মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)

শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!

ট্রেইল অফ টিয়ারস

Featured Video Play Icon
আমেরিকা অভিবাসীদের দেশ। ইউরোপীয়রা জনসংখ্যার ৭২ শতাংশ, আফ্রিকান-বংশোদ্ভূত ১২ শতাংশ, ভারতীয়-চীনা ইত্যাদি সকল এশিয়ান ৫ শতাংশ। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায় আমেরিকার আদি বাসিন্দাদের অস্তিত্ব, যারা এখন জনসংখ্যার ২ শতাংশেরও কম, দোআঁসলা মিলিয়ে মাত্র ৫০ লাখের মত। তাই আজকে এদের ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই।

আমেরিকান ইন্ডিয়ান বা নেটিভ আমেরিকান নাম দিয়ে আমরা যাদের সবাইকে এক বাক্সে বন্দী করি, তাদের কিন্তু প্রায় ৫০০টি স্বতন্ত্র ট্রাইব আর তারা ৯টি আলাদা পরিবারের ৩০০টি ভাষায় কথা বলে। এদের ধর্মীয় বিশ্বাস আর সামাজিক রীতিনীতিও সেরকম বৈচিত্রময়। অ্যারিজ়োনার হোপিরা মাতৃতান্ত্রিক, ওকলাহোমার ওসেজরা পুরুষশাসিত। মিডওয়েস্টের প্রেইরি ইন্ডিয়ানরা ঐতিহ্যগতভাবে যাযাবর শিকারী গোত্র, আবার নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার আনাসাজ়ি-পুয়েবলোরা কৃষিপ্রধান নগরসভ্যতা গড়ে তুলেছিল।

এ সকল জাতেরই পিতৃপুরুষ পূর্ব এশিয়া বা সাইবেরিয়ায় বাস করত। ত্রিশ হাজার বছর আগে — বরফযুগের শেষে — তারা শিকার তাড়া করতে করতে বরফাবৃত বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে আলাস্কায় ঢুকে পড়ে। বরফ গলে যাবার পরে প্রশান্ত মহাসাগরের অকূল পাথার তাদেরকে এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। তারপর কয়েক হাজার বছরের মধ্যে তারা দক্ষিণ আমেরিকা আর ক্যারিবিয়ান পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। অন্যান্য বিশ্বসভ্যতা, বাণিজ্যপথ, আর সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান থেকে আলাদা হয়ে পড়ায় ১৪৯২এ ক্রিস্টোফার কলাম্বাস তাদেরকে পান প্রস্তরযুগীয়, বড়জোর ব্রোঞ্জ প্রযুক্তির পর্যায়ে। এমনকি চাকার ব্যবহারটা পর্যন্ত কেউ জানত না!

দক্ষিণে আজ়তেক, মায়া, ইন্কারা যখন পাথর কেঁটে অতিকায় পিরামিড বানাতে ব্যস্ত, তখন উত্তরের নেটিভ আমেরিকান ট্রাইবগুলি অতটা অগ্রসর ছিল না। তারপরেও তাদের সমৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায় ইলিনয়ের ক্যাহোকিয়া, কলোরাডোর মেসা ভের্দে, আর নিউমেক্সিকোর টাওসচাকোর ধ্বংসাবশেষগুলোর মাঝে। স্প্যানিশ দিগ্বিজয়ীরা ষোড়শ শতকে মেক্সিকোতে লোকমুখে শুনেছিল উত্তরের সাতটি স্বর্ণমণ্ডিত নগরীর কথা। সেগুলো খুঁজে বের করতে তারা অভিযানও পাঠিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে এ সকল জনপদ ক্ষয়িষ্ণু।

১৬২১এর হেমন্তে মেফ্লাওয়ার জাহাজে আগত ইংরেজ সেটলার আর তাদের পড়শি ওয়াম্পানোগ ট্রাইব নবান্নের খাবার একসাথে ভাগাভাগি করে খায়। থ্যাংকসগিভিং ঐতিহ্যের সূত্রপাত এখানেই। কথিত আছে ১৬১৪ সালে ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে জন স্মিথ বলে এক ইংরেজ সেটলারের প্রেমে পড়ে স্থানীয় ইন্ডিয়ান চীফের মেয়ে পোকাহোন্তাস। আমেরিকার ইতিহাসে নাকি সেই প্রথম ইন্টাররেশিয়াল বিয়ে। তাদের প্রেমকাহিনী নিয়েই অ্যানিমেটেড ফিল্ম ‘পোকাহোন্তাস’ তৈরি করে ডিজ়নি।

অন্যদিকে ইউরোপীয়রা বাজে যে জিনিসটা নিয়ে এসেছিল আমেরিকায়, তা হলো গুটিবসন্তের জীবাণু। পুরনো পৃথিবীর এ রোগের সাথে অপরিচিত নেটিভদের ইম্যুন সিস্টেম এর বিরুদ্ধে ছিল অকার্যকরী। ফলে মহামারিতে বিপুলসংখ্যক ইন্ডিয়ান মারা যায়।

আমেরিকার গোড়াপত্তনের পরে নেটিভ আমেরিকানদের সম্বন্ধে মার্কিন প্রতিষ্ঠাতাদের ধারণা ছিল ভাল-খারাপ মিশ্রিত। তাদের হিসাবে নেটিভরা জংলী জাত হলেও নৈতিক মূল্যবোধ টনটনে, আর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্ব তাদেরকে সভ্যতা শেখানো। (ব্যতিক্রমঃ বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।)  এ কারণে সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক ট্রাইব, যেমন চেরোকিরা, তাদের আদিভাষা, পোশাক-আষাক, কৃষ্টি ছেড়ে আমেরিকান হতে শুরু করে।

