শত্রু যখন মিত্র


সময়ঃ ২২শে জুন ১৯৪১ রাত ৩টা। স্থানঃ রাশিয়ার বাল্টিক থেকে রোমানিয়ার কৃষ্ণসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ১,৮০০ মাইলের সীমান্ত। জার্মানি, ইতালি, রোমানিয়া, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, ক্রোয়েশিয়া ও হাঙেরি থেকে ৩৬ লাখ সৈন্য, ৩,৩৫০ ট্যাংক, ৭,২০০ আর্টিলারি, ৭ লাখ ঘোড়ায় টানা সাপ্লাই ওয়াগন, ২,৭৭০ এয়ারপ্লেন পূর্বঘোষণা ছাড়াই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল সোভিয়েত ইউনিয়নের পোলিশ ও ইউক্রেনীয় এলাকায়। শুরু হল অপারেশন বারবারোসা।

নাৎসিবাহিনীর এই আকস্মিক আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় সেকালের সর্ববৃহৎ সামরিকবাহিনী। বোমারু ব্লিৎজক্রিগে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে তারা। মস্কোর সাথে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দেয়া হয়। ১০ দিনের মধ্যে হানাদার বাহিনী অগ্রসর হয় ৪০০ মাইল, দখল হয় মিনস্ক, বন্দী হয় ৪ লাখ রুশ সেনা, ওদেসা-কিয়েভে শুরু হয় মাসব্যাপী অবরোধ।

উত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নে জার্মান পানৎসার ডিভিশন, জুন ১৯৪১
উত্তর রাশিয়ায় মুরমানস্ক রেললাইন অতিক্রম করছে ফিনিশ সেনা, অক্টোবর ১৯৪১
২২শে জুন থেকে ২৫শে আগস্টের মধ্যে রাশিয়ায় অক্ষশক্তির আক্রমণের চিত্র

পুরো অপারেশনে বন্দী ৫০ লাখের অধিকাংশ আর ঘরে ফেরেনি। দিনে ৪০ হাজার করে তাদের মৃত্যু ঘটে। ৯০ শতাংশ রুশ মেকানাইজড ব্যাটালিয়ন ধূলিসাত হয়ে যায়। জুন থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ট্যাংকই ধ্বংস হয় ১৫ হাজার। দেড় হাজার প্লেন ধ্বংস হয়, দুই তৃতীয়াংশ টারমাকে পার্ককরা অবস্থাতেই। ২ কোটি সোভিয়েত নাগরিক রাতারাতি আবিষ্কার করে তারা বাস করছে অন্য জগতে। এদের অনেকেই জার্মানদের মুক্তিদাতা হিসাবে স্বাগত জানায়।

রেড ৎসার স্তালিন স্বয়ং নার্ভাস ব্রেকডাউনের দ্বারপ্রান্তে। অনাগ্রসন চুক্তি সইয়ের দু’বছর পুরো না হতেই নাৎসি বাহিনী তাকে আক্রমণ করবে, ভাবনাতেও আসেনি তার। ব্রেস্ত থেকে সেবাস্তোপোল পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ চলছে, কিন্তু জার্মান অফিশাল ঘোষণা না আসা পর্যন্ত প্রতি-আক্রমণের নির্দেশ এল না তার কাছ থেকে। কৃষ্ণসাগরের দাচায় গিয়ে সমানে ভদকা গিলছেন তিনি। কমান্ডার ইন চীফ হিসাবে আসীনও হলেন না। রুশদের কাছে রেডিওতে খবর ভাঙলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মলোতভ, স্তালিন নয়।

টারমাকে ধ্বংসপ্রাপ্ত সোভিয়েত ফাইটার প্লেন, ১৯৪১
অপারেশন বারবারোসায় জার্মানদের হাতে যুদ্ধবন্দী লালবাহিনীর সৈনিক, ১৯৪১
জার্মান যুদ্ধবন্দীশিবিরের দিকে হেঁটে চলেছে আত্মসমর্পণকৃত সোভিয়েত সৈন্য, ১৯৪১
লাটভিয়ার রিগাতে জার্মান সৈন্যরা পায় মুক্তিদাতার সাদর আপ্যায়ন, জুলাই ১৯৪১
জার্মানি ও অক্ষশক্তির দেশগুলির সোভিয়েত আক্রমণের খবর পাবার মূহুর্তে স্তালিন, ১৯৪১

যখন স্তালিনের আদেশ আসল, সেটা জায়গায় থেকে হানাদার আক্রমণ প্রতিহত করার। কিন্তু সীমান্ত অতিক্রম করা যাবে না। কোণঠাঁষা স্বল্পশিক্ষিত সৈন্যদলগুলিকে পিছু হটতে বারণ করা হল। ফল হল লাখে লাখে রুশ যুদ্ধবন্দী।

কিভাবে এমনটা হল? এর পূর্ববর্তী এক দশকে রাশিয়া তো পরিণত হয়েছিল শিল্পায়িত দানবে। বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈন্যদল তাদের। এমন চকিত পরাজয় ঘটল কেন?

