ইরাকী কুর্দিস্তান

“ইরাক ওয়ার ওয়াজ এ গুড থিং!” ইরাক যুদ্ধ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আপনি নিশ্চয় এমন উত্তর দেবেন না? কিন্তু ইরাকের কেউ না কেউ এমন উত্তর আপনাকে দেবেই। এবং নব্বই শতাংশ সম্ভাবনা সে একজন কুর্দী!

ইরাকের বাথিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ রেজোল্যুশন ১৪৪১ লংঘনের অভিযোগে যে যুদ্ধটি ২০০৩এ শুরু হয়, তার সবচেয়ে বড় বেনেফিশিয়ারি ইরাকী কুর্দিস্তান আর তার পলিটিকাল ক্লাস। সাদ্দামের আমলে যে আরবিল ছিল মফস্বলের অনুন্নত প্রাদেশিক একটি শহর, সেটি আজ তেলের পয়সায় সম্পদশালী। বাকি ইরাকের তুলনায় কুর্দিস্তান রিজিওন তুলনামূলক নিরাপদ এলাকা। কুর্দী যে সকল নেতারা ইরাক-ইরানের সীমান্ত বরাবর ‌অতীতে পালিয়ে বেড়াত, তারা আজ বাগদাদে শক্তিমান পাওয়ার ব্রোকার। যে ইরাকে কখনো সুন্নি আরব ছাড়া রাজা বা রাষ্ট্রপতি কেউ হয়নি, সেখানে এখন অলিখিত আইন যে রাষ্ট্রপতি হবেন একজন কুর্দী। আর একজন নয় চারজন রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে সে নিয়ম ‌অনুসরণ করা হয়েছে।

প্রতিবেশী দেশের কুর্দীদের জন্যে ইরাকী কুর্দিস্তান আশার আলোকবর্তিকা, কিন্তু তাদের সরকারগুলির জন্যে একটা গাত্রদাহের ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকী কুর্দীদের সমর্থন পেয়েছে ও দিয়েছে, সেটা আশপাশের দেশগুলিকে, বিশেষ করে তুরস্ককে, মার্কিন মিত্রতা নতুন করে মূল্যায়ন করতে বাধ্য করেছে।

আরবিল শহর, ইরাকী কুর্দীস্তান, ২০২১

ইরাকী কুর্দিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মাসুদ বারজানি যে উপজাতির নেতা, সেটিই বহু দশক ইরাকে কুর্দী স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিল। ত্রিশের দশকে মাসুদের চাচা আহমেদ বারজানি রাজতন্ত্রী সরকারের কেন্দ্রীকরণ আর উপজাতীয় অধিকার হরণ নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে বিফল হয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মাসুদের বাবা মুস্তাফা নতুন করে আরেকটি বিদ্রোহের সূচনা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পালিয়ে সীমান্তের অপর পারে ইরানী কুর্দীদের সাথে হাত মেলান।

গত পোস্টে বলা সোভিয়েত পাপেট রাষ্ট্র রিপাবলিক অফ মাহাবাদকে মু্স্তাফা বারজানির উপজাতীয় সৈন্যদল সামরিক সহায়তা দেয়। কিন্তু সোভিয়েতরা কেটে পড়লে তাদের সাথে সাঙ্গপাঙ্গসহ আজারবাইজানে চলে যান মু্স্তাফা। কম্যুনিস্ট পার্টির পৃষ্ঠপোষকতায় সমাজতন্ত্রে দীক্ষা নেন তিনি ও তার অনুগতরা। তাঁর লক্ষ্য স্বাধীন কুর্দিস্তান। আর সোভিয়েতের লক্ষ্য, যদি স্বাধীন কুর্দিস্তান হয়ই তো তা হবে সমাজতান্ত্রিক রুশঅনুগত কুর্দিস্তান।

বারজানি পরিবার, সামনে আহমেদ, পেছনে মুস্তাফা ও ভাইয়েরা
বারজানি ক্ল্যান

বিভিন্ন রুশ নেতাদের সাথে মোলাকাত করলেও দ্রুত বারজানির সাথে পৃষ্ঠপোষকদের বিরোধ দেখা দেয়। উজবেকিস্তানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একরকম নির্বাসনে পাঠানো হয় স্বাধীনতাযোদ্ধাদের। সোভিয়েতরা এরপর বারজানির উপযোগিতা পায় ১৯৫৮ সালে ইরাকে আরব জাতীয়তাবাদী সামরিক অভ্যুত্থান ও রাজতন্ত্রের রক্তক্ষয়ী পতনের পর।

