আদি ইসলামী মুদ্রা – ২

আদি ইসলামী মুদ্রা নিয়ে এটা আমার দ্বিতীয় লেখা — প্রথম লেখা এখানে

আজকে লিখছি আরব দিগ্বিজয়ের সমসাময়িক সিরিয়ার মুদ্রা নিয়ে। ছবির মুদ্রাগুলো আমার সংগ্রহ থেকে। ভালমত খেয়াল করলে দেখবেন, বিজ্যান্টাইন ধাঁচের মুদ্রাগুলিতে সম্রাট কিংবা খলীফার ছবি তো রয়েছেই, তার সাথে দৃশ্যমান একাধিক ক্রুশ। কখনো এসব খ্রীষ্টান প্রতীকের পাশাপাশি আরবীতে ধর্মীয় কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ অনুবাক্য লেখা। মুদ্রাগুলির বর্ণনার পর তদকালীন ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত একটা বিবরণ দেব, তারপর কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিশ্লেষণ।

এখানে দেখানো সব মুদ্রাই তামার তৈরি। কালের বিবর্তনে অনেকটা ক্ষয়ে গেছে, তারপরও ছাঁপগুলি দৃশ্যমান। এগুলি চালু ছিল পূর্ব রোম সাম্রাজ্যে, যার প্রচলিত নাম বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য। আরবদের কাছে এ সাম্রাজ্য পরিচিত ছিল ‘রূম’ হিসাবে। কুরআনে একটি সুরাও রয়েছে একই নামে। এ সুরায় রোম আর পারস্যের সাসানী সাম্রাজ্যের চিরন্তন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার শেষ ফলের ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে।

বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যে এই নিম্ন মূল্যের মুদ্রা পরিচিত ছিল ফোলিস নামে। আরবদের কাছে এর নাম ফালস, বর্তমানযুগের বহু আরবীভাষী দেশে দিরহাম বা দিনারের থেকে ছোট মানের মুদ্রাকে বলা হয় ফিলস, বহুবচনে ফুলুস। সন্দেহ নেই, আরবী নামটির উৎস সেই লাতিন ফোলিস।

বিজ্যান্টিন সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্সের তাম্রমুদ্রা

ছবির প্রথম মুদ্রা খোদ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের। ৬৪১ থেকে ৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত চালু ছিল। এক পিঠে বড় করে লাতিন হরফ ‘এম’ লেখা, এটা মুদ্রা মানের প্রতীক। সাথে লাতিন হরফে টাঁকশালের নামের কয়েকটি অক্ষর আর বছর। অপর পিঠে দন্ডায়মান সম্রাট দ্বিতীয় কন্সট্যান্স, ডানহাতে ক্রুশমন্ডিত রাজদন্ড, আরেক হাতে ক্রুশওয়ালা গ্লোব — গ্লোবুস ক্রুসিজের।

পরের আটটি ছবির মুদ্রা সিরিয়ায় প্রচলিত ছিল এমন এক সময়ে যখন সে দেশটি আর বিজ্যান্টিনদের হাতে নেই। ৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে দামেস্ক থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত অধিকাংশ এলাকা হয়েছে নতুন ইসলামী রাশিদুন খেলাফতের করায়ত্ত। মুদ্রাগুলি নতুন প্রশাসনের আশীর্বাদপুষ্ট। দেখা যাচ্ছে, বিজ্যান্টিনদের আমল থেকে মুদ্রার চেহারার এমন কোন পরিবর্তন হয়নি। সেই ‘এম’, সেই সম্রাটের কায়া, এমনকি ক্রস পর্যন্ত। মুদ্রা গবেষকরা কিভাবে আলাদা করে বুঝলেন এগুলি ইসলামী মুদ্রা? এর কারণ, একটু নজর দিলে বোঝা যাবে মুদ্রার ছাঁচে পরিবর্তন, গুণমানের তফাত। আরো চোখে পড়বে এখানে সেখানে ত্রুটিপূর্ণ লাতিনের ব্যবহার। আর কোন ক্ষেত্রে মুদ্রার আকৃতি ও ওজন বিজ্যান্টিন মুদ্রার থেকে ভিন্ন। বিজ্যান্টিনসদৃশ এই ইমিটেশনগুলিকে নিউমিজম্যাটিস্টরা নাম দিয়েছেন স্যুডো-বিজ্যান্টিন। সময়কাল ৬৪৭ থেকে ৬৭০ সালের মধ্যে। সবচেয়ে পুরনোটিতে তিন ক্রসধারী ‘সম্রাটের’ ছবি, সময়কাল ৬৩৮-৬৪৩।

রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘তিন সম্রাট’ ফালস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘সম্রাত-সম্রাজ্ঞী’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
রাশিদুন খিলাফাতের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দাঁড়িওয়ালা
দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস

আর সব শেষের পাঁচটি মুদ্রা রাশিদুন খেলাফত পরবর্তী উমাইয়া খলীফাদের সময়কার সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের।

প্রথম দুটি প্রথম উমাইয়া শাসক মুয়া’বিয়ার সময়কার (শাসনকাল ৬৬১-৬৮০), যার সাথে চতুর্থ রাশিদুন খলীফা আলীর সংঘাত দিয়ে ইসলামের প্রথম ‘ফিতনা’ বা গৃহযুদ্ধের শুরু। একটি মুদ্রা দেখতে হুবহু আগের আমলের স্যুডো-বিজ্যান্টিনগুলির মত। অন্যটিতে একটু তফাত চোখে পড়ে। ক্রসওয়ালা রাজন্ডধারী ‘সম্রাটের’ ঠিক সামনে আরবীতে ওপর থেকে নিচে ‘বিসমিল্লাহ’ লেখা। আর অপর পিঠে এম অক্ষরের ওপরে বামপাশে অর্ধচন্দ্র, ডানপাশে ছয়মাথা তারা। অস্পষ্ট কিন্তু এমের নিচেও আরবীতে ‘তাইয়িব’ লেখা, যার অর্থ ‘উত্তম’ অর্থাৎ এই মুদ্রা লেনদেনের জন্যে স্বীকৃত।

পরের তিনটি মু্য়া’বিয়ার উত্তরসূরী আব্দুল মালিক ইবনে মারওয়ানের সময়ের। উমাইয়া বংশের পঞ্চম এই খলীফা ৬৮৫ থেকে ৭০৫ পর্যন্ত শাসন করেন। তার মূল কৃতিত্ব ছিল মুয়া’বিয়ার মৃত্যুর পর শুরু হওয়া দ্বিতীয় ফিতনার অবসান ঘটিয়ে পুরো সাম্রাজ্যকে একীভূত করা। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি ইসলামের জন্যে একটি গঠনমূলক সময়। সে ব্যাপারে বিস্তারিত ভিন্ন পোস্টে বলবো। আব্দুল মালিকের মুদ্রা দুটির প্রথমটিতে সেই সম্রাটের ছবি, হাতে গ্লোবাস ক্রুসিজের, মাথায় ক্রুশধারী মুকুট। সাথে গ্রীকে লেখা ΚΑΛΟΝ – কালোন, অর্থ ‘উত্তম’। অন্যপাশে আরবীতে লেখা ‘বি-হিমস’ অর্থাৎ এমেসা বা হিমস (বর্তমান হোমস) শহরে মুদ্রিত। অপরপিঠে এম অক্ষর, ওপরে সাতমাথা তারকা, আর দুপাশে গ্রীক অক্ষরেও এমেসা শহরে মুদ্রিত লেখা — এমেসিস — ΕΜΙ/СΗС। নিচে আরবীতে ‘তাইয়িব।’ দ্বিতীয় মুদ্রাটিতেও সম্রাট-ক্রস, আর এমের নিচে আরবী লেখা ‘আল-ওয়াফা লিল্লাহ’ — অর্থাৎ বিশ্বস্ততা আল্লাহর। কোন ধর্মীয় পুস্তকে বা দোয়ার মধ্যে এখন এমন অনুবাক্য অবিশ্বাস্যকরভাবে অনুপস্থিত। তৃতীয় মুদ্রায় ক্রসধারী তিন বিজ্যান্টিন সম্রাটের মূর্তি এক পিঠে। আরেক পিঠে এম অক্ষরের ওপর খ্রীষ্টান কাই-রো গুপ্তলিপি (এমনটার ব্যবহার কুরআনেও রয়েছে, যেমন ইয়া-সীন)। আর তিন পাশে আরবী লেখা — ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান। অর্থাৎ বাইসান (স্কাইথোপোলিস) শহরে মুদ্রিত প্রকৃত ফালস। শহরটি বর্তমান ইসরাইলের বেইত-শে’আন।

