প্রাচীন বিশ্বের বাণিজ্য

সুইডেনে আবিষ্কৃত আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম।

ছবির রৌপ্যমুদ্রাগুলি আব্বাসী খেলাফতের দিরহাম। মুদ্রার পিঠে খলীফার নামের পাশাপাশি আল্লাহ-রাসুলের নামে কালেমা লেখা। এ মুদ্রা খুব একটা দুর্লভ নয়। তবে এগুলি যে জায়গায় আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটাই পিলে-চমকানো ব্যাপার! উৎপত্তিস্থল বাগদাদ কিংবা দামেস্ক থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাইল উত্তরে, একাধিক পর্বত-সাগর-নদী পেরিয়ে সুইডেনের স্টকহোমের কাছে এক সমাধিঢিবির মধ্যে পাওয়া গেছে এগুলি।

ভাইকিং ‘নৌকাসমাধিতে’ কুফী হরফে আল্লাহ-আলীর নাম এম্ব্রয়ডার করা সিল্কের কাপড়ও নাকি পেয়েছেন বলছেন সুইডিশ গবেষকরা। আরেক জায়গায় একটা আংটিও পাওয়া গেছে যার গায়ে নাকি ‘আল্লাহর জন্যে’ আরবীতে খোদাই করা।

ভাইকিং আর আব্বাসী খেলাফতের মধ্যে দশম/একাদশ শতকে একটা যোগসূত্র যে থেকে থাকতে পারে, এটা অনেকের কল্পনাতীত। দুটি কালচারের মধ্যে হাজার হাজার মাইল দূরত্ব। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ববিদরা এরকম উদাহরণ প্রায়শই পান। এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।

সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত রেশমের কাপড়ে এম্ব্রয়ডার করে আল্লাহ ও আলী লেখা।
সুইডেনের ভাইকিং সমাধিতে আবিষ্কৃত আংটিতে লিল্লাহ লেখা।

এরকম আরো ভূরি ভূরি উদাহরণ দিতে পারি। বঙ্গোপসাগরের তীরে পন্ডিচেরির কাছে তামিলনাড়ুর আরিকামেডুতে গ্রীক-রোমান ধাঁচের একটি বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেখানে পাওয়া গেছে রোমান অ্যাম্ফোরা — ওয়াইন সংরক্ষণ ও স্থানান্তরের জন্যে বড় বড় মাটির বোতল। আরো পাওয়া গেছে রোমান-গ্রীক ও ভারতীয় ডিজাইনে ছাঁপমারা মাটির পাত্র। আর সম্রাট অগাস্টাসের মুখাবয়বখচিত স্বর্ণমুদ্রা।

জাপানের সমাধিস্তূপে পাওয়া নীলরঙের কাঁচের থালা নিয়েও জাপানী রসায়নবিদরা অনেক গবেষণা করেছেন। কারণ এরকম নিদর্শন জাপানে আর পাওয়া যায়নি। তাদের রিসার্চ থেকে বেরিয়েছে যে, রোমান সাম্রাজ্যে এ ধরনের থালা ব্যবহৃত হত, আর সেসবে অ্যান্টিমোনির মত বিশেষ ধাতু যে যে পরিমাণ পাওয়া গেছে, তা একই অনুপাতে রয়েছে থালাটিতে। অর্থাৎ রোমের বিলাসদ্রব্য কিভাবে যেন এসে পড়েছে ছয় হাজার মাইল দূরে জাপানে।

তামিলনাড়ুর আরিকামেডুর কাছে পুদুক্কোটাইয়ে আবিষ্কৃত রোমান সম্রাট অগাস্টাসের মুদ্রা।
জাপানের সামাধিস্তূপে আবিষ্কৃত রোমান কাঁচের থালি।

