পুরাকীর্তির সপক্ষে

পুরাকীর্তির দরকারটা কি? এটা কি খায় না পিন্দে? গরিব মানুষের আবার পুরাকীর্তি কি? অথবা — আধুনিক যুগে আমরা হবো আধুনিক, কেন ফিরে ফিরে প্রাচীনকে আগলে রাখা? এগুলির সাথে আমাদের বর্তমান পরিচয়ের যোগাযোগ কোথায়?

কিংবা, তালেবান-আইসিসের মত ‘এগুলি মোনাফেকি, মোশরেকি, কুফ্ফার; ধ্বংস কর সব!’

শেষ ‘যুক্তি’টা থেকে উল্টোদিকে যাই।

তালেবানরা যখন বামিয়ানের পাহাড় কেটে তৈরি বিশালকায় বুদ্ধমূর্তি রকেট মেরে ধুলায় মিশিয়ে দেয়, তখন আমার চোখ ফেঁটে জল এসেছিল। বামিয়ানের বুদ্ধ এমন এক শৈলীর উদাহরণ যাকে বলে গান্ধার শিল্প — ভারতীয় সনাতন বৌদ্ধ শৈল্পিক রীতির সাথে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সাথে আসা গ্রীক শিল্পী আর তাদের বংশধরদের গতিশীল আইডিয়া মিলে তৈরি হয়েছিল অনন্য গ্রেকো-বুডিস্ট আর্ট।

সিরিয়া-ইরাকে আইসিস গণহত্যাসহ নানা অপরাধ তো করেছেই। তার সাথে সাথে পালমিরার প্রাচীন অনন্য স্থাপত্যশৈলী আর জাদুঘরে রক্ষিত পুরাকীর্তি ধ্বংস করেছে। পালমিরাও গান্ধারশিল্পের মত অনন্য কারণ আরবদের সাথে গ্রীক মিলেছে এখানে। আবার অনেক সুন্দর সুন্দর মসজিদ, সমাধি আর সুফী খানকাও ট্যাংক-রোলার দিয়ে গুড়িয়ে আইসিস ধূলিসাৎ করেছে। চোদ্দশ’ বছর ধরে বিভিন্ন মুসলিম আমলে, এমনকি ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চার খলিফার আমলেও, এ এলাকায় এরকম ধ্বংসযজ্ঞ হয়নি।

মালির তিমবাক্তুতেও ২০১২ সালে ইসলামী কট্টরপন্থী দল আনসারদ্বীন প্রাচীন মালি সাম্রাজ্যের আদি ইসলামী সুফী সন্তদের অদ্বিতীয় সমাধির শৈলী আর সংলগ্ন মসজিদের অংশবিশেষ ধ্বংস করেছে। অথচ সুফীদের মাধ্যমেই সে এলাকায় ইসলামের প্রথম প্রচার-প্রসার হয়।

তাদের এসব করার জন্যে তারা কেতাব ঘাঁটিয়ে ঘাঁটিয়ে সন্দেহপূর্ণ নানা ফতোয়া আর পুরনো উদাহরণ বের করে। কিন্তু আসল ইচ্ছেটা হল, তারা প্রাচীন কালে নবীরা যেমন কা’বা বা অন্য কোন পবিত্রস্থানের ভেতর রাখা মূর্তি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন, তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে মনে মনে পুণ্যার্জন করতে চায়। সুফীদের কোন কোন গ্রুপের ধর্মচর্চা মূলধারার হিসাবে একটু প্রশ্নসাপেক্ষ হতে পারে, কিন্তু পালমিরা-বামিয়ান কি দোষ করলো তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। কারণ সিরিয়া-আফগানিস্তান এখন মুসলিম সংখ্যাগুরু, আর কেউই সেসব জায়গায় গিয়ে প্রাচীন ধর্মের অবতারদের উপাসনা করে না।

বরং পুরাকীর্তি টিকিয়ে রাখারই যুক্তি আমার মনে হয় কোরান-সুন্নাহ পড়লে পাওয়া যায়। সূরা আহকাফে বর্ণনা করা হয়েছে আদ্ আর সামুদ জাতের ওপর গজবের কাহিনী। সৎপথ থেকে বিচ্যুত হবার ফলে তাদের নগরগুলিকে ভূমিকম্প আর ঝড় দিয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়। মাদাইন সালেহ বলে সৌদি আরবের মরুভূমিতে এখনো সামুদ জাতির নগরের ধ্বংসাবশেষ আছে। সুপ্রচলিত একটি হাদীসে মাদা’ইন সালেহর মতো ‘অভিশপ্ত স্থান’ থেকে মুখ ফিরিয়ে চলে যাবার উপদেশ বলা থাকলেও, কুরআনের সূরা রূমের নবম আয়াত অনুযায়ী আমার মতে প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে নৈতিক শিক্ষাগ্রহণের অনুপ্রেরণা রয়েছে। আর পুরাকীর্তি ধ্বংস করার ইসলামী যুক্তি আমি খুঁজে কোথাও পাইনি।

সৌদির কথা যখন উঠলো, তখন স্বীকার যেতেই হয় আইসিস, তালেবান, আনসারদ্বীন — এদের পেছনে সৌদি সরকারের সরাসরি ইন্ধন যদি না থেকেও থাকে তো তাদের নাকের ডগা দিয়ে ধনাঢ্য সৌদি নাগরিকেরা প্রশ্নবিদ্ধ চ্যারিটিতে পয়সা ঢেলে সন্ত্রাসবাদকে মালসামান দিয়েছে। অথচ সৌদিতে কিন্তু কিং সাউদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জাদুঘরে, জেদ্দা জাদুঘরে অনেক পুরাকীর্তি সংরক্ষিত আছে, যাদের মধ্যে প্রচুর প্রস্তরমূর্তি। সেগুলিও মাঝেমধ্যে বাইরের দেশে ট্রাভেলিং একজিবিশনে যায়। মাদাইন সালেহসহ অন্যান্য নগরেও এখন পর্যটকরা যেতে পারে। অর্থাৎ দুনিয়ার সবচে’ ‘বর্বর’ মুসলিম রাজ্যটিও তাদের পুরাকীর্তি টিকিয়ে রেখেছে, আর বহির্বিশ্বকে তা প্রদর্শন করে। পরিহাসের ব্যাপার, ওয়াহাবি কট্টরপন্থীরা ইসলামধর্মের সাথেই জড়িত অনেক সমাধিচিহ্ন — সমাধি নয় — ধ্বংস করে দিয়েছে এই অজুহাতে যে অন্যথায় অশিক্ষিত মানুষ সেগুলিতে গিয়ে খোদার পরিবর্তে নবী বা সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করবে।

অন্তত এটুকু মনে হয় দাবি করতে পারি যে ইসলামে খুঁজে খুঁজে পুরাকীর্তিবিরোধী নিয়ম পাওয়া গেলেও পুরাকীর্তির সপক্ষে উদাহরণ কম নয়। শুধু ইসলামে নয়, যেকোন ধর্মের একটু গোঁড়ারা প্রাচীন শিল্পকর্ম বা পান্ডুলিপি নিয়ে একটু অস্বস্তিতেই থাকে। অধুনা ভারতে হিন্দু কট্টরপন্থীরা পাঁচশো বছরের পুরোনো অনন্য স্থাপত্যশৈলীর বাবরী মসজিদ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে। শুধু যে ধর্মান্ধরাই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী ধ্বংস করেছে তা নয়, কমিউনিস্ট চীনে ষাটের দশকে কালচারাল রেভলুশনের সময় অনেক পুরোনো বৌদ্ধ ও তাওইস্ট মন্দির ধ্বংস করে ফেলা হয়। প্রাচীন চীন সম্রাটদের সমাধি লুট করে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করে ফেলে সরকারি মদদ পুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়-ছাত্রের দল। একই ঘটনা ঘটে কমিউনিস্ট খ্‌মের রুজ শাসিত কম্বোডিয়াতেও