প্রথম উমাইয়া খলিফা মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস
মুয়া’বিয়ার আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, বিসমিল্লাহ অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, বি-হিমস/তাইয়িব অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘দ্বিতীয় কন্সট্যান্স’ ইমিটেশন ফোলিস, আল-ওয়াফা লিল্লাহ অংকিত
আব্দুল মালিকের আমলের সিউডো-বিজ্যান্টিন ‘তিন সম্রাট’ ইমিটেশন ফোলিস, ফালস আল-হাক্ব বি-বাইসান’ অংকিত

সিরিয়াতে কিভাবে ৬৩৩-৬৩৬এর ভেতর ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হল, তার জন্য দুইটি বিপরীত প্রেক্ষাপট চিন্তা করে দেখতে হবে। এক, বিজ্যান্টিন-সাসানী সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ও তাদের মধ্যে একটানা যুদ্ধবিগ্রহ। আরেকটি হলো আরব উপদ্বীপে ট্রাইবাল সিস্টেমের বহুত্বভিত্তিক পরিচয় শেষ হয়ে ইসলামী একত্বভিত্তিক আত্মপরিচয়ের শুরু।

লেইট অ্যান্টিকুইটি বলে ৩০০ থেকে ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত যে সময়টা, তখন সভ্য বিশ্বে দুইটি পরাশক্তি — কনস্ট্যান্টিনোপলভিত্তিক বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য আর বাগদাদের নিকটবর্তী ক্টেসিফোনভিত্তিক পারসিক সাসানী সাম্রাজ্য। রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সামরিক প্রতিযোগিতার ধারাবাহিকতায় বিজ্যান্টিনরা সাসানীদের বিরুদ্ধে পর্যায়ক্রমে লড়ে ৫০২-৫০৭এ আনাস্তাসিয়ান যুদ্ধ, ৫২৪-৫৩২এ আইবেরিয়ান যুদ্ধ, ৫৪০-৫৫৭তে জাস্টিনিয়ান-খসরুর যুদ্ধ, ৫৭২-৫৯১এ ককেশাসের যুদ্ধ, আর শেষমেশ ৬০২-৬২৮এর বিজ্যান্টিন-সাসানী যুদ্ধ।

৬০০ খ্রিষ্টাব্দের আশপাশ দিয়ে সাসানী-বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের সাথে স্থানীয় রাজ্যগুলির মানচিত্র

এ যুদ্ধগুলো মহাযুদ্ধের থেকে কম কিছু ছিল না। দুই সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্নভাষী সৈন্য এসবে অংশ নেয়। বড় শহর অবরোধ ও গ্রামাঞ্চলের কৃষিক্ষেত্রের ধ্বংসসাধন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক। যুদ্ধে দুই সাম্রাজ্যেরই ছিল একাধিক শক্তিশালী মিত্র। ইথিওপিয়ার আক্সুম সম্রাট নাজুস ছিলেন অর্থডক্স খ্রীষ্টান ও বিজ্যান্টিনদের বন্ধু। দক্ষিণ আরবের ইয়েমেনের প্রাচীন রাজ্যগুলির একটি হিমইয়ার তখনো ছিল মোটামুটি শক্তিশালী। তাদের ওপর ছিল পারস্যের প্রভাব। এই ইয়েমেনই সংঘটিত হ্য় বিজ্যান্টিন ও সাসানীদের রক্তক্ষয়ী প্রক্সি ওয়ার। কুরআনে বর্ণিত আবরাহার সেনাবাহিনী ছিল ইথিওপিয়া থেকে প্রেরিত। তারা স্থানীয় ইয়েমেনী ইহুদী রাজার খ্রীষ্টান নির্মূল অভিযানের বদলা নিতে নাজরান এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। সুরা ফীল অনুযায়ী আবাবিল পাখির প্রস্তরবর্ষণে মক্কাঅভিমুখী আবরাহা আর তার হস্তীবাহিনীর নির্মম মৃত্যু হয়। ইয়েমেনের মত স্থানে খ্রীষ্টান-ইহুদীর পাশাপাশি পাগানবিশ্বাসী দক্ষিণ আরবীয় ট্রাইবের বসবাস ছিল। এদের জীবনধারা উত্তর আরবের হেজাজ আর মধ্য আরবের বেদুইনদের থেকে অনেকটা ভিন্ন ছিল।

দুই সাম্রাজ্যের আরেকটা বড় যুদ্ধক্ষেত্র ছিল আরবের উত্তরে সিরিয়া-ইরাকের বিশাল স্তেপ সমভূমি। পূর্বে ফোরাত নদীর পশ্চিম তীরে আবাস গাড়া আরব লাখমী বংশের ট্রাইব। এক দুই শতক ধরে এরা সাসানীদের আজ্ঞাবহ, কখনো কখনো রাজা স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। আর মধ্যোপসাগরীয় উপকূলের পশ্চাদভূমি সিরিয়া-জর্দানের আরব ট্রাইবগুলির নেতৃত্বে ছিল ঘাসানী বংশের গোত্রপতিরা। এরা বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে যথেষ্ট স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করত। এই দুই পক্ষের আরবরা যে কোন বড় যুদ্ধে ফ্রন্টলাইনে থাকত। তাদের লাইট ক্যাভালরি দিয়ে দ্রুত আক্রমণ ছিল বিজ্যান্টিন-সাসানী দুপক্ষেরই প্রমিত রণকৌশল।

৬২০-৬২৮এর যুদ্ধে সাসানীরা বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের অন্তর্কলহের সুযোগ নিয়ে ইরাক-সিরিয়া পুরোটুকু দখল করে কন্সট্যান্টিনোপল পর্যন্ত চলে যায়। পুরো নিকটপ্রাচ্য পদানত হয় পারসিকদের। এই দীর্ঘ সামরিক অধিকৃতির সময়টা সিরিয়ার মানুষ বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্যের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। খ্রীষ্টান ঘাসানী দলনেতারাও পালিয়ে যায় বিজ্যান্টিন এলাকায়। অপরদিকে সাসানীরা বিজয়ের সুযোগে ইরাকের লাখমীদের স্বাধীনতা খর্ব করে তাদের রাজাকে লাঞ্ছিত করে। পুরস্কার দূরে থাকুক, কেন্দ্রের আজ্ঞাবহ হয়ে পড়তে হয় এ এলাকার নেস্টরিয়ান খ্রীষ্টান, মানিকেইস্ট ও পাগান আরব ট্রাইবগুলিকে।

