তান্নু তুভা

আজ যে দেশটির ডাকটিকেট দেখাচ্ছি ত্রিশ দশকের ম্যাপসহ, তার স্বাধীন অস্তিত্ব আর নেই। ১৯২১ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত নামমাত্র স্বাধীন দেশটির নাম তুভা।

১৯৩৬ সালের তুভার এই ডাকটিকেটে দেখা যাচ্ছে রেলের সাথে উটের দৌড়। প্রকৃতপক্ষে তুভায় কোন রেললাইন ছিল না। তুভার ‘উন্নয়নের’ মিথ্যে প্রচারনার উদাহরণ এ ডাকটিকেট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

মোঙ্গোলিয়া আর রাশিয়ার মাঝে স্যান্ডইউচ দেশটি এখন রাশিয়ার একটি স্টেট। ১৯১১ পর্যন্ত এটি চীনের চিং সাম্রাজ্যের করদ রাজ্য মোঙ্গোলিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার অনেকগুলি স্বাধীন রাজ্যকে ‘কলোনাইজ’ করে। তাদের মধ্যে রয়েছে কাজ়াখ়, বুখা়রা, খ়িভ়া, কোকন্দ প্রভৃতি খা়নাত আর তুর্কমেন-কিরগিজ় যাযাবরদের একাধিক গোত্র। এর আগেই অবশ্য ষোড়শ শতকে ইভ়ান দ্য টেরিবলের সময় সাইবেরিয়ার সিবির খা়নাতকে বশ করার মাধ্যমে মস্কোর ছোট্ট স্লাভিক রাজত্বটি রুশ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

উপরের দেশগুলি যখন স্বাধীন ছিল, তখন সভ্যদেশে ডাকটিকেটের প্রচলন থাকলেও এরা অনগ্রসর মধ্যযুগীয় রাজ্য হওয়ায় টিকেট ছাড়ত না। তাই রুশ ‘কলোনাইজেশনের’ প্রমাণ হিসাবে সেসব জাহির করতে পারছি না। কাছাকাছি যেটা পড়ে, সেটা এই তুভার স্ট্যাম্প। কলোনাইজেশনের ফর্মুলাটা বলছি। এর সাথে ১৮৩৬এ টেক্সাসের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্ত হবার ফর্মুলার মিল আছে — বেমিলও আছে।

তুভায় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকেই রুশ বণিক, র‍্যাঞ্চার, আর শিকারীরা চিং সাম্রাজ্যের ফরমান নিয়েই আনাগোনা করত। তারা বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় ফার্ম গড়ে তোলে। শিকারীরা সেখানকার লোমশ জানোয়ার মেরে তাদের ফার নিয়ে বেঁচতো রাশিয়ার বনেদী পরিবারগুলির কাছে।

১৯১১তে চীনের মানুষ চিং সাম্রাজ্যের উপর যারপরনাই বীতশ্রদ্ধ ছিল। বিদেশীদের কাছে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত্ব স্বার্থ বিকিয়ে দেয়া ছিল তাদের অসন্তুষ্টির মূল কারণ (বক্সার বিদ্রোহ, ১৮৯৯-১৯০১)। ফলে চিংদের বিরুদ্ধে শিনহাই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়, প্রতিবাদের মুখে ‘বিধবা-সম্রাজ্ঞীর’ হাতের পুতুল ছয়বছরবয়েসী পুত্র সম্রাট পু-য়ী রাজসিংহাসন পরিত্যাগ করেন । পরিশেষে সুন-ইয়াত-সেনের নেতৃত্বে চীনা জাতীয়তাবাদী দল কোমিনতাং প্রভিশনাল প্রজাতন্ত্রী সরকার গঠন করে।

ত্রিশ দশকের এই মানচিত্রে তুভার অবস্থান দেখানো হয়েছে — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

১৯১১তে চীনের এই দুর্বলতার সুযোগে মোঙ্গোলিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এসময় মোঙ্গোলদের মত তুভার জনগণও অনেকটা হাভাতে জীবনযাপন করছিল। একটা কারণ রুশ ফারশিকারীদের অতিশিকারের কারণে তাদের অন্নসংস্থান কমে যাওয়া, তার ওপর অজন্মা খরা। একদল তুভান নেতা চাইলো মোঙ্গোলিয়ার সাথে যোগ দিতে, আরেকদল চাইলো রুশদের ‘প্রোটেকশন’। কারণ মোঙ্গোলদের থেকে তাদের তুর্কীজাতীয় ভাষা-সংস্কৃতি ভিন্ন, শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মে দু’জাত মিলে।

