চীনের আপৎকালে যুক্তরাষ্ট্র


ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে প্রাক-আধুনিক যুগের বহু সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা ছিল করুণ। ইউরোপে অটোমান সাম্রাজ্য, পশ্চিম এশিয়ায় ইরানী আব্বাসী সাম্রাজ্য, চীনের চিং, ভারতের মুঘল — এরা সকলেই ইউরোপীয়, মূলত ব্রিটিশ, ফরাসী, অস্ট্রোহাঙেরীয়, রুশ, কিংবা জাপানী আগ্রাসনের সম্মুখীন। আফ্রিকার পুরনো রাজ্যগুলিও ছিন্নবিচ্ছিন্ন, তাদের ভাগাভাগি করে উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করছে ব্রিটিশ-ফরাসী-জার্মানরা। ডাচ, পর্তুগীজ ও স্পেনীয়রাও দ্বিতীয় কাতারে।

ফরাসী পত্রিকা ল্য পতি জু্র্নালে চীন ভাগাভাগির কার্টুন, ১৮৯৮

একটা ব্যাপার মাথায় এল যে, মুঘল সাম্রাজ্যের অধঃপতনের মূল সুবিধাভোগী হল ব্রিটিশরা। অটোমান সাম্রাজ্য থেকে অস্ট্রীয়, ব্রিটিশ ও রুশ পৃষ্ঠপোষকতায় স্বাধীনতা পেল কিংবা বিচ্ছিন্ন হল গ্রীস, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, বসনিয়া, আলবেনিয়া প্রভৃতি। কিন্তু চীনের ভাগ্য কেন এমন টুকরোটুকরো হল না? ইউরোপীয় ও জাপানীদের চীন নামের কেক কেটে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করার কার্টুন তো সে সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু আসলে তো তা হয়নি।

হ্যাঁ, হংকং ও মাকাউ ব্রিটিশ ও পর্তুগীজদের কলোনি ছিল। চীনের বিভিন্ন বন্দরে পশ্চিমা, রুশ ও জাপানীদের বিশেষ সুবিধা ছিল। শাংহাইয়ে ছিল ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্ট। ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের মত এক্সট্রা-টেরিটরিয়ালিটি সুবিধা। কিন্তু মুঘল সাম্রাজ্যের মত ফরেন কলোনাইজেশনের সম্মুখীন হয়নি চীন। আবার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত পক্ষ তুরস্ক ও অস্ট্রোহাঙেরি যেভাবে বিভক্ত হয়ে “ডিকলোনাইজেশন”ধাঁচের ব্রেকআপের মাধ্যমে নতুন কিছু দেশের জন্ম দিয়েছিল, সেরকম ভাগ্যও চীনের হয়নি। যদিও সেটিও মূলে মাল্টিএথনিক এম্পায়ার রুলড বাই আ মাইনরিটি পীপল। হংকং-মাকাউয়ের মত কলোনি পর্তুগীজদের গোয়া-দমন-দিউ কিংবা ব্রিটিশদের ফোর্ট উইলিয়ামের থেকে তেমন কিছু বেশি ছিল না। বাকি চীনের আয়তনের তুলনায় এ সকল উপনিবেশ নিতান্তই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র।

তবে ফোর্ট উইলিয়াম যেমন ব্রিটিশ বেঙ্গলের ভবিষ্যতের দিকেই নির্দেশ করছিল, চিং শাসনামলের এক পর্যায়ে মুঘল সাম্রাজ্যের সেইরকম শেষ পরিণতির দিকেই যাচ্ছিল চীন। সে থেকে ঘটনাচক্রে তারা রক্ষা পায় এক উঠতি স্থানীয় পরাশক্তির কারণে। সে পরাশক্তিটি যুক্তরাষ্ট্র!

এ বলছি না যে, যুক্তরাষ্ট্র কেবল শুভানুধ্যায়ী হিসাবে চীনের পাশে এসে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়ায়। সেটা অবশ্যই একটা লেভেলে ছিল। তবে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারের “নিকট” প্রতিবেশী হিসাবে চীনের ভাগ্য নিয়ে কিংবা চীনে নিজেদের স্বার্থ নিয়ে মার্কিনদের মাথাব্যথা আর সক্ষমতা দুটোই যথেষ্ট ছিল, যেটা তুরস্ক কিংবা ভারতের বেলায় অতটা ছিল না। ইউরোপীয় ও জাপানীদের ওজনের বিপরীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনা দাঁড়িপাল্লায় বিশাল এক ব্যালেন্স হিসাবে কাজ করে।

একটু ব্যাখ্যা করে বলি চীনকে সম্পূর্ণ উপনিবেশায়নের হাত থেকে কিভাবে একার্থে মার্কিনরা রক্ষা করে।

চীনের সাথে ইউরোপীয়দের সরাসরি বাণিজ্য শুরুর অনেক পরে মার্কিনদের আবির্ভাব। অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাষ্ট্র থেকে দুয়েকটা সরকারী মিশন সরাসরি যায়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা চীনে আফিমের ব্যবসায় বেশি জড়িত ছিল। ব্রিটিশরা যেখানে ভারত থেকে একচেটিয়া আফিম রপ্তানী করত, সেখানে মার্কিনরা পারস্য থেকে কিনে সে বস্তু চীনে বিক্রি করত। চীনে এ বাণিজ্যের সিংহভাগ অবশ্য ছিল ব্রিটিশদের হাতে।

চীনে স্থানীয় পোশাকপরিহিত মার্কিন মিশনারি, ঊনবিংশ শতক

এর পাশাপাশি মার্কিন মিশনারিদের আনাগোনা হতে শুরু করে চীনে। ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি বিদ্যালয়, হাসপাতাল প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনের জনগণের মাঝে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসে তারা। মিশনারিদের অনেকে এখনো খারাপ দৃষ্টিতে দেখেন। কিন্তু সত্য এত সোজাসাপ্টা নয়। আমি, আমার পরিবারের একাধিক সদস্য শিক্ষিত হয়েছি ক্যাথলিকপরিচালিত স্কুল বা কলেজে। ধর্মপ্রচারণার বিন্দুমাত্র অন্তত আমি দেখিনি। চীনের কিছু সাধারণ মানুষও মিশনারিদের শিক্ষার সে সুফল ভোগ করে।

আফিম যুদ্ধে পরাজয়ের পর চিং সাম্রাজ্যকে অনেক ছাড় দিতে হয় ব্রিটিশদের কাছে। বাণিজ্যে তারা পায় মোস্ট ফেভারড নেশনের সম্মান। পাঁচটি বন্দরে মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা পায়। এর আগে সরকারীভাবে চীনের অভ্যন্তরের সাথে সরাসরি বাণিজ্য ছিল নিষিদ্ধ, তবে চোরাকারবারী ঠিকই চলত। ব্রিটিশরা এই লাভজনক সরকারী সুবিধাটি পাওয়ার কারণে ‌অন্যান্য বাণিজ্যিক শক্তিরাও একই ন্যায্য দাবি নিয়ে চীন সম্রাটের কাছে দূত পাঠায়। সামরিক হুমকি দিয়ে হোক, উপঢৌকনের বিনিময়ে হোক, সে দাবি আদায় করে নেয় ফরাসী, রুশ, জাপানী, ও অন্যান্য দেশ। সাথে মার্কিনরাও।

যুক্তরাষ্ট্রের নেভাডায় রেললাইন তৈরিতে নিযুক্ত চীনা শ্রমিক, ঊনবিংশ শতক

মার্কিন বণিকরা যখন চীনা বন্দরে ব্যবসারত, তখন চীনা শ্রমিকদেরও আগমন হতে থাকে ক্যালিফোর্নিয়াসহ অন্যান্য মার্কিন টেরিটরিতে। প্যাসিফিক রেলওয়ে লাইনে কাজ করে অনেকে, আবার নতুন আবিষ্কৃত স্বর্ণখনিতেও। স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি চীনা আসে যে অনেক মার্কিন নাগরিক চীনাবিদ্বেষ পোষণ করতে শুরু করে। পরবর্তীতে চীনা শ্রমিকদের প্রবেশ কয়েক দশকের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। তারপরও এখনো সান ফ্রান্সিস্কোতে অনেক পরিবারের দেখা মিলবে যারা সেই চীনাবংশোদ্ভূত।

