শত্রু যখন মিত্র


সময়ঃ ২২শে জুন ১৯৪১ রাত ৩টা। স্থানঃ রাশিয়ার বাল্টিক থেকে রোমানিয়ার কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ১,৮০০ মাইলের সীমান্ত। জার্মানি, ইতালি, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও হাঙেরি থেকে ৩৬ লাখ সৈন্য, ৩,৩৫০ ট্যাংক, ৭,২০০ আর্টিলারি, ৭ লাখ ঘোড়ায় টানা সাপ্লাই ওয়াগন, ২,৭৭০ এয়ারপ্লেন পূর্বঘোষণা ছাড়াই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়নের পোলিশ ও ইউক্রেনীয় এলাকায়। শুরু হল অপারেশন বারবারোসা।

নাৎসিবাহিনীর এই আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় সেকালের সর্ববৃহৎ সামরিকবাহিনী। বোমারু ব্লিৎজক্রিগে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তারা। মস্কোর সাথে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়। ১০ দিনের মধ্যে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হয় ৪০০ মাইল, দখল হয় মিনস্ক, বন্দী হয় ৪ লাখ রুশ সেনা, ওদেসা-কিয়েভে শুরু হয় মাসব্যাপী অবরোধ।

উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান পানৎসার ডিভিশন, জুন ১৯৪১
উত্তর রাশিয়ায় মুরমানস্ক রেললাইন অতিক্রম করছে ফিনিশ সেনা, অক্টোবর ১৯৪১
২২শে জুন থেকে ২৫শে আগস্টের মধ্যে রাশিয়ায় অক্ষশক্তির আক্রমণের চিত্র

পুরো অপারেশনে বন্দী ৫০ লাখের অধিকাংশ আর ঘরে ফেরেনি। দিনে ৪০ হাজার করে তাদের মৃত্যু ঘটে। ৯০ শতাংশ রুশ মেকানাইজড ব্যাটালিয়ন ধূলিসাত হয়ে যায়। জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ট্যাংকই ধ্বংস হয় ১৫ হাজার। দেড় হাজার প্লেন ধ্বংস হয়, দুই তৃতীয়াংশ টারমাকে পার্ককরা অবস্থাতেই। ২ কোটি সোভিয়েত নাগরিক রাতারাতি আবিষ্কার করে তারা বাস করছে অন্য জগতে। এদের অনেকেই জার্মানদের মুক্তিদাতা হিসাবে স্বাগত জানায়।

রেড ৎসার স্তালিন স্বয়ং নার্ভাস ব্রেকডাউনের দ্বারপ্রান্তে। অনাগ্রসন চুক্তি সইয়ের দু’বছর পুরো না হতেই নাৎসি বাহিনী তাকে আক্রমণ করবে, ভাবনাতেও আসেনি তার। ব্রেস্ত থেকে সেবাস্তোপোল পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, কিন্তু জার্মান অফিশাল ঘোষণা না আসা পর্যন্ত প্রতি-আক্রমণের নির্দেশ এল না তার কাছ থেকে। কৃষ্ণসাগরের দাচায় গিয়ে সমানে ভদকা গিলছেন তিনি। কমান্ডার ইন চীফ হিসাবে আসীনও হলেন না। রুশদের কাছে রেডিওতে খবর ভাঙলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মলোতভ, স্তালিন নয়।

টারমাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ফাইটার প্লেন, ১৯৪১
অপারেশন বারবারোসায় জার্মানদের হাতে যুদ্ধবন্দী লালবাহিনীর সৈনিক, ১৯৪১
জার্মান যুদ্ধবন্দীশিবিরের দিকে হেঁটে চলেছে আত্মসমর্পণকৃত সোভিয়েত সৈন্য, ১৯৪১
লাটভিয়ার রিগাতে জার্মান সৈন্যরা পায় মুক্তিদাতার সাদর আপ্যায়ন, জুলাই ১৯৪১
জার্মানি ও অক্ষশক্তির দেশগুলির সোভিয়েত আক্রমণের খবর পাবার মূহুর্তে স্তালিন, ১৯৪১

যখন স্তালিনের আদেশ আসল, সেটা জায়গায় থেকে হানাদার আক্রমণ প্রতিহত করার। কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করা যাবে না। কোণঠাঁষা স্বল্পশিক্ষিত সৈন্যদলগুলিকে পিছু হটতে বারণ করা হল। ফল হল লাখে লাখে রুশ যুদ্ধবন্দী।

কিভাবে এমনটা হল? এর পূর্ববর্তী এক দশকে রাশিয়া তো পরিণত হয়েছিল শিল্পায়িত দানবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈন্যদল তাদের। এমন চকিত পরাজয় ঘটল কেন?

ফাস্ট রিওয়াইন্ড, ১৯৩৭ সাল। মস্কোতে গোপন বিচার বসেছে লালবাহিনীর মার্শাল তুখাচেভস্কিসহ সাতজন জেনারেলের। তুখাচেভস্কি যেনতেন লোক নন, যুদ্ধ উপমন্ত্রী। অভিযোগ, এরা জাপান ও জার্মানির সাথে সোভিয়েতবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। খুব দ্রুত তাদের অপরাধ প্রমাণ করে দিল ট্রিবুনাল, সাক্ষ্য দিল তাদের নিকট সহকর্মীরা। মৃত্যুদন্ড হল শাস্তি।

আসলে যেসকল সাক্ষী ছিল, তাদেরকে অত্যাচার করে নয়ত ব্ল্যাকমেল করে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছিল। এসব বেরিয়েছে নব্বইপরবর্তী যুগে পুরনো সোভিয়েত আর্কাইভ ঘাঁটিয়ে। এই ক্যাঙ্গারু কোর্টের কারণ আর কিছুই নয়, স্তালিনের সন্দেহবাতিক।

বিশের দশকের শেষভাগে স্তালিন অন্যান্য বলশেভিক নেতাদের ঘাঁড় ভেঙে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন লিওন ত্রতস্কি। দু’জনের মধ্যে নানা ব্যাপারে টক্কর লেগে থাকত। মূল আদর্শগত সংঘাত ছিল বিশ্বে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া নিয়ে। ত্রতস্কি তার পক্ষপাতী, স্তালিন তার বিরোধী। ত্রতস্কির নির্বাসন হয় ১৯২৯ সালে।

কিন্তু, স্তালিনের মনে সবসময় সন্দেহ ছিল ত্রতস্কিপন্থীরা লুকিয়ে আছে তারই পার্টির মাঝে। পার্টি আর সেনানেতৃত্বের মাঝে থেকে কেউ ষড়যন্ত্র করছে তাকে সরাতে। ১৯৩৪ সালে এক জনপ্রিয় নেতা কিরভের গুপ্তহত্যার পর তার মনে সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের সেই সন্দেহ থেকে অগণিত কম্যুনিস্ট পার্টি সদস্যের ওপর নেমে আসে মৃত্যুর খাঁড়া। তুখাচেভস্কির শো ট্রায়াল ছিল এরই অংশ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা, মাঝে স্তালিন, সর্বডানে নিগৃহীত মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মার্শাল তুখাচেভস্কি
মেক্সিকোতে সর্বশেষ ঠিকানা হয় নির্বাসিত সোভিয়েত নেতা লিওন ত্রতস্কির, সাথে স্ত্রী নাতালিয়া, পেছনে চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কালো, ১৯৩৭
স্তালিনের গ্রেট পার্জের শিকার আসামীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ পড়ে শোনানো হচ্ছে, ১৯৩৬
১৯৩৭ সালে মস্কো খাল উদ্বোধনকালে স্তালিনের পাশে ছিলেন গুপ্তপুলিশপ্রধান ইয়েষভ। পরের বছর পার্জে তারই প্রাণ যায়। ছবি থেকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় তাকে।

গর্দান গেল লালবাহিনীর প্রথমদিককার এসকল নায়কোচিত নেতৃত্বের। গুলাগে কারাদন্ডে যায় আরো অসংখ্য জেনারেল-কর্নেল। ১৯৩৮ নাগাদ প্রায় ৩৮ হাজার লালবাহিনী সদস্য হয় চাকরিচ্যুত, এদের ২৩ হাজারের হয় মৃত্যুদন্ড। এই গ্রেট পার্জের শেষে দেখা গেল, ৫ জন সোভিয়েত মার্শালের ৩ জন লাপাত্তা। ১০১ জেনারেলের ৯১ গ্রেপ্তার, ৮০জন মৃত। ৮০ শতাংশ কর্নেল শেষ। নেভির ৯ অ্যাডমিরালের ৮জন আর নেই। এই রেড টেররে দেশব্যাপী মারা যায় সর্বমোট ১৩ লাখ।

যে লালবাহিনী ছন্নছাড়া চাষা-শ্রমিক বিপ্লবীদের দঙ্গল থেকে ত্রিশের দশক নাগাদ পরিণত হয়েছে ১৩ লাখের প্রশিক্ষিত সেনাদলে, যে বাহিনীতে সংযুক্ত হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক মেকানাইজড আর্মার্ড ব্রিগেড, সে বাহিনী হয়ে পড়ল যোগ্য নেতৃত্বশূন্য, অদক্ষ, মনোবলহীন, রাজনৈতিক আটাশে ও গুপ্তচর দিয়ে ভর্তি। বিমান ও নৌবাহিনীর অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। সামরিক সরঞ্জাম ছিল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো।

কিয়েভে লালবাহিনীর ৪৫তম মেকানাইজড কোরের মহড়া, ১৯৩৫
বৃহত্তম সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করছে ক্রেমলিনে, ১৯৪১

হিটলারের সাথে ষড় করে ১৯৩৯এর সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেবার পর পর নভেম্বরে এ সেনাবাহিনী নিয়েই স্তালিন আক্রমণ করে বসেন ফিনল্যান্ডকে। উদ্দেশ্য, প্রাক্তন রুশ এ কলোনিকে আবার কব্জা করা। বাল্টিকের দেশগুলিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। কিন্তু ফিনল্যান্ডে আশাতীতরকম মার খায় লালবাহিনী। ৩ গুণ কম সৈন্য আর ৩০ গুণ কম বিমানের ফিনিশ বাহিনী বিশাল সোভিয়েত সেনাদলকে ফিনিশ করে দেয় উইন্টার ওয়ারে। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে মুখ বাঁচানো শান্তিচুক্তি করেন স্তালিন।

হিটলারের আর বুঝতে বাকি থাকে না লালবাহিনীর আসল হাল। এখানেই আরম্ভ আমার আর্টিকেল।

স্তালিন যথেষ্ট সাবধানবাণী পেয়েছিলেন চার্চিল-রোজাভেল্টের কাছ থেকে। কিন্তু সেগুলি গা করেননি। তার ধারণা ছিল ব্রিটেনের সাথে জার্মানির যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। সময় পাবে সোভিয়েতরা। যা হল, তার জন্য আসলেই প্রস্তুত ছিল না রুশরা। অথচ এ পর্যন্ত অনাগ্রসন চুক্তির খাতিরে খোদ জার্মানিকেই টনকে টন গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও খাদ্যশস্য রপ্তানী করে এসেছে তারা। দুধকলা খাইয়ে সাপ নয়, ড্রাগন পোষা যাকে বলে!

২৩শে আগস্ট ১৯৩৯, অনাগ্রাসন চুক্তি স্বাক্ষর করছেন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোতভ। পেছনে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ, আর স্তালিন। এর গোপন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের ছোট স্বাধীন দেশগুলি তারা ভাগাভাগি করে নেয়।
জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের দুই সপ্তাহের মাথায় সোভিয়েতরাও পূর্ব পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, দুই বাহিনীর কমান্ডারের করমর্দনের চিত্র, সেপ্টেম্বর ১৯৪১
উইন্টার ওয়ারে ফিনিশদের হাতে যুদ্ধবন্দী ক্যামোফ্লাজবিহীন লালবাহিনীর সৈন্য, ১৯৩৮-৪০
নাৎসি জার্মানির সর্বমোট আমদানির শতাংশ হিসাবে সোভিয়েত থেকে আমদানির চিত্র

খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হল রুশ নেতৃত্বকে। জার্মানির হাতে পড়ার ভয়ে বিশাল সব ফ্যাক্টরিগুলি খুলে খুলে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হল উরাল পর্বতের পূর্বে। আর যেগুলি নেয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে খামার ও কৃষি সরঞ্জাম, সেগুলি পোড়ামাটি নীতি ধরে ধ্বংস করে দিয়ে পিছু হটল লালবাহিনী।

রাজনৈতিক আটাশেদের সরানো হল, লালবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হল সামরিক র‍্যাংক আর ডেকোরেশন। অর্থডক্স চার্চকে পুনরিজ্জীবিত করা হল সাধারণ মানুষের মনোবল ফিরিয়ে আনতে, তারা আশীর্বাদ করতে শুরু করল অস্ত্রধারী রিজার্ভ সৈনিকদের। তৈরি হল গুলাগের বন্দীদের ব্যাটালিয়ন। যুদ্ধক্ষেত্রে পলায়নের শাস্তি হল তাৎক্ষণিক মৃত্যুদন্ড।

মস্কোর প্রতিরক্ষার জন্য বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল। অদম্য তরুণ নেতৃত্বের কারণে সে যাত্রা মস্কো বেঁচে গেল।

কিন্তু রসদ বেশি অবশিষ্ট নেই। জার্মানির দখলে বিশাল শিল্পায়িত এলাকা আর ফসলী জমির ৪০ শতাংশের বেশি। চাষাবাদের যন্ত্র আর পশুরও ৫০ শতাংশ। বাকি জনগণ কৃষিজমির বদলে যুদ্ধক্ষেত্রে শামিল। কে করবে চাষাবাদ?