ফাস্ট রিওয়াইন্ড, ১৯৩৭ সাল। মস্কোতে গোপন বিচার বসেছে লালবাহিনীর মার্শাল তুখাচেভস্কিসহ সাতজন জেনারেলের। তুখাচেভস্কি যেনতেন লোক নন, যুদ্ধ উপমন্ত্রী। অভিযোগ, এরা জাপান ও জার্মানির সাথে সোভিয়েতবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। খুব দ্রুত তাদের অপরাধ প্রমাণ করে দিল ট্রিবুনাল, সাক্ষ্য দিল তাদের নিকট সহকর্মীরা। মৃত্যুদন্ড হল শাস্তি।

আসলে যেসকল সাক্ষী ছিল, তাদেরকে অত্যাচার করে নয়ত ব্ল্যাকমেল করে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ানো হয়েছিল। এসব বেরিয়েছে নব্বইপরবর্তী যুগে পুরনো সোভিয়েত আর্কাইভ ঘাঁটিয়ে। এই ক্যাঙ্গারু কোর্টের কারণ আর কিছুই নয়, স্তালিনের সন্দেহবাতিক।

বিশের দশকের শেষভাগে স্তালিন অন্যান্য বলশেভিক নেতাদের ঘাঁড় ভেঙে নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। তার মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন লিওন ত্রতস্কি। দু’জনের মধ্যে নানা ব্যাপারে টক্কর লেগে থাকত। মূল আদর্শগত সংঘাত ছিল বিশ্বে সমাজতন্ত্র ছড়িয়ে দেয়া নিয়ে। ত্রতস্কি তার পক্ষপাতী, স্তালিন তার বিরোধী। ত্রতস্কির নির্বাসন হয় ১৯২৯ সালে।

কিন্তু, স্তালিনের মনে সবসময় সন্দেহ ছিল ত্রতস্কিপন্থীরা লুকিয়ে আছে তারই পার্টির মাঝে। পার্টি আর সেনানেতৃত্বের মাঝে থেকে কেউ ষড়যন্ত্র করছে তাকে সরাতে। ১৯৩৪ সালে এক জনপ্রিয় নেতা কিরভের গুপ্তহত্যার পর তার মনে সে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। ১৯৩৭ সালে স্তালিনের সেই সন্দেহ থেকে অগণিত কম্যুনিস্ট পার্টি সদস্যের ওপর নেমে আসে মৃত্যুর খাঁড়া। তুখাচেভস্কির শো ট্রায়াল ছিল এরই অংশ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক ও রাজনৈতিক হর্তাকর্তারা, মাঝে স্তালিন, সর্বডানে নিগৃহীত মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত মার্শাল তুখাচেভস্কি
মেক্সিকোতে সর্বশেষ ঠিকানা হয় নির্বাসিত সোভিয়েত নেতা লিওন ত্রতস্কির, সাথে স্ত্রী নাতালিয়া, পেছনে চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কালো, ১৯৩৭
স্তালিনের গ্রেট পার্জের শিকার আসামীদের মৃত্যুদন্ডাদেশ পড়ে শোনানো হচ্ছে, ১৯৩৬
১৯৩৭ সালে মস্কো খাল উদ্বোধনকালে স্তালিনের পাশে ছিলেন গুপ্তপুলিশপ্রধান ইয়েষভ। পরের বছর পার্জে তারই প্রাণ যায়। ছবি থেকেও নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয় তাকে।

গর্দান গেল লালবাহিনীর প্রথমদিককার এসকল নায়কোচিত নেতৃত্বের। গুলাগে কারাদন্ডে যায় আরো অসংখ্য জেনারেল-কর্নেল। ১৯৩৮ নাগাদ প্রায় ৩৮ হাজার লালবাহিনী সদস্য হয় চাকরিচ্যুত, এদের ২৩ হাজারের হয় মৃত্যুদন্ড। এই গ্রেট পার্জের শেষে দেখা গেল, ৫ জন সোভিয়েত মার্শালের ৩ জন লাপাত্তা। ১০১ জেনারেলের ৯১ গ্রেপ্তার, ৮০জন মৃত। ৮০ শতাংশ কর্নেল শেষ। নেভির ৯ অ্যাডমিরালের ৮জন আর নেই। এই রেড টেররে দেশব্যাপী মারা যায় সর্বমোট ১৩ লাখ।