রুশ সম্রাট নিকোলাস প্রথমে মনোস্থির করতে না পারলেও শেষ পর্যন্ত রুশ কলোনিস্ট আর ট্রেডারদের চাপে অজুহাত দাঁড়া করালেন যে তুভায় রুশদের ওপর আক্রমণ হচ্ছে, আর তাদের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব তাঁর সেনাবাহিনীর। রুশ সেনাদল প্রথমে একটা ক্ষণস্থায়ী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করলো রুশপন্থী তুভানদের, পরে সে প্রজাতন্ত্র রাশিয়ার অংশ হয়ে গেল।

এখানেই কাহিনী শেষ নয়। ১৯১৭তে রুশ সাম্রাজ্যের বহুদিনের নড়বড়ে ভিত ভেঙে পড়ল বলশেভিক বিপ্লবের আঘাতে। মস্কো-পেত্রোগ্রাদসহ অল্পকিছু শহরে কম্যুনিস্টরা সরকারের দখল নিলেও প্রাদেশিক অঞ্চলগুলি ৎসারপন্থী ‘শ্বেত রুশ’ জেনারেলদের দখলে ছিল। সেসব অঞ্চলে তারা নিজেদের ইচ্ছেমত স্বাধীন সরকার গঠন করা শুরু করে

সেই রুশ গৃহযুদ্ধের সময়ে ১৯১৮তে তুভা প্রথমে দখল করে এক শ্বেতফৌজ জেনারেল কোলচাক। কিন্তু এক বছর পরেই তুভার দখল চলে যায় চীনা ও মোঙ্গোল সেনাদলের কাছে। কম্যুনিস্ট লালফৌজ ধীরে ধীরে যখন শ্বেতরুশদের হারিয়ে দেয়া শুরু করে, তখন তারা ১৯২১এ তুভায় ঢুকে চীনাদের হটিয়ে দেয়। আর তুভার বলশেভিক কমরেডদেরকে দিয়ে নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় — তুভান পিপলস রিপাবলিক

তান্নু-তুভা নামে নতুন ‘স্বাধীন’ দেশটিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল কেবলমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মোঙ্গোলিয়া। ছোট দেশটি এত সুদূর আর বিচ্ছিন্ন যে তারা স্বাধীন না পরাধীন নাকি পাপেট, তাতে বাকি বিশ্বের কিছু যেত-আসত না। কিন্তু তুভা ডাকটিকেট ইস্যু করত। আর সেগুলিও ছিল নানা রঙের, আর ত্রিভুজ, প্যারালেলোগ্রাম, ডায়মন্ড, ইত্যাদি অদ্ভূত আকারের। তাই যখন বহির্বিশ্বের মানুষের হাতে এসে পড়ত, সবাই তখন আহা-উহু করত

তুভার প্রথম প্রধানমন্ত্রী কু’লার দোন্দুকের মাথায় স্বাধীন চিন্তা ঘুরপাক খাওয়া অবশ্য রুশরা থামাতে পারেনি। প্রাক্তন বৌদ্ধ শ্রমণ সেই রাষ্ট্রনায়ক চেষ্টা করেন মোঙ্গোলিয়ার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করতে, আর বৌদ্ধ ধর্ম ও লামাদেরকে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। সমাজতান্ত্রিক পলিসিকেও পাশ কাটিয়ে চলা শুরু করেন তিনি।

১৯২৬এ দোন্দুক বৌদ্ধ ধর্মকে যখন রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন, তখন স্তালিনের টনক নড়ল। মস্কোর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ তুভান ছাত্রকে দেশে ফেরত পাঠালেন। তারা তুভায় এসে ‘জনসংগ্রাম’ সংগঠিত করতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত ১৯২৯এ কু’র মাধ্যমে দোন্দুককে অপসারণ করা হয়। পাঁচ জনে মিলে সোভিয়েত স্টাইল সরকার দাড়া করায়। জোরপূর্বক যৌথখামারব্যবস্থা চালু করে; মোঙ্গোল বর্ণমালা উচ্ছেদ করে প্রথমে লাতিন ও পরে সিরিলিক অক্ষরের ব্যবহার চালু করে ; রুশদের নাগরিকত্বপ্রদান শুরু করে; আর বৌদ্ধ ধর্মের লামা আর প্রাচীন ধর্মের শামানদের জেলে পোরা শুরু করে। ১৯৩২ সালে দোন্দুককে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়।

