গঙ্গা বইছো কেন?

Featured Video Play Icon

 

“বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছো কেন?”

সবার পরিচিত এই গানটা ভূপেন হাজারিকা গেয়েছেন বাংলা ছাড়াও হিন্দী আর অসমীয়াতে (উচ্চারণঃ অহমিয়া)। অনেকেই হয়ত জানেন যে গানের সুরটা আসলে অনেক পুরনো একটা মার্কিন মিউজ়িক্যালের সুর অবলম্বনে।

আসল গানটার নাম “ওল´ ম্যান রিভার” — ওপরের ভার্শনটা “শোবোট” বলে ১৯৩৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। গেয়েছেন সেসময়কার বহুলপ্রতিভাসম্পন্ন আমেরিকান-ফুটবল খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, সামাজিক-রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট পল রোবসন

বহু চড়াই-উৎরাই পার করা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের ছেলে এই বাস ব্যারিটোন শিল্পীর সাথে হাজারিকার দেখা হয় নিউ ইয়র্কে। পঞ্চাশের দশকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূপেন যখন পিএইচডি করছেন, তখন রোবসন সম্ভবত নিউ ইয়র্কের হারলেমের বাসিন্দা। রোবসন বিশের দশকে নিউ জার্সির রাটগারসে পড়েছেন, নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া থেকে এলএলবি পাশ। তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে ছিল ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে। ভূপেনের সাথে যখন তাঁর দেখা হয়, তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় আর প্রকাশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিনের প্রশংসা করার কারণে তিনি একঘরে

“শোবোট” চলচ্চিত্রটা ব্রডওয়ে মিউজ়িক্যাল থিয়েটারের একটা নাটক অবলম্বনে তৈরি। নাটকটার কাহিনীও এডনা ফার্বার রচিত একই নামের বেস্টসেলার উপন্যাস থেকে নেয়া। গল্পটা ১৮৮০এর দিককার মিসিসিপি নদীর ভ্রাম্যমান জাহাজ-থিয়েটার নিয়ে, যাকে সবাই চিনত শোবোট হিসাবে। অনেকটা আমাদের দেশের ভ্রাম্যমাণ সার্কাস বা যাত্রাদলের মত এরা মিসিসিপি ধরে সারা বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিড-ওয়েস্ট আর সাউথের মধ্যে আপ-ডাউন করত। গ্রামে-গঞ্জে মুভি থিয়েটার গজিয়ে উঠেনি তখনও। নদীতীরের কোন গ্রামে একটা শোবোট আসলে তাই সাড়া পড়ে যেত, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলে ছুটে আসত মজা দেখতে।

সেই কাহিনীর একটা চরিত্র জো, তাকে এই দৃশ্যে রূপ দিয়েছেন পল রোবসন। সে শোবোটের কুলি। জাহাজে যতরকম সাপ্লাই লাগে, সেসব ভারি ভারি জিনিসপত্র কূল থেকে নিয়ে আসতে হয় তাকেই। এখানে সে গান ধরেছে মিসিসিপি নদকে উদ্দেশ্য করে। লিংকনের ১৮৬৩এর ইম্যানসিপেশন প্রক্ল্যামেশনের পরেও তার মত কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে মুক্তি নেই। জমি-জমা নেই, ভোটাধিকার নেই, নেই শিক্ষা-দীক্ষা-চাকরির গ্যারান্টি। সমান পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সাদাদের থেকে অনেক বেশি হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি করতে হয়। জো তাই মিসিসিপি নদকে একরকম আদর করেই বকছে ওল’ ম্যান বলে, কারণ হাজার বছর ধরে সে বুড়ো বয়েই চলেছে, কোনদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে জানে অনেক কিছুই, কিন্তু মুখটি খুলবে না!

