সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের সমাজতান্ত্রিক জটিলতা


গত দুটি পোস্টে (, ) বলেছি সোভিয়েত ইউনিয়নকে দুর্যোগের সময় কিভাবে বিশাল সহায়তা করে মার্কিন সরকার ও পশ্চিমা কম্পানিগুলি। শেষ খন্ড বলা বাকি আছে। তবে আলোচনার এ পর্যায়ে একটা সেগোয়ে করতে চাই। সোভিয়েত প্রযুক্তিবিপ্লবের অর্থসংস্থান কোত্থেকে কিভাবে হল? আর কতটুকুই সফলকাম হয় সোভিয়েতরা?

স্তালিনের দাবি ছিল, তিনি নাকি রুশ জনতাকে খুঁজে পান জমিতে কাঠের লাঙল দিয়ে চাষাবাদরত, আর তাদের রেখে যাচ্ছেন পারমাণবিক চুল্লীর মালিক হিসাবে। এটা বাস্তবিক কথা নয়। রুশ বিপ্লবের আগেই ৎসারপন্থী রাশিয়ায় শিল্পায়ন চলছিল। পশ্চিমা দেশগুলির তুলনায় মাথাপিছু আয় কম হলেও স্টীল উৎপাদনে রাশিয়ার স্থান ছিল বিশ্বের চার নম্বর। বিপ্লব ও যুদ্ধের ডামাডোল আর তারপর কম্যুনিস্টদের অনভিজ্ঞ বাস্তবতাবিবর্জিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কারণেই ৎসার আমলের শিল্পগুলি জীর্ণ দশায় নিপতিত হয়। সেসব ঘটনা না ঘটলে ৎসারের সিস্টেমে রাশিয়া শিল্পায়িত হতে পারত।

ৎসারের আমলের রুশ টেক্সটাইল মিল, ১৯০৫

মার্কিন সাহায্যে লব্ধ স্তালিনী শিল্পায়নের জন্য যে সোভিয়েত জনগণকে মূল্য দিতে হয়নি তা কিন্তু নয়! মার্কিন প্রকৌশলীদের উচ্চ বেতন দেয়া হত কিভাবে, সেটা আন্দাজ আছে কারো?

মস্কোতে নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিনিধি ডুরান্টির মত পুলিৎজারবিজয়ী সাংবাদিক যখন সোভিয়েতদের প্রগতির প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন গ্যারেথ জোনস নামে এক ব্রিটিশ সাংবাদিক সোভিয়েতদের চোখ এড়িয়ে চলে যান ইউক্রেনের গ্রামাঞ্চলে। সেখানে দেখেন আরেক মহাদুর্ভিক্ষের চিত্র, যেটি আজও হলোদমর নামে স্বীকৃত। কিন্তু আগের মত কোন সহায়তার অনুরোধ যায়নি সেবার। ৫০ লাখের মত মানুষ তাতে মারা যায়। এর কারণ, ইউক্রেনের ঊর্বরভূমির খাদ্যশস্য কৃষকদের থেকে জোর করে কেড়ে শহরের শিল্পায়নরত শ্রমিকদের খাওয়াচ্ছে স্তালিন সরকার, নয়ত রপ্তানি করেছে। উদ্দেশ্য, ঐ শিল্পায়নের মূলধন জোগাড়।

নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ওয়াল্টার ডুরান্টি। ত্রিশের দশকে সোভিয়েত প্রগতিশীলতার ওপর রিপোর্ট লিখে পুলিৎজার জিতেন। কিন্তু সোভিয়েত শোষণের বিরুদ্ধে লেখেননি কিছু।
কিয়েভের নিকট গৃহহীন ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৪
ইউক্রেনের পলতাভার নিকট দুর্ভিক্ষে মৃত নারী, ১৯৩৪
খার্কিভের রাস্তায় এসে স্থান নিয়েছে দুর্ভিক্ষপীড়িত ইউক্রেনীয় কৃষক, ১৯৩৩
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনসের ১৯৩৩ সালের ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট, ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা
ব্রিটিশ সাংবাদিক গ্যারেথ জোনস, ১৯৩৩-৩৪এ ইউক্রেনীয় হলোদমর দুর্ভিক্ষের ওপর রিপোর্ট করেন। কম্যুনিস্ট সরকার এ দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে।