তারপরও যখনই নেটিভদের জমিজমার উপর ইউরোপীয়দের দৃষ্টি পড়েছে, তখনই তারা প্রশাসনের সাথে যোগসাজশ করে তাদেরকে সেখান থেকে উচ্ছেদ করেছে। চেরোকিদের এলাকায় স্বর্ণ আবিষ্কৃত হলে বাইবেলের এক্সোডাসের ইহুদীদের মত তাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। বাচ্চা-কাচ্চা, বুড়ো-বুড়িদের নিয়ে শ’ শ’ মাইল পায়ে দলে চেরোকিদের চলে যেতে হয়েছিল পশ্চিমের ইন্ডিয়ান টেরিটোরিতে। যাত্রাপথে খাদ্যাভাবে, ঠান্ডায় মৃত্যুবরণ করেছিল অনেকে। তার উপরে ভিন্নগোষ্ঠীর নেটিভরাও তাদের উপরে আক্রমণ করে। যারা আদিনিবাস ছাড়তে অরাজি ছিল, তাদের সাথেও ইউরোপীয়দের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৮৩০এর দশকের এসব ঘটনা ইতিহাসে পরিচিত ‘ট্রেইল অফ টিয়ারস’ হিসাবে।

গৃহযুদ্ধের পরে শিল্পবিপ্লবের সস্তা প্রডাক্ট মদ্যপানীয় আর আগ্নেয়াস্ত্রও নেটিভদের হাতে আসা শুরু করে। সাদাদের বিরুদ্ধে তো ইন্ডিয়ানরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেই, একে অন্যের বিরুদ্ধেও অপ্রতুল গোচারণভূমি নিয়ে ঝগড়াঝাটিতে লেগে থাকে তারা। ফলে যুদ্ধে, নেশায়-বিষণ্ণতায়, অনাহারে-অপুষ্টিতে নেটিভ আমেরিকান জনসংখ্যা আরো কমতে থাকে।

১৮৯০এ এক মার্কিন সেনাদল সাউথ ডাকোটার উন্ডেড নী ক্রীকের কাছে লাকোটা ইন্ডিয়ানদের একটা গ্রুপকে  তাদের নির্ধারিত রিজ়ারভেশনে এসকর্ট করে নিয়ে যাচ্ছিল। সেসময় ভুল বুঝাবুঝি থেকে ঝগড়ার সুত্রপাত হয় আর সৈন্যরা গুলি করে প্রায় তিনশ’ লাকোটাকে মেরে ফেলে। তাদের মধ্যে নারী-শিশু মৃতের সংখ্যা ছিল ২০০। উন্ডেড নী এখন মার্কিন ইতিহাসে সবচে’ রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ড হিসাবে স্বীকৃত।

এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া শুরু করে ১৯২৪ সালে। সে বছর আমেরিকার সকল আদিবাসীকে জাতিগোষ্ঠীনির্বিশেষে মার্কিন নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার দেয়া হয়। ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত চার্লস কার্টিস ১৯২৯এ রিপাবলিকান পার্টির টিকেটে ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট রোজ়ভেল্টের আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে প্রচুর নেটিভ আমেরিকান জওয়ান সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছিল। সেনাজীবনকে নেটিভরা সেসময়ে সম্মানজনক হিসাবে দেখতো। ২০০২এর উইন্ড-টকারস মুভিটাতে দেখতে পারবেন নাভ়াহো ট্রাইবের নেটিভরা কিভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীকে গোপন সাংকেতিক ভাষায় যোগাযোগ করতে সাহায্য করেছিল।

আজ অধিকাংশ নেটিভ আমেরিকান শহুরে, কিছু থাকে রিজ়ারভেশনে। রিজ়ারভেশনগুলি স্বায়ত্ত্বশাসিত, তাদের ক্ষেত্রে স্টেটের আইন খাঁটে না। তার সুযোগ নিয়ে কিছু রিজ়ারভেশন জুয়া আর টাকা ধারের ব্যবসা বসিয়ে টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলছে। সবসময় সেগুলি যে সৎ ব্যবসা তা নয়। নিউমেক্সিকো-অ্যারিজ়োনার কিছু নেটিভ জীবিকানির্বাহ করে চিত্তাকর্ষক স্যুভনির হস্তশিল্প বানিয়ে। আবার মন্টানা-ডাকোটার অনেক রিজ়ারভেশন আছে, যারা সরকারী অনুদানের উপর নির্ভরশীল। তাদের ভালো স্কুল-কলেজ নেই, বেকারত্ব-মাদকাসক্তির হার অতিরিক্ত।

২০০৯এ ওবামা সরকার নেটিভ আমেরিকানদের ওপর অতীতের দুর্ব্যবহারের জন্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এখন অনেক নেটিভ আমেরিকান সম্প্রদায় নতুন প্রজন্মকে তাদের আদিভাষা-সংস্কৃতি শিখানোর ব্যাপারে সচেতন। ওকলাহোমার চেরোকিদের অঞ্চলে গেলে ইংরেজির পাশাপাশি তাদের ভাষারও রোডসাইন দেখা যায়। মতপ্রকাশ আর সংস্কৃতিচর্চার স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রগতি হলেও বাসস্থান আর খাদ্যসংস্থানের নিরাপত্তার জন্যে এখনও অনেক সম্প্রদায়কে সংগ্রাম করতে হয়।

