হাইতি – ২, রাষ্ট্রনির্মাণ, ১৮১০-১৮৬০

হাইতির স্বাধীনতার ঘোষণায় দেসালিন প্রজাদের জন্যে একরকম সাবধানবাণী লিখে রেখে গিয়েছিলেন। যেদিন নেতাদের আদেশ পালনের দায়িত্ব হাইতির জনগণ বিস্মৃত হবে, সেদিন আবার ভিনদেশের পরাধীনতার শৃংখল পরবে তারা। একরকম প্রচ্ছন্ন হুমকি আর কি!

হাইতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মত জনপ্রতিনিধি-সম্মেলন ডেকে সংবিধানপ্রনয়ণ না হয়ে দেসালিনের অঙ্গুলিহেলনেই সব কিছু চলতে থাকল। লুভেরত্যুরের আমলেও ফ্রান্সের প্রজাতান্ত্রিক সম্মেলনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পাঠিয়েছিল হাইতি। সেসবের ধার না ধেরে সহসা সম্রাট বনে বসেন দেসালিন। এ যেন প্রতিপক্ষ ফরাসী সম্রাট নাপোলেওঁকে কাঁচকলা দেখানো!

নাপোলেওনের সময়েও ফরাসীর পাশাপাশি স্থানীয় ক্রেওল ভাষায় সরকারী ঘোষণা প্রকাশ করা হত। দেসালিন জনসাধারণের বোধগম্য এই ভাষাটাও পরিত্যাগ করেন। ভাবটা এমন যে, হাইতির অধিকাংশ মানুষ গ্রাম্য মূর্খ, তাদের এত দাম দিয়ে কোন ফায়দা নাই! ফরাসীভাষী শহুরে এলিট আর প্রাদেশিক সামরিক শাসকদের কথামতই দেশ চলবে।

হাইতির প্রথম রাষ্ট্রপতি ও সম্রাট দেসালিন (জীবৎকাল: ১৭৫৮-১৮০৬, শাসনকাল: ১৮০৪-০৬)। ফরাসী ছিন্নমস্তক হাতে। তাঁর আমলে হাইতির অবশিষ্ট ফরাসী শ্বেতাঙ্গদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চলে। ১৮০৪ সালের এনগ্রেভিং।
দেসালিনের স্বাধীনতার ঘোষণার পোস্টার, ১৮০৪। হাইলাইটেড অংশের অনুবাদ: “If you ever refused or grumbled while receiving those laws that the spirit guarding your fate dictates to me for your own good, you would deserve the fate of an ungrateful people.”
সম্রাট দেসালিনের রাজ্যাভিষেক, ১৮০৪।
দেসালিনের সম্রাট হবার প্রেরণা ফরাসী সম্রাট নাপোলেওনের থেকে এসে থাকতে পারে। তিনি ১৮০৪ সালে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা করেন।

স্বেচ্ছাচারী শাসন করতে গিয়ে অবশ্য শীঘ্রই জনরোষের শিকার হন সম্রাট দেসালিন। প্রথমত, ভূমিদাসভিত্তিক খামার ব্যবস্থার কোন সংস্কার তিনি করেননি। দ্বিতীয়ত, দোআঁশলা মুলাটো শিক্ষিতশ্রেণীর সাথে তাঁর বেশি দহরমমহরম হাইতির মানুষ ভাল দৃষ্টিতে দেখেনি। তৃতীয়ত, প্রাদেশিক সেনাপ্রধানদের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন তিনি।

১৮০৬ সালে তাঁরই দুই সহযোদ্ধা আলেকসন্দ্র পেতিওঁ আর অঁরি ক্রিস্তোফ আঁতাত করে অনুগত সেনাদল নিয়ে রাজধানী পোর্তোপ্র্যাঁসে প্রবেশ করেন। বিদ্রোহী জনগণ রাষ্ট্রীয় প্রাসাদ থেকে সম্রাটকে রাস্তায় টেনে বের করে গুলি করে হত্যা করে। শুধু তাতেই তারা ক্ষান্ত হয়নি, দেসালিনের মৃতদেহকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তারা।

