ঊনবিংশ শতকে আফ্রিকার উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় উপনিবেশ গড়তে থাকে ফ্রান্স, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, জার্মানি ও ইতালি ১। ইতিহাসবিদরা এই উপনিবেশায়নের নাম দিয়েছেন ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’।
এসময় স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় দুটি দেশ, লাইবেরিয়া ও ইথিওপিয়া।
ইথিওপিয়ার মানবসভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বিশেষ করে লোহিত সাগরের দু’পারের আক্সুম সাম্রাজ্য আর আরব উপদ্বীপের সংস্কৃতি একে অপরকে প্রভাবিত করেছে কয়েকশ বছর ধরে ২।
ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে দেশে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট হন তেওদ্রোস। কিন্তু ব্রিটেনের সাথে বচসা বাঁধিয়ে যুদ্ধে হেরে শেষ পর্যন্ত তেওদ্রোস আত্মহত্যা করেন, আর ব্রিটিশরা তাঁর দুর্গ লুটতরাজ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। রাজপুত্র ও বিধবা রাণীকে রাজবন্দী করে তারা ব্রিটেনে নিয়ে যায় ৩।
এরপরের সম্রাট চতুর্থ ইউহানিস সুদানের মাহদী রাষ্ট্রের ৪ দরবেশ ফ্যানাটিকদের সাথে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৮৯এ সম্রাট হন দ্বিতীয় মেনেলিক। প্রথম ডাকটিকেটটিতে (১৮৯৪) তাঁরই ছবি।
ইউহানিসের সময় থেকেই অবশ্য আরেকটা নতুন বিদেশী শক্তির থাবা বিস্তৃত হচ্ছিল এ অঞ্চলে। সে হলো ইতালি।
ইতালি দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মোটে ১৮৬১ সালে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইতালির পুনরুত্থানের ৫ পর সেদেশের অভিজাতরা স্বদেশকে প্রাচীন রোমের আসনে পুনরোধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত প্রজাদের ব্যারামে আরাম দিতেও জাতীয়তাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ ছিল ভাল মলম। পূর্ব আফ্রিকা তাদের কাছে মনে হলো নতুন রোমান সাম্রাজ্য শুরু করার উপযুক্ত স্থান।
১৮৮৯এ দুয়েকটা খন্ডযুদ্ধে মেনেলিকের বিরুদ্ধে জিততে না পেরে ইতালি একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তাঁর সাথে, এর নাম ‘উচালের চুক্তি’। সে চুক্তির শর্তানুযায়ী এরিত্রেয়ার ওপর ইতালির অধিকার মেনে নেন মেনেলিক।
ইতালির প্রতিনিধি অবশ্য একটু চালাকি করেন। তাঁর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল ইথিওপিয়াকে ইতালির প্রটেক্টরেট বানানোর। চুক্তির আমারিনিয়া ভাষার সংস্করণে লেখা হলো, সম্রাট যদি চান, তাহলে বহির্বিশ্বের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ার দায়িত্ব ইতালির প্রতিনিধিকে দিতে পারেন। কিন্তু ইতালীয় সংস্করণে ক্রিয়াপদ অনূদিত হলো বাধ্যতামূলক অর্থে। অর্থাৎ সম্রাটের সকল বৈদেশিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ইতালির অনুমতিক্রমেই স্থাপন করা যাবে।
বিশ্বে মর্যাদার আসনে স্বদেশকে বসাতে ব্রিটেন-জার্মানির রাজা-রাণীর কাছে সমকক্ষ হিসাবে মেনেলিক সম্পর্কস্থাপনের চিঠি লিখলেন। কিন্তু দু’জনেই ইতালির সাথে চুক্তির শর্ত যেমনটি জেনেছেন তা জানিয়ে মেনেলিকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর অভিযোগের মুখে ইতালীয়রা ভুল শোধরানোর বদলে একরকম দাবি করলো, নীচ কৃষ্ণাঙ্গ জাতির জংলী রাজা মিথ্যে বলছে।
