মানুষ কোন না কোনভাবে যদি ভাবে তারা মৃত্যুর ঊর্ধ্বে, তখনই তাদের গ্রান্ডফাদার ক্লকে ঢংঢং করে বারোটা বেজে ওঠে।
আমার হিসাবে, এডগার অ্যালান পো খুবই আন্ডাররেটেড একজন লেখক। তিনি কিন্তু একাধারে ডিটেক্টিভ় নভ়েল, সাই-ফাই আর গথিক ম্যাকাবার শৈলীর লিখনের জনক। তাঁর লেখা দ্য গোল্ড বাগও আমার পড়া অন্যতম শ্রেষ্ঠ রোমাঞ্চকর ছোট গল্প। তাতে এনক্রিপশনের ব্যাপারে যেসব আইডিয়া দেয়া হয়েছে, সেগুলি পরে মার্কিন এক সেনাপ্রধানকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল সিগনালিং কোর তৈরিতে। তার ওপর আছেন মার্ডারস ইন দ্য র্যু মর্গের খ্যাতিমান ফরাসী ডিটেক্টিভ় দ্যুপ্যাঁ! এগুলি এইচ জি ওয়েলস আর আর্থার কোনান ডয়েলের জন্যেও প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণা ছিল।
কিন্তু পো মূলত পরিচিত তাঁর গথিকশৈলীর ছোটগল্পের জন্যে। সেগুলিতে তিনি মানুষের সবচে’ নীচ স্বভাবের মনোবৃত্তিগুলি তুলে ধরেছেন খুবই সাবলীলভাবে, কোনটা শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন নিয়ে, আবার কোনটা তার সাথে ডার্ক হিউমার মিলিয়ে একটু কৌতুকপ্রদ। সবগুলিই ফিরে ফিরে মৃত্যু বিষয়টাকে টেনে নিয়ে এসেছে। আর প্রতিটা ভিলেইনই মানবিক — তাদের প্রতি যতটা না ঘৃণা জাগে, তার থেকে বেশি হয় করুণা।
কাস্ক অফ় আমন্টিলাডোতে রয়েছে প্রতিশোধপরায়ণ বন্ধু কর্তৃক এক দুর্ভাগার খুনের কাহিনী। মন্ত্রেসর তার বন্ধু ফরতুনাতোকে দেয়াল তুলে এক ছোট কামরার মধ্যে জীবন্ত কবর দিয়ে দেয় এ কাহিনীতে। ফ়ল অফ় দ্য হাউজ় অফ় আশারেও মানসিক রোগগ্রস্ত এক ভাই তার বোনকে সেরকম জীবন্ত সমাধিতে বন্ধ করে ফেলে।
পিট অ্যান্ড দ্য পেন্ডুলাম গল্পে বলা হয়েছে স্প্যানিশ ইনকুইজ়িশনের সময়ে ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক সংস্কারপন্থীদের নিপীড়নের লোমহর্ষক বৃত্তান্ত। টেল-টেইল হার্টে রয়েছে ঠান্ডা মাথায় এক রগচটা বৃদ্ধকে খুন করে তার দেহাবশেষকে টুকরো টুকরো করে বাড়ির মেঝের নিচে গুম করে ফেলার কাহিনী — যার শেষ খুনীর পাপবোধের ফলস্বরূপ তার মনস্তত্ত্বে মেঝের ফ্লোরবোর্ডের নিচ থেকে আসা বুড়োর চলমান হৃদপিন্ডের ধকধক আওয়াজ। আর কেউ শুনতে না পেলেও সে আওয়াজ তাকে পাগল করে ফেলে। আর পুলিশের সামনে সে মেঝে খুঁড়ে বের করে ফেলে নিজের কীর্তিকলাপের প্রমাণ!
