“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”
রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।
রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।
সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।
আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।
পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।
সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।
এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।
এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।
আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।
শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।
আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!
অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!
সত্যজিতের প্রফেসর শঙ্কুর রোমাঞ্চকর সব অভিযানের মধ্যে একটা ছিল একশৃঙ্গ অভিযান। তাতে শঙ্কু আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা তিব্বতের দুর্গম এলাকায় গিয়ে সন্ধান পান অদ্ভূত এক স্থানের। সেখানে দুনিয়ার যাবতীয় রূপকথার প্রাণী আর বৃক্ষের আবাস — এদের মধ্যে একটা হচ্ছে ইউনিকর্ন, যার বাংলা সত্যজিৎ করেছেন একশৃঙ্গ।
এই গল্পটা আজ মনে পড়ল একটা খবর দেখে। বিজ্ঞানীরা পুরনো কিছু ফসিল পুনরায় নিরীক্ষণ করেছেন, যেগুলি এলাস্মোথেরিয়াম বলে এক অতিকায় গন্ডারজাতীয় প্রাণীর। গন্ডারের শিংয়ের থেকেও লম্বা একটিমাত্র শিং ছিল এই আদি স্তন্যপায়ী প্রাণীটির। কিছুদিন আগেও ধারণা করা হত যে এলাস্মোথেরিয়াম পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এক থেকে দু’লাখ বছর আগে।
নতুন গবেষণায় বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন যে পশ্চিম রাশিয়া ও মধ্য এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া ও উত্তর চীন পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় এলাস্মোথেরিয়াম বেঁচে ছিল ৩৬,০০০ বছর আগ পর্যন্ত। অর্থাৎ এলাস্মোথেরিয়াম সিবিরিকাম নামক এ প্রজাতিটির সাথে আদি হোমো স্যাপিয়েন্সের মোলাকাত অসম্ভব কিছু ছিল না। হয়ত কোন কোন দুর্গম এলাকায় আরো কয়েক হাজার বছর বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে এই ইউনিকর্ন।
স্বভাবতই আমরা ভাবতে পারি এই এলাস্মোথেরিয়ামই রূপকথার ইউনিকর্ন কিনা। প্রাচীনকালের মানুষ হয়ত সে জানোয়ারকে নিয়েই বর্তমানের রূপকথা ফেঁদেছে। যদিও রূপকথার ইউনিকর্ন দেখতে ঘোড়ার মত, তার শিং প্যাঁচানো। আর এলাস্মোথেরিয়াম দেখতে গন্ডারের মত। তবে তাপির, গন্ডার আর ঘোড়া একই বর্গের খুরসহ প্রাণী — তাদেরকে বলে অড-টোড্ আঙ্গালেটস।
যদি ধরে নিই এলাস্মোথেরিয়ামই আদিকালের ইউনিকর্ন, তাহলে প্রস্তরযুগের মানুষ তার চিত্র ফ্রান্সের রুফিন্যাক গুহায় এঁকেছে ১৩,০০০ বছর আগে। আবার ২,৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সিন্ধু সভ্যতারটেরাকোটা সীলেও পাওয়া গেছে এর মত এক ছবি। চীনা আর তুর্কী-মোঙ্গল মিথলজিতেও এরকম ঘোড়া আছে। আবার অনেক ক্লাসিক গ্রীক লেখক ইউনিকর্নের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের বইয়ে। কিন্তু সন্দেহ নেই তাদের সে বিবরণ সেকেন্ড-হ্যান্ড, পূর্ববর্তী কোন মৌখিক গল্প শুনে তাতে আরো মনের মাধুরী মিশিয়ে মুখরোচক বানিয়েছেন একশৃঙ্গ ঘোটককে।