যে লালবাহিনী ছন্নছাড়া চাষা-শ্রমিক বিপ্লবীদের দঙ্গল থেকে ত্রিশের দশক নাগাদ পরিণত হয়েছে ১৩ লাখের প্রশিক্ষিত সেনাদলে, যে বাহিনীতে সংযুক্ত হয় বিশ্বের সর্বপ্রথম আধুনিক মেকানাইজড আর্মার্ড ব্রিগেড, সে বাহিনী হয়ে পড়ল যোগ্য নেতৃত্বশূন্য, অদক্ষ, মনোবলহীন, রাজনৈতিক আটাশে ও গুপ্তচর দিয়ে ভর্তি। বিমান ও নৌবাহিনীর অবস্থা ছিল সবচেয়ে শোচনীয়। সামরিক সরঞ্জাম ছিল রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অকেজো।

কিয়েভে লালবাহিনীর ৪৫তম মেকানাইজড কোরের মহড়া, ১৯৩৫
বৃহত্তম সেনাবাহিনী কুচকাওয়াজ করছে ক্রেমলিনে, ১৯৪১

হিটলারের সাথে ষড় করে ১৯৩৯এর সেপ্টেম্বরে পোল্যান্ড ভাগাভাগি করে নেবার পর পর নভেম্বরে এ সেনাবাহিনী নিয়েই স্তালিন আক্রমণ করে বসেন ফিনল্যান্ডকে। উদ্দেশ্য, প্রাক্তন রুশ এ কলোনিকে আবার কব্জা করা। বাল্টিকের দেশগুলিকেও নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। কিন্তু ফিনল্যান্ডে আশাতীতরকম মার খায় লালবাহিনী। ৩ গুণ কম সৈন্য আর ৩০ গুণ কম বিমানের ফিনিশ বাহিনী বিশাল সোভিয়েত সেনাদলকে ফিনিশ করে দেয় উইন্টার ওয়ারে। পরাজয় অবশ্যম্ভাবী দেখে মুখ বাঁচানো শান্তিচুক্তি করেন স্তালিন।

হিটলারের আর বুঝতে বাকি থাকে না লালবাহিনীর আসল হাল। এখানেই আরম্ভ আমার আর্টিকেল।

স্তালিন যথেষ্ট সাবধানবাণী পেয়েছিলেন চার্চিল-রোজাভেল্টের কাছ থেকে। কিন্তু সেগুলি গা করেননি। তার ধারণা ছিল ব্রিটেনের সাথে জার্মানির যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হবে। সময় পাবে সোভিয়েতরা। যা হল, তার জন্য আসলেই প্রস্তুত ছিল না রুশরা। অথচ এ পর্যন্ত অনাগ্রসন চুক্তির খাতিরে খোদ জার্মানিকেই টনকে টন গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল ও খাদ্যশস্য রপ্তানী করে এসেছে তারা। দুধকলা খাইয়ে সাপ নয়, ড্রাগন পোষা যাকে বলে!

২৩শে আগস্ট ১৯৩৯, অনাগ্রাসন চুক্তি স্বাক্ষর করছেন সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোতভ। পেছনে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপ, আর স্তালিন। এর গোপন অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের ছোট স্বাধীন দেশগুলি তারা ভাগাভাগি করে নেয়।
জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণের দুই সপ্তাহের মাথায় সোভিয়েতরাও পূর্ব পোল্যান্ডে অনুপ্রবেশ করে দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করে, দুই বাহিনীর কমান্ডারের করমর্দনের চিত্র, সেপ্টেম্বর ১৯৪১
উইন্টার ওয়ারে ফিনিশদের হাতে যুদ্ধবন্দী ক্যামোফ্লাজবিহীন লালবাহিনীর সৈন্য, ১৯৩৮-৪০
নাৎসি জার্মানির সর্বমোট আমদানির শতাংশ হিসাবে সোভিয়েত থেকে আমদানির চিত্র

খুব দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হল রুশ নেতৃত্বকে। জার্মানির হাতে পড়ার ভয়ে বিশাল সব ফ্যাক্টরিগুলি খুলে খুলে ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়া হল উরাল পর্বতের পূর্বে। আর যেগুলি নেয়া সম্ভব নয়, বিশেষ করে খামার ও কৃষি সরঞ্জাম, সেগুলি পোড়ামাটি নীতি ধরে ধ্বংস করে দিয়ে পিছু হটল লালবাহিনী।