আমেরিকার গৃহযুদ্ধে উত্তরের ইউনিয়নের সেনাবাহিনী দক্ষিণের বিদ্রোহী কনফ়েডারেটদের বিরুদ্ধে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জিতেছিল। দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক উচ্ছেদও করেছিলেন লিংকন। কিন্তু সে বিজয়ের মূল্যবোধটাকে ধরে রাখা বোধ হয় যুদ্ধে জেতার থেকে বেশি কঠিন ছিল।

যু্দ্ধের পরে রাজনৈতিক একতার খাতিরে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ ডেমোক্রাটদের সাথে আপোসরফার ভিত্তিতে সংস্কার করতে চাইলেন। আর সেসবের একটা ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকাররোধ। তার ওপরে দক্ষিণের স্টেটগুলির ডেমোক্রাট সরকার ব্ল্যাক কোডস বলে বর্ণবাদী আইন প্রণয়নের কারণে র‍্যাডিক্যাল রিপাবলিকানরা গেল খেপে। ১৮৬৮এর নির্বাচনে জেতার পরে তারা ফ়েডারেল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে একরকম মার্শাল ল’ জারি করলো দক্ষিণের স্টেটগুলোতে। সেখানে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, মুক্ত ক্রীতদাস, দক্ষিণের কিছু রিপাবলিকান সমর্থক আর দক্ষিণাদের কাছে কার্পেটব্যাগার নামে কুখ্যাত উত্তর থেকে আসা সুযোগসন্ধানীরা একত্র হয়। তারা স্টেট পর্যায়ে রাজনৈতিক আর শিক্ষা অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদারনৈতিক সংস্কার করে। এই সংস্কার ইতিহাসে পরিচিত ‘রিকনস্ট্রাকশন’ নামে।

কিন্তু একে সাদার্ন ডেমোক্রাট আর তাদের সমর্থিত বর্ণবাদী গুপ্তসংস্থা কু ক্লাক্স ক্লান সেকেলে সাদার্ন সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসাবে চিত্রায়িত করে। তারা রিপাবলিকান আর কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা আর গুপ্তহত্যা শুরু করে। এদের মোক্ষম সুযোগ আসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের দ্বিতীয় টার্মের শেষে। ১৮৭৬এর নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ ভোটচুরি করে আর কালোদেরকে ভয় দেখিয়ে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখে তারা। সেভাবে এরা স্টেট সরকারগুলির দখল নেয়, আর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রাদারফ়োর্ড হেইজ়কে প্রায় হারিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট পদের বিনিময়ে কমপ্রমাইজ়স্বরূপ রিপাবলিকানরা দক্ষিণের শেষ তিনটা স্টেট থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে। রিকনস্ট্রাকশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারপর সাদার্ন ডেমোক্রাট সরকারদের শাসনে কালোদের অবস্থা আবার যেমনকার তেমন, শুধু দাসত্বশৃংখল বাদে। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলিতে নতুন আইনকানুন জারি হল যাদের বলে ‘জিম ক্রো ল’জ়’। সেগুলির মূল লক্ষ্য ছিল কালোদের (আর আইনী ভাষায়, কিছু গরীব সাদাদেরও!) ‘সমান কিন্তু আলাদা’ বন্দোবস্ত রাখা। সোজা কথায় বর্ণবিভেদ বা সেগ্রেগেশন!

গৃহযু্দ্ধের পরপরই কালোদের যেটা দরকার ছিল সেটা হলো, ক্রীতদাস থেকে যাতে তারা শেয়ারক্রপার ভূমিদাস না হয়ে যায় তার জন্যে অর্থনৈতিক সাহায্য। লিংকন তাই চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁকে মেরে ফেলে জন উইল্কস বুথ। আর সদ্য-নিঃস্ব শ্বেতাঙ্গ তুলাচাষীদেরও দরকার ছিল ফ্রী মার্কেট লেবারের কিছুটা গ্যারান্টি। কিন্তু সবকিছু রাজনীতির প্যাঁচে ওলট-পালট হয়ে যায়। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো সাত-আট দশক