তাছাড়া শিল্পায়নে ব্যবহৃত রুশ শ্রমিকদের একটা বিশাল অংশ ছিল অনৈচ্ছিক শ্রমিক। অনেকে ছিল গুলাগের রাজনৈতিক বন্দী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও অধ্যাপক। এসকল শ্রমে অনভিজ্ঞ মানুষ হাজারে হাজারে মারা যায় স্তালিনের প্রকল্পগুলিতে কাজ করতে গিয়ে।

কারখানার শ্রমিকদের ওয়ার্কিং ও লিভিং কন্ডিশন এমন ছিল যে সেটা ব্রিটেনের শিল্পায়নের যুগের ডিকেনজিয়ান ডিসটোপিয়াকেও হার মানায়। সাধারণ শ্রমিকরা নিয়ম না মানলে তাদের আইনসিদ্ধ শাস্তি ছিল ভয়াবহ। কিন্তু সরকারের মালিকানায় পরিচালিত কারখানায়গুলো থেকে শ্রমিকরা অন্যত্র গেলে কাজ করবে কে? কেন্দ্রীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তো ভেস্তে যাবে। এ কারণে ১৯৩২ সাল থেকে স্তালিন ইন্টারনাল পাসপোর্ট সিস্টেম চালু করেন। দেশের এক শহর থেকে আরেক শহরে গেলে অনুমতি ব্যতিরেকে যাওয়া অসম্ভব। আয়রনির ব্যাপার হল, ৎসারের সময়ে শেষ এ সিস্টেম চালু ছিল, লেনিন এই আইনকে পশ্চাদমুখী স্বৈরাচারী ইত্যাদি অভিধা দিয়ে উঠিয়ে দিয়েছিলেন। শ্বেত ৎসার নিকোলাসের জায়গা নিলেন এবার রেড ৎসার স্তালিন।

১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
১৯৩২ সালে বাল্টিক-শ্বেতসাগর খাল নির্মাণে নিযুক্ত গুলাগের বন্দী অনৈচ্ছিক শ্রমিক
সাইবেরিয়ার প্রিজন ক্যাম্পের চিত্র
১৯৩৬এ গুলাগের বিছানাগুলির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছে পোস্টারের যুগল মার্ক্স ও স্তালিন
১৯৩২ সালে গুলাগের সর্দারদের গ্রুপ ছবি
দার্শনিক পাভেল ফ্লরেন্সকি ১৯৩৩ সালে সোভিয়তবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেপতার হন। স্তালিনের গুলাগে তার ১০ বছরের নির্বাসন হয়। তিন বছরের মাথায় গুলাগে গুলি করে মারা হ্য় তাকে।
গুলাগ সর্দার স্তেপান গারানিন। ১৯৩৭ সালে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকরোক্তি আদায়ের অভিযোগে তার নিজেরই বন্দীদশা শুরু হয়। গুলাগে মারা যায় কয়েক বছর পর।
১৯৩৭ সালে অনৈচ্ছিক শ্রম দিয়ে তৈরি মস্কো খাল পরিদর্শনে স্তালিন, পেছনে মলোতভ
গুলাগের মহিলা সেকশন, সাইবেরিয়ার ঠান্ডায় নেই কোন হীটিং ব্যবস্থা, ত্রিশের দশক
ৎসারের আমলের ইন্টারনাল পাসপোর্ট। এ কাগজ ব্যতিরেকে স্বদেশের এক জায়গা থেকেই আরেক জায়গায় কেউ যেতে পারত না।

রাশিয়ায় টেইলরিজম চালুর অনেক সমস্যাও ছিল। পশ্চাদপসর রুশ কর্মীদের ঘড়ি ছিল না। সময়মত শিফটে এসে হাজির হত না। তারপর কম্যুনিস্ট পার্টির হর্তাকর্তারা কারখানার এক জায়গায় দক্ষতা বাড়ালে দেখা যেত বটলনেক অন্যত্র, যেখানে বিন্দুমাত্র নজর দেয়া হয়নি। কর্মীরা আমদানিকৃত দামী যন্ত্র ব্যবহার করত খুব অদক্ষভাবে। সেগুলি প্রায়ই বিকল হয়ে যেত। তৈরি পণ্যের গুণগত মানের অবস্থা ছিল শোচনীয়। এসবের দোষ পড়ত প্রকৌশলী ও ম্যানেজারদের ঘাঁড়ে। কখনো কখনো তাদের সাবোটাজের অভিযোগে কর্মচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হত শাস্তি হিসাবে।