মধ্যযুগে আরব আলকেমিস্টরা ইউনিকর্নের শিংয়ের ভেষজ গুণাগুণ বর্ণনা করেছেন। আবার বাগদাদের খলিফা হারুন-অর-রশিদ নাকি ফ্রাংক সম্রাট ও প্রথম হোলি রোমান এম্পেরর শার্লমেইনকে ইউনিকর্নের শিং উপহার পাঠিয়েছিলেন, যেগুলো এখন ফ্রান্সের এক জাদুঘরে সংরক্ষিত। কিন্তু এগুলো আসলে নারহয়াল নামে এক শিংওয়ালা তিমির। এখনো চীনের হোমিওপ্যাথি মেডিসিনে গন্ডারের শিংয়ের ওষধি গুণ আছে বলে কুসংস্কার চালু আছে। যেকারণে আফ্রিকার প্রচুর দেশে পোচাররা বিলুপ্তপ্রায় ব্ল্যাক রাইনো মেরে তাদের শিং চীনা-অধ্যুষিত দেশগুলিতে মোটা দামে পাচার করেছে।
রূপকথার প্রাণী নিয়ে যে জীববিদ্যা তাকে বলে ক্রিপ্টোজুওলজি। যারা এতে আগ্রহ পান, তারা নানাভাবে অতীতের বিলুপ্ত প্রাণীর সাথে রূপকথার জীবের যোগাযোগ বের করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক যে তাদের থিওরিগুলি প্রমাণ করা সহজ কাজ নয়। মানুষের আদিমতম স্মৃতিগুলি সোজাসাপ্টা লিখিত ভাষায় কেউ বলে যায়নি। যদি থেকে থাকে তো তা মৌখিকভাবে বংশপরম্পরায় ‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো’ টাইপ ঘুমের গান অথবা ঠাকুরমার ঝুলির মত গল্পের মাধ্যমে কালে কালে অনেক ফিল্টার হয়ে আমাদের কাছে এসেছে।
কিন্তু রূপকথা নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন, তারা বলবেন যে পৃথিবীর নানা সংস্কৃতির রূপকথাগুলির মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রয়েছে। আমাদের দেশের ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভারতবর্ষের রূপকথার সাথে পূর্ব ইউরোপের রূপকথার যোগাযোগ নিয়ে কিছু গবেষণা করেছিলেন বলে মনে পড়ে। তাঁর আগ্রহ যোগানোর জন্যে বোধহয় তাঁর গুরু ময়মনসিংহগীতিকার সংকলক দীনেশচন্দ্র সেন কৃতিত্বের দাবিদার। দীনেশচন্দ্র ছিলেন ভারতীয় উপকথার পাইওনিয়ার, যদিও তিনি তুলনামূলক লোককথা নিয়ে শহীদুল্লাহর মত কাজ করেননি।
এখানে এটাও উল্লেখ না করে পারছি না যে, শহীদুল্লাহ ধর্মপরায়ণ মুসলিম ছিলেন, একই সাথে বৌদ্ধ চর্যাপদ নিয়ে গবেষণা-অনুবাদ করেছেন, সংস্কৃত-তিব্বতীসহ বহু প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় তাঁর দখল ছিল। পশ্চিমা শিক্ষাতে শিক্ষিত হয়েও আরবী-ফারসী থেকে অনেক সাহিত্যকর্ম বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন, যার মধ্যে রুবাইয়াতে ওমর খইয়াম রয়েছে। আজকের যুগে আমাদের তরুণপ্রজন্ম তাঁর নাম শুনেছে কিনা আমার সন্দেহ!
যাক গে, মূল কথায় ফিরে আসি। চীনের মিথে যেমন ড্রাগন আছে, তেমন ইউরোপেও আছে, আবার দক্ষিণ আমেরিকাতেও সর্পরূপী দেবতার উপাসনা করা হত। আমাদের রূপকথায় যেমন পঙ্খীরাজ, তেমন তুর্কী-মোঙ্গল-তিব্বতী রূপকথাতেও আছে উড়ন্ত ঘোড়া। তুর্কীদের পঙ্খীরাজের নাম আবার তুলপার। নর্সভাইকিংদের উপকথার ভালক্যুরিরা উড়ন্ত ঘোড়ার পিঠে চেপেই যুদ্ধক্ষেত্রে নেমে আসত নিহত বীরদেরকে ভালহাল্লা স্বর্গে নিয়ে যেতে। গ্রীকদের পাখাওয়ালা ঘোড়ার নাম পেগাসাস।
সেরকম কেল্টিক রূপকথায় আছে ডয়ার্ফ–গবলিন, লর্ড অফ দ্য রিংসে দেখে বুঝেছেন যে ডয়ার্ফদের অবসেশন মাটি খুঁড়ে ধনরত্ন বের করা, কিন্তু তাদের মত কিপ্টে আর হয় না। সেরকম ভারতের রূপকথায় আছে যক্ষ আর যক্ষের ধন।