উরাল পর্বতের অপর পারে স্থানান্তরের জন্য আলাদা করে রাখে সোভিয়েত কারখানার যন্ত্রাংশ, ১৯৪১
পোড়ামাটি নীতির অংশ হিসাবে রুশরা লেনিনগ্রাদের নিকটস্থ একটি গ্রাম ধ্বংস করে দিচ্ছে, ১৯৪১
উপায়ান্তর স্তালিন সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু অর্থডক্স চার্চকে পুনর্বাসিত করেন, তারা যুদ্ধগামী সেনাদের আশীর্বাদ প্রদান করে, ১৯৪১-৪৩
মস্কোর সন্নিকটে ট্যাংকবিরোধী ব্যারিকেড, অক্টোবর ১৯৪১

সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ক্রান্তিলগ্নে দ্রুত পাশে এসে দাঁড়ায় তাদের এতদিনের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

হ্যাঁ, অস্তিত্বসংকটাপন্ন ব্রিটেনের অন্তত সেকেন্ড ফ্রন্ট দরকার ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তখনও পার্ল হারবার আক্রমণ হয়নি। তখনও কংগ্রেস মিত্রবাহিনীকে সরাসরি অস্ত্র ও অর্থসাহায্য দেবার বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় রোজাভেল্ট কংগ্রেসের একটা বড় অংশের সহায়তায় পাশ করলেন লেন্ড লীজ বিল। মার্চ ১৯৪১এ, বারবারোসার আগেই। এই বিলের লক্ষ্য, মিত্রবাহিনীর দেশগুলিকে এমন অস্ত্র সাহায্য দেয়া, যেটা যুদ্ধে ধ্বংস হলে আর দাম দিতে হবে না। যদি ধ্বংস না হয়, তাহলে ফেরত আসবে নয়ত ব্যবহারকারীরা কিনে নেবে। এ ছিল রোজাভেল্টের সাথে রিপাবলিকানদের কমপ্রমাইজ।

প্রথমে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও প্রজাতন্ত্রী চীন এ বিলের আওতায় সাহায্য পায়। বারবারোসার পর যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের শেষ নাগাদ সর্বমোট ৫০ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য যায়, আজকের মুদ্রামানে ৮০০ বিলিয়ন। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটের ১৭ শতাংশ এটি।

৫টি পথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ১৭ মিলিয়ন টন রসদ আসে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এক, কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে ইরান ও ককেশাসের ভেতর দিয়ে। দুই, ভূমধ্যসাগর ও বসপোরাস প্রণালী ধরে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলিতে। তিন, নরওয়ের উত্তরে আর্কটিক সাগরের বন্দর মুরমান্সক ও আর্খেনগেল্সকে। চার, সোভিয়েতের সাথে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে আবদ্ধ জাপানের ৎসুশিমা প্রণালী ধরে ভ্লাদিভস্তকে। আর পাঁচ, বেরিং প্রনালী অতিক্রম করে চুকোতকা উপদ্বীপে।

লেন্ডলীজ অ্যাক্ট সই করছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোজাভেল্ট, মার্চ ১৯৪১
সোভিয়েতমুখী লেন্ডলীজ রুটের চিত্র

মার্কিন সাহায্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৩০ হাজার রেডিও সেট, ৩,৪৪,০০০ টেলিফোন-টেলিগ্রাফ, ১২ লাখ মাইলের তার, সাড়ে ৪ লাখ বিভিন্ন সাইজের ট্রাক, ৩৪ হাজার মটরবাইক, ১১ হাজার রেলকার, ২ হাজার রেল ইঞ্জিন, সাড়ে ৮ হাজার ট্র্যাক্টর, ১৪ হাজার প্লেন ও হেলিকপ্টার, ১ হাজার কন্স্ট্রাকশন ইকুইপমেন্ট, ৫০ হাজার প্যানেলের রানওয়ে ম্যাট, আর একেবারে নতুন ব্রিটিশ প্রযুক্তির রেডার।

লালবাহিনীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিশাল ফ্রন্টলাইনের যোগাযোগ ও লজিস্টিকস। সোভিয়েত প্রযুক্তির রেডিও ছিল খুবই অকার্যকর। মার্কিন রেডিও-টেলিগ্রাফ-টেলিফোন ছিল উচ্চমানের। ফ্রন্টলাইনে রসদ নিয়ে যাবার মত যথেষ্ট ট্রাক সোভিয়েতদের ছিল না। এসময় মার্কিন ডজ ও স্টুডেবেকার ট্রাক হয়ে দাঁড়ায় লালবাহিনীর নির্ভরযোগ্য বাহন। স্টুডেবেকারের ওপর কাতিয়ুশা রকেট লঞ্চার লাগালে সেগুলি পরিণত হত মোবাইল আর্টিলারিতে। যুদ্ধকালীন সময়ে রেল পরিবহন ব্যবস্থার এক তৃতীয়াংশ, আর রেললাইনের ৯৩ শতাংশ স্টীল আসে লেন্ডলীজ থেকে। বমার-ফাইটার-ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটের ৩০ শতাংশ ছিল মার্কিননির্মিত।

মার্কিন খাদ্য ও জ্বালানিতেল রাশিয়ায় যায় যথাক্রমে ৪৫ লাখ টন ও ২৭ লাখ টন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্ষমতা ছিল না স্থানীয়ভাবে এত উৎপাদনের। এছাড়াও সাড়ে ৭ হাজার মার্কিন ও ৫ হাজার ব্রিটিশ ট্যাংক আসে। পূর্ব ফ্রন্টের যুদ্ধক্ষেত্রের ১৬ শতাংশ ট্যাংক আসে লেন্ডলীজ থেকে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফট, অ্যান্টিট্যাংক, আর্টিলারি মোটর ক্যারেজ ২ হাজার। ফীল্ড গান, অ্যান্টিট্যাংক গান, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান ৭,১০০। মর্টার ও মেশিনগান ১১ হাজার। সাবমেশিনগান ও স্মল আর্মস দেড় লাখ। কামানের গোলা ৮০ লাখ রাউন্ড। এএ রাউন্ড ৮৩ লাখ। মর্টার রাউন্ড সাড়ে ৩ লাখ। স্মল আর্মস রাউন্ড ১১ লাখ। ৯০টি কার্গো শিপ, ১০৫টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার শিপ। অগণিত বিস্ফোরক ডায়নামাইট, টিএনটি, ডেটোনেটর। ফোর্ডের পুরো একটি টায়ার প্ল্যান্ট তুলে নিয়ে এসে পুনর্স্থাপন করা হয় উরালে।

যুক্তরাজ্য থেকেও ৫ হাজার মাটিল্ডা ট্যাংক পাঠানো হয়, ১৯৪১
মার্কিন শারম্যান ট্যাংকে করে চলেছে লালবাহিনী, ১৯৪৩
রাশিয়ার বেলগরদ শহরে মার্কিন ট্যাংকের সাথে রুশ সৈন্য, ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩
মার্কিন স্টুডেবেকার ট্রাকের ওপর চাপানো কাতিউশা লঞ্চার থেকে রকেট ছুটছে, ১৯৪২
ককেশাসে মার্কিন লেন্ডলীজ ট্রাক ও অ্যান্টিট্যাংক গানের সাথে সোভিয়েত সৈন্য, সেপ্টেম্বর ১৯৪২
মার্কিন লেন্ডলীজ ডগলাস হ্যাভক বোমারু বিমানের সাথে সোভিয়েত ক্রু
সিনসিনাটি শহরের ক্রোগার বেকারিতে মার্কিন কর্মীরা ক্যান করছে সোভিয়েত লেন্ডলীজের খাদ্য, জুন ১৯৪৩
বি-১৭ ফ্লাইং ফর্ট্রেস বোমারু বিমানের গোলার সামনে করমর্দনরত সোভিয়েত ও মার্কিন বৈমানিক, ১৯৪৪
ইরানের দুর্গম পাহাড়ী গিরিসংকটের রাস্তা দিয়ে যেত সোভিয়েতের উদ্দেশ্যে মার্কিন লেন্ডলীজ সাহায্য
ইরানের পারসিয়ান করিডর দিয়ে ৭,২০০ ট্রাকে করে সোভিয়েতে যেত মার্কিন সাহায্য
ইরানের আবাদান এয়ারফীল্ড থেকে মার্কিন যুদ্ধবিমান বুঝে নিত সোভিয়েত বৈমানিকের দল

রুশদের দেয়া মার্কিন এই সাহায্যের মু্দ্রামান সে সময়ে ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার, বর্তমান যুগের ১৮০ বিলিয়ন। ব্রিটেন লেন্ডলীজের ৫৮ শতাংশ সাহায্যের ভাগীদার ছিল আর দ্বিতীয় স্থানের ২৩ শতাংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের। বিনিময়ে এরা যুক্তরাষ্ট্রকে কি দিয়েছিল?

যুক্তরাজ্য থেকে অত্যাধুনিক কিছু প্রযুক্তি আসে যুক্তরাষ্ট্রে, যার মধ্যে পড়ে রেডার, সাবমেরিন ডিটেকশন, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপিক গানসাইট, ম্যাগনেট্রন, প্লাস্টিক এক্সপ্লোজিভ প্রভৃতি। যুদ্ধশেষে অবশিষ্ট যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ যুক্তরাজ্য কিনে নেয় ৯০ শতাংশ ছাড়ে। সে বাবদ ১.১ বিলিয়ন পাউন্ডের কর্জ পরিশোধ করে ২০০৬ সালে।

আর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায় প্রচুর কাঁচামাল — ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, প্লাটিনাম, স্বর্ণ, কাঠ। সেসবের হিসাব মিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাওনা দাবি ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলার। সোভিয়েত ইউনিয়ন দর কষাকষি করে দিতে চায় মোটে ১৫০ মিলিয়ন। শেষ পর্যন্ত ৭০০ মিলিয়নে রফা হয় ১৯৭২ সালে। বাকি পাওনা মাফ করে দেয়া হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের আর্জি মেনে স্তালিন কমিনটার্ন নামের ইতিমধ্যে অকার্যকর আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট সংগঠনটিকে অফিশালি বন্ধ করে দেন।

গত পোস্টে বর্ণিত দ্রুত শিল্পায়ন সোভিয়েতকে এ যুদ্ধে যতটুকু সাহায্য করার কথা ছিল, সেটা যে হয়নি নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না! সোভিয়েত বাহিনীর প্রযুক্তি ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব ছিল লক্ষ্যনীয়। তুখাচেভস্কির বাতলে দেয়া ডীপ অপারেশনস থিওরির প্রয়োগ করা হয় অনেক দেরিতে। এমনকি বারবারোসা শুরুর এক সপ্তাহ আগেও ৩০০ অফিসারকে পার্জ করা হয়। পোল্যান্ডে নির্মানাধীন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জার্মানদের থামাতে যথেষ্ট টেকসই ছিল না।

কিন্তু স্তালিনের ভাগ্য সহায় যে জাপান নিরপেক্ষতা বজিয়ে রাখে। প্রখর রুশ শীত জার্মানদের কাঁদার পাঁকে ফেলে। আর কোটি কোটি সোভিয়েত নাগরিক বিনা বাক্যব্যয়ে অস্ত্র তুলে নেয়, প্রাণ দেয়। আর শিল্পবিপ্লবের সময়কার মত সোভিয়েত পেশীর সাথে শামিল হয় মার্কিন যন্ত্র ও প্রযুক্তি।

পুতিনের রাশিয়াতে এ ইতিহাস আর শেখানো হয় না। প্রতি বছর বিজয়দিবসের প্যারেডে দাবি করা হয়, সোভিয়েতরা একাই বীরত্বের সাথে নাৎসিদের হটিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, রক্ত তারা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন প্রযুক্তি সাথে না থাকলে স্তালিন এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতেন না। স্তালিন কখনো খোলাখুলি এ কথা কাউকে বলেননি। কিন্তু পরবর্তী সোভিয়েত নেতা খ্রুষভের বরাত অনুযায়ী স্তালিন বহুবার এ কথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য না করলে জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েতের অস্তিত্বরক্ষা ছিল নিতান্তই অসম্ভব।

এদিকে অধুনা ২০২২ সালে নতুন করে মার্কিন লেন্ডলীজ চালু হয় রাশিয়ার চকিত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। সাহায্য গেছে ৬০ বিলিয়ন মু্দ্রামানের। রাশিয়া পেয়েছিল ১৮০ বিলিয়ন ডলার, ফেরত দিয়েছিল ৭০০ মিলিয়ন। সেটা কি ফেরত চাইবেন কেউ? সর্বকালের ইতিহাসের এ‌ই হল সবচেয়ে বড় আয়রনি, সবচেয় করুণ ট্র্যাজিকমেডি!