১৮৯৩ সালে উচালের চুক্তি রদ করে দিলেন মেনেলিক। ইতালীয় সেনাবাহিনী এরিত্রেয়া থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া শুরু করলো। তাদের সেনাপ্রধান ভেবেছিলেন, ইথিওপিয়ার জাতিগত বিভক্তির সুযোগে মেনেলিকের অবস্থান দুর্বল করা সম্ভব। কিন্তু বিধি বাম! মেনেলিকের পক্ষ নিয়ে গোটা দেশ থেকে তিগ্রে, আমহারা, সকল জাতের সৈন্যদল ছুটে এল। ১৮৯৬ সালে আদওয়ার যুদ্ধে ইতালীয়দের সারপ্রাইজ অ্যাটাক তাদের জন্যে উল্টো সারপ্রাইজ হয়ে দাঁড়ালো। মেনেলিকের নেতৃত্বে মূলত বর্শা-তলোয়ারধারী বিশাল সেনাদল হারিয়ে দিল কামান-বন্দুকধারী ইতালীয়দের। বন্দী হলো কয়েক হাজার। এরিত্রেয়ায় পালিয়ে ফেরার পথে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেছনে ফেলে গেল ইতালীয়রা ৬।
মেনেলিকের শাসনামলে ইথিওপিয়ার আধুনিকায়ন শুরু হয়। করব্যবস্থার সংস্কার ও কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয়। ডাক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদেরও প্রচেষ্টা চালান মেনেলিক ৭। এই ডাকটিকেটটি তাঁর সেই উন্নয়নপ্রচেষ্টার সাক্ষাত প্রমাণ।
এরপরে ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে চলে যাই ১৯৩৫ সালে। এর মধ্যে ১৯৩০এ ইথিওপিয়ার সম্রাট হয়েছেন রাস তাফারি মিকোন্নেন, তাঁর রাজকীয় নাম হাইলে সেলাসি ৮। ১৯২৩এ ইথিওপিয়া লীগ অফ নেশন্সের সদস্য হয়েছে। ১৯৩১এ সংবিধান প্রণীত হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কারের কিছুমাত্র হলেও ছোঁয়া পাচ্ছে ইথিওপিয়াবাসী।
ইতালি কিন্তু চল্লিশ বছর আগের সে অপমানের কথা ভুলে যায়নি। মুসোলিনির আস্ফালনের সাথে সেখানে তাল মিলিয়ে কুচকাওয়াজ করছে ফ্যাশিস্ট ব্ল্যাকশার্টের দল। মুসোলিনিরও বিংশ শতকের জুলিয়াস সীজ়ার হবার স্বপ্ন। গ্রেট ডিপ্রেশনের অর্থনৈতিক ধাক্কার পাল্টা শক থেরাপি হিসাবেও একটা জেতার মত যুদ্ধ দরকার ছিল মুসোলিনির।
পশ্চিমা শক্তিদের সাথে গোপন কূটনীতিতে জিতে মুসোলিনি ১৯৩৫এ সেনাপতিদের আদেশ দিলেন আগে বাড়ার। এই প্রথমবারের মত লীগের এক সদস্যদেশ আরেককে বিনা উস্কানিতে আক্রমণ করলো। হাইলে সেলাসির ডাকে সারা দেশে যুদ্ধের সাজ পড়ে গেল। মজার ব্যাপার হলো, এসময় ইথিওপিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে হিটলারের জার্মানি ৯।
প্রথম প্রথম যুদ্ধ খুব মন্থরগতিতে চলছিল। দু’একটা সংঘর্ষে ইথিওপীয়রা বিজয়ী হয়। এরপর মুসোলিনির তাড়া খেয়ে ইতালীয়রা স্থানীয় এরিত্রীয় গোত্রগুলোকে ঘুষ দিয়ে দলে ভেড়ায়। বেশুমারে বোমাবর্ষণ করা হয় ইথিওপীয় শহরগুলির ওপর। এমনকি তারা রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে। এ অসম যুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৩৬ সালে। হাইলে সেলাসি আদ্দিস আবাবার প্রতিরক্ষাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে চলে যান জেরুজালেম।
ছবির দ্বিতীয় ডাকটিকেটটি ১৯৩৬ সালের। এতে লেখা ‘ইতালীয় ঔপনিবেশিক ডাক’। ডাকটিকেটে ছবি ইতালির রাজার, তখন ইথিওপিয়ার সম্রাট তৃতীয় ভিত্তোরিয়ো এমানুয়েলের। ব্রিটেনের রাজা জর্জ যেমন একই সাথে ভারতের সম্রাট ছিলেন, সেরকম হবার শখ তাঁরও মিটলো।