রাজনৈতিক আটাশেদের সরানো হল, লালবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা হল সামরিক র‍্যাংক আর ডেকোরেশন। অর্থডক্স চার্চকে পুনরিজ্জীবিত করা হল সাধারণ মানুষের মনোবল ফিরিয়ে আনতে, তারা আশীর্বাদ করতে শুরু করল অস্ত্রধারী রিজার্ভ সৈনিকদের। তৈরি হল গুলাগের বন্দীদের ব্যাটালিয়ন। যুদ্ধক্ষেত্রে পলায়নের শাস্তি হল তাৎক্ষণিক মৃত্যুদন্ড।

মস্কোর প্রতিরক্ষার জন্য বিশাল রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল। অদম্য তরুণ নেতৃত্বের কারণে সে যাত্রা মস্কো বেঁচে গেল।

কিন্তু রসদ বেশি অবশিষ্ট নেই। জার্মানির দখলে বিশাল শিল্পায়িত এলাকা আর ফসলী জমির ৪০ শতাংশের বেশি। চাষাবাদের যন্ত্র আর পশুরও ৫০ শতাংশ। বাকি জনগণ কৃষিজমির বদলে যুদ্ধক্ষেত্রে শামিল। কে করবে চাষাবাদ?

উরাল পর্বতের অপর পারে স্থানান্তরের জন্য আলাদা করে রাখে সোভিয়েত কারখানার যন্ত্রাংশ, ১৯৪১
পোড়ামাটি নীতির অংশ হিসাবে রুশরা লেনিনগ্রাদের নিকটস্থ একটি গ্রাম ধ্বংস করে দিচ্ছে, ১৯৪১
উপায়ান্তর স্তালিন সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু অর্থডক্স চার্চকে পুনর্বাসিত করেন, তারা যুদ্ধগামী সেনাদের আশীর্বাদ প্রদান করে, ১৯৪১-৪৩
মস্কোর সন্নিকটে ট্যাংকবিরোধী ব্যারিকেড, অক্টোবর ১৯৪১

সোভিয়েত ইউনিয়নের এই ক্রান্তিলগ্নে দ্রুত পাশে এসে দাঁড়ায় তাদের এতদিনের শত্রু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য।

হ্যাঁ, অস্তিত্বসংকটাপন্ন ব্রিটেনের অন্তত সেকেন্ড ফ্রন্ট দরকার ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ওপর তখনও পার্ল হারবার আক্রমণ হয়নি। তখনও কংগ্রেস মিত্রবাহিনীকে সরাসরি অস্ত্র ও অর্থসাহায্য দেবার বিরুদ্ধে। এমন অবস্থায় রোজাভেল্ট কংগ্রেসের একটা বড় অংশের সহায়তায় পাশ করলেন লেন্ড লীজ বিল। মার্চ ১৯৪১এ, বারবারোসার আগেই। এই বিলের লক্ষ্য, মিত্রবাহিনীর দেশগুলিকে এমন অস্ত্র সাহায্য দেয়া, যেটা যুদ্ধে ধ্বংস হলে আর দাম দিতে হবে না। যদি ধ্বংস না হয়, তাহলে ফেরত আসবে নয়ত ব্যবহারকারীরা কিনে নেবে। এ ছিল রোজাভেল্টের সাথে রিপাবলিকানদের কমপ্রমাইজ।

প্রথমে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও প্রজাতন্ত্রী চীন এ বিলের আওতায় সাহায্য পায়। বারবারোসার পর যুক্ত হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। যুদ্ধের শেষ নাগাদ সর্বমোট ৫০ বিলিয়ন ডলারের সাহায্য যায়, আজকের মুদ্রামানে ৮০০ বিলিয়ন। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেটের ১৭ শতাংশ এটি।

৫টি পথে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সাড়ে ১৭ মিলিয়ন টন রসদ আসে সোভিয়েত ইউনিয়নে। এক, কেপ অফ গুড হোপ ঘুরে ইরান ও ককেশাসের ভেতর দিয়ে। দুই, ভূমধ্যসাগর ও বসপোরাস প্রণালী ধরে কৃষ্ণসাগরের বন্দরগুলিতে। তিন, নরওয়ের উত্তরে আর্কটিক সাগরের বন্দর মুরমান্সক ও আর্খেনগেল্সকে। চার, সোভিয়েতের সাথে নিরপেক্ষতার চুক্তিতে আবদ্ধ জাপানের ৎসুশিমা প্রণালী ধরে ভ্লাদিভস্তকে। আর পাঁচ, বেরিং প্রনালী অতিক্রম করে চুকোতকা উপদ্বীপে।

লেন্ডলীজ অ্যাক্ট সই করছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোজাভেল্ট, মার্চ ১৯৪১
সোভিয়েতমুখী লেন্ডলীজ রুটের চিত্র