নতুন প্রধানমন্ত্রী ব্রিগেডিয়ার আব্দুল করিম কাসিমের আশ্বাসে বারজানি নির্বাসন থেকে ফিরে আসেন। কুর্দিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের ব্যাপারে কাসিমের সাথে সমঝোতাও হয়। কুর্দিস্তান ডেমোক্রাটিক পার্টিকে বৈধতা দেয়া হয়। কিন্তু কাসিম বারজানির ক্রমবর্ধমান শক্তিতে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে শুরু করেন। বারজানি শুধু সোভিয়েত নয়, মার্কিন, ইরানী, ইসরায়েলী যে কোন উৎস থেকে সহায়তা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। অপরদিকে বারজানিবিরোধী সোভিয়েতসমর্থিত কুর্দী নেতাদেরকে ইরাকের কেন্দ্রীয় সরকার গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়। ফলে ১৯৬১ সালে ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। কুর্দী মিলিশিয়া গেরিলা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে কাসিমের সেনাবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। তারা সমর্থন পায় ইরান ও ইসরায়েল থেকে। বহু সাধারণ কুর্দী এ সংঘাতে ইরাকী সেনাবাহিনীর কনভেনশনাল অস্ত্রের ব্যবহারে মারা যায়।

ইরাকী প্রধানমন্ত্রী আব্দুল করিম কাসিমের সাথে মুস্তাফা বারজানি
প্রথম ইরাকী-কুর্দী যুদ্ধ, ১৯৬১-৭০

কিন্তু এই কুর্দী অভিযান নিয়েই কাসিমের সাথে তার সেনানায়কদের বিরোধ দেখা দেয়। ক্যুতে তিনি নিহত হন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কর্নেল আব্দুস সালাম আরিফ আর তার ভাই লেফটেনেন্ট জেনারেল আব্দুর রহমান আরিফ কেউই কুর্দী পেশমের্গা গেরিলার বিরুদ্ধে সফলতা অর্জন করতে পারেননি। বাধ্য হয়ে ১৯৬৬ সালে একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে নতুন করে স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়ে বারজানিকে।

কিন্তু তাতে বাদ সাধে ১৯৬৮ সালে ইরাকে বাথ পার্টির ক্যু। আরব জাতীয়তাবাদীদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসে বাথ সমাজতন্ত্রী জাতীয়তাবাদীরা। এ পার্টির আদর্শ নাৎসি পার্টির থেকে এমন কিছু ভিন্ন নয়। সাদ্দাম হোসেন তখন বড় মাপের বাথিস্ট নেতা না হলেও তাকে ১৯৭০এ পাঠানো হয় কুর্দীদের সাথে নতুন করে শান্তিস্থাপনের জন্যে। স্বায়ত্ত্বশাসন আর কুর্দীকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদার দেবার প্রস্তাবে ইরাক রাজি হয়।

কিন্তু সে চুক্তি বাস্তবায়নেও কেন্দ্রীয় সরকার নানা টালবাহানা করে। ততদিনে কুর্দী এলাকার মসুল ও কিরকুক শহরের আশপাশে তেলের খনি আবিষ্কৃত হয়েছে। সেসবের ওপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্যে কেন্দ্রীয় সরকার এলাকাটির “আরবীকরণ” শুরু করে। এর অর্থ হল, আদি অধিবাসী কুর্দী, অ্যাসিরীয়, ইয়াজিদী এদেরকে সরিয়ে সে জায়গায় আরব বেদুইন উপজাতিগুলিকে প্রতিস্থাপন করা। এতে করে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটি বাথ পার্টির একদলীয় নিয়ন্ত্রণে থাকবে।