এ হলো আরব উপদ্বীপের ঠিক বাইরের ভূরাজনৈতিক চিত্র। হেজাজ ও মধ্য আরবে এই দুই সাম্রাজ্যের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বিশাল মরু এলাকায় নাগরিক সভ্যতা গড়ে তোলা, করসংগ্রহের মাধ্যমে তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন কাজ। সামান্য জীবিকার ওপর বেঁচে থাকা মরুর বেদুইনরাও কাবু করার মত মানুষ নয়। প্রায়ই এরা দল বেঁধে চড়াও হত এই এলাকার মধ্য দিয়ে যাওয়া বাণিজ্য কাফেলার ওপর। আর দুই সাম্রাজ্যের দুর্বলতা একটু টের পেলে এরা দ্রুত মরুভূমি অতিক্রম করে আক্রমণ করত সভ্যতার কিনারায় গড়ে ওঠা শহরগুলিতে। ইসলামের অভ্যুদয়ের আগেও এরা জেরুজালেম অবরোধ করেছিল একবার। এসব আক্রমণের লক্ষ্য সেসব এলাকার স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ নেয়া নয়, শহরবাসী ও বিজ্যান্টিন গভর্নরদের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে কেটে পড়া।

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী যদি ধরি মক্কা ছিল হেজাজের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র, তাহলে মক্কাকে ওপরের ট্রাইবগুলির ব্যতিক্রম বলতে হবে। আরব উপদ্বীপে এরকম ছোট ছোট কিছু শহর ছিল, যাদের যৎসামান্য বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল, তার পাশাপাশি স্থানীয় দেবদেবীর মন্দির থাকার কারণে একটা বাৎসরিক মেলাও হত — তার ইকনমিক ইমপ্যাক্ট পড়ত স্থানীয় লোকজনদের ওপর। অর্থাৎ এ শহরগুলির বাসিন্দারা মরুর বেদুইনের মত পুরোপুরি যাযাবর নয়, বলা চলে সেমি-নোমাডিক।

এদেরই মত সেমি-নোমাডিক ঐ ঘাসানী-লাখমীরাও। বাণিজ্যকেন্দ্রিক শহর তাদেরও ছিল। দক্ষিণ আরবের ক্যাশ ক্রপ আতর-ধূপ আর সেমিপ্রেশাস রত্ন ইত্যাদি সিরিয়া হয়ে রোমে পৌঁছত আদিকালে। ঘাসানীদের পূর্বসূরী নাবাতীরা সেভাবে সম্পদশালী হয়ে গড়েছিল পেত্রার মত শহর। ইসলামের অভ্যুদয়ের সময় কিছুটা হলেও এ বাণিজ্য চালু ছিল — যদিও আগের মাত্রায় নয়। এই বাণিজ্যপথ ধরেই দামেস্ক-হিমস পর্যন্ত যাতায়াত ছিল মক্কার কুরাইশ ট্রাইবসহ অন্যান্য আরবদের। সেসব বড় শহরে নিঃসন্দেহে তাদের আত্মীয়স্বজনেরও বসতি ছিল। হাদীসে ঘাঁটালে দেখা যাবে, আবু জাহল, যিনি ছিলেন অন্যতম ইসলামবিদ্বেষী কুরাইশ, তার মালিকানায় নাকি দামেস্কের আশপাশে জমিজমা ছিল।

মোট কথা, সিরিয়া ও ইরাকের জনগণের শহুরে অংশ বিজ্যান্টিন বা সাসানী হলেও তাদের সেমিটিক পরিচয় বিলুপ্ত হয়নি। শহুরেদের ভাষা গ্রীকের পাশাপাশি আরামায়িক। আর নাগরিক সভ্যতার ফ্রিঞ্জে গেলে দেখা মিলবে আরামায়িকের নিকটাত্মীয় ভাষা আরবীর, আর সেমি নোমাডিক আরবদের। অর্থাৎ জাতিগত-ভাষাগত পরিচয়ের কথা চিন্তা করলে বিজ্যান্টিন বা সাসানী সাম্রাজ্যের এই এলাকাগুলি আরবদের বেশি কাছাকাছি।

ইসলামের অভ্যুদয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল দাওয়া বা ধর্মপ্রচার। কিন্তু এটি আমরা এখন যেভাবে বুঝি তেমনটা নয়। মুহাম্মদ(সা) ছিলেন সুচতুর কূটনীতিবিদ। মক্কা ছেড়ে মদিনায় আশ্রয় নেবার কারণটাই ছিল মদিনাবাসীর অনুরোধ, যেন তিনি তাদের জাতিগত বিবাদগুলির নিষ্পত্তি করে দেন। তিনি সেটা করতে সমর্থ হন। আর এর মাধ্যমে সারা আরবের ট্রাইবগুলির একীভূত হবার বীজবপন হয়। মক্কার কুরাইশ ও তাদের মিত্রদের আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি মদিনার ঐক্য ধরে রাখতে সক্ষম হন। পাশাপাশি একাধিক বিয়ের মাধ্যমে ও অন্যান্য প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে আরো বেদুইন ট্রাইবকে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ করতে সমর্থ হন।

কিন্তু এসব মিত্র ট্রাইবগুলি যে সবাই মুসলিম হয়েছিল তা নয়। সাকিফ বলে ইরাকের কাছের একটি ট্রাইব তার সকল যুদ্ধে সৈন্য পাঠালেও মুসলিম হয়নি। আর মদীনায় ইহুদী ট্রাইবেরও উপস্থিতি ছিল। হাদীসে যদিও বলা হয়েছে, কুরাইশদের সাহায্য করার কারণে চুক্তিভঙের শাস্তি হিসাবে হয় এদেরকে হত্যা করা হয়, নয়ত নির্বাসনে পাঠানো হয়, আমার ধারণা সেটা সব ইহুদীদের বেলায় ঘটেনি। পরবর্তী ইসলামী দিগ্বিজয়ের সময় মুসলিমদের পাশাপাশি সম্ভবত ঘাসানী ও ইয়েমেনী খ্রীষ্টান, হেজাজি ও ইয়েমেনী ইহুদী, আর ইরাকী মানিকেইস্ট আরব যুদ্ধে পাশাপাশি অংশ নেয়। এর কারণ ইসলামের আবির্ভাবের একটি সাইড-এফেক্ট ছিল বংশপরিচয়ভিত্তিক বিভাজনের বিনাশ। এটি একবার হয়ে গেলে ধর্মীয় বিভাজনটা আর অত বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়।

মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর রাশিদুন প্রথম খলীফা আবু বকর কনসলিডেশন ও করসংগ্রহ শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই তার বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ আসে। অনেক ট্রাইব আগের চুক্তি অনুযায়ী ‘জাকাত’ ট্যাক্সের বাইরে ছিল। তাদের এটা দিতে বাধ্য করা হলে এরা বেঁকে বসে। আবার কিছু ট্রাইবের নেতা মুহাম্মদ(সা)এর দেখাদেখি নিজেদের নবী বলে দাবী করে বসে। ইত্যাকার নানা বিদ্রোহ দমন করার জন্যে আবু বকর বিভিন্ন সেনাপতিকে পাঠান প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলিতে। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ আর কোন ক্ষেত্রে সমঝোতা ছিল এদের পদ্ধতি। এ যুদ্ধগুলিকে একত্রে বলে ‘রিদ্দা’ যুদ্ধ। ইসলামী সেনানায়কদের বেশিরভাগই আবার ছিল মুহাম্মদ(সা)এর প্রাক্তন শত্রু, যারা মক্কার আত্মসমর্পণের পর ধর্মান্তরিত হয়। এরা যেহেতু মক্কার মত একটা কসমোপলিটান শহরের মানুষ, ম্যানেজমেন্ট, ট্রেড আর পলিটিক্স এরা ভালই বুঝত — বেদুইনদের মত নয়।