রাষ্ট্রের স্থপতির এমন পরিণতি হাইতির ভবিষ্যতের জন্যে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। দেসালিনের প্রাক্তন দোসররা তাঁর সৎকারের বালাই না করে ডাকলেন জনপ্রতিনিধির সম্মেলন। যুক্তরাষ্ট্রের আদলে দ্বিকক্ষ সংসদ আর ত্রিমুখী ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রস্তাব করা হল। সেনেটের হাতে বেশি ক্ষমতা চলে যাবার ব্যাপারটা আবার ক্রিস্তফের পছন্দ হলো না। ছোটখাট একটা গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেল পেতিওঁ-ক্রিস্তফের মধ্যে, কিন্তু কেউ কাউকে হারাতে পারলেন না।

দেসালিনের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মৃতদেহ কবরস্থ করার আর কেউ ছিল না, কেবল এক পাগলিনী দেফিলে সহমর্মী হয়ে সে দায়িত্বপালন করে, ১৮০৬।

ক্রিস্তফ তার দলবল নিয়ে হাইতির উত্তরাংশে গিয়ে নিজেকে রাজা দাবি করে বসলেন। বনেদী পদবীগুলি দেয়া শুরু করলেন কাছের মানুষদের। প্রজাদের শিক্ষাদীক্ষায় অবশ্য তার মনোযোগ ছিল। রাজধানী ল্যকাপে একটা মেডিকাল স্কুলও চালু করেন তিনি।

প্রাক্তন গৃহপালিত চাকর, আর এখন রাজা, ক্রিস্তফ বিশাল সঁসুসি প্রাসাদ তৈরি করেন। আরো তৈরি হয় সিতাদ্যাল লাফেরিয়ের বলে এক দুর্ভেদ্য দুর্গ। ইউরোপীয় পর্যবেক্ষকরা লিখে যান, শেকলপরা কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’ কঠোর পরিশ্রম করে নাকি এগুলি তৈরি করেছে। হাজারে হাজারে নাকি মারাও গেছে সে কাজে। ‘দাস’ কথাটা সম্ভবত সত্য নয়, কিন্তু ‘কোর্ভে লেবার’ বা সরকারের ‘উন্নয়নকাজে’ বাধ্যতামূলক শ্রমপ্রদানের ব্যাপারটা ক্রীতদাসপ্রথামুক্ত হাইতির সকল শাসকই সমানে ব্যবহার করেছেন। এ শ্রমিকরা বেতন পেত না, খুব একটা ভাল ব্যবহার তদারককারী সৈন্যদের কাছে পেতও না, বন্দুকের বাঁট কিংবা বেয়নেটের ব্যবহার চলত সমানে। আর লেবারক্যাম্পে বন্দীজীবন কাটাতে হত।

উত্তর হাইতির রাজা অঁরি ক্রিস্তফ (জীবৎকাল: ১৭৬৮-১৮২০, শাসনকাল: ১৮১১-২০)।
সিতাদ্যাল দ্যফেরিয়ের ক্রিস্তফের আদেশবলে তৈরি করে কৃষ্ণাঙ্গ ‘দাসের দল’, এটি এখনো একটি পর্যটন আকর্ষণ।
রাজা ক্রিস্তফের রাজ্যে প্রচলিত মুদ্রা, ১৮২০।

ওদিকে পেতিওঁ দ্বীপের দক্ষিণে গিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন হাইতি প্রজাতন্ত্র। সেখানে সেনেটের সাথে ভাগবাটোয়ারা করেই শাসন শুরু করলেন, কিন্তু কিছুদিনের মধ্যে শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে সেনেটরদের মনোনয়নের ব্যাপারটা নিজের এখতিয়ারে নিয়ে আসলেন। বিরুদ্ধমতের সেনেটরদের কূটচাল চেলে সরিয়ে দিলেন। তবে প্রজাতন্ত্রের সকল পুরুষকে ভোটাধিকার দেয়া হল।

কর ও ভূমিসংস্কারও দক্ষিণে কিছুটা হলো। প্রথমে খামারব্যবস্থা চালু থাকলেও জনগণের দাবির মুখে বড় জমি ভাগ করে বিলিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু পেতিওনের সৈন্যরাই এসব সুবিধার ভাগীদার হল। তাদের মালিকানার জমিতে ভাড়াটে হিসাবে চাষাবাদ করত গরিব ভূমিদাস চাষী।