যা হোক, ইসলাম ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে পুরাকীর্তি ধ্বংস করার যুক্তিখন্ডনের একটা চেষ্টা করলাম। এখন জবাব দিই আধুনিক টেকি বস্তুবাদী আত্মতুষ্ট জেনারেশনের প্রশ্নের। পুরাকীর্তির সাথে বর্তমান যুগের যোগাযোগ কোথায়। কেন তারা অমূল্য।

কম্প্লেসেন্ট বলে আমরা আজকের যুগের অনেক কিছুই মেনে নিই, ধরে নিই ‘গ্রান্টেড’। টাকা আছে, কেন টাকা আছে আড়াই হাজার বছর ধরে জানি না! সুতরাং বিটকয়েনে পয়সা ঢালি! টাকাকে নাকি সে প্রতিস্থাপন করবে। টাকা কেন এতদিন ধরে কি কি গুণের কারণে কি কি প্রয়োজন মেটায় তা আমরা জানি না। এগুলো জানতে হলে ইতিহাস-সমাজবিজ্ঞান পড়ে বোঝা যায়। কিন্তু কেউ কি কখনো চিন্তা করে দেখেছে কি ধরনের পরিস্থিতি প্রাচীন তুরস্কের ছোট্ট লিডিয়া রাজ্যে টাকার উৎপত্তি ঘটালো, অথচ তারও প্রাচীন যুগের আরো উন্নত সভ্যতা মিশরে টাকার প্রচলনই ছিল না?

মনে হতে পারে, এসব প্রশ্ন অবান্তর। কি হবে এসব জেনে! কিন্তু মানুষের মনস্তত্ত্ব কিন্তু হাজার বছরের বিবর্তনে খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি! আমরা দশ হাজার বছর আগে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করতাম, এখনো করি। যেধরনের কুসংস্কার নিয়ে চলতাম, এখনো সেসব বেঁচে আছে আমাদের মধ্যে কোন না কোনভাবে। অর্থাৎ খুবই মৌলিক অনেক ব্যাপার আছে যেগুলি দশ হাজার বছর আগে যতটা সত্য ছিল আজও ততটা।

দুনিয়ার সকল মানুষকে ভাবুন একটা বড় প্রাণী, তার বিভিন্ন কোষের মধ্যে নানারকম মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তার বিবর্তন হয়। আমাদের পক্ষে সে প্রাণীটি কোনদিকে গেলে তার উদ্বর্তনটা সুনিশ্চিত হবে, তা বোঝার জন্যে অতীতের দিকেই দৃষ্টিক্ষেপণ একমাত্র রাস্তা। কেন হঠাৎ করে ময়েন্জোদারোর এত উন্নত সভ্যতা বিলুপ্ত হলো সে এক রহস্য। যদি তার সোজাসাপ্টা উত্তর বেরুত, তাহলে বোধহয় আমরা সামগ্রিক সার্ভাইভাল পাজলটার আরেকটা মিসিং পীস পেতাম। ইসলামে আদ্-সামুদের ধ্বংসাবশেষ দেখে যেসকল প্রকারের শিক্ষাগ্রহণের কথা বলা হয়েছে, তার মধ্যে হয়ত এও একটা! যখন আদসামুদের মত গজব আবার আসবে তখন ধনীগরীব কেউই পরিত্রাণ পাবে না!

আর এসকল প্রাকটিক্যাল ব্যাপার-স্যাপারের উপরে আছে আর্ট — শিল্প! একটা সুন্দর নিখুঁত কারুকার্য দেখলে কার না মন জুড়ায়! ময়েন্জোদারোর বালাপরিহিত নর্তনরত কিশোরীর ছোট্ট একটা মূর্তির মধ্যে আমাদের অতি আদি এক পূর্বসূরীর যে মানবিক ছবি ফুঁটে উঠেছে, সামনাসামনি দেখলে মনে হয় এ যুগেরই কোন গ্রাম্য লাস্যময়ী বালিকা।

শুধু তাই নয়, ইরাকের এশনুন্নার জিগুরাতে পাওয়া ছোট ছোট নারী-পুরুষ-শিশুর স্ট্যাচুয়েটগুলি যেভাবে হাত জোড় করে চোখ বড় বড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, তাতে চিত্রিত হয়ছে তাদের অসহায়ত্ব। তাদের সহায় ঈশ্বরকেই স্মরণ করছে তারা। সেদেশে দুই নদী ছিল বেয়ারা, মিশরের নীলনদের মত নিয়মিত দু’তীর প্লাবিত করত না। মাঝেমধ্যে খরা হত, তখন আকাল। আবার ভয়াবহ বন্যাও হত, তাতেও জীবন ও সম্পদের ক্ষয়। সেকারণে তাদের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি আর ধর্মীয় দর্শন ছিল অদৃষ্টবাদী বা ফেটালিস্ট। নূহনবীর বজরা আর মহাপ্লাবনের কাহিনীও মূলে সেদেশের।

সোজা কথায় আমরা আজ যা যা বিশ্বাস করি, যেসব মূল্যবোধকে উচ্চাসন দিই, আমাদের পূর্বপুরুষরা কিভাবে কেন সেসবে উপনীত হলেন, কি ধরনের পরিস্থিতি তাদেরকে সেসবের দিকে চালিত করল — এসকল কিছুর উত্তর আছে পুরাকীর্তি আর প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের গবেষণার মধ্যে। আমরা যতই চেষ্টা করি না কেন সেসবকে ধ্বংস করে আমাদের পুরনো পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে জোর করে নতুন পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করতে, আমরা পারব না! কারণ সেসকল প্রাচীনতা আমাদের মনস্তত্ত্বের মধ্যে, জাতিগত স্মৃতির মধ্যে মজ্জাগতভাবে প্রথিত!

