“পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
আয় আর-একটিবার আয় রে সখা, প্রাণের মাঝে আয়।
মোরা সুখের দুখের কথা কব, প্রাণ জুড়াবে তায়।”
রবিঠাকুরের এই গানটির সুর যে মৌলিক নয়, তা প্রবাসী বাঙ্গালীমাত্রেরই জানা। কারণ, প্রতি ৩১শে ডিসেম্বর লন্ডনের বিগ বেন থেকে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার, সিডনি অপেরা হাউস থেকে এমনকি প্রাচ্যের জাপান পর্যন্ত একই সুরে গান করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় বিপুলসংখ্যক জনতা।
রবীন্দ্রনাথ গানটি লিখেছিলেন ১৮৮৫ সালে। তাঁর প্রথম বিলাতযাত্রা হয় সতেরো বছর বয়েসে ১৮৭৮ সালে। সে যাত্রা আর বিলাতজীবনের কাহিনী তিনি লিখে রেখে গেছেন য়ুরোপ-বাসীর পত্রে। সে বই পড়লে জানবেন যে, ব্রাইটন আর সংলগ্ন এলাকার বিভিন্ন পার্টি, সোশ্যাল গ্যাদারিং আর নাচগানের দাওয়াতে রবীন্দ্রনাথের হরদম যাওয়া-আসা ছিল। রবার্ট বার্নসের আসল গানটা ততদিনে কমপক্ষে একশ’ বছর ধরে স্কটল্যান্ড আর অন্যান্য ব্রিটিশ রাজ্যের পানশালাগুলিতে জনপ্রিয়তা কুড়িয়ে আসছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম বিলাতজীবনে কোন না কোন জায়গায় গানটি অবশ্যই শুনে থাকবেন। ও হ্যাঁ, যারা তদ্কালীন ব্রিটেনের মানুষের ‘কলোনিয়াল’ দৃষ্টিভঙ্গি সম্বন্ধে খুবই অরাজনৈতিক বিবরণী জানতে চান, তারা বিশ্বকবির এই বইটি পড়ে দেখুন।
সুরটির ‘মূল রচয়িতা’ রবার্ট বার্নস ছিলেন স্কটিশ কবি ও গীতিকার। লিখতেন ইংরেজীর স্কটিশ উপভাষা স্কটসে। ১৭৮৮ সালে এডিনবরার ‘স্কটস মিউজিকাল মিউজিয়াম’ নামে এক প্রকাশনার কাছে ‘ফর অল্ড ল্যাং সাইন’ নামক এই গানটি সুরসহ পাঠান, নামটির ইংরেজী শব্দান্তর হল ‘ফর ওল্ড টাইম’স সেইক’ — পুরনো স্মৃতির খাতিরে। বার্নস যদিও নিজের কিছু কাব্য এতে জুড়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু সুর ও মূল কথাগুলি যে একটি স্কটিশ লোকগীতি থেকে ধার করেছিলেন সে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছিলেন। অর্থাৎ রবিঠাকুরের সুপরিচিত গানটি বার্নসের ধারেরও ধার।
আমরা যদিও জানুয়ারির এক তারিখকে বলি ইংরেজী নববর্ষ, আসলে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডসহ ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজ্যগুলি, এবং তাদের প্রাক্তন কলনী আমেরিকা, ১৭৫২ সালের আগে ২৫শে মার্চকে মানত বছরের শুরু। ২৫শে মার্চের তারিখটা স্প্রিং ইকুইনক্সের সাথে জড়িত। আরব-পারসিকদের নওরোজও উদযাপিত হয় একই দিনের ধারকাছ দিয়ে।
পয়লা জানুয়ারিটা মূলে রোমান ঐতিহ্য, কারণ প্রাচীন রোমের শাসনভার নবনির্বাচিত কনসালরা তুলে নিতেন ঐ তারিখে। আসলে, রোমসহ প্রাচীন নিকটপ্রাচ্যে দশটি মাসে বছর গোনা হত, শীতকালে কোন মাস গোনা হত না, আর বছর শুরু হত মার্চে। সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মাসগুলির নাম তাই এখনো লাতিনের সাত থেকে দশ পর্যন্ত সংখ্যার স্মৃতিবহন করে চলেছে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি যোগ হয় রোমশহরের আদিকালে, পুরো বছরকে বারটি চান্দ্রমাস দিয়ে পরিপূর্ণতা দিতে। জানুয়ারির নামকরণ তখন হয় দু’মুখো দেবতা জানুসের নামে। জানুস হলেন কাল, আরম্ভ, শেষ — সোজা কথায় ট্রানজিশনের দেবতা। এজন্য তাঁর এক মুখ ফেরানো অতীতের দিকে, আরেকটা ভবিষ্যদ্মুখী।
সুদূর স্কটল্যান্ডে অবশ্য প্রাচীন রোমান সভ্যতার ছোঁয়া কখনোই লাগেনি (‘বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য’ দ্রষ্টব্য)। স্কটিশদের ঐতিহ্য এখনো বেশ গ্রাম্য ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন। অবশ্য একই কারণে তাঁরা অতিথিপরায়ণ আর বন্ধুবৎসল। আমার প্রাক্তন কর্মক্ষেত্রের ম্যানেজার ছিলেন স্কটিশ এবং খুবই অমায়িক। অবশ্য কিপ্টা আর গুলবাজ বলেও স্কটদের দুর্নাম আছে। অতীতে ৩১শে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে স্কটিশরা নববর্ষের বদলে অন্য এক উৎসব পালন করত। একে স্কটস ভাষায় বলে হগমানে। একটা সময় স্কটল্যান্ডের প্রেসবাইটারিয়ান চার্চ ক্রিসমাস পালন করতে মানুষকে নিরুৎসাহিত করত। প্রাক-খ্রীষ্টান হগমানেই ছিল ক্রিসমাসের পরিবর্তে বছরের সবচে’ বড় উৎসব।
এদিনে স্কটিশ বাচ্চাকাচ্চারা হ্যালোইনের মত বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়ে, আর চকলেট-মিষ্টি উপহার পায়। ফার্স্ট-ফুটিং বলে একটা কুসংস্কার মানে যারা, তারা চেষ্টা করে কারো বাসায় প্রথম পদার্পণ করে সৌভাগ্য আর সর্বোৎকৃষ্ট আতিথেয়তা অর্জন করতে। বন্ধুরা একে অন্যের বাড়িতে যায় লবণ, কয়লা, শর্টব্রেড, হুইস্কি, ব্ল্যাকবান রুটি ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী উপহার নিয়ে। পুরনো আমলে শীত কাটানোর জন্যে এসবের দরকার ছিল, সেসব উপহারের প্রথা এখনো রয়ে গেছে। আর রবার্ট বার্নসের গানটি থেকে বুঝতে পারছেন যে সারা বছরের ব্যস্ততার কারণে বহুদিন যোগাযোগ না থাকার পরেও এদিন হয়তবা বাল্যবন্ধুদের একটা সুযোগ হয় কুশলবিনিময়ের। সেটাই বার্নস বলছেন এভাবেঃ
“We twa hae run about the braes,
and pou’d the gowans fine;
But we’ve wander’d mony a weary fit,
sin’ auld lang syne.”
