“বিস্তীর্ণ দু’পারের অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও,
নিঃশব্দে নীরবে ও গঙ্গা তুমি, গঙ্গা বইছো কেন?”
সবার পরিচিত এই গানটা ভূপেন হাজারিকা গেয়েছেন বাংলা ছাড়াও হিন্দী আর অসমীয়াতে (উচ্চারণঃ অহমিয়া)। অনেকেই হয়ত জানেন যে গানের সুরটা আসলে অনেক পুরনো একটা মার্কিন মিউজ়িক্যালের সুর অবলম্বনে।
আসল গানটার নাম “ওল´ ম্যান রিভার” — ওপরের ভার্শনটা “শোবোট” বলে ১৯৩৬ সালে নির্মিত চলচ্চিত্র থেকে নেয়া। গেয়েছেন সেসময়কার বহুলপ্রতিভাসম্পন্ন আমেরিকান-ফুটবল খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়ক, সামাজিক-রাজনৈতিক অ্যাকটিভিস্ট পল রোবসন।
বহু চড়াই-উৎরাই পার করা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসের ছেলে এই বাস ব্যারিটোন শিল্পীর সাথে হাজারিকার দেখা হয় নিউ ইয়র্কে। পঞ্চাশের দশকে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূপেন যখন পিএইচডি করছেন, তখন রোবসন সম্ভবত নিউ ইয়র্কের হারলেমের বাসিন্দা। রোবসন বিশের দশকে নিউ জার্সির রাটগারসে পড়েছেন, নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া থেকে এলএলবি পাশ। তাঁর খ্যাতি তুঙ্গে ছিল ত্রিশ আর চল্লিশের দশকে। ভূপেনের সাথে যখন তাঁর দেখা হয়, তখন কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য হওয়ায় আর প্রকাশ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও স্তালিনের প্রশংসা করার কারণে তিনি একঘরে।
“শোবোট” চলচ্চিত্রটা ব্রডওয়ে মিউজ়িক্যাল থিয়েটারের একটা নাটক অবলম্বনে তৈরি। নাটকটার কাহিনীও এডনা ফার্বার রচিত একই নামের বেস্টসেলার উপন্যাস থেকে নেয়া। গল্পটা ১৮৮০এর দিককার মিসিসিপি নদীর ভ্রাম্যমান জাহাজ-থিয়েটার নিয়ে, যাকে সবাই চিনত শোবোট হিসাবে। অনেকটা আমাদের দেশের ভ্রাম্যমাণ সার্কাস বা যাত্রাদলের মত এরা মিসিসিপি ধরে সারা বছর যুক্তরাষ্ট্রের মিড-ওয়েস্ট আর সাউথের মধ্যে আপ-ডাউন করত। গ্রামে-গঞ্জে মুভি থিয়েটার গজিয়ে উঠেনি তখনও। নদীতীরের কোন গ্রামে একটা শোবোট আসলে তাই সাড়া পড়ে যেত, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলে ছুটে আসত মজা দেখতে।
সেই কাহিনীর একটা চরিত্র জো, তাকে এই দৃশ্যে রূপ দিয়েছেন পল রোবসন। সে শোবোটের কুলি। জাহাজে যতরকম সাপ্লাই লাগে, সেসব ভারি ভারি জিনিসপত্র কূল থেকে নিয়ে আসতে হয় তাকেই। এখানে সে গান ধরেছে মিসিসিপি নদকে উদ্দেশ্য করে। লিংকনের ১৮৬৩এর ইম্যানসিপেশন প্রক্ল্যামেশনের পরেও তার মত কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনে মুক্তি নেই। জমি-জমা নেই, ভোটাধিকার নেই, নেই শিক্ষা-দীক্ষা-চাকরির গ্যারান্টি। সমান পারিশ্রমিকের বিনিময়ে সাদাদের থেকে অনেক বেশি হাড়ভাঙ্গা খাঁটুনি করতে হয়। জো তাই মিসিসিপি নদকে একরকম আদর করেই বকছে ওল’ ম্যান বলে, কারণ হাজার বছর ধরে সে বুড়ো বয়েই চলেছে, কোনদিকে তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। সে জানে অনেক কিছুই, কিন্তু মুখটি খুলবে না!