পেতিওঁ দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন স্প্যানিশ কলোনির স্বাধীনতাকামী নেতাদেরকেও সাহায্য করতে শুরু করলেন। এভাবে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে সিমন বলিভারের সাথে। এতে অবশ্য হাইতির সাধারণ করদাতার টাকাপয়সাই খরচ হলো।

দক্ষিণ হাইতির প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি আলেকসন্দ্র পেতিওঁ (জীবৎকাল: ১৭৭০-১৮১৮, শাসনকাল: ১৮০৭-১৮১৮)।

উত্তর-দক্ষিণের দুই রাজ্যই অবশ্য ভূরাজনৈতিক অঙ্গনে সেসময়কার যুক্তরাষ্ট্রের মতই একরকম অচ্ছুৎ ছিল। ইউরোপীয়দের কাতারে যোগদানের জন্যে পেতিওঁ-ক্রিস্তফ দুজনই বেশ মুখিয়ে ছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গরা রাষ্ট্রপরিচালনায় কোন অংশে কম নয়, এটা দেখাতে অবশ্য পেতিওনের থেকে ক্রিস্তফ বেশি আগে বাড়া ছিলেন, তাই অর্থনীতির খাতিরে খামারব্যবস্থাকে আগের মত রেখে দেন।

দুই হাইতিতেই এসময় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা মুক্ত কালোদের অভিবাসন চলে। একই সময়ে পশ্চিম আফ্রিকার লাইবেরিয়ারও গোড়াপত্তন হয় — আগে লিখেছি এ নিয়ে। এভাবে হাইতিতে একটা মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল। তবে মার্কিন থেকে আসা কালো কৃষক ও কারিগরদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই হাইতিতে খাপ না খাওয়াতে পেরে ফিরে যায়। এর মূল কারণ ছিল ভূমিদাসপ্রথা আর পাসপোর্টছাড়া মুক্ত যাতায়াতের অভাব।

১৮২০ সালে উত্তরে রাজা ক্রিস্তফ অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর প্রজা আর দরবারের অভিজাত উভয়েরই সমর্থন এতদিনে মিইয়ে এসেছে। তাঁর অসুস্থতার সুযোগে অভ্যুত্থানের মুখে ক্রিস্তফ আত্মহত্যা করেন। কিছুদিনের মধ্যে দক্ষিণের প্রজাতন্ত্রের সৈন্যরা উত্তরের নেতৃত্বহীন সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দুই হাইতিকে আবার একত্রিত করে।

ততদিনে দক্ষিণে পেতিওনের মৃত্যু হয়েছে। আর সেখানে ক্ষমতাসীন তারই সহচর জেনারেল বোয়াইয়ের। শুধু উত্তর-দক্ষিণ হাইতি নয়, প্রতিবেশী ডমিনিকান রিপাবলিকের স্প্যানিশবিরোধী স্বাধীনতাসংগ্রামের সুযোগে সে দেশেও দখলদার সৈন্য পাঠিয়েছেন তিনি। এভাবে দুই দশকের জন্যে পুরো হিসপানিওলা দ্বীপটি একই রাষ্ট্রের দখলে আসে।

পেতিওনের উত্তরসূরী জেনারেল জঁপিয়ের বোয়াইয়ের (জীবৎকাল: ১৭৭৬-১৮৫০, শাসনকাল: ১৮১৮-৪৩)। একনায়কতন্ত্র চালান দেশে।

বোয়াইয়েরের শাসনামল ছিল প্রজাতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র। সংসদ ছিল কেবল রাষ্ট্রপতির আদেশাবলীতে সীল-ছাপ্পর মারার জন্যে। নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন তিনি। প্রদেশগুলির শাসনভার ছিল সেনাসামন্তদের হাতে। প্রতিবাদ-বিরুদ্ধাচারের কোন সুযোগই ছিল না, ধরপাকড় আর বিরোধীদের ফায়ারিং স্কয়াডে মৃত্যুদন্ডপ্রদান চলত নিয়মিত। শিক্ষাক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ে হাইতি। ক্রিস্তফের গড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যায়। সারা হাইতিতে এসময় ছিল মোটে দশটা পাবলিক স্কুল। আর প্রাইভেট স্কুলগুলিও জোর করে বন্ধ করে দেয়া হয়। বোয়াইয়েরের হিসাবে, শিক্ষা মানেই বিপ্লব আর ক্ষমতার গদি ধরে টানাটানি।