জেরুজালেম থেকে হাইলে সেলাসি জেনেভায় এলেন লীগ অফ নেশন্সের হেডকোয়ার্টারে। ইতালীয় সাংবাদিকদের অকথ্য গালিগালাজ অগ্রাহ্য করে সেলাসি যা বললেন, তা অবস্মরণীয় এক ভাষণ। লীগের সদস্যদের তিনি ভর্ৎসনা করলেন লীগ চার্টারের দশম ধারার অবমাননা করে ইতালি যে একতরফা আগ্রাসন চালিয়েছে, তার প্রতিবাদ না করার জন্য। তিনি তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন যে ইথিওপিয়া আজ আক্রান্ত হচ্ছে, কাল আসবে তাদের পালা ১০।
হাইলে সেলাসী পরবাসী হবার পরে আরো বেশি খ্যাতিমান হলেন। ১৯৩৬ সালে ম্যান অফ দ্য ইয়ার হিসাবে টাইমস পত্রিকা তাঁকে কাভার করে। সে আমলে মার্কিনে বর্ণবাদ চললেও কৃষ্ণাঙ্গ সেলাসিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল, আর তাঁর বক্তৃতাগুলিতে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ফ্রাংকলিন রোজ়ভেল্ট ইথিওপিয়াকে লেন্ড-লীজ় চুক্তির আওতায় আনেন।
আমেরিকার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য, আর ব্রিটিশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার সৈন্যদের সহায়তায় ১৯৪১এর মে মাসে ইথিওপিয়া হয় নাৎসি-ফ্যাশিস্টমুক্ত প্রথম দেশ। পাঁচ বছর নির্বাসনশেষে আদ্দিস আবাবায় ফিরে হাইলে সেলাসি যা বললেন, তাও স্মরণীয়, “Do not indulge in the atrocities which the enemy has been practicing in his usual way.”
১৯৭৪ পর্যন্ত হাইলে সেলাসি ইথিওপিয়া শাসন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ভাল কাজ যেমন করেছেন, বিতর্কিত ব্যাপারও কম ঘটেনি সেসময়। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষের কথা কে না জানে। ১৯৭৪এ মিলিটারি কুয়ের মাধ্যমে সেলাসিকে অপসারণ করে একদল সোভিয়েতপন্থী সেনা। সেলাসিকে খুন করে লাশ গুম করে দেয় তারা। সারা দেশে গৃহযুদ্ধ চলে বিশ বছর ধরে। সামরিক জান্তার শাসনামল শেষ হলে ১৯৯২ সালে তাঁর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায়।
আজ ইথিওপিয়ায় গণতন্ত্র চলছে। শত বছরে যে জিনিস কল্পনা করা যেত না, ইথিওপিয়ার মানুষ তা করেছে। বহুদিনের তিগ্রে সংখ্যালঘু জাতির প্রাধান্যের সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু আমহারা-ওমোরোরা একত্রিত হয় ২০১৮তে প্রতিবাদ করে। প্রধানমন্ত্রী হন আবি আহমেদ বলে মুসলিম-খ্রীষ্টান মিশ্র পরিবারের সন্তান এক ওরোমো।এরিত্রেয়ার সাথে বহুদিনের যুদ্ধের ইতি টেনেছেন তিনি। মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতির উন্নয়নেরও চেষ্টা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে আফ্রিকায় জাতি ও ধর্মগত সাম্যের আলোকবর্তিকা হতে পারে আজকের ইথিওপিয়া।
(১) স্পেইন ও পর্তুগালের সাম্রাজ্য এসময় অবক্ষয়ের পথে। মোজাম্বিক, গিনি, অ্যাংগোলা, ইত্যাদি ছাড়া আর তেমন আফ্রিকান কলোনি এদের ছিল না। ১৮২০-৫০এর মধ্যে লাতিন আমেরিকার প্রায় সকল পর্তুগীজ-স্প্যানিশ রাজ্য স্বাধীনতালাভ করে। [Spanish American wars of independence]↩
(২) বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে আরব উপদ্বীপে তাঁদের জাতশত্রু পারসিকদের মোকাবিলা করে আক্সুম সাম্রাজ্য। আক্সুমের সেনাপতি আবরাহার ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআনের বিখ্যাত ফীল সূরায় উল্লেখিত আছে। আবরাহা ঐতিহাসিক চরিত্র, আরবে ইহুদী-খ্রীষ্টান দাঙ্গা-যুদ্ধ লেগে থাকত। খ্রীষ্টান আবরাহা অবিচারে ইহুদীনিধন করেন। মক্কা থেকে প্রথম মুসলিম হিজরত বা নির্বাসন মদিনায় নয়, হয় আবিসিনিয়ায়। আবিসিনিয়ার নেগুশ বা আল-নাজাশী তাদেরকে উদারতার সাথে আশ্রয় দেন। [Migration to Abyssinia