শোবোট ছবিটাতে আরো অনন্য কিছু ব্যাপার দেখবেন, যেমন ১৮৮০র দিকে সাদা-কালো মিশ্র বিয়ের ব্যাপারটা কিভাবে দেখা হত। ছবিটি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা শতবর্ষের সেরা একশো মার্কিন ফিল্মের তালিকায় প্রায় প্রতিবছরই থাকে।

আমেরিকার মিসিসিপি থেকে বাংলার গঙ্গা — গণমানুষের গায়ক হিসাবে ভূপেন হাজারিকা  একটা চমৎকার দেশ-কালাতিক্রমী  সমান্তরাল গান-সুর নিয়ে এসে উপহার দিয়েছেন আমাদেরকে। ৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর ৯২তম জন্মবার্ষিকী। শ্রদ্ধা তাঁর আর তাঁর প্রতিভাবান বন্ধুর প্রতি!

স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার উন্মুক্ত…

Featured Video Play Icon

ইজ়রায়েলের সর্বকালের সবচে’ জনপ্রিয় শিল্পী ওফ়রা হাজ়া গাইছেন এই গানটা। ১৯৭৮এর টিভি সম্প্রচারের ভিডিও এটা। গানটার ১৯৮৪এর ভার্শন পরে ইউরোপ-আমেরিকার চার্টে প্রথম স্থানে ছিল। এই রেকর্ডিংএর সময় ওফ়রা ২১ বছরের তরুণী, কিন্তু ১৯ বছরেই তিনি খ্যাতি কুড়নো শুরু করেন। পরে ইজ়রায়েলের হয়ে ইউরোভিশন প্রতিযোগিতাতেও অংশ নেন। যেসব বিখ্যাত শিল্পীদের সাথে একসাথে গান করেছেন, তাদের মধ্যে নুসরাত ফতেহ আলী খানও আছেন।

ওফ়রা হাজ়ার ছোটবেলা কেটেছিল তেল আবিবের হাতিকভ়া নামের এক বস্তিতে। তাঁর বাবা-মা ছিলেন ইয়েমেন থেকে আসা কপর্দকশূন্য রেফ্যুজি। সপ্তদশ শতকের ইয়েমেনী কবি সালাম শাবাজ়ির লেখা কবিতায় সুর করা এই গানটা গাইছেন হাতিকভ়ার মিউজ়িক ওয়ার্কশপের সাথে। দলটা তৈরি হয়েছিল তাঁদের মহল্লার গরীব ছেলেমেয়েদেরকে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুযোগ দেয়ার জন্য।

লঘুচিত্তে গাওয়া এই গানটার বিষয়বস্তু নির্ধনের প্রতি স্রষ্টার মমতার গুণকীর্তন। “যদি ন্যায়পরায়ণের দানের দরজা বন্ধ হয়ে যায়, তবে মনে রেখো স্রষ্টার স্বর্গদুয়ার সর্বদা উন্মুক্ত।” আর খোদার কাছে অনুনয় করা হচ্ছে তাঁকে ‘এল হা’ঈ’ নামে ডেকে, যেটা মুসলিমদের কাছেও স্রষ্টার নিরানব্বই নামের একটা। সপ্তদশ শতকে মধ্যমপন্থী সুন্নি ওসমানী তুর্কীদের সাহায্য করার সন্দেহে ইয়েমেনের জ়াইদী শিয়া বংশীয় ইমাম বা শাসক শাবাজ়ি আর তাঁর ইয়েমেনী ইহুদী গোত্রকে মাওজ়া বলে এক মরুএলাকায় নির্বাসনে পাঠায়। সেখানে তাদের এক-পঞ্চমাংশ খাদ্যাভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। স্বগোত্রকে সাহস আর আশা যোগানোর জন্যে শাবাজ়ির এ কাব্য রচনা।

