পেপার ট্রেইল

“জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও” — ছোটবেলা থেকে আমরা শুনে এসেছি এটা নাকি নবীজী বলেছেন। সত্যি কথা হলো, এটি একটি দা’য়ীফ (দুর্বল) হাদীস, সম্ভবত বানোয়াট। ইসলাম ও আরবের আদি ইতিহাসে চীনের সাথে তেমন কোন প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক যোগাযোগ ছিল না।

অবশ্য ইসলামের শুরুতে আরব দিগ্বিজয়ের ঝান্ডা পশ্চিমে ইউরোপ আর পূর্বে ভারত পর্যন্ত প্রসারিত হতে বেশি সময় লাগেনি। নবীজীর প্রয়াণের বিশ বছরের মধ্যে দুই বড় পড়শী বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের পূর্বভাগের একটা বড় অংশ আর সাসানীদের পুরো রাজ্য আরবদের করায়ত্ত হয়। এর মধ্যে ইরানের উত্তরপূর্বের খোরাসান (বর্তমান আফগান-ইরানের উত্তর সীমান্তে) মধ্য এশিয়ার প্রবেশপথ। এ এলাকার উত্তরের দুর্গম গিরিপথের মধ্যে দিয়েই প্রাচীন পরিব্রাজকরা চীনে যেতেন।

অর্থাৎ চীন ও আরব এ দুইয়ের মোলাকাত ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

চীনের তাং সাম্রাজ্যের মানচিত্র

এসময় চীনে তাং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত। পরবর্তী অন্যান্য রাজবংশের মত অন্তর্মুখী এরা ছিল না। বিশাল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় সমান অংশগ্রহণ ছিল রাজকার্য পরিচালনায়। এরকম কসমোপলিটান রাজ্যে পূর্বের কোরিয়ান, উত্তরের মোঙ্গোল, পশ্চিমের তুর্কী জাতিগোষ্ঠীগুলিকে যথাযোগ্য স্থান দেয়া হত। অবশ্যই যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা চীনের সম্রাট ‘স্বর্গপুত্রকে’ উপঢৌকন পাঠানো বন্ধ করত।

মধ্য এশিয়ার মাধ্যমে সিল্করোডের বাণিজ্যপথ এসময় ভারতকে চীনের সাথে যুক্ত করে। মধ্য এশিয়া ছিল প্রাচ্য-প্রতীচ্যের এক মিলনস্থল। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের উত্তরসূরী গ্রেকো-ব্যাক্ট্রিয়ান রাজারা যেমন ছিল আফগানে, সেরকম ফারগানা-তাশখন্দ-বুখারা-কাশগর-সমরখন্দ এসব শহরেও সগডিয়ানভাষী ইরানীশাসিত নগররাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এরা ছিল বংশপরম্পরায় বণিক। আর নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, মানিকিয়ান, ইহুদী, জোরোয়াস্ট্রিয়ান ইত্যাকার নানা ধর্মবিশ্বাসের অনুসারীদের আবাস ছিল এ রাজ্যগুলিতে।

সিল্ক রোডের ভারতীয়, পারসিক, চীনা অংশ

ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম চীনে প্রথম যায় এ পথেই। সম্ভবত অতীশ দীপংকরও এই রাস্তার পূর্বভাগ যেটা পাকিস্তানের গিলগিটের মধ্যে দিয়ে গেছে, সেদিক দিয়ে তিব্বতে গেছেন। চীন থেকেও হিউয়েন সাং এ পথেই ভারত ও বাংলায় এসেছিলেন সংস্কৃত বৌদ্ধ পান্ডুলিপি সংগ্রহ করতে। তার সে অভিযানের গল্প পরবর্তীতে চীনা পুরাকাহিনীতে পরিণত হয়েছে, যার ইংরেজী নাম ‘এ জার্নি টু দ্য ওয়েস্ট’। আর তার অন্যতম প্রধান চরিত্র বানররাজা সুন উখোং। ছোটবেলায় আমরা এই কাহিনীর চীনা ছবিবই পড়েছি।

সিল্ক রোডের অন্যতম স্থলবন্দর চীনের দুনহুয়াংএর গুহায় আবিষ্কৃত হয়েছে দেয়ালচিত্র। এখানে ভারতীয় প্রভাবে আঁকা বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী চিত্রিত।
বানর রাজা সুন উখোং, সম্ভবত চরিত্রটি ভারতের হনুমানজির অনুপ্রেরণায় সৃষ্ট

তাং সাম্রাজ্যের শত্রু অবশ্য কম ছিল না। ইরানীরা যেমন তুরানের যাযাবরদের একরোখা বর্বর বলে তুলে ধরেছে শাহনামার মত মহাকাব্যে, তেমন চীনারাও এদেরকে ‘পশ্চিমের ডাকাত’ নামে ডাকত। বিভিন্ন ট্রাইবের তুর্কীভাষী এসকল জনপদ আবার নিজেদের মধ্যেও লড়ত। চীনাদের সাথে মিত্র হিসাবেও যোগ দিত, কখনো হত শত্রু। এসকল যাযাবরদের ঠান্ডা রাখার জন্যে তাদের সাথে তাং সম্রাটরা নানা কূটনৈতিক চুক্তি সাক্ষর করে। সে অনুযায়ী একে অন্যের পরিবারের সাথে বিবাহসূত্রে তারা আবদ্ধ হয়।