]↩
(৩) তেওদ্রোস তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে উত্তর ও পশ্চিম থেকে মিশর-সুদান আর পূর্বে ওরোমো-সোমালিদের মুসলিম সেনাশক্তির মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এদের বিরুদ্ধে সংঘাতকে খ্রীষ্টান ধর্যুমদ্ধ আখ্যা দিয়ে ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু এসময় ব্রিটিশদের সাথে মিশরী ও তুর্কীদের মিত্রতা ছিল, আর পশ্চিমা বিশ্বে তখন খ্রীষ্টান ধর্মযুদ্ধ বলে কোন কিছুর তাৎপর্য আর নেই। ব্রিটিশরা সে কারণে তেওদ্রোসকে নেতিবাচক জবাব পাঠায়। অপমানিত সম্রাট তেওদ্রোস তারপর ব্রিটেনের রাজপ্রতিনিধিদের আটক করে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখেন। পরাশক্তি ব্রিটেন এর সমুচিত জবাব দেবার জন্য বম্বে থেকে প্রখ্যাত সামরিক প্রকৌশলী রবার্ট নেপিয়েরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠায়। নেপিয়ের লোহিতসাগরের তীরে নেমে দ্রুত একটি বন্দর তৈরি করে ফেলেন ও স্থানীয় বিদ্রোহী গোত্রগুলোর সহায়তায় দুর্গম পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তেওদ্রোসের রাজধানী মাগদালায় এসে পৌঁছান। ব্রিটিশদের আধুনিক সমরাস্ত্র আর নিয়মানুবর্তী সেনাদলের কাছে পরাজিত হয় তেওদ্রোসের ট্রাইবাল সেনাবাহিনী। বন্দী রাজপুত্র আলেমাইয়াহু রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রিয়পাত্র ছিলেন।[British Expedition to Abyssinia]↩
(৪) সুদান ১৮৮০র দশক পর্যন্ত মিশরের তুর্কীশাসিত রাজ্যের দখলে ছিল। এ সময় মোহাম্মদ আহমেদ বলে এক সুফী দরবেশ নিজেকে মাহদী (মুসলিমদের ‘কলির অবতার’) দাবি করে। সঙ্গীসাথী জুটিয়ে মিশরীদের শাসন উচ্ছেদ করে। মিশর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারাও এদের মুখোমুখি হয়। কিন্তু এদের পাগলা হামলায় ব্রিটিশ মিশরী সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সুদানের ব্রিটিশ গভর্নর গর্ডনকে মেরে তাঁর কাটা মাথা মাহদীর কাছে পাঠানো হয়। মাহদীপন্থী ‘আনসারবাহিনী’ সুদানে কঠোর ইসলামী শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করে, আর আশপাশের রাজ্যগুলিকে ‘জিহাদের’ নামে তটস্থ রাখে। সুদানে দাস কেনাবেঁচা আবার শুরু হয়। ধর্মীয় আইন-দর্শনের পুরনো বইপত্রও পুড়িয়ে ফেলে এরা। মোহাম্মদ আহমেদ দাবি করে খোদার সাথে নাকি তার কথোপকথন হয়, আর কলেমা শাহাদাতে মাহদী হিসাবে তার ওপর বিশ্বাসস্থাপনের শপথ যুক্ত করা হয়। মোহাম্মদ আহমেদ টাইফয়েডে মারা যাবার পর তার আরেক অনুসারী খলিফা হিসাবে ক্ষমতা দখল করে। ব্রিটেন ১৮৯৫এ মিশর ও সুয়েজ রক্ষার খাতিরে লর্ড কিচেনারের নেতৃত্বে আনসারদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষিত সেনাদল পাঠায়। তিনি এদেরকে ১৮৯৮এ পরাজিত করতে সমর্থ হন। ততদিনে সুদানের অর্থনীতির পঙ্গু অবস্থা। আঠারো বছরের মধ্যে সংঘাতে-দুর্ভিক্ষে সেখানের জনসংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গেছিল। [Mahdist State]↩