আগস্ট ২২, ১৯৪৫। বিজয়ীবেশে বার্লিনে রুশ, মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা।

লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন

আজকে আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লিখবো, সেটা সকলের মনঃপূত না হতে পারে। আমরা ছোটবেলা থেকে নেতাজি সুভাষ বসুকে ভারত-বাংলার স্বাধীনতাসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে দেখে এসেছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি জাতিগত, ধর্মীয় কোন জাতীয়তাবাদকে সুদৃষ্টিতে দেখি না। সে আমলের বৈশ্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদ হয়ত গ্রহণযোগ্য ছিল, কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের উৎপত্তি ও যুদ্ধকালীন কার্যক্রম অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। জাতীয়তাবাদের ও জাতীয় নেতাদের পূজো যারা করতে ভালবাসেন, তারা দয়া করে খোলা মন নিয়ে পড়ুন। নয়ত নাই পড়ুন।

আমার সংগ্রহের কয়েকটি ডাকটিকেট দিয়ে শুরু করি। প্রথম জোড়াটি ১৯৪২ সালের ক্রোয়েশিয়ার। বিভিন্ন স্লাভিক জাতির সমন্বয়ে গঠিত রাষ্ট্র ইউগোস্লাভিয়া দখলের পর নাৎসি বাহিনী ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্রকে ‘মু্ক্ত’ করে। সেদেশের সরকার গঠিত হয় উশতাসে নামক উগ্র জাতীয়তাবাদী একটি ক্রোয়েশীয় রাজনৈতিক দলের দ্বারা। তারা নাৎসিদের থেকেও অধিক জাতিগত হত্যা সংঘটন করে। উশতাসে সরকার নামে ‘স্বাধীন’ হলেও আদতে জার্মান তাঁবেদার ছিল।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৪১-৪৩ সাল

সেরকম চেকোস্লোভাকিয়া রাষ্ট্রটিকেও জার্মানরা ত্রিখন্ডিত করে। সুডেটেনল্যান্ড খাস জার্মানির অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমান চেকিয়ার বাকি অংশ হয় বোহেমিয়া-মোরাভিয়া নামক জার্মান প্রটেক্টরেট। আর স্লোভাকিয়া হয় ক্রোয়েশিয়ার মত চেকদের শাসন থেকে ‘স্বাধীনতাপ্রাপ্ত’। হ্লিংকা পার্টির উগ্র জাতীয়তাবাদী সরকার জার্মান রাষ্ট্রের পাপেট ছিল এবং তাদের সকল যুদ্ধাপরাধী কর্মকান্ডে হাত মেলায়। দ্বিতীয় ছবিতে স্লোভাকিয়ার স্ট্যাম্প।

নাৎসি তাঁবেদার রাষ্ট্র স্লোভাকিয়ার ডাকটিকেট, ১৯৩৯

তৃতীয় ছবির ডাকটিকেটগুলি বেশ দুর্লভ আর বেশির ভাগ সংগ্রহকারীর কাছে অপরিচিত। অপারেশন বারবারোসার মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নকে চকিত আক্রমণ করে বসে জার্মানি। সেটা ১৯৪১ সাল। স্তালিনের একাধিক শুদ্ধি অভিযানের কারণে সোভিয়েত সেনাদল ছিল অপিরপক্ব অফিসারদের নেতৃত্বে পরিচালিত। এদের অনেকে জার্মানদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। হিটলারের বর্ণবাদী থিওরিতে রাশান আর বেশিরভাগ স্লাভিক মানুষ নিচুস্তরে পরিগণিত। তাই এসকল যুদ্ধবন্দীদের বেশ অত্যাচার সহ্য করতে হয়। প্রায় অর্ধেকের মত যুদ্ধবন্দী ক্যাম্পে মৃত্যুমুখে পতিত হয়।

কিন্তু ‘৪২এ স্তালিনগ্রাদে হারার পর হিটলারের সভাসদরা তাঁকে রাজি করান যে এসকল যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে একটি ‘লিবারেশন আর্মি’ বানালে সোভিয়েতবিরোধী প্রপাগান্ডায় কাজে দেবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে সাধারণ রাশিয়ান মানুষ স্তালিনের ভয়ে প্রকম্পিত হত, যেমনটা হত সেদেশের জাতিগত সংখ্যালঘুরা।

জেনারেল ভ্লাসভ নামে এক রাশান অফিসার জার্মানদের সাথে আঁতাত করে ঠিক করেন যে, যুদ্ধবন্দীদের একাংশ নিয়ে একটি ‘মুক্তিবাহিনী’ গঠিত হবে, যারা রাশিয়া ও সোভিয়েত অধিকৃত অঞ্চল থেকে কমুনিস্ট শাসন উচ্ছেদের জন্যে জার্মানদের সহায়তা করবে। ডাকটিকেট দুটি এই ভ্লাসভ আর্মির ইস্যুকৃত।

রাশিয়ান “রাজাকার” ভ্লাসভ আর্মির ডাকটিকেট, ১৯৪৪

পরের তিনটি ছবিতে দেখিয়েছি নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেটের গতানুগতিক বিষয়বস্তু, ডিজাইন ইত্যাদি। আর শেষ ডাকটিকেটগুলো ‘আজাদ হিন্দের’। ডাকটিকেটগুলির বিষয়বস্তু, ডিজাইন ও প্রিন্টিং একটু ভাল করে দেখুন।

নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৫ ও ১৯৪১। ডানের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
নাৎসি জার্মানির ডাকটিকেট, ১৯৪৪ ও ১৯৪৩। নিচের টিকেটটির ডিজাইনার আক্সটার-হয়টলাস আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের নকশা করেন।
আজাদ হিন্দের ডাকটিকেট, ১৯৪৩। জার্মানিতে নকশা করা। নাৎসি জার্মানির রাষ্ট্রীয় ছাপাখানায় মুদ্রিত।

এতগুলি ডাকটিকেট দেখানোর মূল লক্ষ্য এটা বোঝানো যে, জার্মান তাঁবেদার রাষ্ট্রগুলির সরকার থেকে শুরু করে এমনকি ডাকটিকেট ডিজাইন ও প্রিন্টিং পর্যন্ত ছিল নাৎসি আনুকূল্যের ওপর নির্ভরশীল। আমার দেখানো স্ট্যাম্পগুলির সকলের ডিজাইন ও বিষয়বস্তু প্রায় এক।

আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটগুলি তার ব্যতিক্রম নয়। জার্মানির যে ডাকটিকেটগুলি দেখিয়েছি তার ডিজাইনার স্বামী-স্ত্রীযুগল আক্সটার-হয়টলাস। আবার এরাই আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটেরও ডিজাইনার! আর এ টিকিটগুলো ছাঁপা হয়েছিল জার্মানির সরকারি প্রিন্টিং হাউজ রাইখসড্রুকারিতে। অর্থাৎ তাঁবেদার অন্যান্য সরকারগুলির থেকে এই ‘আজাদ হিন্দ’ খুব একটা আলাদা ছিল না।

পরে এ ডাকটিকেটের বিশাল পরিমাণ সুভাষ বসু ও তার অনুগত অফিসাররা নিয়ে যান জাপানে ও বার্মায়।

আজাদ হিন্দের যাত্রা শুরু ‘আজাদ হিন্দ’ হিসাবে নয়। উত্তর আফ্রিকায় তবরুক আর আল-আলামিনে ১৯৪০-৪১এর যুদ্ধের পর একটা বড় ব্রিটিশ সেনাদল জার্মান ও ইতালীয়দের যুদ্ধবন্দী হয়। এদের মধ্যে ছিল ব্রিটিশ ভারতের অনেক সৈন্য। প্রথমে ইতালিতে ও পরে জার্মানিতে স্থানান্তরিত হয় এরা।

ভ্লাসভ আর্মির মত ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডার অস্ত্র হিসাবে এই ভারতীয়দের ব্যবহারের বুদ্ধি আসে জার্মান ও ইতালীয়দের মাথায়। ইতালীয়রা ১৯৪২এ তিনশর মত ‘স্বেচ্ছাসেবক’ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে গঠন করে বাতালিওনি আজাদ হিন্দুস্তান। কিন্তু যথেষ্ট কাঠখড় পুড়িয়ে প্রশিক্ষণ দেবার পরে এদের বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়ায় দলটিকে ভেঙে দেয়া হয়।

এখানে বলে রাখা ভাল, যুদ্ধবন্দীদের নিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করাটা সাধারণত সামরিক বিবেচনায় ভাল নয়। কারণ যে মুহূর্তে তারা যুদ্ধক্ষেত্রে স্বদেশীদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হবে, সে মুহূর্তে আবার দল পরিবর্তন করতে পারে। এরপরেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানরা বহুজাতিক ভাফেন এসএস নামে প্যারামিলিটারি বাহিনীতে ভিনদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের জায়গা দেয়। এদের মধ্যে ছিল ডাচ, বেলজিয়ান, ডেনিশ, নরওয়েজিয়ান, ব্রতোঁ, তাতার, আর্মানী, আজারবাইজানী, জর্জিয়ান, লাটভিয়ান, এস্তোনিয়ান, ফিনিশ, প্রভৃতি জাতির সৈন্য। আরবদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল লেগিওন ফ্রাইয়েস আরাবিয়েন — ফ্রী আরাবিয়ান আর্মি। সাধারণত ফ্রন্টলাইনে এদের ব্যবহার করা হত না, সিভিলিয়ান অধিকৃত এলাকাতেই বিভিন্ন কাজে লাগানো হত এদের।

মূল কথা হলো, ইন্ডিয়ান লিবারেশন আর্মির শুরুটা সুভাষ বসুর মাধ্যমে নয়। তাঁর সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যের সাথে ভাগ্যক্রমে অক্ষবাহিনীর এসকল প্রপাগান্ডাধর্মী কর্মকান্ড মিলে যায়।

ইতালির মতই জার্মানরা ১৯৪১ নাগাদ উত্তর আফ্রিকা থেকে সাতাশ জন ভারতীয় যুদ্ধবন্দীকে উড়িয়ে নিয়ে আসে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার বানানোর উদ্দেশ্যে। ধীরে ধীরে জার্মানিতে আফ্রিকা-ইউরোপ থেকে অধিকৃত প্রায় হাজার পনেরো ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীর সমাবেশ গড়ে ওঠে। হিটলার অবশ্য এসএসপ্রধান হিমলারের ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি আইডিয়াটাকে পছন্দ করেননি। তাঁর হিসাবে ভারতীয়রা অতীতে আর্য থেকে থাকলেও এখন মিশ্রিত নিচু শ্রেণীর জাত।

হিটলারকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে হিমলার ১৯৪২এর জানুয়ারি নাগাদ লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েন বলে একটা ছোটখাটো ‘স্বেচ্ছাসেবক’ সৈন্যদল গড়ে তোলেন। কিন্তু পক্ষপরিবর্তনে যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে তেমন একটা সাড়া মিলছিল না। জার্মান অধিনায়কত্বের পরিবর্তে দরকার হয়ে পড়ে বিশ্বাসযোগ্য ভারতীয় নেতৃত্ব। এখানেই নেতাজির সফল আবির্ভাব।

ব্রিটিশ ভারতীয় সিআইডির চোখে ধূলো দিয়ে নেতাজি কলকাতা থেকে দুঃসাহসিক এক যাত্রা করেন ১৯৪২এর শুরুতে। পুরো ভারত অতিক্রম করে আফগানিস্তানের সীমানা দিয়ে রাশিয়াতে ঢোকেন ছদ্মবেশে। তারপর নতুন নাম নিয়ে সোজা মস্কো। তাঁর যাত্রার ঠিকানা ছিল মস্কোই, জার্মানি নয়। তাঁর হিসাবে, স্বাধীন ভারতের জন্যে দরকার ছিল বিশ বছরের সমাজতন্ত্রী একনায়কতন্ত্র, ঠিক সোভিয়েত রাশিয়ার আদলে।