দ্বিতীয় ইরাকি-কুর্দী যুদ্ধ, ১৯৭৪-৭৫
সাদ্দামসহ মুস্তাফা বারজানি

বারজানি এ নীতির বহু প্রতিবাদ করেও ফল পাননি। তার ওপর একটি ব্যর্থ আততায়ী হামলা হয় বারজানির ওপর, যার পেছনে সাদ্দামের হাত ছিল। দ্বিতীয় যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় কুর্দিস্তানে। বারজানিকে ইরান ভারি অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে অভ্যস্ত পেশমের্গা কনভেনশনাল অস্ত্র দিয়ে ইরাকের সুপেরিয়র সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন কিছু করতে পারেনি। ওদিকে ১৯৭৫এ ইরাক-ইরানের শাত-ইল-আরব ভূমিবিরোধ আলজিয়ার্স চুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা হয়ে যায়। ইরানের শাহ তখন সহায়তা বন্ধ করে দিলে বারজানিকে আবার পালাতে হয়ে সীমান্তের ওপারে।

এ সময় বারজানির অবর্তমানে কেডিপির প্রগতিশীল সদস্যদের নিয়ে নতুন পার্টি পেট্রিওটিক ইউনিয়ন অফ কুর্দিস্তান পি,ইউ,কে সংগঠিত করেন তারই সহযোদ্ধা জালাল তালাবানি। ১৯৭৬এ লো-লেভেল ইনসার্জেন্সি চালু রাখে তারা। কিন্তু শীঘ্রি কেডিপির সাথে ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন সাদ্দাম হোসেন। উত্তর ইরাকের বড় শহরগুলিতে সামরিক শক্তিবলে পুরোদমে চলে আরবীকরণ অভিযান।

১৯৭৯ সালে ইরানের বিপ্লবের পর পরই মৃত্যুবরণ করেন মুস্তাফা বারজানি। তার স্থান নেন ছেলে মাসুদ। পরের বছরই শাত-আল আরবের পুরনো বিবাদের দোহাই দিয়ে ইরান আক্রমণ করে বসেন সাদ্দাম। সুযোগ পেয়ে কেডিপি ও পিইউকে উভয়েই উত্তর ইরাকে আবার বিদ্রোহ শুরু করে দেয়। অপেক্ষাকৃত রক্ষণশীল বারজানির দল সরাসরি ইরান থেকে সাহায্য পায়। আর তালাবানির দল সাহায্য পায় বাথিস্ট সিরিয়া আর লিবিয়ার থেকে।

কিন্তু ইরানের সাথে যুদ্ধরত অবস্থাতেও ইরাকের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনীর যথেষ্ট অস্ত্রবল ছিল উত্তরের বিদ্রোহ সামাল দেবার। ১৯৮৩ সালে বিশাল অভিযান চালিয়ে আরবিল প্রদেশে মাসুদের উপজাতি বারজানিদেরকে প্রায় নিঃশেষ করে দেয়া হয়। তার পরিবারের বহু সদস্যকে অপহরণ করে নিয়ে যায় ইরাকী বাহিনী। পরবর্তীতে সেসময়ে নিহত পাঁচশর ওপর মানুষের গণকবর খুঁজে পায় কুর্দীরা।

হালাবজায় রাসায়নিক আক্রমণে নিহত বাবা-শিশু, ১৯৮৮
ইরান ইরাক ফ্রন্টলাইনে গ্যাসমাস্কপরা ইরানী সৈন্য
কেমিকাল আলি

১৯৮৮ সালে ইরানঅধিকৃত হালাবজা শহরে গোলানিক্ষেপ করে সাদ্দামের বাহিনী। আন্তর্জাতিক আইনের থোড়াই কেয়ার করে মার্চে সে শহরে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে তারা। স্থানীয় ইরাকী কুর্দী বৃদ্ধ-নারী-শিশু হাজারে হাজারে কঠিন মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। “কেমিকাল আলি” ডাকনাম দেয়া হয় সে ঘটনার নেতৃত্বে থাকা সাদ্দামের তুতোভাইকে। মানব ইতিহাসে এই প্রথম ঘটনা যেখানে স্বদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে উইপন অফ মাস ডিস্ট্রাকশন ব্যবহার করল কোন একটি দেশ। বৃহত্তর “আল-আনফাল” অভিযানের ‌অংশ ছিল এ আক্রমণ। কুরআনের একটি সূরার নামে অভিযানটির নামকরণ। সব মিলিয়ে প্রায় এক লাখ কুর্দী মানুষের মৃত্যু হয় এ অভিযানে, যাকে এখন অনেকে কুর্দী জেনোসাইড নামে অভিহিত করে। একই কারণে ইসরাইলের সাথে কুর্দীরা একটা ঐতিহাসিক সংযোগ বোধ করে।