নতুন একটি সাম্রাজ্য অবশ্য চীনের দক্ষিণপশ্চিমে এ সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে। সেটি তিব্বত। এরাও মূলত যাযাবর। আর সপ্তম শতক থেকে শুরু করে এরা চীনাদেরকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারিম বেসিন পুরোপুরি তিব্বতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়াতে চীনাদের পশ্চিমে যাবার রাস্তা সংকুচিত হয়ে পড়ে। মধ্য এশিয়াতে তাং বাণিজ্যপ্রভাব ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সবচে বড় প্রতিবন্ধক ছিল তিব্বত সাম্রাজ্য।

আরব সেনাদল এসময় মধ্য এশিয়ার মারি-সমরখন্দ জয় করে বেশি পূর্বে আর অগ্রসর হয়নি। এরপরে মধ্য এশিয়ার বিশাল স্তেপভূমি আর গোবি-তাকলামাকান মরুভূমি। জনশূন্য বিশাল এলাকার মাঝে একটি-দুটি মরূদ্যান শহর। কেন্দ্রীয় কোন শাসনব্যবস্থা নেই। সব মিলিয়ে করারোপের মত যথেষ্ট জনসংখ্যা নেই। বিশাল সাম্রাজ্যও নেই জয় করার মত। তখন ইউরোপের সাথে সিল্ক রোড বাণিজ্যও তেমন বেশি নয়। সব মিলিয়ে উমায়্যা খলীফাদের তেমন কোন অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভ ছিল না মধ্য এশিয়ার আরো অভ্যন্তরে ঢোকার।

সিল্ক রোডের পশ্চিম চীন প্রান্তের তুরপান শহরের প্রাচীন ভবন। তাকলা মাকান মরুভূমি পেরিয়ে চীনা তুর্কীস্তান কিংবা শিনজিয়াংএ এসে এই মরুদ্যান শহরে পৌঁছত সওদাগরি কাফেলা।

চীনাদের অবশ্য এ অঞ্চলের প্রতি প্রাচীনতা থেকে আগ্রহ ছিল। প্রথম চীনা সম্রাট শিহুয়াংতি মধ্য এশিয়াতে এক রাজপ্রতিনিধি পাঠান ‘রক্তঘর্ম’ অশ্ব খুঁজে নিয়ে আসার জন্যে। যুদ্ধে নাকি ভীষণ দ্রুততা দিত এ ঘোড়া। আরো নানা ভারতীয় বিলাসদ্রব্য পাওয়া যেত এখানকার বাজারে।

পূর্ব-পশ্চিমের মিলনস্থলের এ রাষ্ট্রগুলো তাই কখনো স্বাধীন, কখনো চীনা প্রটেক্টরেট, এভাবে চলছিল। নবাগত প্রতিবেশী উমাইয়্যা খিলাফতকে এরা চীনের বিরুদ্ধে ব্যালান্সিং অ্যাক্টের জন্যে ব্যবহার করতে শুরু করে। এর ফলে ৭১৫তে একবার আর ৭১৭তে আরেকবার উমাইয়্যা সেনাদল তাংদের মিত্র তুর্কী জাত তুর্গেশদের মুখোমুখি হয়।

৭৪৭এ উমাইয়্যাদের পতন ঘটে আব্বাসী অভ্যুত্থানের মুখে। ক্ষমতার কেন্দ্র সিরিয়া থেকে পরিবর্তিত হয়ে আসে ইরাক-ইরানে। সাসানী সাম্রাজ্যেরই একরকম পুনরুত্থান ঘটে পারসিক প্রভাব বাড়ার সাথে। বাগদাদের আব্বাসী খলীফাদের দৃষ্টি হয় প্রাচ্যমুখী। আর নতুন ‘সাম্যবাদী’ খেলাফত প্রতিষ্ঠার সাথে বেশ একটা জিহাদী জোশও চলে আসে আরব-অনারব দু’জাতের মুসলিমদের মধ্যে।

আব্বাসী খেলাফতের মানচিত্র

৭৫১তে মধ্য এশিয়ার দুই রাজ্য ফারগানা আর শাশ (তাশখন্দ) একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। শাশের বিরুদ্ধে তাং সাম্রাজ্যের সাহায্য প্রার্থনা করে ফারগানা। কোরিয়ান তাং জেনারেল গাও শাশে আক্রমণ চালিয়ে সেখানকার অধিকর্তাকে হত্যা করেন। শাশের রাজপুত্র পালিয়ে গিয়ে আব্বাসী বিপ্লবের অন্যতম নেতা মারি-সমরখন্দের গভর্নর আবু মুসলিমের দরবারে গিয়ে হাজির হন। এভাবে আব্বাসীদের সাথে তাং সাম্রাজ্যের সংঘাতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।