কিন্তু মস্কোতে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হন নেতাজি। সোভিয়েতরা তখন জার্মানদের নিয়ে ভীত। যেকোন মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে। এমতাবস্থায় ব্রিটেন-আমেরিকার মত সম্ভাব্য মিত্রদের চটানোর কোন মানে হয় না। বিফলমনোরথ নেতাজিকে তারা বার্লিনমুখী ট্রেনে তুলে দেয়। কারণ জার্মানদেরই তখন প্রয়োজন ছিল সুভাষ বসুর মত কারো।

পাঠক হয়ত আঁচ করতে পারছেন, নেতাজি স্বদেশপ্রেম আর ব্রিটিশবিদ্বেষে এতটাই অন্ধ আর ‘দ্য এনেমি অফ মাই এনেমি ইজ মাই ফ্রেন্ড’ এ তত্ত্বে এতটাই মশগুল যে যুদ্ধকালীন রাজনীতির সাধারণ জ্ঞান হয় তাঁর বিলুপ্ত হয়েছে, নয়ত তিনি সজ্ঞানেই ব্রিটিশের তদকালীন শত্রু জার্মান-সোভিয়েতদের বাণিজ্যপণ্যে পরিণত হয়েছেন। যদি এ শত্রুরা সমঝোতার মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি করে ফেলত তাহলে আজাদ হিন্দের কি হত? নানা কৌশলগত কারণেই ‘এনেমি অফ মাই এনেমি…’ এ তত্ত্বের এমন সাদাসিধা প্রয়োগ মূলত অকার্যকর।

যাহোক, এপ্রিল ‘৪২এ জার্মানিতে এসে পড়েন নেতাজি। হিটলারের সাথে দেখা করতে চেয়েও তা মেলে কয়েক মাস পর। এর মধ্যেই তাঁকে কাজে লাগিয়ে নেন হিমলার।

ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়ার ব্যাপারে ব্রিটিশ ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে সাড়া না মেলার মূল কারণ একমাত্র দেশী নেতৃত্বের অভাব নয়। এসকল সৈন্যদের অধিকাংশ বংশপরম্পরায় ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে এসেছে। ব্রিটিশরাজের প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্যের যে শপথ তারা নিয়েছে, তা ভঙ্গ করা মিলিটারি কোড অফ অনারের পরিপন্থীও বটে। আর ভিনদেশী-অন্যভাষী জার্মানদেরই বিশ্বাস করার কি কারণ?

সুভাষ বসু একে একে প্রতিটা পিওডাব্লিউ ক্যাম্পে গিয়ে এসকল ভারতীয় সৈন্যদের স্বাধীনতার পক্ষে লড়ার জন্যে উদ্বেলিত করে তোলেন। ফ্রী ইন্ডিয়া সেন্টার বলে একটি রেডিও স্টেশনও শুরু হয়। নেতাজি ছিলেন অসাধারণ বক্তা। আর অনেক শিক্ষিত সৈন্যের কাছেও তাঁর নাম ছিল সুপরিচিত। শুধু এসকল কারণে নয়, যুদ্ধবন্দীশিবিরের করুণ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যে আর নতুন সেনাদলে অফিসার পদবীর আশাতেও অনেকে সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশরাজের প্রতি আনুগত্যের শপথ ভাঙার। সুভাষ বসু ছিলেন তাদের এ সিদ্ধান্তের রেস্পন্সিবল পার্টি।

তবে ১৫ হাজার যুদ্ধবন্দীর মধ্যে শেষ পর্যন্ত শুরুতে কেবল তিন হাজার সৈন্য ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনে যোগ দেয়। নেতাজির আশা ছিল কমপক্ষে এক লাখ সৈন্যের একটি বাহিনী বানাবেন। তারপর জার্মানি থেকে যাত্রা করে সোভিয়েত এলাকার মধ্য দিয়ে আফগান ও ভারতের সীমানায় পৌঁছলে ভারতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জনবিদ্রোহ শুরু হয়ে যাবে। বলা বাহুল্য, এ ছিল নিতান্ত নাইভ একটি প্ল্যান।

ভারতের অবিসংবাদিত নেতা সুভাষ বসু ছিলেন না। গান্ধী-নেহরুর নেতৃত্বে কংগ্রেস ও অসহযোগিতা আন্দোলনের পক্ষে বেশ দৃঢ় জনসমর্থন ছিল। আর উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালুচ ও পাঠান জাত কিন্তু ব্রিটিশদের সেনাদলে বংশানুক্রমে বিশ্বস্ত সৈন্য যুগিয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে নেতাজির নেতৃত্বে হুঁটহাঁট বিদ্রোহ শুরু হত কিনা, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর কিভাবে কার খরচের খাতা ভরিয়ে হাজার হাজার মাইল পেরোত এ বিশাল সেনাবহর সেটা মোটেও অবান্তর প্রশ্ন নয়। নেতাজির পরিকল্পনাগুলি ছিল বেশ জাঁকালো, কিন্তু বাস্তবতাবিবর্জিত। তার এসব পরিকল্পনায় পূর্ণ সমর্থন যোগানোটাও ছিল জার্মানদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব।

১৯৩৯এ যুদ্ধ শুরুর সাথে সাথে হোম রুলের পরওয়া না করে ব্রিটেনের পক্ষে ভারতের ব্রিটিশ রাজ জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কষ্টার্জিত সংসদীয় ব্যবস্থা প্রায় রহিত করা হয়। এ টিকেটটির ব্যবহার ডাকপ্রেরনে হয়নি, হয়েছিল যুদ্ধের খরচ ওঠানোর বন্ডে। লাখে লাখে এ দামী টিকেটটি কেনেও অনেক ভারতবাসী, মূলত পাকিস্তানের এলাকাতে। ব্রিটিশদের প্রতি মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন তুলনামূলক বেশি ছিল।

যা হোক অগাস্ট ‘৪২ নাগাদ মোটামুটি সাড়ে চার হাজারের একটা রেজিমেন্ট গড়ে ওঠে জার্মানিতে। তাদের ইউনিফর্ম ছিল জার্মান সেনাবাহিনীর ধাঁচে। আর ইনসিগনিয়া ছিল জাফরান-সাদা-সবুজ ট্রাইকালার স্ট্রিপের মাঝে শিকারে উদ্যত বাঘের ছবি। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে তারা নেতাজির প্রতি নয়, হিটলারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেয়। শপথের কথাগুলি ছিল এমন: “I swear by God this holy oath that I will obey the leader of the German race and state, Adolf Hitler, as the commander of the German armed forces in the fight for India, whose leader is Subhas Chandra Bose.”

লেগিওন ফ্রাইয়েস ইন্ডিয়েনের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের কালার গার্ড। শিখ, মুসলিম ও হিন্দু ধর্মের সম্মিলিত। ভারতের তিনরঙা পতাকার মাঝে শিকারোদ্যত ব্যাঘ্র। ওপরে দেখানো আজাদ হিন্দের ডাকটিকেটের একটিতে এ চিত্র রয়েছে।
নাৎসি আর্মির প্রশিক্ষণে রত শিখ সৈন্য। হাতে এমজি-৩৪ অটোম্যাটিক। আজাদ হিন্দের ইন্সিগ্নিয়া দেখা যাচ্ছে ইউনিফরমে। ওপরে দেখানো একটি টিকেটে এ দৃশ্য মুদ্রিত হয়েছে।

নেতাজির অনুরোধ ছিল এ সৈন্যবাহিনী ইউরোপের যুদ্ধে ব্যবহৃত হবে না, হবে কেবল ভারতমুক্তির যুদ্ধে। এতে জার্মানরা যে খুব একটা খুশি হয়েছিল তা নয়। হিটলার নাকি আড়ালে বলেছিলেন, ফ্রি ইন্ডিয়ান আর্মি ইজ এ জোক। শুধু প্রপাগান্ডার খাতিরে বসিয়ে বসিয়ে এদের খাওয়ানো-পরানো আর প্রশিক্ষণ দেয়াটা তাঁর মনঃপূত হয়নি। তাঁকে বুঝিয়ে ঠান্ডা করেন হিমলার। শেষ পর্যন্ত সুভাষ বসুর সাথে একটি মোলাকাতেরও ব্যবস্থা করে দেন, কিন্তু হিটলার কোন প্রতিশ্রুতি সে মিটিংএ নেতাজিকে দেননি। নেতাজি এতে মনোক্ষুণ্ণ হন।

১৯৪২এ হিটলারের সাথে শেষ পর্যন্ত মোলাকাত হয় নেতাজির।

নেতাজির পছন্দের সোভিয়েতদেরকেও ততদিনে আক্রমণ করে বসেছেন হিটলার। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধ চলছে। কিন্তু আফগান সীমানা পর্যন্ত জার্মান সেনাদের যাওয়া তো দূরের কথা, তার কৌশলগত তেমন কোন কারণও ছিল না। হিটলারের লক্ষ্য ছিল উরাল আর ককেশাস পর্যন্ত সম্পদশালী এলাকাটির দখল নেয়া। তাঁর প্ল্যানে মধ্য এশিয়া ও ইরান ছিল সুদূরের পরিকল্পনামাত্র। পারস্যের মধ্যে দিয়ে একটা রাস্তা থাকলেও তা ছিল অনেক প্রতিকূল।

বিষন্ন নেতাজির দিকে তখন অগ্রসর হয় জাপানিরা। ‘৪২ নাগাদ জাপানিদের হাতে সিঙ্গাপুর-মালয়-বার্মার ব্রিটিশ গ্যারিসনের পতন হয়েছে। তাদের হাতে হাজার চল্লিশেক ভারতীয় যুদ্ধবন্দী। এদের নিয়ে তৈরি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নেতৃত্বে তখন জাপানপ্রবাসী রাসবিহারী বসু, কিন্তু তাদের দরকার ছিল আরো তরুণ ক্যারিসম্যাটিক নেতৃত্ব। সুভাষ বসু সে রোলপ্লে করতে রাজি হন।

ভারতের বার্মা সীমান্তে জাপানিসমর্থিত বড় সেনাদল নিয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামের সফলতার সম্ভাব্যতা নেতাজির চোখে আরো বেশি ছিল। কিন্তু তাঁর যে আশা ভারতের সীমানায় এসে পৌঁছলেই জনবিদ্রোহের সূচনা হবে তাতে গুড়েবালি। ব্রিটিশরা যুদ্ধকালীন সংবাদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল শত্রুর প্রপাগান্ডা ছড়ানো বন্ধের জন্যে। এই সেনাদলের অস্তিত্বের কোন খবরই ভারতবাসী যুদ্ধকালীন সময়ে জানতে পারেনি। তাই সুভাষ বসুর সামরিক পন্থায় ভারতমুক্তির তেমন কোন বাস্তবতা ছিল না।

যাই হোক, ১৯৪৩এ সুভাষ বসু ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাপানমুখী সাবমেরিনে চড়ে বসেন। তাঁকে অনুসরণ করে কিছু সেনা অফিসার। কিন্তু অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হয় সাধারণ ভারতীয় সৈন্যরা। জার্মান এক অফিসারকে তাদের অধিনায়ক বানানো হয়, কিন্তু সৈন্যদের অভিযোগের মুখে তাকে অপসারণ করা হয়। শুধুমাত্র ভারতমুক্তির যুদ্ধে শামিল করা হবে এ কথা দেয়া সত্ত্বেও জার্মানরা রেজিমেন্টটিকে অধিকৃত নেদারল্যান্ডে আটলান্টিক ওয়াল নামক উপকূলীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় স্থানান্তর করে।

ফেব্রুয়ারি ১৯৪৪এ আটলান্টিক ওয়ালে ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মি পরিদর্শনে ফীল্ড মার্শাল রোমেল।

এসময় ডাচ সাধারণ জনগণের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিল ভিনদেশী এ সৈন্যদল। ডাচ মেয়েরা পর্যন্ত ভারতীয় সৈন্যদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। কিছু ক্ষেত্রে বিবাহবন্ধনেও আবদ্ধ হয় কয়েক সৈন্য। অন্যান্য জার্মানদের মত ফ্রন্টলাইন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়নি এই ভারতীয়রা। মোটামুটি আরামেই কাটে তাদের ১৯৪৩-৪৪। ডাচরা নিজেরাও অধিকৃত জনগোষ্ঠী হওয়ায় ব্রিটিশশাসিত পরাধীন ভারতীয়দের প্রতি তাদের যথেষ্ট সহানুভূতি ছিল। জার্মান প্রপাগান্ডার একটা ভূমিকাও ছিল এতে।