উপরের স্ট্যাম্পটি তার পরবর্তী সময়ের। ১৯৩৬ সালের। বাইরের মানুষ যদিও ভাবত এসব ডাকটিকেট তুভা থেকে প্রকাশিত, তারপরও পারতপক্ষে এগুলি তুভার আলোবাতাস আদৌ পেয়েছে কিনা সন্দেহ! কারণ এগুলি প্রিন্ট করা হয়েছে মস্কোর অফিশাল সোভিয়েত প্রেসে! হয়ত কিছু তুভাতে পাঠানো হয়েছে — তুভার মত বিস্তীর্ণ কম জনধ্যুষিত দেশে সেগুলির কি ব্যবহার ছিল স্তালিনই বলতে পারতেন ভাল! কিন্তু বাকি বিশ্বের ফিলাটেলিস্টদের কাছে এসব স্ট্যাম্প বিকোত বেশ, আর তার থেকে দু’পয়সা কামাই করে নিত সোভিয়েতরা (তখনও তারা সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠেনি)।

এ ডাকটিকেটে দেখানো হচ্ছে যে রেলগাড়ির সাথে রেইস দিচ্ছে ব্যাক্ট্রিয়ান ঊট। ভাবখানা এমন যে, তুভায় এতই প্রগতির বন্যা বইছে যে ঊটকে নিজের চাকরি বহাল রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে!

বাস্তবতা হলো, তুভাতে সে আমলে কোন রেললাইনই ছিল না, আর এই একবিংশ শতকেও নেই!

তুভাকে অবশ্য বেশিদিন এই ড্রামার ভিক্টিম হতে হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে স্তালিন যখন ১৯৪৪এর অক্টোবরে জার্মান বাহিনীকে সাঁড়াশি অভিযান করে ইউক্রেইন, বেলারুশ, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্তোনিয়া থেকে উৎখাত করছেন, আর একে একে এ দেশগুলিকে ‘এসএসআর’ নাম দিয়ে ‘মুক্ত’ করে দিচ্ছেন, আর তারা বেজায় খুশি হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দিচ্ছে, তখন কোন এক সকালে উঠে তুভাবাসী দেখে তারাও কোন ফাঁকে ‘এসএসআর’ নয়, রুশ এসএসআরের ‘ওব্লাস্ত’ (প্রদেশ) হয়ে গেছে! তাদের সংসদ ‘খুরালে’ কোন ভোটাভুটি ছাড়াই রাবারস্ট্যাম্প মেরে রাশিয়ার কাছে যা স্বাধীনতা ছিল — স্ট্যাম্প ইস্যু করার অধিকারসহ — দেশনেতারা বেঁচে দিয়েছে!

আজ তুভা রুশ ফেডারেশনের ৮৫টি ফেডারেল সাবজেক্ট, যার মধ্যে ২২টি রিপাবলিক, তাদের একটি রিপাবলিক। এখনো দেশটি বিচ্ছিন্ন, প্রত্যন্ত। রেললাইন একটা চালু হবার কথা ২০২০ সালে।

তুভানদের সংস্কৃতি, বিশেষ করে মোঙ্গোলদের মত থ্রোট সিঙ্গিং
, পশ্চিমা বিশ্বে বেশ মনোযোগ কেড়েছে। সেটা শোনার জন্য ইউটিউবে হুন-হুর-তু (Huun Huur Tuu) কিংবা কোঙ্গার-ওল ওন্দার (Kongar-ol Ondar) খুঁজে দেখুন


(১) খা়নাত হলো ‘খা়ন’শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য। এরা মুসলিমও হতে পারে, বৌদ্ধও হতে পারে, শামানও হতে পারে। খা়ন শব্দটি মূলে তুর্কী-মোঙ্গোল, আরবী নয়। চেঙ্গিস খা়ন মুসলিম ছিলেন না! [Khanate]

(২) এখানে অবশ্য পু-য়ীর কাহিনী শেষ না, আবার তাঁকে দেখা যাবে জাপানের পাপেট স্টেট মাঞ্চুরিয়ার নামমাত্র ‘সম্রাট’ হিসাবে! [Henry Puyi]

(৩) বিভিন্ন শ্বেতফৌজ জেনারেলও রাশিয়ার সাম্রাজ্যের কোন না কোন এলাকায় ৎসার নিকোলাসকে রাজা মেনে স্বাধীন রাজ্য বানিয়ে ডাকটিকেট ছাড়ত, সেগুলি বেশ চমকপ্রদ আইটেম! [White Movement]