সিরিয়া ও ইরাকের বিজয় এই রিদ্দা যুদ্ধের সূত্র ধরেই। যখন এ সকল সেনানায়করা দূরদূরান্তের ট্রাইবগুলিকে বশ করতে গেছে, তখন তারা এসেছে বিজ্যান্টিন ও সাসানী ভূমিতে আবাসরত আরবদের সংস্পর্শে। স্বভাবতই এদের ট্রাইবাল পরিচয় ভেঙে তাদেরকে নতুন আরব-মুসলিম পরিচয়ের মধ্যে আনার একটা প্রচেষ্টা হয়। কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধ কোন ক্ষেত্রে মূলো ঝুলানোর মাধ্যমে সে কাজটা হয়।

বিশেষ করে সিরিয়া ছিল আরবের বাইরে সাম্রাজ্যবিস্তারের জন্যে খুবই উপযুক্ত। ততদিনে বিজ্যান্টিনরা সাসানীদেরকে হঠিয়েছে। তারা আবার নতুন করে ঘাসানীদের মত একটা মিত্র ট্রাইবাল স্ট্রাকচার দাঁড়া করানোর চেষ্টা করছে। তাদের সে লক্ষ্যটা আবার রাশিদুন খলীফাদের লক্ষ্যের পরিপন্থী, সংঘাত ছিল অনিবার্য। তাছাড়াও সিরিয়া ছিল আরব উপদ্বীপের তুলনায় স্বর্গ। মেডিটেরানিয়ান সাগরের আর্দ্র বাতাসের কারণে সেখানে চাষাবাদ হত ভাল। বাণিজ্যের সম্পর্কও সেখানে কুরাইশ-উমাইয়াদের আগে থেকেই ছিল। তার ওপর ইসা(সা)সহ অনেক আব্রাহামিক নবীর কারণে জেরুজালেম শহরের ধর্মীয় গুরুত্বও অপরিসীম।

সিরিয়াতে শুরুতে পাঠানো পাঁচ সেনাপ্রধানের সকলেই মক্কাবাসী কুরাইশ ছিলেন, যাদের আগের জীবন ছিল ইসলামবিদ্বেষী, কিন্তু পাপমোচনের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ইসলামগ্রহণ করেন। সাথে তারা নিয়ে আসেন যুদ্ধের কৌশলজ্ঞান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আমর ইবনে আবুল আস, খালিদ বিন ওয়ালিদ, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান, আবু উবায়দা ইবনে আল জার্রাহ, শুরাহবিল ইবনে আবু হাসানা। এদের সৈন্যরা ছিল শুধু মক্কার কুরাইশবংশীয় নয়, ইয়েমেনের কিন্দাবংশীয় ও মধ্য আরবের তায়ী বংশীয়। অর্থাৎ মূলত রিসেন্ট মুসলিম কনভার্ট, যারা হয়ত রিদ্দা যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আরবদের সিরিয়া অভিযানের মানচিত্র

প্রথম পর্যায়ে সিরিয়ার মরু ও গ্রামাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এদের সেনাবাহিনী। স্থানীয় সব ট্রাইব তাদেরকে যে সাহায্য করেছিল তা নয়। ঘাসানসহ চারপাঁচটি ট্রাইব বিজ্যান্টিনদের পক্ষ নিয়ে ছোট ছোট যুদ্ধে লড়ে। কিন্তু খুব একটা সুবিধা তারা করতে পারে না। দামেস্কের মত শহরগুলি বহু সংঘাত দেখে ক্লান্ত, আরব সেনাবাহিনী তাদের দ্বারে আসলে নামমাত্র প্রতিরোধ করার পর করপ্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ধর্মান্তরের কোন শর্ত ছিল না। আর এধরনের কর তারা সাসানী কিংবা বিজ্যান্টিনদের আগে থেকেই দিয়ে এসেছে।

দ্বিতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিনরা ঘটনার সংবেদনশীলতা আঁচ করতে পেরে বড় সেনাবাহিনী নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সম্রাট হেরাক্লিয়াস স্বয়ং সিরিয়ার অ্যান্টিয়োক শহর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রথমদিকে ধরাশায়ী শহরগুলি এ সুযোগে আবার পক্ষপরিবর্তন করে। কিন্তু যুদ্ধকৌশলের সুবাদে কিংবা নেহাত ভাগ্যক্রমে সংখ্যায় কম আরব সৈন্যদলের কাছে বিজ্যান্টিনরা একে একে পরাজিত হয় আজনাদাইন আর ইয়ারমুকের মত গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধে। যুদ্ধে নিহত হয় হেরাক্লিয়াসের বহু নিকট সেনাপ্রধান, ৬৩৫এ সিরিয়া ছেড়ে কন্সট্যান্টিনোপলে ফিরে যান তিনি। সে বছরই দামেস্ক পুনরায় আরবদের করতলগত হয়। তারপর ৬৩৬এ জেরুজালেম অবরোধ করে বসে আরবরা। শহরটির অর্থডক্স খ্রীষ্টান প্যাট্রিয়ার্ক সোফ্রোনিয়াস আরবদের সাথে চুক্তি করে জেরুজালেম তাদের হাতে তুলে দেন। চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল জেরুজালেমে ইহুদীদের পুনর্বাসন করা যাবে না।

তৃতীয় পর্যায়ে বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে এ এলাকায় সরাসরি আর কোন হস্তক্ষেপ আসে না। মোটামুটি ৫০ বছরের জন্যে চিন্তাহীনভাবে চলে রাশিদুন ও উমাইয়া খলীফাদের শাসন, বিজ্যান্টিনরা ৬৯০এর দিকে একটিবার চেষ্টা চালায় কিন্তু শেষমেশ ঘুষ নিয়ে চলে যায়। উমাইয়া শাসনামলে মদীনা থেকে খেলাফতের গদি সরিয়ে নিয়ে আনা হয় দামেস্কে, কারণ শহরটির অবস্থান ছিল কৌশলগতভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ ও বিশ্ববাণিজ্যের সাথে সংযুক্ত। আশপাশের তুলনামূলক দুর্গম এলাকাগুলিতে বিদ্রোহী জনগোষ্ঠী ধীরে ধীরে উমাইয়াদের বশ্যতা স্বীকার করে। এদের মধ্যে অ্যান্টি-লেবানন পর্বতের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান মার্দাইটরা বহুদিন কার্যত স্বাধীন ছিল। এসব বিচ্ছিন্ন জনপদ করপ্রদান ছাড়াও অন্যান্য নানা শর্ত মেনে নিয়ে উমাইয়াদের শাসন মেনে নেয়।

এই হল মুসলিমদের সিরিয়া বিজয়ের সম্পূর্ণ না হলেও সংক্ষিপ্ত একটা আউটলাইন। এবার কিছু ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ আর প্রশ্ন করি। প্রশ্নগুলির কিছুর উত্তর আছে, কিছুর সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা নেই।