নেটিভ আমেরিকান বংশোদ্ভূত একজনকে আমি চিনি। ইউএস আর্মিতে বহুদিন থাকার পরে সফ্টওয়্যার সেক্টরে চাকরি করে সফল হয়, আর্লি রিটায়ার করে। সে অবশ্য ব্যতিক্রম। নেটিভ আমেরিকানদের মোটে ১৫% স্নাতক ডিগ্রিধারী। তবে বেকারত্বের হার সাদাদের তুলনায় একটু বেশি হলেও এখন আগের তুলনায় বেশি নেটিভ সার্ভিস সেক্টরের পেশায় আসে। কিছু বছর আগেও তারা ট্রাডিশনাল সমাজব্যবস্থা আর জীবনযাত্রা ছেড়ে চাকরীতে খুব একটা আসতো না।

ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক দিয়ে নেটিভ আমেরিকানদের মধ্যে খ্রীষ্টান যেমন আছে, সেরকম স্থানীয় একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারীও আছে। পেয়োটে বলে এই ধর্মে ওয়াখান থানকা, অর্থাৎ ‘মহান আত্মা’, নামে এক নিরাকার ঈশ্বরের উপাসনা করা হয়। প্রকৃতির জীব-জড় সবকিছু ওয়াখান থানকার আত্মার ধারক, তাই বুনো গাছপালা আর জানোয়ারদের সংরক্ষণ করা পেয়োটে অনুসারীদের ধর্মীয় কর্তব্য। নেটিভ আমেরিকানদের নাচ-গানও মূলত প্রাকৃতিক শক্তি আর পূর্বপুরুষদের আত্মার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত। তাদের প্রসিদ্ধ নাচগুলি হল গোস্ট ডান্সরেইন ডান্সসান ডান্স, প্রভৃতি।

মা’ক্ চি বলে এই গানটির ভাষা অধুনাবিলুপ্ত টুটেলো-সাপোনি। মোহক-বংশোদ্ভূত রোবি রবার্টসন কানাডার মূলধারার স্বনামধন্য শিল্পী। আর মার্কিন ইউলালি ব্যান্ডটার সদস্যরাও ইন্ডিয়ান ঐতিহ্যের। নেটিভ আমেরিকানদের পূর্বপুরুষরা গানটির বিষয়বস্তু। উত্তরপ্রজন্মকে সাহস যোগাতে তাদের আত্মা ফিরে ফিরে আসে, যেন নিজস্ব সংস্কৃতি আর মূল্যবোধে তারা অটল থাকে, যেন তারা ভুলে না যায় আত্মপরিচয় আর স্বজাতির শিকড়।

সুবর্ণদ্বীপের বানরনৃত্য

Featured Video Play Icon
জাকার্তা, সুকার্নো, ইয়োগইয়াকার্তা, সুহার্তো, জাভা, সুমাত্রা, গারুডা, মালয়, সিঙ্গাপুর — মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার এই নামগুলির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আজ বলবো কি কারণে এই নামগুলো যথাক্রমে আসলে জয়কর্তা, সুকর্ণ, যোগ্যকর্তা, সু-অর্থ, যব, সমুদ্র, গরুড়, মলয়, সিংহপুর ইত্যাদি থেকে এসেছে।

লেখার সাথের ভিডিওতে দেখতে পাচ্ছেন ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী ‘কেচা’ নামক অনুষ্ঠান। অপার্থিব এই দৃশ্যটি নেয়া হয়েছে ‘বারাকা’ বলে ১৯৯২এ তৈরি তথ্যচিত্র থেকে। এটা ধারণ করা হয়েছে বালির গুনুং কাউয়ি বলে একাদশ শতাব্দীর এক মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মাঝে।

বালির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ট্যুরিস্টদের কাছে যেমন জনপ্রিয়, ঠিক ততটা মনকাড়া তাদের শিল্প-সংস্কৃতি — যার মধ্যে আছে ছায়ানাট্য, লেগংবারং নৃত্য, আর রামায়ণের নাট্যাভিনয়। রাবণের রাক্ষসবাহিনী বনাম হনুমানের বানরবাহিনীর যুদ্ধের প্রতীকী রি-এন্যাক্টমেন্ট এই কেচা  নামক ‘বানরনৃত্য’।

অংশগ্রহণকারীদের কানে গোঁজা জবাকুসুম — যেটা বাংলায় দুর্গাপূজায় ব্যবহৃত হয়। দৃশ্যটির গোঁড়ার দিকে দেখা যাচ্ছে বালির উলুওয়াতু মন্দিরের নিকটবর্তী অরণ্যের শাখামৃগদের, তারা সেখানকার পবিত্র রক্ষক। আর দেখানো হয়েছে জাভার বোরোবুদুর বৌদ্ধবিহার আর কম্বোডিয়ার আংকোর ভাটের বিষ্ণুমন্দিরের স্থাপত্য ও অলংকরণ। সেগুলি ভারতবর্ষের মন্দির-মসজিদগুলোর থেকে কোন অংশে কম নয়!