অর্থাৎ বন্ধু বা বান্ধবী দু’জন মিলে ছোটবেলায় পাহাড়ে পাহাড়ে কত দৌড়ে বেরিয়েছে, সুন্দর সুন্দর কত ডেইজি ফুল তুলেছে একসাথে। সময়ে দু’জনের পথ হয়ে গেছে সুদূর, পদযুগল হয়ে পড়েছে ক্লান্ত। কিন্তু হতাশার কিছু নেই! বর্ষবরণের সুযোগে আবার মিলিত হবে দু’জনার হৃদয়, পানপাত্র তুলে একে অপরের সৌভাগ্য কামনা করবে দু’জনে। অর্থাৎ ‘পুরানো সেই দিনের কথার’ মতই নস্টালজিয়ার সাথে সাথে বান্ধব-আলিঙ্গন আর শুভকামনা।
এখনো স্কটল্যান্ডের এডিনবরায় বিশ্বের সবচে’ ঐতিহ্যবাহী বর্ষবরণের উৎসব পালিত হয় ৩১শে ডিসেম্বর। এ ভিডিওটিতে দর্শকরা যেভাবে ক্রস করে একে অন্যের হাত ধরে গান করছেন, সেভাবে এডিনবরায় সমবেত জনতা হাতে হাত মিলিয়ে নাচে-গায়। বহ্ন্যুৎসবও হয় স্কটল্যান্ডের কোথাও কোথাও। সেসব জায়গায় শীতের শুকনো কাঁটালতা পেঁচিয়ে তৈরি বলে আগুন জ্বালিয়ে রাতের বেলায় আনন্দসমাবেশ করে শহরের অধিবাসীরা, উৎসবশেষে সেসব জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ড সমুদ্রের ঢেউয়ে বিসর্জিত হয়।
আজকের যুগে নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে যে ‘বলড্রপ’ হয়, তার অনুপ্রেরণা স্কটল্যান্ডের সেসব ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান থেকে আসাটা বিচিত্র নয়। ৩১শে ডিসেম্বর টাইমস স্কয়ারে প্রতি বছর বর্ষবরণের কনসার্ট হয়, আর বছরের শেষ মিনিটকে বিদায় জানানো হয় ওয়ান টাইমস স্কয়ারের স্কাইস্ক্র্যাপারের শীর্ষের ফ্ল্যাগপোল থেকে আলোকসজ্জিত একটি ‘টাইম বলের’ ৬০ ফীট ‘অধঃগমনের’ মাধ্যমে। প্রচুর জনসমাগমের মাধ্যমে ১৯০৭ সাল থেকে টাইমস স্কয়ারের এই ঐতিহ্য পালিত হচ্ছে। এ উৎসবে সবার আগে যে গানটি বাজানো হয় সেটি অল্ড ল্যাং সাইন। অবশ্য আমেরিকায় গানটি জনপ্রিয় হয় তিরিশের দশকে, গাই লমবার্ডো নামে কানাডীয় এক সঙ্গীতশিল্পীর নিউইয়ারস ঈভের বিশেষ রেডিও অনুষ্ঠানের খাতিরে।
শুধু্মাত্র রবিঠাকুরই যে বার্নসের ‘রচিত’ গানটিকে ভাষান্তর করেছেন তা কিন্তু নয়! জাপানের একটি জনপ্রিয় গান ‘হোতারু নো হিকারি’ — সেটিও অল্ড ল্যাং সাইনের সুরে, বিষয়বস্তুও একইরকম। আর একসময় দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয় সঙ্গীতেরও ছিল একই সুর। একে আজকের সংবেদনশীল শিল্পসমঝদাররা হয়ত আখ্যা দিবেন কালচারাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন হিসাবে। যেমনটা চীনের জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতজ্ঞ লোবিন ওয়াং নব্বইয়ের দশকে উইগুর লোকগীতির অনুপ্রেরণায় রচিত কিছু গান কপিরাইট করতে গিয়ে কঠোর সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন (সে ব্যাপারে শীঘ্রই লিখবো)।
আমার হিসাবে, লোকগীতি তো আসলে কোন জাতিগোষ্ঠীর কপিরাইট করার মত কিছু নয়, কারণ কোন একজনমাত্র শিল্পী একদিনে বা একমাসে ‘শিল্পটি’ তৈরি করেননি। সুর আর কথাগুলি শতবছর ধরে মুখে মুখে বিবর্তিত হয়েছে, অন্য দেশ-ভাষাতেও গিয়েছে অরগ্যানিকভাবে লোকমুখেই। যদি এগুলোকে অন্য দেশের কোন স্বনামধন্য কবি বা গীতিকার যথাযথ কৃতজ্ঞতাস্বীকার করে স্বভাষায় অ্যাডপ্ট করেন, তাতে ক্ষতি নেই। বরং মূল জাতিগোষ্ঠীর গৌরবই তাতে। অবশ্য ‘ইন্সপায়ারড’ শিল্পীর কপিরাইট করার চেষ্টাটা আর্টিস্টিক লাইসেন্সের থেকে একটু বেশি হয়ে যেতে পারে। আমি যতদূর জানি, রবীন্দ্রনাথ যথাযথ ক্রেডিট দিয়েছিলেন, কিন্তু বার্নসের নাম উল্লেখ করেননি কারণ তা হয়ত সেসময় জানা ছিল না তাঁর। জনপ্রিয় ফোকগানই ভেবে নিয়েছেন আর তাই লিখেছেন পাদটীকায়। আপাতদৃষ্টে তা ভুল নয়, কারণ বার্নসের ‘মূলটিও’ আসলে ‘নকল’!