বামিয়ানের বড় বুদ্ধমূর্তি — তালিবানদের ধ্বংস করার আগে ও পরে। ষষ্ঠ শতকে তৈরি এবং হিউয়েস ৎসাং এগুলির বিবরণ দিয়ে গেছেন। আদি মুসলিমদের আমলে টিকে থাকলেও আওরাংজেব প্রভৃতি ফ্যানাটিক শাসক এগুলি ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালান।
গান্ধার শিল্পের এক অনন্য উদাহরণ লাহোর জাদুঘরে সংরক্ষিত উপবাসরত বুদ্ধের এই মূর্তিটি। সম্ভবত চতুর্থ বা পঞ্চম শতকে তৈরি। বুদ্ধের বোধিপ্রাপ্তির আগে তিনি শ্রমণদের সাথে সংযমসাধনা করতেন, সম্ভবত এটা সে সময়ের প্রতিকৃতি। তাঁর দেহ কংকালসার, চক্ষু কোটরাগত; কিন্তু মুখে স্মিতহাসি আর অসাধারণ এক ঔজ্জ্বল্য। গ্রীক শিল্পীরা ছিলেন রিয়েলিস্টিক, কোন ভারতীয় শিল্পী বুদ্ধকে এ ভাবে কল্পনা করার আইডিয়াও পেত না!
পালমিরার দেবতা বা’লের মন্দির ২০১৫তে আইসিস ধ্বংস করে ফেলে। ৩২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত এ মন্দিরটি খ্রীষ্টান রোমান সম্রাটদের পাগানদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় শুদ্ধি অভিযানের সময় বন্ধ করে দেয়া হয়, কিন্তু নানা সাম্রাজ্যের উত্থানপতন সত্ত্বেও টিকে রয়েছিল আইসিস পর্যন্ত।
জার্মানীর ফ্রাংকফুর্টের লীবীগহৌস জাদুঘরে সংরক্ষিত পালমিরিন আর্টের নিদর্শন। ১৫০-২০০ খ্রীষ্টাব্দের লাইমস্টোনে খোদাই করা সমাহিত ব্যক্তির প্রতিকৃতি। মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, হাতে পশুবলির রক্ত ধরার পাত্র। শিল্পটির শৈলী আদতে গ্রীক হলেও সাবজেক্ট স্পষ্টতই সেমিটিক (হিব্রু বা আরব) কালচারের মানুষ।
পশ্চিম আফ্রিকার মালি সাম্রাজ্যের সিদি ইয়াহিয়া আল আন্দালুসি ছিলেন সাংকারে মাদ্রাসা-বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অধ্যক্ষ। তাঁর নামে পরিচিত সিদি ইয়াহিয়া মসজিদটি স্থাপিত হয় ১৪৪০ সালে। তিমবাক্তু সেসময় জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার জন্যে সুপরিচিত ছিল — বর্তমানের আফ্রিকার মত নয়। মসজিদের বিশাল কাঠের দরজায় খোদাই করা ডিজাইন ছিল, মাগরেবী রীতির শৈলীতে। আনসারদ্বীন ২০১২তে অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে বর্তমান যুগের মালির মুসলিমদের তীর্থস্থান এ মসজিদটির দরজা ভেঙ্গে ইট তুলে বন্ধ করে দেয়।
মাদাইন সালেহ বা সালেহ নবীর শহরে এরকম ১৩১টি পাথর কুঁদে তৈরি সমাধি আছে। এগুলি প্রথম খ্রীষ্টাব্দে আল-আনবাত বা নাবাতিয়ান গোত্রের আরবদের তৈরি। কোরানে এদের সামুদ নামে উল্লেখ আছে। জর্দানের পেত্রা শহরের পাহাড় কেটে তৈরি সমাধিগুলিও নাবাতিয়ানদের তৈরি।
স্যান্ডস্টোন খোদাই করে তৈরি এ মূর্তিটি খ্রীষ্টপূর্ব ৩য়-৪র্থ শতকে লিহিয়ানবাসীদের তৈরি। এই সাম্রাজ্য উত্তরপশ্চিম আরব উপদ্বীপে, মদিনা-তাইমা ইত্যাদি শহরসহ বর্তমান লেবানন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আরব বা সেমিটিক তুতো ভাই নাবাতিয়ানদের সাথে এদের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় সম্ভবত বাণিজ্যপথের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে, এবং পরে মাদাইন সালেহসহ বিভিন্ন জায়গায় লাহিয়ানীদের জায়গায় শাসনভার তুলে নেয় নাবাতিয়ানরা। এই মূর্তিটি কিং সৌদ বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষিত। অন্যান্য পুরাকীর্তির সাথে মাঝেমধ্যে বাইরের জাদুঘরেও লোনে যায়।
৬৩০-৬২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের লিডীয় মুদ্রা। ইলেক্ট্রাম নামে সংকরধাতুর তৈরি। সিংহ লিডীয় সংস্কৃতিতে রাজকীয় কর্তৃত্বের প্রতীক। তার মাথার ওপর উজ্জ্বল সূর্য। লিডিয়ার রাজা এসময় ছিলেন সাডিয়াটিস, তাঁর পৌত্র ক্রীসাসের নাম গ্রীক-লাতিন হয়ে ইংরেজীতে এসেছে একটি প্রবচনের মাধ্যমে — রিচ অ্যাজ় ক্রীসাস বলতে খুব ধনবান কাউকে বুঝানো হয়। লিডিয়ার রাজধানী সার্ডিস ভূবনবিখ্যাত ছিল তার সৌন্দর্যের জন্য।
ব্রোঞ্জের তৈরি এই নর্তনরত কিশোরীর মূর্তিটি এখন নয়াদিল্লী জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের সিন্ধু সভ্যতার মহেঞ্জোদারো নগরে আবিষ্কৃত নিদর্শন এটি। মোটে ৪ইঞ্চি এই মূর্তির মধ্যে দৃপ্ত অঙ্গভঙ্গি যেরকম প্রাকৃতিকভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, তার কারণে এটি সুপরিচিত শিল্পকর্ম। তার চুলের খোঁপা করার স্টাইল, হাতভর্তি বালা — এগুলি জানান দেয় যে ভারতীয় উপমহাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় সিন্ধুসভ্যতার সময়ে এখনকার থেকে খুব বেশি আলাদা ছিল না। আরো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে সেসময় সব সভ্যতা ব্রোঞ্জের কাজ জানত না, কিন্তু এরা পারত, এবং ভালই পারত। ১৭০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার মত শহরগুলোর অবক্ষয় শুরু হয়। প্রত্নত্ত্ববিদরা গৃহযুদ্ধ আর যক্ষ্মার মত রোগের প্রমাণ পেয়েছেন। নগরগুলির অবক্ষয়ের সাথে সাথে নাগরিকরা ধীরে ধীরে গ্রামে চলে যায়, তাই সিন্ধুসভ্যতার আচারব্যবহার ইত্যাদির অবশেষ বেঁচে গেছে গ্রাম্য সংস্কৃতির মধ্যে। অনেক ইতিহাসবিদের ধারণা বৈদিক ধর্মের মধ্যেও সিন্ধুসভ্যতার প্রভাব রয়েছে।
এশনুন্না প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার একটি নগররাষ্ট্র। সেখানকার দেবতা আবুর মন্দির বা জিগুরাতের ধ্বংসাবশেষে এই প্রার্থনাকারীদের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়। ২৯০০ থেকে ২৫৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে লাইমস্টোন খোদাই করে তৈরি এগুলো। আসলে প্রার্থনাকারীরা উপাসনা থেকে দৈনন্দিন কাজে ফিরে যাবার আগে দেবমূর্তির সামনে নিজেদের প্রার্থনারত ছোট ছোট মূর্তি স্থাপন করে যেতেন, যেন দেবতা তুষ্ট থাকেন তারা সশরীরে সামনে না থাকলেও। প্রার্থনার ভঙ্গি, পোশাকআশাকের ডিটেইল, পিগমেন্টে রং করা বড় বড় চোখ — সবকিছু প্রাকৃতিক। পোশাক আশাক বর্তমানের হলে বোধহয় আধুনিক চার্চে খ্রীষ্টান প্রার্থনাকারী বলে চালিয়ে দেয়া যেত!

গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!

Featured Video Play Icon

মালয়েশিয়ার এথনিক চীনা শিল্পী ইমী উইয়ের গাওয়া এ গানটি বৌদ্ধ ধর্মের সবচে’ পবিত্র মন্ত্রগুলোর একটি। এর নাম প্রজ্ঞাপারমিতাহৃদয় সূত্রম — সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ প্রজ্ঞার পরিপূর্ণতার অন্তঃকরণ। অর্থাৎ এ মন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে সর্বোচ্চ সত্য উদ্ঘাটনের গূঢ়তত্ত্ব।

মহাযান মতধারার বৌদ্ধধর্মে প্রজ্ঞাপারমিতার স্থান উচ্চাসনে। এ প্রসঙ্গে বলা ভাল যে, ইসলামে যেমন দু’টো বড় শাখা শিয়া ও সুন্নী, তেমন বৌদ্ধধর্মের তিনটি প্রধান ধারা বা ‘যান’ থেরবাদী, তান্ত্রিক আর মহাযানী। থেরবাদী আর মহাযানীর মধ্যে মৌলিক তেমন কোন তফাত নেই; থেরবাদকে ধরা যেতে পারে সনাতন, প্রাচীন; মহাযান অন্যান্য দেশে গিয়ে তাদের স্থানীয় আচারকে একীভূত করে নিয়েছে। বাংলাদেশ-শ্রীলংকা-মিয়ানমারসহ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে থেরবাদ প্রচলিত। চীন-ভিয়েতনাম-জাপানের মহাযান পন্থার শাস্ত্রীয় আনুষ্ঠানিকতা থেরবাদের থেকে বেশি। মহাযানী ধারার একাংশ ভূটান-তিব্বত-মোঙ্গোলিয়াতে গিয়ে সেখানকার প্রাচীন শামানিস্ট বিশ্বাসকে মিলিয়ে নিয়ে হয়ে গেছে গূঢ়তাত্ত্বিক অধ্যাত্মবাদ, যার নাম তন্ত্রযান বা বজ্রযান।