রামায়ণ আর হিন্দুধর্ম বালিসহ সারা ইন্দোনেশিয়াতে এসেছে প্রাচীন ভারতবর্ষ থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো।

ভিয়েতনামের ফুনানচম্পা, কম্বোডিয়ার চেনলাখ্মের, থাইল্যান্ডের দ্বারাবতী, মালয়েশিয়ার গঙ্গানগরলংকাসুকা, ইন্দোনেশিয়ার মজাপহিতশ্রীবিজয়াশৈলেন্দ্র, মায়ানমারের পাগান — অতীতের এ সকল রাজ্য সবাই কোন না কোনভাবে ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করেছে। এদের অধিকাংশের নামই সে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষ্য।

বিশেষ করে ভারতের দুটো অঞ্চল পূর্বদিকে হিন্দু-বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত-পালি ভাষা, নাগরীলিপি, স্থাপত্যশৈলী, আর পরবর্তীতে ইসলাম, ইত্যাদির বিস্তারে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। সে দুটো কোরোমান্ডেল উপকূল আর বঙ্গ। নালন্দার বৌদ্ধবিহারে ৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে খচিত শিলালিপি থেকে আমরা জানতে পারি ‘সুবর্ণদ্বীপের’ — অর্থাৎ সুমাত্রার — শ্রীবিজয়া রাজ্যের শৈলেন্দ্রবংশীয় মহারাজা বলপুত্র কর্তৃক একটি মঠস্থাপনের জন্যে অনুদানের কথা। আর আমাদের বিক্রমপুরের বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর তিব্বতে ধর্মপ্রচারে যাবার আগে সুবর্ণদ্বীপেই  শ্রীবিজয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় অধ্যয়ন করেন।

কি উপায়ে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রথম পূর্ব এশিয়াতে এসে পৌঁচেছে, তার বিস্তারিত কোথাও লিপিবদ্ধ নেই। ধারণা করা যেতে পারে বাণিজ্যের খাতিরে শ’ শ’ বছর ধরে ধীরে ধীরে এখানকার স্থানীয় রাজ-রাজড়ারা — সাথে তাদের প্রজারা — ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-শিল্পকলা-ধর্মচিন্তার ঐশ্বর্য দেখে তাতে আকৃষ্ট হয়। দক্ষিণ ভারতের তেলেগু পল্লব বংশের রাজারাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে সমুদ্রের অপরপারে নতুন রাজ্য আর রাজবংশ স্থাপনে। এ ছিল কমবেশি শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়া।

ভারতীয় দখলদারিত্ব আর ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাসও অবশ্য একটা সময়ে পাওয়া যায়। সেটা হলো একাদশ শতাব্দীতে তামিল চোলবংশের আগ্রাসনে শ্রীবিজয়া সাম্রাজ্যের পরাজয়, যাদের স্থান পরে পূরণ করে ত্রয়োদশ শতকের মজাপহিত বলে জবদ্বীপের — অর্থাৎ জাভার — আরেকটি রাজবংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিমদের ঠিকানাও এ এলাকায় প্রাচীনতা থেকে পাওয়া যায়। সপ্তম-অষ্টম শতক থেকে তাদের বাণিজ্যপ্রধান সমুদ্রতীরবর্তী বন্দর-নগরগুলি ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। সুফী ধর্মপ্রচারকরা দ্বীপগুলির আরো গভীরাঞ্চলে ইসলামের বাণী নিয়ে যায়। তার উপরে ভারতে মুসলিম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পরে তাদের বনেদী বংশগুলির সাথে আত্মীয়তা করার জন্যে ইন্দোনেশিয়ার রাজারাও ধর্মান্তরিত হওয়া শুরু করে। তাছাড়াও আরবীর পরিবর্তে মালয় ভাষাতে ইসলামী পান্ডুলিপির প্রাচুর্য ছিল। এসব কারণে শীঘ্রই পুরো ইন্দোনেশিয়ার আশি শতাংশ মানুষ মুসলিম হয়ে যায়।

সেই ধারার ব্যতিক্রম শুধু বালি । বহুদিন ধরে তারা জাভা-সুমাত্রার মুসলিম রাজ্যগুলি থেকে স্বাধীন ছিল। আলাদা দ্বীপ হওয়ায় ধর্মপ্রচারকরাও সহজে সেখানে যেতে পারেনি। সেকারণে তারা আদিধর্ম বজিয়ে রেখেছে। তাদের রাজ্যগুলিকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরে দখলে নেয় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তি হল্যান্ড। বালিনিজ়দের উপর তাদের অত্যাচার দেখে বাকি ইউরোপীয় জাত তাদেরকে ছি-ছি করেছিল। সে কারণে তিরিশের দশকে অনেকটা ক্ষতিপূরণস্বরূপ ডাচরা বালির শিল্পসংস্কৃতিকে যথাযোগ্য মর্যাদা দেয়া শুরু করে। কেচা-নৃত্যের উদ্ভব সে সময়।

এদের হিন্দুধর্মও ভারতের থেকে অনেক স্বতন্ত্র। পুরনো অ্যানিমিস্ট বিশ্বাসের মূল খুঁজতে বেশিদূর যাওয়া লাগে না। যেমন, কেচা আসলে সাংহিয়াং বলে বালির এক ভূততাড়ানি অনুষ্ঠানের আধুনিক রূপ। বৌদ্ধধর্মও পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়নি। মজাপহিত রাজবংশের সময় শিব আর বুদ্ধ দু’য়েরই উপাসনা চলত একই মন্দিরে, এ ছিল তাদের অভাবনীয় ধর্মীয় সংস্কার আর সহনশীলতার প্রমাণ। ইসলামের বিস্তারের পরেও আগের অনেক আচারব্যবস্থা সুফী চিন্তার প্রভাবে রিডিফাইন-রিপারপাজ় হয়েছে। যেমন সুরো বলে নববর্ষের অনুষ্ঠান যুগ যুগ ধরে মুসলিম সমাজে জনপ্রিয়তাসহকারে পালিত হয়ে আসছে।