কোত্থেকে কি এসেছে সেটা বের করা কঠিন কাজ। তবে কিছু কমন থিম সব রূপকথায় আছে। যেমন জোসেফ ক্যাম্পবেল বলে এক উপকথাবিদ হিরো থিমটা নিয়ে গবেষণা করেছেন। হিরো থাকবে একজন গল্পে, তার ‘কামিং অফ এইজে’ বা পরিপক্বতার বয়েসে কোন কঠিন পরীক্ষা বা ফীট থাকবে। উৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে গ্রীকদের ‘টুয়েল্ফ টাস্কস অফ হারকিউলিস’। জোসেফ ক্যাম্পবেল এসব কাহিনীকে ইন্টারপ্রেট করেছেন প্রাচীন মানুষের মনস্তত্ত্ব আর তাদের ম্যাজিকে বিশ্বাসের মাধ্যমে। এ থিমটা তাই সব কালচারেই কমন, কারণ সব মানবপ্রজাতির আদি মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তন একইভাবে হয়েছিল, পরে বিভিন্ন অঞ্চলে গিয়ে সেসবে আরো স্থানীয় ডিটেইল যোগ হয়।
কিছু রূপকথাতে সেক্সুয়াল আন্ডারটোনও রয়েছে। যেমন বিউটি অ্যান্ড দ্য বীস্ট এবং আরো অনেক। আমি জানি না কোন নৃতত্ত্ববিদ এ প্রমাণ করতে পারবেন কিনা, যে সেসব কাহিনী প্রাচীনকালে যেসব আলাদা আলাদা মানবপ্রজাতি ছিল — যেমন নিয়ান্ডারটাল, হোমোসেপিয়েন্স, ডেনিসভ়ান, আরো একটি অজানা প্রজাতি — তাদের মধ্যে ইন্টারমিঙলিংয়ের অবচেতন স্মৃতি। তারা যে ইন্টারমিঙ্গল করেছিল তা এখন বিজ্ঞানীদের অজানা নেই, আফ্রিকার বাইরের মানুষের কমপক্ষে শতকরা পাঁচ ভাগ জীন নিয়ান্ডারটাল। বলা বাহুল্য নিয়ান্ডারটালদের চেহারা ছিল গাঁট্টাগোট্টা, অনেকটা লর্ড অফ দ্য রিংসের ডয়ার্ফরাজা গিমলির মত! আবার যদি ডেনিসোভানদের আরো পরিপূর্ণ ফসিল বেরোয়, আর তাতে যদি দেখা যায় তারা এল্ফদের মত, তাহলে তো উপকথাবিদ-নৃতত্ত্ববিদ দুয়েরই পোয়াবারো! এখানে আমি সত্যজিতের মত একটু অতিকল্পনার আশ্রয় নিলাম!
অনেক কাহিনীই আছে যেখানে কল্পনার আশ্রয় নেয়ার কোন দরকার নেই। নূহনবীর মহাপ্লাবনের কাহিনী ৩০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সুমেরীয় গল্প থেকে এসেছে। সে কাহিনী পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়নি, কিন্তু তার অংশবিশেষের উল্লেখ আছে প্রাচীনতম মহাকাব্য গিলগামেশের বীরত্বগাঁথার মধ্যে। আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ যদি পড়ে থাকেন, তাহলে ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের প্রাচীন মিশরের টেইল অফ দ্য শিপরেকড সেইলর পড়ে মিলিয়ে দেখুন!
আরব্যোপন্যাসের আলিবাবা-চল্লিশ চোরের কাহিনী তো সত্য ঘটনা অবলম্বনে! ১৪৫৬ থেকে ১৪০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে হিব্রুদের পূর্বসূরী কানানাইট জাতির জোপা (বর্তমান জাফা) নগররাষ্ট্র ফারাও তৃতীয় থুতমোসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। প্রাচীন মিশরের নাপোলেওঁ হিসাবে পরিচিত থুতমোসে তাঁর জেনারেল জেহুতিকে পাঠান বিদ্রোহদমনে। জেহুতি জোপ্পার রাজকুমারকে শান্তিআলোচনার নামে নগরপ্রাচীরের বাইরে তাঁর ক্যাম্পে দাওয়াত দিয়ে পাঠান। তারপর চালাকি করে তাঁকে বন্দি করে ফেলেন। আর কয়েকশ’ সৈন্যকে বস্তায় ভোর ঘোড়াগাধার পিঠে চাপিয়ে এক রথীকে পাঠান নগরে। সেখানে গিয়ে রথী ঘোষণা করে যে জেহুতি রাজকুমারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন আর নগরবাসীকে শান্তির টোকেনস্বরূপ উপহার পাঠিয়েছেন। মাথামোটা কানানাইটরা যে দরজা খুলে দিয়েছিল বলা বাহুল্য! ট্রোজান হর্সের কাহিনীও একই রকম!