এতক্ষণ যেসব উদাহরণ দিলাম, তা বড়জোর এক হাজার থেকে দু’হাজার বছর আগের। এদের থেকেও পুরনো উদাহরণ হলো, প্রাচীন মিশরের তিন হাজার বছরের পুরনো মামির চুলে সিল্কের সুতোর আবিষ্কার। সে সময়ে একমাত্র চীনাদেরই আয়ত্ত ছিল সিল্ক তৈরির চাবিকাঠি। তার মানে দাঁড়াল, ছয় হাজার মাইল অর্থাৎ পৃথিবীর পরিধির প্রায় একচতুর্থাংশ পাড়ি দিয়ে এসে মিশরীয় অভিজাতদের শোভাবর্ধন করেছে রেশমী সুতো।

আজকের দুনিয়ার কথা‌ই ভাবুন। বাংলাদেশে বসে ‘আই লাভ এনওয়াই’ টিশার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপনি। শার্টের আমদানি হয়ত মার্কিন মুল্লুক থেকে। আবার মার্কিন মুল্লুকের আইডিয়া কাজে লাগিয়ে বানানো শার্টটা খুব সম্ভব বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্পেরই প্রস্তুত। কোথাকার মাল কোথায় এসে পড়ল, অথচ আমরা আজ অবাক হই না।

চীনা সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত রোমান পাত্র।

আজ থেকে তিন চার হাজার বছর আগেও একই কাহিনী ঘটেছে। আজকের পরিসরে না হলেও সেপরিমাণটা তুলনামূলকভাবে বড়ই। পরিমাণটারও উত্থানপতন হয়েছে।

আর বিভিন্ন সভ্যতার যে কর্মকান্ড এ ম্যাজিকটা যুগযুগান্তরে ঘটিয়েছে, তার নাম ট্রেড — বাণিজ্য। সোনা-রূপার তৈরি মুদ্রা কিংবা বুলিয়ন আবিষ্কারের বহু আগে থেকেই মানবজাতি একে অন্যের সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে যোগাযোগ করে আসছে। টাকার ব্যবহার না থাকলেও বার্টার বা বিনিময়ের মাধ্যমে বাণিজ্য চলেছে। আর সওদা আদানপ্রদানের পাশাপাশি চলেছে ধর্মীয়, দার্শনিক, প্রযুক্তিগত, ভাষা-সাংস্কৃতিক মতবিনিময়।

প্রাচীন মানুষ কৃষিকাজ শিখে থিতু হতে হতে শুরু হয় নগরসভ্যতার। সমষ্টিগত শ্রমের দক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসে মানুষের। কিন্তু বহু আদি নগরসভ্যতায় একটা সমস্যা খুঁজে পান প্রত্নতত্ত্ববিদরা। যদিও খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে বড় জনসংখ্যার ভরনপোষণ সম্ভব, তাতে খাদ্যের বৈচিত্র কমে যায়। সুষম পুষ্টির অভাবে আদি নগরবাসীরা ছিল শিকারী-সংগ্রহকারী যাযাবরদের থেকে শারীরিকভাবে দুর্বল। ফলে ‌অনেক আদি নগর বহির্শত্রুর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।

কিন্তু দক্ষতা বাড়ানোর জন্যে যে কাজটা তারা সাধন করেছে তা হলো শ্রমের বিশেষায়িতকরণ। আদি নগরেই দেখা যায় একেকটি পাড়ার পেশা একেক রকম। কেউ কৃষক, কেউ কুম্ভকার, কেউ সূত্রধর। নগরের মধ্যেই আঞ্চলিক বাণিজ্যের যাত্রা শুরু। তারপরে খাদ্য থেকে শুরু করে অন্যান্য কাঁচামালের বৈচিত্র্যের জন্যে স্থানীয় আর সব জনবসতির সাথে আদানপ্রদান শুরু।

নব্যপ্রস্তরযুগের পরবর্তী ক্যালকোলিথিক যুগে, অর্থাৎ ব্রোঞ্জের আবিষ্কারের প্রাক্কালে বিশেষায়িত শ্রমের আবির্ভাবের সাথে সাথে বৈশ্বিক না হলেও আঞ্চলিক বাণিজ্যের শুরু। সেটা কমপক্ষে সাত/আট বাজার বছর আগের কথা। তারপর চার হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেসোপটেমিয়াতে গরুর মত ভারবাহী পশুকে পোষ মানানোর ফলে লং ডিসট্যান্স ট্রেডিংয়ের রাস্তা খুলে যায়।

মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়দের সাথে ময়েঞ্জোদারো-হরপ্পার যোগাযোগটা বৈদেশিক বাণিজ্যের সবচে প্রাচীন উদাহরণ। স্থল ও নৌপথে ভারতের মশলাপাতি ও সেমিপ্রেশাস রত্নরাজি এসে পৌঁছত উরের মত ইরাকের বড় শহরগুলিতে। হরপ্পান সভ্যতার টেরাকোটা সীল আর আবক্ষ মুর্তির মধ্যেও মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব হুবহু দৃশ্যমান। এ বাণিজ্য তুঙ্গে ওঠে আড়াই হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। আর প্রাক-আর্য হরপ্পান নগরগুলির পতনের পর এ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ময়েঞ্জোদারোর এই মূর্তিটি কোন রাজার নয়, সম্ভবত অলিগার্কের। শিল্পে মেসোপটেমিয়ার সাংস্কৃতিক প্রভাব সুস্পষ্ট।
ঊর শহরে আবিষ্কৃত কার্নেলিয়ান পাথরের নেকলেস। শিল্প দেখে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার থেকে আমদানি।

এরপর মিশরে পোষ মানে ভারবাহী গাধা, সে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বে। তার পাশাপাশি নীলনদের নৌপথে চলে উত্তর-দক্ষিণ বাণিজ্য। কৃষিজমির দখল আর আঞ্চলিক নৌবাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের খাতিরেই সম্ভবত মিশরে আবির্ভাব ঘটে প্রথম সাম্রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার। শাসকদের কাজ হলো প্রজাদের কৃষিজমির ভাগবন্টন আর আঞ্চলিক বাণিজ্যের নিরাপত্তাবিধান আর যাত্রাপথের রক্ষণাবেক্ষণ। এসবের ব্যয়নির্বাহের জন্যে কর ধার্য হত। অর্থ দিয়ে না হলেও খাদ্যশস্য আর বাণিজ্যের ফেরির ভাগ দিয়ে সে কর পরিশোধিত হত। অর্থাৎ যেখানে মিষ্টির সুবাস, মাছির উৎপাত সেখানেই। তার মানে এই নয় যে, ইতিহাসে বাণিজ্যই সবসময় রাজা-সম্রাটদের জন্ম দিয়েছে।

ঊটও পোষ মানে তিন হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আশপাশ দিয়ে। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেন-ওমানের স্থলপথ, হর্ন অফ আফ্রিকার সোমালিয়া, লোহিত সাগরের নৌপথ ইত্যাদির যোগসাজশে প্রাচীন ভারতের সাথে যুক্ত হয় মিশর। ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্সের’ আগ দিয়ে মিশরে সিডার কাঠ আমদানি হত লেবানন থেকে, সাইপ্রাস থেকে তামা-ব্রোঞ্জ, দক্ষিণ আরব থেকে সুগন্ধি, নুবিয়া থেকে সোনা, প্রভৃতি।

হিট্টাইট আর মিশরীরা ছিল সেযুগের সুপারপাওয়ার, আর সভ্য বিশ্বের হেন শহর নেই যাদের সাথে যোগাযোগ ছিল এ দু’য়ের। সিরিয়ার মিত্তানি মিত্রদের সাথে পত্রযোগাযোগের পান্ডুলিপি আবিষ্কৃত হয়েছে, যেগুলি পড়লে মনে হবে সে যুগের কূটনীতি এ যুগের থেকে এমন ভিন্ন কিছু ছিল না। সে সব পত্রে বিলাসদ্রব্যের বিনিময়ে কেউ চাইছে মিশরীদের প্রতিরক্ষা। কেউ পাঠাচ্ছে বিশাল উপঢৌকন, এ আশায় যে ভবিষ্যতে তার প্রতিদান পাওয়া যাবে। বিভিন্ন আদানপ্রদানের রশিদ এগুলি। পাওয়া গেছে মিশরের তেল-আল-আমারনাতে।