দাবার ছক পাল্টাতে শুরু করে ১৯৯১ সালে। সাদ্দামের কুয়েত দখলের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বিশাল কোয়ালিশন নিয়ে ইরাকে আক্রমন চালায়। উত্তর ইরাকে ঘোষিত হয় নো ফ্লাই জোন। নিজেদের বিবাদ মিটিয়ে তালাবানি ও বারজানিরা সেখানে ডি ফ্যাক্টো স্বায়ত্ত্বশাসন শুরু করেন। বুশের আহ্বানে দক্ষিণে শিয়া-সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাতেও সাদ্দামবিরোধী গণআন্দোলন শুরু হয়ে যায়। দু জায়গাতেই নিষ্ঠুরভাবে সামরিক বাহিনীর সাহায্যে বিদ্রোহ মোকাবেলা করে নিজের গদি রক্ষা করেন সাদ্দাম। কিরকুক থেকে হটে পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নেয় কুর্দী স্বায়ত্ত্বশাসিত কাউন্সিল।

হালাবজা মেমোরিয়াল, ইরাকী কুর্দিস্তান
কুর্দী বিদ্রোহ, ১৯৯১

একতাবদ্ধ ইরাকী কুর্দিস্তান নিজেদের অধিকৃত এলাকায় সংসদ নির্বাচন করে ১৯৯২ সালে। উত্তরে বারজানির কেডিপি আর দক্ষিণে তালাবানির পিইউকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। ইরাকী সরকার এদের ওপর অবরোধ আরোপ করে। পিকেকে নির্মূলের লক্ষ্যে তুরস্কের সেনাবাহিনীও পশ্চিমে একটি অভিযান চালায়। কঠিন এ সময়টিতে কুর্দীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে। গৃহযুদ্ধ চলে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। কেন্দ্রীয় ইরাক সরকার ও ইরান যথারীতি উভয় পক্ষকে নিজের সুবিধার জন্যে ব্যবহার করে। ১৯৯৭এ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় সহিংসতা বন্ধ করে দুই কুর্দী পক্ষ।

২০০৩এ বুশ দুই’য়ের ইরাক আক্রমণে শরিক হয় কুর্দী সৈন্যরাও। এ সময় যুক্তরাষ্ট্র আগের বারের মত মিত্র দেশগুলির সহায়তা পায়নি। বিশেষত তুরস্ক তাদের ভূমি ব্যবহারের অনুমতি দেয়নি। এ কারণেই উত্তর ইরাকে কুর্দীদের ওপর নির্ভর করতে হয় মার্কিনদের। আয়রনিকালি তুরস্ক এভাবেই “শত্রু” জাতিটিকে সাহায্য করে বসে, যেখানে একটা সুযোগ ছিল “ক্লীনাপ অপারেশন” চালানোর। সাদ্দামসমর্থিত বাহিনীগুলির ওপর কুর্দী পেশমের্গা সহজেই বিজয় পায়। কিরকুক ও ‌অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর ফিরে আসে তাদের হাতে।

আরবিল শহরে ইরাকী কুর্দী ও অ্যাসিরীয়দের সমাবেশ
বিভিন্ন দেশের মাঝে কুর্দী জাতিগোষ্ঠীর বিভাজন

২০০৬এ দখলদার মার্কিনদের বিরুদ্ধে যখন ইরাকের বাকি সকল ‌‌অংশে ইনসারজেন্সি চলেছে, তখন কুর্দিস্তান ও দক্ষিণের শিয়া-অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল তুলনামূলকভাবে শান্ত। নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকার নির্ধারিত হয় গৃহযুদ্ধচলাকালীন সময়েই। তাতে ইরাকী প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেন কুর্দী নেতা জালাল তালাবানি স্বয়ং। ২০১১-১২র দ্বিতীয় সুন্নি ইনসারজেন্সি আর ২০১৩-১৭র আইসিস যুদ্ধ ইরাকি কুর্দিস্তানের একাংশে হলেও নিজেদের শহরগুলির নিয়ন্ত্রণ হারায়নি কুর্দিস্তান রিজওনাল সরকার।