কিন্তু এভাবেই ১৮৪৩এ আরেকটা বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। শহুরে মধ্যবিত্ত গ্রাম্যসমাজ আর ডমিনিকান রিপাবলিকের স্বাধীনতাকামী গুপ্তসংস্থার সাথে যোগ দিয়ে বোয়াইয়েরকে তাঁড়াতে সক্ষম হয়। এই ডামাডোলের সুযোগে ডমিনিকান রিপাবলিক হাইতি থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ডমিনিকানরা হাইতিতে খুব একটা সুখে ছিল না। বিশেষত সেখানে প্রচুর শ্বেতাঙ্গের বসবাস ছিল, হাইতির রাষ্ট্রতন্ত্র অনুযায়ী তারা ছিল সম্পত্তির মালিকানা থেকে বঞ্চিত।

হাইতির নতুন উদারপন্থী সরকার আরেকটা সংবিধান রচনা করল। কিন্তু হাইতির প্রবাদেই রয়েছে, ‘শাসনতন্ত্র ছাঁপানো কাগজে, আর বেয়নেট তৈরি ইস্পাতে!’ সরকার যতই সংস্কারপন্থী হোক না কেন, ক্ষমতায় আসামাত্র গদি পাকাপোক্ত করতে তারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন সরকারের ওপর রক্ষণশীল সেনাবাহিনীর চাপ এক দিক থেকে, আরেকদিকে গ্রাম্য পপুলিস্ট মিলিশিয়াও দাঁড়িয়ে গেছে শহুরে এসট্যাবলিশমেন্টের প্রভাবের বিরুদ্ধে। এসকল বিদ্রোহ-বিপ্লবেই কেটে যায় কয়েক বছর।

শেষমেষ ১৮৪৭এ আপোষের ভিত্তিতে কৃষাঙ্গ বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিবিদ ফাউস্ত্যাঁ সুলুককে রাষ্ট্রপতি হিসাবে গ্রহণ করে নেয় বিবাদমান দলগুলি। তারা ভেবেছিল, নমনীয় কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট দোআঁশলা এলিটদের কথা যেমন শুনবেন, তেমন গ্রামাঞ্চলের কৃষ্ণাঙ্গ জনসাধারণও তুষ্ট হবে স্বগাত্রবর্ণের নেতা পেয়ে।

কিন্তু এদের সব পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দিলেন সুলুক — ১৮৪৯এ তিনি হয়ে বসলেন হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট! এবার বোধহয় তাঁর রাস্তা ধরেই ১৮৫১তে ফ্রান্সের সম্রাট বনলেন তৃতীয় নাপোলেওঁ। নাপোলেওঁকে নিয়ে সরাসরি হাস্যকৌতুক করতে বাঁধা থাকায় ফরাসী থিয়েটারে সম্রাট সুলুক তাঁর স্থানপূরণ করেন! সুলুকের দরবারের হাস্যকর সব পদবীর অভিজাত, যেমন ডিউক অফ লেমনেড আর ডিউক অফ মারমালেডের কথোপকথন শুনে ফরাসীরা নাপোলেওনকে স্মরণ করেই হেসে গড়িয়ে পড়ত।

হাইতির দ্বিতীয় সম্রাট ফাউস্ত্যাঁ সুলুক (জীবৎকাল: ১৭৮২-১৮৬৭, শাসনকাল: রাষ্ট্রপতি, ১৮৪৭-৪৯, সম্রাট, ১৮৪৯-৫৯)।
ফ্রান্সের সম্রাট তৃতীয় নাপোলেওঁ সুলুকের মতই প্রথমে ছিলেন রাষ্ট্রপতি (১৮৪৮-৫২), তারপর সম্রাট (১৮৫২-৭০)।