১৪২০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মিশরী বাণিজ্যজাহাজ।
চতুর্থ খ্রীষ্টপূর্ব শতকের ফীনিশীয় জাহাজ।

এরপর এক অন্ধকার যুগের সূচনা হয়ে, যাকে অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ নাম দিয়েছেন ‘ব্রোঞ্জ এইজ কলাপ্স’। ‘সীপিপল’ নামক অজানা জাতির আগ্রাসনে মধ্যপ্রাচ্যের সভ্য শহরগুলির একে একে পতন ঘটে। কমে আসে কূটনৈতিক যোগাযোগ। ভেঙে পড়ে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা আর বড় সাম্রাজ্যগুলি। অর্থাৎ মাছিরা ঝেঁটিয়ে বিদায়। তাই বলে মিষ্টি আদানপ্রদান থেমে থাকেনি। এই অরাজকতার মধ্যেই উত্থান ঘটে নতুন এক বণিকজাতির, যাদের নাম ফীনিশিয়ান। এরা নতুন ধরনের দ্রুত জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দিকে দিকে। দূরদূরান্তে স্থাপন করে বাণিজ্য কলোনি। বড় সাম্রাজ্যের জন্ম না দিলেও তাদের একটা বড় লেগ্যাসি আমরা এখনো বহন করে চলেছি, যার নাম অ্যালফাবেট।

পৃথিবীর অপর প্রান্ত চীনে অরাজকতার যুগশেষে দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতকে নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন সম্রাট শিহুয়াংদি। তার রাজদূত মরুভূমি-পর্বত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় আসে যুদ্ধে কাজে লাগানোর মত দ্রুত ঘোড়ার খোঁজে। সে বাণিজ্য সম্পর্ক থেকেই শুরু হয় সিল্করোডের পূর্বভাগের।

ফারগানার ঘোড়া, এই ‘স্বর্গের’ ঘোড়ার জন্যেই চীনারা মধ্য এশিয়ার সাথে বাণিজ্যসম্পর্ক স্থাপন করে, যার থেকে সিল্করোডের শুরু।
প্রাচীন রোমের অভিজাতদের কাছে চীনা রেশমের কাপড়ের বেশ কদর ছিল।
চীনের সমাধিসৌধে আবিষ্কৃত বিজ্যান্টিন স্বর্ণমুদ্রায় সম্রাট কন্সট্যান্সের মুখাবয়ব।

আর রোমান সাম্রাজ্যও দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকে ইরান ও মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে যুক্ত হয় চীনের বাণিজ্যপথের সাথে। ইউরোপ থেকে যেত সোনা আর চীন থেকে রেশম। আর আজকের ট্রেড ওয়ারের শুরুও এই সময়ে। রোমান অভিজাতরা চীনা রেশমের জন্যে রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে। সম্রাট টাইবেরিয়াস বাধ্য হয়ে সিল্কের ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। চীনও রেশমের গোপন প্রস্তুতপ্রণালী আগলে রেখেছিল, যাতে রোম সাম্রাজ্যের কারিগররা প্রতিযোগিতায় আবির্ভূত না হয়।

রোমানদের আগেই সম্ভবত গ্রীকরা বাণিজ্য কলোনি স্থাপন করেছিল ভারতের আরিকামেডুতে। পেরিপ্লাস অফ দ্য এরিথ্রেয়ান সী নামের গ্রীক পান্ডুলিপিতে এ বন্দরের উল্লেখ আছে। গ্রীকদের পরে রোমান সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে এই বাণিজ্যবসতি। বহু দেশীবিদেশী বণিকদের স্থায়ী-অস্থায়ী নিবাস ছিল এই ভারতীয় শহরটি। আনুমানিক সময়কাল দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে সপ্তম খ্রীষ্টীয় শতক।