শুধু যে শ্রমিকের আগমন হয় তা নয়। ১৮৫০ ও ১৮৬০এর দশকে তাইপিং নামে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ হয় চীনে। চিং সাম্রাজ্য ছিল পতনের দ্বারপ্রান্তে। মার্কিন ও ইউরোপীয়দের প্রযুক্তিগত ও সামরিক সহযোগিতায় সে যাত্রা বেঁচে যায় হান জনগোষ্ঠীর ওপর শাসনরত বহিরাগত মাঞ্চুরিয়ান রাজপরিবার। এর পর তাদের উপলব্ধি হয় যে পশ্চিমা প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণ না পেলে তারা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে না। চায়নিজ এডুকেশন মিশন নামে একটি প্রজেক্টে দেড়শ’র মত টীনেজ বয়েসী চীনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পড়তে আসে। এসব সাংস্কৃতিক লেনদেনে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন আদিতে চীনে বাণিজ্যকরা মার্কিন ব্যবসায়ীরা আর তদকালীন স্টেট ডিপার্টমেন্ট।

কানেকটিকাটে চায়নিজ এডুকেশন মিশনের চীনা ছাত্রদের বেসবল টীম, ১৮৭৮
যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত চিং সম্রাটের রাষ্ট্রদূত লিয়াং চেং, চায়নিজ এডুকেশন মিশনে শিক্ষিত, বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ডের প্রতিষ্ঠায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন, বিংশ শতকের প্রথমভাগ

চায়নিজ এডুকেশন মিশনে যারা প্রশিক্ষণ পেয়েছিল, এদের অধিকাংশ আর ফিরে যায়নি। চিং সম্রাট এদের পাঠালেও সম্রাটের হর্তাকর্তাদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়াশীল দল ছিলই। এরা তাইপিং বিদ্রোহের জন্যে তাইপিং নেতার পশ্চিমা মিশনারি শিক্ষা, আর তার খ্রীষ্টান সিনক্রেটিক ধর্মকে দোষারোপ করে। তাছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে চীনাবিদ্বেষী মনোভাব থেকে ইমিগ্রেশনের ওপর কড়াকড়ি হবার কারণেও চায়নিজ এডুকেশন মিশন বন্ধ করার একটা চাপ আসে। ছাত্ররা বেশি বেশি পশ্চিমা ও “বিলাসী” হয়ে যাচ্ছে এমন জজবা তোলা হয়। তবে এদের মধ্যে যারা ফিরে গেছিল, তাদের অনেকেই চীনে পজিটিভ একটা অবদান রাখে। প্রজাতন্ত্রী চীনের একাধিক মন্ত্রী ও রাষ্ট্রনেতা ছিলেন মার্কিনশিক্ষিত। সামাজিক সংস্কার, বিশেষ করে নারীদের পা-বাঁধার কুসংস্কারের বিরুদ্ধেও আমাদের দেশের বিদ্যাসাগরের মত ভূমিকা রাখেন এসকল মার্কিনশিক্ষিত চীনারা।

১৯০৫এ কোরিয়ায় মোতায়েন জাপানী সৈন্য, লক্ষ্য করুন পশ্চিমা পোশাক ও অস্ত্রসজ্জা

জাপান সাগরের অপর পারে কিন্তু চলছিল চিংদের সংস্কারবিমুখতার বিপরীত চিত্র। জাপানীরা খুব দ্রুত পশ্চিমাদের সাথে বাণিজ্যের রাস্তা খুলে দেয়। পাশাপাশি বিভিন্ন পাশ্চাত্যদেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। নইলে তারা ১৮৫০এর দশক নাগাদ চীনের মতই বন্ধ দেশ ছিল। পশ্চিমা বিভিন্ন দেশ ও কম্পানিকেও পরস্পরের সাথে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত রেখে তারা নিজেদের আখেরটা গুছিয়ে নেয়। খুব দ্রুত একটা রাজনৈতিক ও শিল্পসংস্কার ঘটে যায় সে দেশে। অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিতে পরিণত হয় জাপান।

পশ্চিমা দেশগুলির সাথে চীনে “অধিকার আদায়ের” প্রতিযোগিতায় শামিল হয় জাপানও। নানা ছুঁতোয় কোরিয়া উপদ্বীপের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে চীনের সাথে যুদ্ধ হয় জাপানের। সেটা ১৮৯৪/৯৫ সাল। পরাজিত চীন কোরিয়ায় জাপানের অধিকার মেনে নেয়, সাথে আরো কিছু সুযোগ সুবিধা ছেড়ে দেয়।

কাঁচি দিয়ে চীনের মানচিত্র কাটতে উদ্যত জার্মানি, ইতালি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, ফ্রান্স। মাঝখানে ওপেন ডোর পলিসির কাগজ হাতে বাগড়া বেঁধে দাঁড়িয়েছে আংকল স্যাম, পাক ম্যাগাজিন, ১৮৯৯

এখানেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রথম অবতীর্ণ হয় চীনের অখন্ডতা রক্ষায়। চীনের এই দুর্বল অবস্থার সুযোগে মুখিয়ে ছিল ব্রিটিশ, ফরাসী, জাপানী, রুশ সকলে। ল্য পতি জু্র্নাল নামের ম্যাগাজিনে তখনই সেই কেক কাটার কার্টুন প্রকাশিত হয়। এ সকল পরাশক্তি চীনকে টুকরো টুকরো করে যার যার নিজের “স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স” বানানোর স্বপ্নে গোপনে এক অন্যের সাথে মোলাকাত করতে থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকার মত বড় একটা ভূখন্ড নিজেদের বোঝাপড়ার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নেয়া।

যুক্তরাষ্ট্রের ওপেন ডোর পলিসি নিয়ে ব্রিটিশ কার্টুন যে রুশ ভল্লুক ভদ্রভাবে মার্কিন ফ্রী ট্রেড লেডিকে চীনের ওপেন ডোর দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেবে (সার্কাজম অর্থে!), ১৮৯৯ পাঞ্চ ম্যাগাজিন

কিন্তু বাদ সাঁধে মার্কিনরা। তাদের নীতি ছিল “ওপেন ডোর পলিসি।” সে নীতি অনুযায়ী চীনে মুক্তবাণিজ্যের ক্ষেত্রে সকল দেশ সমান অধিকার ভোগ করবে। চীনের ভৌগোলিক-রাজনৈতিক অখন্ডতা বজিয়ে থাকবে। বাণিজ্যকর আদায়ের দায়িত্ব সম্পূর্ণ চিং সরকারের। বাংলায় ব্রিটিশরা যেমন মুঘল সম্রাটকে ঘুষ দিয়ে সে লাভজনক দায়িত্ব বাগিয়ে নিয়েছিল, সেটি হবে না। অন্যান্য পরাশক্তি মার্কিনদের এই ওপেন ডোর পলিসির সাথে একমত না হলেও নতুন পরাশক্তিটির ভৌগোলিক নিকটতা আর সামরিক শক্তির ভয়ে চুপচাপ সেটা মেনে নেয়। সে যাত্রা বেঁচে যায় চীন।

জাপানের সাথে যুদ্ধে হারার পর আবার একটা বোধোদয় ঘটে চীনের নেতৃত্বের মধ্যে। তরুণ সম্রাট গুয়াংশু রাজ্যের সুশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের একটি ছোট দল নিয়ে নতুন করে একটি সংস্কার আন্দোলন দাঁড়া করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সে আশায় গুঁড়েবালি! একশ’ দিনের মাথায় রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল আমলা ও সেনানায়করা বিধবা রাণীমাতা সিশিএর নেতৃত্বে সংস্কারপন্থীদের ক্যুয়ের মাধ্যমে পদচ্যুত করে। অনেক বুদ্ধিজীবী নিহত হন, গুয়াংশু হন প্যালেস প্রিজনার। আবার অন্ধকার যুগে ফিরে যায় চীন।

চীনের অশীতিপর বৃদ্ধা বিধবা রাণীমাতা সিশি, চীনের সকল আধুনিকায়ন ও সংস্কার রহিত করেন, বক্সারদের উস্কানি দেন, ফলশ্রুতিতে চিং সাম্রাজ্যের শেষ ঘন্টা বেজে ওঠে, ১৯০০