(৪) মোঙ্গোলিয়াতেও লালফৌজের প্রচ্ছন্ন সহায়তায় গঠিত হয় কম্যুনিস্ট সরকার। সোভিয়েত রাশিয়া বাদে তাই মোঙ্গোলিয়া একটি মাত্র দেশ যেখান সাত দশক কম্যুনিজম চলেছে। [Mongolian People’s Republic]

(৫) পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানও তান্নু-তুভার পোস্টেজ স্ট্যাম্প দেখে খুবই শখ করেছিলেন সেখানে যাবার। কিন্তু মার্কিনদের জন্যে সোভিয়েতের সুদূর একটি অঞ্চলে যাওয়া ছিল অকল্পনীয়, বিশেষ করে যখন সোভিয়েতদের পর্যটনশিল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের প্রগতিশীলতা জাহির করা, তুভার মত প্রত্যন্ত পশ্চাদপর সমাজব্যবস্থা দেখালে উল্টোফল। ১৯৮৮ সালে ফেইনম্যানের স্বপ্ন পুরো হবার আগেই তিনি ক্যান্সারে মারা যান। তার ঠিক পরপরই তার তুভা যাবার ভিসা হাজির হয়। [Tuva or Bust!]

(৬)কামাল আতাতুর্কের তুর্কী-আরবী থেকে লাতিনে যাবার মত। খোলস পাল্টে কিছু একটার চেহারা পরিবর্তনই ছিল এসকল ‘রিফর্মার’দের প্রগতিশীলতার উদাহরণ। এতে সামাজিক বাস্তবতার তেমন কোন পরিবর্তন হয় না। [Turkish Alphabet Reform]

(৭) সোভেতস্কায়া সোৎসিয়ালিস্তিচেস্কায়া রেসপুবলিকা — এ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নামেমাত্র স্বতন্ত্র ১৫টি প্রজাতন্ত্রের গালভরা অফিশাল নাম, সোভিয়েত সোশালিস্ট রিপাবলিক। [Republics of the Soviet Union]

(৮) থ্রোট সিঙ্গিং এক অদ্ভূত ‘এলিয়েন’ টাইপের গান, ফুসফুস থেকে গলা পর্যন্ত প্রায় প্রতিটা চেম্বারের রেজোন্যান্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে আওয়াজ তুলতে পারলে মনে হয় যে একই মানুষ দুই বা ততোধিক টোনের শব্দ করছে! একে ওভারটোন সিঙ্গিংও বলে। তিব্বতী বৌদ্ধ শ্রমণরাও এভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করে। মোঙ্গলদের পাশাপাশি তুভান আর আরো কিছু পূর্ব সাইবেরীয় গোত্রের এ ঐতিহ্য রয়েছে। [Overtone Singing]

(৯) টেড-এক্সের একটা তুভান থ্রোট সিঙ্গিং ভিডিও [Tuvan Throat Singing | Alash | TEDxBaltimore]

ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস

১৯১৪ সালে সার্বিয়া নামের ছোট্ট, কিন্তু দাম্ভিক, স্লাভিক জাতীয়তাবাদী রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটিকে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির যৌথ সাম্রাজ্য আক্রমণ করে বসে। আর তার ফলে শুরুতে ইউরোপ, পরে বিশ্বব্যাপী ইউরোপীয় কলোনিগুলি, আর শেষে নব্যপরাশক্তি জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র, জড়িয়ে পড়ে সাড়ে তিন বছর দীর্ঘ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে (১৯১৪-১৯১৮)।

ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে ইউরোপে এথনিক-লিংগুইস্টিক জাতীয়তাবাদ ছিল বেশ জনপ্রিয়। এর ফলশ্রুতিতে ছোট-মাঝারি কয়েকটি রাজ্য নিয়ে উত্তরে ও দক্ষিণে দু’টি নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা হয় — বিসমার্কের জার্মানি (১৮৭১) ও গারিবাল্দির ইতালি (১৮৬১)।

ডানপন্থী জাতীয়তাবাদের পাশাপাশি বামপন্থী অ্যানার্কিজ়ম, বিপ্লবী কম্যুনিজ়মও যে জনপ্রিয় হচ্ছিল বলা বাহুল্য। পুরনো সাম্রাজ্যগুলির দুর্বলতার সুযোগে তাদেরও সফল ও বিফল উত্থান ঘটে বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে (বলশেভিক বিপ্লব, ১৯১৭; সোভিয়েত হাঙ্গেরি, ১৯১৯; জার্মানির স্পার্টাসিস্ট বিদ্রোহ, ১৯১৯)। আর জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে মুলত অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি ও রাশিয়া ভেঙ্গে নতুন কয়েকটি দেশ ইউরোপের মানচিত্রে স্থান পায় (চেকোস্লোভাকিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া)।