(৫) চতুর্থ শতকে গথজাতির আক্রমণে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের পতন হয়। তারপর থেকে ইতালির বিভিন্ন এলাকা বিদেশী নানা রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রেনেসঁসের সময় ধীরে ধীরে তাদের জাতিপরিচয়ের নতুন জাগরণ হতে থাকে। কিন্তু ছোট ছোট রাজ্যগুলি ছিল একে অপরের প্রতিযোগী আর বহির্দেশীয় শক্তিগুলোর সাথে তাদের অ্যালাইনমেন্ট ছিল। নাপোলেওনের সময় উত্তর ইতালিতে ফরাসী সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি ‘ইতালি’ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নাপোলেওনের পরাজয়ের পর ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র আগের অবস্থায় ফিরে গেলেও ইতালিতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে যায়। বহুদিন ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যের দ্বারা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় ইতালির রাজ্যগুলি। তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যে একক ইতালীয় পরিচয়ের বিকাশ হচ্ছিল, তা রোধ করার চেষ্টা করে অধিকাংশ ইতালীয় রাজবংশগুলি। কার্বোনেরি নামক একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে ওঠে। এদের এক সদস্য মাৎসিনি ইয়াং ইতালি বলে আরেকটি দল গড়েন, যার আদলে পরে ইয়াং টার্কি, ইয়াং সার্বিয়া ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী গ্রুপের আত্মপ্রকাশ। আরেক কার্বোনেরি গারিবাল্দি স্বল্পসংখ্যক অনুসারী নিয়ে সামরিক অভিযান, কুয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যে ইতালীয় জনতার নামে ডিক্টেটরশীপ প্রতিষ্ঠা করছিলেন। প্রুশিয়ার সাথে কূটনীতির মাধ্যমে সার্দিনিয়া রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কাভুর উত্তরে অস্ট্রিয়াকে বাগে আনেন। আর দক্ষিণে গারিবাল্দি নাপোলি-সিসিলির রাজার শাসন উৎখাত করে তার রাজভার তুলে দেন সার্দিনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ভিত্তোরিও এমানুয়েলের হাতে। রোমসহ পোপের রাজ্যগুলিও হস্তগত হয়। এভাবে ১৮৬০এর দশকে ইতালি বলে নতুন রাজ্যটি আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রক্রিয়াকে ইতালীয় ভাষায় নাম দেয়া হয়েছে রিসর্জিমেন্তো বা পুনরুত্থান। [Italian unification]↩
(৬) এসময় ফরাসী-রুশরা মেনেলিককে সমর্থন দেয়। ইতালির পেছনে ব্রিটিশদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল জিবুতির ফরাসী ঘাঁটির মাধ্যমে সুয়েজ প্রণালী ও লোহিত সাগরের জাহাজপথের ওপর তাদের প্রভাব কাউন্টারব্যালেন্স করার জন্য। ইতালির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মেনেলিক ফরাসীদের সাহায্য চেয়ে পেলেন কেবল আদর্শিক সমর্থন। রুশ সম্রাট অবশ্য অর্থোডক্স খ্রীষ্টান ধর্মের ভ্রাতৃত্বের খাতিরে মেনেলিককে উপদেষ্টা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পাঠালেন। আদওয়া যুদ্ধের লজ্জাস্কর পরাজয়ের পরপরই ইতালিতে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, জনবিক্ষোভের মুখে সরকারের পতন হয়। ইথিওপিয়াকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয় ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স। এরিত্রেয়া অবশ্য ইতালিরই থেকে যায়। [Second Italo-Ethiopian War]↩