মার্কিন সাহায্যের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ৩০ হাজার রেডিও সেট, ৩,৪৪,০০০ টেলিফোন-টেলিগ্রাফ, ১২ লাখ মাইলের তার, সাড়ে ৪ লাখ বিভিন্ন সাইজের ট্রাক, ৩৪ হাজার মটরবাইক, ১১ হাজার রেলকার, ২ হাজার রেল ইঞ্জিন, সাড়ে ৮ হাজার ট্র্যাক্টর, ১৪ হাজার প্লেন ও হেলিকপ্টার, ১ হাজার কন্স্ট্রাকশন ইকুইপমেন্ট, ৫০ হাজার প্যানেলের রানওয়ে ম্যাট, আর একেবারে নতুন ব্রিটিশ প্রযুক্তির রেডার।

লালবাহিনীর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল বিশাল ফ্রন্টলাইনের যোগাযোগ ও লজিস্টিকস। সোভিয়েত প্রযুক্তির রেডিও ছিল খুবই অকার্যকর। মার্কিন রেডিও-টেলিগ্রাফ-টেলিফোন ছিল উচ্চমানের। ফ্রন্টলাইনে রসদ নিয়ে যাবার মত যথেষ্ট ট্রাক সোভিয়েতদের ছিল না। এসময় মার্কিন ডজ ও স্টুডেবেকার ট্রাক হয়ে দাঁড়ায় লালবাহিনীর নির্ভরযোগ্য বাহন। স্টুডেবেকারের ওপর কাতিয়ুশা রকেট লঞ্চার লাগালে সেগুলি পরিণত হত মোবাইল আর্টিলারিতে। যুদ্ধকালীন সময়ে রেল পরিবহন ব্যবস্থার এক তৃতীয়াংশ, আর রেললাইনের ৯৩ শতাংশ স্টীল আসে লেন্ডলীজ থেকে। বমার-ফাইটার-ট্রান্সপোর্ট এয়ারক্রাফটের ৩০ শতাংশ ছিল মার্কিননির্মিত।

মার্কিন খাদ্য ও জ্বালানিতেল রাশিয়ায় যায় যথাক্রমে ৪৫ লাখ টন ও ২৭ লাখ টন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সক্ষমতা ছিল না স্থানীয়ভাবে এত উৎপাদনের। এছাড়াও সাড়ে ৭ হাজার মার্কিন ও ৫ হাজার ব্রিটিশ ট্যাংক আসে। পূর্ব ফ্রন্টের যুদ্ধক্ষেত্রের ১৬ শতাংশ ট্যাংক আসে লেন্ডলীজ থেকে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফট, অ্যান্টিট্যাংক, আর্টিলারি মোটর ক্যারেজ ২ হাজার। ফীল্ড গান, অ্যান্টিট্যাংক গান, অ্যান্টি এয়ারক্রাফট গান ৭,১০০। মর্টার ও মেশিনগান ১১ হাজার। সাবমেশিনগান ও স্মল আর্মস দেড় লাখ। কামানের গোলা ৮০ লাখ রাউন্ড। এএ রাউন্ড ৮৩ লাখ। মর্টার রাউন্ড সাড়ে ৩ লাখ। স্মল আর্মস রাউন্ড ১১ লাখ। ৯০টি কার্গো শিপ, ১০৫টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার শিপ। অগণিত বিস্ফোরক ডায়নামাইট, টিএনটি, ডেটোনেটর। ফোর্ডের পুরো একটি টায়ার প্ল্যান্ট তুলে নিয়ে এসে পুনর্স্থাপন করা হয় উরালে।

যুক্তরাজ্য থেকেও ৫ হাজার মাটিল্ডা ট্যাংক পাঠানো হয়, ১৯৪১
মার্কিন শারম্যান ট্যাংকে করে চলেছে লালবাহিনী, ১৯৪৩
রাশিয়ার বেলগরদ শহরে মার্কিন ট্যাংকের সাথে রুশ সৈন্য, ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩
মার্কিন স্টুডেবেকার ট্রাকের ওপর চাপানো কাতিউশা লঞ্চার থেকে রকেট ছুটছে, ১৯৪২
ককেশাসে মার্কিন লেন্ডলীজ ট্রাক ও অ্যান্টিট্যাংক গানের সাথে সোভিয়েত সৈন্য, সেপ্টেম্বর ১৯৪২
মার্কিন লেন্ডলীজ ডগলাস হ্যাভক বোমারু বিমানের সাথে সোভিয়েত ক্রু
সিনসিনাটি শহরের ক্রোগার বেকারিতে মার্কিন কর্মীরা ক্যান করছে সোভিয়েত লেন্ডলীজের খাদ্য, জুন ১৯৪৩
বি-১৭ ফ্লাইং ফর্ট্রেস বোমারু বিমানের গোলার সামনে করমর্দনরত সোভিয়েত ও মার্কিন বৈমানিক, ১৯৪৪
ইরানের দুর্গম পাহাড়ী গিরিসংকটের রাস্তা দিয়ে যেত সোভিয়েতের উদ্দেশ্যে মার্কিন লেন্ডলীজ সাহায্য
ইরানের পারসিয়ান করিডর দিয়ে ৭,২০০ ট্রাকে করে সোভিয়েতে যেত মার্কিন সাহায্য
ইরানের আবাদান এয়ারফীল্ড থেকে মার্কিন যুদ্ধবিমান বুঝে নিত সোভিয়েত বৈমানিকের দল