ঊনবিংশ শতকে ইউরোপের রাজপরিবারগুলি নাপোলেওনের সময়কার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ (১৮০৩-১৮১৫) এড়ানোর জন্যে একে অন্যের সাথে সামরিক সমঝোতা চুক্তি করা শুরু করে। নানা চুক্তির জালের বুনটে সংরক্ষিত হয় ছোট রাজ্যগুলির নিরাপত্তা, স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স, ইত্যাদি। তার ওপর রাজপরিবারগুলি একে অন্যের সাথে আত্মীয়তার বন্ধনে জড়িয়ে আরেক লেভেলের ‘নিরাপত্তা’ তৈরি করে। যেমন, রুশ ৎসার নিকোলাস ছিলেন ব্রিটিশরাজ পঞ্চম জর্জের আপন খালাত ভাই, তাঁদের ছবি দেখলে তাঁদের আলাদা করে চেনার উপায় নেই। এধরনের ভূরাজনৈতিক ব্যবস্থা পরিচিত ছিল ‘ব্যালান্স অফ গ্রেট পাওয়ারস’ বলে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থামানো তো দূরের কথা, এ ব্যবস্থা একদিক থেকে দায়ী ছিল যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির জন্যে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ অনেক গভীর, একটি কারণ জার্মানির উচ্চাকাংক্ষা। উডরো উইলসনের ভাষায় “ব্রিটেন হ্যাজ় দ্য আর্থ, এন্ড জার্মানি ওয়ান্টস ইট।” এটুকু কথার পিছনে অনেক লম্বা ইতিহাস রয়েছে। শিল্পায়ন যুগের শেষভাগে কাঁচামাল আর বাজারের জন্যে প্রতিযোগিতা, বাণিজ্যিক ও সামরিক সাম্রাজ্য গড়ার প্রচেষ্টা, ইত্যাদি। সে চিত্রে জার্মানি ছিল লেইটকামার। শেষে এসেও যুদ্ধবিগ্রহের সুযোগ নিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়া ছিল জার্মান শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এধরনের “রেয়ালপলিটিক” (“বাস্তবতাভিত্তিক কূটনীতি”) জার্মানির রূপকার বিসমার্কেরই সিগনেচার কৌশল। এর সফলতার কারণেই প্রুশিয়া নামক সামরিক রাষ্ট্র থেকে জার্মান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা ও বিকাশ হয় (১৮৭১-১৯১৯)।

অর্থাৎ বিশ্বযুদ্ধের আগে থেকেই তার যথেষ্ট বারুদ তৈরি ছিল।

আর সে বারুদে যে স্ফূলিঙ্গটি বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে, তা হলো বসনিয়ায় সার্ব আততায়ীর হাতে ডাকটিকেটে দেখানো অস্ট্রীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়ার মৃত্যু (জুন ২৪, ১৯১৪)।

১৯১৭ সালে বসনিয়ায় অস্ট্রীয় সামরিকবাহিনীর ব্যবহারের জন্য প্রকাশিত এই ডাকটিকেটে স্মরণ করা হয়েছে ১৯১৪ সালে সার্ব আততায়ীর হাতে নিহত আর্চডিউক ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড ও তাঁর স্ত্রী সোফিয়াকে — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের যুবরাজ হবার কথা ছিল না। অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির রক্ষণশীল সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের একমাত্র পুত্র রুডল্ফ ত্রিশ বছর বয়সে পরকীয়া প্রেমের সূত্র ধরে প্রেমিকার সাথে আত্মহত্যা করেন ১৮৮৯ সালে। সেসময় নাকি তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। ফলশ্রুতিতে, ফ্রানৎস ইয়োসেফের ছোট ভাই কার্ল লুডভ়িগ হন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। ১৮৯৬ সালে তাঁরও মৃত্যু হয় — প্যালেস্টাইনের ‘পবিত্র’ জর্দান নদীর নোংরা পানি খেয়ে টাইফয়েডে ভুগে। তখন তাঁরই ছেলে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ওপর যুবরাজ হবার গুরুদায়িত্ব বর্তায়।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সেকারণে অনেক দেরিতে রাজশাসনের উপযোগী শিক্ষালাভ শুরু করেন। বৃদ্ধ সম্রাট ফ্রানৎস ইয়োসেফের সাথেও ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। ‘বুড়ো ভামকে’ অতিরিক্ত রক্ষণশীল ভাবতেন তিনি। বিয়েও করেন রাজপরিবারের ঐতিহ্যের বাইরে। তাতে সম্রাট সায় দেন শুধুমাত্র একটি শর্তে, যে বিয়েটি হবে ‘মর্গানিটিক’। অর্থাৎ রাজকার্য, উপাধি, ইত্যাদিতে সোফিয়া আর তাঁর ছেলেমেয়েদের কোন দাবি থাকবে না। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড মারা গেলে তাঁর বংশধরের পরিবর্তে সম্রাট হবেন ফ্রানৎস ইয়োসেফের আরেক ভাতিজা কার্ল।

