প্রাচীন ভারতের অথর্ববেদ আর ভাইকিং ওল্ড নর্স সাগার (মহাকাব্য) মধ্যে শুধু যোজন যোজন দূরত্ব নয়, কমপক্ষে এক হাজার বছরের বিভক্তি।
তারপরও এই গানটিতে গাওয়া ওল্ড হাই জার্মান আর ওল্ড নর্স ভাষার মন্ত্রগুলি শুনে আমার বেদের কথা মনে পড়ে গেল।
গানটিতে দুটি ভাষা আর তিনটি আলাদা মন্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। প্রথমটি অষ্টম শতকের প্রাচীন জার্মানিক ভাষায় শত্রুর বন্দিত্ব থেকে মুক্তিলাভের মন্ত্র। মন্ত্রের যাদুকরী শক্তির বলে উত্থিত ‘ইদিসি’ নামক নারীদৈবশক্তির সাহায্যে হাতের বন্ধন আলগা করে পালানোর তাল করছে বন্দী যোদ্ধারা।
অষ্টম শতকে লেখা এ মন্ত্র ভাগ্যক্রমে মের্সেবুর্গ নামে এক পুরনো জার্মান শহরের ক্যাথলিক মনাস্টেরির লাইব্রেরিতে খুঁজে পাওয়া যায় ঊনবিংশ শতকে। মধ্যযুগীয় খ্রীষ্টান প্রেয়ারবুকের মাঝে আলগা কাগজে লেখা ছিল দুটি মন্ত্র। একটার কথা বললাম, আর অন্যটার বিষয়বস্তু আহত ঘোড়ার খুরের পরিচর্যা। প্রাক-ভাইকিং জার্মানিক দেবতা উওটান তার পুত্র বাল্ডরের ঘোড়ার ডিসলোকেটেড হাড় ঠিক করার জন্যে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দিচ্ছেন: Bone to bone, blood to blood, limb to limb, as if they were mended!
গানের দ্বিতীয় মন্ত্রের মধ্যে রয়েছে নেক্রোম্যান্সি বা মৃতব্যক্তিকে জাগিয়ে তোলার ওল্ড নর্স মন্ত্র। আইসল্যান্ড আর নরওয়েতে পাওয়া ভাইকিং আমলের ‘পোয়েটিক এডার’ কাহিনীর সাথে জড়িত গ্রোগাল্ডর মহাকাব্যের নায়ক তার মৃত মা গ্রোয়ার সমাধিস্তূপে গিয়ে তার প্রেতাত্মাকে উত্থিত করেছে। উদ্দেশ্য, বিপদসংকুল যাত্রার আগে গ্রোয়ার উপদেশগ্রহণ। গ্রোয়ার আত্মা গুনে গুনে নয়টি মন্ত্র দিয়ে ছেলের ওপর রক্ষাকবচ দিয়ে দিচ্ছে। তার একটি ঐ মের্সেবুর্গ মন্ত্রের হাতের বন্ধন আলগা করার হুবহু সমান্তরাল। আর নয় সংখ্যাটি ওল্ড নর্স ধর্মে একটি পুণ্যকর সংখ্যা।
আর গানের কোরাসে পুরুষকন্ঠে যে মন্ত্র তাকে বলে ওয়াশিং ভার্স। এটাও ভাইকিং যুগের। শত্রুর দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন যোদ্ধা বলে উঠছে: I wash from me my enemies’ hatred, the greed and wrath of powerful men। ধরে নিতে পারি, এর সাথে হাত-মুখ ধুয়ে পরিষ্কার করার একটা রিচুয়াল ছিল। প্রার্থনাটির মূল উদ্দেশ্য নিজের মনস্তত্ত্বকে পরিষ্কার করা। যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক, আর দৈনন্দিন জীবনেই হোক, যেন নিষ্কলুষ মনে প্রতিশোধপ্রবণতা পরিহার করে যেটা করণীয় সেটা করা যায়।
