প্রেতাত্মার রাত্রি

Featured Video Play Icon

হ্যালোউইন সমাগত প্রায়। অক্টোবর শেষের এই উৎসব আমেরিকাসহ বিশ্বের নানা দেশে নানা নামে পালিত হয়। এদেশের বাচ্চারা ভূত-প্রেত-দত্যি-দানোর সাজ পড়ে পাড়ার বাড়ি বাড়ি যায় ভয় দেখাতে। ট্রিক অর ট্রীট বলে টফি-চকলেট আদায় করে নেয়।

এই উৎসব মার্কিনদেশে এসেছে ইংল্যান্ড-আয়ারল্যান্ড থেকে। এখন সেক্যুলার অনুষ্ঠান হিসাবে পালিত হলেও, খ্রীষ্টধর্মের ঐতিহ্যের অংশ এটা। হ্যালোউইন মানে হ্যালোড ইভ়নিং বা পবিত্র রাত্রি, যে রাত সকল সন্তের উদ্দেশ্যে প্রার্থনার জন্যে উৎসর্গীকৃত। কিন্তু এর শিকড় প্রাক-খ্রীষ্টান কেল্টিক ড্রুইড ঐতিহ্যে, যার ‌বৈশিষ্ট্য পূর্বপুরুষ আর প্রকৃতিদেবীর আরাধনা। বর্তমান যুগে সে ঐতিহ্যের বাহক আইরিশরা হ্যালোউইনকে সাওয়িন নাইট বা পবিত্ররাত্রি হিসাবে পালন করে — শুধু সেটা তাদের ক্যাথলিক ধর্মে এসে নতুন তাৎপর্য পেয়েছে।

হ্যালোউইন আসলে একটা হারভেস্ট ফেস্টিভাল বা নবান্ন পরব। ফসল কাটা শেষে পড়শীদের মধ্যে মিষ্টি-খাবার আদান-প্রদানের উৎসব। সে থেকে পাম্পকিন প্যাচের হোৎকা কুমড়ো আর খড়ের গাঁদা। আবার বছরের একই সময়ে শীতের প্রাক্কালে ঊর্বরতা বিদায় নেয়, আর প্রকৃতিমাতার ঘুম অথবা ‘মৃত্যুর’ প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়।

হ্যালোউইনের সাথে সেজন্যে মৃত্যুরও একটা যোগাযোগ আছে। ভূতপ্রেত সাজার ব্যাখ্যাও সেটা, যদিও এরকম সাজসজ্জা তুলনামূলকভাবে নতুন প্রচলন। অনতিপ্রাচীনকালে এসময় পরলোকগত পূর্বপুরুষদের স্মরণ-সম্মান করা হত। প্রাক-কলাম্বাস যুগের ঐতিহ্য ধরে মেক্সিকোতে হ্যালোউইনের সময়েই পালন করা হয় দিয়া দে লস মুয়ের্তোসকোকো নামের ডিজ়নি ছবির কাহিনী এ নিয়েই।

যারা নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা তাদেরকে বোঝানো একটু কঠিন উত্তরের দেশগুলিতে এসময় কি ধরনের ঋতুপরিবর্তন হয়। আবহাওয়া হঠাৎ করে ঠান্ডা হয়ে যায়, পর্ণমোচী বৃক্ষ সবুজ পাতা ঝেড়ে ফেলে ধূসর হাতের মত শাখাপ্রশাখা নিয়ে ভূত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একটা শীতল স্যাঁতসেঁতে বাতাস সেসব উদোম ডালপালার ভেতর দিয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ করে বয়ে যায়। দিন ছোট হয়ে আসে আর অনেক জায়গায় ঝাঁপ দিয়ে পাঁচটার সময় থমথমে অন্ধকার হয়ে যায়। গায়ে কাঁটা দেয়ার মত ব্যাপারস্যাপার!

সাজপোশাকের পাশাপাশি হন্টেড হাউজ় বা পোড়োবাড়িগুলোর ব্যবসাও এসময় তুঙ্গে ওঠে। সাবার্বের বাড়িগুলিকেও পোড়োবাড়ি সাজানোর হিড়িক পড়ে যায়। পাম্পকিন প্যাচ আর থিম পার্কগুলিতে স্পেশাল ভয়ের রাইডগুলি ছোট-বড় ফ্যান্কেনস্টাইন আর ড্রাকুলার ভীড়ে ভর্তি হয়ে যায়।

কানাডিয়ান শিল্পী লরীনা ম্যাককেনিটের ‘অল সোলস নাইট’ নামের এই গানটা বিভিন্ন সংস্কৃতির হ্যালোউইন কিংবা একই ধরনের উৎসবের মূল প্রাচীন ভাবাবেগটা নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছে। বোনফায়ারের চারদিকে নেচে চলেছে ছায়ার দল, এরা ইউরোপীয় ভূত। আর মোমবাতি-কাগজের লন্ঠনের কাঁপা-কাঁপা আলোতে জাপানীদের পিতৃপুরুষ-স্মরণের ওবোন উৎসব। অক্টোবরের পরিবর্তে অবশ্য অগাস্টে পালিত হয় ওবোন।

মৃত্যু ব্যাপারটা আমাদের সংস্কৃতিতে একরকম টাবু। আমরা সে ব্যাপারে আলোচনা করতে ভয় পাই, বিমর্ষ হয়ে পড়ি। গুরুগম্ভীর টপিক সেটা। সেটা অমূলক নয়। যদিও ইসলামধর্মে মৃত্যুকে খোদার নিকট ফিরে যাওয়া হিসাবে ধরা হয়, অর্থাৎ আসলে টাবু কোন বিষয় এটা নয়। আমার মতে, হ্যালোউইন বা অল সোলস নাইটের মত উৎসব পালনের মাধ্যমে অন্যান্য সংস্কৃতিতে মৃত্যুকে নরমালাইজ় করার চেষ্টা করা হয়েছে। পরলোকগত পিতৃপুরুষদের সম্মান করে তাঁদের জীবদ্দশার আনন্দের স্মৃতি আর সাফল্যগুলো স্মরণ করা এবং সেসবের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে স্রষ্টার কাছে তাঁদের জন্যে প্রার্থনা করা — মৃত্যুর বিষণ্ণতাকে লাঘব করার জন্যে এ এক অনন্য উৎসব।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!