অল্ড ল্যাং সাইনের স্মৃতিস্পর্শে নতুন বছর সবার ভালো কাটুক, বন্ধুবান্ধব আর পরিবারের সকলের সাথে আনন্দময় হোক — এ শুভকামনা রইল। হ্যাপি নিউ ইয়ার!
গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।
ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!
এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।
এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।
এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা।
কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অগ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।
সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।
ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।
দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।
পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।
এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।
আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেলডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিকগথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁও–হিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।
অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।
পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।
উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।
বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।
এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।
স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।
কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল।
বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।
ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।
লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!
আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।
ৰালুম আদ্রিয়ানি বা হেড্রিয়ান’স ওয়াল রোমান প্রদেশ ব্রিটানিয়ার উত্তরে ১২২ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি শুরু হয়। নর্থ সীর পারে টাইন নদীর তীর থেকে শুরু করে আইরিশ সীর পারে সলওয়ে ফার্থে গিয়ে শেষ। প্রতি পাঁচ মাইলে একটি করে দুর্গ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে’ উত্তরের সীমানা। এরও উত্তরে বাস করত প্রাচীন ব্রিটনদের নানা ‘জংলী’ গোষ্ঠী, যাদের একটি পিক্ট।জুলিয়াস সীজ়ার আর ট্যাসিটাসের মত ‘প্যাট্রিশিয়ানরা’ ছিল প্রাচীন রোমের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষরা রোমনগরীর গোড়াপত্তনের সময় সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার আগে রোম ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল। প্রজাতন্ত্রের সেনেটের সকল সদস্য ছিল প্যাট্রিশিয়ান, আর সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্লিবিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমেরিকার সেনেট-হাউজ সে আদলেই গড়া। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রোমান প্যাট্রিশিয়ানরা বংশগৌরবের বড়াই করত, ভাল-খারাপ বংশের ভিত্তিতে জাতপাত মানত। এই ছবিতে এক প্যাট্রিশিয়ানের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তাঁর দুই পূর্বপুরুষের আবক্ষ মূর্তি হাতে নিয়ে বংশগরিমা জাহির করছেন।বেলজিয়ান কমিক্স সিরিজ অ্যাস্টেরিক্স দ্য গলের অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন পর্বে ব্রিটেনের গোত্রপতি কাসিভেলাউনাসকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। সম্ভবত টেমস নদীর উত্তরপারে তাঁর গোত্র কাতুভেলাউনির আবাস ছিল। অন্যান্য সব কেল্ট উপজাতির মত এরাও তাদের অন্যান্য তুতোভাইদের সাথে সবসময় মারামারিতে লেগে থাকত।৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের রোমান মুদ্রায় গলের কেল্টিক আর্ভের্নি গোত্রাধিপতি ভারসিন্জেটরিক্সের চিত্র। জার্গোভিয়া শহরে ৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রাজা নির্বাচিত হবার পর রোমসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গল প্রদেশের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। কেল্টিক উপজাতিগুলি আসলে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, জুলিয়াস সীজ়ার তার সুযোগ নিয়ে রোমের কর্তৃত্ব বহাল করেছিলেন গলে। ভারসিন্জেটরিক্স যেটুকু ঐক্য আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়ে তৈরি সৈন্যদল শেষবারের মত আলেসিয়াতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সীজ়ারের চতুর যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। ভারসিন্জেটরিক্সকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, বিজয়যাত্রায় তাঁকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় রোমানদের সামনে প্রদর্শন করা হয় আর কয়েক বছর পরে বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিচে ডানের মুদ্রাপিঠে তাই চিত্রিত হয়েছে। এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ করাটাও অবশ্য রোমান ইতিহাসবিদদের কৃতিত্ব, কারণ কেল্টিকদের সিংহভাগ লিখতে-পড়তে জানত না। যারা জানত, তারা রোমানদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তা শিখে, আর ধীরে ধীরে লাতিনভাষীই হয়ে যায়। বর্তমান ফরাসী ভাষা লাতিনেরই অপভ্রংশ। ও আরেকটা ব্যাপার হল, কেল্টদের একটা গোত্র সেনোনেস আলেসিয়ার যুদ্ধের তিনশ’ বছর আগে রোম নগরী লুন্ঠন করে। তখন রোম সীজারের সময়কার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই আলেসিয়ার বিজয় ছিল রোমানদের একরকম প্রতিশোধ।ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন ওপি বুডিকাকে এঁকেছেন এভাবে। তাঁর পোশাকআশাক রোমান ধাঁচের দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটা ছিল না। বুডিকা তাঁর সমব্যথী ব্রিটনদেরকে আহ্বান করছেন রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বুডিকার অগ্নিবর্ষী সেই ভাষণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বুডিকার নেতৃত্বে ব্রিটনরা বেশ কিছু রোমান সেটলমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়, আর রোমান সাধারণ নাগরিকরা নিহত-নিগৃহীত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ধরা না পড়লেও পলাতক বুডিকা শেষ পর্যন্ত নাকি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের প্রতিকৃতি। রোমের সেনেটরও ছিলেন। অ্যানালস আর হিস্টরিস নামে তাঁর দুটি বইয়ের অংশবিশেষ এখনো বিদ্যমান। সেগুলিতে ট্যাসিটাস অগাস্টাস সীজারের স্থাপিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম চার সম্রাটের রাজত্বকালের বর্ণনা লিখে গেছেন। ট্যাসিটাস তাঁর শ্বশুর আগ্রিকোলারও জীবনী লিখেন, আগ্রিকোলা ব্রিটেনবিজয়ের পুরোধা সেনাপতি ছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদদের মধ্যে ট্যাসিটাস সর্বকালের সবচে’ পরিচিত ও সম্মানিত।দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরী-গ্রীক ভূগোলবিশারদ টলেমির বর্ণনানুযায়ী মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্র। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের নাম ছিল আলবিয়ন। পরে ব্রিটানিয়া নামেও পরিচিত হয়। এর উত্তরাংশের নাম ট্যাসিটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায় ক্যালেডোনিয়া হিসাবে, সেখানের অধিবাসী ক্যালেডোনিঈ নামে এক গোত্রের নামানুসারে। মধ্যযুগের ‘ইতিহাসবিদদের’ ধারণা ছিল যে আদিকালে আলবিয়নে দৈত্যদের বসবাস ছিল।ট্যাসিটাসের হিংস্র পিক্টদের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চিত্রকর তাদের একজনকে কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। এরা নাকি যুদ্ধে হেডহান্টিং করত। দশম শতাব্দীতে পিক্টদের জাতিপরিচয় তাদের রাজনৈতিক মিত্র গেলদের সাথে মিশে যায়। স্কটল্যান্ডে এখনও বড় বড় পাথরে পিক্টদের খোদাই করা নানা নকশা, জীবজন্তুর চিত্র দেখা যায়। ভাষালিপির উদাহরণ পাওয়া গেছে কম।জার্মানির এক জাদুঘরে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে কেল্ট যোদ্ধার পোশাক রিকন্স্ট্রাক্ট করা হয়েছে এভাবে। কেল্টরা ইউরোপের অন্যতম আদিবাসী ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাত, যেমনটা গ্রীকরা। চেকারড জামা কেল্টদের ট্রেডমার্ক। এখনো আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অনেক ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে কেল্টিক মোটিফ চেনা যায়। কেল্টদের প্রাচীনতম উল্লেখ কমপক্ষে ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এরা নগরবাসী না হলেও চামড়া আর ধাতুর কাজ, অস্ত্র তৈরি, পোশাক বানানো — এসবে পারদর্শী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনচেতা কেল্টরা রোমানদের বশীভূত হলেও তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ছাপ স্পেনের গ্যালিসিয়া, ফ্রান্সের ব্রিটানি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস, কর্নওয়াল, স্কটল্যান্ড ও আইল অফ ম্যান, হেব্রাইডসের মত ছোট দ্বীপগুলো এবং আয়ারল্যান্ডের মত দূর অঞ্চলের ভাষা, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।জার্মানিক বলতে ইতিহাসে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। তাদের নামেই জার্মানির ইংরেজী নাম, যা এসেছে লাতিন হয়ে। ভাইকিং বা নর্স, অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট, গথ — এরা সবাই জার্মানিক। ফ্রান্সের বর্তমান নাম যাদের নামে, সেই ফ্রাংকরাও জার্মানিক। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিসহস্র সাল থেকে জার্মানিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের উথালপাথাল সময়ে হুনরা এশিয়া থেকে মাইগ্রেট করে আসে পূর্ব ইউরোপে, তাদের চাপে জার্মানিক গোত্রগুলি আরো পশ্চিমে সরা শুরু করে। এসব গোত্রের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের শোচনীয় দশা দাঁড়ায়। রোমানরা এর আগে জার্মানিক গোত্রদের আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম লুন্ঠন করে ভিসিগথ নামে এক গোত্র, তাদের রাজার নাম ছিল আলারিক। সেরকম সময়েই রোমান ব্রিটেনও জার্মানিক অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের দ্বারা ধীরে ধীরে ‘বিজিত’ হয়। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জাতিস্বত্ত্বার যাত্রা শুরু এ সময়েই। ম্যাপে দেখানো হয়েছে অষ্টম শতকের ইংরেজ ইতিহাসবিদ বীডের বর্ণনানুযায়ী ইংল্যান্ডে জার্মানিক গোত্রদের মাইগ্রেশনের আনুমানিক চিত্র।