আব্বাসী খেলাফতের সাথে মিত্রতার চুক্তিতে আবদ্ধ হয় বৌদ্ধ তিব্বত সাম্রাজ্য। অমুসলিম তুর্কী যাযাবর তুর্গেশরাও সাহায্যের হাত বাড়ায়। সব মিলিয়ে প্রায় লাখখানেক সৈন্য নিয়ে বর্তমান কাজাকস্তানের তালাস নদীর উপত্যকায় সমবেত হয় আব্বাসী সেনাদল। চীনাদের সেনাশক্তিও কম ছিল না। অবশ্য এ সব সংখ্যার অনেক কমবেশি হতে পারে।

তিব্বতী সাম্রাজ্য, ৭৯০ খ্রিষ্টাব্দ
বর্তমান কাজাখস্তানে অবস্থিত তালাস নদী

তিনদিনব্যাপী ভীষণ যুদ্ধ হয় দুই দলের মধ্যে। যুদ্ধের শেষভাগে তাংদের মিত্র কারলুক তুর্কী যাযাবররা দলত্যাগ করে শত্রুদের সাথে যোগ দেয়। তাতে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় চীনা সেনাশক্তি। সেনাপতি গাও পশ্চিম থেকে জান নিয়ে পালিয়ে ফেরেন মূল তাং ভূমিতে। প্রতিশোধ নেবার জন্যে নতুন সেনাদল গড়ে তুলতে না তুলতেই ৭৫৫তে খোঁজ আসে যে বেজিংয়ের দিকে এক বিশাল বিদ্রোহীদল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে তাং সেনাপতি আন লুশান। নিজেকে তিনি ইয়ান নামে নতুন এক বংশের সম্রাট দাবি করে বসেছেন। আব্বাসীদের কথা ভুলে সেনাপতি গাওকে উল্টোদিকে রওনা দিতে হয় তাং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য।

আন লুশান বিদ্রোহে পরবর্তী আট বছর বিপর্যস্ত হয় সমগ্র উত্তর চীন। পশ্চিমে সাম্রাজ্যপ্রসারের স্বপ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখতে হয় তাংদের।

তালাসের যুদ্ধ, ৭৫১ খ্রিষ্টাব্দ

অপরদিকে আবু মুসলিমের জিহাদী জোশেও ব্রেক কষে দেন নতুন আব্বাসী খলীফা আল-মনসুর। আবু মুসলিমের জনপ্রিয়তা আর বিশেষত শিয়া মতাদর্শীদের অন্ধ সমর্থনের কারণে শত্রুতা বেড়ে চলে খলীফার সাথে। ষড়যন্ত্র করে ‘জিন্দিক’ বা ধর্মপরিত্যাগকারী সাব্যস্ত করে আবু মুসলিমকে হত্যা করেন আল-মনসুর। এরপর আব্বাসীরাও মধ্য এশিয়ায় নতুন সামরিক অভিযান পাঠানো বন্ধ করে দেয়।

অর্থাৎ দুই সাম্রাজ্যই মোটামুটি একটা স্থিতিশীলতায় আসে। শ’দুয়েক বছর ধরে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের একটা সীমানা দাঁড়া হয়ে যায় এ অঞ্চলে। এ সীমানা অবশ্য দ্বাদশ শতাব্দীতে পদদলিত করে চেঙ্গিস খান আর তার মোঙ্গোল হোর্ড।

তালাসের যুদ্ধ নিয়ে আজকালকার মানুষ খুব বেশি কিছু জানে না। চীনারা এর কিছু বিবরণ লিখে গেছে। তাতে নিজেদের পরাজয়ের সাফাই গেয়েছে। আর আরব ইতিহাসবিদরাও দুয়েক জায়গায় এর উল্লেখ করেছেন, কিন্তু খুব বেশি গুরুত্ব দেননি।

কিন্তু এ যুদ্ধের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এরপর মধ্য এশিয়ার পশ্চিমভাগ সুনির্দিষ্টভাবে মুসলিম সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আসে, যদিও এরা ইসলাম ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে গ্রহণ করে আরো শ’খানেক বছর পর। চীনা বাণিজ্য যায় কমে।

মধ্য এশিয়া হয়ে ভারত থেকে চীনে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মের যে সাপ্লাই লাইন সেটা কেটে যায়। অবশ্য এসময় ভারতে নতুন করে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বাড়ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের জন্যে চীনা-জাপানী-কোরিয়ানদের তাই খুঁজে নিতে হয় স্বকীয়তা। এর ফলে শুরু হয় শাওলিন, চান, জেন, প্রভৃতি স্থানীয় জাতের বৌদ্ধধর্ম। তাদের শিল্পসংস্কৃতিও ভারতীয় প্রভাব থেকে স্বাধীন হতে থাকে।

চীনা ‘চান’ বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম নিদর্শন ‘হাস্যরত বুদ্ধ’। আসলে ইনি লোককাহিনীতে বর্ণিত এক চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু। ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্মে এরকম কিছু নেই। অর্থাৎ চীনা বৌদ্ধ ধর্ম হয়ে গেছে স্বতন্ত্র।