কোন কারণ ছাড়াই ওপরমহল থেকে নির্দেশ আসত কাজ দ্রুত করার নয়ত প্রডাকশন কোটা বাড়ানোর। উদাহরণস্বরূপ, লেনিনের তড়িতায়ন স্বপ্নে তাড়িত সোভিয়েত পার্টিকর্মীরা সারা দেশে তামার স্যালভেজ অপারেশন চালায়। অশিক্ষিত চাষারা নিয়ে আসে বিভিন্ন মানের তামার দ্রব্য, যেগুলি থেকে ভালমানের বৈদ্যুতিক তার বানানো লাভজনক নয়। এরাই ফ্যাক্টরিতে কাজ করে এবং তাদের তৈরি গাড়ি ও ট্র্যাক্টর হয় বেশ নিম্নমানের।

ফোর্ডের তৈরি দশ বছরের গ্যারান্টিওয়ালা ট্র্যাক্টর সোভিয়েত চাষার ব্যবহারে তিন মৌসুমের মধ্যে অকেজো হয়ে পড়ে থাকত। পড়ে থাকলে বরং রুশ চাষার লাভ, সরকারী যৌথখামারের কাজে ফাঁকি দিতে পারে! ট্র্যাক্টর ঠিক করানোর পার্টস ও রিপেয়ার শপ ছিল নামে মাত্র। মেশিন টুলসের যন্ত্র সঠিক রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ত। ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর জনপ্রিয় হলেও ইউক্রেন ও ভল্গা অববাহিকার মাটি গভীরভাবে কর্ষণের উপযুক্ত ছিল না। আর এদের জ্বালানী ছিল বেনজিন, যেটা রাশিয়ায় সহজলভ্য নয়।

১৯৩৭ নাগাদ এর্ন্সট মের ডিজাইন করা মাগনিতোগোর্স্কের অ্যাপার্টমেন্টগুলো হয়ে পড়ে নোংরা, জনাকীর্ণ বস্তি। মে’র ডিজাইনের সাথে মিল না রেখে অ্যাপার্টমেন্টগুলির এত পরিবর্তন সাধন করে সোভিয়েতরা, যে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হন। একেকটি ফ্ল্যাটে দেখা যেত পাঁচ ছ’জন গাঁদাগাঁদি করে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকছে। বাথটাব ব্যবহৃত হচ্ছে স্টোরেজের জন্য।

সোভিয়েত ব্লক অ্যাপার্টমেন্টের রান্নাঘর, ৫০/৬০এর দশক
স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্টের নারীকর্মী, তিরিশের দশক
স্তাখানোভাইট আন্দোলনের পোস্টার। এরা ছিল “অতিমানবিক” শ্রমিক। এদের কাজ ছিল ক্রমাগত কাজ করে রেকর্ড ভাঙা। সহকর্মীরা এদের দেখতে পারত না। এদের কাজের গুণগত মানও ছিল কম।
পোস্টারে লেখা কয়লা শিল্পায়নের পাঁচ বছরের পরিকল্পনা শেষ হবে তিন বছরে।

বাস্তবতাবিবর্জিত পরিকল্পনার কারণে দেখা যায় স্তালিনের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যে সব কাজ সমাধা হবার কথা ছিল, সেগুলি পিছিয়ে দিতে হয় পরের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষভাগে। ওদিকে পোস্টার সেঁটে চলেছে পার্টিকর্মীরা, “পাঁচ বছরের কাজ শেষ করি চলো তিন বছরে!” মাগনিতোগোর্স্কে দেখা দিল সাপ্লাই চেইন সমস্যা। যে পরিমাণ ক্যাপাসিটি তৈরি হয়েছে, সে পরিমাণ উৎপাদনের কাঁচামাল সাপ্লাইয়ে বটলনেক। এত বড় স্টীল মিল হওয়া সত্ত্বেও সে কমপ্লেক্সটির ভেতরের সকল রেললাইন বানানোর উপযুক্ত উৎপাদনই মিলটিতে নেই। গত পোস্টে বলেছি ডিমান্ড বিল্ডাপ না করেই সবকিছু বিশাল বিশাল বানানোর সোভিয়েত শখের কারণে দ্নিপ্রোগেসের মত বিদ্যুতকেন্দ্রও ক্ষতিতে চলেছিল কয়েক বছর।