১৯৪০এর গ্রীষ্মে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দখল করে নেয় জার্মান আর্মি। বিশেষত, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় ছিল অভাবনীয়। হিটলার ভেবেছিলেন, হয়ত ইংল্যান্ড এতে শান্তি-আলোচনায় আগ্রহী হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! ১৯৪০এর গ্রীষ্মেই ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলে আকাশযুদ্ধে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের শহীদদের ব্যাপারেই চার্চিল বলেছিলেন, ‘নেভার ওয়াজ সো মাচ ও’ড বাই সো মেনি টু সো ফিউ’। যদি জার্মান লুফটভাফা সফল হত ব্রিটিশ আকাশশক্তিকে পরাস্ত করতে, তাহলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে সেনা ও নৌ আক্রমণের বন্দোবস্ত প্রস্তুত ছিল, এর কোডনেম ছিল অপারেশন সীলায়ন। এ ছবিতে জার্মান সৈন্যরা তারই মহড়া দিচ্ছে। ব্রিটেনের চ্যানেল আইল্যান্ডসও জার্মানদের দখলে ছিল বিশ্বযুদ্ধের বাকি পাঁচ বছর। ১৭৯০এর দশকে ইউরোপব্যাপী অনেক যুদ্ধাভিযান করেন নাপোলেওনও। ব্রিটেন ছিল তাঁর সবচে’ বড় শত্রু। ১৮০৩ থেকে ১৮০৫এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণের পাঁয়তারা তাঁরও ছিল। আমেরিকার কাছে লুইজিয়ানা এলাকা বিক্রি করে এ অভিযানের অর্থসংগ্রহ করে ফ্রান্স। আইরিশ বিদ্রোহীদেরও একটা অংশ ফরাসীদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু ফরাসীদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের তুলনায় ছিল কম ও অনভিজ্ঞ, তাই শেষ পর্যন্ত এসব প্ল্যান নাপোলেওঁ এগজেকিউট করেননি।মধ্যযুগে তৈরি বেইয়ো টেপেস্ট্রিতে নরম্যানদের ডিউক দিগ্বিজয়ী উইলিয়ামকে দেখানো হয়েছে এভাবে। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ শোরগোল ওঠে যে তিনি নাকি নিহত হয়েছেন। তখন উইলিয়াম এক টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তকাবরণ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখান, পলায়নপর সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে, এটাই এ ছবিতে দেখানো হচ্ছে। সে যুদ্ধে তাঁর জয়লাভের আরেক কারণ ছিল অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন প্রায় আড়াইশ’ মাইল উত্তরে আরেক যুদ্ধে নরওয়ের ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড হারদ্রাদার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। সেই একই রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়ামকে রুখতে। দুই হ্যারল্ডই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। উইলিয়ামের নরম্যান রাজ্যের অবস্থান ছিল উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। এরা আসলে ভাইকিং লুটেরা-সেটলার আর জার্মানিক ফ্রাংকদের সংকর। এদের ভাষা নর্ম্যান ছিল পুরনো ফরাসীর কাছাকাছি।গেল হচ্ছে ইন্দোইউরোপীয় একটি ভাষাগোত্র, যাদের মধ্যে ম্যাংক্স, আইরিশ ও স্কটিশ গেলিক পড়ে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ডেল রিয়াটা রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস আর কর্নওয়ালের ওপরও এদের প্রভাব ছিল। ডেল রিয়াটার স্কটিশ উত্তরসূরীর নাম আলবা রাজ্য। ম্যাকবেথ সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ১০৫৭ সাল পর্যন্ত। রাজা হবার আগে মোরে বলে এক সুদূর এলাকার ‘মোরমেয়ার’ ছিলেন, সেপদ মূলত রাজার মতই সার্বভৌম ছিল। স্কট রাজা প্রথম ডানকান ম্যাকবেথের সাথে যুদ্ধে মারা যান আর ম্যাকবেথ হন পরবর্তী রাজা। তাঁর শাসনামল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ম্যালকমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপীয়ার তাঁর ম্যাকবেথ নাটক লিখেছেন মধ্যযুগীয় ‘ইতিহাসবিদদের’ বানোয়াট বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, তবে তিনি যেভাবে স্কটদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, সেটা মোটামুটি সত্য। (ছবিতে ম্যাকবেথ)১২৮৬ সালে স্কটিশ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার হন তাঁর নাতনী মার্গারেট। কিন্তু মার্গারেট অপরিণতবয়স্ক হওয়ায় স্কটল্যান্ডের অভিজাতরা একটা গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশশাসন শুরু করে। মার্গারেটও মারা যান ১২৯০এ। তখন বিভিন্ন বনেদী পরিবার রাজসিংহাসনের জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেষে তারা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে। এডওয়ার্ড ‘লংশ্যাংকস’ শর্ত দেন যে আগে তাঁকে ‘লর্ড প্যারামাউন্ট’ হিসাবে তাঁর আনুগত্যস্বীকার করতে হবে। তার পরে তিনি জন ব্যালিওল বলে এক দুর্বলচিত্ত অভিজাতকে রাজা ঘোষণা করেন। যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও ব্যালিওল এডওয়ার্ডের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন। এরই সুযোগে ছিলেন এডওয়ার্ড, এই অজুহাতে তিনি স্কটল্যান্ডে আক্রমণ করেন। জন বালিওল সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন আর সব অভিজাতদেরকে এডওয়ার্ডকে রাজা হিসাবে মেনে নেবার শপথে বাধ্য করা হ্য়। ১২৯৭-৯৮তে প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন গার্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়ালেস। প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জেতার পরে ফলকার্কের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। ওয়ালেসের পরে রবার্ট ব্রুস একাধিক ইংলিশ ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হন, আর তাদের নাকের ডগা দিয়ে পার্থে রাজ্যাভিষেক করে স্কটল্যান্ডের রাজা হন। এরপর বেশ ক’টি যুদ্ধে হারার পরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর পরিবারও একসময় ইংরেজদের কাছে রাজবন্দী ছিল। স্কটরা সফল গেরিলাযুদ্ধ চালানোর পর ১৩২৭এ তখনকার ইংলিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। (ছবিতে রবার্ট দ্য ব্রুস)১৭৭০এর এই এনগ্রেভিংয়ে দেখা যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে স্কটিশ গ্রাম্য নারীদের উলের তৈরি টুইড কাপড় ওয়াকিংয়ের চিত্র। গানের তাল কাজের অগ্রগতির সাথে আরো দ্রুত হত, কারণ শেষের দিকে কাপড়ের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তাকে আরো দ্রুততার সাথে কম্প্রেস করতে হত। কাপড়ের কুন্ডলীটা ঘড়ির কাঁটার দিকে হাতে হাতে ঘুরত, উল্টোদিকে ঘুরানো ছিল অমঙ্গলজনক। এখনকার যুগে আর এধরনের কাজ কেউ করে না। পঞ্চাশের দশকে শেষ সত্যিকারের ওয়াকিং হয়েছিল বলে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে ওয়াকিং সংয়ের ঐতিহ্য বেঁচে রয়েছে স্কটিশ হাইল্যান্ডস, আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জ আর কানাডার নোভা স্কশিয়ার কেপ ব্রেটন আইল্যান্ডের স্কটিশ সেটলারদের বংশধরদের মাঝে।