এ হল তালাস যুদ্ধের কালচারাল ইমপ্যাক্ট। এর থেকেও বড় যে ইমপ্যাক্ট তা টেকনোলজিকাল। সেটা হলো কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। নবম শতকের আগে শুধুমাত্র চীনারা জানত কিভাবে তুঁত গাছের বাকল থেকে মালবেরি পেপার প্রস্তুত করা যায়। এ ছিল তাংদের রাষ্ট্রীয় টপ সিক্রেট জ্ঞান। সিল্ক রোডের কোন বণিকের সাধ্য ছিল না কাগজ তৈরির কারখানায় ঢোকার। চীনের বাইরে বাকি বিশ্বের লেখাপড়া চলত ভাঙা মাটির পাত্রের টুকরায় (শার্ড) আঁকিবুঁকি করে, নয়ত পশুর চামড়ার পার্চমেন্টে লিখে। এসবই ছিল খুব কঠিন প্রক্রিয়া।

চীনের ফাং মাতানে আবিষ্কৃত প্রাচীনতম কাগজের নিদর্শন, আনুমানিক দ্বিতীয় খৃষ্টপূর্বাব্দ।

তালাস যুদ্ধে আব্বাসীরা হাজার কয়েক তাং সৈন্য ও প্রযুক্তিবিদদের যুদ্ধবন্দী করে। এদের মধ্যে ছিল কাগজওয়ালারাও। প্রথমে সমরখন্দে এদের নিয়ে যাওয়া হয়। কাগজ বানানোর কৌশল তাদের কাছ থেকে শিখে নেয় স্থানীয় শিল্পীরা। এর বছর পঞ্চাশেক পরেই বাগদাদে কাগজ তৈরির কারখানার উল্লেখ পাওয়া যায়।

কাগজের প্রযুক্তিলাভের ফলে আব্বাসী খেলাফতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিস্তারে বিশাল একটা বিপ্লব আসে। শুধু কুরআন-হাদীস নয়, দর্শন-বিজ্ঞানেরও চর্চা সহজলভ্য করে দেয় কাগজ। এ জোয়ারে সওয়ার হয়ে আসে নবম-দশম শতকের ইসলামী স্বর্ণযুগ। কাগজে যেভাবে কালিকলমে লেখার প্রক্রিয়া, ক্যালিগ্রাফি একমাত্র সে মিডিয়ামেই সম্ভব। চীনাদের ক্যালিগ্রাফি সর্বজনবিদিত। সম্ভবত একইভাবে আরবী ক্যালিগ্রাফিরও যাত্রা শুরু হয়। মধ্যপ্রাচ্য আর পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরিগুলিও প্রতিষ্ঠিত হয় আব্বাসী খেলাফতে।

১১৮০তে পূর্ব ইরানে কাগজে তৈরি কুরআনের ক্যালিগ্রাফিক ফোলিও (নিউ ইয়র্কের মেট মিউজিয়াম)
ডানে একাদশ শতকের চীনা সং রাজবংশের সময়কালীন কাগজে আঁকা ক্যালিগ্রাফি (তাইওয়ানের ন্যাশনাল প্যালেস মিউজিয়াম)

একাদশ-দ্বাদশ শতকের মধ্যে কাগজ পৌঁছে যায় স্পেনের উমায়্যা খেলাফতে। সেখানে পড়তে আসা ইউরোপীয়রাও পায় কাগজ তৈরির প্রযুক্তি। তারপর পঞ্চদশ শতকে গুটেনবের্গ, বাঁধানো বই, রেনেসাঁস, এজ অফ রিজন, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভল্যুশন ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ‘পেপার ট্রেইল’ ধরে সামনে হাঁটলে আমরা এরকম বৈপ্লবিক অনেক কিছুই পাই। আজকে কাগজ নষ্ট করতে আমাদের বাঁধে না। অথচ ছোটবেলায় শিখেছি কাগজ অমূল্য একটা জিনিস। আসলেই তাই! প্রমিথিউসের আগুন চুরির মত কাগজের রহস্যটাকেও ভেদ করে কেড়ে নিয়ে আসতে হয়েছিল বাকি বিশ্বের জন্যে। যদি না এরকমটা হত, তালাসের যুদ্ধ না হত, আর যুদ্ধে আব্বাসীরা না জিতত, তাহলে হয়ত কাগজের জন্যে ইউরোপকে অপেক্ষা করে বসে থাকতে হত আরো একশ’ বছর। সেই অল্টারনেট হিস্টরি কল্পনার কাজটা আপনাদের হাতে সমর্পণ করে আজকের মত শেষ করলাম।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার

Featured Video Play Icon

নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে কেবল টিভি যখন আসা শুরু করল, তখন আমার পছন্দের একটা চ্যানেল ছিল এমটিভি। সেসময়ের এমটিভি পরের ইন্ডিয়ান এমটিভির থেকে অনেক বেশি মেইনস্ট্রীম ছিল। মার্কিন-ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ান চার্টের সুপারহীট ভিডিওগুলি চলত তাতে।