স্তালিন এ অবস্থা দেখে নতুন ফতোয়া দিলেন “ডিজী উইথ সাক্সেস” নামে। তার এক্সকিউজ, এত দ্রুত সোভিয়েতরা সাফল্যের মুখ দেখছে যে সেটা হজম করতে পারছে না! এবার আনতে হবে ধীরতা।

ডিজী উইথ সাক্সেস, পার্টির উদ্দেশ্যে স্তালিনের লেখা ফতোয়া, ১৯৩০

স্তালিনের ফ্যাক্টরি ম্যানেজাররা তো আরো এক কাঠি ওপরে। তারা সচেষ্ট ছিলই পার্টি বসদের কাছে নিজেদের জাহির করতে। ফোলানো-ফাঁপানো প্রডাকশন নাম্বার যেত ফাইনাল রিপোর্টে। কোটা পূরণ করতে না পারলে গর্দান যায়, আর কোটা পূর্ণ করেও বেশি দেখাতে পারলে মেডেল আছে কপালে! সোভিয়েত ব্যবস্থাপকদের চয়েস খুবই ক্লীয়ার।

সাধারণ মানুষ যে এই দ্রুত অগ্রগতির থেকে লাভবান হয়েছিল তাও নয়। ভারিশিল্পের ওপর বেশি জোর দেবার কারণে ভোক্তাশিল্প ছিল অবহেলিত। খাদ্য-বস্ত্রের মত মৌলিক চাহিদা পূরণের দিকে সরকারের নজর ছিল কম। অসঙ্গতিপূর্ণ নোট ছাঁপানোর কারণে ভোক্তাপণ্যে মুদ্রাস্ফীতি ছিল অত্যাধিক। দেখা যেত, যেসকল ব্যক্তিমালিকানার খামার তখনও অবশিষ্ট ছিল, সেসবের কৃষক শস্য বিক্রির পরিবর্তে স্টক করে রাখছে। সরকার এসে সেগুলি কেড়ে না নেওয়া পর্যন্ত সেগুলি বিক্রি করত না। শেষ পর্যন্ত সে রাস্তাই নিতে হত কম্যুনিস্ট পার্টিকে। তাতেও যখন চাহিদা না মেটে, তখন শহরের মানুষকে আনা হয় রেশনের আওতায়। রুটির জন্য লম্বা লাইন ছিল সোভিয়েত শহরগুলির দৈনন্দিন দৃশ্য।

তিরিশের দশকে মস্কোতে রুটির জন্য লম্বা লাইন

ওদিকে তথাকথিত সাম্যবাদের দেশের শিল্পায়ন হয় কিন্তু পুঁজিবাদী আদলেই! রাষ্ট্র ছিল সকলের বেতনভাতার নির্ধারক। সোভিয়েত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশকরা ডিপ্লোমা ইনজিনিয়াররা পেত সাধারণ অদক্ষ কর্মীর ৬ থেকে ৮ গুণ। উপরের লেভেলের ম্যানেজাররা পেত ৩০ গুণ। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের বেতনভাতা ছিল সর্বোচ্চ। তারা থাকত বিশেষ বিদেশী এলাকায় ভাল বাসস্থানে। আমদানিকৃত বিলাসদ্রব্য আনা হত তাদের জন্য। ছিল সুইমিং পুল গল্ফ কোর্স। বিনিময়ে কর্নেল কুপারের মত মানুষ সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সফল লবিইং করেন। গ্রেট ডিপ্রেশনের যুগে সোভিয়েত ইউনিয়নে যদি মার্কিন পণ্যের রপ্তানি হয়, মার্কিন মানুষের কর্মসংস্থান হয়, তো মন্দ কি?