‘৪৩এর শীতের আগমনের সাথে সাথে আবার স্থানান্তর করা হয় ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনকে। এবার ভাফেন এসএসের সরাসরি কমান্ডে তাদের অবস্থান হয় দক্ষিণ ফ্রান্সের আরামদায়ক উপকূলে। ‘৪৪এর জুনে ফ্রান্সের নর্মন্ডি উপকূলে যৌথবাহিনী সফলতার সাথে অবতরণ করে। শুরু হয় ফ্রান্সের স্বাধীনতাযুদ্ধ। সে সমরে না চাইলেও ভারতীয় সৈন্যরা জড়িয়ে যায়। জার্মান ডিভিশনগুলি সমানে পিছু হটতে শুরু করে। আর ফ্রন্টলাইনের পেছনে ফ্রেঞ্চ রেজিস্ট্যান্সের চোরাগোপ্তা গেরিলা হামলা বেড়ে যায়। ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের প্রথম লোকক্ষয় হয় এখানেই। ফরাসী পার্টিজানদের বিরুদ্ধে তখন কিছু যুদ্ধে শামিল হয় ভারতীয়রা।

ফ্রান্সে জার্মান সেনাবাহিনীর মিলিটারি ফাংশনে আজাদ হিন্দের শিখ অফিসারকে নাৎসি স্যালুট দিচ্ছে উপস্থিত জার্মানরা।
ভারতীয় সৈন্যদের একটি ছোট গ্রুপকে নির্দেশনা দিচ্ছে জার্মান অফিসার। ভারতীয় সৈন্যদের পরনে জার্মান সেনাবাহিনীর পোশাক, হেলমেট। ফ্রান্স, ১৯৪৪।

যে স্বাধীন ভারতের লক্ষ্যে এ সাড়ে চার হাজার সৈন্যের জার্মান সার্ভিসে যোগদান, তার থেকে এভাবে ক্রমে দূরে সরে যায় তারা। যে নেতার ব্যক্তিগত অনুরোধের কারণে বাপদাদার মিলিটারি কোড অফ অনার ভেঙে হিটলারের আনুগত্যের শপথ নিয়েছিল তারা, তাঁর কাছ থেকেও বহুদিন কোন খবর নেই। নেতৃত্বহীন, খুঁটিহীন, হতোদ্যম ভারতীয় সৈন্যদের মধ্যে নিয়মানুবর্তিতার অভাব দেখা দিতে শুরু করে। অনেকে মদ্যোপান শুরু করে। ফ্রান্সের প্রতিকূল সামরিক পরিবেশে ধর্ষণ ও শিশুহত্যার মত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগও এদের বিরুদ্ধে ফরাসীরা করে যুদ্ধের পরে।

‘৪৫এর মে’তে যুদ্ধ শেষ হয়। নিরপেক্ষ সুইজারল্যান্ডে আশ্রয় নেবার ইচ্ছা থাকলেও ফ্রী ইন্ডিয়া আর্মি শেষমেশ ফরাসী ও মার্কিনদের হাতে বন্দী হয়। তাদেরকে ব্রিটিশদের হাতে সমর্পণ করা হয়। ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির পাশাপাশি লালকেল্লায় এদেরও বিচার হয়। কিন্তু ভারতে ততদিনে স্বাধীনতার পক্ষে গণআন্দোলন বেশ জোরেসোরে চলছে। লালকেল্লায় আজাদ হিন্দের রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারের পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্রোহ করে বসে ভারতীয় নৌ ও বিমানবাহিনী। শেষ পর্যন্ত কিছুদিনের জেল ও ডিসঅনারেবল ডিসচার্জের শাস্তি দিয়ে আইএনএ ও ফ্রী ইন্ডিয়া লেজিওনের সকল অফিসার ও সৈন্যকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশরাজ। সুভাষ বসু এসবের আগেই তাইওয়ানে বিমানদুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। যে সামরিক প্রক্রিয়ায় বিজয়ী সেনাবাহিনীর অধিনায়ক হিসাবে ভারতের মুক্তি আনার স্বপ্ন ছিল তাঁর, আজাদ হিন্দ ফৌজ তার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন প্রক্রিয়ায় পরাজিত ও ‘রাজাকার’ আখ্যায়িত হয়ে স্বাধীনতাসংগ্রামকে প্রভাবিত করে।

আরেকটা ব্যাপার অনেক বাঙালী ভাবেন যে সুভাষ বসু তাঁর অনুগত সেনাদলে ধর্মীয়-জাতিগত সীমানা ভেঙে সব ছাঁপিয়ে ভারতীয় সাম্যবাদী-জাতীয়তাবাদী একটি অনুভূতি দাঁড়া করান। এটা যতটা না আদর্শবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা উচিত, তার থেকে বেশি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যাচাই করা জরুরী।

ব্রিটিশ ভারতীয় আর্মিতে ধর্মীয়-জাতিগত বিভাজনের অনেক যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল। একই ভাষার ব্যবহার, একই ধরনের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদি অনেক বড় প্র্যাক্টিকাল কারণ। ফ্রী ইন্ডিয়ান আর্মির অবস্থা সেরকম ছিল না। তারা সংখ্যাতেও ছিল কম, জাতিগত-ধর্মীয়ভাবে আলাদা করলে ছোট ইউনিটের কারণে সাংগঠনিক সমস্যা দেখা দিত। তাছাড়াও মনে রাখতে হবে যুদ্ধবন্দী হিসাবে তারা একটা প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন ছিল। সেখানে জাতিগত-ধর্মীয় বিরোধ তৈরির কোন অনুকূল অবস্থা ছিল না। খারাপ সিচুয়েশনে পড়লে বাঘে-মহিষেও এক ঘাঁটে জল খায়।

আর প্রতিকূল অবস্থা থেকে বেরুনোর সাথে সাথেই কিন্তু হিন্দু-মুসলিম বিরোধটা এই একই আর্মির মধ্যে দেখা গেছে। লালকেল্লার বিচারের সময় মুসলিম সৈন্যরা হিন্দুদের ওপর দোষ চাপায় জোরপূর্বক আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগদানে তাদের বাধ্য করার জন্যে। এ অভিযোগের সত্যাসত্য বের করা কঠিন। কিন্তু ভারতীয় ব্রিটিশ আর্মিতে যে ধর্মীয় বিরোধের সুযোগ ও স্থান ছিল না, তার পরিস্থিতি ঠিকই তৈরি হয় আজাদ হিন্দ ফৌজে। সে ব্যাপারে পরে কোনসময় বিস্তারিত বলবো।

সুভাষ বসুর জীবনী নিয়ে বাঙালী বহু পড়াশোনা করেছে, বিস্তর লেখালেখি করেছে। হিরো ওয়ারশিপের শেষ নেই!  কিন্তু পুরো কাহিনীটার বাস্তবধর্মী বিশ্লেষণ করতে হলে জার্মান-জাপানী দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখাও জরুরী। আর সাধারণ সৈন্যদের দিকেও নজরটা বাঙালী দিয়েছে কম, যতটা না দিয়েছে নেতৃত্বের প্রতি। সে চেষ্টাটাই আজকে আমি করলাম জার্মান ফ্রী ইন্ডিয়ান লেজিওনের সংক্ষিপ্ত কাহিনীর মধ্য দিয়ে। পরে সুযোগ হলে বার্মার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির কাহিনী ও জাপানী দৃষ্টিকোণ নিয়েও একটি বিশ্লেষণ করার আশা রাখি।

বুডিকার বিদ্রোহ ও অন্যান্য

Featured Video Play Icon

গেম অফ থ্রোনস সিরিজের ভক্তদের নিশ্চয় মনে করিয়ে দিতে হবে না, ওয়েস্টেরোসের উত্তর সীমান্তের ‘দ্য ওয়াল’ দেয়ালের কথা। হোয়াইট ওয়াকার আর ওয়াইল্ডলিংদের আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্যে সুউচ্চ দেয়ালটা তৈরি করেন নেড স্টার্কের পূর্বপুরুষ ব্র্যান দ্য বিল্ডার।

ওয়ালের মত থ্রোনসের অনেক কিছুই কিন্তু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের ভূগোল-ইতিহাসের সাথে মিলে যায়!

এই ধরুন হেড্রিয়ান’স ওয়াল। স্কটিশ ‘হাইল্যান্ডসের’ দক্ষিণে — ইংল্যান্ডের ‘নর্থে’(!) — প্রস্তরনির্মিত এই দেয়াল উত্তর সাগর থেকে আইরিশ সাগর পর্যন্ত ৭৩ মাইলব্যাপী বিস্তৃত। রোমসম্রাট হেড্রিয়ান ১২২ খ্রীষ্টাব্দে এর নির্মাণকার্য শুরু করেন।

এর আগে রোমের সেনাপতি জুলিয়াস সীজ়ার ৫৫ ও ৫৪ খ্রীষ্টপূর্বে যুদ্ধজাহাজের বহর নিয়ে ব্রিটেনে এসেছিলেন। সেটা ফ্রান্সে কেল্টদের সম্মিলিত সেনাদলকে পরাজিত করারও দু’বছর আগে। কেল্টিক ব্রিটন উপজাতি কাতুভেলাউনিদের রাজা কাসিভেলাউনাস সীজ়ারের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু গলের বিদ্রোহদমনের জন্যে সীজ়ারকে ইউরোপের মূল ভূখন্ডে ফিরে যেতে হয়। ব্রিটনরা তারপর আবার আগের মত স্বাধীন।

এ স্বাধীনতা বেশিদিন টেকেনি। একশ’ বছরের মধ্যেই — খ্রীষ্টীয় চল্লিশের দশকে — সম্রাট ক্লডিয়াসের আদেশে নতুন করে রোমের সেনাবাহিনী যুদ্ধ নতুবা মিত্রতার চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটেনের গোত্রগুলিকে একে একে বশ করা শুরু করে। স্বাধীনতাসংগ্রামীদের মধ্যে সেসময়ের একজন ব্রিটিশ লোক-ইতিহাসে এখনও সুপরিচিত, এবং তিনি একজন নারী। নাম বুডিকা

কেল্টিক ইসেনি গোত্রের রাণী ছিলেন বুডিকা, আরেক নাম বুডিসিয়া। রাজা প্রাসুটেগাস ছিলেন রোমানদের মিত্র, উত্তরসূরী হিসাবে দুই কন্যার সাথে সম্রাট নিরোকে সহ-শাসক ঘোষণা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর রোমান সামরিক শাসক সেই উইল অ‌গ্রাহ্য করে নিরোকে একমাত্র শাসক দাবি করেন। দাবি অমান্য করায় বুডিকাকে জনসম্মক্ষে চাবুকপেটা করা হয়, দুই রাজকন্যা হন রোমসৈন্যদের দ্বারা ধর্ষিত। তারপর প্রতিশোধপরায়ণ বুডিকা ইসেনিসহ অন্যান্য স্বাধীনতাকামী কেল্টিক গোত্রের সৈন্যদলকে একতাবদ্ধ করে ফিরে আসেন।

সংখ্যায় ভারি বুডিকার সেনাশক্তি কয়েকটি খন্ডযুদ্ধে জয়লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রোমের অভিজ্ঞ, নিয়মিত সৈন্য ও রণকৌশলে পারদর্শী সেনানায়কদের কাছে তিনি হেরে যান। এরপর প্রায় চারশ’ বছরের জন্যে বর্তমান ইংল্যান্ড, ওয়েলস আর কর্নওয়াল রোম সাম্রাজ্যের অধীন হয়ে থাকে।

ও হ্যাঁ, ইতিহাস ‘সবসময়’ বিজয়ীরা লিখলেও অনেকসময় সঠিকটাই লেখেন। কারণ বুডিকার বিদ্রোহের ন্যায্য কারণ ও আনুষঙ্গিক ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ আমরা ট্যাসিটাস আর ক্যাসিয়াস ডিও বলে দুই সমসাময়িক রোমান ইতিহাসবিদের কাছে পাই। ট্যাসিটাসের শ্বশুর আবার ছিলেন রোমের সেনাপতি।

দুটো এলাকা অবশ্য রোমের শাসন থেকে বেঁচে যায়। আয়ারল্যান্ড, যা আলাদা দ্বীপ, আর স্কটল্যান্ড — ‘আলবিয়ন’ দ্বীপের পাহাড়ী উত্তরভাগ। রোমানদের কাছে ক্যালিডোনিয়া নামে পরিচিত স্কটল্যান্ডের এ অংশে বাস ছিল পিক্ট বলে একটি গোত্রের। তারা কেল্টিক জনগোষ্ঠীরই একটি অংশ বলে ধারণা করা হয়।

পিক্টরা ‘সভ্য’ রোমানদের কাছে ছিল বর্বর — অনেকটা থ্রোনসের ওয়াইল্ডলিংদের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে তারা আবির্ভূত হত খালি গায়ে, আর সারা শরীরে ছিল রঙীন উল্কি। পিক্টরা ছিল রক্তপিপাসু, হিংস্র। এদের কোন নগর ছিল না, যদিও লৌহনির্মিত অস্ত্রপ্রযুক্তি তাদের নখদর্পণে ছিল।