সেসময়ে একটা জার্মান গ্রুপের ইলেক্ট্রনিক রিমিক্স বেশ মনে ধরেছিল। গ্রুপটার নাম এনিগমা। এদের ঝ়নর’টাকে নিউ এইজও বলা যায়। ইলেক্ট্রনিক ইন্স্ট্রুমেন্টাল আপবীট মিউজ়িক ভালই লাগত। যেটা পরে বুঝেছি সেটা হলো, এনিগমা আসলে বিভিন্ন স্বল্পপরিচিত শিল্পী আর এথ়নিক মিউজ়িক ইত্যাদি থেকে স্যাম্পল করে ট্র্যাক দাঁড়া করাতো। সেসবের মধ্যে ক্যাথলিক মাসগীতি আছে, সংস্কৃতমন্ত্র আছে, আছে জাপানী শাকুহাচি নামক বিশেষ বাঁশির সিনথেসাইজড সুর।

আর আইজ় অফ় ট্রুথ শীর্ষক এই গানটিতে ব্যবহৃত হয়েছে মোঙ্গোলিয়ার প্রখ্যাত লংসং বা দীর্ঘগীতি, মোঙ্গোলিয়ান ভাষায় উরতিয়িন দু। এখানে আলসিন গাজ়রিন জ়েরেগলেয়ে বলে গানটি গেয়েছেন আদিলবিশ নেরগুই। লংসংয়ের আরেক নামদার শিল্পী নামজিলিন নোরোভ়বানজ়াদ নব্বইয়ের দিকে বাংলাদেশে এসেছিলেন। আমার আবছা আবছা মনে পড়ে, হয়ত বিটিভিতে বাংলা দেশাত্মবোধক গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন। অন্তত তাঁর জবরজং মোঙ্গোল পোশাকআশাকের চিত্র মনে আছে। নোরোভ়বানজ়াদ ছিলেন দেশবিদেশে মোঙ্গোল সংস্কৃতিকে সুপরিচিত করার অগ্রদূত।

লংসংএর এরকম নাম হবার কারণ গানের শব্দগুলোকে অনেক টেনে টেনে উচ্চারণ করা হয়। কিছু গান আছে যেগুলি এভাবে তিন ঘন্টা পর্যন্ত চলতে পারে! বিভিন্ন তাৎপর্যপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠান যেমন বিয়ে, শেষকৃত্য ইত্যাদিতে এগুলি গাওয়া হত। সেগুলির কয়েকটা আবার নব্বইপূর্ববর্তী কম্যুনিস্ট সরকারের সুদৃষ্টির অভাবে কালের আবর্তে হারিয়ে গেছে। দুই হাজার বছরের পুরনো এই সঙ্গীতকলা এখন ইউনেস্কো ঐতিহ্য হিসাবে স্বীকৃত।

মোঙ্গোলদেরকে তাদের ‘সভ্য’ প্রতিবেশী রুশ-চীনারা বর্বর আখ্যায়িত করত। মধ্যযুগে চেঙ্গিস খান আর তাঁর বংশধররা যে পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে আব্বাসী খিলাফ়তসহ তৎকালীন সভ্য জগতের অন্যান্য সাম্রাজ্যের যবনিকাপাত করেছিলেন, তার কারণে অনেক ইতিহাসেই মোঙ্গোলদের স্থান হয়েছে যুদ্ধকামী-রক্তপিয়াসু হিসাবে। কিন্তু ইতিহাসে তাদের গুরুত্ব বুঝতে দৃষ্টিকোণের খুব বেশি পরিবর্তন দরকার হয় না। সেকথায় আসছি, একটু পরে।

দ্বাদশ শতাব্দীতে তেমুজিন — পরবর্তী নাম চেঙ্গিস — মোঙ্গোলদেরকে একতাবদ্ধ করে সাম্রাজ্য গড়ে তোলা শুরু করেন। কিন্তু তার দেড় হাজার বছর আগ থেকেই তাঁর পূর্বপুরুষরা ছিল চীনাদের গাত্রদাহ। খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মোঙ্গোলদের পূর্বসূরী শিকারী-মেষচারণকারী একটি জাত পরিচিত ছিল শ়িয়োংনু নামে — ধারণা করা হয় এরাই আসলে হুনদের আদিবংশ। প্রাচীন যুদ্ধকৌশলের দু’টি আবিষ্কার জোড়াধনুক বা কম্পোজ়িট বো, আর অশ্বারোহী তীরন্দাজ — এ দুটোরই শুরু শ়িয়োংনুর আবাসভূমিতে। তুর্কীদের বাস ছিল এদের পশ্চিমে। প্রতি বছর শ়িয়োংনু ঘোড়সওয়ারের দল বিরান স্তেপের মাঝ থেকে উদয় হতো চীনের কৃষিপ্রধান বসতিগুলিতে লুঠতরাজ চালাতে। শ়িয়োংনু সংস্কৃতিতেও লংসংয়ের স্থান চীনা ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে।