প্রতিক্রিয়াশীলতার সাথে যুক্ত হয় সাধারণ মানুষের জাতীয়তাবাদী ক্ষোভ আর বিদেশীবিদ্বেষ। শহরে শহরে গড়ে ওঠে কুংফুএর মুগুরভাঁজা “বক্সার” ষন্ডাদের ক্লাব — অনেকটা অনুশীলন সমিতির মত। এবার চিং সাম্রাজ্যের প্রকাশ্য সমর্থন ও সহায়তায় প্রতিটি প্রদেশে এসকল বক্সার মব আক্রমণ করতে থাকে বিদেশী যে কোন কিছু। হোক খ্রীষ্টান মিশন, দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল। এ অবস্থায় চিং সম্রাট ইচ্ছাকৃতভাবে হাত গুঁটিয়ে বসে থাকার কারণে বিদেশী চৌদ্দটি দেশ একসাথে একটি শান্তিরক্ষীবাহিনী পাঠায় চীনে। অনুপ্রবেশের দোহাই দেখিয়ে এদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করে সিশির প্রতিক্রিয়াশীল সরকার। যেসব সংস্কার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছিলেন সিশি, সেগুলির অভাবেই দ্রুত পরাজিত হয় কুস্তিগীর বক্সার বিপ্লবী আর চিং সেনাদল।

১৯১১ সালের পূর্বের মাঞ্চুরিয়ার মুগুরভাজা বক্সারদের চিত্র
১৮৯৯ সালের বক্সার বিদ্রোহের সময় বক্সার ও চিং সেনাদল পশ্চিমা, সন্দেহজনক পশ্চিমা চর ও খ্রীষ্টানদের ওপর বেধড়ক হত্যাকান্ড চালায়, ধ্বংস হয় তাদের জীবিকা

কিন্তু যে বিদেশী কনসার্নগুলির বিপুল ক্ষয়ক্ষতি বক্সার বিদ্রোহ থেকে হয়, তার পুরো ক্ষতিপূরণের দাবি থেকে মুক্তি পেলেন না সিশি। চিং সরকারকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলিকে বিশাল পরিমাণের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হতে হল। এ ছিল লাস্ট স্ট্র অন দ্য ক্যামেল’স ব্যাক। চিং সাম্রাজ্যের বাকি দিন ছিল হাতেগোনা।

বক্সার বিদ্রোহের ক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু বাকি পরাশক্তিগুলোর থেকে ভিন্ন একটা পন্থা অবলম্বন করে। বক্সারের ক্ষতিপূরণ থেকে একটা বিশাল অংশ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে উদ্বৃত্ত রয়ে যায়। ১৯০৮ সালে কংগ্রেস ঠিক করে যে এ টাকা চীনকে ফিরিয়ে দেয়া হবে। এ চিন্তাটি আর কোন পরাশক্তি করেওনি। যুক্তরাষ্ট্রে চালু হয় বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ নামে একটি বিখ্যাত এডুকেশন ফান্ড। এর মাধ্যমে প্রচুর চীনা ছাত্র আবারও পড়তে আসে যুক্তরাষ্ট্রের নামীদামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এদের অনেকেই পরে প্রজাতন্ত্রী ও গণপ্রজাতন্ত্রী কম্যুনিস্ট চীনা মূল ভূখন্ড আর তাইওয়ানে বিদ্বান ও বিজ্ঞানী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হন। বক্সার ইনডেমনিটি ফান্ড থেকে বেজিংএ একটি প্রযুক্তি কলেজও শুরু হয়, যার নাম ছিংহুয়া। এটি কিন্তু এখনও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের এক নাম্বার বিদ্যাপীঠ।

বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপ পাওয়া প্রথম ব্যাচের ছাত্রছাত্রী, ১৯০৯ সাল। সামনের সারিতে বসা ভবিষ্যৎ প্রজাতন্ত্রী প্রেসিডেন্ট চৌ জিচি।
বক্সার ইনডেমনিটি স্কলারশিপের টাকায় প্রতিষ্ঠিত চীনের নাম্বার ওয়ান বিশ্ববিদ্যালয় ছিংহুয়ার বর্তমান চিত্র

ওদিকে ১৯০৫এ রুশ-জাপানী যুদ্ধের পর আবারও জাপান মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর-পূর্ব চীনে রুশদেরকে সরিয়ে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়। তখনো মার্কিনরা যুদ্ধ ব্যতিরেকে কূটনীতির মাধ্যমে চীনের অখন্ডতা নিশ্চিত করে। চীনের চলমান সংস্কারেও মার্কিন সাহায্য আসতে থাকে। ১৯১২ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয় চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই পরিবর্তনকে স্বাগত জানায়। একই সাথে ওপেন ডোর পলিসির প্রতি নতুন করে আস্থা ব্যক্ত করে।

১৯১১ সালের শিনহাই বিপ্লবের মাধ্যমে চীনের চিং সাম্রাজ্যের উচ্ছেদ হয়, প্রতিষ্ঠিত হয় প্রজাতন্ত্রী সরকার
চীনা বিপ্লবের পুরোধা সুন ইয়াত সেন, ১৯১০, ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত হাওয়াইয়ে মার্কিন শিক্ষায় শিক্ষিত হন
ইউয়ান শিকাই, চীন প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি, ১৯১৫। সুন ইয়াত সেনের পরিবর্তে তাকে আপোষে রাষ্ট্রপতি বানানো হয়। পরে নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করতে গিয়ে পুরো দেশে বিশৃংখলা অরাজকতার জন্ম দেন এই পুরনো ধাঁচের চিং জেনারেল।

তবে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে আবার বিপদে পড়ে যায় চীন। ব্রিটিশদের অনুরোধে জাপান মিত্রপক্ষে যোগ দেয়। কারণ আর কিছুই না। চীনের যে স্বল্প কিছু অংশে জার্মান কলোনি ছিল সেগুলি কব্জা করা। ব্রিটিশরা সেটা মেনে নেয়। কিন্তু জাপানীদের লোভ ছিল আরো বিস্তৃত। একুশ দফা নামে ১৯১৫ সালে তারা একটি আলটিমেটাম দেয়। এর সারবত্তা ছিল চীনের সকল কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক আর প্রশাসনিক দায়িত্ব জাপানের কাছে ছেড়ে দিতে হবে। সোজা কথায় চীন পরিণত হবে জাপানীপ্রশাসিত চীনে। যেখানে চীন নামটা ঠিক থাকবে, কিন্তু আসলে পরিচালিত হবে জাপানীদের দ্বারা।

ইউরোপের যুদ্ধে ব্যস্ত থাকা ব্রিটিশ ও আমেরিকানরা জাপানীদের সুযোগ নিয়ে এমন খাইখাই করাটা একদম সহ্য করেনি। তারা এই আল্টিমেটাম পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিনরা উল্টো চীনা সরকারকে বলে দেয় যেকোন মূল্যে জাপানকে রুখতে, যুক্তরাষ্ট্রের তাতে সমর্থন থাকবে। অবস্থা বেগতিক দেখে জাপানীরা পিছপা হয়। খুব সামান্য অর্জনের বিনিময়ে তারা খোয়ায় ব্রিটিশ ও মার্কিনদের বিশ্বাসভাজনতা। এ ব্যাপারটা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ঘটনাবলীতে প্রভাব রাখে।

অর্থাৎ এ যাত্রাও চীন বেঁচে যায়। তবে তাদের মূল্যও দিতে হয়। ১৯১৭ সালে সেদেশে বিশৃংখলা শুরু হয়ে যায়। কেন্দ্রীয় সরকার প্রদেশগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। সেসব এলাকা স্থানীয় “ওয়ারলর্ডদের” শাসনাধীন হয়। তারা নামকাওয়াস্তে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের নামে নিজ নিজ এলাকায় শাসন করতে থাকে। এই অবস্থায় মার্কিনদের সম্পূর্ণ সমর্থন ছিল কেন্দ্রীয় জাতীয়তাবাদী সরকারের সাথে। আর রুশ-জাপানীদের পলিসি ছিল একেক ওয়ারলর্ডকে পয়সা খাইয়ে নয়ত একের বিরুদ্ধে আরককে লড়িয়ে নিজেদের সুবিধা উদ্ধার।

১৯১৯এর ভের্সাই ট্রীটিতেও চীন ব্যর্থ হয় শানদং উপদ্বীপে প্রাক্তন জার্মান, এখন জাপানের শাসনাধীন কলোনি পুনরুদ্ধার করতে। এর জন্য বহু চীনা নাগরিক মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনকে দোষারোপ করে। কিন্তু আসল ঘটনা হল, চীনা সরকার ভের্সাই ট্রীটির আগেই জাপানীদের সাথে আলদা গোপন চুক্তি করে সে দাবি ছেড়ে দেয়ায় উইলসনের আর কিছু করার ছিল না।

১৯২০/৩০এর দশকে শাংহাইয়ে মার্কন ধাঁচের জ্যাজ ব্লুজ সঙ্গীত ছিল জনপ্রিয়। চীনা সঙ্গীতের সাথে মিলে নতুন ধরনের মিশ্র গীতিবাদ্যের জন্ম হয়।