কথায় কথায় ইউনিকর্ন থেকে বহু দূরে চলে এসেছি। উপসংহারে এটুকুই বলতে চাই যে, মানবসভ্যতার রূপকথা-মিথ-ফেইরিটেল-লেজেন্ডের মধ্যে অনেক ভুলেযাওয়া স্মৃতি আছে যেগুলি মানুষ এখনো ফিরে ফিরে মনে করে, কারণ সেগুলি তার মানসের কাছে এখনও আকর্ষণীয়। কয়েক শতাব্দী পরে স্টার ওয়ারসেরল্যুক স্কাইওয়াকার হয়ে যাবে গিলগামেশ, লর্ড অফ দ্য রিংস হয়ে যাবে রামায়ণ বা ইলিয়াড। এগুলিতে যা রয়েছে, পূর্বসূরীদের মত তাদের একই রসদ! তখনকার মানুষ তাই খাবে, কারণ তার মনস্তত্ত্ব তখনও থাকবে আজকের মতই প্রাচীন।
বিভিন্ন কালচারে প্রাচীনকালে নরবলির প্রথা চালু ছিল। এ নিয়ে একটু জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করতে চাই। এর থেকে পাঠক ইতিহাসের ‘অপরাধ’গুলিকে ‘ফাস্ট ফুড’ স্টাইলে মূল্যায়নের আগে ভালভাবে সেগুলির পরিস্থিতি যাচাই করার ব্যাপারে একটু শিক্ষালাভ করতে পারেন।
অনেক ধর্মে এখনো পশুবলির প্রথা আছে। ইসলামে গবাদিপশু কোরবানীকে আধুনিকচিত্তের অনেক মানুষ দেখেন মধ্যযুগীয় বর্বরতা হিসাবে। মনে রাখা দরকার, ইসলামে পশু কোরবানীর লক্ষ্য শুধুমাত্র খাদ্য নয়, বরং নিজের প্রিয় কোন প্রাণীকে নিজ স্বত্ত্ব পরিত্যাগ করে, মায়া ভুলে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করা।
হ্যাঁ, আজকের মূল্যবোধের হিসাবে এটা অমানবিক হতে পারে। কারণ আমাদের গোয়াল থাকলে গোয়ালে এখন হাজারো পশু, আলাদা করে একটা প্রিয় পশু সেরকম আর নেই। আর গোয়াল যাদের নেই, তাদের আর পশুর প্রতি মায়াই জন্মাবে কোত্থেকে! অর্থাৎ আসল উপলক্ষ্য থেকে কোরবানীর ব্যাপারটা অনেক দূরে চলে এসেছে, শুধু হয়ে রয়েছে আনুষ্ঠানিকতা।
তাবৎ হিউমেইন সোসাইটি সদস্যদের এ ভেবে একটু বাস্তববাদী হওয়াটা বোধহয় দরকার যে, যখন পশুবলি প্রথা ইসলাম, খ্রীষ্টান আর ইহুদীধর্মের কুলপিতা ইব্রাহিম বা এব্রাহাম চালু করছেন, তখন তিনি যে প্রাচীন রীতিটার সংস্কারসাধন করছেন সে হল নরবলি! This triggers the tooltipইসমাঈল হোন কিংবা আইজ়্যাক, তিনি নিজেই রাজি ছিলেন এতে, কিন্তু বেঁচে গেলেন ঈশ্বর দয়াপরবশ হয়ে তাঁকে এক মেষ দিয়ে স্থানান্তরিত করার কারণে।
এ রূপকথা নয়! জাতিগত স্মৃতির অবশেষ রয়ে গেছে শিক্ষামূলক ‘কিংবদন্তীর’ মধ্যে। ইহুদী ধর্মের সবচে’ বড় সংস্কার হয়েছিল সপ্তম খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নবী দ্বিতীয় ইসাইয়ার আমলে। এসব লেজেন্ডের তখনই উৎপত্তি ‘নতুন’ মূল্যবোধের জাস্টিফিকেশন হিসাবে। সেসময়েই ইহুদীদের ‘ইহুদী’ হয়ে ওঠা। এর পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠীকে ইহুদী না বলে হিব্রু বলা সমীচীন। হিব্রুদের রাজ্যে নরবলি চালু ছিল, আর তাদের রাজারা নিজেদের সন্তানকেই তাদের দেবের উদ্দেশ্যে অগ্নিআহুতি দিত গেহেন্না বলে এক উপত্যকায় — পরবর্তীতে অভিশপ্ত ঘোষিত এই উপত্যকার নাম আর আরবী জাহান্নাম একই শব্দ।
তো এ ধরনের বলিদান শুধু মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসেই নেই, কালীসাধনার পাঁঠাবলির মূল নরবলিতে। প্রাচীন মিশর, গ্রীসেও একই জিনিস ছিল। আমেরিকাতে তো এই সেদিন, পঞ্চদশ খ্রীষ্টাব্দেও অ্যাজ়টেক, মায়া আর অন্যান্যরা পিরামিডের শীর্ষ থেকে মনুষ্যরক্তের বন্যা নামিয়ে দিত।