শিকারপাগল ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের ১৮৯২-৯৩এর ভারতভ্রমণের সময়কার ছবি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

জার্মানির সমস্যা ছিল তার শাসকগোষ্ঠীর জার্মান-জাতীয়তাবাদী ঔদ্ধত্য, আর অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সমস্যা ছিল তার উল্টো। জাতিগতভাবে জার্মান, আর ধর্মে ক্যাথলিক, হাবসবুর্গ গোষ্ঠীর সম্রাটরা কয়েক শতাব্দী ধরে সার্ব, ক্রোয়েশিয়ান, স্লোভেনিয়ান, চেক, স্লোভাক, ইউক্রেনিয়ান, রোমানিয়ান, পোলিশ, ইতালিয়ান, ইত্যাদি নানা ভাষা ও জাতের প্রজাদেরকে শক্ত হাতে শাসন করে চলছিল। ১৮৪৮ সালে সে ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসে হাঙ্গেরির মাগিয়ার জাতিগোষ্ঠীর বিপ্লবের মাধ্যমে। অস্ট্রিয়ার শাসকরা রাজি হন সাম্রাজ্যকে দু’টি সমকক্ষ রাজত্বে ভাগ করে একভাগের শাসনভার মাগিয়ারদের দিতে, অবশ্য রাজা-সম্রাট থাকবেন একই হাবসবুর্গ উত্তরসূরী।

এতে সমস্যার তেমন কোন সমাধান হয়নি। কারণ মাগিয়াররা আরো ক্ষমতাবান হয়ে অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা শুরু করে। অপরদিকে অস্ট্রীয় জার্মানরাও সামরিক অভিযানের মাধ্যমে প্রাক্তন তুর্কী প্রদেশ বসনিয়া-হারজেগোভিনাকে হস্তগত করে তাকে ‘প্রতিরক্ষার’ নামে (বসনিয়া-হারজেগোভিনা প্রটেক্টোরেট, ১৮৭৮)।

অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরিকে প্রদেশে ভাগ করে কিভাবে ফেডারেল পদ্ধতিতে শাসন করা সম্ভব, ১৯০৬এ তার একটা প্রস্তাবনা করেছিলেন এক রোমানিয়ান বুদ্ধিজীবী আউরেল পপভিৎস। ফরাসী ভাষার মানচিত্রে এই বৃহত্তর অস্ট্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রাদেশিক বিভাগ দেখানো হয়েছে। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

এসব কারণে জার্মান-মাগিয়ার বাদে বাকি সকল এথনিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে স্লাভরা, যারপরনাই অসন্তুষ্ট ছিল। আর দু-দু’টো বল্কান যুদ্ধে ‘ইউরোপের সিক ম্যান’ তুরস্ককে পরাজিত করে সার্বিয়া-বুলগেরিয়ার মত দেশগুলি সে এলাকার সামরিক পরাশক্তিগুলির মাঝে যথোপযুক্ত স্থান করে নেয়। সার্বিয়ার পরবর্তী লক্ষ্য হলো আরেক ‘সিকম্যান’ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরীর ‘নিষ্পেষিত’ স্লাভিক জনগোষ্ঠীদের ‘মুক্ত’ করে উত্তরের তুতো ভাই রুশদের মত দক্ষিণেও সর্ব-স্লাভিক দেশ ‘ইউগোস্লাভিয়া’ কায়েম করা। সে লক্ষ্যে বসনিয়ার সার্ব স্বাধীনতাসংগ্রামীদের (বা সন্ত্রাসবাদীদের) গোপনে রসদ সরবরাহ করে সার্বিয়া। সংগঠিত হয় ইয়ং বসনিয়া আর ব্ল্যাক হ্যান্ডের মত গুপ্তদল।