তবে কেন্দ্রের সাথে তেল-উত্তোলন ও পরিবহন নিয়ে পরবর্তীতে নানা বিবাদে জড়িয়েছে কুর্দীরা। সে নিয়ে সংঘাত হয়েছে উভয় পক্ষের মধ্যে। কেন্দ্রের শাসানি আর মার্কিনসহ অন্যান্য মিত্রদের সাবধানবাণী সত্ত্বেও ২০১৭ সালে স্বাধীনতা নিয়ে গণভোট করেন বারজানি। ৯২ শতাংশ ভোট পড়ে স্বাধীনতার পক্ষে। তবে এটা কোন বাইন্ডিং রেফারেন্ডাম ছিল না। স্বাধীনতা দূরে থাক, উল্টো কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী কুর্দিস্তানের অধিকৃত এলাকার ২০ শতাংশের পুনর্দখল নেয়। এ ছিল বারজানির আদর্শিক কিন্তু ভুল একটি পদক্ষেপ।

ইরাকী কুর্দিস্তানে তেলগ্যাসের চিত্র
আর্বিল, ইরাকী কুর্দিস্তান, বর্তমানকাল
কুর্দিস্তান স্বাধীনতা রেফারেন্ডামের প্রাক্কালে সমাবেশ, ২০১৭
কুর্দিস্তান স্বাধীনতা রেফারেন্ডামের প্রাক্কালে সমাবেশ, ২০১৭

সাদ্দাম বা কাসিমের সময়কার থেকে ইরাকী কুর্দীদের বর্তমান চিত্র বেশ উন্নত। কিন্তু এখনো সেই পুরনো কেন্দ্রবিরোধী সংঘাতের বীজ রয়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারে তাদের যথাযথ গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব আছে। কুর্দিশ পাইপলাইনের তেলগ্যাস থেকে ভাল আয় আছে। আর স্বায়ত্ত্বশাসন এখন সরকারীভাবে স্বীকৃত। যতদিন এমন একটা পাওয়ার ব্যালান্স টিকিয়ে রাখতে পারবে কুর্দীরা, ততদিন ভবিষ্যতের একটা আশা আছে স্বাধীন রাষ্ট্রের।

আশা করি এখন বুঝতে পারছেন, কেন একজন ইরাকী জাতীয়তাবাদী কুর্দী আপনাকে বলবে ইরাক ওয়ার ওয়াজ এ গুড থিং! আরও বুঝেছেন, আশপাশের দেশগুলির কেন কুর্দী ইস্যু নিয়ে গাত্রদাহ বেড়েছে।

আধুনিক জাতিরাষ্ট্র

যখন ছোট ছিলাম, তখনকার দুটো ভূরাজনৈতিক ঘটনা আমাদের প্রজন্মের স্মৃতিপটে গেঁথে আছে। এক, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিকরণ ও তার জায়গায় একসাথে পনেরটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি। দুই, সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাকী সেনাবাহিনীর কুয়েত আক্রমণ ও অ্যানেক্সেশন।

ছোটবেলায় তাই মনে একটা প্রশ্ন ছিল, একটা দেশ দেশ হয় কিভাবে? স্কুলের বইপুস্তক থেকে শেখা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল সে প্রশ্নের তখন জানা একমাত্র উত্তর। কিভাবে পনেরটি দেশ যুদ্ধ ছাড়া হুঁট করে স্বাধীন হয়ে গেল, কিংবা কেন একটি বড় দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করে আরেকটি ছোট দেশের স্বাধীনতা হরণ করে নিল, সে সব ছিল জানা উত্তরের বিপরীত। এসব নিয়ে জানতে বুঝতে উইকিপিডিয়ায় লেজুড় ধরে ধরে একের পর এক আর্টিকেল পড়ার মত পরবর্তী দশ বছরে পড়ে ফেললাম পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া, কম্যুনিজম, মার্ক্সিজম প্রভৃতির ইতিহাস। আমার খোঁজা উত্তরটা কিন্তু অন্য কোথাও।