আমেরিকার গৃহযুদ্ধে উত্তরের ইউনিয়নের সেনাবাহিনী দক্ষিণের বিদ্রোহী কনফ়েডারেটদের বিরুদ্ধে ভীষণ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জিতেছিল। দাসপ্রথার আনুষ্ঠানিক উচ্ছেদও করেছিলেন লিংকন। কিন্তু সে বিজয়ের মূল্যবোধটাকে ধরে রাখা বোধ হয় যুদ্ধে জেতার থেকে বেশি কঠিন ছিল।
যু্দ্ধের পরে রাজনৈতিক একতার খাতিরে ডেমোক্রাট প্রেসিডেন্ট জনসন দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গ ডেমোক্রাটদের সাথে আপোসরফার ভিত্তিতে সংস্কার করতে চাইলেন। আর সেসবের একটা ছিল মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকাররোধ। তার ওপরে দক্ষিণের স্টেটগুলির ডেমোক্রাট সরকার ব্ল্যাক কোডস বলে বর্ণবাদী আইন প্রণয়নের কারণে র্যাডিক্যাল রিপাবলিকানরা গেল খেপে। ১৮৬৮এর নির্বাচনে জেতার পরে তারা ফ়েডারেল সেনাবাহিনী পাঠিয়ে একরকম মার্শাল ল’ জারি করলো দক্ষিণের স্টেটগুলোতে। সেখানে রিপাবলিকান রাজনীতিবিদ, মুক্ত ক্রীতদাস, দক্ষিণের কিছু রিপাবলিকান সমর্থক আর দক্ষিণাদের কাছে কার্পেটব্যাগার নামে কুখ্যাত উত্তর থেকে আসা সুযোগসন্ধানীরা একত্র হয়। তারা স্টেট পর্যায়ে রাজনৈতিক আর শিক্ষা অধিকারের ক্ষেত্রে ব্যাপক উদারনৈতিক সংস্কার করে। এই সংস্কার ইতিহাসে পরিচিত ‘রিকনস্ট্রাকশন’ নামে।
কিন্তু একে সাদার্ন ডেমোক্রাট আর তাদের সমর্থিত বর্ণবাদী গুপ্তসংস্থা কু ক্লাক্স ক্লান সেকেলে সাদার্ন সংস্কৃতির ওপর আঘাত হিসাবে চিত্রায়িত করে। তারা রিপাবলিকান আর কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা আর গুপ্তহত্যা শুরু করে। এদের মোক্ষম সুযোগ আসে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট গ্রান্টের দ্বিতীয় টার্মের শেষে। ১৮৭৬এর নির্বাচনে বিপুল পরিমাণ ভোটচুরি করে আর কালোদেরকে ভয় দেখিয়ে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখে তারা। সেভাবে এরা স্টেট সরকারগুলির দখল নেয়, আর রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রাদারফ়োর্ড হেইজ়কে প্রায় হারিয়ে দেয়। প্রেসিডেন্ট পদের বিনিময়ে কমপ্রমাইজ়স্বরূপ রিপাবলিকানরা দক্ষিণের শেষ তিনটা স্টেট থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে। রিকনস্ট্রাকশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তারপর সাদার্ন ডেমোক্রাট সরকারদের শাসনে কালোদের অবস্থা আবার যেমনকার তেমন, শুধু দাসত্বশৃংখল বাদে। দক্ষিণের রাষ্ট্রগুলিতে নতুন আইনকানুন জারি হল যাদের বলে ‘জিম ক্রো ল’জ়’। সেগুলির মূল লক্ষ্য ছিল কালোদের (আর আইনী ভাষায়, কিছু গরীব সাদাদেরও!) ‘সমান কিন্তু আলাদা’ বন্দোবস্ত রাখা। সোজা কথায় বর্ণবিভেদ বা সেগ্রেগেশন!
গৃহযু্দ্ধের পরপরই কালোদের যেটা দরকার ছিল সেটা হলো, ক্রীতদাস থেকে যাতে তারা শেয়ারক্রপার ভূমিদাস না হয়ে যায় তার জন্যে অর্থনৈতিক সাহায্য। লিংকন তাই চেয়েছিলেন, কিন্তু তার আগেই তাঁকে মেরে ফেলে জন উইল্কস বুথ। আর সদ্য-নিঃস্ব শ্বেতাঙ্গ তুলাচাষীদেরও দরকার ছিল ফ্রী মার্কেট লেবারের কিছুটা গ্যারান্টি। কিন্তু সবকিছু রাজনীতির প্যাঁচে ওলট-পালট হয়ে যায়। সে অবস্থা থেকে উত্তরণ পেতে মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো সাত-আট দশক।
শোবোট ছবিটাতে আরো অনন্য কিছু ব্যাপার দেখবেন, যেমন ১৮৮০র দিকে সাদা-কালো মিশ্র বিয়ের ব্যাপারটা কিভাবে দেখা হত। ছবিটি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের করা শতবর্ষের সেরা একশো মার্কিন ফিল্মের তালিকায় প্রায় প্রতিবছরই থাকে।
আমেরিকার মিসিসিপি থেকে বাংলার গঙ্গা — গণমানুষের গায়ক হিসাবে ভূপেন হাজারিকা একটা চমৎকার দেশ-কালাতিক্রমী সমান্তরাল গান-সুর নিয়ে এসে উপহার দিয়েছেন আমাদেরকে। ৮ই সেপ্টেম্বর তাঁর ৯২তম জন্মবার্ষিকী। শ্রদ্ধা তাঁর আর তাঁর প্রতিভাবান বন্ধুর প্রতি!