অবশ্য ১৯৯৮ সালে সুহার্তোর পতনের সময় থেকে মুসলিম-খ্রীষ্টান, মালয়-চীনা দাঙ্গা এখন নিত্যনৈমিত্তিক। নাইন-ইলেভেনের মত ভূরাজনৈতিক কারণে স্থানীয় কট্টরপন্থীদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা গিয়ে ইন্দোনেশীয়দের হাজার বছরের ধর্মীয় সহনশীলতা বিপন্ন। বালির হিন্দু জনগোষ্ঠী তাও বেঁচে গেছে দেশের কদর বাড়ানো আর ট্যুরিস্টদের টাকা উপার্জনের সামর্থের কারণে। সেটা কতদিন টেকে সেটা দেখবার বিষয়। অন্তত যতদিন ওয়াহহাবি মতবাদের সরকারগুলির অর্থায়ন থাকবে, ততদিন তাদের ভয় থেকেই যাবে।

তুর্কীনাচন

Featured Video Play Icon
ইসলামের প্রসার ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুফী চিন্তাধারার অবদান অনস্বীকার্য। আর সুফী সাধকদের মধ্যে মওলানা রুমী উচ্চমর্যাদায় অধিষ্ঠিত — তুরস্ক-পারস্য-ভারতে তো বটেই, ইউরোপ-আমেরিকাতেও তাঁর কাব্য আজ বহুলপঠিত।

উপরের ভিডিওতে যেটা দেখছেন, তাকে নাচগানের পর্যায়ে ফেলাটা ভুল হবে। এই পারফরম্যান্সটা জনসমক্ষে করা হলেও অতীতে এ ধরনের প্রার্থনাগীতি আর ঘূর্ণিনৃত্যের সমাবেশ হত শুধু মৌলভীদের খানকায়। যে কেউ তাতে অংশ নিতে পারত বা দেখতে যেতে পারত, কিন্তু এর মূল উদ্দেশ্য স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়ার আধ্যাত্মিক প্রচেষ্টা, দর্শক-শ্রোতার মনোরঞ্জন নয়।

এই ধরনের জ়িকর বা স্রষ্টার নামস্মরণ করাকে তুর্কী ভাষায় বলে সেমা, যেটার আরবী শব্দমূলের অর্থ শ্রবণ করা। প্রখ্যাত সুফী কবি জালালুদ্দিন রুমী ত্রয়োদশ শতকে মিস্টিসিজ়ম বা গূঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উপর ভিত্তি করে সেমাসহ অন্যান্য সুফী ঐতিহ্যের সূচনা করেন, যেটা তুর্কী-ফার্সী-আরবী ভাষায় মৌলভী তরিকা বলে পরিচিত। মূলধারার অনেক মুসলিম মনীষীদের হিসাবে এগুলি ইসলামের বিপরীত নয়, নামাজ-রোজার প্রতিস্থাপকও নয়। রুমী কুরআন-হাদীসের বিশ্লেষণ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রকাশিত জানা নিয়মকানুন থেকে শুরু করার পরে ইসলামের আরেকটি গূঢ় অন্তর্মূলে যাওয়া সম্ভব, যেখানে সৃষ্টি আর স্রষ্টার মধ্যে সম্পর্ক প্রেমের। সেমার মত জ়িকর সুফী সাধককে সেই পর্যায়ে পৌঁছতে সাহায্য করে।

সুফী দর্শনের শুরু রুমীর মাধ্যমে নয়, তাঁর আগেও অনেক মনীষী ইসলামের মানবিক আধ্যাত্মিক দিকগুলি খুঁজে বের করে তার প্রসার ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এমনকী তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রখ্যাত সাধক ছিলেন একজন নারী, তাঁর নাম রাবিয়া বসরী। আর ইমাম গাজ্জ়ালী — যাঁর মতাদর্শের প্রসারের কারণে ইবনেসিনা-ইবনেরুশদের ইসলামী যুক্তিবাদী দর্শন জনপ্রিয়তা-পৃষ্ঠপোষকতা হারানো শুরু করে — তিনি আশারী নামক সুফী মতবাদেরই প্রবক্তা ছিলেন। বিজ্ঞান দিয়ে স্রষ্টা আর সৃষ্টিকে বোঝার থেকে তাঁর পছন্দ ছিল অন্তর্মুখী সাধনা আর ধ্যানের মাধ্যমে স্রষ্টার নিকটবর্তী হওয়া আর সৃষ্টির মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করা। তাঁর ফতোয়া অনুযায়ী, যদি অন্তরের পবিত্রতা থাকে, তাহলে নাচ-গান-সুরের সাহায্য নিয়ে জ়িকর করা অবৈধ নয়।

এই পারফরম্যান্সে তাই দেখতে পাচ্ছেন বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার — যার মধ্যে আছে নেই নামক বাঁশি, রিক্ক্ বলে খঞ্জনী, গীটারের মত উদ, আর আমাদের সন্তুরের মত কানুন। শিল্পীরা তাদের ট্র্যাডিশন অনুযায়ী কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফাতিহা দিয়ে শুরু করেছেন, কিন্তু সেমার বাকি অংশে কোন কুরআন-হাদীসের বাণী টানা হয়নি। সেটা ইচ্ছামূলক, যেন কেউ তাঁদের আবৃত্তিকে পবিত্র বাণীর সাথে গুলিয়ে ফেলে পাপী না হয়।