ক্রিস্তফ-পেতিওঁ-বোয়াইয়ের-সুলুক সবার আমলেই হাইতিতে অ্যাবলিশনিস্টদের যাতায়াত হয়েছে। এরা সকলেই হাইতির স্বাধীনতাপরবর্তী অবস্থা দেখে যারপরনাই বিব্রত হয়েছেন। দাসপ্রথা যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যে অবশ্যপ্রয়োজনীয় নয়, তা প্রমাণ করতে গিয়ে উল্টো চিত্র দেখেন তারা। ক্যারিবিয়ানের অন্যান্য দ্বীপের দাসদের থেকে হাইতির কৃষ্ণাঙ্গদের অর্থনৈতিক অবস্থা এমন কিছু ভাল হয়নি। পঞ্চাশ বছর আগে ফরাসীদের ছেড়ে যাওয়া চিনির খামার আগাছাভরা। মানুষজন গাত্রাচ্ছাদন ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের বাসস্থান কুঁড়েঘরে, ইত্যাদি। সামান্য মুক্তি পেয়ে তারা সুখী বটে কিন্তু নিজেদের বৈষয়িক উন্নতির কোন চিন্তা তাদের নেই।

তাদের এ পর্যবেক্ষণ অবশ্য সম্পূর্ণ নয়। হাইতির শুরুতে নগর ও গ্রামের বৈষম্যের বীজ রোপিত হয়েছিল। তার ফলে কৃষিখামারে উৎপন্ন শস্য রপ্তানি থেকে উপার্জিত রাজস্বে শহুরে ফরাসীভাষী মানুষ উন্নতি করেছে। আর ক্ষতি হয়েছে ক্রেওলভাষী কৃষ্ণাঙ্গ চাষাদের। বাণিজ্যে করারোপ করেই হাইতির রাষ্ট্রপরিচালনার সিংহভাগ খরচ উঠত, আর ১৮৮১ নাগাদ এই নির্ভরতা গিয়ে ঠেকে ৯৮ শতাংশে। অর্থাৎ শহুরে বণিকগোষ্ঠীর সমৃদ্ধি যুগিয়েছে খামারের ভূমিদাস কৃষক। এদের উপার্জন একদিকে কমেছে, আর ভোগ্যপণ্যের খরচ বেড়েছে। খামারে কাজ করার পাশাপাশি রাস্তাঘাট তৈরি আর অন্যান্য সরকারী উন্নয়ন প্রকল্পেও চাষাদের জোর করে কাজে লাগানো হত। সরকারী চাকুরে বা খামারের শ্রমিক না হলে যে কারো গ্রেপ্তার ও খামারে সোপর্দ ছিল অনিবার্য।

হাইতি রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত ছিল সামরিক বাহিনী আর শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তের হাতে, এদের অধিকাংশ ছিল মুলাটো বা দোআঁশলা বর্ণের। গ্রামের মানুষের সাথে এদের ছিল বিস্তর ফারাক।
গ্রাম্য হাইতিয়ানদের ভুডু ধর্মকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হত শহুরে সমাজে। সরকারের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গ্রামের মানুষ ভুডু চর্চা করত। এরা নাকি নরবলি দিত। এ চিত্রে ১৮৬৪ সালের একটি চাঞ্চল্যকর ভুডু নরবলির মামলার গ্রেপ্তারকৃত আসামীদের দেখানো হয়েছে।
হাইতির গ্রাম্যসমাজে লাকু বা পঞ্চায়েতব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ সরকারের চোখের আড়ালে নিজেদের স্বাধীন জীবনযাত্রা চালিয়ে যায়।

নগরভিত্তিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে বাঁচতে অভিনব পদ্ধতি বের করে হাইতির গ্রামগুলি। ‘লাকু্’ বলে একটা সিস্টেম তৈরি করে তারা, অনেকটা পঞ্চায়েতের মত। বড় যৌথ পরিবার নিয়ে ছোট আবাদী জমির মাঝে কুঁড়েঘরের গ্রুপ বানিয়ে তারা থাকত। সরকারী খামারে নামমাত্র কাজ করে এসে নিজ জমিতেই কফি-তামাক ফলাত, সেসবের একাংশ বেঁচত নিজেদের আভ্যন্তরীণ বাজারে, বাকিটা নিকটস্থ বন্দরশহরে। সরকার ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না লাকুর বার্টার ইকনমিতে কি পরিমাণ শ্রম আর রাজস্ব ফাঁকি যাচ্ছে। বাধ্যতামূলেক শ্রমের ডাক পড়লেও সেখানে না গিয়ে কাছের পাহাড়ে লুকিয়ে থাকত গ্রামবাসী।