তবে বিশের দশকে কূটনীতির জোরে জাপানের এসকল আগ্রাসী কার্যকলাপকে পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয় মার্কিনসহ অন্যান্য পরাশক্তি। বিশ-ত্রিশের দশক ছিল পাশ্চাত্য আর চীনা প্রগতিশীল নেতৃত্বের সুসম্পর্কের স্বর্ণযুগ। শাংহাই ছিল চীনা জ্যাজ-ব্লুজ সিনক্রেটিজমের ক্যাপিটাল, আর পূর্ব এশিয়ার ফাইন্যানশিয়াল ক্যাপিটাল। হংকংয়ের সাথে পাল্লা দেবার মত শহর ছিল সেটি।

১৯২৭-২৮ সালের মধ্যে প্রায় পুরো চীনকে একত্রিত করতে সক্ষম হয় কুওমিনতাং পার্টি। তাদের রাজধানী ছিল নানজিংয়ে। নতুন করে এরা পাশ্চাত্য ও মার্কিনদের স্বীকৃতি পায়। কিন্তু হয় জাপানের চক্ষুশূল। ১৯৩১ সালে জাপানী সেনাবাহিনীর একদল ষড়যন্ত্র করে মাঞ্চুরিয়াতে মুকদেন ফল্স ফ্ল্যাগ ইনসিডেন্টের ছুঁতোয় চীনের ওপর একতরফা আক্রমণ করে। জাপানের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে আসে ব্রিটিশ লর্ড লিটনের নেতৃত্বে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানকারী দল। চীনের পক্ষে তাদের রায় গেলে লীগ অফ নেশনস থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার করে জাপান। এসব ঘটনা টিনটিনের কমিক পাতাতেও এসেছে।

১৯৩৩ সালে লীগ অফ নেশনস থেকে জাপানের ওয়াক আউটের দৃশ্য এভাবে কমিক বইয়ের পাতায় তুলে ধরেছেন বেলজিয়ান শিল্পী এর্জে।

মাঞ্চুরিয়ায় একতরফা জাপানী দখলদারিত্ব আর প্রাক্তন চীনা সম্রাট পু’য়ীর পুতুল সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি। যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিক মহলে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। জাপান বাণিজ্যিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের সাথে তাদের অনেক লাভজনক লেনদেন ছিল। জাপানের এমন কট্টরপন্থার পেছনে ছিল তাদের আর্মির এক অতি-জাতীয়তাবাদী ফ্যাকশন, যারা ত্রিশের দশকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে সমর্থ হয়।

১৯৩৭ সালের নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার রিপোর্টে এসেছে চীনা রাজধানী নানকিংয়ে ব্যাপক জাপানী বোমাবাজির ক্ষয়ক্ষতিতে আহতদের সহায়তায় কিভাবে এগিয়ে এসেছে স্থানীয় মার্কিনরা।

মাঞ্চুরিয়ান ইনসিডেন্টের কপি-পেস্ট ১৯৩৭ সালে মার্কো পোলো ব্রিজ ইনসিডেন্ট ঘটে। শুরু হয় দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ। চীনে অবস্থানরত মার্কিন নাগরিকরা চীনা সাধারণ মানুষের জন্য ত্রাণ প্রচেষ্টার আয়োজন করে। বহুর্বিশ্বে জাপানীদের নিষ্ঠুরতাকে হেডলাইনে প্রকাশ করতে সাহায্য করে। “নানজিংয়ের ধর্ষণের” মত ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আন্তর্জাতিক মহলের আর ভাবনার অবকাশ থাকে না যে, সাম্রাজ্যের জন্য ক্ষুধিত ক্ষমতালিপ্সু জাপানী মিলিটারি হুন্তা কতদূর যেতে পারে। পরবর্তীতে অ্যাটম বোমা ফেলার মত সিদ্ধান্তে এসব ঘটনা ভীষণ প্রভাব ফেলে।

জাপানের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে চীনের প্রজাতন্ত্রী জাতীয়তাবাদী সরকার নয় শুধু, মাওজেদংয়ের কম্যুনিস্টদেরও সহায়তা দেয় মার্কিনরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও রুশদের যে লেন্ডলীজ পদ্ধতিতে মার্কিন সামরিক সহায়তা দেয়া হয়েছিল, তার শুরু আসলে এই চীনা সহায়তার মধ্য দিয়ে। সামরিক রসদের চালান যেত দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে। ব্রিটিশ কনভয়ে যেত মার্কিন অস্ত্র। জাপানীরা বার্মা দখল করলে সে কাজের দায়িত্ব নেয় ফ্লায়িং টাইগারস নামে ব্রিটিশ ও মার্কিন আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক পাইলটদের দল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার আগেই চীনের সাথে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন অসম চুক্তি রদ করা হয়, সকল ট্রীটি পোর্ট ফিরে যায় চীনের কাছে। শাংহাইয়ের ইন্টারন্যাশনাল লেগেশনও। যুদ্ধের পর মার্কিন সমর্থনের কারণেই জাতিসংঘে স্থায়ী আসনটি পায় প্রজাতন্ত্রী চীন।

দুর্গম বার্মা রোড দিয়ে মার্কিন ও ব্রিটিশ রসদ যেত জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত চীনা সেনাবাহিনীর কাছে, ১৯৪১
বার্মা জাপানী দখলে চলে যাবার পর দুর্গম পর্বতের প্রতিকূল আবহাওয়া উপেক্ষা করে চীনাদের কাছে রসদ নিয়ে পৌঁছে দিত ফ্লায়িং টাইগার্স নামে এই মার্কিন স্বেচ্ছাসেবক পাইলটের দল, ১৯৪৩

কম্যুনিস্টদের সাথে জাতীয়তাবাদীদের গৃহযুদ্ধেও মধ্যস্থতার একটা ইনিশিয়াল প্রচেষ্টা হয় মার্কিনদের থেকে। কিন্তু সোভিয়েত প্রভাব আর কোল্ড ওয়ার ডায়নামিক্সের কারণে সেগুলি সাফল্য পায়নি। কম্যুনিস্টদের ক্ষমতা দখলের ফলে ওপেন ডোর পলিসির আর কোন প্রয়োজন থাকে না। বাকি বিশ্ব থেকে আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে চীনের মূল ভূখন্ড।

কোরিয়ান যুদ্ধে প্রথম চীনা কম্যুনিস্ট লালফৌজ আর মার্কিন সামরিক শক্তি মুখোমুখি হয়। এ ছাড়া আর কখনো দেশ দুটি একে অপরের বিরুদ্ধে লড়েনি। চীনাদের হিউম্যান ওয়েভ আক্রমণের বিরুদ্ধে জেনারেল ম্যাকার্থার অ্যাটম বোমা আক্রমণ চালাতে চেয়েছিলেন। তার পাগলামো থামানোর জন্য তাকে পদচ্যুত করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান স্বয়ং — জাপানে অ্যাটম বোমা ফেলার দায় চাপানো হয় যার ওপর।

সত্তর দশকে চীন-সোভিয়েত শত্রুতা চরমে উঠলে তার সুবিধাটা বাগিয়ে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সঠিক মানবিক অবস্থানটি ভেতরে ভেতরে থাকলেও নিক্সন প্রশাসন গোপনে চীনের সাথে চ্যানেল তৈরি করে ইয়াহিয়া সরকারের মধ্যস্থতায়। সে কারণে সকল ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরাসরি বিরোধিতা তারা করতে পারেনি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীনের অবস্থান ছিল খোলাখুলিরকম স্বাধীনতাবিরোধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তেমনটা ছিল না।

চীন-মার্কিন এই দেতঁতের কারণেই কম্যুনিস্ট চীন জাতিসংঘে প্রজাতন্ত্রী চীনের স্থায়ী আসনটি পায়। নইলে সে ভোটটি ছিল তাইওয়ানের হাতে। সেই ওপেন ডোর পলিসির উত্তরাধিকার ধরেই তাইওয়ানকে এখনও অখন্ড চীনের অংশ হিসাবে স্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র। তাইওয়ানের কোন দূতাবাস ও অফিশাল কূটনৈতিক মিশন যুক্তরাষ্ট্রে নেই। আছে কেবল কালচারাল মিশন।