কানুন বাদ্যযন্ত্রটি এখানে বাজাচ্ছেন জ়ুলিয়্যাঁ জালালুদ্দিন ওয়াইস বলে এক ফরাসী মিউজ়িশিয়ান, যিনি ইউরোপে সুফীসঙ্গীতকে জনপ্রিয় করার অন্যতম পথিকৃৎ। সিরিয়ার দামেস্কের বিখ্যাত উমাইয়্যা মসজিদের শেখ শাক্কুর এখানে প্রধান গায়ক হিসাবে অংশ নিয়েছেন। খোদাকে স্মরণ করছেন কয়েক রকম নামে, আল্লাহু হা’ঈ অর্থ আল্লাহ সদাজীবিত, সর্বদা-জাগ্রত। ক’দিন আগে একটা হিব্রু ইয়েমেনী গান নিয়ে লিখেছিলাম, সেখানেও স্রষ্টাকে একই হা’ঈ নামে ভূষিত করেছেন ইহুদী গীতিকার। আরেকটা উপাধিতে খোদাকে স্মরণ করছেন শেখ শাক্কুর, আলিমুল সির্‌রি‍‍‍ ওয়া জাহরি, অর্থাৎ গুপ্ত আর প্রকাশিত সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ। এখানেই উঠে এসেছে সুফী চিন্তাধারার মূল প্রতিপাদ্য, যে, আক্ষরিকের পরেও কুরআন-হাদীসে ‘গুপ্ত’ একটা লেভেল আছে, সেটা হিউম্যানিজ়ম বা মানবতাবাদ থেকে খুব অভিন্ন কিছু নয়।

ঘূর্ণিনৃত্যের পোশাক আর একেকটা অঙ্গভঙ্গির মধ্যেও গুহ্য অর্থ রয়েছে। সিক্কা বলে ঊটের লোমের তৈরি লম্বা টুপি আসলে সমাধিস্তম্ভের রূপক, সে সমাধি আত্ম-অহমের। আর শিল্পীদের পরনে যে ঢোলা স্কার্টের মত সাদা পোশাক, সেটা যেন কাফনের কাপড়। তাঁরা শুরু করছেন বুকের উপরে দু’হাত রেখে বাউ করে, এই ভঙ্গি তওহীদ বা স্রষ্টার একত্বের প্রতীকী ঘোষণা। তাঁরা ঘুরছেন ডান থেকে বামে, ডান হাত কখনো উপরে ফেরানো, বাম হাত অধঃমুখী। যেন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার ভালোবাসার বাহক হিসাবে স্বর্গ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে এসে বিলিয়ে দিচ্ছেন পৃথিবীর বাকিসব প্রাণীকে। গ্রহনক্ষত্রের আবর্তনের প্রাচীন স্বর্গীয় নিয়মকে অনুকরণ করে সেমাজ়েনরা ঘুরে চলেছেন। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়া তাঁদের লক্ষ্য নয়।

রুমীর চিন্তাধারার মধ্যে সকল ধর্ম-বর্ণের মানুষেরই খোদার ভালবাসা ‌অর্জনের ক্ষমতাকে পরিপূর্ণরূপে স্বীকার করা হয়েছে। সত্যি বলতে কি, অন্যান্য অনেক প্রাচীন আর আধুনিক ধর্মের মধ্যেও সুফীদের মত আধ্যাত্মিক দর্শনের উদাহরণ আছে। মধ্যপ্রাচ্যে খ্রীষ্টের আগমনের সময়ে গ্নস্টিসিজ়ম বলে একটা গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শন প্রচলিত ছিল, যেটা প্রাক-ক্যাথলিক খ্রীষ্টধর্মকেও প্রভাবিত করেছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধধর্ম কিংবা শ্রীকৃষ্ণলীলাও এধরনের গুঢ়তাত্ত্বিক দর্শনের উত্তম উদাহরণ। তাই বলে এটা ভাবাটা পুরোপুরি ঠিক নয় যে, রুমী ও অন্যান্য সুফীরা অনৈসলামিক চর্চাকে ইসলামী রূপ দিয়েছেন। তাঁরা স্বগরিমায় মূলধারার ইসলামী আইনকানুনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন, তাঁদের চিন্তাধারার বিবর্তন হয়েছে অনেক পড়াশোনা আর মেডিটেশনের মাধ্যমে।

সুতরাং সুফীবাদ ইসলামের থেকে আলাদা বিশেষ কিছু নয়। একাদশ-দ্বাদশ শতক থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সুফীদের বহু তরিকা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে এসেছে। ভারতে ইসলামের বিস্তারের মূল কারণ মুসলিম দিগ্বিজয়ীদের সাথে সুফী সাধকদের আগমন। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ভারতবর্ষের নামীদামী মাদ্রাসাগুলো সুফী মতাদর্শেরই দিকপাল ছিল। বায়েজ়িদ বোস্তামী, হাফেজ়, শেখ সাদী, রুমী ইত্যাদি মনীষীর চিন্তাধারা পরবর্তীতে প্রভাবিত করেছে মির্জ়া গালিব, ইকবাল, নজরুলের মত কবিকে।

আধুনিক কালে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অবস্থার কারণে মুসলিমরা হয় পশ্চিমা শিক্ষার প্রভাবে যুক্তিবাদী ধারায় ফিরেছে, নয়ত সালাফী-ওয়াহহাবী অর্থায়নের কারণে ধর্মগ্রন্থের আক্ষরিক অর্থটাকে গ্রহণ করে একটু কট্টরপন্থী অবস্থানে চলে গিয়েছে। দু’পক্ষের কেউই সুফী চিন্তাধারার শক্তিটাকে অনুধাবন করতে পারে না। অবহেলার কারণে অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত ভন্ডপীর আর মুরীদের দল সুফী মতবাদকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে।

বিশেষ করে সালাফীরা সুফীসাধনাকে অনৈসলামিক মনে করে। তারা সেমা, জ়িকর, নামাজের পর দোয়া — এসব সুফী প্রথাকে বলে বিদআত বা ধর্মবিচ্যুত উদ্ভাবন। সেকারণে সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে আইসিস খুঁজে খুঁজে সুফী সাধকদের হত্যা করেছে। জালালুদ্দিন ওয়াইস তখন তাঁর দামেস্কের বাসস্থান থেকে পালাতে বাধ্য হন। এই ভিডিওতে অংশ নেয়া সেমাজ়েনদের অনেকে এখন গৃহহীন রেফ্যুজি, একজন পায়ে শ্রাপনেলের আঘাত নিয়ে শয্যাশায়ী।