এই পিক্ট আর তাদের আইরিশ মিত্ররা প্রায়ই ব্রিটেনের ভেতরে এসে লুটতরাজ করে রোমান পুলিশ আসার আগেই পর্বতাঞ্চলে ভেগে পড়ত। হেড্রিয়ান’স ওয়াল বানানোর এটাই মূল কারণ। একটা সময় হেড্রিয়ান’স ওয়ালেরও উত্তরাংশ রোমের আয়ত্তে চলে আসে, তখন তারা আরেকটু উত্তরে অ্যান্টোনিন ওয়াল বলে আরেকটি দেয়াল তুলে নিজেদের আরও সুরক্ষিত করে।

আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের তুলনায় ইংল্যান্ড একটু কম সুরক্ষিত। কারণ, ইংলিশ চ্যানেল ডোভারে মোটে ২০ মাইল চওড়া। পঞ্চম শতকের ‘গ্লোবাল ক্রাইসিসের’ সময় রোমানরা জার্মানিক গথ ‘মাইগ্র্যান্ট’ গোত্রদের আক্রমণে যখন ব্যতিব্যস্ত, তখন তারা ইংল্যান্ড থেকে ধীরে ধীরে সেনাবাহিনী সরিয়ে নেয়। প্রতিরক্ষার অভাবে ডেনমার্ক-জার্মানি থেকে সাগরপথে অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট নামক অন্যান্য জার্মানিক গোত্র এসে হাজির হয়ে যায় ইংল্যান্ডে। অ্যাঙ্গল থেকেই ইংল্যান্ডের নামকরণ। পরবর্তীতে ভাইকিংরাও হানা দেয় সেখানে। শেষ সফল সমুদ্রাভিযান করেন নর্ম্যান ডিউক উইলিয়াম দ্য কনকারার। সে সালটা একটা ইংরেজী সংখ্যা দিয়ে সুপরিচিত — টেন-সিক্সটি-সিক্স। অধুনাকালে নাপোলেঁওহিটলারও অবশ্য সমুদ্রাভিযানের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সফল হননি।

অপরদিকে স্কটল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড বাইরের ‘সভ্য-শিক্ষিত’ বিশ্ব থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন ছিল। নবম শতাব্দীতে ভাইকিংদের আক্রমণ প্রতিহত করার লক্ষ্যে পিক্টরা উত্তর আয়ারল্যান্ডের গেল নামক কেল্টিক গোত্রদের সাথে মিলে নতুন এক রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তন করে, তার নাম ছিল ডেল রিয়াটা। গেলদের ভাষা-সংস্কৃতি গ্রহণ করে স্কটিশ হাইল্যান্ডের পিক্ট অধিবাসীরাও হয়ে যায় গেলিক। আজকের স্কটল্যান্ডের অন্যতম ভাষা স্কটিশ গেলিক আর আইরিশ গেলিক একই ভাষাপরিবারের অংশ।

পিক্ট-গেলদের পরবর্তী রাজ্য আলবার রাজনীতি ছিল আর সব কেল্টদের মত পরিবার-গোত্র-ট্রাইব ভিত্তিক। তারা ভ্রাতৃঘাতী অনেক যুদ্ধ করেছে গোচারণভূমির অধিকার নিয়ে। কখনো একে অন্যের গবাদিপশু চুরির কারণে শতাব্দীব্যাপী পারিবারিক শত্রুতার সূচনা হত। শেক্সপীয়ারের ট্র্যাজিক নায়ক ম্যাকবেথ আসলে ছিলেন আলবার রাজা। অন্য রাজবংশের ডানকানকে যুদ্ধে হত্যা করে সিংহাসনে আসীন হন তিনি। অবশ্য শেক্সপীয়ারের বর্ণনাগুলি একটু রঙচড়ানো।

উইলিয়ামের নর্ম্যান কনকোয়েস্টের পরে স্কটদের কিছু গোত্র ইংল্যান্ডের নর্ম্যান-ফরাসী বনেদী পরিবারে বিয়েশাদীর মাধ্যমে নিজেদের আভিজাত্য বাড়ানোর চেষ্টা করে। তাই গেলিক ভাষার পাশাপাশি মিডল ইংলিশ ভাষারও প্রচলন শুরু হয়। স্কটস নামক ইংরেজীর উপভাষা তাই আজ স্কটল্যান্ডে গেলিকের থেকে বেশি প্রচলিত।

বনেদী সম্পর্কের অজুহাতে ত্রয়োদশ শতকে যুধ্যমান ক্লান লীডাররা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে অনুরোধ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে রাজা ঠিক করে দিতে। এডওয়ার্ড সে সুযোগে স্কটল্যান্ডের শাসনভার নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। তখন প্রায় ষাট বছরব্যাপী স্বাধীনতাসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়, যাতে হলিউডি মুভির সুপরিচিত উইলিয়াম ওয়ালেস, রবার্ট দ্য ব্রুস আর অন্যান্যরা ইংলিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শেষ পর্যন্ত জয়ী হন। ১৬০৩এ স্কটল্যান্ডের রাজা ষষ্ঠ জেমস পারিবারিক উত্তরাধিকারসূত্রে ইংল্যান্ডেরও রাজা অভিষিক্ত হন। এই সময়েও স্কটল্যান্ড আলাদা স্বাধীন দেশ ছিল। সে স্বাধীনতা খর্ব হয় ১৭০৭এ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন স্কটিশরা অ্যাক্ট অফ দ্য ইউনিয়নের শর্তানুযায়ী ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অবিভক্ত রাজ্য ‘গ্রেট ব্রিটেনকে’ মেনে নেয়।

এসব ইতিহাসের সাথে সঙ্গে দেয়া গানটির সম্পর্ক একরকম আছে। ঐ যে বলছিলাম, দুর্গম পাহাড় ও দ্বীপপুঞ্জের দেশ স্কটল্যান্ড বহুদিন ‘সভ্যতা’ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। ইংল্যান্ড তার কেল্টিক ঐতিহ্য কালে কালে হারিয়ে ফেলে, সে জায়গা নেয় লাতিন-জার্মানিক-নর্ম্যান-ফরাসী ভাষা ও কেতা। যখন ইংলিশরা সেপথে শিক্ষা-দীক্ষা নিচ্ছে, তখনও স্কটল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ডে অনেক ‘গাঁইয়া’ ব্যাপারস্যাপার প্রচলিত ছিল। তাই তাদের প্রচুর লোকসংস্কৃতি বেঁচে গেছে। নানাসময় খারাপ অবস্থায় নিপতিত হলেও এখন স্কটিশরা আদি ভাষা-গান শিখে আত্মপরিচয় পুনরাবিষ্কার করছে। অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে বলতে পারি যে, ভিডিওর স্কটিশ গায়কদের কারো ধমনীতে সম্পূর্ণ পিক্টিশ বা গেলিক রক্ত নেই, যেমনটা আমাদের দেশেরও কারো শতভাগ ‘শুদ্ধ-শুচি’ বংশপরিচয় নেই।

স্কটিশ গেলিক ভাষায় গাওয়া এ গানটি এক ধরনের ‘ওয়াকিং সং’ — দলগত শ্রমসঙ্গীতের একটি উদাহরণ। তিন দশক আগেও আমার বাবাকে দেখেছি উলের তৈরি টুইডের কোট পড়তে। স্কটিশদের স্কার্টের মত জামা ‘কিল্ট’ এ কাপড়েই তৈরি, ঠান্ডা আবহাওয়ায় তা আরামদায়ক। টুইড একসময় হাতেই বানাত স্কটল্যান্ডের গ্রামের মেয়েরা। সেটা বানানোর একটা পর্যায়ে বড় এক চক্র করে বসে নানাবয়েসী কর্মী কাপড়ের কুন্ডলীকে চেপে চেপে কম্প্রেস করত, তাতে টুইডের ঘনত্ব বাড়ত। এই প্রক্রিয়াটাকে বলা হয় ওয়াকিং বা ফুলিং।

কাজটা ছিল পুনরাবৃত্তিপূর্ণ আর একঘেঁয়ে। তাই কাজের সাথে তাল মেলাতে ওয়াকিং সংয়ের উৎপত্তি। কাজের দ্রুততার সাথে গানের বিষয়-তালও পরিবর্তিত হত। এতে কাজটা আনন্দদায়ক হত, নৈপুণ্যও বাড়ত। গানের বিষয় ছিল নারীমহলের দৈনন্দিন ছোটবড় দুঃখ-সুখ-আশা-নিরাশার প্যাঁচাল, কখনো কানাঘুষা-কুৎসারটনা। যেমন, এই গানটায় বর্ণিত হচ্ছে আনা নামে এক মেয়ের কথা। সে অন্তঃস্বত্ত্বা, সন্তানের বাবা যেনতেন কেউ নয়, স্বয়ং নৌবাহিনীর লর্ডের পুত্র! আনার প্রতিটা বড়াইয়ের পরে সখীরা কোরাস করে তার প্রতি মমতা প্রকাশ করছে। গানের কথা সবসময় এক থাকত না, ইম্প্রভাইজ় হত প্রতিবারে। আরেকরকম ওয়াকিং সং আছে যার ভাষার কোন মানে নেই, তালের সাথে আবোলতাবোল। এদেরকে বলে পোর্টা বিঅল

বাংলাদেশের লোকগীতির সাথে যারা পরিচিত, তারা হয়ত সারিগান শুনেছেন। দক্ষিণপূর্ব বাংলার ভাটি অঞ্চলে নৌকাবাইচের সাথে সারিগান হয়। এগুলোও কিন্তু মূলে শ্রমসঙ্গীত! দৈনন্দিন কাজের একঘেঁয়েমি কাটাতেই এর উৎপত্তি, নৌকাবাইচের ঐতিহ্যে বেঁচে রয়ে গেছে। সারিগানেরও বিষয়বস্তু ওয়াকিং সংয়ের মত। যেমন, ‘শাম পীরিতির এত যন্ত্রণা’ নামে গানটিতে এক তরুণী অভিযোগ করেছেন শাশুড়ীর খোঁটা দেয়া নিয়ে। এরকম শাশুড়ী-বউয়ের পারিবারিক বিরোধ নিয়ে স্কটিশ ওয়াকিং সংও আছে।

ফকির আলমগীরের হেনরির হাতুড়ি গানটাও আমেরিকার রেলশ্রমিকদের শ্রমসঙ্গীত। আমেরিকার শিল্পায়নের সময় হাজার হাজার মাইল রেললাইন বসিয়েছিল সাদা-কালো-চীনা নানা জাতের শ্রমজীবী মানুষ। স্টীল-ড্রাইভিং বলে একটা ধাঁপ ছিল, তাতে তাল ঠিক রেখে টীমওয়ার্ক করতে হত। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরির লেজেন্ডের উৎস এখানেই। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ দাসেদেরও তুলোর ক্ষেতে কাজের সময় গাওয়া গানগুলি থেকে এখনকার অনেক ‘স্পিরিচুয়াল’ গস্পেলগীতির আবির্ভাব। ওয়াকিং সংয়ের মত এদেরও বৈশিষ্ট্য ‘কল অ্যান্ড রেসপন্স’ — একটা সোলো ‘কল’ লাইনের পর সবাই মিলে ‘কোরাস’ রেসপন্স।

লোকসংস্কৃতি বেঁচে থাকে চিরন্তন একটা মানবিক ভিত্তির ওপর। সেটার জন্যে ‘সভ্য’ শিক্ষাদীক্ষার কোন দরকার নেই, আভিজাত্য আর ক্লাস মেইনটেইন করার কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। খুবই তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গানগুলি হতে পারে। কিন্তু চিন্তা করে দেখুন, মানুষ কত জাতি-ধর্ম-দেশে বিভক্ত, তারপরও অশিক্ষিত গেঁয়ো চাষী, তাঁতি বা মাঝির মধ্যে কত শক্তিশালী একটা সার্বজনীন মানবিক পরিচয় লুকিয়ে আছে!