ষষ্ঠ জেমসের মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি, তাছাড়াও জেমস ইংল্যান্ডের রাজা, আয়ারল্যান্ডের লর্ড, সপ্তম হেনরির বংশধর ছিলেন। ১৫৬৭ সালে তের মাস বয়েসে স্কটল্যান্ডের রাজা হন, আর ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের রাণী প্রথম এলিজাবেথ সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাবার পরে ১৭০৭এ ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্যকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। মধ্যপন্থী শান্তিপ্রিয় জেমস অবশ্য সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট দু’পক্ষেরই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ক্যাথলিকরা তাঁকে মারার চেষ্টা করে (গানপাউডার প্লট), আর অ্যাংলিকান চার্চের সদস্যরা ভাবত জেমস ক্যাথলিকদের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল। এসব কারণে ১৬৪২এর ইংলিশ গৃহযুদ্ধের বীজবপন হয়। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড জেমসের আইনানুগ উত্তরসূরীকে সমর্থন করে, আর ইংল্যান্ড হল্যান্ডের প্রিন্স অফ অরেন্জ উইলিয়ামকে। জেমসের সময়েই আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন শুরু হয়। আর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিং জেমস বাইবেল সংকলিত হয়, যা থেকে আজকের বেশির ভাগ ইংরেজী বাইবেলের সংস্করণ এসেছে, ছবিতে তার মুখবন্ধ।জন হেনরি সম্ভবত ঐতিহাসিক চরিত্র নন, অনেকের অবশ্য ধারণা তাঁর কাহিনী আসলেই ঘটেছিল ১৮৭০ সালের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরি ছিলেন ‘স্টীল-ড্রাইভিং ম্যান’ — তাঁর দায়িত্ব ছিল স্টীলের তৈরি একটা ড্রীলকে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথরে ঢুকিয়ে গর্ত তৈরি করা। সে গর্তে বিস্ফোরক ভরে পাহাড় ভেঙে রেললাইনের জন্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হত। জন হেনরির চাকরি খাবার জন্যে অবশ্য স্টীমচালিত হাতুড়ি চলে এসেছে। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতলেন জন হেনরি, কিন্তু বিজয়শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন — গানের মূল বিষয়বস্তু এই। আমেরিকা আর বহির্বিশ্বে এ গান শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকরকম গান ‘স্পিরিচুয়াল’ হলো মূলত ধর্মীয় গীত। এতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুঃখকষ্টের বর্ণনা আর সেসবের পরে যে পরকালে তাদের জন্যে স্বর্গ রয়েছে, তার আশা। এগুলিও মূলত শ্রমসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বর্তমানের ব্লুজ়ের উৎপত্তি কৃষ্ণাঙ্গ স্পিরিচুয়াল থেকে। চিত্রে জন হেনরির কাহিনী।বাংলাদেশী নৃতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. মাহবুব পিয়ালের এই ইন্টারভিউতে তিনি সারিগান নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর কথাগুলো ভাল করে শুনবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ডিটেইলের বদলে তার অর্থটা আসলে কি, এটা বোঝার ওপর তিনি ভদ্রভাবে জোর দিয়েছেন — উপস্থাপিকার ইতিহাসের রেফারেন্সের বিপরীতে। আরো সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন কেন লোকসংস্কৃতি ‘হারিয়ে যাবার’ কারণে আক্ষেপের কিছু নেই। আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সময় পেলে অনুষ্ঠানটি দেখুন। আর লোমাক্স দ্য সংহান্টার ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝবেন লোকসঙ্গীতপ্রেমীরা কিভাবে সেগুলি খুঁজে বের করে রেকর্ড করে রাখেন, কালের আবর্তে হারিয়ে যাবার আগে।
যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরপশ্চিমে প্যাসিফিক মহাসাগরের পাশে দুটো সুন্দর স্টেট আছে — ওরেগন আর ওয়াশিংটন। এই এলাকার রেইন ফরেস্টের সুউচ্চ চিরহরিৎ গাছপালা, নয়নাভিরাম তুষারাবৃত পর্বত আর পাথুরে সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ারসান ফ্রান্সিস্কো পর্যন্তও বিস্তৃত। ওরেগনে বেশ ক’বছর আগে গ্রীষ্মের কয়েক মাস কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সেসময়ের অন্যতম স্মৃতি হল এক মার্কিন সহকর্মী বন্ধুর সাথে প্রশস্ত কলাম্বিয়া নদীর তীরে ক্যাম্প করে দু’রাত্রি কাটানো — স্কামানিয়া ফ়োক ফ়েস্টিভাল উপভোগ করার উসিলায়।
সে উৎসবে গেছিলাম মূলত আইরিশ স্টেপ ড্যান্সিং সামনাসামনি দেখার লোভে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই এনিয়া–চীফটেইনস প্রমুখ শিল্পীর গান আর স্টারটিভিতে রিভ়ারড্যান্স শো দেখে আইরিশ–কেল্টিক ঐতিহ্যের প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। হাতে আঁকা ছবির মত নিসর্গের মাঝে খোলা আকাশের নিচে সেই আইরিশ নৃত্য-গীতি-বাদ্য দেখা-শোনা তো হলোই, উপরি হিসাবে পেলাম মার্কিনদেশের নানারকম উপভোগ্য লোকগীতির পরিবেশনা। তার মধ্যে ছিল ফ়োক, ব্লুজ়, জ্যাজ় — আর ব্লুগ্রাস!