আবার যুক্তিবাদী সেক্যুলারদের শাসনেও সুফীরা তাদের অনেক অধিকার হারিয়েছে। ১৯২৫ সালে কামাল আতাতুর্ক তুরস্কে প্রকাশ্যে সুফী মতবাদের চর্চা আইন করে বন্ধ করে দেন, অভিযোগ ছিল এগুলো মধ্যযুগীয় কুসংস্কার। ইস্তাম্বুলের প্রায় আড়াইশ’ তেক্কে বা খানকা বন্ধ করে দেয়া হয়, নয়ত তাদের জাদুঘর হিসাবে সরকারী মালিকানায় নিয়ে আসা হয়। তারপরেও অনেক সুফী গোপনে ব্যাক্তিগতভাবে চর্চা চালিয়ে যেতে থাকে। পঞ্চাশের দশকে শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের উদ্দেশ্যে সেমা পালন করার লাইসেন্স দেয়া হয়। ২০০০এর দশক থেকে এখন খুব একটা কড়াকড়ি নেই। মধ্য এশিয়ার প্রাক্তন সোভিয়েত দেশগুলি থেকে অবশ্য সত্যিকারের সুফীবাদ পুরোপুরি বিলীন হয়ে গেছে, আছে খালি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসাধনের খোলস হিসাবে। অথচ একসময় এরাই সুফীসাধনার অগ্রগণ্য কেন্দ্র ছিল।

পশ্চিমাবিশ্বে কিন্তু এখন সুফীদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, বিশেষ করে নাইন-ইলেভেনের পরে অনেকে ইসলাম সম্পর্কে জানতে গিয়ে সুফীবাদকে পুনরাবিষ্কার করেছে। আমেরিকায় কবিতার বইয়ের কাতারে রুমীর অনুবাদগুলো এখন বেস্টসেলার। ইউনেস্কোও ২০০৮এ সেমাকে স্বীকৃতি দিয়েছে মানবসভ্যতার অমূল্য ঐতিহ্য হিসাবে।

মানবতার সার্বজনীনতাকে তুলে ধরতে রুমীর লেখা একটি কবিতা দিয়ে শেষ করিঃ
“At times we are hidden, at times revealed;
We are Muslims, Christians, Jews; of any race.
Our hearts are shaped like any human heart,
But every day we wear a different face.”

গঙ্গা বইছো কেন?

Featured Video Play Icon

 

“বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছো কেন?”

সবার পরিচিত এই গানটা ভূপেন হাজারিকা গেয়েছেন বাংলা ছাড়াও হিন্দী আর অসমীয়াতে (উচ্চারণঃ অহমিয়া)। অনেকেই হয়ত জানেন যে গানের সুরটা আসলে অনেক পুরনো একটা মার্কিন মিউজ়িক্যালের সুর অবলম্বনে।

আসল গানটার নাম “ওল´ ম্যান রিভার” — ওপরের ভার্শনটা “শোবোট” বলে ১৯৩৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। গেয়েছেন সেসময়কার বহুলপ্রতিভাসম্পন্ন আমেরিকান-ফুটবল খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, সামাজিক-রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট পল রোবসন

বহু চড়াই-উৎরাই পার করা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের ছেলে এই বাস ব্যারিটোন শিল্পীর সাথে হাজারিকার দেখা হয় নিউ ইয়র্কে। পঞ্চাশের দশকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূপেন যখন পিএইচডি করছেন, তখন রোবসন সম্ভবত নিউ ইয়র্কের হারলেমের বাসিন্দা। রোবসন বিশের দশকে নিউ জার্সির রাটগারসে পড়েছেন, নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া থেকে এলএলবি পাশ। তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে ছিল ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে। ভূপেনের সাথে যখন তাঁর দেখা হয়, তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় আর প্রকাশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিনের প্রশংসা করার কারণে তিনি একঘরে

“শোবোট” চলচ্চিত্রটা ব্রডওয়ে মিউজ়িক্যাল থিয়েটারের একটা নাটক অবলম্বনে তৈরি। নাটকটার কাহিনীও এডনা ফার্বার রচিত একই নামের বেস্টসেলার উপন্যাস থেকে নেয়া। গল্পটা ১৮৮০এর দিককার মিসিসিপি নদীর ভ্রাম্যমান জাহাজ-থিয়েটার নিয়ে, যাকে সবাই চিনত শোবোট হিসাবে। অনেকটা আমাদের দেশের ভ্রাম্যমাণ সার্কাস বা যাত্রাদলের মত এরা মিসিসিপি ধরে সারা বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিড-ওয়েস্ট আর সাউথের মধ্যে আপ-ডাউন করত। গ্রামে-গঞ্জে মুভি থিয়েটার গজিয়ে উঠেনি তখনও। নদীতীরের কোন গ্রামে একটা শোবোট আসলে তাই সাড়া পড়ে যেত, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলে ছুটে আসত মজা দেখতে।

সেই কাহিনীর একটা চরিত্র জো, তাকে এই দৃশ্যে রূপ দিয়েছেন পল রোবসন। সে শোবোটের কুলি। জাহাজে যতরকম সাপ্লাই লাগে, সেসব ভারি ভারি জিনিসপত্র কূল থেকে নিয়ে আসতে হয় তাকেই। এখানে সে গান ধরেছে মিসিসিপি নদকে উদ্দেশ্য করে। লিংকনের ১৮৬৩এর ইম্যানসিপেশন প্রক্ল্যামেশনের পরেও তার মত কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে মুক্তি নেই। জমি-জমা নেই, ভোটাধিকার নেই, নেই শিক্ষা-দীক্ষা-চাকরির গ্যারান্টি। সমান পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সাদাদের থেকে অনেক বেশি হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি করতে হয়। জো তাই মিসিসিপি নদকে একরকম আদর করেই বকছে ওল’ ম্যান বলে, কারণ হাজার বছর ধরে সে বুড়ো বয়েই চলেছে, কোনদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে জানে অনেক কিছুই, কিন্তু মুখটি খুলবে না!