রুশদের দেয়া মার্কিন এই সাহায্যের মু্দ্রামান সে সময়ে ছিল ১১ বিলিয়ন ডলার, বর্তমান যুগের ১৮০ বিলিয়ন। ব্রিটেন লেন্ডলীজের ৫৮ শতাংশ সাহায্যের ভাগীদার ছিল আর দ্বিতীয় স্থানের ২৩ শতাংশ সোভিয়েত ইউনিয়নের। বিনিময়ে এরা যুক্তরাষ্ট্রকে কি দিয়েছিল?

যুক্তরাজ্য থেকে অত্যাধুনিক কিছু প্রযুক্তি আসে যুক্তরাষ্ট্রে, যার মধ্যে পড়ে রেডার, সাবমেরিন ডিটেকশন, জেট ইঞ্জিন, জাইরোস্কোপিক গানসাইট, ম্যাগনেট্রন, প্লাস্টিক এক্সপ্লোজিভ প্রভৃতি। যুদ্ধশেষে অবশিষ্ট যুদ্ধাস্ত্র ও যুদ্ধজাহাজ যুক্তরাজ্য কিনে নেয় ৯০ শতাংশ ছাড়ে। সে বাবদ ১.১ বিলিয়ন পাউন্ডের কর্জ পরিশোধ করে ২০০৬ সালে।

আর সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠায় প্রচুর কাঁচামাল — ম্যাঙ্গানিজ, ক্রোমিয়াম, প্লাটিনাম, স্বর্ণ, কাঠ। সেসবের হিসাব মিটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাওনা দাবি ছিল ১.৩ বিলিয়ন ডলার। সোভিয়েত ইউনিয়ন দর কষাকষি করে দিতে চায় মোটে ১৫০ মিলিয়ন। শেষ পর্যন্ত ৭০০ মিলিয়নে রফা হয় ১৯৭২ সালে। বাকি পাওনা মাফ করে দেয়া হয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের আর্জি মেনে স্তালিন কমিনটার্ন নামের ইতিমধ্যে অকার্যকর আন্তর্জাতিক কম্যুনিস্ট সংগঠনটিকে অফিশালি বন্ধ করে দেন।

গত পোস্টে বর্ণিত দ্রুত শিল্পায়ন সোভিয়েতকে এ যুদ্ধে যতটুকু সাহায্য করার কথা ছিল, সেটা যে হয়নি নিশ্চয় বুঝিয়ে বলতে হবে না! সোভিয়েত বাহিনীর প্রযুক্তি ও দক্ষ নেতৃত্বের অভাব ছিল লক্ষ্যনীয়। তুখাচেভস্কির বাতলে দেয়া ডীপ অপারেশনস থিওরির প্রয়োগ করা হয় অনেক দেরিতে। এমনকি বারবারোসা শুরুর এক সপ্তাহ আগেও ৩০০ অফিসারকে পার্জ করা হয়। পোল্যান্ডে নির্মানাধীন প্রতিরক্ষাব্যবস্থা জার্মানদের থামাতে যথেষ্ট টেকসই ছিল না।

কিন্তু স্তালিনের ভাগ্য সহায় যে জাপান নিরপেক্ষতা বজিয়ে রাখে। প্রখর রুশ শীত জার্মানদের কাঁদার পাঁকে ফেলে। আর কোটি কোটি সোভিয়েত নাগরিক বিনা বাক্যব্যয়ে অস্ত্র তুলে নেয়, প্রাণ দেয়। আর শিল্পবিপ্লবের সময়কার মত সোভিয়েত পেশীর সাথে শামিল হয় মার্কিন যন্ত্র ও প্রযুক্তি।