এর আগে ব্লুগ্রাস সম্পর্কে আমার ধারণা খুব বেশি ছিল না। শুধুমাত্র যেখানে এর নমুনা পেয়েছিলাম, সেটা হল কোয়েন ব্রাদারস পরিচালিত, জর্জ ক্লুনি অভিনীত অনবদ্য মিউজ়িক্যাল চলচ্চিত্র ‘ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ’। এ লেখার অনুসঙ্গ হিসাবে তার থেকে একটা গান জুড়ে দিলাম।
গানের কথায় বুঝতে পারছেন, গায়ক (বা গীতিকার) দুঃখ-ভারাক্রান্ত হৃদয় উজাড় করে দিচ্ছে। আমেরিকার দক্ষিণের পাহাড়ী আপালাচিয়া অঞ্চলের কেন্টাকি স্টেটে তার জন্ম। সারাজীবন নানারকম ঝুটঝামেলা তার সঙ্গী। মানে, হয়ত সে সমাজচ্যুত আউটক্যাস্ট, অথবা আইন থেকে পলাতক আউটল’। তার নেই কোন বন্ধু-নিকটজন, যে তার ছন্নছাড়া জীবনে সহায় হতে পারে। পথে হয়ত প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সেখানেও পিছু ছাড়েনি তার অতীত। তাই আবার সে পলায়নপর, হয়ত তার মরণ হবে সে প্রচেষ্টায়। হয়ত প্রেমিকা তাকে ভুলে অন্য কাউকে ভালবাসবে, কিন্তু তাতে তার হাঁহুতাশ নেই! কারণ এ সুনিশ্চিত, যে একসময় না একসময় স্বর্গের স্বর্ণালী সৈকতে আবার দেখা মিলবে দু’জনার!… গানটা যতটা না দুঃখের, তার থেকে বেশি বোধহয় দুর্ভাগ্যপীড়িত অনন্যোপায় গায়কের সান্ত্বনালাভের প্রয়াস। (মুভ়িটা দেখলেই বুঝবেন গানের মাজেজা!)
এখানে গানটা পুরোপুরি ব্লুগ্রাস স্টাইলে গাওয়া হয়নি, কারণ একমাত্র সঙ্গত গীটার। সাধারণত ব্লুগ্রাস গানে গীটারের সাথে ব্যাঞ্জো, ফ়িড্ল, ম্যান্ডোলিন, স্ট্রিং বাস, ইত্যাদি জুড়ি থাকে। কিন্তু মুভ়িতে ক্লুনির কল্পিত ব্যান্ড সগি বটম বয়েজ় নামের সাথে প্রখ্যাত ব্লুগ্রাস ব্যান্ড ফ়গি মাউন্টেইন বয়েজ়ের সুস্পষ্ট মিল। তিরিশ-চল্লিশের দশকে রেডিও আর গ্রামোফ়োন জনপ্রিয় ও সহজলভ্য হওয়া শুরু করে যখন, তখন ১৯১৩তে লেখা এ গানটি আরো অনেকের পাশাপাশি ব্লুগ্রাস শিল্পীরাও রেকর্ড করেন। অধুনাযুগের সবচে’ খ্যাতিমান ব্লুগ্রাসগায়ক রাল্ফ় স্ট্যানলিও এটা গেয়েছিলেন, অ্যালিসন ক্রাউসও। সুতরাং ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র ব্লুগ্রাস যোগাযোগ অনস্বীকার্য।
কিভাবে ব্লুগ্রাসের উৎপত্তি হলো, সে কাহিনী ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মতই মর্মস্পর্শী। আমেরিকায় ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত দাসত্বপ্রথা ছিল সে আমরা ভালমতই জানি। যেটা অত ভালমত জানি না, সেটা হলো একই শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ কিভাবে একরকম দাস হিসাবেই মার্কিনে এসেছিল। এখনকার ভাষায় এদেরকে বলে ইনডেঞ্চারড সার্ভ্যান্ট, বা চুক্তিবদ্ধ চাকর।
ইউরোপীয় জাহাজী আর দালালের দল ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডের সহায়সম্পত্তিহীন কর্মক্ষম মানুষ পেলে তাদেরকে নতুন বিশ্বের উন্নত জীবন আর সুযোগের কথা দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে চুক্তিনামায় সই করাত, তারপর আমেরিকায় এনে টাকার বিনিময়ে তুলে দিত তাদের মালিকের কাছে। বিশেষ করে আয়ারল্যান্ডে পরপর কয়েকটি দুর্ভিক্ষের কারণে জীবন বাঁচাতে গরিবদের চুক্তিস্বাক্ষরব্যতীত আর তেমন কোন উপায় ছিল না। চুক্তি অনু্যায়ী যতদিন না সেই চাকর গতর খেঁটেই হোক আর অন্য কোনভাবে হোক, অন্তত তার জাহাজভাড়া না পরিশোধ করছে, ততদিন সে মালিকের আজ্ঞাবাহী। যদি পালায় তো কৃষ্ণাঙ্গ দাসের মতই তাকে খুঁজে বের করে মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার নিয়ম।
তো, এসকল দরিদ্র শ্বেতাঙ্গরা মুক্তির ঋণ পরিশোধ করার পরে যে সাথে সাথে সমৃদ্ধি, জমিজমা পেয়ে যেত, তা নয়! উত্তরের তেরো কলোনির অধিকাংশ ইতিমধ্যে জনবহুল হয়ে গেছে, জায়গাজমির মালিকানা দলিল-দস্তাবেজ হয়ে গেছে। অতএব এরা সুযোগের সন্ধানে যাওয়া শুরু করে দক্ষিণের কৃষিকাজনির্ভর স্টেটগুলিতে। আপালাচিয়ার দক্ষিণাংশের কেন্টাকি, টেনেসি, জর্জিয়া ইত্যাদি স্টেটে কাজ পায় অনেকে। কিন্তু জমির মালিকানা যারা খুঁজছিল, তাদের জন্যে বাকি ছিল অনূর্বর পাহাড়ী জমি। সেসবেই কোনরকমে বসতি গেঁড়ে সাবসিস্টেন্স ফার্মিং আর শিকার করে জীবননির্বাহ শুরু করে তারা।