সারমর্মে সেঞ্চুরি অফ হিউমিলিয়েশনের নাম ধরে যে মড়াকান্নাটা চীনারা এখনো দেয়, সে সেঞ্চুরিটি আরো খারাপ হতে পারত তাদের জন্য। বেঁচে গেছে যুক্তরাষ্ট্রের কারণে। এর কারণ যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের স্বার্থ শুধু দেখতে পেয়েছে তা নয়। ১৮৯০এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মত প্রাক্তন স্পেনীয় কলোনিগুলিকে হস্তগত করে নিজেদের একটা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বানানোর অবস্থানে ছিল। অন্যান্য পরাশক্তির সাথে যোগসাজশে চীনকেও কেটেছিঁড়ে খাবার একটা সুযোগ যুক্তরাষ্ট্রের ছিল। সেটা ঘটেনি। অষ্টাদশ শতকে ওরিয়েন্টাল সভ্যতা বিশেষত চীনা সভ্যতার ব্যাপারে মার্কিনদের একটা ফ্যাসিনেশন ছিল। রোমান বা গ্রীক সভ্যতার প্রতি আকর্ষণের থেকে সেটা কম ছিল না। ফাউন্ডিং ফাদারদের অনেকেই চীনা সভ্যতার প্রশংসা করে গেছেন। এ সম্মানটার কারণেই চীন প্রচুর সহমর্মিতা সমবেদনা আর সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে পায়।

বর্তমান যুগের চীনা-মার্কিন শত্রুতার নেপথ্যে চীনা সংস্কৃতি-সভ্যতা বাঁধা নয়। বাঁধা কম্যুনিজম, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, চীনা সম্প্রসারণবাদ ও বাণিজ্যে অসম সুবিধাভোগ। যদি চীনে কোন এক স্বপ্নের যুগে সিসিপি’র বিনাশ ঘটে, যুক্তরাষ্ট্র আর সে দেশটি নিঃসন্দেহে বন্ধুতার বহু প্রাচীন ইতিহাস খুঁজে পাবে। এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই!

হাইলে সেলাসি

ঊনবিংশ শতকে আফ্রিকার উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় উপনিবেশ গড়তে থাকে ফ্রান্স, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, জার্মানি ও ইতালি । ইতিহাসবিদরা এই উপনিবেশায়নের নাম দিয়েছেন ‘স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা’।

এসময় স্বাধীনতা ধরে রাখতে সক্ষম হয় দুটি দেশ, লাইবেরিয়া ও ইথিওপিয়া।

ইথিওপিয়ার মানবসভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। বিশেষ করে লোহিত সাগরের দু’পারের আক্সুম সাম্রাজ্য আর আরব উপদ্বীপের সংস্কৃতি একে অপরকে প্রভাবিত করেছে কয়েকশ বছর ধরে

ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে দেশে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট হন তেওদ্রোস। কিন্তু ব্রিটেনের সাথে বচসা বাঁধিয়ে যুদ্ধে হেরে শেষ পর্যন্ত তেওদ্রোস আত্মহত্যা করেন, আর ব্রিটিশরা তাঁর দুর্গ লুটতরাজ করে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দেয়। রাজপুত্র ও বিধবা রাণীকে রাজবন্দী করে তারা ব্রিটেনে নিয়ে যায়

ইথিওপিয়ার প্রথম ডাকটিকেটে (১৮৯৪) সম্রাট দ্বিতীয় মেনেলিকের ছবি। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

এরপরের সম্রাট চতুর্থ ইউহানিস সুদানের মাহদী রাষ্ট্রের দরবেশ ফ্যানাটিকদের সাথে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেন। ১৮৮৯এ সম্রাট হন দ্বিতীয় মেনেলিক। প্রথম ডাকটিকেটটিতে (১৮৯৪) তাঁরই ছবি।

ইউহানিসের সময় থেকেই অবশ্য আরেকটা নতুন বিদেশী শক্তির থাবা বিস্তৃত হচ্ছিল এ অঞ্চলে। সে হলো ইতালি।

ইতালি দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে মোটে ১৮৬১ সালে। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইতালির পুনরুত্থানের পর সেদেশের অভিজাতরা স্বদেশকে প্রাচীন রোমের আসনে পুনরোধিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন। নানা সমস্যায় জর্জরিত প্রজাদের ব্যারামে আরাম দিতেও জাতীয়তাভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী আদর্শ ছিল ভাল মলম। পূর্ব আফ্রিকা তাদের কাছে মনে হলো নতুন রোমান সাম্রাজ্য শুরু করার উপযুক্ত স্থান।

১৮৮৯এ দুয়েকটা খন্ডযুদ্ধে মেনেলিকের বিরুদ্ধে জিততে না পেরে ইতালি একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তাঁর সাথে, এর নাম ‘উচালের চুক্তি’। সে চুক্তির শর্তানুযায়ী এরিত্রেয়ার ওপর ইতালির অধিকার মেনে নেন মেনেলিক।

ইতালির প্রতিনিধি অবশ্য একটু চালাকি করেন। তাঁর ওপর কড়া নির্দেশ ছিল ইথিওপিয়াকে ইতালির প্রটেক্টরেট বানানোর। চুক্তির আমারিনিয়া ভাষার সংস্করণে লেখা হলো, সম্রাট যদি চান, তাহলে বহির্বিশ্বের দেশগুলির সাথে সম্পর্ক গড়ার দায়িত্ব ইতালির প্রতিনিধিকে দিতে পারেন। কিন্তু ইতালীয় সংস্করণে ক্রিয়াপদ অনূদিত হলো বাধ্যতামূলক ‌‌অর্থে। অর্থাৎ সম্রাটের সকল বৈদেশিক সম্পর্ক শুধুমাত্র ইতালির অনুমতিক্রমেই স্থাপন করা যাবে।

বিশ্বে মর্যাদার আসনে স্বদেশকে বসাতে ব্রিটেন-জার্মানির রাজা-রাণীর কাছে সমকক্ষ হিসাবে মেনেলিক সম্পর্কস্থাপনের চিঠি লিখলেন। কিন্তু দু’জনেই ইতালির সাথে চুক্তির শর্ত যেমনটি জেনেছেন তা জানিয়ে মেনেলিকের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর অভিযোগের মুখে ইতালীয়রা ভুল শোধরানোর বদলে একরকম দাবি করলো, নীচ কৃষ্ণাঙ্গ জাতির জংলী রাজা মিথ্যে বলছে।

১৮৯৩ সালে উচালের চুক্তি রদ করে দিলেন মেনেলিক। ইতালীয় সেনাবাহিনী এরিত্রেয়া থেকে দক্ষিণে অগ্রসর হওয়া শুরু করলো। তাদের সেনাপ্রধান ভেবেছিলেন, ইথিওপিয়ার জাতিগত বিভক্তির সুযোগে মেনেলিকের অবস্থান দুর্বল করা সম্ভব। কিন্তু বিধি বাম! মেনেলিকের পক্ষ নিয়ে গোটা দেশ থেকে তিগ্রে, আমহারা, সকল জাতের সৈন্যদল ছুটে এল। ১৮৯৬ সালে আদওয়ার যুদ্ধে ইতালীয়দের সারপ্রাইজ অ্যাটাক তাদের জন্যে উল্টো সারপ্রাইজ হয়ে দাঁড়ালো। মেনেলিকের নেতৃত্বে মূলত বর্শা-তলোয়ারধারী বিশাল সেনাদল হারিয়ে দিল কামান-বন্দুকধারী ইতালীয়দের। বন্দী হলো কয়েক হাজার। এরিত্রেয়ায় পালিয়ে ফেরার পথে বিপুলসংখ্যক অস্ত্র ও গোলাবারুদ পেছনে ফেলে গেল ইতালীয়রা

মেনেলিকের শাসনামলে ইথিওপিয়ার আধুনিকায়ন শুরু হয়। করব্যবস্থার সংস্কার ও কাগুজে মুদ্রার প্রচলন হয়। ডাক ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। ক্রীতদাসপ্রথা উচ্ছেদেরও প্রচেষ্টা চালান মেনেলিক । এই ডাকটিকেটটি তাঁর সেই উন্নয়নপ্রচেষ্টার সাক্ষাত প্রমাণ।

এরপরে ফাস্ট ফরওয়ার্ড করে চলে যাই ১৯৩৫ সালে। এর মধ্যে ১৯৩০এ ইথিওপিয়ার সম্রাট হয়েছেন রাস তাফারি মিকোন্নেন, তাঁর রাজকীয় নাম হাইলে সেলাসি । ১৯২৩এ ইথিওপিয়া লীগ অফ নেশন্সের সদস্য হয়েছে। ১৯৩১এ সংবিধান প্রণীত হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক সংস্কারের কিছুমাত্র হলেও ছোঁয়া পাচ্ছে ইথিওপিয়াবাসী।