ধারণা করা হয়, প্রজ্ঞাপারমিতাসূত্রের উদ্ভব খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে। সবচে’ প্রাচীন আবিষ্কৃত নমুনাটি ৭৫ খ্রীষ্টাব্দের, এর নাম অষ্টসহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা, কারণ এতে আট হাজার পংক্তি রয়েছে। ১৭৯ খ্রীষ্টাব্দে কুষাণ সাম্রাজ্যের এক বৌদ্ধ শ্রমণ চীনা ভাষায় প্রজ্ঞাপারমিতার অনুবাদ করেন। এর আশপাশ দিয়েই ভারতবর্ষ থেকে চীনে বৌদ্ধধর্মের আগমন ঘটে। চীনের সুপরিচিত শাওলিন টেম্পলের শ্রমণরা মহাযানপন্থারই অনুসারী। আত্মসংযম চর্চার জন্যে চীনা শ্রমণরা যে ধ্যান করে, তাকে তারা ডাকে ‘চান’ বলে। জাপানে গিয়ে চান হয়ে গেছে ‘জ়েন’

বাংলায় পাল রাজবংশ ছিল মহাযান আর তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের বড় পৃষ্ঠপোষক। অষ্টম থেকে দ্বাদশ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত পালরা উত্তরপূর্ব ভারতের বিভিন্ন রাজ্য শাসন করে। বিহারের নালন্দাবিক্রমশীলা আর বাংলাদেশের নওগাঁর সোমপুর বিহার পালদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধি লাভ করে। দ্বাদশ শতকে দিল্লীর মামলুক সুলতানাতের তুর্কী সেনাপতি বখতিয়ার খিলজির আক্রমণে এসকল বিহার লুন্ঠিত-বিধ্বস্ত হয় — অবশ্য ইতিমধ্যে পালসাম্রাজ্যের অন্তিমযাত্রা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

নালন্দা-সোমপুর ছিল অনেকটা এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মত। ধর্মের পাশাপাশি সাহিত্য, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি চর্চার কেন্দ্র ছিল বিহারগুলি। পালপূর্ববর্তী গুপ্ত আর বর্ধন রাজবংশের আমলে চীন থেকে ঈ জিং, শ়ুয়ান ৎসাং, ফাশ়িয়ান — শেষ দু’জনকে আমরা চিনি ‘হিউয়েন সাং’ আর ‘ফা হিয়েন’ নামে — ভারতের এসব বিহারে এসেছিলেন সংস্কৃত শিখতে আর বৌদ্ধ সূত্রের পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তারা চীনে ফিরে সেসবের অনুবাদ করেন — প্রজ্ঞাপারমিতাও ছিল এদের মাঝে। ইন্দোনেশিয়ার শ্রীবিজয়ারাজ্যও পালযুগে নালন্দায় বিহারস্থাপনের জন্যে অর্থ যোগান দেয়।

পালদের যুগেই বাংলা ভাষার আদিরূপ আবির্ভাব হওয়া শুরু করে। প্রাচীন বাংলার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদ তান্ত্রিক বৌদ্ধ অধ্যাত্মবাদের অমূল্য সাহিত্যকর্ম। ঢাকার বিক্রমপুরের সন্তান অতীশ দীপংকর মহাযান-বজ্রযান পন্থার বিস্তারের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন। ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রায় অধ্যয়নের পরে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে তিব্বতের রাজার অনুরোধে সেদেশে যান অতীশ। তিব্বতী তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মে তিনি এখনও সম্মানের আসনে অধিষ্ট। ২০০৩এ সোমপুর বিহার দেখতে গিয়েছিলাম যখন, তখন এই ভেবে গায়ে শিহরণ হয়েছিল যে, সাড়ে আটশ’ বছর পূর্বে সেখানের সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামা করতেন অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান, আর হয়ত প্রাচীন বাংলাতেই তাঁর কথোপকথন হত সঙ্গী-সাথীদের সাথে! এখনো জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া থেকে প্রচুর বৌদ্ধ পর্যটক এসকল বিহারে তীর্থযাত্রায় আসেন।

প্রজ্ঞাপারমিতা বর্তমানযুগে ‘ধারণী’ মন্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ এ মন্ত্র যে পাঠ করবে — সে অর্থ বুঝুক বা নাই বুঝুক — অমঙ্গল তাকে স্পর্শ করবে না। অনেকটা যেমন আমাদের দেশী সরল ধার্মিক মানুষ অর্থ না জেনে সূরা-দোয়া মুখস্ত করেন আর সোচ্চারে পাঠ করেন। বলতে পারেন, পালযুগে আমরা একই কাজ করতাম বৌদ্ধমন্ত্র নিয়ে। অর্থাৎ আমাদের ধর্মচর্চাপদ্ধতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি! চীনা-জাপানীদের বৌদ্ধধর্মের সেই একই দশা! তারা সংস্কৃত শব্দোচ্চারণের স্বদেশী রূপ দিয়ে প্রজ্ঞাপারমিতা আবৃত্তি করে — অথচ উচ্চারিত শব্দগুলোর কোন সত্যিকার অর্থ তাদের ভাষাতে নেই!

আনুষ্ঠানিকতার জাল ভেদ করে প্রজ্ঞাপারমিতা সূত্রের মূল বিষয়বস্তুটা বুঝানোর চেষ্টা করি। এতে বুদ্ধশিষ্য, গৌতমের অন্যতম সাথী, শারিপুত্রের সাথে কথোপকথন হচ্ছে অবলোকিতেশ্বরের। অবলোকিতেশ্বর হচ্ছেন গৌতমের নির্বাণপরবর্তীযুগে পুনর্জন্ম হয়ে আসা বর্তমানযুগের বোধিসত্ত্ব। সংসারের জাল ছিন্ন করে বোধিপ্রাপ্ত হলেও অন্যান্য প্রাণীর প্রতি দয়াপরবশ হয়ে পরিনির্বাণ গ্রহণ না করে ফিরে ফিরে আসেন ধর্মদীক্ষাদানের জন্যে, যাতে অন্যেও তাঁর শিক্ষা নিয়ে বোধি বা সত্যের সন্ধান পেতে পারে।

শারিপুত্রকে অবলোকিতেশ্বর শেখাচ্ছেন মোক্ষলাভের মূলমন্ত্র: সকল বস্তু, ভাবের অস্তিত্বের সাথে তাদের অনস্তিত্ত্বের কোন পার্থক্য নেই! দ্বিতীয় বুদ্ধ বলে পরিচিত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের শূন্যতাবাদের তত্ত্বে এই চিন্তা পরিপূর্ণতা পেয়েছে। এ তত্ত্ব লিখে বা বলে বোঝানো খুব কঠিন! মনোভাবটা জাগ্রত করতে হলে চাই কঠোর সাধনা। সোজা ভাষায় যদি বোঝাতে চেষ্টা করি, তাহলে এটুকুই বলতে পারি যে, সকল দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায় এটা অন্তরের অন্তস্তলে অনুভব করা যে, কোন কিছুর অস্তিত্ত্ব আছে বলেই আমরা তার অনস্তিত্ত্ব বা অভাব বোধ করি। দুঃখজরার মূল প্রথিত সেই জ্ঞানের মধ্যেই। যদি মোহমুক্তি পেতে চাই তাহলে আত্মপরিচয় বা ইগোকে পরিত্যাগ করতে হবে, মিলিয়ে দিতে হবে শূন্যতার মাঝে, যেখানে বস্তু বা ভাবের অনস্তিত্ত্ব আর অস্তিত্ত্বের উপলব্ধির মাঝে কোন ফারাক নেই। দুঃখ থেকে মুক্তি সে পথেই।