গরীবের প্রতি যেমন ইসলামে জ়াকাত দেয়া কর্তব্য, ইহুদী ধর্মেও সেরকমটা আছে। ধর্মপ্রাণ ইহুদীদের আয়ের এক-দশমাংশ দান-খয়রাতে দিয়ে দেবার নিয়ম কোন কোন তরিকায়। হিব্রু ভাষায় এই বাধ্যতামূলক নিয়মকে বলে স়দাকা, যেটা ইসলামে ঐচ্ছিক দানক্রিয়ারও নাম। ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম মনীষী ইহুদী ধর্মসংস্কারক মুসা বিন মাইমুনের তরিকায় আট শ্রেণীর মধ্যে প্রথম সারির স়দাকা হলো, সত্যিকারের অভাবী কাউকে অনুদান বা সুদহীন ঋণ দেয়া, বিশেষ করে যদি সে অর্থটাকে নিজের অবস্থার দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের কাজে লাগায়। আর তাঁর নিয়মাবলীতে ধনী-গরীব সবারই কিছু পরিমাণ দান-খয়রাত করা বাধ্যতামূলক।

বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টান ধর্মে কিছু ক্ষেত্রে দরিদ্রতাকে দেখা হয় স্বর্গীয় গুণ হিসাবে। যে কারণে সন্ন্যাসব্রত নেয়ার একটা ঐতিহ্য তাদের আছে। ইহুদীধর্মে তেমনটা নেই। গরীবদের দয়া করার কথা বলা হলেও ধর্মীয়ভাবে ছোটবেলা থেকে ইহুদীদের এটাই শেখানো হয় যে স্বেচ্ছায় দরিদ্র-পরনির্ভর হওয়া অবাঞ্ছনীয়, সবার উচিত নিজের সাধ্যমত কারিগরি কাজ শিখে ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকুরি করা। কারণ আব্রাহাম, জেকব, সলোমন, আইজ়্যাক — ইহুদী ঐতিহ্যে এ সকল নবীই স্বনির্ভর ছিলেন। হয়ত এই মানসিকতার কারণেই পৃথিবীর ইহুদী জনসংখ্যার একটা বড় অংশ অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল।

সুদখোর ইহুদীর যে স্টেরেওটাইপটা সুপরিচিত, সেটা কিন্তু অনেকাংশেই অতিরঞ্জিত, আর সেটা মুসলিম বিশ্ব নয়, এসেছে পশ্চিমাবিশ্ব থেকে — শেক্সপীয়ারের শাইলক দ্রষ্টব্য। ধনী ইহুদীদের মধ্যে রথ্সচাইল্ড পরিবার সুপরিচিত হলেও অনেকে মনে করেন রকাফেলার, কার্নেগী, জেপি মর্গান, এরাও ইহুদী ছিলেন — সে ধারণা ভুল। আর দারিদ্র্য থেকে ইহুদীরাও মুক্ত নয়। আল্ট্রা-কনজ়ার্ভেটিভ ইহুদী ‌অধ্যুষিত নিউ ইয়র্ক স্টেটের কিরিয়াস জোয়েল হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচে’ গরীব শহর।

ইয়েমেনে ইহুদীদের বসবাস ছিল সুপ্রাচীন কাল থেকে, তারা ঈশ্বরকে ডাকত রহমান নামে, তাদের ধর্মীয় আচারব্যবস্থাও ছিল অন্য এলাকার ইহুদীদের থেকে স্বতন্ত্র। তৃতীয় খ্রীষ্টাব্দ থেকে ষষ্ঠ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত খ্রীষ্টান বিজ়্যান্টাইন সাম্রাজ্য আর আহুরা-মাজ়দার উপাসক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্যের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলেছে, তাতে ইয়েমেনের খ্রীষ্টান আরব আর ইহুদীরাও পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ করেছে। জ়ু নুওয়াস বলে ইয়েমেনের হিমইয়ার রাজ্যের এক ইহুদী রাজা ইসলামের আবির্ভাবের একশ’ বছর আগে খ্রীষ্টানদের ওপর গণহত্যা চালান। তাদেরকে ইহুদীধর্মগ্রহণ অথবা মৃত্যু বেছে নিতে বাধ্য করেন, আর যারা ধর্মান্তরিত হয়নি, তাদেরকে চার্চের মধ্যে আটকে রেখে জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। সে অত্যাচার থেকে খ্রীষ্টানরা রক্ষা পায় আবিসিনিয়ার খ্রীষ্টান আক্সুম সাম্রাজ্যের সামরিক হস্তক্ষেপে। কিন্তু সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত ইয়েমেনী ইহুদীদের করতে হয়েছে অধুনাকাল পর্যন্ত।