অ্যালান পো মৃত্যু নিয়ে অবসেসড ছিলেন তার কারণ বোধহয় কয়েকটা। ১৮০৯এ বস্টনে তাঁর জন্ম। এক বছর বয়েসে বাবা পরিবারকে পরিত্যাগ করেন, মা মারা যান দু’বছর বয়েসে। জন অ্যালান নামে ধনাঢ্য এক ভদ্রলোকের পরিবারে পালকপুত্র হিসাবে বড় হন, ভারজিনিয়ার রিচমন্ডে — সেখানে এডগার অ্যালান পো মিউজ়িয়াম দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
ছাত্রাবস্থায় পড়াশোনায় বেশি মন টেকেনি, লেখালেখি আর জুয়াখেলায় ঝোঁক ছিল পো’এর। সে নিয়ে পরে পালকপিতার সাথে মনোমালীন্য আর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কিছুদিন সেনাবাহিনীতেও কর্মরত ছিলেন পো। পালকমাতার অসুখের কথা গোপন রাখা হয়েছিল পো’র কাছ থেকে। তাঁর মৃত্যুর কথা জানতে পেরে পো রিচমন্ডে ফেরেন, কিন্তু সমাধির একদিন পর। জন অ্যালান এরপর দ্বিতীয় বিয়ে করলে সে নিয়েও ঝগড়া হয়। দু’বছর পর বড় ভাইয়েরও অকালমৃত্যু দেখতে হয় পো’কে।
১৮৩৫এ ২৬ বছর বয়েসী পো বিয়ে করেন তুতো-বোন ১৩ বছরের ভারজিনিয়াকে। তাঁকে যে ভালবাসতেন প্রাণ দিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু ১৮৪২এ ভারজিনিয়ার যখন যক্ষ্মা ধরা পড়ল, পো তখন বুঝে নিলেন যা বোঝার। বিষণ্ণতা আর নিয়তিবাদ তাঁর লেখায় ছাপ ফেলা শুরু করলো। ১৮৪৭এ মারা গেলেন ভারজিনিয়া। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর দু’বছর আগেই ভবিষ্যতদ্রষ্টা পো লেখেন তাঁর সবচে’ কালজয়ী কবিতা দ্য রেভ়েন।
সে কাব্যে বিমর্ষ এক পন্ডিত বইয়ের মাঝে ডুবে আছেন, প্রিয়তমা লেনোরকে হারানোর বেদনা ভুলে যাওয়ার প্রয়াসে। এমন সময় এক বিশাল দাঁড়কাকের আবির্ভাব ঘরের দরজার চৌকাঠের ওপরে। সে যখন ডেকে ওঠে, পন্ডিতপ্রবর ভাবেন কাক বলছে সে নামটি যেটা তিনি ভুলতে চান — লেনোর। কাককে অনুনয় করতে সে আবার ডেকে ওঠে — লেনোর নয়, সে আসলে বলছে নেভ়ারমোর! প্রেয়সীর দেখা তুমি আর কখনো পাবে না! যতবার বিদ্বান চান সে কথা ভুলতে, ততবার রেভ়েন ডেকে ওঠে — নেভ়ারমোর! এ এক উদ্ভ্রান্ত দ্বন্দ্ব! একদিকে বিরহবেদনা নিরসণের মানবিক প্রয়াস, আর অন্যদিকে প্রেমিকার স্মৃতির প্রতি অকপট বিশ্বস্ততা! (নিচের গানটা রেভ়েন কাব্য অবলম্বনে পো’এর প্রতি প্রগ রক গ্রুপ অ্যালান পারসনস প্রজেক্টের ট্রিবিউট।)
দ্য রেভ়েন লিখে পো মজুরি পেয়েছিলেন মোটে নয় ডলার। তাঁর ‘লেনোর’ ভারজিনিয়ার অকালমৃত্যুর দু’বছর পরে হতদরিদ্র-ক্ষতহৃদয়-ভগ্নশরীর ৪০ বছর বয়েসী এডগার অ্যালান পোও ১৮৪৯এর অক্টোবরের এক স্যাঁতস্যাঁতে ঠান্ডা রাতে দেহত্যাগ করেন বাল্টিমোরের রাস্তায় — অনেকটা তাঁর গথিক গল্পগুলির মত রহস্যজনকভাবেই!
এই ফ়লের কোন এক গা ছমছমে সন্ধ্যায় পো’এর একটা রোমহর্ষক ছোটগল্প পড়ে ফেলুন! হ্যাপি হ্যালোউইন!