আমেরিকার গৃহযুদ্ধে উত্তরের ইউনিয়নের সেনাবাহিনী দক্ষিণের বিদ্রোহী কনফ়েডারেটদের বিরুদ্ধে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জিতেছিল। দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক উচ্ছেদও করেছিলেন লিংকন। কিন্তু সে বিজয়ের মূল্যবোধটাকে ধরে রাখা বোধ হয় যুদ্ধে জেতার থেকে বেশি কঠিন ছিল।

যু্দ্ধের পরে রাজনৈতিক একতার খাতিরে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ ডেমোক্রাটদের সাথে আপোসরফার ভিত্তিতে সংস্কার করতে চাইলেন। আর সেসবের একটা ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকাররোধ। তার ওপরে দক্ষিণের স্টেটগুলির ডেমোক্রাট সরকার ব্ল্যাক কোডস বলে বর্ণবাদী আইন প্রণয়নের কারণে র‍্যাডিক্যাল রিপাবলিকানরা গেল খেপে। ১৮৬৮এর নির্বাচনে জেতার পরে তারা ফ়েডারেল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে একরকম মার্শাল ল’ জারি করলো দক্ষিণের স্টেটগুলোতে। সেখানে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, মুক্ত ক্রীতদাস, দক্ষিণের কিছু রিপাবলিকান সমর্থক আর দক্ষিণাদের কাছে কার্পেটব্যাগার নামে কুখ্যাত উত্তর থেকে আসা সুযোগসন্ধানীরা একত্র হয়। তারা স্টেট পর্যায়ে রাজনৈতিক আর শিক্ষা অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদারনৈতিক সংস্কার করে। এই সংস্কার ইতিহাসে পরিচিত ‘রিকনস্ট্রাকশন’ নামে।

কিন্তু একে সাদার্ন ডেমোক্রাট আর তাদের সমর্থিত বর্ণবাদী গুপ্তসংস্থা কু ক্লাক্স ক্লান সেকেলে সাদার্ন সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসাবে চিত্রায়িত করে। তারা রিপাবলিকান আর কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা আর গুপ্তহত্যা শুরু করে। এদের মোক্ষম সুযোগ আসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের দ্বিতীয় টার্মের শেষে। ১৮৭৬এর নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ ভোটচুরি করে আর কালোদেরকে ভয় দেখিয়ে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখে তারা। সেভাবে এরা স্টেট সরকারগুলির দখল নেয়, আর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রাদারফ়োর্ড হেইজ়কে প্রায় হারিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট পদের বিনিময়ে কমপ্রমাইজ়স্বরূপ রিপাবলিকানরা দক্ষিণের শেষ তিনটা স্টেট থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে। রিকনস্ট্রাকশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারপর সাদার্ন ডেমোক্রাট সরকারদের শাসনে কালোদের অবস্থা আবার যেমনকার তেমন, শুধু দাসত্বশৃংখল বাদে। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলিতে নতুন আইনকানুন জারি হল যাদের বলে ‘জিম ক্রো ল’জ়’। সেগুলির মূল লক্ষ্য ছিল কালোদের (আর আইনী ভাষায়, কিছু গরীব সাদাদেরও!) ‘সমান কিন্তু আলাদা’ বন্দোবস্ত রাখা। সোজা কথায় বর্ণবিভেদ বা সেগ্রেগেশন!

গৃহযু্দ্ধের পরপরই কালোদের যেটা দরকার ছিল সেটা হলো, ক্রীতদাস থেকে যাতে তারা শেয়ারক্রপার ভূমিদাস না হয়ে যায় তার জন্যে অর্থনৈতিক সাহায্য। লিংকন তাই চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁকে মেরে ফেলে জন উইল্কস বুথ। আর সদ্য-নিঃস্ব শ্বেতাঙ্গ তুলাচাষীদেরও দরকার ছিল ফ্রী মার্কেট লেবারের কিছুটা গ্যারান্টি। কিন্তু সবকিছু রাজনীতির প্যাঁচে ওলট-পালট হয়ে যায়। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো সাত-আট দশক

শোবোট ছবিটাতে আরো অনন্য কিছু ব্যাপার দেখবেন, যেমন ১৮৮০র দিকে সাদা-কালো মিশ্র বিয়ের ব্যাপারটা কিভাবে দেখা হত। ছবিটি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা শতবর্ষের সেরা একশো মার্কিন ফিল্মের তালিকায় প্রায় প্রতিবছরই থাকে।

আমেরিকার মিসিসিপি থেকে বাংলার গঙ্গা — গণমানুষের গায়ক হিসাবে ভূপেন হাজারিকা  একটা চমৎকার দেশ-কালাতিক্রমী  সমান্তরাল গান-সুর নিয়ে এসে উপহার দিয়েছেন আমাদেরকে। ৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর ৯২তম জন্মবার্ষিকী। শ্রদ্ধা তাঁর আর তাঁর প্রতিভাবান বন্ধুর প্রতি!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!