সব মিলিয়ে বুঝতে পারছেন হয়ত, সোভিয়েত সিস্টেমে পুঁজিবাদী শোষণের পরিবর্তে সেটি হয়ে গেছে রাষ্ট্রীয়-সরকারী শোষণ। স্টেট সেখানে এক্সপ্লয়টার, ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টের জায়গায়। বরং আরো বাজে এক্সপ্লয়টার। ফোর্ড-টেইলরের মত মানুষ যেখানে শ্রমিকদের ভাল বেতন দেবার পক্ষপাতী ছিলেন, সেখানে সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র শ্রমিকদের বেতন তো বটেই, যাতায়াতও ফিক্স করে রেখে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে স্তালিনের আমলে বেশ কিছু শ্রমিক ধর্মঘটও হয়, সমাজতন্ত্রী ওয়ার্কার্স প্যারাডাইজ প্রলেতারিয়াত ডিক্টেটরশিপ রাষ্ট্রে যেটা অভাবনীয়। অবশ্য যথারীতি সেসব ধর্মঘটের বিনাশও করে সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ।

স্তালিনের আমলের অগণিত শ্রমিক ধর্মঘটের একটি স্তালিনের মৃত্যুর পর সোভিয়েত পোস্টারে স্থান নেয়

যাই হোক, ত্রিশের দশকের শেষ নাগাদ নানা ভুল রাস্তায় টক্কর মেরে সোভিয়েত একটা স্থিতিশীল শিল্পায়নের অবস্থায় এসে দাঁড়ায়। তবে লেনিন-স্তালিনের এই ডিজী উইথ সাক্সেস শিল্পায়নের পেছনে বলেছি একটা প্যারানয়া কাজ করত। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির আগ্রাসনের ভয়ে এর আরম্ভ বিশের দশকে। ত্রিশের দশকে যখন সত্যি সত্যি সে সময়টা এল, তখন কি সোভিয়েত রাষ্ট্র তৈরি ছিল প্রতিরক্ষার জন্য? সে কাহিনী বলে সাড়ব আগামী খন্ডে।

ভারতীয় ভক্তিবাদ – ৩

Featured Video Play Icon

সাব আয়া একহি ঘাটসে, উৎরা একহি বাট, বীছ মে দুৰিধা পাড় গা’ই, হো গায়ি বারা বাট — সন্ত কবীরের পঞ্চদশ শতকের মলৰী ভাষায় গাওয়া ভজন। সবাই আসছিল একই ঘাট থেকে, সবার একই পথ, মাঝে পড়ল দ্বিধায় সকলে, হয়ে গেল বারো পথ।

কবীরের একশ’টি ভজন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি ইংরেজী সংকলন বেরিয়েছিল ১৯১৫ সালে। সারা বিশ্বে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল সেটি। রবীন্দ্রনাথ যে কবীরকেই তুলে ধরেছেন, তাতে অবাক হবার কিছু নেই। রবীন্দ্রনাথের ব্রাহ্ম ধর্মবিশ্বাস কবীরের দর্শনের মতই নিরাকার একত্ববাদী। এখনও কবীরপন্থা বলে একটি ধর্মবিশ্বাস বহু ভারতীয় অনুসরণ করে।

আগেই বলেছি চতুর্দশ-পঞ্চদশ শতক ভারতের জন্যে ক্রান্তিকাল। উত্তর ভারতে মুসলিম দিগ্বিজয় সম্পূর্ণ হলেও আগের সেই স্থিতিশীলতা নেই। দিল্লী সুলতানাতের মত বড় রাজ্য ভেঙে ভেঙে তৈরি হয়েছে অনেক সামন্ত রাজ্য। রাজনৈতিক ভাগ্য ও সামাজিক অধিকারের অবস্থা ক্রমপরিবর্তনশীল।

ইসলাম ধর্ম ভারতীয় স্থানীয় দর্শনগুলোর জন্যে একটা বড়সড় চ্যালেঞ্জ ছিল। ভারতে যে সময় ইসলামের আগমন, তখন মোটে বৌদ্ধধর্মকে সরিয়ে নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের প্রতিস্থাপন প্রক্রিয়া চলছে। এর পুরোভাগে ছিল বেশ কিছু দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় রাজবংশ, যাদের মধ্যে পড়ে বাংলার সেনরা।