এসব বর্বরদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে চীনের বিভিন্ন রাজ্যের রাজা তাদের উত্তর সীমান্তে দেয়াল তুলে দেন। পরবর্তীতে চীনের প্রথম সম্রাট শিহুয়াংদি এসবের বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে, মেরামত করে বিশাল যে দেয়ালটি দাঁড়া করান, তা-ই আজ গ্রেট ওয়াল। শিহুয়াংদি আর তাঁর উত্তরসূরীরা তিন-চারশ’ বছরের জন্যে শ়িয়োংনু-শ়িয়ানবেই দুই গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে চীনের ধনসম্পদ থেকে তাদের দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত করতে সমর্থ হন।

শ়িয়োংনুদের পশ্চিমা অভিযানের ফলে ইউয়েঝ়ি বলে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী একটি জাতি আবাসচ্যুত হয়। তারা শেষ পর্যন্ত মধ্য এশিয়া আর পশ্চিম ভারতবর্ষে এসে নতুন এক রাজ্য গড়ে। ইতিহাসে এ রাজ্য কুশান নামে পরিচিত, আর তাদের প্রখ্যাত রাজার নাম কনিষ্ক। মহান কনিষ্কের পৃষ্ঠপোষকতাতেই ভারত থেকে বৌদ্ধধর্ম সিল্ক রোড ধরে মধ্য এশিয়া হয়ে চীনে প্রবেশ করে।

গ্রেট ওয়াল বানিয়ে অবশ্য চীনারা পরিত্রাণ পায়নি। এত দীর্ঘ একটা দেয়ালের সংস্কার দরকার হয়, যথেষ্ট প্রহরী-‌অস্ত্রশস্ত্র লাগে, থাকা চাই লৌহদ্বার। শ়িয়োংনুদের ফিরে আসতে খুব বেশিদিন লাগেনি। দেয়ালে দুর্বলতা খুঁজে বের করে তারা আবার ঢুকে পড়ে চীনের অভ্যন্তরে। এখনকার চীনের ‘স্বায়ত্ত্বশাসিত’ ইনার মোঙ্গোলিয়া, শ়িনজিয়াং, মাঞ্চুরিয়া এসব এলাকায় তারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। কিন্তু চীনা সভ্যতার শিক্ষাদীক্ষা সংস্কৃতি দেখে তাদের রাজরাজড়ারা যখন আকৃষ্ট হল, তখন তারা চীনাদের নাম-ভাষা-আচার অনুকরণ করে চীনা বনা শুরু করল। দেয়াল দিয়ে ঠেকিয়ে নয়, চীনারা প্রকারান্তরে জয়লাভ করলো তাদের সমৃদ্ধ শিক্ষাসংস্কৃতির গুণে! (বর্তমান যুগের জন্যে ইতিহাসের শিক্ষা!)

শ়িয়োংনুদের তুতো ভাই যারা রয়ে গেছিল গোবি-তাকলামাকান মরুভূমির আশপাশে, কিংবা তিয়ানশান পর্বতের পাদদেশে, তাঁরাই ধীরে ধীরে পরিচয় পেল মোঙ্গোলদের বিভিন্ন গোত্র হিসাবে। তাদের মধ্যে একতা ছিল না, ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ লেগে থাকতো সবসময়। দ্বাদশ শতকে তেমুজিন নামে এক গোত্রপ্রধান তোগরুল নামে আরেক গোত্রাধিপতির সহায়তায় যুদ্ধজয় আর আত্মীয়তাবন্ধনের মাধ্যমে একে একে সকল মোঙ্গোল গোত্রকে একতাবদ্ধ করেন। পরে তোগরুলকে হঠিয়ে দিয়ে তেমুজিন আসীন হন চেঙ্গিস নামের খ়াগান — খানদের খান বা শাহেনশাহ — হিসাবে।

মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র খ়ারখ়োরুম থেকে চেঙ্গিস অভিযান চালান চীন, মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া, জাপান, ভারত, পারস্য, ইউক্রেন, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও সেসব এলাকা থেকে উৎকোচ আদায় করে ক্ষান্ত দিত তাঁর সেনাদল। তাদের মূল লক্ষ্য রাজ্যশাসন নয়, ছিল নিজেদের বীরত্বগাঁথাকে সমৃদ্ধ করার প্রয়াস। পরের খ়াগানরা চেষ্টা করেন তাঁদের পূর্বসূরীদের সফলতাকে অতিক্রম করতে।

এভাবে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি মেংকু খানের শাসনামলে মোঙ্গোল সাম্রাজ্য পরিণত হয় বিশ্বের সর্বকালের সর্ববৃহৎ একক রাষ্ট্রে। তার মধ্যে পড়ে বর্তমানযুগের গোটা তিরিশেক দেশের অংশবিশেষ — চীন, বার্মা, থাইল্যান্ড, লাওস, ভিয়েতনাম, কোরিয়া, কাজ়াকস্তান, কিরগিজ়স্তান, উজ়বেকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক, প্যালেস্টাইন, সিরিয়া, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, রাশিয়া, পোল্যান্ড, ইউক্রেন, বেলারুশ, মলদোভা, আর রোমানিয়া।