ইতালি কিন্তু চল্লিশ বছর আগের সে অপমানের কথা ভুলে যায়নি। মুসোলিনির আস্ফালনের সাথে সেখানে তাল মিলিয়ে কুচকাওয়াজ করছে ফ্যাশিস্ট ব্ল্যাকশার্টের দল। মুসোলিনিরও বিংশ শতকের জুলিয়াস সীজ়ার হবার স্বপ্ন। গ্রেট ডিপ্রেশনের অর্থনৈতিক ধাক্কার পাল্টা শক থেরাপি হিসাবেও একটা জেতার মত যুদ্ধ দরকার ছিল মুসোলিনির।

পশ্চিমা শক্তিদের সাথে গোপন কূটনীতিতে জিতে মুসোলিনি ১৯৩৫এ সেনাপতিদের আদেশ দিলেন আগে বাড়ার। এই প্রথমবারের মত লীগের এক সদস্যদেশ আরেককে বিনা উস্কানিতে আক্রমণ করলো। হাইলে সেলাসির ডাকে সারা দেশে যুদ্ধের সাজ পড়ে গেল। মজার ব্যাপার হলো, এসময় ইথিওপিয়াকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে হিটলারের জার্মানি

প্রথম প্রথম যুদ্ধ খুব মন্থরগতিতে চলছিল। দু’একটা সংঘর্ষে ইথিওপীয়রা বিজয়ী হয়। এরপর মুসোলিনির তাড়া খেয়ে ইতালীয়রা স্থানীয় এরিত্রীয় গোত্রগুলোকে ঘুষ দিয়ে দলে ভেড়ায়। বেশুমারে বোমাবর্ষণ করা হয় ইথিওপীয় শহরগুলির ওপর। এমনকি তারা রাসায়নিক অস্ত্রও ব্যবহার করে। এ অসম যুদ্ধের সমাপ্তি হয় ১৯৩৬ সালে। হাইলে সেলাসি আদ্দিস আবাবার প্রতিরক্ষাযুদ্ধে পরাজিত হয়ে পালিয়ে চলে যান জেরুজালেম।

১৯৩৬ সালে ইথিওপিয়ার সম্রাট হাইলে সেলাসিকে যুদ্ধে হারিয়ে দেশটির দখল নেয় ইতালি। এই ডাকটিকেটে ইতালির রাজা দ্বিতীয় ভিত্তোরিয়ো এম্মানুয়েলে হয়েছেন একাধারে ইথিওপিয়ার সম্রাট। — ব্যক্তিগত সংগ্রহ

ছবির দ্বিতীয় ডাকটিকেটটি ১৯৩৬ সালের। এতে লেখা ‘ইতালীয় ঔপনিবেশিক ডাক’। ডাকটিকেটে ছবি ইতালির রাজার, তখন ইথিওপিয়ার সম্রাট তৃতীয় ভিত্তোরিয়ো এমানুয়েলের। ব্রিটেনের রাজা জর্জ যেমন একই সাথে ভারতের সম্রাট ছিলেন, সেরকম হবার শখ তাঁরও মিটলো।

জেরুজালেম থেকে হাইলে সেলাসি জেনেভায় এলেন লীগ অফ নেশন্সের হেডকোয়ার্টারে। ইতালীয় সাংবাদিকদের অকথ্য গালিগালাজ অগ্রাহ্য করে সেলাসি যা বললেন, তা অবস্মরণীয় এক ভাষণ। লীগের সদস্যদের তিনি ভর্ৎসনা করলেন লীগ চার্টারের দশম ধারার অবমাননা করে ইতালি যে একতরফা আগ্রাসন চালিয়েছে, তার প্রতিবাদ না করার জন্য। তিনি তাদের সতর্ক করে দিয়ে বললেন যে ইথিওপিয়া আজ আক্রান্ত হচ্ছে, কাল আসবে তাদের পালা ১০

১৯৩৬ সালে জেনেভায় লীগ অফ নেশন্সের সামনে নিজ দেশের বিরুদ্ধে ইতালির আগ্রাসনের প্রতিবাদ করে ভাষণ দিচ্ছেন রাজ্যচ্যুত ইথিওপীয় সম্রাট হাইলে সেলাসি। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

হাইলে সেলাসী পরবাসী হবার পরে আরো বেশি খ্যাতিমান হলেন। ১৯৩৬ সালে ম্যান অফ দ্য ইয়ার হিসাবে টাইমস পত্রিকা তাঁকে কাভার করে। সে আমলে মার্কিনে বর্ণবাদ চললেও কৃষ্ণাঙ্গ সেলাসিকে সবাই স্বাগত জানিয়েছিল, আর তাঁর বক্তৃতাগুলিতে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পর ফ্রাংকলিন রোজ়ভেল্ট ইথিওপিয়াকে লেন্ড-লীজ় চুক্তির আওতায় আনেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ইতালীয় পূর্ব আফ্রিকার মানচিত্র, ইথিওপিয়া, এরিত্রেয়া আর বর্তমান দক্ষিণ সোমালিয়া নিয়ে তৈরি হয়েছিল এ সাম্রাজ্য। — ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত

আমেরিকার অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত সাহায্য, আর ব্রিটিশ ও দক্ষিণ আফ্রিকার সৈন্যদের সহায়তায় ১৯৪১এর মে মাসে ইথিওপিয়া হয় নাৎসি-ফ্যাশিস্টমুক্ত প্রথম দেশ। পাঁচ বছর নির্বাসনশেষে আদ্দিস আবাবায় ফিরে হাইলে সেলাসি যা বললেন, তাও স্মরণীয়, “Do not indulge in the atrocities which the enemy has been practicing in his usual way.”

১৯৭৪ পর্যন্ত হাইলে সেলাসি ইথিওপিয়া শাসন করেন। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি ভাল কাজ যেমন করেছেন, বিতর্কিত ব্যাপারও কম ঘটেনি সেসময়। বিশেষ করে ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষের কথা কে না জানে। ১৯৭৪এ মিলিটারি কুয়ের মাধ্যমে সেলাসিকে অপসারণ করে একদল সোভিয়েতপন্থী সেনা। সেলাসিকে খুন করে লাশ গুম করে দেয় তারা। সারা দেশে গৃহযুদ্ধ চলে বিশ বছর ধরে। সামরিক জান্তার শাসনামল শেষ হলে ১৯৯২ সালে তাঁর দেহাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায় রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনায়।

আজ ইথিওপিয়ায় গণতন্ত্র চলছে। শত বছরে যে জিনিস কল্পনা করা যেত না, ইথিওপিয়ার মানুষ তা করেছে। বহুদিনের তিগ্রে সংখ্যালঘু জাতির প্রাধান্যের সরকারের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরু আমহারা-ওমোরোরা একত্রিত হয় ২০১৮তে প্রতিবাদ করে। প্রধানমন্ত্রী হন আবি আহমেদ বলে মুসলিম-খ্রীষ্টান মিশ্র পরিবারের সন্তান এক ওরোমো।এরিত্রেয়ার সাথে বহুদিনের যুদ্ধের ইতি টেনেছেন তিনি। মানবাধিকার ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা পরিস্থিতির উন্নয়নেরও চেষ্টা চলছে। অদূর ভবিষ্যতে আফ্রিকায় জাতি ও ধর্মগত সাম্যের আলোকবর্তিকা হতে পারে আজকের ইথিওপিয়া।


(১) স্পেইন ও পর্তুগালের সাম্রাজ্য এসময় অবক্ষয়ের পথে। মোজাম্বিক, গিনি, অ্যাংগোলা, ইত্যাদি ছাড়া আর তেমন আফ্রিকান কলোনি এদের ছিল না। ১৮২০-৫০এর মধ্যে লাতিন আমেরিকার প্রায় সকল পর্তুগীজ-স্প্যানিশ রাজ্য স্বাধীনতালাভ করে। [Spanish American wars of independence]

(২) বিজ্যান্টিনদের মিত্র হিসাবে আরব উপদ্বীপে তাঁদের জাতশত্রু পারসিকদের মোকাবিলা করে আক্সুম সাম্রাজ্য। আক্সুমের সেনাপতি আবরাহার ভয়াবহ পরিণতির কথা কুরআনের বিখ্যাত ফীল সূরায় উল্লেখিত আছে। আবরাহা ঐতিহাসিক চরিত্র, আরবে ইহুদী-খ্রীষ্টান দাঙ্গা-যুদ্ধ লেগে থাকত। খ্রীষ্টান আবরাহা অবিচারে ইহুদীনিধন করেন। মক্কা থেকে প্রথম মুসলিম হিজরত বা নির্বাসন মদিনায় নয়, হয় আবিসিনিয়ায়। আবিসিনিয়ার নেগুশ বা আল-নাজাশী তাদেরকে উদারতার সাথে আশ্রয় দেন। [Migration to Abyssinia
]