একটি রাষ্ট্র কিভাবে রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়? এটা আসলে একটা ক্লাবে ঢোকার মত। এক্সক্লুজিভ ক্লাব। চাইলেই আমি আপনি নিজেদের প্রাইভেটলি ওনড জায়গাজমি নিয়ে নতুন একটা স্বাধীন দেশ ঘোষণা করলাম, আর অন্যান্য সকল রাষ্ট্র আমাদের বাহবা দিয়ে তাদের ক্লাবে ঢুকিয়ে নেবে, এ এত সহজ নয়।

বর্তমান রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে আগত — আপনি যতই সে সংজ্ঞাকে “ঔপনিবেশিক” বলে গালি দেন না কেন, আপনি সে সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত একটি রাষ্ট্রেই বসবাস করছেন। এটা‌ই বাস্তবতা। আর এ সংজ্ঞাটা যথেষ্ট কার্যকর।

ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্র সংজ্ঞার পেছনে প্রচুর রক্তপাতের ইতিহাস আছে। ঊনবিংশ শতকের শুরুর ভাগে নাপোলেওঁ বোনাপার্ত সমগ্র ইউরোপের মানচিত্র তছনছ করে ফেলেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নামমাত্র রাষ্ট্র বানিয়ে দেন তিনি, সেগুলির মাথায় ছিল তার পরিবারের কোন না কোন সদস্য। ১৮১৫তে নাপোলেওনের পরাজয়ের পর মানচিত্র আগের জায়গায় ফিরে যায়। কিন্তু নাপোলেওনের সময়ের বিপ্লবী চিন্তাধারণাটা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়ে যায়। প্রচুর রাষ্ট্রনীতিবিদ ও দার্শনিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন যুক্তিসংগত সংজ্ঞা দিতে শুরু করেন, বাস্তব অবস্থাটা যেমনই হোক না কেন। জাতীয়তাবাদী দর্শনগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিপর্যয় আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরও ব্যাপক মারণযজ্ঞের পরই ইউরোপ তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ একটা সময় পায় রাষ্ট্রের ক্রমাগত রিফাইনড ডেফিনিশনের কারণে। সে ইতিহাস এখনো চলমান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে রাষ্ট্র গঠনের পেছনে ছিল সাম্রাজ্যের ধারণা। সেখানে জোর যার মুলুক তার। সকল রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হবে বড় সাম্রাজ্যগুলির ক্লাবে আলোচনার মাধ্যমে। এ ধরনের ভূরাজনীতির কারণেই অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্য বহু দশক দুর্বলতায় ভুগেও বেঁচে থাকে। এক একটি সাম্রাজ্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সংগঠিত, যার নেতৃত্বে একটি সংখ্যাগুরু জাতির একনায়কতন্ত্রী বা গণতান্ত্রিক শাসক অধিষ্ঠিত। এক সাম্রাজ্য ‌অন্য সাম্রাজ্যের সাথে নানা রকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। তার অন্তর্গত জাতিগোষ্ঠীগুলির ইচ্ছা ও অধিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে গৌণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ বড় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা। কলোনি, রিসোর্স, কৌশলগত এলাকার দখল প্রভৃতি নিয়ে। যুদ্ধপরবর্তী পরাজিত বিধ্বস্ত দেশগুলির ভাগ্য নির্ধারণের একটা মূলমন্ত্র ছিল ন্যাশনাল সেল্ফ-ডিটারমিনেশন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উডরো উইলসনের চৌদ্দ দফা এই মূলমন্ত্রের ধারক।

ইউরোপের বড় দুটি সাম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বিতীয়টি ছিল বহু জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত। সেটিকে ভেঙে বহু জাতিগত সীমানা নির্ধারিত হয়। ইউগোস্লাভিয়া গড়ে ওঠে তাদের থেকে অধিকৃত এলাকাকে সার্বিয়া-মন্টেনেগ্রোর সাথে যুক্ত করে। কিছু এলাকা পায় রোমানিয়া-ইতালিও। চেকোস্লোভাকিয়া-পোল্যান্ড বহু শতক পর আবার স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