আর যাদের এতে মন ভরলো না, তারা আর তাদের বংশধরেরা কাউবয়-আউটল’ হিসাবে গিয়ে হাজির হল ওয়াইল্ড ওয়েস্টে। কখনো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সহযোগিতায়, কখনো সরকারের আইনি বিরোধিতা গায়ে না মেখে, নেটিভ আমেরিকানদের হটিয়ে নিজেরাই নিজেদের জায়গা করে নিল। কেউ কেউ ওরেগন ট্রেইলের পাইওনিয়ারদের পথ অনুসরণ করে পশ্চিমের স্টেটগুলিতে হাজির হয়ে গেল।
যারা আপালাচিয়াতে রয়ে গেছিল, অতীতের দারিদ্র্য, স্বল্পশিক্ষা, বর্ণবাদ আর কুসংস্কার এখনো তাদেরকে ছাড়েনি। গৃহযুদ্ধের সময়ে এরা দাসপ্রথার রক্ষক কনফ়েডারেট সরকারকে সমর্থন দিয়েছে, কারণ কৃষ্ণাঙ্গরা মুক্তি পেলে তাদের সীমিত জীবিকায় ভাগীদার বাড়বে। যারা জমির মালিকানাহীন কুলি ছিল তাদেরকে ডাকা হত পো’বয় (পুওর বয়) নামে, ক্রীতদাসদের মত তাদেরও ভোটাধিকার দক্ষিণের স্টেটগুলিতে ছিল না। সে আইনের পরিবর্তন হয় গৃহযুদ্ধে ফ়েডারেল সরকারের জয়লাভের পরে।
হিলবিলি আর রেডনেক নাম দিয়ে অন্যান্য শিক্ষিত সাদারা এদেরকে এখনো কটাক্ষ করে। এদের ভুল বানান, অদ্ভূত উচ্চারণ, কাজ়িন বিয়ে করার রীতি, তাপ্পিমারা পোশাক, আর ঘরে বানানো মদের বোতল সত্তর-আশির দশকেও চলচ্চিত্রে দেখানো হত তাদের স্টেরেওটাইপ বুঝানোর জন্যে। ডেলিভ়ারেন্স মুভিটা দেখতে পারেন উদাহরণ হিসাবে। বলতে পারেন, এধরনের স্টেরেওটাইপিংও একরকম রেসিজ়ম, আর তা না হলেও অনেক নিচু চোখে দেখা। আবার আপালাচিয়ার ধনাঢ্য সাদা চাষী আর ব্যবসায়ীরা যখন রাজনীতিতে ঢুকত, তারা সরল হিলবিলিদের বর্ণবাদ আর অন্যান্য ভয়-বিদ্বেষ উস্কে দিত নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থোদ্ধারের জন্যে। এ কৌশল এখনও খাঁটে।
আইনকানুন মানার ব্যাপারেও হিলবিলিরা একটু অমনোযোগী, আর একরোখা-স্বাধীনচেতা হওয়ায় ম্যান অফ় কনস্ট্যান্ট সরো’র মত ট্রাবলে জড়াতেও সময় লাগে না। দক্ষিণের স্টেটগুলির কড়া আইন অনেকের জীবনে একবার এসে ধরলে বাকি জীবন পিছে লেগেই থাকে।
বুঝতে পারছেন, এ যুগে এরাই সম্ভবত আদর্শ ট্রাম্প সাপোর্টার! অপরদিকে রাল্ফ় স্ট্যানলির মত নামীদামী শিল্পীরা কখনোই রাজনীতিতে ঝোঁক দেখাননি!
ব্লুগ্রাসের সুরের পিছনে এখনো ফ়োক ইংলিশ কিংবা আইরিশ-স্কটিশ একটা ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। ফ়িডলের দ্রুত তালের মধ্যে আয়ারল্যান্ডের জিগস–রীলসের ছন্দের প্রভাব রয়ে গেছে। খুব দ্রুততার সাথে কর্ড পরিবর্তন করার জটিল ইমপ্রোভ়াইজ়েশনও ব্লুগ্রাসের আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। এমনকি, যতই বর্ণবাদী বলি না কেন হিলবিলিদের, কৃষ্ণাঙ্গদের ব্লুজ়-জ্যাজ় থেকে তারা অনেক কিছু শিখে মিলিয়ে নিয়েছে ব্লুগ্রাসের মধ্যে। বিষয়বস্তুর মধ্যে বিয়োগবেদনার পাশাপাশি রয়েছে অতীতের স্মৃতিচারণ, পূর্বপুরুষদের বীরত্বের জয়গাঁথা, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে বাকবিতন্ডা বা মারামারির উপাখ্যান, কিংবা বহিরাগতদের অনুপ্রবেশ আর পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে আক্ষেপ-ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। আর সর্বোপরি, গ্রাম্য আপালাচিয়ার সীমিত জীবিকা আর দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপনের কঠিন চিত্র।
ব্লুজ়ের মধ্যে যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের জাতিগত বেদনার স্মৃতি রূপান্তরিত হয়ে গেছে সার্বজনীন একটা আবেগপ্রবণতায়, আমি বলবো সেরকম ব্লুগ্রাসও শ্বেতাঙ্গ খেঁটে-খাওয়া মানুষের শ্রেণীগত আশা-নিরাশা-বীরত্ব-ভয়-সুখ-দুঃখ ইত্যাদির ভাবপ্রবণ সরল অভিব্যক্তি।
আশা করি তুলনামূলক স্বল্পপরিচিত একটি মার্কিন শ্বেতাঙ্গ সংস্কৃতিকে কিছুটা হলেও তুলে ধরতে পেরেছি, আর পাঠকরা সামান্য হলেও এদের সহমর্মী হতে পারছেন। ও হ্যাঁ, ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ — দেখতে ভুলবেন না!