ফাস্টফুড ইতিহাসবিদরা দ্রুত দেখেশুনে ড্রাইভবাই শুটিং করে যাবেন: ওরা ছিল বর্বর, অনুন্নত; কিংবা তারা ছিল ধর্মান্ধ, সাধারণের সুযোগ নেয়া রাজা আর হুজুরের দল।
কয়েকটা সিম্পল প্রশ্নের জবাব তাদের কাছে আমার আর্জি: কেন নরবলির সময় বহুক্ষেত্রে শিশুদের বেঁছে নেয়া হত, মানুষ কি এতই অমানুষ? আবার সেসব শিশুর বেশিরভাগই রাজ্যপালের বা পুরোহিতের সন্তান? অ্যাজ়টেকরা হয়ত যুদ্ধবন্দীদের মারত। কিন্তু তাদের না মেরে দাস বানিয়ে গতরখাঁটা কাজ করালেই তো তাদের আরো উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি হত।
বুঝতে হলে আপনাকে বহুদিন ধরে বহু দিক থেকে লেখা বহু ইতিহাস পড়ে একটা পরিপূর্ণ কম্প্রেহেনশন আনতে হবে। অথবা অন্ততপক্ষে অবজ়ার্ভার হিসাবে নিজেকে চিন্তা না করে ভাবুন আপনি সে আমলের একজন মানুষ। ভাবুন আপনার দৈনন্দিন জীবনের সীমাবদ্ধতাগুলি কি হতে পারে, সারভাইভালের জন্য আপনার কী কী দরকার। এ যুগে এধরনের কল্পনা খুব কঠিন কাজ, কারণ আমরা একটা কমপ্লেসেন্ট জেনারেশন — খাদ্য, পোশাক, জ্ঞান-বিজ্ঞানের অ্যাক্সেস, টেক, কোন কিছুর অভাব নেই, আছে উদ্বৃত্ত! তাই আমাদের বাঁধে না নিজেদের মাপকাঠিতে অন্য দেশ-কাল-কালচারের বিচার বসাতে।
আমি একটু চেষ্টা করে দেখি পারি কিনা। প্রাচীন মানুষ হিসাবে আপনি হতে পারেন পঞ্চাশ থেকে একশ’ মানুষের ছোটখাট একটা দলের নেতা। জাতিদেশের কনসেপ্ট তখনও শুরু হয়নি। জীবিকানির্বাহ হয় শিকার করে, নয়ত প্রাথমিকস্তরের কৃষিকার্য করে। প্রকৃতির ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। হয়ত পাঁচটা বছর ভাল শিকার জুটলো বা ফলন হলো, তারপর শুরু হলো মন্দা।
খাবার রেশনিং শুরু হলো। কিন্তু পরের বছরও মন্দা। কোনরকমে টেনেটুনে চলছে। কিন্তু জনতা ক্ষুধায়-ক্লান্তিতে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। আপনার কাছে বা পুরাহিতের কাছে কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই — কেন এমন হচ্ছে। বিজ্ঞানের ব’ও জানা নেই । প্রথম যেটা মনে হতে পারে যে প্রকৃতির কোন দৈবশক্তি আপনার বা আপনার গোত্রের ওপর ক্রোধান্বিত। সুতরাং সেই দেবের ক্রোধপ্রশমন করতে হবে। আপনার বউ রাগলে আপনি কী করেন? ফুলের গোঁছা? জুয়েলরি গিফ্ট? হয়ত একটা ডিনার? অর্থাৎ একটা কিছু উৎসর্গ করা দরকার শক্তিমান দেবতার উদ্দেশ্যে।
উৎসর্গ করার জন্যে সবচে’ কার্যকরী যার মধ্যে আপনার অ্যাটাচমেন্ট আছে। বস্তুগত অনুরক্তি নয়, আত্মিক। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা হবে আপনার সন্তান। সন্তান আপনার ভবিষ্যতের বীজ নয় শুধু, সে বড় হলে গোত্রের কর্মক্ষম একজন ব্যক্তিও হবে। গোত্রপ্রধান হিসাবে আপনার প্রভাব আরো বাড়াবে। কিন্তু বর্তমানের অকালটাকে না অতিক্রম করতে পারলে সন্তানসহ গোত্রের বাকি সবাই না খেয়ে মরবেন। এ কথা হয়ত পুরোহিত শুধু বানিয়ে বানিয়ে বলছে না, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে মনেপ্রাণে। আর অন্যকোন বেটার এক্সপ্লেনেশন তার বা আপনার কাছে নেই। গোত্রের বাকি সবার কাছে আইডিয়াটা উপস্থাপন করার পর নব্বইজন সায় দিল, দশজন দিল না। কী করবেন আপনি?