প্রথমত, আদি ইসলামী শাসকরা বর্বর যাযাবর ছিল না। মক্কা-মদীনা-তায়েফের মত হেজাজের কমবেশি গুরুত্বপূর্ণ শহরের বাসিন্দা ছিল এরা। সিরিয়ার সভ্য আরব গোত্রদের সাথে বাণিজ্যিক খাতিরে তাদের যোগাযোগ ছিল। টাকাপয়সা আর কর আদায়ের গুরুত্বটা আগের রেজিমগুলির মত তাদের বেশ ভালই জানা ছিল। ইরাকের আরব গোত্রগুলোর ওপর সাসানীদের চাপিয়ে দেয়া ‘ইতিওয়া’ করের সাথে যেমন তারা পরিচিত ছিল, তেমনই তাদের নিজেদের সমাজেও দুর্বল ট্রাইবদের থেকে তারা প্রটেকশন মানি হিসাবে খুউওয়া নামে কর আদায় করত। সিরিয়ার এই মুদ্রাগুলির ডিজাইনের পেছনে সেটাই মটিভেশন। যে নতুন ধর্মই তারা গ্রহণ করুক না কেন, বাণিজ্য-অর্থনীতির কোন ডিসরাপশন হবে না, চলতে থাকবে। একই কারণে মুহাম্মদ(সা)এর মৃত্যুর পর আদি ইসলামী কম্যুনিটিতে তার বংশ বনু হাশিমের পরিবর্তে প্রভাব বেড়েছে বাণিজ্যে অগ্রগণ্য বনু উমাইয়া গোত্রের। তৃতীয় খলীফা উসমান ছিলেন তাদেরই এক গোত্রনেতা। তেমনটা ছিলেন প্রথম উমাইয়া খলীফা মুয়া’বিয়া।

দ্বিতীয়ত, কর আর অর্থনীতি চালু রাখতে মু্দ্রাব্যবস্থার হঠাৎ কোন সংস্কার তারা করেনি। একই রকম বিজ্যান্টিন মুদ্রা চালু রেখেছে, এমনকি ৬৬০এর দশক পর্যন্ত সরাসরি বিজ্যান্টিন সাম্রাজ্য থেকে তাম্রমুদ্রা আমদানি করেছে। নিজেরা মুদ্রণ শুরু করলেও মানব অবয়ব কিংবা ভিন্নধর্মীয় প্রতীক ব্যবহারের ব্যাপারে কার্পণ্য করেনি। তাতে আরবী অক্ষর আনতেও সময় লাগিয়েছে ত্রিশ বছরের বেশি। এটা রাশিদুন খলীফাদের সময়েও হয়েছে, কিন্তু তারা তাদের নামের কোন চিহ্ন এসব মুদ্রায় রেখে যাননি, যেটা পরবর্তী উমাইয়ারা করেছেন।

মুয়া’বিয়া আর তার পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী ইসলামী ইতিহাসবিদরা, বিশেষ করে শিয়ারা, গুপ্ত খ্রীষ্টান আখ্যায়িত করে। তার একটা মূল কারণ, উমাইয়া সাম্রাজ্যের শক্তির কেন্দ্র ছিল সিরিয়া যেটা প্রাক্তন বিজ্যান্টিন এলাকা, পারস্য-ইরানের নয়। দ্বিতীয় কারণ আলী আর তার পুত্রদের সাথে এদের সংঘাত। আরেকটা কারণ হতে পারে পরবর্তী যুগের ইতিহাসবিদরা এসব মুদ্রা দেখেই সে ধারণায় উপনীত হয়েছেন এবং সেটাই লিখে গেছেন। আসল ব্যাপারটা হল, মুয়া’বিয়া একবার মানবঅবয়ববিহীন স্বর্ণমুদ্রা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সিরিয়ার সভ্য মানুষের কাছে তখনো মুদ্রার ফিয়াত মূল্যের সাথে সম্রাট-ক্রস প্রভৃতির ইমেজ সংযুক্ত। মুয়া’বিয়ার প্রথম প্রচেষ্টার মুদ্রাগুলিকে কেউ গ্রহণ না করায় বাধ্য হয়ে আগের মুদ্রার নকশা ফিরিয়ে আনতে হয় তাকে।

একই প্রসঙ্গে বলা ভাল, শুধু মুদ্রায় নয়। জর্দান ও ইসরাইলের মরুভূমিতে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। সেসবে রয়েছে খুবই হৃদয়গ্রাহী ও প্রাণবন্ত মানুষ ও পশুপাখির মূর্তি। অর্থাৎ, শুধু মু্দ্রায় নয় ব্যক্তিগত জীবনেও উমাইয়ারা ইসলামের বর্তমান স্বীকৃত ট্যাবুর একটি ভেঙেছেন, আর পরবর্তী ধর্মগুরুদের থেকে তাদের ধর্মবিচ্যুতির অভিযোগ একটা খেয়াল করার মত ব্যাপার। আরো উল্লেখ্য, কুরআনে সরাসরি ছবি আঁকা, মূর্তি বানানোর নিষেধাজ্ঞা নেই, যদি না তার উদ্দেশ্য খোদার শরীক করে পূজো করা হয়। এসব ট্যাবুর ভিত্তি হাদীসে, যেগুলি সংকলিত হয় এসব মুদ্রা ও প্রাসাদের পত্তনেরও একশ বছর পর।

জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
জর্দানের কুসাইর আমরার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর দন্ডায়মান খলিফার মূর্তি, পাদানিতে দুইটি সিংহ
প্যালেস্টাইনের পশ্চিম তীরের খিরবাত আল মাফজার উমাইয়া প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ভেতর ফ্রেস্কো ছবি

তৃতীয়ত, চাঁদ-তারা প্রতীক। এ প্রতীক উমাইয়া মুদ্রায় দেখা যায় আর পরবর্তীতে ইসলামী প্রতীক হিসাবেও তার ব্যবহার হয়। কিন্তু এটি আরো পুরনো সিম্বল। বিজ্যান্টিন আর সাসানী দুই সাম্রাজ্যের মুদ্রাতেই চাঁদতারা ব্যবহৃত। আসলে চাঁদ ও তারা, যেটা কিনা আসলে শুক্রগ্রহ, পাগান একটি সিম্বল। রোমান পাগান বিশ্বাসে দেবী ডায়ানার প্রতীক চাঁদ ও তারা। তেমন প্রাচীন মেসোপটেমিয়ান দেবী ইশতারেরও, যেটা চলে এসেছে সাসানী মুদ্রায়। এ বিধর্মী চিহ্নটি কি জেনেশুনে অ্যাডপ্ট করেছিল আদি মুসলিম শাসকরা? আজকাল অনেকে বলে চাঁদ-তারার জন্যে দায়ী অটোমানরা। সেটা অর্ধসত্য, এই মুদ্রাগুলি চাঁদ-তারার আদি গুরুত্বের প্রমাণ।

চতুর্থত, আল ওয়াফা লিল্লাহ। লয়াল্টি বিলংগস টু আল্লাহ। এমন অনুবাক্য কেন অন্য কোথাও আর চোখে পড়ে না? বিসমিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, মুহাম্মাদ রাসুলাল্লাহ, লিল্লাহিল হামদ, ইনিল হুকমু ইল্লা লিল্লাহ, লা হাওলা ওয়া কুওয়াতা…, আল্লাহুস সামাদ… — ইত্যাদি জিকর ও সুরার অংশবিশেষ উমাইয়া আমলের মুদ্রায় দেখা যায়, যেগুলি এখনো সুপরিচিত। কিন্তু আল ওয়াফা লিল্লাহ — এর কোন খোঁজ নেই। কোথা থেকে এল? আর কোথায় গেল? আগে ছিল? আগে থাকলে হারিয়ে গেল কিভাবে?