এখানে এটা উল্লেখ করা দরকার যে, ইসলামে ইহুদীদের স্বাধিকার দেবার বিরুদ্ধে কোন নিয়ম নেই। খ্রীষ্টানদের মত তাদেরকে ‘আহলাল কিতাব’ বা খোদাপ্রদত্ত পুস্তকের অনুসারী হিসাবে যথোপযুক্ত ধর্মীয় অধিকার দেয়া আর তাদের সম্পত্তি রক্ষার কথা বলা আছে। হিজরতের পরে মদিনাসনদ বলে একটা চুক্তিনামায় সকলপক্ষের সহমতে এ সকল গ্যারান্টি দেয়া হয়। তাতে একটা রাষ্ট্রেরও গঠনতন্ত্র রূপ পায়, যার সকল সদস্যকে ধর্মগোত্রনির্বিশেষে সুনির্দিষ্ট অধিকার দেয়া হয়। পরে চুক্তিভঙ্গের কারণে তিনটি প্রধান ইহুদী গোত্রকে তখনকার সাধারণ প্রচলন অনুযায়ী নিষ্ঠুর শাস্তি দেয়া হয়। তারপরেও অন্যান্য ইহুদীগোত্র মদিনায় মুসলিমদের সাথে দ্বিতীয় খলিফার শাসনামল পর্যন্ত সহাবস্থান করেছে। অন্যধর্মাবলম্বীদের মত জিজ়িয়া কর তাদের দিতে হত, কিন্তু মুসলিমদের বাধ্যতামূলক জ়াকাত কর তাদের জন্যে ছিল মওকুফ।

হাজার বছরের বেশি ধরে মুসলিম-ইহুদীরা একসাথে বসবাস করেছে, এটাই স্বাভাবিক যে সে ইতিহাস মিশ্র। মুসলিম রাজ্যগুলি তাদের ইহুদী প্রজাদের সাথে কিরকম আচরণ করেছে, সেটা নির্ভর করে কোন গোত্র-বংশ-ধর্মীয় গ্রুপ ক্ষমতায় ছিল তার ওপর। স্পেনের গ্রানাদাতে একবার যেমন ইহুদীদের ওপর গণহত্যা চলেছে, আবার সেরকমই কোন দূরদর্শী রাজা সেখানে তাদেরকে মুসলিমদের সমান অধিকার দিয়েছিলেন। মধ্যযুগে নিঃসন্দেহে ইউরোপের খ্রীষ্টান রাজ্যগুলির থেকে মুসলিম রাজ্যে ইহুদীরা নিরাপত্তা বেশি পেত। ওসমানী সাম্রাজ্যেও ইহুদীরা যথেষ্ট ইন্টেগ্রেটেড ছিল, শাসন আর করব্যবস্থায় তাদের অনেক অবদান ছিল।

এখন আবারও মুসলিম সমাজ একটা ইহুদীবিদ্বেষী ফেইজ়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে আমার ধারণা। কারণ দু’টো। এক, ঊনবিংশ-বিংশ শতকে ইহুদীবিদ্বেষী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলির কলোনিতে ইউরোপীয়দেরই প্রভাবে গুজব-ভুল ধারণার বিস্তার ঘটেছে বেশি। সেটা তুঙ্গে উঠেছিল নাৎসিদের ছড়ানো প্রপ্যাগান্ডার মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে ইজ়রায়েলের আবির্ভাব, আর তার বিরুদ্ধে আরবদের তিনটা যুদ্ধ (খেয়াল করুন, এখনকার ইজ়রায়েলের প্রাণের শত্রু ইরান সেগুলির কোনটাতেই অংশ নেয়নি)। সেই রাজনীতির মধ্যে না গিয়ে এটুকু বলাই যথেষ্ট যে তিরিশ-চল্লিশের দশকে মিশর, লিবিয়া, ইরাক, আর ইয়েমেনে এসবের প্রভাবে কয়েকটি মুসলিম-ইহুদী দাঙ্গা হয়েছে, দু’পক্ষেই বহু ক্ষয়ক্ষতি-মৃত্যু ঘটেছে।