মেংকুর পরে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যকে চেঙ্গিসের চার নাতির মধ্যে ভাগ করে দেয়া হয়। এঁদের একজন কিন্তু মোঙ্গোল ইতিহাসে সবচে’ বিখ্যাত খ়াগান — হুবিলাই খান, যাকে আমরা চিনি কুবলাই নামে। তিনি সং রাজবংশকে পরাজিত করে চীনের সবচে’ সম্পদশালী অংশকে মোঙ্গোল নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন চীনের ইউয়েন রাজবংশ, আর গোড়াপত্তন করেন খানবালিগ বলে নতুন এক রাজধানীর, যেটা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় বেইজিং। মার্কো পোলো তাঁর সিল্ক রোড যাত্রার বিবরণে লিখে রেখে গেছেন কুবলাইয়ের মাহাত্ম্যের কথা।

কুবলাইয়ের নেতৃত্বেই মোঙ্গোলরা সভ্যতার ইতিহাসের বুকে দৃপ্ত পদচিহ্ন রাখা শুরু করে। তারা অত্যাচারী লুটেরা নয়, বিবর্তিত হয় সুকৌশলী ও দক্ষ প্রশাসক হিসাবে। তারা শাসনকার্যের অন্যান্য বিষয়ে দক্ষ জাতিগোত্রকেও সুযোগ দেয়, তাদের মধ্যে সর্বাগ্রে ছিল সেনা হিসাবে তুর্কীরা আর শিক্ষিত কেরানী হিসাবে পারসিকরা। এদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদও অলংকৃত করে। চীনা ব্যুরোক্র্যাসি আর নিয়মানুবর্তিতার প্রভাবও পড়া শুরু করে রাজকার্যে। দাসপ্রথার প্রচলন থাকলেও তা ছিল সীমিত আকারে, কঠোর কায়িক পরিশ্রমের জন্যে নয়।

আর ইউরোপ থেকে পূর্ব এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত সিল্ক রোডের সকল রাজত্বকে প্রথমবারের মত একতাবদ্ধ করাতে বাণিজ্যের যতরকম বাঁধা আর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সব দূর হয়ে যায়। মোঙ্গোলরা সে পথের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করাতে স্থিতিশীলতা বাড়ে, চুরিডাকাতির ভয় কমে যায়। এর সুফল ভোগ করে সিল্ক রোডের সাথে সংযুক্ত সকল জনপদ। আর তার কর আদায় করে এক সময়কার মেষপালক মোঙ্গোলরাও আরামদায়ক জীবনযাপন করে। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রোমানরা দেড় হাজার বছর আগে ঠিক এ কাজটিই করেছিল, তাদের সুশাসন পরিচিত ছিল প্যাক্স রোমানা বা রোমপ্রদত্ত শান্তি হিসাবে।

জাতিগত সহনশীলতার পাশাপাশি ধর্মীয় পরমতসহিষ্ণুতার জন্যেও মোঙ্গোলরা সুপরিচিত ছিল। কুবলাইয়ের দরবারে ট্র্যাডিশনাল মোঙ্গোল শামানিজ়মের আচার সরকারীভাবে প্রচলিত থাকলেও বৌদ্ধধর্ম, ইসলাম, খ্রীষ্টধর্ম, কনফুশিয়ানিজ়ম আর দাওইজ়মের প্রতিনিধিত্ব সেখানে ছিল। ধর্মীয় ব্যাপারে কোন জোরাজুরি বা পক্ষপাতিত্ব ছিল না। এমনকি প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস অনুযায়ী আকাশদেবতা তেংরির উপাসনাকারী মোঙ্গোলরাও যখন ইসলামে আকৃষ্ট হয়েছে, তখন তারা মুসলিম হয়েছে। কোথাও গিয়ে হয়েছে বৌদ্ধ। নেস্টরিয়ান বলে অধুনালুপ্ত এক খ্রীষ্টান তরিকাও অনুসরণ করেছে।

আবার পারস্যে গিয়ে ইরানী সভ্যতা অনুসরণ করে অনেকে ইরানী হয়ে গিয়েছে, চীনে সেরকম চীনা জাতিতে মিলে গেছে, তুর্কী ভাষা গ্রহণ করে কোথাও তুর্কী রাজ্যের মালিক হয়েছে, সেরকম ভারতে আসতে আসতে তারা হয়ে গেছে ফারসীভাষী মোগল। উর্দু আর উর্দি শব্দ দুটোর উৎপত্তিও তুর্কী-মোঙ্গোল ওর্দা থেকে, যা হলো মোঙ্গোলদের ভ্রাম্যমান পরিবারকেন্দ্রিক দলবহর। ওর্দা থেকে তিন গোয়েন্দার খেপা শয়তান বইয়ে উল্লেখিত বাটু খানের গোল্ডেন হোর্ডও। যাহোক, প্রজাদের ভাষাসংস্কৃতি আত্তীকরণের মাধ্যমে মোঙ্গোলরা বিভিন্ন দেশে নিজেদের শাসনকে রাজনৈতিক বৈধতা দেয়। এরা ছিল সত্যিকারের কসমোপলিটান একটা জাত!