এটা অন্য ধর্মদর্শনের মাধ্যমে বোঝানোটা মনে হয় খুব বেশি কঠিন নয়। ইসলামের সুফী মতের সাথে তুলনা করে দেখতে পারেন। সেখানে খোদাপ্রেমের মদে মত্ত মানুষ নশ্বরতার পরিধি পেরিয়ে হতে চায় স্রষ্টার সাথে একাত্ম। হাদীসের ভাষায় ‘মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুবরণ করা’! কিংবা চেষ্টাচরিত্রের পরে মন্দভাল যাই ফল হোক না কেন, তাকে গ্রহণ করে কৃতজ্ঞ হওয়া। খুব একটা তফাত নেই প্রজ্ঞাপারমিতার থেকে। বাউলিয়ানার ওপরেও  বৌদ্ধ দর্শনের কিছুটা প্রভাব এক সময় পড়েছিল।

বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন বা নাস্তিক যুক্তিবাদী দর্শনের দিকে যদি চোখ ফেরাই তাহলেও এ ধরনের চিন্তাধারা রয়েছে। ঊনবিংশ শতকে আর্থার শপেনহাওয়ার তাঁর ‘দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ় উইল অ্যান্ড রিপ্রেজ়েন্টেশন’ বইটিতে অস্তিত্ত্বের উপলব্ধিকে তুলে ধরেছেন মানুষের প্রবল ইচ্ছাশক্তির চূড়ান্ত অভিব্যক্তি হিসাবে। যদিও শপেনহাওয়ার বৌদ্ধ দর্শনের সাথে পরিচিত ছিলেন আর সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা পান, তাঁর ব্যাখ্যা বৌদ্ধ চিন্তাধারার অনেকটা বিকৃত পশ্চিমা সংস্করণ । শপেনহাওয়ার পক্ষান্তরে অনুপ্রেরণা যোগান আধুনিক যুগের আরো অনেক দার্শনিক, লেখক ও বৈজ্ঞানিককে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন ফ্রয়ড, আইনস্টাইন, য়্যুঙ, মপাসঁ, নয়মান, নিচা, শ্রয়ডিঙার, তলস্তয়, ভ়াগনার — আর নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক হেরমান হেসা!

এই হেরমান হেসার ‘সিদ্ধার্থ’ উপন্যাসটি আমার তরুণ বয়সে পড়া, আমার পরবর্তী চিন্তাভাবনার উপর এর প্রভাব অপরিসীম। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বেশ ভাল একটা বাংলা অনুবাদ পড়েছিলাম, পরে ইংরেজী দু’টি আলাদা অনুবাদও। এই অসাধারণ কাহিনীতে গৌতম নয়, সিদ্ধার্থ বলে আরেক সমসাময়িক কল্পিত রাজকুমারের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় অবলোকন করতে পারবেন — তাঁর মনোবেদনা, মোক্ষলাভের সংগ্রাম, শ্রমণজীবন, ‘মধ্যপন্থার’ আবিষ্কার, সংসারে মনোনিবেশ, গৌতমবুদ্ধের সাথে মোলাকাত, শেষ পর্যন্ত নদীপারাপারের তরীচালক হিসাবে তাঁর অহমলোপ আর বোধিপ্রাপ্তি।

হেসা খুবই নিখুঁতভাবেই মহাযান বৌদ্ধ দর্শনের প্রজ্ঞাপারমিতা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সে তত্ত্বে বোধিলাভের জন্যে থেরবাদের অন্তর্মুখী সাধনার আবশ্যকীয়তা নেই, জাগতিক সুখদুঃখের অনুভূতি অক্ষত রেখেই শূন্যতার উপলব্ধি অর্জন করা সম্ভব। অর্থাৎ আমি-আপনি যে জাগতিক অবস্থাতেই থাকি না কেন, কিছু মৌলিক সত্যের ওপর মনোনিবেশ করলে অহমের বিলোপ, মনের দ্বন্দ্বগুলি প্রশমন করে দুঃখজরার বিনাশসাধন অসাধ্য নয়।

মনে হয় পাঠক ইতিমধ্যে আন্দাজ করতে পারছেন সব ধর্মের একটা মৌলিক গুণ মানসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতগুলির নিরসন করে শান্তিতে বিরাজমান হওয়ার পথ বাতলানো। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এব্রাহাম ম্যাজ়লো বলে এক মনস্তত্ত্ববিদ মানবিক চাহিদার খুঁটিনাটি গবেষণা করেছেন। তাঁর শ্রেণীবিভাগের সর্বনিম্ন স্তরে রয়েছে দৈহিক চাহিদা, তার পরে নিরাপত্তা, তৃতীয়ত প্রেম-ভালোবাসা বা কোন জাতিগোত্রের সাথে একাত্মতার চাহিদা, চতুর্থত শ্রদ্ধা-মর্যাদার চাহিদা, আর সর্বোচ্চ স্তরের নাম দিলেন সেল্ফ়-অ্যাকচুয়ালাইজ়েশন। প্রথম চারটি স্তর অতিক্রম করে মানুষ শেষ স্তরে এসে চায় স্বপরিচয়ে, স্বপেশায় পারফ়েকশন বা পূর্ণতাপ্রাপ্তি। বৌদ্ধ দর্শনে এটা অহম বা ইগোর সর্বোচ্চ রূপ।

ম্যাজ়লো পরে আরো একটি পর্যায় যোগ করেন যার নাম দেন ট্রানসেন্ডেন্স বা স্ব-কে অতিক্রম করা। বৌদ্ধ দর্শনে এটাই অহমের বিলোপ, নিজের থেকে বেশি কিছু হয়ে ওঠা, শূন্যতা!

এপর্যায়ে এসে প্রজ্ঞাপারমিতার শেষ পংক্তি অনুযায়ী আপনি ‘গতে, গতে, পারগতে, পারসংগতে — বোধি স্বাহা!’ — নদীর অপরপারে! স্নান করছেন বোধির আলোকচ্ছটায়! তবে তাই হোক!

থ্যাংকসগিভিংয়ের মার্কিন ঐতিহ্য

Featured Video Play Icon

আগামী সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হবে থ়্যাংকসগিভ়িং নামে রাষ্ট্রীয় ছুটি। প্রতি নভ়েম্বরের চতুর্থ বৃহস্পতিবার এ দিবস পালিত হয়। পরেরদিন শুক্রবারও অধিকাংশ অফিস বন্ধ থাকে। শুধু ব্যস্ত থাকে শপিং মল। ব্ল্যাক ফ্রাইডে নামে পরিচিত এ দিনে দোকানপাটে আপনি পাবেন বছরের সবচে’ বড় ছাড়। বিশেষ করে যারা দামী ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী কিনতে চান, তাদের তো পোয়াবারো! অনেক শহরে রঙচঙে ফ্লোট বা সজ্জিত ভেলাসহকারে মার্চিং ব্যান্ডের তালে তালে বেসামরিক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। এগুলোর মধ্যে সবচে’ নামকরা হলো নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটানে মেইসিজ় বলে চেইন ডিপার্টমেন্ট স্টোরের আয়োজিত মেইসিজ় থ়্যাংকসগিভ়িং প্যারেইড

মার্কিনদের জন্যে বড়দিনের মত থ়্যাংকসগিভ়িংও পারিবারিক পুনর্মিলনীর একটা বড় সুযোগ। মায়ের তৈরি (বা পছন্দ করে কেনা!) ক্র্যানবেরি সস, ম্যাশড পটেটো, গ্রেভ়ি, স্প্রাউটস, সুইট কর্ন, গ্রীনবীন ক্যাসরোল, পামকিন পাই আর ঐতিহ্যবাহী স্টাফ়ড টার্কী খেতে ছেলে-মেয়েরা দূরদূরান্তের কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরে। বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় তাই এয়ারপোর্ট-হাইওয়েগুলোর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধর্মানুরাগী পরিবারদের থ়্যাংকসগিভ়িং ডিনার শুরু হয় ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞতাজ্ঞাপনের ‘গ্রেইস’ প্রার্থনার মাধ্যমে। খাবার পর রাতে সবাই বের হয়ে পড়ে, দোকানপাটের লাইনে দাঁড়িয়ে যায় ‘ডোরবাস্টার ডীল’ ধরার লোভে!