ওদিকে রুশ সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির সদস্য হলেও বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে তারা অক্ষশক্তির সাথে আলাদা শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। তাদের আত্মসমর্পণ থেকেও কিছু স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। বাল্টিকের দেশগুলি, ককেশাসের তিনটি দেশ, আর ইউক্রেন-বেলারুশ বিভিন্ন মেয়াদে স্বাধীন থাকে — সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে পুনর্দখলের আগ পর্যন্ত। তবে পোল্যান্ড-ফিনল্যান্ডকে আর আগের মানচিত্রে ফেরাতে পারেনি ত্রতস্কির লালবাহিনী।

নতুন গঠিত দেশগুলির যারা যারা বিজয়ী মিত্রশক্তিকে সাহায্য করে, যাদের ইতিমধ্যে একটি ক্লিয়ারলি ডিফাইনড বর্ডার, আর যথেষ্ট জনপ্রতিনিধিত্বপূর্ণ নেতৃত্ব রয়েছে, এবং বেশ আগে থেকেই যারা বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তারা সহজেই জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাদের রাষ্ট্রপরিচয়কে স্বীকৃতি দেয় প্রথমে পরাশক্তিগুলির ক্লাব, পরে লীগ অফ নেশনসের কালেক্টিভ কনসেনসাস। শুধু তাই নয়, যেসব ছোট জাতিগত রাষ্ট্র শত্রুভাবাপন্ন বড় রাষ্ট্রের প্রতিবেশী, তাদের স্বাধীনতার গ্যারান্টর হয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি। পোল্যান্ড-চেক এর উদাহরণ। এর থেকে লাভবান হয় ছোট রাষ্ট্রগুলি আর মিত্রশক্তির পরাশক্তি দেশগুলিও। এর বিপরীতে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের থেকে ভেঙে বের হওয়া বেশ কিছু ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র শুরুতে বলা ঐ শর্তগুলি পুরোপুরি পূর্ণ করে স্থায়ী রাষ্ট্র স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে, সাম্রাজ্যের পরিচয় থেকে জাতিগত পরিচয়ের এ ভূরাজনৈতিক প্রথায় আসতে গিয়ে উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী দর্শনের ক্যান অফ ওয়ার্মস খুলে আসে। চেক-পোলিশ রাষ্ট্রগুলি প্লুরালিস্ট ডেমোক্রেসি হিসাবে যাত্রা শুরু করলেও খুব শীঘ্রি জাতীয়তাবাদী পরিচয়টি বেশি আঁকড়ে ধরে। এর মূল কারণ ইতালি-জার্মানিতে ফ্যাশিজমের উত্থান। কোন কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তাদের বিপরীত জাতীয়তাবাদের উগ্রপন্থী প্রতিক্রিয়া হিসাবেই শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাই জার্মান-অস্ট্রিয়ান-ইতালিয়ান জাতীয়তাবাদী ইরেডেন্টিজমের চূড়ান্ত ফল। সে যুদ্ধের পর ইউরোপের পুনর্গঠনের সময় দেশগুলির রাষ্ট্রতন্ত্রে নতুন কিছু সাংবিধানিক ধারা যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে একেকটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেয়া হবে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার। তারা অন্য জাতির ভূখন্ডে বাস করলেও পাবে সমাধিকার ও সমনিরাপত্তা। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদ লাভের অন্যতম শর্ত করা হয় এই ধারাটিকেই। সোজা কথায় জাতীয়তাবাদ যেন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার অর্জনের পথে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়। আগের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।