পরবর্তী উমাইয়া ফালসে মানব অবয়ব না থাকলেও চাঁদ-তারা চলে যায়নি

পঞ্চমত, আরব সেনাবাহিনীতে ইহুদী ও খ্রীষ্টানদের সম্ভাব্য উপস্থিতি। তদকালীন সিরিয়াক-কপ্টিক-গ্রীক ভাষায় লিখিত ইতিহাসবিদদের বিবরণীর কোথাও মুসলিম বা ইসলাম শব্দটি পাওয়া যায় না। তাদের বিবরণীতে নতুন আরব শাসকদের নাম ‘মাহগেরে’ বা মাহগ্রায়ে। কোথাও তায়ী গোত্রের নামে তাইইয়ায়ে। মাহগ্রায়ে শব্দটি আরবী মুহাজির শব্দের অপভ্রংশ। মদীনায় যে আদি মুসলিমরা মক্কা থেকে গিয়েছিলেন তাদের নাম মুহাজির বা স্বেচ্ছানির্বাসিত। ইসলামে এখনও হিজরতের একটা রিচুয়াল সিগনিফিক্যান্স আছে। এখন এরা মুসলিম ছিল নাকি বিভিন্ন ধর্মের আরবের অংশগ্রহণ সেখানে ছিল এটা একটা বিশাল প্রশ্ন।

সোফ্রোনিয়াসের চুক্তিতে ইহুদীদের জেরুজালেমে পুনর্বাসন নিষেধের যে শর্তটা, সেটা কি বিজয়ী আরব সেনাদলে ইহুদীদের অন্তর্ভুক্তির কারণে? নাকি মদিনা আর সংলগ্ন এলাকা থেকে খলীফা উমরের সময় কথিত ইহুদী উচ্ছেদের রিঅ্যাকশন? এখানে উল্লেখ্য, ৬২০-২৮এর সাসানী-বিজ্যান্টিনদের মহাযুদ্ধের অংশ হিসাবে একটি ইহুদী বিদ্রোহও সংঘটিত হয়। বিজ্যান্টিনদের দুর্বলতার সুযোগে সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবাসরত ইহুদীরা প্যালেস্টাইন প্রিমা প্রদেশে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। আরব দিগ্বিজয়ের সময়ে কি এরা তুতো ভাই আরবদের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সৈন্যদল দিয়ে সাহায্য করে? বর্তমান যুগে ইহুদীদেরকে মুসলিম বিশ্ব দু’চোখে না দেখতে পারলেও ইসলামের ইতিহাসের তুলনামূলক অধিক সময়ে তাদের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল, এমনকি তাদের ধর্ম ও দর্শনও ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত হয়। যদি উভয়ে দলবদ্ধ হয়ে সিরিয়া-প্যালেস্টাইনের দখল নেয়, তাতে অবাক হব না। পরের ইসলামী ইতিহাসবিদরা যা লিখে গেছেন, তার অধিকাংশ তাদের সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেল্ফ-সার্ভিং হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। অন্তত সমসাময়িক অনৈসলামী উৎস সেরকমই ইঙ্গিত দেয়।

আজ এ পর্যন্তই। এতগুলি প্রশ্ন করার কারণ এসট্যাবলিশমেন্টকে আঘাত করা নয়, অবজেক্টিভ পদ্ধতিতে ইতিহাস নিরূপণ। আশা করি, পাঠক ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

সিরিয়া ও সাইকস-পিকো

নিচের তিনটি ডাকটিকেট সিরিয়ার জন্মলগ্নের। প্রথমটা আসলে তুর্কী সাম্রাজ্যের, কিন্তু ১৯১৯ সালে এর উপরে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার)। দ্বিতীয়টা ১৯২০এর, নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা এর প্রকাশের উপলক্ষ্য। আর শেষটা ১৯২১এর, আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর এবার ছাঁপ ফরাসীতে — ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার।

তুর্কী সাম্রাজ্যের ডাকটিকেটের উপরে ১৯১৯ সালে ছাঁপ মেরে দেয়া হয়েছে ‘আল-হুকুমাত-আল-আরাবিইয়া’ (আরব সরকার) — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ম্যাপে ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র দেখানো হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে সংঘাতের ভৌগোলিক ব্যাপ্তি যতটুকু ছিল তার থেকে অনেক বেশি ছিল মধ্যপ্রাচ্যের সমরাঙ্গনে। ইউরোপের থিয়েটারে সার্বিয়ার পক্ষ নিয়ে রুশ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে অস্ট্রিয়ার মিত্র জার্মানি ও রাশিয়ার মিত্র ফরাসী-ব্রিটিশরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

সেরকম, তুরস্ক-জার্মানির গোপন আঁতাঁতের পরে একটি জার্মান যুদ্ধজাহাজ তুর্কী সহায়তায় কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ওডেসা বন্দরের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনা ছিল তুর্কী যু্দ্ধমন্ত্রী আনওয়ার পাশার যুদ্ধ বাঁধানোর ষড়যন্ত্র, কারণ সুলতানসহ ওসমানী সরকারের অনেকের যুদ্ধে সায় ছিল না। এরপর রুশদের আহ্বানে আবার সেই ফরাসী-ব্রিটিশদের তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা।

ওসমানী তুর্কী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আরব বিদ্রোহীদল ও তাদের ব্রিটিশ-মিশরী মিত্রদের সিনাই-ফিলিস্তিন সামরিক অভিযানের (১৯১৫-১৮) চিত্র — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

সুয়েজ় প্রণালী সবসময়ই মধ্যপ্রাচ্যের যুধ্যমান সকল পক্ষের চোখের মণি। সুয়েজ়বিজয়ের লক্ষ্যে জার্মান উপদেশ নিয়ে তুর্কীরা সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে। সুয়েজ়ের প্রতিরক্ষার খাতিরে ব্রিটিশ ক্যাম্পেন শুরু করার পাশাপাশি মক্কার ‘শরীফ’ হুসেইন বিন আলীর সাথে গোপন পত্রযোগাযোগ শুরু করেন মিশরের ব্রিটিশ হাই কমিশনার ম্যাকম্যাহন।

১৯২০এর সিরিয়া আরব রিপাবলিকের এই ডাকটিকেটের প্রকাশের উপলক্ষ্য নতুন আরব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

শরীফ হুসেইন ছিলেন বিখ্যাত বনি হাশেম গোত্রের গোত্রপতি । সাতশ বছর ধরে তাঁর বংশ মক্কা ও মদিনার শাসন পরিচালনা করে আসছিল — অবশ্য ওসমানী সাম্রাজ্যের বশ্যতা স্বীকার করে। তাঁর রাজ্যের নাম ছিল হেজাজ়।

বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরপর হেজাজ়ের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ে। তুর্কীদের সাথে হুসেইন বিন আলীর বহুদিনের ভাল সম্পর্ক থাকার পরেও যখন মক্কায় হজ্জ্বযাত্রীদের আগমনে ভাঁটা পড়া শুরু করলো, মিশর থেকে খাদ্যশস্য আসা গেল বন্ধ হয়ে, আর শেষে যখন তিনি খবর পেলেন ওসমানীরা তাঁকে সরানোর মতলব করছে, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রিটিশদের সাথে যোগ দেবার।

১৯২১এর আরব সরকারের ডাকটিকেটের ওপর ফরাসীতে ছাঁপ ও.এম.এফ, ওক্যুপাসিয়োঁ মিলিতের ফ্রঁসেজ়, যার অর্থ ফরাসী সামরিক দখলদার সরকার