ক’দিন আগে বলছিলাম যে অক্টোবর শেষের হ্যালোউইন আসলে একটি নবান্ন উৎসব বা হারভ়েস্ট ফ়েস্টিভ্যাল। থ়্যাংকসগিভ়িংএর মূলও নবান্নের মধ্যেই! কিভাবে বুঝিয়ে বলি।

চারশ’ বছর আগে, ১৬২০ সালে, মেফ্লাওয়ার নামক এক জাহাজে করে প্রায় একশ’ ‘পিলগ্রিম’ নারী-পুরুষ-শিশু ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পিলগ্রিমরা ছিল ক্যালভ়িনিস্ট প্রটেস্ট্যান্ট খ্রীষ্টানদের একটি গোত্র — এরা ক্যাথলিকদের সনাতন ধর্মবিশ্বাস তো মানতই না, এমনকি ইংল্যান্ডের প্রটেস্ট্যান্ট অ্যাংলিকান চার্চের আনুষ্ঠানিকতাতেও তাদের আপত্তি ছিল। নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসের স্বাধীন চর্চার লক্ষ্যে তারা জন্মভূমি পরিত্যাগ করে।

আমেরিকার দক্ষিণে আরামদায়ক ভার্জিনিয়া কলোনিতে যাবার কথা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে তারা উত্তরপূর্বের বর্তমান ম্যাসাচুসেটস স্টেটের প্লিমথে নোঙর ফেলতে বাধ্য হয়। যথেষ্ট খাবার মজুদ তাদের ছিল না, আর শীতের সময় বুনো ফলমূলেরও অভাব ছিল। ফলে ঠান্ডায়-অপুষ্টিতে দলটির সদস্যরা অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর প্রায় অর্ধেক মারা যায়।

পিলগ্রিমদের নতুন পড়শী ওয়াম্পানোগ ট্রাইবের নেটিভ় আমেরিকানদের সাথে প্রথম প্রথম কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও শেষ পর্যন্ত দু’দলের মধ্যে শান্তিচুক্তি নিষ্পত্তি হয়। ওয়াম্পানোগরা তাদের মজুদ ভান্ডার থেকে ভুট্টা, শিকারকরা পশুর মাংস, ইত্যাদি দিয়ে পিলগ্রিমদের সাহায্য করে।

শীত শেষে পিলগ্রিমরা নেটিভ়দের কাছ থেকে স্থানীয় জীবনযাত্রার শিক্ষাগুলি নিয়ে চাষাবাদ করে আর তাদের ফসলের ভালো ফলন হয়। সে এলাকায় টার্কী আর বুনো মুরগীর মত পাখিরও প্রাচুর্য ছিল। নবান্নে তাই পিলগ্রিমরা ওয়াম্পানোগদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ায়। আর তাদের কাছ থেকে শীতের সময় নেয়া খাবারের ঋণ পরিশোধ করে দেয়।

তিনদিনব্যাপী সেই মহাভোঁজে ওয়াম্পানোগরাও হরিণ শিকার করে নিয়ে আসে। ৯০জন নেটিভ় আর ৫০জন পিলগ্রিম মিলে সব খাবার ভাগাভাগি করে খায়। রান্নার দায়িত্বে ছিলেন পিলগ্রিমদের দলের চার মহিলা। ইতিহাসবিদদের ধারণা এ ভোঁজটি হয় ১৬২১এর অক্টোবরের শেষে, মানে হ্যালোউইনের ধারকাছ দিয়ে। অবশ্য পিলগ্রিমরা হ্যালোউইন-ক্রীসমাসের আনুষ্ঠানিকতা মানতো না।

প্লিমথে বসতির গোড়াপত্তনের পরে প্রায় নিয়মিত এই বাৎসরিক ভোঁজ আয়োজন করা হত, তারিখটা স্থির ছিল না। বিশেষ করে ১৬২৩এ খরার কারণে পিলগ্রিমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তারা খোদার কাছে প্রার্থনা করে, রোজা রাখে। তারপর ‘অলৌকিকভাবে’ দু’সপ্তাহ টানা বৃষ্টি হওয়ায় তাদের ফলন বিপন্মুক্ত হয়। সেবার তাদের থ়্যাংকসগিভ়িং ভোঁজ তাই ছিল আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

এরপর শতবছরের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় উদ্যোগে পিলগ্রিমদের উত্তরসূরীরা থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখে। ১৭৭৭এ আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে হবু রাষ্ট্রপতি ওয়াশিংটন একে প্রথমবারের মত দেশব্যাপী সরকারী ছুটির স্বীকৃতি দেন। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট টমাস জেফ়ারসন অবশ্য রাষ্ট্রীয় আর ধর্মীয় বিধানের পৃথকীকরণের যুক্তিতে থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের ছুটি ঘোষণা দেয়া থেকে বিরত থাকেন। পাকাপোক্তভাবে ছুটিটি আবার চালু করেন এব্রাহাম লিংকন।

তারিখটা নিয়ে অবশ্য একটু শোরগোল তুলেছিলেন ফ্র্যাংকলিন রোজ়াভ়েল্ট। ১৯৩৯ সালে তিনি নভ়েম্বরের শেষ পঞ্চম বৃহস্পতিবারের পরিবর্তে চতুর্থ বৃহস্পতিবার (এ বছরের মত!) ছুটি ঘোষণা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল যাতে ক্রীসমাস শপিংয়ের জন্যে একটা সপ্তাহ বেশি পাওয়া যায় — তাতে বিক্রিবাট্টা বেড়ে যদি গ্রেট ডিপ্রেশনের মন্দার অর্থনীতিটা একটু চাঙা হয়। এ ব্যাপারটা অনেক রিপাবলিকান মানতে পারেনি। পরে কংগ্রেস আইন করে চতুর্থ বৃহস্পতিবার ছুটির দিন স্থির করে দেয়।

থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের সাথে মার্কিনদের দানশীলতার একটা ঐতিহ্যও জড়িত। ক্রীসমাসের একমাস আগে থেকে সব দাতব্য প্রতিষ্ঠান মাঠে নেমে পড়ে তহবিল সংগ্রহের জন্যে। ছুটির আমেজে সাধারণ মানুষও থাকে দরাজদিল। শপিং করে মল থেকে বেরুনোর পথে ঘন্টি-বাজানো অর্থসংগ্রহকারীর সাজানো বালতিতে দু’-চার ডলার ফেলে দিতে কসুর করে না অনেকে — হোক সে অসুস্থ-অনাথ শিশুদের হাসপাতালের জন্যে, কিংবা যুদ্ধাহত অথর্ব সৈনিকের কল্যাণার্থে , অথবা হয়ত গৃহহীন মানুষের খাদ্যসংস্থানের ফ়ুড ড্রাইভ়ের জন্যে।

অনেক নেটিভ় আমেরিকান কলাম্বাস ডে’র মত থ়্যাংকসগিভ়িংকেও মনে করে তাদের জাতির ওপর অত্যাচারের ইতিহাসের অবমাননা হিসাবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, নেটিভ়দের ওপর গতানুগতিক নিষ্পেষণ তুলনামূলক অধুনার ঘটনা — ঊনবিংশ শতকের প্রায় পুরোভাগ জুড়ে। আর সেসময়টাতে নেটিভ়দের হাতেও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। তারা ছিল বিভক্ত, অসংগঠিত — যার সুযোগ নেয় শ্বেতাঙ্গ র‍্যাঞ্চার, কাউবয় আর আউটল’রা। কিন্তু তারও আগে নেটিভ়রা ব্রিটিশ-ফরাসী-আমেরিকান সব পক্ষে তাদের সমকক্ষ হয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। পিলগ্রিমদের সাথে ওয়াম্পানোগদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইতিহাস যেমন রয়েছে, তেমনই নেটিভ়দের অন্য ট্রাইব কর্তৃক ভার্জিনিয়াতে সেটলারদের পুরো জনপদ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ারও ইতিহাস আছে। আর যদি ইউরোপীয়রা তাদের জমি চুরিই করে থাকে, তাহলে তো আমাদের আর্য-আরব-পারসিক পূর্বপুরুষরাও ইউরোপীয়দের মতই জবরদখলকারী — যাঁরা বাংলার সাঁওতাল, অস্ট্রোনেশিয়ান আদিবাসীদের আবাসভূমি বেদখল করেছিলেন — কতটুকু ছলে-বলে-কৌশলে সে কারো মনে নেই, কারণ সে ঘটনা ‌অধুনার নয়। বর্তমানের মূল্যবোধ দিয়ে অতীতের ‘অপরাধের’ বিচার করা ন্যায়সঙ্গত নয়। আর নেটিভ় আমেরিকানদের বর্তমান জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ সাড়ম্বরে থ়্যাংকসগিভ়িং উদযাপন করে। ব্ল্যাক ফ্রাইডেকে অফিসিয়ালি কিন্তু ডাকা হয় নেটিভ় আমেরিকান হেরিটেজ ডে’ নামে।