আজ আমাদের মনে হতে পারে যে, এসব সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে — আগের ‘ভালো’ জিনিসগুলো আর নেই। সে নিয়ে আক্ষেপ করে প্রোটেকটিভ-প্রোটেকশনিস্ট-ন্যাশনালিস্ট ইত্যাদি হবার কিছু নেই। সেসবকে একশ’ ভাগ ফেরানো যাবে না। আমি বলবো, মানুষের সার্বজনীন সাংস্কৃতিক পরিচয় বিবর্তিত হয়ে বেঁচে থাকবে নতুন কোন মাধ্যমে। ‘সভ্যতার পতন’ ঘটলেও সরল মাধ্যমগুলির সার্বজনীন আকর্ষণ রয়ে যাবে, আর তা ক্রমাগত বিকশিত হতে থাকবে আমাদের ভবিষ্যতপ্রজন্মের মানসে।

ৰালুম আদ্রিয়ানি বা হেড্রিয়ান’স ওয়াল রোমান প্রদেশ ব্রিটানিয়ার উত্তরে ১২২ খ্রীষ্টাব্দে তৈরি শুরু হয়। নর্থ সীর পারে টাইন নদীর তীর থেকে শুরু করে আইরিশ সীর পারে সলওয়ে ফার্থে গিয়ে শেষ। প্রতি পাঁচ মাইলে একটি করে দুর্গ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সবচে’ উত্তরের সীমানা। এরও উত্তরে বাস করত প্রাচীন ব্রিটনদের নানা ‘জংলী’ গোষ্ঠী, যাদের একটি পিক্ট।
জুলিয়াস সীজ়ার আর ট্যাসিটাসের মত ‘প্যাট্রিশিয়ানরা’ ছিল প্রাচীন রোমের অভিজাতশ্রেণী। এদের পূর্বপুরুষরা রোমনগরীর গোড়াপত্তনের সময় সেখানকার অধিবাসী ছিলেন। সাম্রাজ্যে রূপান্তরিত হবার আগে রোম ‘প্রজাতন্ত্র’ ছিল। প্রজাতন্ত্রের সেনেটের সকল সদস্য ছিল প্যাট্রিশিয়ান, আর সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্লিবিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে। আমেরিকার সেনেট-হাউজ সে আদলেই গড়া। ধনাঢ্য প্রভাবশালী রোমান প্যাট্রিশিয়ানরা বংশগৌরবের বড়াই করত, ভাল-খারাপ বংশের ভিত্তিতে জাতপাত মানত। এই ছবিতে এক প্যাট্রিশিয়ানের মূর্তিতে দেখা যাচ্ছে তিনি তাঁর দুই পূর্বপুরুষের আবক্ষ মূর্তি হাতে নিয়ে বংশগরিমা জাহির করছেন।
বেলজিয়ান কমিক্স সিরিজ অ্যাস্টেরিক্স দ্য গলের অ্যাস্টেরিক্স ইন ব্রিটেন পর্বে ব্রিটেনের গোত্রপতি কাসিভেলাউনাসকে চিত্রিত করা হয়েছে এভাবে। সম্ভবত টেমস নদীর উত্তরপারে তাঁর গোত্র কাতুভেলাউনির আবাস ছিল। অন্যান্য সব কেল্ট উপজাতির মত এরাও তাদের অন্যান্য তুতোভাইদের সাথে সবসময় মারামারিতে লেগে থাকত।
৪৮ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের রোমান মুদ্রায় গলের কেল্টিক আর্ভের্নি গোত্রাধিপতি ভারসিন্জেটরিক্সের চিত্র। জার্গোভিয়া শহরে ৫২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে রাজা নির্বাচিত হবার পর রোমসাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে গল প্রদেশের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন। কেল্টিক উপজাতিগুলি আসলে ঐক্যবদ্ধ ছিল না, জুলিয়াস সীজ়ার তার সুযোগ নিয়ে রোমের কর্তৃত্ব বহাল করেছিলেন গলে। ভারসিন্জেটরিক্স যেটুকু ঐক্য আনতে পেরেছিলেন, তা দিয়ে তৈরি সৈন্যদল শেষবারের মত আলেসিয়াতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু সীজ়ারের চতুর যুদ্ধকৌশলের কাছে পরাস্ত হয়। ভারসিন্জেটরিক্সকে বন্দী করে রোমে নিয়ে যাওয়া হয়, বিজয়যাত্রায় তাঁকে শৃংখলাবদ্ধ অবস্থায় রোমানদের সামনে প্রদর্শন করা হয় আর কয়েক বছর পরে বন্দীদশায় তাঁর মৃত্যু হয়। নিচে ডানের মুদ্রাপিঠে তাই চিত্রিত হয়েছে। এসব কাহিনী লিপিবদ্ধ করাটাও অবশ্য রোমান ইতিহাসবিদদের কৃতিত্ব, কারণ কেল্টিকদের সিংহভাগ লিখতে-পড়তে জানত না। যারা জানত, তারা রোমানদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় তা শিখে, আর ধীরে ধীরে লাতিনভাষীই হয়ে যায়। বর্তমান ফরাসী ভাষা লাতিনেরই অপভ্রংশ। ও আরেকটা ব্যাপার হল, কেল্টদের একটা গোত্র সেনোনেস আলেসিয়ার যুদ্ধের তিনশ’ বছর আগে রোম নগরী লুন্ঠন করে। তখন রোম সীজারের সময়কার মত শক্তিশালী ছিল না। তাই আলেসিয়ার বিজয় ছিল রোমানদের একরকম প্রতিশোধ।
ব্রিটিশ চিত্রশিল্পী জন ওপি বুডিকাকে এঁকেছেন এভাবে। তাঁর পোশাকআশাক রোমান ধাঁচের দেখানো হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এমনটা ছিল না। বুডিকা তাঁর সমব্যথী ব্রিটনদেরকে আহ্বান করছেন রোমানদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে ধরার জন্য। রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাস বুডিকার অগ্নিবর্ষী সেই ভাষণের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। বুডিকার নেতৃত্বে ব্রিটনরা বেশ কিছু রোমান সেটলমেন্ট জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয়, আর রোমান সাধারণ নাগরিকরা নিহত-নিগৃহীত হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে ধরা না পড়লেও পলাতক বুডিকা শেষ পর্যন্ত নাকি বিষপানে আত্মহত্যা করেন।
অস্ট্রিয়ার পার্লামেন্ট ভবনের সামনে রোমান ইতিহাসবিদ ট্যাসিটাসের প্রতিকৃতি। রোমের সেনেটরও ছিলেন। অ্যানালস আর হিস্টরিস নামে তাঁর দুটি বইয়ের অংশবিশেষ এখনো বিদ্যমান। সেগুলিতে ট্যাসিটাস অগাস্টাস সীজারের স্থাপিত রোমান সাম্রাজ্যের প্রথম চার সম্রাটের রাজত্বকালের বর্ণনা লিখে গেছেন। ট্যাসিটাস তাঁর শ্বশুর আগ্রিকোলারও জীবনী লিখেন, আগ্রিকোলা ব্রিটেনবিজয়ের পুরোধা সেনাপতি ছিলেন। রোমান ইতিহাসবিদদের মধ্যে ট্যাসিটাস সর্বকালের সবচে’ পরিচিত ও সম্মানিত।
দ্বিতীয় শতাব্দীর মিশরী-গ্রীক ভূগোলবিশারদ টলেমির বর্ণনানুযায়ী মধ্যযুগে আঁকা মানচিত্র। প্রাচীন গ্রীকদের কাছে গ্রেট ব্রিটেন দ্বীপের নাম ছিল আলবিয়ন। পরে ব্রিটানিয়া নামেও পরিচিত হয়। এর উত্তরাংশের নাম ট্যাসিটাসের ইতিহাসে পাওয়া যায় ক্যালেডোনিয়া হিসাবে, সেখানের অধিবাসী ক্যালেডোনিঈ নামে এক গোত্রের নামানুসারে। মধ্যযুগের ‘ইতিহাসবিদদের’ ধারণা ছিল যে আদিকালে আলবিয়নে দৈত্যদের বসবাস ছিল।
ট্যাসিটাসের হিংস্র পিক্টদের বর্ণনা থেকে ষোড়শ শতাব্দীর চিত্রকর তাদের একজনকে কল্পনা থেকে এঁকেছেন এভাবে। এরা নাকি যুদ্ধে হেডহান্টিং করত। দশম শতাব্দীতে পিক্টদের জাতিপরিচয় তাদের রাজনৈতিক মিত্র গেলদের সাথে মিশে যায়। স্কটল্যান্ডে এখনও বড় বড় পাথরে পিক্টদের খোদাই করা নানা নকশা, জীবজন্তুর চিত্র দেখা যায়। ভাষালিপির উদাহরণ পাওয়া গেছে কম।
জার্মানির এক জাদুঘরে ঐতিহাসিক বর্ণনা থেকে কেল্ট যোদ্ধার পোশাক রিকন্স্ট্রাক্ট করা হয়েছে এভাবে। কেল্টরা ইউরোপের অন্যতম আদিবাসী ইন্দো-ইউরোপীয়ভাষী জাত, যেমনটা গ্রীকরা। চেকারড জামা কেল্টদের ট্রেডমার্ক। এখনো আয়ারল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের অনেক ঐতিহ্যবাহী ডিজাইনে কেল্টিক মোটিফ চেনা যায়। কেল্টদের প্রাচীনতম উল্লেখ কমপক্ষে ষষ্ঠ খ্রীষ্টপূর্ব শতাব্দীতে। এরা নগরবাসী না হলেও চামড়া আর ধাতুর কাজ, অস্ত্র তৈরি, পোশাক বানানো — এসবে পারদর্শী ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। স্বাধীনচেতা কেল্টরা রোমানদের বশীভূত হলেও তাদের পূর্ববর্তী সংস্কৃতির ছাপ স্পেনের গ্যালিসিয়া, ফ্রান্সের ব্রিটানি, যুক্তরাজ্যের ওয়েলস, কর্নওয়াল, স্কটল্যান্ড ও আইল অফ ম্যান, হেব্রাইডসের মত ছোট দ্বীপগুলো এবং আয়ারল্যান্ডের মত দূর অঞ্চলের ভাষা, চিত্রকলা আর সঙ্গীতের মধ্যে এখনও রয়ে গেছে।
জার্মানিক বলতে ইতিহাসে ইন্দোইউরোপীয়ভাষী এক বিশাল জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়। তাদের নামেই জার্মানির ইংরেজী নাম, যা এসেছে লাতিন হয়ে। ভাইকিং বা নর্স, অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, জুট, গথ — এরা সবাই জার্মানিক। ফ্রান্সের বর্তমান নাম যাদের নামে, সেই ফ্রাংকরাও জার্মানিক। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিসহস্র সাল থেকে জার্মানিকদের উল্লেখ পাওয়া যায়। পঞ্চম শতকের উথালপাথাল সময়ে হুনরা এশিয়া থেকে মাইগ্রেট করে আসে পূর্ব ইউরোপে, তাদের চাপে জার্মানিক গোত্রগুলি আরো পশ্চিমে সরা শুরু করে। এসব গোত্রের আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের শোচনীয় দশা দাঁড়ায়। রোমানরা এর আগে জার্মানিক গোত্রদের আক্রমণ সফলভাবে মোকাবিলা করেছিল। কিন্তু ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম লুন্ঠন করে ভিসিগথ নামে এক গোত্র, তাদের রাজার নাম ছিল আলারিক। সেরকম সময়েই রোমান ব্রিটেনও জার্মানিক অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সনদের দ্বারা ধীরে ধীরে ‘বিজিত’ হয়। ইংরেজী ভাষা ও ইংরেজ জাতিস্বত্ত্বার যাত্রা শুরু এ সময়েই। ম্যাপে দেখানো হয়েছে অষ্টম শতকের ইংরেজ ইতিহাসবিদ বীডের বর্ণনানুযায়ী ইংল্যান্ডে জার্মানিক গোত্রদের মাইগ্রেশনের আনুমানিক চিত্র।