তিনি ম্যাকম্যাহনের সাথে চুক্তি করলেন যে তুরস্কের বিরুদ্ধে বেদুইন সৈন্যদলের সাহায্যের বিনিময়ে ব্রিটিশরা উত্তরে হালাব (আলেপ্পো) থেকে দক্ষিণে আদেন পর্যন্ত আরব এলাকায় তাঁকে স্বাধীন রাজ্যগঠনে সমর্থন দেবে। অবশ্য মধ্যোপসাগর তীরের সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত অঞ্চল, আর দক্ষিণ আরবের আদেন-কাতার-কুয়েত ইত্যাদি ইউরোপীয়দেরই থাকবে। হুসেইন আরো দাবি করলেন বেদুইনদের সমর্থন কেনার জন্য লাখ লাখ স্বর্ণমুদ্রা, যাতে ম্যাকম্যাহন রাজি হলেন। (এসময় এই এলাকায় তেল আবিষ্কার হয়নি।) সে চুক্তির পরে টি.ই. লরেন্স বা ‘লরেন্স অফ আরাবিয়া’ ১৯১৬ সালে আরব বিদ্রোহীদের উপদেষ্টা হিসাবে এসে হাজির হন।

এভাবে ঔপনিবেশিক শক্তিদের সহায়তায় আরব স্বাধীনতাকাংক্ষীদের ডি ফ্যাক্টো প্রতিনিধি হয়ে যান হুসেইন। ওসমানী সাম্রাজ্যের মধ্যবিত্ত আরব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা ১৯১৩ সালে প্রথম আরব কংগ্রেসের মাধ্যমে যে আরব জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের সূচনা করেন, রাতারাতি তার রাজনৈতিক ঝান্ডা হাইজ্যাক হয়ে যায়। ওসমানী আরব প্রদেশগুলিতে যেসকল বেদুইন গোত্রের আবাস ছিল, তারাও উৎকোচ নিয়ে তু্র্কীদের সাহায্য করে। অর্থাৎ আরবের নেতা হিসাবে হুসেইন বিন আলীর সমর্থন সব জায়গায় ছিল না। এসুযোগে এক সময় ওসমানীরা মক্কা দখল করে নেয় আর পবিত্র শহরটির বিপুল ধ্বংসসাধন করে।

ম্যাপে দেখানো হেজাজ় রেলওয়ে ছিল ইস্তাম্বুল থেকে মক্কা পর্যন্ত বিস্তৃত ওসমানী সেনাবাহিনীর সাপ্লাই লাইন। ব্রিটিশ ও ফরাসীদের অর্থ ও প্রযুক্তির সাহায্যে হুসেইন বিন আলীর পুত্র ফয়সাল এই রেললাইনের ওপর চোরাগোপ্তা মাইন হামলা, লুটতরাজ শুরু করেন। তাঁর গেরিলাদল ছিল ট্রাইবাল বেদুইন আর ওসমানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধবন্দী আরবদের নিয়ে সংগঠিত। টি.ই. লরেন্স ছিলেন যুদ্ধ পরিকল্পনায় তাঁর শরিক। পূর্বদিকে ফয়সালের এক ভাই আব্দুল্লাহ তুর্কী মিত্র রাশিদীদের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করেন। আরেক ভাই আলী দক্ষিণে মদিনায় তুর্কীদের ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন।

এভাবে হেজাজ় রেলওয়ে ধরে ধীরে ধীরে উত্তরদিকে অগ্রসর হয় আরব সেনাদল। ফয়সাল একে একে জেদ্দা, ইয়ানবো, আকাবা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ নগর জয় করেন। অন্যদিকে মিশর থেকে ব্রিটিশ-ফরাসী ফৌজও সিনাই হয়ে ফিলিস্তিন-লেবাননে ঢুকে পড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ১৯১৮এর সেপ্টেম্বরে ব্রিটিশ ঈজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স সিরিয়ার দামেস্ক দখল করে নেয়। ফয়সালও তাদের পিছু পিছু দামেস্কে প্রবেশ করে আরবদের জন্যে স্বাধীন রাজ্য ঘোষণা করেন। সে রাজ্যে ধর্মনির্বিশেষে সকল আরবদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।

কিন্তু এর পরপরই ফয়সাল ও হুসেইন একের পর এক দুঃসংবাদ পাওয়া শুরু করলেন। জানতে পারলেন ১৯১৭তে ব্রিটিশদের ঘোষিত বালফুর ডিক্লারেশনের কথা — যাতে ফিলিস্তিনের অংশবিশেষে ব্রিটিশ ম্যান্ডেটে ইহুদীদের জন্যে আবাসস্থল প্রতিষ্ঠার অধিকার স্বীকৃত হয়। আরো তাঁদের কানে এলো ব্রিটিশ-ফরাসীদের গোপন সাইকস-পিকো চুক্তির কথা। এর শর্তানুযায়ী সিরিয়া-লেবানন আর ইরাক হবে যথাক্রমে ফ্রান্স আর যুক্তরাজ্যের ঔপনিবেশিক বলয়ের অংশ, স্বাধীন আরব বাসভূমি নয়। ব্রিটিশদের প্রতিশ্রুতিভঙ্গে বিশ্বাস হারালেন না অবশ্য ফয়সাল। ভাবলেন, সাইকস-পিকোর বাস্তবায়ন হবে যুদ্ধের সমাপ্তিতে, ততদিনে তিনি ব্রিটিশদের মত পরিবর্তন করতে সক্ষম হবেন।… এর এক মাস পরেই অক্ষশক্তি আত্মসমর্পণের ফলে যুদ্ধের যবনিকাপাত হয়ে যায়।

যুদ্ধের পরে তুরস্কের দখলকৃত এলাকাগুলির কি হবে সে নিয়ে প্যারিসে মিত্রশক্তির আলোচনা বসে। তাতে যোগ দেন ফয়সাল। মার্কিনরা ব্রিটিশ আর ফরাসীদের রাজি করায় স্বাধীন কিং-ক্রেইন কমিশনের মাধ্যমে ফয়সালের সমস্যাটি সমাধান করতে। সে কমিশন ১৯২০এ সিরিয়ায় এসে পৌঁছায় এবং বিভিন্ন শহরে গিয়ে আরব জনগোষ্ঠীর মতামত নেয়া শুরু করে। তাদের মতে পৌঁছতে বছর খানেক সময় লাগে। শেষ পর্যন্ত যখন সে কমিশনের রিপোর্টও এল যে এসব এলাকার অধিকাংশ অধিবাসী কোন না কোন প্রকার স্বাধীনতা চায় আর এদের সকলে স্বাধীন আবাসভূমির যোগ্য না হলেও সিরিয়াতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব, ততদিনে ব্রিটিশ-ফরাসীরা কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছে, আর লীগ অব নেশন্সের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে সাইকস-পিকো চুক্তির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি বাগিয়ে ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্র লীগের সদস্য হয়নি, কংগ্রেসের বাগড়া দেয়ার কারণে। তাই কিং-ক্রেইন কমিশনের রিপোর্টও বস্তাবন্দি হলো।

এসব ঘটনার বিপরীতে সিরিয়ায় ফয়সালপন্থী বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। লেবাননের ম্যারোনাইট খ্রীষ্টান আর দক্ষিণ সিরিয়ার দ্রুজরা অবশ্য ফয়সালবিরোধী ছিল। ফরাসীরা সেনাদল পাঠিয়ে জোরপূর্বক নিজেদের ম্যান্ডেট প্রতিষ্ঠা করে। তাদের সাথে এক দফা যুদ্ধে ফয়সালের সেনাদল পরাজিত হয়। ফয়সাল হার মেনে যুক্তরাজ্যে নির্বাসন চলে যান। এখানে শুরু হয় তৃতীয় ডাকটিকেটটির ইতিহাস।