(৭) ১৮৩৩এ ব্রিটেন আর ১৮৬৩ সালে আমেরিকা ক্রীতদাস কেনাবেঁচা আইন করে বন্ধ করার ফলে পশ্চিম আফ্রিকার দাসব্যবসায় ভাঁটা পড়ে। কিন্তু পূর্ব আফ্রিকায় ঊনবিংশ শতকের পুরোভাগে আর বিংশ শতকের শুরুতে দাসপ্রথা তখনও প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে আরবের বিভিন্ন রাজ্যে ইথিওপিয়া থেকে আনা দাসদের বেশ বড় বাজার ছিল। এদের বেশির ভাগই গার্হস্থ্য কাজে নিয়োজিত হত, ক্ষেতখামারের হাড়ভাঙ্গা শ্রমে অতটা নয়। ওমানী, ইয়েমেনী, সোমালি দাসব্যবসায়ীদের ঘাঁটি ছিল জানজিবারের ওমানীশাসিত মুসলিম রাজ্য। হাবশী বা ইথিওপীয় দাসরা অতীতে ভারতবর্ষেও এসেছে। বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন হাবশী দাস। মেনেলিক দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আইনকানুন প্রচলন করলেও সেগুলির তেমন একটা প্রয়োগ হয়নি। তিরিশের দশক পর্যন্ত আরবের সাথে দাসব্যবসা চলেছে। লীগ অফ নেশন্সের বেশ কটি রেজল্যুশনের পরেও তা কমেনি। আরবে দাসপ্রথা চালু থাকার একটা কারণ অনেকদিন পূর্ব আফ্রিকার সাপ্লাই সোর্স বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। [Arab slave trade]↩
(৮) রাস্তাফারি নামে জামাইকাতে একটি ধর্ম চালু আছে। বব মার্লি ছিলেন রাস্তাফারি আর তাঁর গানে সে ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন ব্যাপার আমাদের অজান্তে উঠে এসেছে। ১৯৩০এর দশক থেকে জামাইকার অনেক কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্বাস করা শুরু করে যে হাইলে সেলাসী হলেন মেসিয়া, যীশুর দ্বিতীয় অবতার, জীবন্ত ঈশ্বর বা জাহ। তাদের আরো বিশ্বাস আফ্রিকায় রয়েছে তাদের প্রতিশ্রুত আবাসভূমি জায়ন। এ ধরনের অল্টারনেটিভ ধর্মবিশ্বাসের জনপ্রিয়তা পাবার একটা কারণ জামাইকাতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে কারণে হাইলে সেলাসী আফ্রিকার একমাত্র স্বাধীন সম্রাট হিসাবে এই বিশেষ মর্যাদাটি পান। যদিও তিনি নিজে খ্রীষ্টান ছিলেন, তিনি রাস্তাফারিদের নিরুৎসাহিত করেননি। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে জামাইকার জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। [Rastafari]↩
(৯) ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে ইতালির অন্যায় যুদ্ধে ব্রিটেন-ফ্রান্সের থেকে বিরোধিতা আসতে পেরে বলে মুসোলিনি তাদেরকে খেলালেন কূট চালে। গোপনে তাদের হুমকি দিলেন যে ইথিওপিয়া হবে ইতালীয়, আর যদি তা না হয়, তিনি জার্মানির হিটলারের সাথে সামরিক মিত্রতা চুক্তি করবেন (তখনও এ মিত্রতা ছিল না)। ব্রিটেন-ফ্রান্স এতে ভড়কে গিয়ে গোপনে তাঁর সাথে রফা করে, তাদের হোর-লাভাল প্রস্তাবনার মাধ্যমে রাজি হল যে ইতালি ইথিওপিয়ার সিংহভাগ পাবে, আর ছোট্ট একটা অংশ ইথিওপীয় রাষ্ট্র হিসাবে থেকে যাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপুল রক্তক্ষয়ের পরে ব্রিটিশ-ফরাসী সাধারণ মানুষ সংঘাতে যেতে চায় না, এটা তাদের রাজনীতিবিদরা ঠিকই বুঝেছিলেন। ইথিওপিয়ার মত নাম-না-জানা আফ্রিকান রাজ্যের সার্বভৌমত্বহানির বিপরীতে আদর্শগত যুদ্ধের আরোই কোন সমর্থন ছিল না। জার্মানি প্লেন, রাইফেল, গোলাবারুদ পাঠিয়ে মেনেলিককে সাহায্য করে এই উদ্দেশ্যে যে ইতালির সৈন্যদল সেখানে বহুদিন ব্যস্ত থাকবে, আর সে ফাঁকে জার্মানি ইতালির উত্তরে জার্মানভাষী অস্ট্রিয়াকে দখল করে নেবে। ১৯৩৮ সালে তা ঘটে, ইতালির সাথে আনঅফিশাল সমঝোতার পরপর।[Anschluss]↩