আশা করি কিছুটা বোঝাতে পেরেছি পরিস্থিতিটা। প্রস্তরযুগের শেষ পর্যন্ত মানবজাতির জন্যে সারভাইভ্যালটা এমনি ছিল। ব্রোঞ্জযুগে নতুন টেকনোলজির কারণে আরেকটু ভাল অবস্থায় আসে মানুষ। তারপরও সেরেমোনিয়াল রিলিজিয়াস স্যাক্রিফাইস চলত, কারণ বাপদাদারা করে এসেছে। লৌহযুগে এসে যখন মানবসভ্যতা উপনীত হলো, তখন তাদের কৃষিকাজের লাঙলসহ নতুন নতুন যন্ত্র বেরিয়েছে, শিকারের বহুরকম অস্ত্র। প্রকৃতির প্রতিকূলতা কাটিয়ে কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণ মানুষ। ইসাইয়ার মত সংস্কার তখন অনেক কালচারেই হয়, এবং নরবলি স্থানান্তরিত হয় পশুবলি দ্বারা।
যেকোন প্রাচীন মূল্যবোধকে মূল্যায়নের পরীক্ষা হলো, Did it sound like the only, not just a, good idea at the time? And did everyone else think so?
নতুন মূল্যবোধও একইভাবে এস্ট্যাবলিশ হয়। যারা জোর করে সব সনাতন প্রথাকে বন্ধ করে দিতে চান, আশা করি তারা এটা কনসিডার করবেন!
মার্কিন দেশের মানুষ আজকাল মেরি ক্রিসমাস না বলে অনেক সময় হ্যাপি হলিডেজ বলে সম্ভাষণ করে। উদ্দেশ্য, যারা খ্রীষ্টান নয়, তাদের অনুভূতিতে আঘাত না দেয়া। আর মেরি ক্রিসমাস বললে উল্টো যদি কথা শুনতে হয়, ‘আমি তো খ্রীষ্টান নই’? ভিনদেশী চেহারার হলে তো কথাই নেই। আর কিছু মুসলিম ও ইহুদী আসলেই এ ব্যাপারে একটু স্পর্শকাতর। যাই হোক, মার্কিনরা আপনাকে জোর করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাধ্য করবে না।
আমার অবশ্য মেরি ক্রিসমাস সম্ভাষণ শুনতে ও ফিরিয়ে দিতে খারাপ লাগে না। ক্রিসমাসের উপলক্ষ্যে ছুটি তো আর যেনতেন হলিডে না। সমঝদারদের কাছে সেক্যুলার ছুটি আর স্পিরিচুয়াল ব্রেক একরকম নয়। রিল্যাক্স করার সুযোগ যখন একটু পেয়েছি, স্পিরিচুয়াল একটা ব্রেক হোক সানন্দে।
ডিসেম্বরের ২৫শে যীশুখ্রীষ্টের জন্ম আসলে সম্ভবত হয়নি। কিন্তু সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ডিসেম্বরের ২৫ দক্ষিণায়ণের দিন, উত্তর গোলার্ধ সূর্য হতে তার সবচে দূরপ্রান্তে গিয়ে আবার ফিরে আসা শুরু করে। অর্থাৎ দীর্ঘরাত্রির পালা শেষ, দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ে, উষ্ণতা ফিরে আসা শুরু করে ‘পৃথিবীতে’। সাথে আসে বসন্ত ও প্রকৃতির প্রাচুর্য। খ্রীষ্টের জন্মের আগ থেকেই এ দিনটি তাই অনেক প্যাগান ধর্মানুসারীদের, বিশেষ করে রোমানদের কাছে ছিল পবিত্র। এ হলো প্রকৃতির পুনর্জন্ম।
ভার্জিন মেরীর থেকে যীশুর সতীজন্ম ব্যাপারটাও পুরনো আইডিয়া। বিশেষ করে গ্রীক মিথে জিউসের জন্ম একই রকম। এমনকি গৌতমবুদ্ধের জন্মও মায়াদেবীর বুকের পাশ থেকে, অর্থাৎ হৃদয় হতে। তাঁর জন্মও সাধারণভাবে হয়নি।
প্রাচীন মিশরের দেবী আইসিস, অনিষ্টের দেব সেথের ষড়যন্ত্রে নিহত স্বামী অসাইরিসের মৃতদেহের টুকরো টুকরো অংশ নিয়ে লেবাননের রাজপ্রাসাদ থেকে ফেরার পথে দুঃখের আতিশয্যে তাঁকে আলিঙ্গন করেন। আর তার ফলে ‘সতীজন্ম’ হয় দেবতা হোরাসের। মাতা মেরীর কোলে বসা শিশু যীশু যেমন নতরদামসহ নানা গীর্জায় মূর্তিআকারে শোভা পাচ্ছে, আইসিসের ক্রোড়ে মাতৃদুগ্ধপানরত হোরাসের একইরকম ভাস্কর্য বিশ্বের সকল জাদুঘরের প্রাচীনমিশরীয় সেকশনে ভূরি ভূরি রয়েছে। তার কোনকোনটিতে আবার অসাইরিস এসে যুক্ত হয়ে হোলি ট্রিনিটি সম্পূর্ণ করেছেন।