রোম, আর পরে বিজ্যান্টিন, সাম্রাজ্যের সাথে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যপথ যুক্ত ছিল। একে বলে ইনসেন্স রাউট। ইয়েমেনের স্থানীয় গাছের বাকল থেকে তৈরি হত দুটি সুগন্ধি, এগুলি দিয়ে এখনো আতর তৈরি হয়। এদের নাম ফ্রাংকিনসেন্স ও মাঢ়। রোমান দেবালয়ে পূজোর কাজে এদের ব্যবহার ছিল।

ইয়েমেন থেকে শুরু করে লোহিত সাগরের তীরের জেদ্দা, তারপর জর্দানের পেত্রা হয়ে মধ্যোপসাগরীয় বন্দরে এসে জাহাজে উঠত এই মালামাল। যীশুখ্রীষ্টের জন্মলগ্নে এগুলিই উপহার নিয়ে এসেছিলেন তিন মেজাই। তৃতীয় খ্রীষ্টপূর্ব শতক থেকে দ্বিতীয় খ্রীষ্টীয় শতকের মধ্যে এই ইনসেন্স রাউট উপকূলীয় আরব শহরগুলিকে সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিল।

ইনসেন্স রাউটের অন্যতম স্থলবন্দর জর্দানের পেত্রা।

ইসলামী ঐতিহ্যে যদিও বলা হয় নবীজীর বাণিজ্যে হাতেখড়ি এই পথের মক্কা-সিরিয়া অংশে, তাতে একটা সমস্যা রয়েছে। গথদের হাতে ততদিনে রোমের পতন হয়েছে, আর বিজ্যান্টিনরা ঘোরতর খ্রীষ্টান। এসব সুগন্ধির বড় বাজার তখন আর নেই ইউরোপে।

রোমের পতনপরবর্তী সময় বিজ্যান্টিনরা চীনের সাথে সিল্করোডের মাধ্যমে বাণিজ্য করতে থাকে। চীনা সমাধিতে বিজ্যান্টিন মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। রাজনৈতিক শত্রু ইরানিদের পাশ কাটিয়ে মধ্য এশীয় সগডিয়ানদের মাধ্যমে সরাসরি সিল্কের বাজার পায় তারা। ভারত থেকেও মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে বৌদ্ধধর্ম পাচার হয়ে গেছে চীনে একই সময়ে। মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলি প্রকৃতার্থেই ছিল মানুষের মিলনমেলা।

ভাইকিংরা এ চিত্রে এসে যুক্ত হয় এরকম সময়েই। নবম/দশম খ্রীষ্টীয় শতকে সুইডিশ ভাইকিংরা ভলগা নদীর তীর ধরে লুটতরাজ করতে করতে অনেক দক্ষিণে ইউক্রেনের নভগরোদ আর কিয়েভ শহরে এসে পড়ে। সেখানকার স্লাভ জাতির মানুষ এই ‘রুস’দেরকে রাজা মানা শুরু করে। গোড়াপত্তন হয় প্রাচীন রাশিয়ার। এই ভাইকিংয়ের দল আরো দক্ষিণে কৃষ্ণসাগরের তীরে এসে টক্কর খায় বিজ্যান্টিনদের সাথে।

ততদিনে লুটতরাজ ছেড়ে ভাইকিংরা নতুন পেশা ধরেছে, বাণিজ্য আর ভাড়াটে সৈন্যগিরি। মার্সেনারি হিসাবে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়া পড়ত তাদের। সে সুবাদে একটু বাণিজ্যও করে নিত। এভাবেই সম্ভবত আব্বাসী খেলাফতের সাথে তাদের যোগাযোগ। আর আব্বাসীদের চকচকে রূপার ধাতব মুদ্রার প্রতি তাদের ছিল বিশেষ টান। আরব পরিব্রাজক ইবনে ফাদলানও উত্তরের দেশে ভ্রমণ করে এসে ভাইকিংদের নৌকা-শেষকৃত্যের একটা বিবরণী লিখে গেছেন আরবীতে।