ইসলাম শুধু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, ছিল সামাজিক মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ভারতীয় ধর্মগুলির প্রতিযোগী। অন্তত থিওরিতে ইসলামে জাতপাত নেই, সবার জন্যে খোদার করুণা সমান। বৌদ্ধ-জৈন ধর্মানুসারীদের বাদ দিলে ভারতীয় বর্ণপ্রথার জন্যে এ ছিল এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গের মত সীমান্তবর্তী জায়গা, যেখানে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বর্ণবাদে নিষ্পেষিত বহু প্রাক্তন বৌদ্ধ ও অসবর্ণ মানুষ রাষ্ট্র ও ধর্মের চোখে অস্পৃশ্য, তাদের জন্যে ইসলাম ছিল আকর্ষণীয় একটি বিকল্প।

যারা নিচু শ্রেণীর খেঁটে খাওয়া মানুষ, তাদের সকলে যে খারাপ অবস্থায় ছিল তা নয়। ইউরোপীয়দের আগমনের সাথে সাথে মার্কেট এক্সপানশন হয়েছে অনেক কুটিরশিল্পের। ব্রাহ্মণদের চোখে চন্ডাল হলেও নিম্নবর্ণের শূদ্ররা কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে। এ ধরনের নিম্ন মধ্যবিত্ত অত সহজে ধর্মান্তরিত হয়নি, হলেও তা হয়েছে নামে মাত্র। ইসলামগ্রহণ যদি নাও করে, নতুন ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু বর্ণপ্রথায় তাদের তেমন কোন সম্মানজনক স্থান নেই। অর্থাৎ, এরা না ঘরকা, না ঘাটকা। এরকম আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী প্রতিবাদ ছিল কেবল সময়ের ব্যাপার।

দরিদ্র তাঁতী পরিবারের কবীর সেই নিষ্পেষিত শ্রেণীরই প্রতিনিধি। তিনি মুসলিম ছিলেন না হিন্দু, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তাকে স্ব-স্ব ধর্মের সন্ত বানাতে হিন্দু-মুসলিম-শিখ সকলে এক পায়ে খাঁড়া। অথচ জীবদ্দশায় সম্ভবত তাকে হিন্দু-মুসলিম উভয়েরই গঞ্জনা সইতে হয়েছে।

কবীরের ভজন গবেষণা করে যতটুকু মনে হয়, মুসলিম পরিবারে বড় হলেও সে ধর্মের খুব বেশি জ্ঞান তার ছিল না। সম্ভবত তার পরিবার প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্মের কনভার্ট। কিন্তু সাবালক বয়েসে কবীরের হাতেখড়ি বৈষ্ণব ভক্তিবাদের সমসাময়িক সাধক রামানন্দের হাত ধরে।

কবীরের দর্শনকে সহজিয়া বলা যেতে পারে। সহজ ভাষায় তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন তা হলো, বাইরে দিয়ে ধার্মিক হয়ে কোন মোক্ষ নেই, অন্তরে থাকতে হবে ভক্তি। দেবমূর্তি তো কোন কথা বলে না, তাকে কেন পূজবো? ঈশ্বরের বাস সে তো মন্দির-কাবায় নয়, মানুষের অন্তরে। মুসলিম কাজী সে একদিকে কুরআন বাঁছে, আরেকদিকে কেড়ে নেয় গরীব মানুষের জমি। তেমন তিলকছাঁপা হিন্দু ব্রাহ্মণ যতই বেদপাঠ করুক না কেন, আত্মার মধ্যে যদি সেটা সে ধারণ না করে, তারও নেই পাপমোচন। অন্তর ভাল না হলে বাইরের পাকপবিত্রতার কোন মূল্য নেই।