অবশ্য ফয়সালকে বেশিদিন রাজ্যবিহীন রাজা থাকতে হয়নি। ব্রিটিশরা তাদের ম্যান্ডেটরাজ্য ইরাকে তাঁকে রাজসিংহাসনে বসায়। আর ট্রান্সজর্ডান ম্যান্ডেটের রাজা হন তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ। হেজাজ় রাজ্যে তাঁদের বড় ভাই আলী কিছুদিন রাজা থাকার পর সৌদী আক্রমণের মুখে ১৯২৫এ তাঁকে গদি ছাড়তে হয়। সেখানে শুরু হয় ইতিহাসের নতুন এক পাতা।


(১) মিডল ঈস্ট থিয়েটার ছিল পাঁচটি সমরাঙ্গন জুড়ে: সিনাই-ফিলিস্তিন, মেসোপটেমিয়া, ককেশাস, পারস্য, আর গালিপোলি। মেসোপটেমিয়া বা ইরাক অভিযানে বিপুলসংখ্যক ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা অংশগ্রহণ করে। বিদ্রোহী কবি নজরুল এ যুদ্ধে যোগদানের জন্যে লাহোর সেনানিবাসে প্রশিক্ষণ নেন, কিন্তু সে যুদ্ধক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তাঁকে যেতে হয়নি। [Middle Eastern theatre of World War I]

(২) ইজিপশান এক্সপেডিশনারি ফোর্স বা ই.ই.এফ. ছিল মিশরভিত্তিক ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, ফ্রান্স ও ইতালীর সম্মিলিত সেনাদল। কমনওয়েলথ সেনাদলের অস্ট্রেলীয় ও নিউজিল্যান্ডার কোরের ডাকনাম আনজ়াক — এরা গালিপোলি সমরাঙ্গনে সাহসিকতার সাথে লড়ে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আরেক ক্যাজুয়াল্টি ছিল মিশর। ১৮৬৭ থেকে নামে মাত্র তুরস্কের অধীন ছিল মিশরের স্বাধীন শাসক খদিভরা, ইউরোপীয়দের সাথে তাদের ভাল সম্পর্ক ছিল। ১৯১৪ সালে খদিভ আব্বাসকে অপসারণ করে ব্রিটিশরা সরাসরি মিশরের শাসন ক্ষমতা দখল করে, এর মূল কারণ ছিল ভারতের সাথে যোগাযোগের অবলম্বন সুয়েজকে রক্ষা করা। [Egyptian Expeditionary Force]

(৩) মক্কার শরাফা বা আমিরাত, এ ছিল হুসেইন বিন আলীর রাজ্যের আনুষ্ঠানিক নাম। হেজাজ়ের আগে এটি সার্বভৌম রাজ্য ছিল না। ৯৬৮ থেকে ১৯২৫ পর্যন্ত এই রাজ্যটি নানা আকারে বহাল ছিল। [Sharifate of Mecca]

(৪) বনি হাশেম গোত্র প্রাচীন কুরাইশ বংশের অন্তর্গত, এর নাম হযরত মুহম্মদের(স.) প্রপিতামহের নামে। অর্থাৎ হুসেইনের একটা ধর্মীয় বংশগত মর্যাদা ছিল। তিনি সৌদী ছিলেন না। সৌদীরা এসময় ছিল মরুভূমির সীমিত গুরুত্বের বেদুঈন গোত্রমাত্র। আর তাদের শত্রুতা ছিল হুসেইনের সাথে। হুসেইনের তিন পুত্র আলী, ফয়সাল ও আবদুল্লাহ পর্যায়ক্রমে হেজাজ, সিরিয়া-ইরাক আর জর্দানের রাজা হন। ১৯২৫এ ইবন সৌদ নজদ রাজ্য থেকে আক্রমণ চালিয়ে হেজাজ় দখল করে নিয়ে সৌদী আরব রাজ্যের সূচনা করেন। আলী জর্দানে ফিলিস্তিন আততায়ীর হাতে মারা যান ১৯৫১তে। আর ফয়সালের পৌত্র ইরাকের রাজা দ্বিতীয় ফয়সাল মিলিটারি কুতে ১৯৫৮ সালে নিহত হন। এখন একমাত্র জর্দানে হাশেমী রাজত্ব চলছে। ব্রিটিশদের বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে অনেকদিন হুসেইন ক্ষিপ্ত ছিলেন। তাঁর পুত্রদের রাজমুকুট পড়িয়েও ব্রিটিশরা তাঁর রাগ ভাঙ্গাতে পারেনি। শেষে তাঁকে ছেড়ে সৌদবংশের সাথে মিত্রতাচুক্তি করে ব্রিটিশরা। [Hussein bin Ali, Sharif of Mecca]

(৫) টমাস এডওয়ার্ড লরেন্স তাঁর ডাকনাম অর্জন করেন ব্রিটিশ খবরের কাগজে আরব বেদুঈনদের স্বাধীন একরোখা জীবনের রোমান্টিক চিত্র অঙ্কন করে। গুপ্তচর-কূটনীতিক-সেনাপ্রধানের পাশাপাশি শখের প্রত্নতত্ত্ববিদও ছিলেন। ১৯৬২তে তাঁর জীবনের ঘটনা নিয়ে তৈরি অনবদ্য ব্রিটিশ চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের রূপ দেন অভিনেতা পিটার ও’টুল। ফয়সালের সাথে তাঁর ভাল সখ্য থাকলেও বাকি দু’ভাইকে খুব একটা ভাল চোখে দেখেননি লরেন্স। [T. E. Lawrence]

(৬) (৬) ওসমানী সাম্রাজ্যের আরবদের জাতীয়তাবাদ ভারতীয়দের তুলনায় অধুনার ধারণা। ১৯০৮এ বিপ্লবের মাধ্যমে তুরস্কের শাসনক্ষমতা নেয় ইয়াং টার্ক বলে একদল প্রগতিশীল কর্মজীবী নেতা। তাদের শাসনামলে সংসদীয় প্রথার পুনর্প্রবর্তন হলেও বেশিরভাগ মানুষের জীবনে তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। তার ওপর বাল্কানের যুদ্ধের ডামাডোল। ফলে ১৯১৩তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে তিন পাশার ত্রিনায়কতন্ত্র। প্রতি ক্ষেত্রেই তুর্কীরা স্বহস্তে ক্ষমতা কুক্ষিগত করায় ইউরোপে অবস্থানরত একদল বীতশ্রদ্ধ আরব শিক্ষার্থী ১৯১৩তে প্যারিসে একটি আরব কংগ্রেস ডাকে। এতে ওসমানী সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন, সিরিয়া, মিশর প্রভৃতি এলাকার বুদ্ধিজীবীরা যোগ দেয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে আরবদের সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়, বরং স্বাধিকার। ফিলিস্তিনে তুর্কী অভিবাসন আইনের সদ্ব্যবহার করে ইহুদীদের আগমন আর ব্রিটিশ-ফরাসীদের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ছিল আরবদের সংগঠিত হবার আরেক কারণ। আরব কংগ্রেস থেকেই মুসলিম ব্রাদারহুড, বাথ পার্টি, ফ্রী অফিসারস, প্রভৃতি মুভমেন্টের ধারার বিবর্তন। অর্থাৎ হাশেমী-সৌদী রাজতন্ত্রের ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। বলা বাহুল্য, এসময় অধিকাংশ অশিক্ষিত বেদুঈন গোত্রীয় যোদ্ধার দল এত কিছু বুঝত না। প্রাচীনকালের নিয়মানুযায়ী যে দল বেশি উৎকোচ দিত, তাদেরই পক্ষ নিত তারা। [Arab Congress of 1913]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!