১৯১৪ সালের ২৪শে জুন ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড সস্ত্রীক বসনিয়ার সারায়েভো পরিদর্শনে আসেন। সকালেই তাঁর মোটর শোভাযাত্রার ওপর পরিকল্পিত গ্রেনেড হামলা করে ইয়ং বসনিয়ার এক সদস্য। সে যাত্রা বেঁচে যান অস্ট্রিয়ার যুবরাজ, শুধু পিছনের গাড়ির কয়েকজন আহত হয়। ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড গভর্নরের প্রাসাদে পৌঁছে বেশ হম্বিতম্বি করেন, তারপর দুঃসাহস দেখিয়ে দিনের বাকি কর্মসূচীপালনের জন্যে আবার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিছু বিভ্রান্তির কারণে গাড়িবহর পথে বিলম্বিত হয়। ভাগ্যের ফেরে সেপথের পাশেই এক কাফেতে বসে কফি খাচ্ছিল গাভ্রিলো প্রিন্সিপ বলে ইয়ং বসনিয়ার আরেক সদস্য। সকালের বিফল সাথীর কার্যসিদ্ধি করবে কি করবে না সে নিয়ে দোনমনা করতে করতেই গাভ্রিলো কাফে থেকে বের হয়ে সাথে থাকা রিভলভার দিয়ে ক্লোজ রেঞ্জে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড আর সোফিয়াকে গুলি করে বসে। যথোপযুক্ত পরিচর্যা সাথে সাথে না পাওয়ায় দু’জনেই কয়েক মিনিটের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।

এরপরে সূচনা হয় ১৯১৪এর জুলাই সংকট — অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি কঠিন শর্তের আল্টিমেটাম দেয় সার্বিয়াকে। আক্রান্ত হলে সার্বিয়াকে তাদের তুতোভাই রুশরা সাহায্য করবে, এ ভরসায় সার্বরা আল্টিমেটামকে পাশ কাটিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় দুজনের মধ্যে। রুশরা ঠিকই আসে সার্বদের সাহায্যে। জার্মানিও আরো সাম্রাজ্যের লোভে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। আর রুশদের মিত্র, ত্রিপল-অঁতঁতের অপর দুই দেশ ব্রিটেন-ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তুরস্কও অক্ষশক্তির সাথে যোগ দেয় এই ভেবে যে রুশ আর স্লাভদের কাছে খোঁয়া যাওয়া আগের সাম্রাজ্য পুনরোদ্ধার হবে।

ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের মৃত্যুতে বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো, এ ভাগ্যের পরিহাস! কারণ, ফ্রানৎস ফেরডিনন্ড অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির সাম্রাজ্যে জার্মান-মাগিয়ারদের একাধিপত্য খর্ব করে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীকে সমাধিকার দেয়ার ব্যাপারে উদারপন্থী ছিলেন। তাতে নিজের সর্বময় ক্ষমতা অবশ্য অটুট রাখতে পিছপা ছিলেন না। বেঁচে থাকলে আর রাজসিংহাসনে বসলে হয়ত কোন না কোন উপায়ে নিজ রাজ্যের সমস্যাগুলি সমাধানের চেষ্টা করতেন।

এখানে আরেকটা তুলনা উল্লেখযোগ্য। ওসমানি তুরস্ক আর হাবসবুর্গ অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি — এ দুটি দেশের সমস্যাগুলি একই রকম ছিল। দুটোতেই সম্রাট সর্বেসর্বা — সংসদ নামেমাত্র। তাছাড়াও অস্ট্রিয়ার কাইজ়ার একই সাথে হোলি রোমান এম্পেরর — অর্থাৎ ক্যাথলিককূলের ধ্বজাধারী রক্ষক। তুরস্কের সুলতানও সেরকম নমিনাল ‘আমিরুল মুমিনীন’ — তাবৎ মুসলিমদের ঈমানের রক্ষক। দুটো দেশেই ইহুদী-খ্রীষ্টান-মুসলিম আরব-তুর্কী-আর্মানী-ফার্সী চেক-স্লোভাক-ক্রোয়েশীয়-পোলিশ ইত্যাদি নানা জাতি ও ভাষার জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। দুটোই ছিল একরকম ‘সিক ম্যান’ — অর্থাৎ সামরিক প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রগতিশীলতার বিচারে পশ্চাদপর। আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে দুটো দেশই টুকরো টুকরো হয় যায়।

