প্রাচীন ভারতের অথর্ববেদ আর ভাইকিং ওল্ড নর্স সাগার (মহাকাব্য) মধ্যে শুধু যোজন যোজন দূরত্ব নয়, কমপক্ষে এক হাজার বছরের বিভক্তি।
তারপরও এই গানটিতে গাওয়া ওল্ড হাই জার্মান আর ওল্ড নর্স ভাষার মন্ত্রগুলি শুনে আমার বেদের কথা মনে পড়ে গেল।
গানটিতে দুটি ভাষা আর তিনটি আলাদা মন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি অষ্টম শতকের প্রাচীন জার্মানিক ভাষায় শত্রুর বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভের মন্ত্র। মন্ত্রের যাদুকরী শক্তির বলে উত্থিত ‘ইদিসি’ নামক নারীদৈবশক্তির সাহায্যে হাতের বন্ধন আলগা করে পালানোর তাল করছে বন্দী যোদ্ধারা।
অষ্টম শতকে লেখা এ মন্ত্র ভাগ্যক্রমে মের্সেবুর্গ নামে এক পুরনো জার্মান শহরের ক্যাথলিক মনাস্টেরির লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকে। মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টান প্রেয়ারবুকের মাঝে আলগা কাগজে লেখা ছিল দুটি মন্ত্র। একটার কথা বললাম, আর অন্যটার বিষয়বস্তু আহত ঘোড়ার খুরের পরিচর্যা। প্রাক-ভাইকিং জার্মানিক দেবতা উওটান তার পুত্র বাল্ডরের ঘোড়ার ডিসলোকেটেড হাড় ঠিক করার জন্যে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন: Bone to bone, blood to blood, limb to limb, as if they were mended!
গানের দ্বিতীয় মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে নেক্রোম্যান্সি বা মৃতব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলার ওল্ড নর্স মন্ত্র। আইসল্যান্ড আর নরওয়েতে পাওয়া ভাইকিং আমলের ‘পোয়েটিক এডার’ কাহিনীর সাথে জড়িত গ্রোগাল্ডর মহাকাব্যের নায়ক তার মৃত মা গ্রোয়ার সমাধিস্তূপে গিয়ে তার প্রেতাত্মাকে উত্থিত করেছে। উদ্দেশ্য, বিপদসংকুল যাত্রার আগে গ্রোয়ার উপদেশগ্রহণ। গ্রোয়ার আত্মা গুনে গুনে নয়টি মন্ত্র দিয়ে ছেলের ওপর রক্ষাকবচ দিয়ে দিচ্ছে। তার একটি ঐ মের্সেবুর্গ মন্ত্রের হাতের বন্ধন আলগা করার হুবহু সমান্তরাল। আর নয় সংখ্যাটি ওল্ড নর্স ধর্মে একটি পুণ্যকর সংখ্যা।
আর গানের কোরাসে পুরুষকন্ঠে যে মন্ত্র তাকে বলে ওয়াশিং ভার্স। এটাও ভাইকিং যুগের। শত্রুর দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন যোদ্ধা বলে উঠছে: I wash from me my enemies’ hatred, the greed and wrath of powerful men। ধরে নিতে পারি, এর সাথে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করার একটা রিচুয়াল ছিল। প্রার্থনাটির মূল উদ্দেশ্য নিজের মনস্তত্ত্বকে পরিষ্কার করা। যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক, আর দৈনন্দিন জীবনেই হোক, যেন নিষ্কলুষ মনে প্রতিশোধপ্রবণতা পরিহার করে যেটা করণীয় সেটা করা যায়।
মের্সেবুর্গ চার্মগুলি অনন্য। তার কারণ, রোমের প্রভাবে ‘বর্বর’ থেকে ‘সভ্য’ জাতিতে পরিণত হবার সময় প্রাচীন জার্মানিক গোত্রগুলো তাদের পাগান ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়। সে প্রক্রিয়া কখনো শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, কখনো ক্রুসেডের মাধ্যমে সহিংসভাবে হয়েছে। ফলে আগের যে মন্ত্রগুলি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, সেগুলি সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মের্সেবুর্গ চার্মগুলি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মনাস্টেরিতে খ্রীষ্টানের ভেঁক ধরে থাকা পাগান বিশ্বাসীর কল্যাণে। সপ্তম-অষ্টম শতকে জার্মানিক জাতিগুলি এভাবে তাদের ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। একই অবস্থা হয় দশম শতকের ভাইকিংদের।
যেখানে ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য বেঁচেবর্তে থাকে সেটা উত্তর ভারত। বেদ আর এডার মধ্যে অনেক মিল। শুধু দেবদেবী আর মিথলজি নয়। থর হচ্ছেন বেদের ইন্দ্র, তার হাতের বজ্র থরের অস্ত্রের সমান্তরাল। ইত্যাদি অনেক মিল রয়েছে।