ডায়োনাইসাস বলে এক গূঢ়দেবের উপাসনাও প্রচলিত ছিল যীশুর আগে একই এলাকায়। তাঁর জন্মও ভার্জিন বার্থ। ডায়োনাইসাসের উপাসকরা যেধরনের মিস্টিসিজম বা গূঢ়তত্ত্বের চর্চা করত, তা সুফীবাদ বা বাউলদর্শনের আদিমরূপ ধরলে ভুল করা হবে না। তাদের সেসব মিস্টিক ব্যাপারস্যাপার গ্নস্টিক নামক আদি খ্রীষ্টানদের মাধ্যমে আর্লি ক্রিস্টিয়ানিটিতে এসেছিল, যার অনেক কিছুর ছায়া বর্তমানেও রয়ে গেছে। তার একটা হল কম্যুনিয়ন, যেখানে ক্যাথলিকরা রুটি ও ওয়াইন খায় যীশুর রক্ত-মাংসের প্রতীক হিসাবে, কারণ তা ভক্ষণের মাধ্যমে যীশুর আত্মিক গুণ প্রবেশ করে তাদের আত্মায়, অথচ বলা হয় উল্টো যে তারা প্রবেশ করছে কিংডম অফ গডে। মিশরের নাগ হাম্মাদিতে আবিষ্কৃত গস্পেল অফ টমাসের পান্ডুলিপিতে অনেক কিছু ম্যাথু-মার্ক-ল্যুক-জনের থেকে আলাদা এবং গূঢ়তাত্ত্বিক, কারণ তা ছিল গ্নস্টিকদের মিস্টিক বাইবেল।
অর্থাৎ যীশু খ্রীষ্টের দৈব উপায়ে জন্মসহ অন্যান্য অনেক ব্যাপারস্যাপার সে যুগের মানুষের কাছে নতুন কিছু ছিল না। তেমন কোন নতুন আইডিয়া না নিয়ে এসেও খ্রীষ্টধর্ম এতকিছুর মধ্যে কিভাবে নিজের আলাদা একটা জায়গা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলল? অনেকে রোমসম্রাট কনস্ট্যানটিনের দিকে আঙুল তুলে দেখাবেন, কারণ তিনি খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করাতেই সে ধর্মবিশ্বাসের রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠা পায়।
আমার হিসাবে তা শুধু একটিমাত্র কারণ। কনস্ট্যানটিন খ্রীষ্টান হয়েছেন, সেও যীশুর জন্মের তিনশ’ বছর পর। এত শতাব্দী ধরে নানা বিশ্বাস আর ধর্ম আর রাষ্ট্রীয়ভাবে হয়রানির মধ্যে খ্রীষ্টানরা তো হারিয়ে যেতে পারত। তা তো হয়নি।
খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্ম আঁকড়ে ধরে রেখেছিল কারণ ক্রিস্টিয়ানিটির বিশ্বাস এমন একটা মানবিক গুণের পরিপূর্ণ অর্থবহতা তাদেরকে দিয়েছিল, যেটা অন্যান্য সমসাময়িক ধর্মে গতানুগতিকভাবে শুধুমাত্র শাস্ত্রীয় আচারপালনের মাঝে হারিয়ে গেছিল। সে মানবিক গুণটা হলো কমপ্যাশন — করুণা, পরদুঃখকাতরতা যেই শব্দ দিয়েই বলুন না কেন, মনে মনে বোধ না করলে অর্থ অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে।
লাভ ইয়র এনেমিজ, ডু গুড টু দোজ হু হেইট ইউ, ব্লেস দোজ হু কার্স ইউ, প্রে ফর দোজ হু মিসট্রীট ইউ — এ কথাগুলো শুধু যীশু বলেননি। একই বাণী যুগে যুগে গৌতমবুদ্ধসহ আরো অনেকে দিয়ে গেছেন। এসকল স্ববিরোধী উপদেশের কারণ কি? কারণ, মানবস্বত্ত্বা একক, যখন এক মানুষ আরেককে আঘাত করে, সে তা করে নিজেকেই। এটা কেবল একটি মাত্রা। এসবের অর্থ যে আবার ওম শান্তি বলে দুনিয়া থেকে পলায়নপর হওয়া, তাও নয়। এসবের অর্থ শত দুর্দশা-বিপত্তি-দুঃখ-জরায় জর্জরিত হওয়া স্বত্ত্বেও নিজের মনের নৈতিক দ্বন্দ্বগুলোকে সামঞ্জস্যে আনা। নিজেকে হারমোনাইজ করা, চক্রের আবর্তে ঘুরপাক না খেয়ে চক্রের মাঝে স্থির থাকা। মিডল পাথ ইজ দ্য বেস্ট পাথ।
সুতরাং যীশুর সতীজন্ম আসলে কমপ্যাশনের জন্ম — সাধারণ জন্ম নয়। ঈশ্বরের উচ্চারিত দৈব প্রেরণার মাধ্যমে স্পিরিচুয়াল রিবার্থ। পশুপ্রকৃতিকে বশ করে শুচি মানবরূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ। খ্রীষ্ট-বুদ্ধসহ যুগে যুগে যত ‘নবী’, ‘দেবদেবী’, পুরাণের বীরপুরুষদেরকে মানুষ রাজাসনে বসিয়েছে, সবাই আধ্যাত্মিক পুনর্জন্মের মাধ্যমে সে আসনের যোগ্যতা লাভ করেছেন। খ্রীষ্টানদের আত্মিক মুক্তির পথে যীশু ভেহিকল বা যান মাত্র। আবার বৌদ্ধধর্মে যে কোন সাধারণ মানুষও নিজ পথে বুদ্ধ হবার আর নির্বাণপ্রাপ্তির যোগ্যতা রাখে। অর্থাৎ যেকোন সাধারণ মানুষের পক্ষেও সম্ভব আধ্যাত্মিক ‘পুনর্জন্মলাভ’।
ইসলামধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ীও ঈসানবীর সতীজন্ম। আর হযরত মুহাম্মদের(সা) এরকম একটা স্পিরিচুয়াল রিবার্থ হয়েছিল, কিন্তু বর্তমানে সেটার উপরে খুব বেশি গুরুত্ব খুব একটা দেয়া হয়না, যদিও কোন কোন সুফী তরিকায় সে ঘটনা বেশ অর্থপূর্ণ। সেটা হল ফেরেশতা জিবরাইলকর্তৃক চারবার মুহাম্মদের বক্ষবিদারণ আর হৃদয় প্রক্ষালন।
যীশুর ‘সতীজন্মের’ কারণে তিনিই সেই ব্যক্তি হলেন যিনি নিঃস্বার্থভাবে আত্মত্যাগ করলেন, ক্রুসিফিকশনের মাধ্যমে আত্মার আরেক সমতলে পৌঁছে দেখিয়ে দিয়ে গেলেন দুঃখজরা থেকে মুক্তির উপায়। সে সমতলে তিনিই রাজা, কিং অফ কিংস, লর্ড অফ লর্ডস। শুধু ইহুদীদের নয়, সকল চৈতন্যময় উপলব্ধির রাজা, কিং অফ অল কনশাসনেস। সাথে দেয়া ভিডিওতে জর্জ হেন্ডেলেরমেসিয়া ওরাটোরিওরহালেলুইয়া কোরাসে সেই ‘রাজার’ মহিমাকীর্তন করা হচ্ছে — ২৭৭ বছর পরেও ক্রীসমাসে এটা এখনও বেশ জনপ্রিয় ক্লাসিকাল সংগীত।
আপনার-আমার-সবার স্পিরিচুয়াল রিবার্থ হোক, মনের চোখ খুলুক, হৃদয় নিষ্কলঙ্ক হোক — নিজ অন্তরকে জয় করে যেন সকলে হতে পারি মনের ‘রাজা’! মেরি ক্রীসমাস!
গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।
ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!
এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।
এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।
এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা।
কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অগ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।
সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।
ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।
দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।
পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।
এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।
আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেলডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিকগথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁও–হিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।
অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।
পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।
উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।
বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।
এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।
স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।
কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল।
বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।
ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।
লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!
আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।