এ হলো মোটামুটি সভ্য দেশগুলির থেকে পাওয়া বাণিজ্যের লিখিত বিবরণী। নিরক্ষর অনেক দেশও যে বৈদেশিক বাণিজ্যে প্রাচীনকাল থেকে যুক্ত ছিল তার প্রমাণও প্রত্নতত্ত্ববিদরা পেয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ওয়েলসের চার হাজার বছরের পুরনো তামার খনি থেকে মধ্যোপসাগরীয় সভ্য দেশগুলোতে রপ্তানী। কর্নওয়ালের টিনের খনিও সেরকম তিন হাজার বছরের পুরনো। এ দুয়ের তামা আর টিন মিলে সভ্য দেশগুলিতে তৈরি হত ব্রোঞ্জের জিনিসপত্র।

বাল্টিক উপকূল থেকে দক্ষিণে রোম-গ্রীস পর্যন্ত বিস্তৃত অ্যাম্বার রোড তিন হাজার বছরের পুরনো। মধ্যোপসাগর ছাড়িয়ে মিশরের তুতানখামুনের মামির গয়নাতেও জায়গা করে নিয়েছিল বাল্টিকের অ্যাম্বার। সেটা সাড়ে তিন হাজার বছর আগের কথা। ভাইকিং-আরব বাণিজ্যের যেমন লিখিত বিবরণ নেই, ইউরোপের অধিকাংশ এলাকা তখন নিরক্ষর থাকার কারণে অ্যাম্বার রোডেরও তেমন কোন বিবরণী পাওয়া যায়না।

ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষও ছিল নিরক্ষর। কিন্তু তাতে বাণিজ্য থেমে থাকেনি। মূলত নৌপথে তারা চীন থেকে জেড পাথরের আমদানি-রপ্তানি করে গেছে। কমপক্ষে তিন হাজার বছর আগে এই সওদাগরির শুরু।

মিশরের ফারাও তুতানখামুনের ব্রেস্টপ্লেটের নিচের অংশের চারটি অ্যাম্বার পাথর এসেছে সুদূর বাল্টিক উপসাগর থেকে।
ফিলিপাইনের জেড পাথরে তৈরি লিংলিং-ও গয়না রপ্তানি হত পুরো দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতে।

আর সাব-সাহারান আফ্রিকার থেকে রোমান সাম্রাজ্য আর আরব খেলাফতে গেছে সোনা, লবণ, আর কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাস।

পরবর্তী যুগে আরো বহু ট্রেড রুট বিশ্বের মানুষকে সংযুক্ত করেছে। পূর্ব আফ্রিকার জিরাফ বাঙ্গালার সুলতানের উপঢৌকন হিসাবে গিয়ে পৌঁছেছে চীনা সম্রাটের দরবারে। পশ্চিম আফ্রিকার আইভরি হ্যান্ডিক্রাফট শোভা বাড়িয়েছে পর্তুগীজ ডাইনিং টেবিলের। ইন্দোনেশিয়ার মশলা সোনার দরে বিক্রি হয়েছে হল্যান্ড-ইংল্যান্ডের বন্দরে। আমেরিকার আনারস, আলু, কোকো, রাবার, টমেটো, তামাক পাল্টে দিয়েছে বাকি বিশ্বকে।

পঞ্চদশ শতকে চীনা সম্রাটের জন্যে বাংলার সুলতান সাইফউদ্দিন উপঢৌকন পাঠান এই জিরাফ। বহন করে নিয়ে যায় খোজা সেনাপতি জংহোর জাহাজবহর। সাইফউদ্দিন জিরাফটি পান কেনিয়ার মালিন্দির রাজার কাছ থেকে, বাণিজ্যসূত্রে। চীনে জিরাফটি ব্যাপক সাড়া ফেলে, কারণ কাল্পনিক প্রাণী জিলিনের সাথে এর মিল। ফলে সম্রাটের শাসনক্ষমতা পাকাপোক্ত হয়।