(১০) লীগ অফ নেশন্সের দশম আর্টিকল অনুযায়ী কোন সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে তার প্রতিরক্ষায় বাকি সদস্যরা এগিয়ে আসবে। একে বলে ‘কালেকটিভ সিক্যুরিটি’। বহির্দেশীয় সংঘাতে আরেকবার জড়িয়ে পড়তে অরাজি মার্কিনদের কংগ্রেসে এই ধারা প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র লীগে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকে। লীগ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অল্প ক’টি বিবাদের সুরাহা করতে সমর্থ হয়েছিল। সিনিয়র সদস্যরা ক্রমাগত লীগের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত কাজ করছিল। ইউরোপের বেশ ক’টি স্থানীয় সংঘাতে লীগ অর্থবহ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় এবং অধিক শক্তিমান পক্ষ দুর্বল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে। ইতালি-ফিউমে, ইতালি-গ্রীস, পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড-সোভিয়েত, ফ্রান্স-বেলজিয়ামের জার্মান রুহর উপত্যকা দখল, এগুলি কিছু ছোটখাট সংঘাতের উদাহরণ। ১৯৩১ সালে জাপান চীনের উত্তরের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে নিজেরাই ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক করে চীনাদের দোষ দেয়। তারা মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয় চীনাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। ১৯৩২ সালে তাদের চালাকির কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জাপানীরা লীগ থেকে পদত্যাগ করে। এটা ছিল বড় কোন সমস্যা মিটমাটে লীগের প্রথম বিফলতা। এরপর ইতালি পরিষ্কারভাবে দশম দফা লঙ্ঘন করে ইথিওপিয়ার ওপর চড়াও হয়। লীগ অফ নেশন্সের সদস্যরাষ্ট্ররা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্যে ইতালির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে ও অর্থনৈতিক স্যাংকশন আরোপ করে। কিন্তু সেগুলি খুব কার্যকর কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়ায় ইতালির শাসন সব দেশই মেনে নেয়, সাতটি বাদেঃ চীন, নিউজীল্যান্ড, সোভিয়েত, স্পেইন, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া অভিযানের আগ থেকে জাপানের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। চীনে জাপানের দখলকৃত এলাকাগুলিরও স্বীকৃতি দেয়নি যু্ক্তরাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া ও ইথিওপিয়া সংকটের পর লীগ অফ নেশন্সের অর্থপূর্ণ আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। যে দেশ যার ইচ্ছেমত বৃহদশক্তিদের ব্ল্যাকমেল করে ছোট দেশের উপর আগ্রাসন চালায়। জার্মানি-অস্ট্রিয়া, জার্মানি-ডানজিগ, জার্মানি-চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি-আলবেনিয়া, জাপান-চীন, তারপর পোল্যান্ডকে সোভিয়েত ও জার্মানি ভাগাভাগি করে দখল করার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। এভাবে হাইলে সেলাসীর ভবিষদ্বাণী পাঁচ বছরের মধ্যে সত্য হয়। [League of Nations Failures]↩