এভাবে স্বদেশের শোষক সরকারই হয়ে দাঁড়ায় হাইতিবাসীর মূল প্রতিপক্ষ। কিন্তু নিজেরাই একটা লিবার্টারিয়ান-এগালিটারিয়ান সমাজ তৈরি করে ফেলে হাইতিবাসী, বাইরের সাহায্য ছাড়াই। সরকার থেকে নিষেধ থাকা সত্ত্বেও লাকুগুলিতে ভুডু ধর্মের চর্চা চলতে থাকে, ক্রেওল ভাষাও উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।

কিন্তু এ ব্যবস্থা ছিল বেশ প্রিমিটিভ আর ভঙ্গুর। সরকারের হাত হাইতিবাসীর করের পয়সাতেই আরো যত লম্বা হতে থাকল, তত তাদের যাতায়াত ও জীবনযাপনের স্বাধীনতা আরো সংকুচিত হতে শুরু করল। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই ক্ষণস্থায়ী কার্যকরী সমাজব্যবস্থা শীঘ্রই তাসের ঘরের মত ধ্বসে পড়বে উত্তাল সময়ের ঝড়ে।

লাইবেরিয়া – ৩, স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রগঠন, ১৮৪০-১৮৬০

১৮৪৭ সালে আমেরিকো-লাইবেরিয়ানদের একাধিক উপকূলীয় কলোনি একত্রিত হয়ে সংবিধান প্রনয়ণের মাধ্যমে লাইবেরিয়া প্রজাতন্ত্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

এই ঘোষণার পেছনে এসিএস থেকে স্বাধীনতালাভের আদর্শগত অনুপ্রেরণা যতটা না ছিল, তার থেকে বেশি ছিল প্রয়োজন। কারণ, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত রাষ্ট্র না হওয়া পর্যন্ত লাইবেরিয়া তার বন্দর ও সাগরসীমায় বাণিজ্যজাহাজ থেকে শুল্ক আদায়ের চেষ্টা যদি চালায়, আন্তর্জাতিক আইনে তা হবে জলদস্যুতার শামিল!

এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে চার রকমের মার্কিনবংশোদ্ভূত কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে লাইবেরিয়ার যাত্রা শুরু হয়: যাদের জন্ম মুক্তমানুষ হিসাবে, যারা নিজেদের স্বাধীনতা টাকার বিনিময়ে ফিরে পেয়েছে, যারা লাইবেরিয়াযাত্রার জন্যে মুক্তিপ্রাপ্ত, আর যারা ‘রিক্যাপচারড স্লেভ’ (২য় খন্ড দ্রষ্টব্য)।

১৮৫৭ সালে লাইবেরিয়ার সাথে সংযুক্ত হয় মেরিল্যান্ড রিপাবলিক নামে দক্ষিণের আরেক আমেরিকোঅধ্যুষিত কলোনি। বহির্শক্তির কোন হস্তক্ষেপ আর সাহায্য ছাড়াই একটা প্রশাসনিক কাঠামো দাঁড়া হয়ে যায়। প্রথম রাষ্ট্রপতি রবার্টস দক্ষতার সাথে ইউরোপীয় দেশগুলির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। রাজনৈতিক জটিলতার কারণে মার্কিনদের স্বীকৃতি আসতে আরো দেরি হয়।

লাইবেরিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি জে জে রবার্টস, ১৮০৯-১৮৭৬। জন্ম ভার্জিনিয়ার নরফোকে।
লাইবেরিয়ার একটি আমেরিকো প্ল্যান্টেশন। আমেরিকার সাদার্ন স্টাইলে তৈরি। বিশাল খামারের মাঝখানে গেরস্তের বড় বাড়ি। বহু দাস, চাকর, শ্রমিক, এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি, ইত্যাদি।