শেষ করি এই লেখার জুড়ি গানটা নিয়ে কিছু কথা বলে। গানটা আইরিশ গেলিক ভাষায়, গেয়েছেন ময়রা ব্রেনান, প্রখ্যাত নিউ এইজ শিল্পী এনিয়ার বোন। এটি কিন্তু বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টের বুক অফ় সামসের একটি সাম বা প্রার্থনাগীতি — ক্যাথলিকরা মাসের সময় এরকম গান গেয়ে খোদার প্রশংসাকীর্তন করে। বেশির ভাগ প্রটেস্ট্যান্টরা অবশ্য মাস পালন করে না, কিন্তু পিলগ্রিমরা মাস না করলেও সামগীতি গাইত বলে ইতিহাসে উল্লেখ আছে। এখনও থ়্যাংকসগিভ়িং থ়ার্সডে’র আগের বা পরের রোববার মার্কিনের চার্চগুলিতে বিশেষ থ়্যাংকসগিভ়িং প্রার্থনা হয়। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে যাচাই করলেও থ়্যাংকসগিভ়িংয়ের প্রার্থনার মূল লক্ষ্য পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।

আমার কাছে ময়রা ব্রেনানের থ়্যাংকসগিভ়িং সামের সুর ও কথা দু’টিই খুব হৃদয়ছোঁয়া মনে হয়। প্রার্থনাকারীরা বলছেন: “ঈশ্বর, আমাদের করুণা করুন, আশীর্বাদ দিন।। পৃথিবীর সকল জাতি গাইছে আপনার প্রশস্তি।। সকল গোত্রের ন্যায়বিচারক, পথপ্রদর্শক আপনি।। এ ভূমির ফলন্ত ফসল আপনার আশীর্বাদ।। সকল দেশের মানুষের সকল প্রশংসা আপনার।।” সোজা আরবীতে: আলহামদুলিল্লাহি রাব্বুল আলামীন, আর্ রাহমানির রাহীম — কুরআনের উদ্বোধনী সূরা ফ়াত়িহ়ার প্রথম দু’টি পংক্তি!

ব্লুগ্রাস!

Featured Video Play Icon

যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিমে প্যাসিফিক মহাসাগরের পাশে দুটো সুন্দর স্টেট আছে — ওরেগন আর ওয়াশিংটন। এই এলাকার রেইন ফরেস্টের সুউচ্চ চিরহরিৎ গাছপালা, নয়নাভিরাম তুষারাবৃত পর্বত আর পাথুরে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিস্কো পর্যন্তও বিস্তৃত। ওরেগনে বেশ ক’বছর আগে গ্রীষ্মের কয়েক মাস কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেসময়ের অন্যতম স্মৃতি হল এক মার্কিন সহকর্মী বন্ধুর সাথে প্রশস্ত কলাম্বিয়া নদীর তীরে ক্যাম্প করে দু’রাত্রি কাটানো — স্কামানিয়া ফ়োক ফ়েস্টিভাল উপভোগ করার উসিলায়।

সে উৎসবে গেছিলাম মূলত আইরিশ স্টেপ ড্যান্সিং সামনাসামনি দেখার লোভে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই এনিয়াচীফটেইনস প্রমুখ শিল্পীর গান আর স্টারটিভিতে রিভ়ারড্যান্স শো দেখে আইরিশকেল্টিক ঐতিহ্যের প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। হাতে আঁকা ছবির মত নিসর্গের মাঝে খোলা আকাশের নিচে সেই আইরিশ নৃত্য-গীতি-বাদ্য দেখা-শোনা তো হলোই, উপরি হিসাবে পেলাম মার্কিনদেশের নানারকম উপভোগ্য লোকগীতির পরিবেশনা। তার মধ্যে ছিল ফ়োক, ব্লুজ়, জ্যাজ় — আর ব্লুগ্রাস!

এর আগে ব্লুগ্রাস সম্পর্কে আমার ধারণা খুব বেশি ছিল না। শুধুমাত্র যেখানে এর নমুনা পেয়েছিলাম, সেটা হল কোয়েন ব্রাদারস পরিচালিত, জর্জ ক্লুনি অভিনীত অনবদ্য মিউজ়িক্যাল চলচ্চিত্র ‘ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ’। এ লেখার অনুসঙ্গ হিসাবে তার থেকে একটা গান জুড়ে দিলাম।

গানের কথায় বুঝতে পারছেন, গায়ক (বা গীতিকার) দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় উজাড় করে দিচ্ছে। আমেরিকার দক্ষিণের পাহাড়ী আপালাচিয়া অঞ্চলের কেন্টাকি স্টেটে তার জন্ম। সারাজীবন নানারকম ঝুটঝামেলা তার সঙ্গী। মানে, হয়ত সে সমাজচ্যুত আউটক্যাস্ট, অথবা আইন থেকে পলাতক আউটল’। তার নেই কোন বন্ধু-নিকটজন, যে তার ছন্নছাড়া জীবনে সহায় হতে পারে। পথে হয়ত প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সেখানেও পিছু ছাড়েনি তার অতীত। তাই আবার সে পলায়নপর, হয়ত তার মরণ হবে সে প্রচেষ্টায়। হয়ত প্রেমিকা তাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালবাসবে, কিন্তু তাতে তার হাঁহুতাশ নেই! কারণ এ সুনিশ্চিত, যে একসময় না একসময় স্বর্গের স্বর্ণালী সৈকতে আবার দেখা মিলবে দু’জনার!… গানটা যতটা না দুঃখের, তার থেকে বেশি বোধহয় দুর্ভাগ্যপীড়িত অনন্যোপায় গায়কের সান্ত্বনালাভের প্রয়াস। (মুভ়িটা দেখলেই বুঝবেন গানের মাজেজা!)

এখানে গানটা পুরোপুরি ব্লুগ্রাস স্টাইলে গাওয়া হয়নি, কারণ একমাত্র সঙ্গত গীটার। সাধারণত ব্লুগ্রাস গানে গীটারের সাথে ব্যাঞ্জো, ফ়িড্ল, ম্যান্ডোলিন, স্ট্রিং বাস, ইত্যাদি জুড়ি থাকে। কিন্তু মুভ়িতে ক্লুনির কল্পিত ব্যান্ড সগি বটম বয়েজ় নামের সাথে প্রখ্যাত ব্লুগ্রাস ব্যান্ড ফ়গি মাউন্টেইন বয়েজ়ের সুস্পষ্ট মিল। তিরিশ-চল্লিশের দশকে রেডিও আর গ্রামোফ়োন জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হওয়া শুরু করে যখন, তখন ১৯১৩তে লেখা এ গানটি আরো অনেকের পাশাপাশি ব্লুগ্রাস শিল্পীরাও রেকর্ড করেন। অধুনাযুগের সবচে’ খ্যাতিমান ব্লুগ্রাসগায়ক রাল্ফ় স্ট্যানলিও এটা গেয়েছিলেন, অ্যালিসন ক্রাউসও। সুতরাং ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র ব্লুগ্রাস যোগাযোগ অনস্বীকার্য।