শুধু যে বস্তু আর জ্ঞানের আদানপ্রদান হয়েছে তা নয়, মানুষের কাফেলা একেকসময় একেকমুখী হয়েছে। কখনো পরদেশেই রয়ে গেছে বিদেশী বণিক। হরপ্পান সভ্যতার একটি পরিবারের সমাধি আবিষ্কৃত হয়েছে ইরানে। ধরা যেতে পারে যে এরা ছিল সভ্যতার প্রথম ইমিগ্রান্ট। বিদেশ-বিভুঁইয়ে নিজেদের ছোট একটি কলোনি হয়ত তৈরি করেছিল তারা, যেমনটা করেছিল ফীনিশীয় (কার্থেজ), রোমান (মধ্য এশিয়া), গ্রীক (স্পেন), পারসিক (ইয়েমেন), চীনা (ইন্দোনেশিয়া), আরব (আফ্রিকা), আর রেনেসাঁস পরবর্তী যুগের অন্যান্য ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী। এদের যাতায়াত কখনো ছিল বাধাহীন নিরাপদ, কারণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করেছে কোন না কোন বড় সাম্রাজ্য (প্যাক্স রোমানা — ইউরোপীয় বাণিজ্য, প্যাক্স মোঙ্গোলিকা — সিল্ক রোড, অধুনা প্যাক্স আমেরিকানা — বিশ্বব্যাপী মুক্তবাজার প্রতিষ্ঠার ক্রেডিট এদেরই‌ প্রাপ্য)। আবার কখনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অভাবে তা ছিল বিপৎসংকুল।

কিন্তু এটা মানতেই হবে, যতই বাধাবিপত্তি থাকুক, মানুষ একে অন্যের সাথে যোগাযোগ যখন একবার শুরু করেছে, তারপর আর থেমে থাকেনি। জোয়ার-ভাঁটা এসেছে সে বাণিজ্যে, কিন্তু নদীর প্রবাহের মত নতুন ধ্যানধারণা, ধর্মচিন্তা, শব্দভান্ডার এসে যুক্ত হয়েছে একেক সভ্যতায়।

লেখার শেষে এসে মনে হলো রবিঠাকুরের ‘তাসের দেশ’ গীতিনাট্য। সে কাহিনীতে রাজপুত্র আর সদাগর এসে হাজির নতুন দেশে। রাজপুত্র যেখানে দিনবদলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে, সেখানে সদাগর কিন্তু তুলনামূলকভাবে বাস্তববাদী। প্রচলিত নিয়মের সুবিধাভোগী সফল বণিকসমাজ। তাই তারা সাধারণত শান্তিকামীও।

অবাধ ও ন্যায্য বাণিজ্য আসলে বিশ্বশান্তির একটা বড় অনুঘটক। মধ্যপন্থায় ধীর কিন্তু স্থির সামাজিক পরিবর্তন যদি কোন প্রক্রিয়া আনতে পারে, তো সেই বাণিজ্য। সহিংস বিপ্লব তার পন্থা নয়। আলোকিত বিপ্লব যুগে যুগে যারা করে গেছেন, তাদের মূলে বণিকরাই ছিলেন চালিকাশক্তি। রেনেসাঁস শিল্পের পৃষ্ঠপোষকরা যেমন ছিলেন মেদিচির মত বণিক-ব্যাংকার পরিবার, তেমন মার্ক্যান্টাইল যুগের কলোনিয়াল এক্সপ্লয়টেশন থেকে হোমনেশনগুলির মধ্যবিত্ত শ্রেণী আরও সমৃদ্ধশালী ও বহির্মুখী হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে তাদের দর্শন থেকে এসেছে এজ অফ এনলাইটেনমেন্ট। তারপর আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতন্ত্র, বিজ্ঞানপ্রযুক্তি ইত্যাদি।

বাণিজ্যের হাত ধরে ঔপনিবেশিকতা-সাম্রাজ্যবাদের শুরু বলবেন অনেকে। কিন্তু সব দিক বিচার করে, সব ইতিহাস, লংটার্ম ইমপ্যাক্ট দেখে, আমার ব্যক্তিগত মতামত হল, ট্রেড ইজ নট এ জিরো-সাম গেম, ট্রেড ইজ এ পজিটিভ সাম গেম। সবার জন্যে মুক্তবাণিজ্যে আখেরে উইন-উইন।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)

শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!