নিয়মমত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে, যদিও পার্টি ছিল মোটে একটি, ঠিক যুক্তরাষ্ট্রের শুরুর মত। পরে দ্বিতীয় আরেকটি পার্টিও তৈরি হয়, তাদের নাম ট্রু হুইগ। শত বছরের বেশি সময় লাইবেরিয়ার রাজনীতির ওপর কর্তৃত্ব করে আমেরিকো কৃষ্ণাঙ্গদের এই পার্টি। বড় পদে আসীন ব্যক্তিরা অবশ্য গুটিকয় প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য ছিল। এসকল পরিবার ছিল নিজেদের মধ্যে নানারকম আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। এভাবে একটা শাসকশ্রেণী গড়ে ওঠে। এদের অনেকে ছিল ফ্রিমেসন।

লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রে উল্লেখিত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধিকার আর আইনের শাসনের অঙ্গীকার মার্কিন ধাঁচে হলেও একটা ব্যাপারে বিশাল ফারাক ছিল। মার্কিনদেশের প্রতিষ্ঠাতারা যেখানে সাবধানতার সাথে ধর্মকে রাজনীতি থেকে পৃথক করে রাখেন, সেটা লাইবেরিয়ার রাজ্যপালরা করেননি। দাসত্বজীবনে যীশুখ্রীষ্টের বাণী তাদেরকে আশার আলো দেখিয়েছে। স্বভাবতই খ্রীষ্টান ঈশ্বর আর ধর্মের দয়াশীল চেহারা লাইবেরিয়ার শাসনতন্ত্রের পাতায় পাতায়।

লাইবেরিয়ার মনরোভিয়া গ্র্যান্ড মেসনিক লজ। প্রতিষ্ঠা ১৮৬৭ সালে। লাইবেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় পরিণত হয় রেফ্যুজি ক্যাম্পে।

সেই খ্রীষ্টান ঈশ্বরের অনুপ্রেরণা থেকেই আমেরিকোরা স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গ গোত্রগুলিকে সভ্য বানানোর অভিযানে নামে। দুর্গম এলাকায় মিশনারী স্কুল আর চার্চ তৈরি হয়। কোন জায়গায় বৈরিতার মুখোমুখি হয় এরা, আবার কোথাও দুর্বল গোত্রের রাজারা আমেরিকোদের প্রতিরক্ষা আশ্বাসের বিনিময়ে তাদের সন্তানাদিকে স্কুলে-চার্চে পাঠাতে শুরু করে।

শীঘ্রই ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। সামন্তযুগের রীতি অনুযায়ী গোত্রপতিরা তাদের একটি সম্তানকে আমেরিকো কোন পরিবারের কাছে ‘বন্ধক’ রাখে, বা দত্তক দেয়। একে বলে ওয়ার্ড সিস্টেম। ভারতীয় উপমহাদেশে, ইউরোপে, ইন ফ্যাক্ট মধ্যযুগের যেকোন সভ্যদেশে এ রীতি প্রচলিত ছিল। পশ্চিম আফ্রিকার সভ্য জাতিগুলিও এর ব্যতিক্রম ছিল না।

এছাড়া গৃহপালিত চাকরের ব্যাপারটাও পশ্চিম আফ্রিকার সমাজে একেবারে বোনা, আমাদের দেশের মত। ধারদেনা শোধের জন্যে নিজ গোত্রের গরীব-গুর্বোদেরও গোত্রপতিরা আমেরিকো পরিবারগুলোর কাছে পাঠাতে শুরু করে। এসকল সারভ্যান্ট আর ওয়ার্ডদেরকে নিজেদের পরিবারের অংশ করে নেয় আমেরিকোরা। কোন ক্ষেত্রে গোত্রপতিরা আমেরিকোদের দাবি অনুযায়ী কোর্ভে লেবার অর্থাৎ বাধ্যতামূলক শ্রমিকের দলও পাঠায়।