১৯৪০এর গ্রীষ্মে ফ্রান্স-বেলজিয়াম দখল করে নেয় জার্মান আর্মি। বিশেষত, ফ্রান্সের বিরুদ্ধে দ্রুত বিজয় ছিল অভাবনীয়। হিটলার ভেবেছিলেন, হয়ত ইংল্যান্ড এতে শান্তি-আলোচনায় আগ্রহী হবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি! ১৯৪০এর গ্রীষ্মেই ব্যাটল অফ ব্রিটেন বলে আকাশযুদ্ধে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে সমর্থ হয়। এ যুদ্ধের শহীদদের ব্যাপারেই চার্চিল বলেছিলেন, ‘নেভার ওয়াজ সো মাচ ও’ড বাই সো মেনি টু সো ফিউ’। যদি জার্মান লুফটভাফা সফল হত ব্রিটিশ আকাশশক্তিকে পরাস্ত করতে, তাহলে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ব্রিটেনে সেনা ও নৌ আক্রমণের বন্দোবস্ত প্রস্তুত ছিল, এর কোডনেম ছিল অপারেশন সীলায়ন। এ ছবিতে জার্মান সৈন্যরা তারই মহড়া দিচ্ছে। ব্রিটেনের চ্যানেল আইল্যান্ডসও জার্মানদের দখলে ছিল বিশ্বযুদ্ধের বাকি পাঁচ বছর। ১৭৯০এর দশকে ইউরোপব্যাপী অনেক যুদ্ধাভিযান করেন নাপোলেওনও। ব্রিটেন ছিল তাঁর সবচে’ বড় শত্রু। ১৮০৩ থেকে ১৮০৫এর মধ্যে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ইংল্যান্ড আক্রমণের পাঁয়তারা তাঁরও ছিল। আমেরিকার কাছে লুইজিয়ানা এলাকা বিক্রি করে এ অভিযানের অর্থসংগ্রহ করে ফ্রান্স। আইরিশ বিদ্রোহীদেরও একটা অংশ ফরাসীদের সাথে যোগ দেয়। কিন্তু ফরাসীদের নৌশক্তি ব্রিটিশদের তুলনায় ছিল কম ও অনভিজ্ঞ, তাই শেষ পর্যন্ত এসব প্ল্যান নাপোলেওঁ এগজেকিউট করেননি।
মধ্যযুগে তৈরি বেইয়ো টেপেস্ট্রিতে নরম্যানদের ডিউক দিগ্বিজয়ী উইলিয়ামকে দেখানো হয়েছে এভাবে। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধক্ষেত্রে হঠাৎ শোরগোল ওঠে যে তিনি নাকি নিহত হয়েছেন। তখন উইলিয়াম এক টিলার উপরে দাঁড়িয়ে নিজের মস্তকাবরণ সরিয়ে নিজের চেহারা দেখান, পলায়নপর সৈন্যদের উজ্জীবিত করতে, এটাই এ ছবিতে দেখানো হচ্ছে। সে যুদ্ধে তাঁর জয়লাভের আরেক কারণ ছিল অ্যাঙ্গলো-স্যাক্সন রাজা হ্যারল্ড গডউইনসন প্রায় আড়াইশ’ মাইল উত্তরে আরেক যুদ্ধে নরওয়ের ভাইকিং রাজা হ্যারল্ড হারদ্রাদার সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেন। সেই এক‌ই রণক্লান্ত সেনাবাহিনীকে নিয়ে পাঁচদিনের মধ্যে দক্ষিণ ইংল্যান্ডে আসেন উইলিয়ামকে রুখতে। দুই হ্যারল্ডই দুই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। উইলিয়ামের নরম্যান রাজ্যের অবস্থান ছিল উত্তর ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে। এরা আসলে ভাইকিং লুটেরা-সেটলার আর জার্মানিক ফ্রাংকদের সংকর। এদের ভাষা নর্ম্যান ছিল পুরনো ফরাসীর কাছাকাছি।
গেল হচ্ছে ইন্দোইউরোপীয় একটি ভাষাগোত্র, যাদের মধ্যে ম্যাংক্স, আইরিশ ও স্কটিশ গেলিক পড়ে। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ডেল রিয়াটা রাজ্যমন্ডলীর গোড়াপত্তনের মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ওয়েলস আর কর্নওয়ালের ওপরও এদের প্রভাব ছিল। ডেল রিয়াটার স্কটিশ উত্তরসূরীর নাম আলবা রাজ্য। ম্যাকবেথ সে রাজ্যের রাজা ছিলেন ১০৫৭ সাল পর্যন্ত। রাজা হবার আগে মোরে বলে এক সুদূর এলাকার ‘মোরমেয়ার’ ছিলেন, সেপদ মূলত রাজার মতই সার্বভৌম ছিল। স্কট রাজা প্রথম ডানকান ম্যাকবেথের সাথে যুদ্ধে মারা যান আর ম্যাকবেথ হন পরবর্তী রাজা। তাঁর শাসনামল মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় ম্যালকমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাঁর মৃত্যু হয়। শেক্সপীয়ার তাঁর ম্যাকবেথ নাটক লিখেছেন মধ্যযুগীয় ‘ইতিহাসবিদদের’ বানোয়াট বিবরণের ওপর ভিত্তি করে, তবে তিনি যেভাবে স্কটদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুলে ধরেছেন, সেটা মোটামুটি সত্য। (ছবিতে ম্যাকবেথ)
১২৮৬ সালে স্কটিশ রাজা তৃতীয় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর সিংহাসনের দাবিদার হন তাঁর নাতনী মার্গারেট। কিন্তু মার্গারেট অপরিণতবয়স্ক হওয়ায় স্কটল্যান্ডের অভিজাতরা একটা গার্ডিয়ান কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশশাসন শুরু করে। মার্গারেটও মারা যান ১২৯০এ। তখন বিভিন্ন বনেদী পরিবার রাজসিংহাসনের জন্যে নিজেদের মধ্যে মারামারি শুরু করে দেয়। গৃহযুদ্ধের ভয়ে শেষে তারা ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম এডওয়ার্ডকে নিমন্ত্রণ করে তাদের মধ্যে মীমাংসা করতে। এডওয়ার্ড ‘লংশ্যাংকস’ শর্ত দেন যে আগে তাঁকে ‘লর্ড প্যারামাউন্ট’ হিসাবে তাঁর আনুগত্যস্বীকার করতে হবে। তার পরে তিনি জন ব্যালিওল বলে এক দুর্বলচিত্ত অভিজাতকে রাজা ঘোষণা করেন। যথেষ্ট সমর্থন না থাকা সত্ত্বেও ব্যালিওল এডওয়ার্ডের প্রতি আনুগত্য অস্বীকার করেন। এরই সুযোগে ছিলেন এডওয়ার্ড, এই অজুহাতে তিনি স্কটল্যান্ডে আক্রমণ করেন। জন বালিওল সিংহাসন ছাড়তে বাধ্য হন আর সব অভিজাতদেরকে এডওয়ার্ডকে রাজা হিসাবে মেনে নেবার শপথে বাধ্য করা হ্য়। ১২৯৭-৯৮তে প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন গার্ডিয়ান উইলিয়াম ওয়ালেস। প্রথম কয়েকটা যুদ্ধে জেতার পরে ফলকার্কের যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন। ওয়ালেসের পরে রবার্ট ব্রুস একাধিক ইংলিশ ষড়যন্ত্রকে সফলভাবে প্রতিহত করতে সমর্থ হন, আর তাদের নাকের ডগা দিয়ে পার্থে রাজ্যাভিষেক করে স্কটল্যান্ডের রাজা হন। এরপর বেশ ক’টি যুদ্ধে হারার পরে পলাতক জীবনযাপন করতে হয় তাঁকে, তাঁর পরিবারও একসময় ইংরেজদের কাছে রাজবন্দী ছিল। স্কটরা সফল গেরিলাযুদ্ধ চালানোর পর ১৩২৭এ তখনকার ইংলিশ রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেন। (ছবিতে রবার্ট দ্য ব্রুস)
১৭৭০এর এই এনগ্রেভিংয়ে দেখা যাচ্ছে গান গাইতে গাইতে স্কটিশ গ্রাম্য নারীদের উলের তৈরি টুইড কাপড় ওয়াকিংয়ের চিত্র। গানের তাল কাজের অগ্রগতির সাথে আরো দ্রুত হত, কারণ শেষের দিকে কাপড়ের ঘনত্ব বেড়ে যাওয়ায় তাকে আরো দ্রুততার সাথে কম্প্রেস করতে হত। কাপড়ের কুন্ডলীটা ঘড়ির কাঁটার দিকে হাতে হাতে ঘুরত, উল্টোদিকে ঘুরানো ছিল অমঙ্গলজনক। এখনকার যুগে আর এধরনের কাজ কেউ করে না। পঞ্চাশের দশকে শেষ সত্যিকারের ওয়াকিং হয়েছিল বলে লোকসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তবে ওয়াকিং সংয়ের ঐতিহ্য বেঁচে রয়েছে স্কটিশ হাইল্যান্ডস, আউটার হেব্রাইডস দ্বীপপুঞ্জ আর কানাডার নোভা স্কশিয়ার কেপ ব্রেটন আইল্যান্ডের স্কটিশ সেটলারদের বংশধরদের মাঝে।
ষষ্ঠ জেমসের মা ছিলেন স্কটল্যান্ডের রাণী মেরি, তাছাড়াও জেমস ইংল্যান্ডের রাজা, আয়ারল্যান্ডের লর্ড, সপ্তম হেনরির বংশধর ছিলেন। ১৫৬৭ সালে তের মাস বয়েসে স্কটল্যান্ডের রাজা হন, আর ইংল্যান্ডের টিউডর বংশের রাণী প্রথম এলিজাবেথ সন্তানহীন অবস্থায় মারা যাবার পরে ১৭০৭এ ইংল্যান্ডের প্রথম জেমস হিসাবে তাঁর অভিষেক হয়। তিনি ইউরোপের ক্যাথলিক-প্রটেস্ট্যান্টদের যুদ্ধ থেকে যুক্তরাজ্যকে দূরে রাখতে সক্ষম হন। মধ্যপন্থী শান্তিপ্রিয় জেমস অবশ্য সেই উত্তাল সময়ে ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক আর প্রটেস্ট্যান্ট দু’পক্ষেরই ঘৃণার পাত্রে পরিণত হন। ক্যাথলিকরা তাঁকে মারার চেষ্টা করে (গানপাউডার প্লট), আর অ্যাংলিকান চার্চের সদস্যরা ভাবত জেমস ক্যাথলিকদের প্রতি প্রয়োজনাতিরিক্ত সহানুভূতিশীল। এসব কারণে ১৬৪২এর ইংলিশ গৃহযুদ্ধের বীজবপন হয়। আয়ারল্যান্ড ও স্কটল্যান্ড জেমসের আইনানুগ উত্তরসূরীকে সমর্থন করে, আর ইংল্যান্ড হল্যান্ডের প্রিন্স অফ অরেন্জ উইলিয়ামকে। জেমসের সময়েই আমেরিকায় ব্রিটিশ কলোনাইজেশন শুরু হয়। আর তাঁর পৃষ্ঠপোষকতাতেই কিং জেমস বাইবেল সংকলিত হয়, যা থেকে আজকের বেশির ভাগ ইংরেজী বাইবেলের সংস্করণ এসেছে, ছবিতে তার মুখবন্ধ।
জন হেনরি সম্ভবত ঐতিহাসিক চরিত্র নন, অনেকের অবশ্য ধারণা তাঁর কাহিনী আসলেই ঘটেছিল ১৮৭০ সালের দিকে। কৃষ্ণাঙ্গ জন হেনরি ছিলেন ‘স্টীল-ড্রাইভিং ম্যান’ — তাঁর দায়িত্ব ছিল স্টীলের তৈরি একটা ড্রীলকে হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে পাথরে ঢুকিয়ে গর্ত তৈরি করা। সে গর্তে বিস্ফোরক ভরে পাহাড় ভেঙে রেললাইনের জন্যে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হত। জন হেনরির চাকরি খাবার জন্যে অবশ্য স্টীমচালিত হাতুড়ি চলে এসেছে। তার সাথে প্রতিযোগিতা করে জিতলেন জন হেনরি, কিন্তু বিজয়শেষে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন — গানের মূল বিষয়বস্তু এই। আমেরিকা আর বহির্বিশ্বে এ গান শ্রমজীবীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, সিভিল রাইটস মুভমেন্টে ব্যবহৃত হয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের আরেকরকম গান ‘স্পিরিচুয়াল’ হলো মূলত ধর্মীয় গীত। এতে প্রকাশ পেয়েছে তাদের দুঃখকষ্টের বর্ণনা আর সেসবের পরে যে পরকালে তাদের জন্যে স্বর্গ রয়েছে, তার আশা। এগুলিও মূলত শ্রমসঙ্গীত বা ওয়ার্ক সং। বর্তমানের ব্লুজ়ের উৎপত্তি কৃষ্ণাঙ্গ স্পিরিচুয়াল থেকে। চিত্রে জন হেনরির কাহিনী।
বাংলাদেশী নৃতত্ত্ববিদ ও লোকসংস্কৃতির গবেষক ড. মাহবুব পিয়ালের এই ইন্টারভিউতে তিনি সারিগান নিয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন, সাথে গান গেয়েছেন। তাঁর কথাগুলো ভাল করে শুনবেন, বিশেষ করে ইতিহাসের ডিটেইলের বদলে তার অর্থটা আসলে কি, এটা বোঝার ওপর তিনি ভদ্রভাবে জোর দিয়েছেন — উপস্থাপিকার ইতিহাসের রেফারেন্সের বিপরীতে। আরো সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন কেন লোকসংস্কৃতি ‘হারিয়ে যাবার’ কারণে আক্ষেপের কিছু নেই। আমি উনার সাথে সম্পূর্ণ একমত। সময় পেলে অনুষ্ঠানটি দেখুন। আর লোমাক্স দ্য সংহান্টার ডকুমেন্টারি দেখলে বুঝবেন লোকসঙ্গীতপ্রেমীরা কিভাবে সেগুলি খুঁজে বের করে রেকর্ড করে রাখেন, কালের আবর্তে হারিয়ে যাবার আগে।
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!