তফাত হলো, অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির টুকরোগুলি দেশে পরিণত হয় তাদের জাতিস্বত্ত্বার ইচ্ছানুযায়ী। সেসব আত্মসমর্পণের চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও উডরো উইলসন জড়িত ছিলেন, যাঁর মূল লক্ষ্য ছিল যেন সেসব নতুন দেশে কোন না কোন ধাঁচের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। কিছুটা সফলও হয়েছিল সে উদ্দেশ্য, চেকোস্লোভাকিয়া ভাল উদাহরণ। আবার উল্টোদিকে ইউগোস্লাভিয়ায় গণতন্ত্রের বদলে সার্বীয় রাজার ৎসারতন্ত্র কায়েম হয়।

তুরস্কের ক্ষেত্রে আত্মসমর্পণের চুক্তিতে মার্কিনদের আসন ছিল না। তুরস্কের জাতিস্বত্ত্বাগুলির নিজস্ব সিদ্ধান্তের বদলে বিজয়ী ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেদের ইচ্ছেমত ম্যাপ কাটাকুটি করে ভাগ করে নেয়। যার ফলে সিরিয়া ও ইরাকের মত দুটি ‘আর্টিফিশিয়াল’ দেশের উদ্ভব ঘটে, যার প্রজাদের জাতিগত পরিচয়ের মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। এখানেই কিন্তু তাদের পরবর্তী দুর্ভোগের বীজের বপন। সাথে কুর্দিস্তান-সৌদি-প্যালেস্টাইন-লিবিয়া ইত্যাদিরও ভাগ্যলিখন চূড়ান্ত হয়ে যায়। (সাইকস-পিকো অ্যাগ্রিমেন্ট, ১৯১৬)।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এত কিছু লেখার জন্যে শুরুতে বসিনি। চেয়েছিলাম আমার সংগ্রহের ঐ ডাকটিকেটটা জাহির করে ফ্রানৎস ফেরডিনন্ডের গল্প বলতে। কান টানতে মাথা চলে এল!


পুনশ্চ: চিন্তা করে দেখলাম সাইকস-পিকোকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে নির্দোষ বলা যায় কিনা। মনে হয় যায়। কারণ, সিরিয়া-ইরাকের যেসকল সমস্যা, সেসকল সমস্যা ইউগোস্লাভ জনপদগুলিরও ছিল, আর তাদেরও কপালে একই লিখন ছিল (নব্বই দশকের একাধিক যুদ্ধ ও প্রচুর পৈশাচিকতা ও লোকক্ষয়)। ইউগোস্লাভিয়া সেসকল তুর্কী সমস্যা ইনহেরিট করেছিল, গ্রীক-আলবেনীয়দের প্রচুর পকেট ছিল তাদের রাজ্যে যাদের তেমন কোন অধিকার স্লাভরা দেয়নি। অর্থাৎ সমস্যা একই — সাইকস-পিকো ছাড়াই।

আর ইউরোপের জাতিগোষ্ঠীগুলির জাতীয়তাবাদের কারণে তাদের ইতিমধ্যে স্বদেশের মানচিত্রের ধারণা ছিল। ইরাক-সিরিয়ার আলাউয়ী, শিয়া, সুন্নি, দ্রুজ, ইয়াজিদি, তুর্কমেন, এদের জাতীয়তাবাদের তেমন কোন ধারণাই ছিল না — আরব, আর্মনী আর কুর্দ বাদ দিলে। তাদের জনপদগুলিও ছিল ছড়ানো-ছিটানো, আলাদা করে অর্থবহ ভৌগোলিক ম্যাপ আঁকা মনে হয় না সম্ভব ছিল। পরবর্তীতে যখন জনসংখ্যা বাড়তে বাড়তে একেক জনপদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়, তখন থেকেই অধুনাযুগের টেনশনগুলির শুরু।

অর্থাৎ সেসময়ের নিরিখে হয়ত সাইকস-পিকো ছিল আরব স্বদেশভূমির একটি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ঔপনিবেশিক, সমাধান। আর তা না হলেও সাইকস-পিকোর সাধ্যি ছিল না এত কিছু বুঝে (বা না বুঝে) ভবিষ্যদ্দর্শনের।

(আর সাইকস-পিকোর আরেক পার্টনর ছিল রুশরা, পরবর্তী বলশেভিক সরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সাইকস-পিকোর হাড়ি হাঁটে ভেঙে দেয়।)

[Sykes–Picot Agreement]


close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!