পুতিনের রাশিয়াতে এ ইতিহাস আর শেখানো হয় না। প্রতি বছর বিজয়দিবসের প্যারেডে দাবি করা হয়, সোভিয়েতরা একাই বীরত্বের সাথে নাৎসিদের হটিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ, রক্ত তারা দিয়েছে। কিন্তু মার্কিন প্রযুক্তি সাথে না থাকলে স্তালিন এ যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারতেন না। স্তালিন কখনো খোলাখুলি এ কথা কাউকে বলেননি। কিন্তু পরবর্তী সোভিয়েত নেতা খ্রুষভের বরাত অনুযায়ী স্তালিন বহুবার এ কথা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য না করলে জার্মানির বিরুদ্ধে সোভিয়েতের অস্তিত্বরক্ষা ছিল নিতান্তই অসম্ভব।

এদিকে অধুনা ২০২২ সালে নতুন করে মার্কিন লেন্ডলীজ চালু হয় রাশিয়ার চকিত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। সাহায্য গেছে ৬০ বিলিয়ন মু্দ্রামানের। রাশিয়া পেয়েছিল ১৮০ বিলিয়ন ডলার, ফেরত দিয়েছিল ৭০০ মিলিয়ন। সেটা কি ফেরত চাইবেন কেউ? সর্বকালের ইতিহাসের এ‌ই হল সবচেয়ে বড় আয়রনি, সবচেয় করুণ ট্র্যাজিকমেডি!

আগস্ট ২২, ১৯৪৫। বিজয়ীবেশে বার্লিনে রুশ, মার্কিন ও ব্রিটিশ সেনা।

সমাজতন্ত্রী শিল্পায়নের পুঁজিবাদী তরিকা


সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রাথমিক অস্তিত্ব সংকটগুলি কেটে যায় বিশের দশকের মাঝ নাগাদ। রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধে লালবাহিনী জয়লাভ করে। পোল্যান্ড ও বাল্টিক হারালেও প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের প্রায় সর্বত্র শ্বেতবাহিনী ও স্থানীয় বিরোধিতা শক্তহাতে নিষ্ঠুরতার সাথে নির্মূল করতে সক্ষম হয় ত্রতস্কির সেনাদল।

ভল্গায় যখন ১৯২১এর দুর্ভিক্ষ চলমান, তখন কিন্তু লেনিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্রকে কিভাবে বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করা সম্ভব, সে চিন্তায় বেশি প্যারানয়েড। কারণ, কম্যুনিস্ট রাষ্ট্র হিসাবে সোভিয়েতকে ঘিরে থাকা পুঁজিবাদী দেশগুলিকে তারা “শ্রেণীশত্রু” হিসাবে দেখে। যুদ্ধবিধ্বস্ত হলেও প্রযুক্তিতে সেসব দেশ এগিয়ে আছে পঞ্চাশ বছর! তাদের বিরুদ্ধে কিভাবে টিকে থাকা সম্ভব, আর কিভাবেই বা সম্ভব সেসব দেশেও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জোয়ার ছড়িয়ে দেয়া?

সোভিয়েত প্রপাডান্ডা পোস্টারে কটাক্ষ করা হয়েছে ফরাসী, মার্কিন ও ব্রিটিশ পুঁজিবাদীদের, ১৯২০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর বহু আগেই প্রতিবেশীদের আগ্রাসনের ভয়ে শিল্পায়ন শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯২৯

বলশেভিক রাশিয়ার অস্তিত্ব সুনিশ্চিত করতে তাই লেনিনের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল দ্রুত রাশিয়ার শিল্পায়ন সম্পন্ন করা। তাছাড়াও কার্ল মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে শিল্পায়িত দেশে, কৃষিকাজনির্ভর দেশে নয়। রাশিয়া তখনো কৃষিভিত্তিক দেশ। সমাজতন্ত্রে উত্তরণের আদর্শবাদী পথে শিল্পায়ন একটা গুরুত্বপূর্ণ ধাঁপ। ৎসারের আমলে যে অর্গানিক শিল্পায়ন শুরু হয়েছিল, সেটা যুদ্ধ ও বিপ্লবের কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। লেনিন এবার যে শিল্পায়নের জন্য সচেষ্ট হলেন, সেটা বলপূর্বক শিল্পায়ন। ব্যক্তিগত পুঁজি নয়, রাষ্ট্র কিংবা সমবায় সমিতি হবে সে শিল্পায়নের মূল কান্ডারী।

স্বপ্ন এক কথা আর সেটা বাস্তব বানানো আরেক। বিপ্লবের পর রাশিয়ার খুব করুণ অবস্থা। শিল্পায়ন নতুন করে শুরু করবে কাকে দিয়ে? “বুর্জোয়া শ্রেণীশত্রু” প্রকৌশলী-বিজ্ঞানীরা হয় বিপ্লবীদের হাতে নিহত, নয়ত তাদের জীবনের সঞ্চয় নিয়ে অন্যদেশে পলাতক। আর লেনিন স্বয়ং দুটো স্টীমারে করে অগ্রগণ্য চিন্তাবিদদের নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। কেবল দুই স্যুটকেসে সারা জীবন ভরে নিয়ে দেশান্তরী হন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে নৈর্ব্যক্তিক শিক্ষার জায়গা ততদিনে নিয়েছে আদর্শবাদী রাজনৈতিক বুলি আর শ্লোগান।