মের্সেবুর্গ চার্মগুলি অনন্য। তার কারণ, রোমের প্রভাবে ‘বর্বর’ থেকে ‘সভ্য’ জাতিতে পরিণত হবার সময় প্রাচীন জার্মানিক গোত্রগুলো তাদের পাগান ধর্ম পরিত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়। সে প্রক্রিয়া কখনো শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে, কখনো ক্রুসেডের মাধ্যমে সহিংসভাবে হয়েছে। ফলে আগের যে মন্ত্রগুলি মুখে মুখে প্রচলিত ছিল, সেগুলি সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মের্সেবুর্গ চার্মগুলি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে মনাস্টেরিতে খ্রীষ্টানের ভেঁক ধরে থাকা পাগান বিশ্বাসীর কল্যাণে। সপ্তম-অষ্টম শতকে জার্মানিক জাতিগুলি এভাবে তাদের ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে। একই অবস্থা হয় দশম শতকের ভাইকিংদের।
যেখানে ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্য বেঁচেবর্তে থাকে সেটা উত্তর ভারত। বেদ আর এডার মধ্যে অনেক মিল। শুধু দেবদেবী আর মিথলজি নয়। থর হচ্ছেন বেদের ইন্দ্র, তার হাতের বজ্র থরের অস্ত্রের সমান্তরাল। ইত্যাদি অনেক মিল রয়েছে।
আরও এ গানটিতে যে মিল পাচ্ছি সেটা হলো অ্যালিটারেশন বা অনুপ্রাস। অর্থাৎ কাব্যের শব্দগুলোর প্রথম অক্ষর দিয়ে মিল।
উদাহরণস্বরূপ, অথর্ববেদের রোহণী বনস্পতি সুক্ত, যেটা কিনা ঐ দ্বিতীয় মের্সেবুর্গ চার্মের মতই মাংসের সাথে মাংস লাগুক, চর্মের সাথে চর্ম ইত্যাকার মন্ত্রপাঠের পাশাপাশি ক্ষতে অরুন্ধতিচূর্ণ দিতে বলছে, তার কয়েক লাইন দিলাম:
“রোহণ্যসি রোহণ্যস্থচ্ছিন্নস্য রোহণী, রোহয়েদমরুন্ধতি
যৎ তে রিষ্টং যৎ তে দ্যুত্তমস্তি পেষ্ট্রং ত আত্মনি
ধাতা তদ্ ভদ্রয়া পুনঃ সং দধত্ পরুষা পরুঃ…”
আর ওল্ড নর্সে গাইছে:
Þann gel ek þér fyrstan,
– þann kveða fjölnýtan, þann gól Rindi Rani, –
at þú of öxl skjótir, því er þér atalt þykkir;
sjalfr leið þú sjalfan þik.
(থন গেল্ এক্ থের ফ্যুর্শটান,
থন ক্বেদা ফ্যিয়লন্যুতান, থন গোল রিন্দি রানি
অৎ থু ওফ অক্শল শ্যিয়তির, থ্বি এর থের অতল্ত থুক্কির;
শ্যিয়াল্ফর লেইদ থু শ্যিয়াল্ফান থিক…)
ইত্যাদি।
আমরা ছোটবেলায় শিশুতোষ ছড়াতে অ্যালিটারেশন প্রচুর করেছি। এটা ইন্দোইউরোপীয় ঐতিহ্যে একটা কমন ব্যাপার। বিশেষ করে, বৈদিক সংস্কৃত, ওল্ড হাই জার্মান, ওল্ড নর্স, অ্যাংলোস্যাক্সন আর ওল্ড আইরিশ ভাষার সাহিত্যে বেশ ভালমতই ব্যবহার হত এই অলংকার।
গানটি শুনলে তাই মনে হয়ে বেদের কোন মন্ত্র আওড়ানো চলছে। আসলেই ভাইকিংরা এভাবে সুর করে মন্ত্র পড়ত কিনা, তা হয়ত ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন না, কারণ তাদের কোন লিখিত সঙ্গীত খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু কাব্যিক অলংকরণের মিল থেকে ধরে নেয়া যেতে পারে, যে বৈদিক যজ্ঞ-মন্ত্রের সুর থেকে প্রাচীন জার্মানিক গোত্র আর পরবর্তী ভাইকিংরা খুব বেশি দূরে ছিল না।
আজকাল যে সামান্য পরিমাণ পাগানবিশ্বাসী মানুষ উত্তর ইউরোপে বাস করে, তারা তাই বৈদিক সংস্কৃতের অনুকরণেই মন্ত্রপাঠ করে। আর সেটাই এই গানটাতে ধরা পড়েছে।