তবে পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে এই থিওরিটা প্র্যাক্টিসে রূপান্তরিত হয়, পূর্ব ইউরোপে সে প্র্যাক্টিসটি হয়নি। তার মূল কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সেসকল অঞ্চল ছিল রুশ অধিকৃত। তাছাড়াও এ দেশগুলি জাতিবিভেদের সবচে বেশি নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার স্বাক্ষী। এ সকল কারণে, পোল্যান্ড জার্মানি থেকে দখল করা নতুন অঞ্চল থেকে জার্মানভাষীদের বহিষ্কৃত করে। চেকোস্লোভাকরা করে একই কাজ। খোদ রাশিয়া পোল্যান্ডের যে এলাকাটি বেদখল করে, সেখানকার পোলিশদের পাঠায় নির্বাসনে। পূর্ব ইউরোপে এ ধরনের জাতিগত বিশুদ্ধিকরণ চলে পুরো স্নায়ুযুদ্ধের সময়টা জুড়ে। বলতে গেল বর্তমান ইইউ সদস্য হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী জনমতের মূলে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপীয় মূলধারার রাষ্ট্রসংজ্ঞা থেকে ভিন্ন অতীত ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু উপনিবেশ স্বাধীনতা পায়। তাদের সীমানা কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যবাহী জাতিগত পরিচয়ের সীমানা দিয়ে নির্ধারিত হয়নি। হয়েছে কলোনিয়াল ইম্পেরিয়ালিস্ট লেগ্যাসির ওপর ভিত্তি করে। যার ফলে নাইজেরিয়ার মধ্যে পড়েছে দু তিনটি প্রাচীন রাজ্যের উত্তরসূরীরা, যাদের একাংশ খ্রীষ্টান, একাংশ মুসলিম, একাংশ এনিমিস্ট। ভাষাপরিচয়েও সেরকম বৈচিত্র। ভারতও সেরকম। তবে যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই পুরনো জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টটা দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্র দাঁড়া করিয়েছে, তারা স্বভাবতই একটা বড় প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটা হল, তাদের সীমানার ভেতরের সংখ্যালঘু জাতিদের পরিচয় কি হবে। এই অবস্থার সবচে বড় উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। বাথিস্ট ইরাক-সিরিয়া তাদের সকল সংখ্যালঘুদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করত। আরব পরিচয় না গ্রহণ করলে তাদের সমাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত।

এ প্রশ্ন থেকে বেঁচে গেছে প্রাচ্যের কিছু দেশ, যারা তাদের সাম্রাজ্য হারিয়ে “হোমোজেনাস হোম নেশনে” পরিণত হয়েছে। জাপান একটা উদাহরণ। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপের মত সংখ্যালঘুদের অধিকার যারা নিশ্চিত করতে পেরেছে, কোল্ড ওয়ারের সময়টা কিছু অস্থিতিশীলতা পোঁহাতে হলেও তারা শেষ পর্যন্ত তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে এ কাতারে কিছুটা ফেলতে পারি।

বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংজ্ঞা বাংলাভাষী মানুষের জাতিগত হোমোজেনিটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সেটা। স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্লাবে ঢোকার স্বীকৃতি পাবার জন্য যা যা দরকার ছিল বাংলাদেশ সেসব শর্তও পূর্ণ করে। ডিফাইনড বর্ডার আর আইডেন্টিটি। সত্তরের নির্বাচনের কারণে একটি লেজিটিমেট গণপ্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব। কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পরাশক্তিগুলির সাথে লবিইং। ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির যে বিবর্তন হয়েছে, যেখানে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে, সেটা প্রাচ্যের অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। ট্রাইবালিজম, ন্যাশনালিজম ইত্যাদি জনমানসে ষোল আনা বিদ্যমান। আর সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ইচ্ছাটাই সেসব দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রে প্রতিফলিত। ইউরোপের বাইরে বর্তমানে চলমান সংঘাতগুলির অধিকাংশেরই মূল কারণ সেটা।

যা হোক! এত তাত্ত্বিক কথাবার্তা আসলে অন্য আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণার উদ্দেশ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় জাতি রয়েছে যারা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সকল শর্তই বলতে গেলে পূরণ করে। তাদের গৌরবময় ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু তাদের কোন রাষ্ট্র নেই। বহুবার চেষ্টাচরিত হয়েছে। কিন্তু এখনো সফলতা আসেনি। তাদের কাহিনীটাই বলব পরের খন্ডে। কারো ধারণা আছে কি, কোন জাতিটির কথা বলতে চাইছি?

.
.
.
.
.

[উত্তরঃ কুর্দিস্তান]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের ইউরোপ, ১৯১৪
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের ইউরোপ, ১৯১৯
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ইউরোপ, ১৯৩৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপ, মাঝ বরাবর আয়রন কার্টেন, ১৯৫৫
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপ, ১৯৯১
close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!