কিভাবে ব্লুগ্রাসের উৎপত্তি হলো, সে কাহিনী ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মতই মর্মস্পর্শী। আমেরিকায় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত দাসত্বপ্রথা ছিল সে আমরা ভালমতই জানি। যেটা অত ভালমত জানি না, সেটা হলো একই শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ কিভাবে একরকম দাস হিসাবেই মার্কিনে এসেছিল। এখনকার ভাষায় এদেরকে বলে ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট, বা চুক্তিবদ্ধ চাকর।

ইউরোপীয় জাহাজী আর দালালের দল ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের সহায়সম্পত্তিহীন কর্মক্ষম মানুষ পেলে তাদেরকে নতুন বিশ্বের উন্নত জীবন আর সুযোগের কথা দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে চুক্তিনামায় সই করাত, তারপর আমেরিকায় এনে টাকার বিনিময়ে তুলে দিত তাদের মালিকের কাছে। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে পরপর কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কারণে জীবন বাঁচাতে গরিবদের চুক্তিস্বাক্ষরব্যতীত আর তেমন কোন উপায় ছিল না। চুক্তি অনু্যায়ী যতদিন না সেই চাকর গতর খেঁটেই হোক আর অন্য কোনভাবে হোক, অন্তত তার জাহাজভাড়া না পরিশোধ করছে, ততদিন সে মালিকের আজ্ঞাবাহী। যদি পালায় তো কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মতই তাকে খুঁজে বের করে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম

তো, এসকল দরিদ্র শ্বেতাঙ্গরা মুক্তির ঋণ পরিশোধ করার পরে যে সাথে সাথে সমৃদ্ধি, জমিজমা পেয়ে যেত, তা নয়! উত্তরের তেরো কলোনির অধিকাংশ ইতিমধ্যে জনবহুল হয়ে গেছে, জায়গাজমির মালিকানা দলিল-দস্তাবেজ হয়ে গেছে। অতএব এরা সুযোগের সন্ধানে যাওয়া শুরু করে দক্ষিণের কৃষিকাজনির্ভর স্টেটগুলিতে। আপালাচিয়ার দক্ষিণাংশের কেন্টাকি, টেনেসি, জর্জিয়া ইত্যাদি স্টেটে কাজ পায় অনেকে। কিন্তু জমির মালিকানা যারা খুঁজছিল, তাদের জন্যে বাকি ছিল অনূর্বর পাহাড়ী জমি। সেসবেই কোনরকমে বসতি গেঁড়ে সাবসিস্টেন্স ফার্মিং আর শিকার করে জীবননির্বাহ শুরু করে তারা।

আর যাদের এতে মন ভরলো না, তারা আর তাদের বংশধরেরা কাউবয়-আউটল’ হিসাবে গিয়ে হাজির হল ওয়াইল্ড ওয়েস্টে। কখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায়, কখনো সরকারের আইনি বিরোধিতা গায়ে না মেখে, নেটিভ আমেরিকানদের হটিয়ে নিজেরাই নিজেদের জায়গা করে নিল। কেউ কেউ ওরেগন ট্রেইলের পাইওনিয়ারদের পথ অনুসরণ করে পশ্চিমের স্টেটগুলিতে হাজির হয়ে গেল।

যারা আপালাচিয়াতে রয়ে গেছিল, অতীতের দারিদ্র্য, স্বল্পশিক্ষা, বর্ণবাদ আর কুসংস্কার এখনো তাদেরকে ছাড়েনি। গৃহযুদ্ধের সময়ে এরা দাসপ্রথার রক্ষক কনফ়েডারেট সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, কারণ কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্তি পেলে তাদের সীমিত জীবিকায় ভাগীদার বাড়বে। যারা জমির মালিকানাহীন কুলি ছিল তাদেরকে ডাকা হত পো’বয় (পুওর বয়) নামে, ক্রীতদাসদের মত তাদেরও ভোটাধিকার দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ছিল না। সে আইনের পরিবর্তন হয় গৃহযুদ্ধে ফ়েডারেল সরকারের জয়লাভের পরে।

হিলবিলি আর রেডনেক নাম দিয়ে অন্যান্য শিক্ষিত সাদারা এদেরকে এখনো কটাক্ষ করে। এদের ভুল বানান, অদ্ভূত উচ্চারণ, কাজ়িন বিয়ে করার রীতি, তাপ্পিমারা পোশাক, আর ঘরে বানানো মদের বোতল সত্তর-আশির দশকেও চলচ্চিত্রে দেখানো হত তাদের স্টেরেওটাইপ বুঝানোর জন্যে। ডেলিভ়ারেন্স মুভিটা দেখতে পারেন উদাহরণ হিসাবে। বলতে পারেন, এধরনের স্টেরেওটাইপিংও একরকম রেসিজ়ম, আর তা না হলেও অনেক নিচু চোখে দেখা। আবার আপালাচিয়ার ধনাঢ্য সাদা চাষী আর ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতিতে ঢুকত, তারা সরল হিলবিলিদের বর্ণবাদ আর অন্যান্য ভয়-বিদ্বেষ উস্কে দিত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্যে। এ কৌশল এখনও খাঁটে।

আইনকানুন মানার ব্যাপারেও হিলবিলিরা একটু অমনোযোগী, আর একরোখা-স্বাধীনচেতা হওয়ায় ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মত ট্রাবলে জড়াতেও সময় লাগে না। দক্ষিণের স্টেটগুলির কড়া আইন অনেকের জীবনে একবার এসে ধরলে বাকি জীবন পিছে লেগেই থাকে।

বুঝতে পারছেন, এ যুগে এরাই সম্ভবত আদর্শ ট্রাম্প সাপোর্টার! অপরদিকে রাল্ফ় স্ট্যানলির মত নামীদামী শিল্পীরা কখনোই রাজনীতিতে ঝোঁক দেখাননি!

ব্লুগ্রাসের সুরের পিছনে এখনো ফ়োক ইংলিশ কিংবা আইরিশ-স্কটিশ একটা ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। ফ়িডলের দ্রুত তালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের জিগসরীলসের ছন্দের প্রভাব রয়ে গেছে। খুব দ্রুততার সাথে কর্ড পরিবর্তন করার জটিল ইমপ্রোভ়াইজ়েশনও ব্লুগ্রাসের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এমনকি, যতই বর্ণবাদী বলি না কেন হিলবিলিদের, কৃষ্ণাঙ্গদের ব্লুজ়-জ্যাজ় থেকে তারা অনেক কিছু শিখে মিলিয়ে নিয়েছে ব্লুগ্রাসের মধ্যে। বিষয়বস্তুর মধ্যে বিয়োগবেদনার পাশাপাশি রয়েছে অতীতের স্মৃতিচারণ, পূর্বপুরুষদের বীরত্বের জয়গাঁথা, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে বাকবিতন্ডা বা মারামারির উপাখ্যান, কিংবা বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আক্ষেপ-ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আর সর্বোপরি, গ্রাম্য আপালাচিয়ার সীমিত জীবিকা আর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনের কঠিন চিত্র।

ব্লুজ়ের মধ্যে যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের জাতিগত বেদনার স্মৃতি রূপান্তরিত হয়ে গেছে সার্বজনীন একটা আবেগপ্রবণতায়, আমি বলবো সেরকম ব্লুগ্রাসও শ্বেতাঙ্গ খেঁটে-খাওয়া মানুষের শ্রেণীগত আশা-নিরাশা-বীরত্ব-ভয়-সুখ-দুঃখ ইত্যাদির ভাবপ্রবণ সরল অভিব্যক্তি।

আশা করি তুলনামূলক স্বল্পপরিচিত একটি মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতিকে কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পেরেছি, আর পাঠকরা সামান্য হলেও এদের সহমর্মী হতে পারছেন। ও হ্যাঁ, ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ — দেখতে ভুলবেন না!

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)

শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!