আরও এ গানটিতে যে মিল পাচ্ছি সেটা হলো অ্যালিটারেশন বা অনুপ্রাস। অর্থাৎ কাব্যের শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর দিয়ে মিল।
উদাহরণস্বরূপ, অথর্ববেদের রোহণী বনস্পতি সুক্ত, যেটা কিনা ঐ দ্বিতীয় মের্সেবুর্গ চার্মের মতই মাংসের সাথে মাংস লাগুক, চর্মের সাথে চর্ম ইত্যাকার মন্ত্রপাঠের পাশাপাশি ক্ষতে অরুন্ধতিচূর্ণ দিতে বলছে, তার কয়েক লাইন দিলাম:
আর ওল্ড নর্সে গাইছে:
Þann gel ek þér fyrstan,
– þann kveða fjölnýtan, þann gól Rindi Rani, –
at þú of öxl skjótir, því er þér atalt þykkir;
sjalfr leið þú sjalfan þik.
(থন গেল্ এক্ থের ফ্যুর্শটান,
থন ক্বেদা ফ্যিয়লন্যুতান, থন গোল রিন্দি রানি
অৎ থু ওফ অক্শল শ্যিয়তির, থ্বি এর থের অতল্ত থুক্কির;
শ্যিয়াল্ফর লেইদ থু শ্যিয়াল্ফান থিক…)
ইত্যাদি।
আমরা ছোটবেলায় শিশুতোষ ছড়াতে অ্যালিটারেশন প্রচুর করেছি। এটা ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্যে একটা কমন ব্যাপার। বিশেষ করে, বৈদিক সংস্কৃত, ওল্ড হাই জার্মান, ওল্ড নর্স, অ্যাংলোস্যাক্সন আর ওল্ড আইরিশ ভাষার সাহিত্যে বেশ ভালমতই ব্যবহার হত এই অলংকার।
গানটি শুনলে তাই মনে হয়ে বেদের কোন মন্ত্র আওড়ানো চলছে। আসলেই ভাইকিংরা এভাবে সুর করে মন্ত্র পড়ত কিনা, তা হয়ত ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন না, কারণ তাদের কোন লিখিত সঙ্গীত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কাব্যিক অলংকরণের মিল থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে, যে বৈদিক যজ্ঞ-মন্ত্রের সুর থেকে প্রাচীন জার্মানিক গোত্র আর পরবর্তী ভাইকিংরা খুব বেশি দূরে ছিল না।
আজকাল যে সামান্য পরিমাণ পাগানবিশ্বাসী মানুষ উত্তর ইউরোপে বাস করে, তারা তাই বৈদিক সংস্কৃতের অনুকরণেই মন্ত্রপাঠ করে। আর সেটাই এই গানটাতে ধরা পড়েছে।
গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।
ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!
এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।
এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।
এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা।
কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অগ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।
সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।
ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।
দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।
পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।
এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।
আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেলডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিকগথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁও–হিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।
অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।
পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।
উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।
বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।
এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।
স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।
কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল।
বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।
ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।
লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!
আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।