(৩) তেওদ্রোস তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গিয়ে উত্তর ও পশ্চিম থেকে মিশর-সুদান আর পূর্বে ওরোমো-সোমালিদের মুসলিম সেনাশক্তির মুখোমুখি হয়ে পড়েন। এদের বিরুদ্ধে সংঘাতকে খ্রীষ্টান ধর্যুমদ্ধ আখ্যা দিয়ে ব্রিটেনের রাণী ভিক্টোরিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে চিঠি পাঠান। কিন্তু এসময় ব্রিটিশদের সাথে মিশরী ও তুর্কীদের মিত্রতা ছিল, আর পশ্চিমা বিশ্বে তখন খ্রীষ্টান ধর্মযুদ্ধ বলে কোন কিছুর তাৎপর্য আর নেই। ব্রিটিশরা সে কারণে তেওদ্রোসকে নেতিবাচক জবাব পাঠায়। অপমানিত সম্রাট তেওদ্রোস তারপর ব্রিটেনের রাজপ্রতিনিধিদের আটক করে শৃংখলাবদ্ধ করে রাখেন। পরাশক্তি ব্রিটেন এর সমুচিত জবাব দেবার জন্য বম্বে থেকে প্রখ্যাত সামরিক প্রকৌশলী রবার্ট নেপিয়েরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী পাঠায়। নেপিয়ের লোহিতসাগরের তীরে নেমে দ্রুত একটি বন্দর তৈরি করে ফেলেন ও স্থানীয় বিদ্রোহী গোত্রগুলোর সহায়তায় দুর্গম পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে তেওদ্রোসের রাজধানী মাগদালায় এসে পৌঁছান। ব্রিটিশদের আধুনিক সমরাস্ত্র আর নিয়মানুবর্তী সেনাদলের কাছে পরাজিত হয় তেওদ্রোসের ট্রাইবাল সেনাবাহিনী। বন্দী রাজপুত্র আলেমাইয়াহু রাণী ভিক্টোরিয়ার প্রিয়পাত্র ছিলেন।[British Expedition to Abyssinia]

(৪) সুদান ১৮৮০র দশক পর্যন্ত মিশরের তুর্কীশাসিত রাজ্যের দখলে ছিল। এ সময় মোহাম্মদ আহমেদ বলে এক সুফী দরবেশ নিজেকে মাহদী (মুসলিমদের ‘কলির অবতার’) দাবি করে। সঙ্গীসাথী জুটিয়ে মিশরীদের শাসন উচ্ছেদ করে। মিশর ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে আসার পর তারাও এদের মুখোমুখি হয়। কিন্তু এদের পাগলা হামলায় ব্রিটিশ মিশরী সেনাদল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সুদানের ব্রিটিশ গভর্নর গর্ডনকে মেরে তাঁর কাটা মাথা মাহদীর কাছে পাঠানো হয়। মাহদীপন্থী ‘আনসারবাহিনী’ সুদানে কঠোর ইসলামী শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করে, আর আশপাশের রাজ্যগুলিকে ‘জিহাদের’ নামে তটস্থ রাখে। সুদানে দাস কেনাবেঁচা আবার শুরু হয়। ধর্মীয় আইন-দর্শনের পুরনো বইপত্রও পুড়িয়ে ফেলে এরা। মোহাম্মদ আহমেদ দাবি করে খোদার সাথে নাকি তার কথোপকথন হয়, আর কলেমা শাহাদাতে মাহদী হিসাবে তার ওপর বিশ্বাসস্থাপনের শপথ যুক্ত করা হয়। মোহাম্মদ আহমেদ টাইফয়েডে মারা যাবার পর তার আরেক অনুসারী খলিফা হিসাবে ক্ষমতা দখল করে। ব্রিটেন ১৮৯৫এ মিশর ও সুয়েজ রক্ষার খাতিরে লর্ড কিচেনারের নেতৃত্বে আনসারদের বিরুদ্ধে প্রশিক্ষিত সেনাদল পাঠায়। তিনি এদেরকে ১৮৯৮এ পরাজিত করতে সমর্থ হন। ততদিনে সুদানের অর্থনীতির পঙ্গু অবস্থা। আঠারো বছরের মধ্যে সংঘাতে-দুর্ভিক্ষে সেখানের জনসংখ্যা কমে অর্ধেক হয়ে গেছিল। [Mahdist State]

(৫) চতুর্থ শতকে গথজাতির আক্রমণে প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের পশ্চিমাংশের পতন হয়। তারপর থেকে ইতালির বিভিন্ন এলাকা বিদেশী নানা রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রেনেসঁসের সময় ধীরে ধীরে তাদের জাতিপরিচয়ের নতুন জাগরণ হতে থাকে। কিন্তু ছোট ছোট রাজ্যগুলি ছিল একে অপরের প্রতিযোগী আর বহির্দেশীয় শক্তিগুলোর সাথে তাদের অ্যালাইনমেন্ট ছিল। নাপোলেওনের সময় উত্তর ইতালিতে ফরাসী সেনাবাহিনীর সমর্থনে একটি ‘ইতালি’ রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। নাপোলেওনের পরাজয়ের পর ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র আগের অবস্থায় ফিরে গেলেও ইতালিতে জাতীয়তাবাদের আদর্শ থেকে যায়। বহুদিন ফ্রান্স আর অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যের দ্বারা পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় ইতালির রাজ্যগুলি। তাদের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে যে একক ইতালীয় পরিচয়ের বিকাশ হচ্ছিল, তা রোধ করার চেষ্টা করে অধিকাংশ ইতালীয় রাজবংশগুলি। কার্বোনেরি নামক একটি গুপ্ত সংগঠন গড়ে ওঠে। এদের এক সদস্য মাৎসিনি ইয়াং ইতালি বলে আরেকটি দল গড়েন, যার আদলে পরে ইয়াং টার্কি, ইয়াং সার্বিয়া ইত্যাদি জাতীয়তাবাদী গ্রুপের আত্মপ্রকাশ। আরেক কার্বোনেরি গারিবাল্দি স্বল্পসংখ্যক অনুসারী নিয়ে সামরিক অভিযান, কুয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন রাজ্যে ইতালীয় জনতার নামে ডিক্টেটরশীপ প্রতিষ্ঠা করছিলেন। প্রুশিয়ার সাথে কূটনীতির মাধ্যমে সার্দিনিয়া রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কাভুর উত্তরে অস্ট্রিয়াকে বাগে আনেন। আর দক্ষিণে গারিবাল্দি নাপোলি-সিসিলির রাজার শাসন উৎখাত করে তার রাজভার তুলে দেন সার্দিনিয়ার রাজা দ্বিতীয় ভিত্তোরিও এমানুয়েলের হাতে। রোমসহ পোপের রাজ্যগুলিও হস্তগত হয়। এভাবে ১৮৬০এর দশকে ইতালি বলে নতুন রাজ্যটি আত্মপ্রকাশ করে। এ প্রক্রিয়াকে ইতালীয় ভাষায় নাম দেয়া হয়েছে রিসর্জিমেন্তো বা পুনরুত্থান। [Italian unification]

(৬) এসময় ফরাসী-রুশরা মেনেলিককে সমর্থন দেয়। ইতালির পেছনে ব্রিটিশদের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল জিবুতির ফরাসী ঘাঁটির মাধ্যমে সুয়েজ প্রণালী ও লোহিত সাগরের জাহাজপথের ওপর তাদের প্রভাব কাউন্টারব্যালেন্স করার জন্য। ইতালির বিরুদ্ধে সংগ্রামে মেনেলিক ফরাসীদের সাহায্য চেয়ে পেলেন কেবল আদর্শিক সমর্থন। রুশ সম্রাট অবশ্য অর্থোডক্স খ্রীষ্টান ধর্মের ভ্রাতৃত্বের খাতিরে মেনেলিককে উপদেষ্টা আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র পাঠালেন। আদওয়া যুদ্ধের লজ্জাস্কর পরাজয়ের পরপরই ইতালিতে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়, জনবিক্ষোভের মুখে সরকারের পতন হয়। ইথিওপিয়াকে স্বাধীন দেশ হিসাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয় ইতালি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স। এরিত্রেয়া অবশ্য ইতালিরই থেকে যায়। [Second Italo-Ethiopian War]