ইয়েমেনে দীর্ঘকালের জাতিবিদ্বেষী রাষ্ট্রীয় নীতির শিকার ইহুদীরা ১৯৪৭এর ইজ়রায়েল-ফিলিস্তিন বিভাজনের জাতিসংঘ রেজ়োল্যুশনের পরে আরেকবার আক্রান্ত হয়। তাদের ধর্মালয়-বিদ্যালয়-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেয় মুসলিম মব্। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বদলে আদেনের মুসলিম পুলিশই লুটতরাজে যোগ দেয়। দুপক্ষ মিলিয়ে প্রায় দু’শ মানুষ প্রাণ হারায়। ‌

অতঃপর শেষবারের মত ইয়েমেনী ইহুদীরা নিঃস্ব হয় ১৯৪৯/৫০এ অপারেশন ম্যাজিক কার্পেটের সময়। সেটা ছিল ইজ়রায়েলের জুয়িশ এজেন্সীর একটা অপারেশন, যার মাধ্যমে এরিত্রিয়া, সাউদি, জিবুতি, ইয়েমেন আর ব্রিটিশ আদেন থেকে প্রায় পঞ্চাশ হাজার ইহুদীকে গোপনে আকাশপথে ইজ়রায়েলে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন এদের বেশিরভাগই দূর-দূরান্ত থেকে স্থাবর সম্পত্তি জমিজমা ছেড়ে আদেনে এসে প্লেনে উঠে পড়ে। তাদের স্থিরচিত্র ইন্টারনেটে আছে, আর সেগুলি দেখে আমার মধ্যে মানবিক সহানুভূতি জাগ্রত হয়, কারণ আমার পিতৃপুরুষও রেফ্যুজি হিসাবে জমিজমা ছেড়ে প্লেনে চড়ে অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন।

ওফ়রা হাজ়ার বাবা-মাও এভাবে ম্যাজিক কার্পেটে করে ইজ়রায়েলে এসে পড়েন। সেখানে পৌঁছে কিন্তু ইয়েমেনী ইহুদীরা সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তাদের স্বকীয় ধর্মীয় পরিচয় খুইয়ে বসেছিল, সেটা একটা আয়রনি! এখন মধ্যপ্রাচ্যের তুরস্ক আর ইরানে কয়েক হাজার বাদ দিলে ইজ়রায়েল ছাড়া আর কোথাও তেমন কোন ইহুদী জনসংখ্যা নেই।

ও আরেকটা ব্যাপার… এই গানটা ১৯৭৮এ গাওয়া। এসময় একটা বড় আশা নিয়ে ইজ়রায়েল-মিশর দু’দেশের মানুষই একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিল। ১৯৭৭এ সারা আরব বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে মিশরের রাষ্ট্রপতি আনওয়ার সাদাত ইজ়রায়েলে এসে প্রেসিডেন্ট মেনাহিম বেগিনের সাথে দেখা করেন। ১৯৭৮এ ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে মিশরকে ইজ়রায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখলকরা সিনাই উপদ্বীপের বিশাল ভূখন্ড ফেরত দিয়ে দেয় (গাজ়া বাদে)। কিন্তু দু’দেশেরই কট্টরপন্থীরা একে সুদৃষ্টিতে দেখেনি। ফলশ্রুতিতে সাদাতকে ১৯৮১তে নিজের জীবন দিয়ে তার মাশুল দিতে হয়।

এই গানটা ভাল লাগলে একই সময়ে ধারণকৃত  নেশিকোত বায়াম বলে হাজ়ার আরবী-হিব্রু গানটাও শুনে দেখুন! ইম নিন আ’লু গানটার কথা আর অনুবাদ আছে এখানে

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!