সোজা কথায় প্রাচীন পৃথিবীর কম্পার্টমেন্টালাইজ়ড সনাতন ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে ভেঙেচুরে মোঙ্গোলরা একটা তুলনামূলক সাম্যবাদী গতিশীলতা আনতে সক্ষম হয়। তার ফলে চিন্তাধারা, রাজ্যশাসনব্যবস্থা ইত্যাদির একটা বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়। মার্কিনীতে বললে, দ্য লিটল গাইজ় গট আ ব্রেক! ইসলামে সুফী চিন্তাধারাও এসময়ে তুর্কী-মোঙ্গোল পৃষ্ঠপোষকতায় হালে পানি পাওয়া শুরু করে। যেটা সুফীদের দরকার ছিল সেটা হলো আব্বাসী খিলাফ়তের কেন্দ্রীভূত সনাতনী ধর্মীয় প্রভাবের অপসারণ — মোঙ্গোলরা ঠিক সেটাই করেছিল।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে মোঙ্গোলদের উত্তরসূরীরা যখন সারা বিশ্বে রাজত্বপত্তন করে বেড়াচ্ছে, তখন কিন্তু খাস মোঙ্গোলিয়ার অবস্থা খারাপ হওয়া শুরু করেছে। মোঙ্গোল রাজপুত্ররা নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে, আর চীনারা তাতে ইন্ধন জোগায়। শেষ পর্যন্ত ইউয়েন রাজবংশকে হঠিয়ে চীনা মিঙ রাজবংশ হান জাতিগোষ্ঠীর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তার শত বছরের মধ্যে চীনের অন্যান্য প্রদেশে থেকে মোঙ্গোলবিতাড়ন অভিযান সম্পূর্ণ হয়।

ঊনবিংশ-বিংশ শতকের মধ্যে মোঙ্গোলিয়া চীন ও রুশ সাম্রাজ্যের কাছে বিপুল এলাকা হারিয়ে বর্তমানকালের দেশটিতে পরিণত হয়। আর চীন-রাশিয়া মোঙ্গোলিয়াকে ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে বাফার রাষ্ট্র হিসাবে। এখনো চীনের ইনার মোঙ্গোলিয়া অটোনমাস রীজনে ষাট লাখ মোঙ্গোল বসবাস করে, সংখ্যায় তারা খাস মোঙ্গোলিয়ার দ্বিগুণ। স্নায়ু্যুদ্ধের সময় রাশিয়ার কম্যুনিস্ট আবর্তেই ছিল মোঙ্গোলিয়া।

মোঙ্গোলদের অনেক শব্দ তুর্কী-ফারসী হয়ে আমাদের ভাষাতেও এসেছে, যেমন মোঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলা’আন বা’আতারের বাংলা আক্ষরিক নাম হতে পারে ‘লাল বাহাদুর’ — বাহাদুর আর বা’আতার একই শব্দ! খান-খানম তো এখন মুসলিম বংশনাম হিসাবেই প্রচলিত হয়ে গেছে, অথচ আদতে এটা প্রকৃত ইসলামী নাম নয়। উর্দু-উর্দির কথা আগেই বলেছি।

ভিডিওটিতে মোঙ্গোলিয়ার অশ্বারোহী ‘কাউবয়’ গোচারণকারীদের দেখা যাচ্ছে সেদেশের নয়নাভিরাম নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে। মোঙ্গোলিয়ার অনেক মানুষ এখনো যাযাবর, গের বলে ভ্রাম্যমান ঘর নিয়ে এক চারণভূমি থেকে আরেকে যায়। ঘোড়ার সংখ্যা মোঙ্গোলিয়াতে মানুষের থেকেও বেশি। ঘোড়ার একটা সম্মানজনক স্থান আছে তাদের ইতিহাস আর ধর্মপুরাণে। ঘোড়ার দুধ থেকে তৈরি আইরাগ নামে পানীয় পান করে মোঙ্গোলরা, মধ্য এশিয়ার তুর্কী জনপদে আর রাশিয়াতে এটা পরিচিত কুমিস নামে।

লংসংয়ের পাশাপাশি আরো নানারকম সঙ্গীতের চর্চা করে মোঙ্গোলরা। তার মধ্যে থ্রোট সিঙিং বা খুমি ব্যাপারটা আমার কাছে খুব চমকপ্রদ লাগে। গলার গভীরে শব্দের অনুরণনে দুই কিংবা ততোধিক টোন বের করে নিয়ে আসতে পারে খুমি গায়করা। কিন্তু অধিকাংশ শ্রোতা মনে হয় না সেই অপার্থিব শব্দ আমার মত সইতে পারবেন! কৌতূহলী হলে ইউটিউবকে Batzorig Vaanchig, Khusugtun অথবা Huun Huur Tu শুধিয়ে দেখুন। আর আলসিন গাজ়রিন গানটিতে এক মা কল্পনা করছেন কোন এক সুদূর সুন্দর দেশের কথা, যেখানে তাঁর অশ্বারোহী সোনামানিক গেছে গরু চরাতে। যতদিন না ফিরবে সে, বুক আশায় বেঁধে পুত্রধনের অপেক্ষায় থাকবেন মোঙ্গোল জননী, ফিরলে পরে বইবে খুশির বন্যা!

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!