(৭) ১৮৩৩এ ব্রিটেন আর ১৮৬৩ সালে আমেরিকা ক্রীতদাস কেনাবেঁচা আইন করে বন্ধ করার ফলে পশ্চিম আফ্রিকার দাসব্যবসায় ভাঁটা পড়ে। কিন্তু পূর্ব আফ্রিকায় ঊনবিংশ শতকের পুরোভাগে আর বিংশ শতকের শুরুতে দাসপ্রথা তখনও প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে আরবের বিভিন্ন রাজ্যে ইথিওপিয়া থেকে আনা দাসদের বেশ বড় বাজার ছিল। এদের বেশির ভাগই গার্হস্থ্য কাজে নিয়োজিত হত, ক্ষেতখামারের হাড়ভাঙ্গা শ্রমে অতটা নয়। ওমানী, ইয়েমেনী, সোমালি দাসব্যবসায়ীদের ঘাঁটি ছিল জানজিবারের ওমানীশাসিত মুসলিম রাজ্য। হাবশী বা ইথিওপীয় দাসরা অতীতে ভারতবর্ষেও এসেছে। বাংলার সুলতান গিয়াসুদ্দিন ফিরোজ শাহ ছিলেন হাবশী দাস। মেনেলিক দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আইনকানুন প্রচলন করলেও সেগুলির তেমন একটা প্রয়োগ হয়নি। তিরিশের দশক পর্যন্ত আরবের সাথে দাসব্যবসা চলেছে। লীগ অফ নেশন্সের বেশ কটি রেজল্যুশনের পরেও তা কমেনি। আরবে দাসপ্রথা চালু থাকার একটা কারণ অনেকদিন পূর্ব আফ্রিকার সাপ্লাই সোর্স বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। [Arab slave trade]

(৮) রাস্তাফারি নামে জামাইকাতে একটি ধর্ম চালু আছে। বব মার্লি ছিলেন রাস্তাফারি আর তাঁর গানে সে ধর্মবিশ্বাসের বিভিন্ন ব্যাপার আমাদের অজান্তে উঠে এসেছে। ১৯৩০এর দশক থেকে জামাইকার অনেক কৃষ্ণাঙ্গ বিশ্বাস করা শুরু করে যে হাইলে সেলাসী হলেন মেসিয়া, যীশুর দ্বিতীয় অবতার, জীবন্ত ঈশ্বর বা জাহ। তাদের আরো বিশ্বাস আফ্রিকায় রয়েছে তাদের প্রতিশ্রুত আবাসভূমি জায়ন। এ ধরনের অল্টারনেটিভ ধর্মবিশ্বাসের জনপ্রিয়তা পাবার একটা কারণ জামাইকাতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। সে কারণে হাইলে সেলাসী আফ্রিকার একমাত্র স্বাধীন সম্রাট হিসাবে এই বিশেষ মর্যাদাটি পান। যদিও তিনি নিজে খ্রীষ্টান ছিলেন, তিনি রাস্তাফারিদের নিরুৎসাহিত করেননি। তিনি ভেবেছিলেন এর মাধ্যমে জামাইকার জনগণ নিজেদের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। [Rastafari]

(৯) ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে ইতালির অন্যায় যুদ্ধে ব্রিটেন-ফ্রান্সের থেকে বিরোধিতা আসতে পেরে বলে মুসোলিনি তাদেরকে খেলালেন কূট চালে। গোপনে তাদের হুমকি দিলেন যে ইথিওপিয়া হবে ইতালীয়, আর যদি তা না হয়, তিনি জার্মানির হিটলারের সাথে সামরিক মিত্রতা চুক্তি করবেন (তখনও এ মিত্রতা ছিল না)। ব্রিটেন-ফ্রান্স এতে ভড়কে গিয়ে গোপনে তাঁর সাথে রফা করে, তাদের হোর-লাভাল প্রস্তাবনার মাধ্যমে রাজি হল যে ইতালি ইথিওপিয়ার সিংহভাগ পাবে, আর ছোট্ট একটা অংশ ইথিওপীয় রাষ্ট্র হিসাবে থেকে যাবে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিপুল রক্তক্ষয়ের পরে ব্রিটিশ-ফরাসী সাধারণ মানুষ সংঘাতে যেতে চায় না, এটা তাদের রাজনীতিবিদরা ঠিকই বুঝেছিলেন। ইথিওপিয়ার মত নাম-না-জানা আফ্রিকান রাজ্যের সার্বভৌমত্বহানির বিপরীতে আদর্শগত যুদ্ধের আরোই কোন সমর্থন ছিল না। জার্মানি প্লেন, রাইফেল, গোলাবারুদ পাঠিয়ে মেনেলিককে সাহায্য করে এই উদ্দেশ্যে যে ইতালির সৈন্যদল সেখানে বহুদিন ব্যস্ত থাকবে, আর সে ফাঁকে জার্মানি ইতালির উত্তরে জার্মানভাষী অস্ট্রিয়াকে দখল করে নেবে। ১৯৩৮ সালে তা ঘটে, ইতালির সাথে আনঅফিশাল সমঝোতার পরপর।[Anschluss]

(১০) লীগ অফ নেশন্সের দশম আর্টিকল অনুযায়ী কোন সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে তার প্রতিরক্ষায় বাকি সদস্যরা এগিয়ে আসবে। একে বলে ‘কালেকটিভ সিক্যুরিটি’। বহির্দেশীয় সংঘাতে আরেকবার জড়িয়ে পড়তে অরাজি মার্কিনদের কংগ্রেসে এই ধারা প্রচন্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়, এবং যুক্তরাষ্ট্র লীগে যোগ দেয়া থেকে বিরত থাকে। লীগ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে অল্প ক’টি বিবাদের সুরাহা করতে সমর্থ হয়েছিল। সিনিয়র সদস্যরা ক্রমাগত লীগের মূল উদ্দেশ্যের বিপরীত কাজ করছিল। ইউরোপের বেশ ক’টি স্থানীয় সংঘাতে লীগ অর্থবহ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয় এবং অধিক শক্তিমান পক্ষ দুর্বল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব খর্ব করে। ইতালি-ফিউমে, ইতালি-গ্রীস, পোল্যান্ড-লিথুয়ানিয়া, পোল্যান্ড-চেকোস্লোভাকিয়া, পোল্যান্ড-সোভিয়েত, ফ্রান্স-বেলজিয়ামের জার্মান রুহর উপত্যকা দখল, এগুলি কিছু ছোটখাট সংঘাতের উদাহরণ। ১৯৩১ সালে জাপান চীনের উত্তরের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে নিজেরাই ফল্স ফ্ল্যাগ অ্যাটাক করে চীনাদের দোষ দেয়। তারা মাঞ্চুরিয়া দখল করে নেয় চীনাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে। ১৯৩২ সালে তাদের চালাকির কথা প্রকাশ হয়ে পড়লে জাপানীরা লীগ থেকে পদত্যাগ করে। এটা ছিল বড় কোন সমস্যা মিটমাটে লীগের প্রথম বিফলতা। এরপর ইতালি পরিষ্কারভাবে দশম দফা লঙ্ঘন করে ইথিওপিয়ার ওপর চড়াও হয়। লীগ অফ নেশন্সের সদস্যরাষ্ট্ররা রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের জন্যে ইতালির বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনে ও অর্থনৈতিক স্যাংকশন আরোপ করে। কিন্তু সেগুলি খুব কার্যকর কিছু ছিল না। শেষ পর্যন্ত ইথিওপিয়ায় ইতালির শাসন সব দেশই মেনে নেয়, সাতটি বাদেঃ চীন, নিউজীল্যান্ড, সোভিয়েত, স্পেইন, মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া অভিযানের আগ থেকে জাপানের সাথেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হচ্ছিল। চীনে জাপানের দখলকৃত এলাকাগুলিরও স্বীকৃতি দেয়নি যু্ক্তরাষ্ট্র। মাঞ্চুরিয়া ও ইথিওপিয়া সংকটের পর লীগ অফ নেশন্সের অর্থপূর্ণ আর কোন অস্তিত্ব ছিল না। যে দেশ যার ইচ্ছেমত বৃহদশক্তিদের ব্ল্যাকমেল করে ছোট দেশের উপর আগ্রাসন চালায়। জার্মানি-অস্ট্রিয়া, জার্মানি-ডানজিগ, জার্মানি-চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি-আলবেনিয়া, জাপান-চীন, তারপর পোল্যান্ডকে সোভিয়েত ও জার্মানি ভাগাভাগি করে দখল করার ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু। এভাবে হাইলে সেলাসীর ভবিষদ্বাণী পাঁচ বছরের মধ্যে সত্য হয়। [League of Nations Failures]

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!