এ শ্রমের অবশ্য ভীষণ দরকার ছিল আমেরিকোদের। আমেরিকোদের যে জনসংখ্যা, তাতে খেতখামারে একলা কাজ করে বেশি উৎপাদন সম্ভব নয়। ১৮৬২তে সিভিল ওয়ারের শুরুতে লিংকন লাইবেরিয়াকে স্বীকৃতি দিয়ে দেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুক্ত কালোদের অভিবাসন একেবারে শূন্যে গিয়ে ঠেকে। যুদ্ধের কারণে তো বটেই, এছাড়া খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই তখন কালোদের স্বাধিকারের রাস্তা তৈরি হচ্ছে। মার্কিন অভিবাসীদের অভাব পূরণ করে স্থানীয় কালো শ্রমিক আর ক্যারিবিয়ান থেকে আসা নতুন অভিবাসীরা।

কফি, তামাক, ধান, চিনি, তুলো, পামওয়েল ইত্যাদির প্ল্যান্টেশন গড়ে ওঠে আমেরিকান সাউথের ধাঁচে। পাম ওয়েল প্রেসের যন্ত্রও আবিষ্কার করেন লাইবেরিয়ার এক উদ্ভাবক। এসব কাঁচামাল ও শস্য রপ্তানির পাশাপাশি জাহাজশিল্প গড়ে ওঠে। এখনো ছোটদেশ লাইবেরিয়া সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স ও রেজিস্ট্রেশনে অগ্রগণ্য একটি নাম।

লাইবেরিয়ার পতাকা এখনো সারা বিশ্বে জাহাজের ফ্ল্যাগ অফ কনভেনিয়েন্স হিসাবে সুপরিচিত।

এসব উন্নয়নের বিপরীতে স্থানীয় কালোরা আমেরিকোদেরই ক্রীতদাসে পরিণত হতে শুরু করে! দু’একটা অপ্রীতিকর ঘটনার পর সরকার আইন করে সেসব বন্ধ করার চেষ্টা করে। আইনানুযায়ী ঘরে ও খামারে কাজ করা কালোদের জামাকাপড় আর শিক্ষার ব্যাপারটা আমেরিকো গেরস্তকে দেখভাল করতে হবে। নাহলে বড় জরিমানা। আদতে যেটা দাঁড়াল, তা হলো আমাদের দেশের চাকরদের মত সামান্য খাদ্যবস্ত্র আর ধর্মশিক্ষা দিয়ে সোশাল সেগ্রেগেশন।

লাইবেরিয়া পরিদর্শনে আসা মার্কিন দূত যারা অ্যাবোলিশনিস্ট মুভমেন্টের সাথে জড়িত ছিলেন, তারা তাদের রিপোর্টে লাইবেরিয়ার এ শ্রমব্যবস্থাকে সরাসরি ‘স্লেভারি’ হিসাবে বর্ণনা করেন। আমেরিকোরা তাচ্ছিল্য করে স্থানীয় কালোদের ডাকত ‘বয়’ বলে, ঠিক যেমনটা সাদার্ন স্টেটগুলিতে তাদেরকে ডাকত শ্বেতাঙ্গরা! আর দেশের অভ্যন্তরের গোত্রগুলোর নাম তারা দেয় ‘অ্যাবোরিজিনি’! অ্যাবোরিজিনিদের যারা তাদের খামারে থাকত, তাদের প্রত্যেককে মাতৃভাষার নাম ছেড়ে গ্রহণ করতে হত পালক পরিবারের নাম। এটিও ঠিক মার্কিন দেশে গোলাম-মনিবের সম্পর্কের মত!

লাইবেরিয়ার গেরস্ত পরিবারের সাথে তাদের ‘ওয়ার্ড’ বা গৃহপালিত দাস, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগ। দাসেদের বস্ত্র তুলনামূলক কম, কিন্তু মনিবরা ঠিকই ক্রান্তীয় এলাকার গরমের মধ্যেও মার্কিন ঘরানায় আচ্ছাদিত।

সব মিলিয়ে নতুন দেশ লাইবেরিয়া মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের মুক্তির স্বপ্নপূরণ করলেও এর মূল্য দিতে হয় তাদেরই স্বগোত্রীয়দের — হয় তাদের দাসের মত নিজেকে বিকিয়ে দিতে হয় নয়ত স্বকীয় পরিচয় পরিত্যাগ করে হতে হয় সভ্য ‘আমেরিকো’।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!