দু’হাজার বছর আগে সনাতন ধর্মের বিরুদ্ধে গৌতমবুদ্ধের যে বিপ্লব, সে ছিল আর্য উচ্চবর্ণের ত্রুটিপূর্ণ দর্শনের বিরুদ্ধে আরেক উচ্চবর্ণেরই প্রগতিশীল প্রতিবাদ। আর কবীরের প্রতিবাদ একেবারে তৃণমূল থেকে, সকল প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে, তাদের দুর্নীতি-অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। তার দর্শনে রয়েছে সাম্যবাদের ইউটোপিয়া, যেখানে কোন নিষ্পেষন নেই, জাতপাত নেই, সরকার-রাষ্ট্র নেই, কর নেই।

এভাবে কবীর ভারতীয় মানুষের মোহভঙ্গ হওয়া একটা বিশাল অংশের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। আর তার পথ ধরেই আবার হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের ভারতীয় সিনক্রেটিজম-সিনথেসিসের বীজ বপন হয়। পরবর্তী সন্ত-সাধু সন্ন্যাসী-ফকির ইসলামের নামেই হোক, আর হিন্দু ধর্মের নামেই হোক, একই রকম হৃদয়গ্রাহ্য সার্বজনীন মানবিক ধর্মের বাণী প্রচার করে গেছেন।

কবীরপন্থার একটা বৈশিষ্ট্য অনেকান্তবাদ, অর্থাৎ মোক্ষলাভের উপায় কেবল একটি নয়, বহু — কিন্তু সকলের লক্ষ্য ঐ একই।

কবীরের ভক্তিবিপ্লব প্রসঙ্গে আরো দুটি জিনিস মাথায় এল, যা না বললে নয়। এক, মধ্যযুগের শেষে ইউরোপের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমন কিছু ভিন্ন ছিল না। ক্যাথলিক পাদ্রীকূলও ছিলেন মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। সেখানেও খ্রীষ্টান জগতে কবীরের মতই এক জ্ঞানবিপ্লব সংঘটিত হয়, যার নাম প্রটেস্ট্যান্ট রিফর্মেশন। জার্মানির বেনেডিক্টবয়ার্ন মঠে খুঁজে পাওয়া রিফর্মেশনপূর্ব ত্রয়োদশ শতকের কারমিনা বুরানা নামের পান্ডুলিপি ঘাঁটালে একই রকম প্রতিবাদী ভক্তিবাদ চোখে পড়বে। এব্যাপারে এখানে আগে লিখেছি।

আর দুই, অধুনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভক্তিবাদ! হ্যাঁ, এ বস্তুও আছে। তার একটা ধারা সাদার্ন কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের থেকে এসেছে, যাকে বলে নিগ্রো স্পিরিচুয়াল। ওল্ড টেস্টামেন্টের গল্পগুলিকে সমসাময়িক দাসত্বশৃংখলের সাথে যুক্ত করে একটা খোদাভক্তি ও প্রতিবাদ সেখানে উঠে এসেছে। ওয়েড ইন ওয়াটার গানটা মনে আসল। এ গানটি বাপ্টিজমের রেফারেন্সে ভক্তিমূলক হলেও দ্বিতীয় আরেকটি অর্থ রয়েছে। পানিতে সাঁতরালে পলায়নপর দাসের গায়ে আর কোন গন্ধ থাকে না, মনিবের কুকুরও তাকে আর অনুসরণ করতে পারে না।

Let’s wade in the water,
Wade in the water,
Listen to me now, wade in the water.
I wanna know that you’re mine,
Because your love is so fine.

আরেকটি হলো শ্বেতাঙ্গ ইভানজেলিকাল খ্রীষ্টান মূলধারার ফোক গসপেল সঙ্গীত। এটিও সাউথের। এর উদাহরণ মনে হলো ও ব্রাদার হয়্যার আর্ট দাউ ছবির একটা গান:

As I went down in the river to pray
Studying about that good ol’ way
And who shall wear the robe & crown?
Good Lord show me the way

সুতরাং কবীরের ঐ অনেকান্তবাদ আসলে লার্জার কনটেক্সটে খুবই সত্য। পৃথিবীতে আজ ‘বারো’ পথ, কিন্তু সবার সেই একই ঘাট, একই পথ, একই গন্তব্য। কাহাঁ সে আয়া কাঁহা যাওগে, খাবার কারো আপনে তান কি, কোয়ি সাদগুরু মিলে তো ভেদ বাতাৰে, খুল যাৰে অন্তর খিড়কী…

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!