স্টীমশিপ হাকেন, দুটো জাহাজের একটি যাতে করে রুশ ১৯২২ সালে বিরুদ্ধমতের দার্শনিকদের আজীবন নির্বাসনে পাঠান লেনিন

হ্যাঁ, সমাজতন্ত্রীদের পেশীশক্তি আছে, অদক্ষ জনশক্তি আছে। কিন্তু প্রযুক্তি নেই, সাংগঠনিক নেতৃত্বের অভাব। যেসব ব্যবস্থাপক ও সংগঠক ৎসারের আমলে শ্রমিকদের সঠিকভাবে সংগঠিত ও পরিচালিত করে কারখানা চালু রাখত, তারা এখন মৃত নয়ত নিগৃহীত।

ঠিক এমন অবস্থাতেই উপায়ান্তরহীন কম্যুনিস্ট নেতৃত্ব — লেনিন, ত্রতস্কি, স্তালিন স্বয়ং — অনেক সাধারণ সদস্য ও লেবার ইউনিয়নের বিরোধিতা সত্ত্বেও সিদ্ধান্ত নেন রাশিয়ার দ্রুত শিল্পায়নে বৈদেশিক সাহায্য দরকার। পুঁজিবাদী শ্রেণীশত্রুদের শরণাপন্ন হলেও সমস্যা নেই। তারা কম্যুনিস্ট হলেও সে আহ্বানে সাড়া দেয় পশ্চিমের নামীদামী প্রাইভেট কম্পানি — পশ্চিমা সরকাররা নয়, বরং সমাজতন্ত্রের জাতশত্রু প্রাইভেট অন্টরপ্রনররা! এসকল কম্পানির অন্তত ৭০ থেকে ৮০ ভাগই ছিল মার্কিন ধনকুবেরদের পরিচালিত।

ফ্রেডেরিক টেইলর, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইনজিনিয়ারিংএর জনক, কারখানার কর্মীর সাথে
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সটাইল মিলে “টেইলরাইজড” অ্যাসেম্বলি লাইন
টেইলরের প্রকৌশল ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের চিত্রীয় ব্যাখ্যা

বিস্তারিত বলার আগে লেনিন মার্কিন প্রযুক্তি, শ্রমদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা নিয়ে কতটা মন্ত্রমুগ্ধ ছিলেন সেটা না বললেই নয়। ফ্রেডরিক টেইলর নামে এক মার্কিন স্টীল কারখানার ফোরম্যান ও ইনজিনিয়ারিং ম্যানেজারের ভক্ত ছিলেন তিনি। এই টেইলর সাহেব কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রডাকশন ইনজিনিয়ারিংয়ের জনক হিসাবে স্বীকৃত। কারখানার একেকটি বড় কাজকে ছোট ছোট কাজে ভেঙে শ্রমিকদের দক্ষতা ও দ্রুততা বৃদ্ধির একটি প্রক্রিয়া টেইলর বের করেন। শ্রমজীবীদের নেতা লেনিন অদক্ষ শ্রমিকদের রোবটের মত মবিলাইজ ও ইউটিলাইজ করতে এরকম থিওরিই খুঁজছিলেন। তার বদ্ধমূল বিশ্বাস ছিল, বলশেভিক বিপ্লবকে শক্ত খুঁটিতে দাঁড়া করাতে প্রয়োজন এমন মার্কিন ধাঁচের উৎপাদনশীলতা। তবে সেখানে দক্ষ জনবল “লোভাতুর” পুঁজিবাদকে নয়, শক্তিশালী করবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে।

১৯১৭ থেকে ১৯২১ পর্যন্ত চালু “ওয়ার কম্যুনিজমের” ব্যাপক বিফলতার পর লেনিন চালু করেন “নিউ ইকনমিক পলিসি।” কারখানায় আবার অধিষ্ঠিত হয় ৎসারের আমলের প্রশিক্ষিত ম্যানেজার ও ইনজিনিয়াররা। ব্যক্তিপুঁজিকেও হালাল করা হয় কিছু খাতে। তবে ভারিশিল্প, তড়িত অবকাঠামো, আর পরিবহন ক্ষেত্র ছিল সরকারের একছত্র নিয়ন্ত্রণে। এসকল খাতেই নিয়ে আসা হল বাইরের অভিজ্ঞ প্রকৌশলী কন্ট্রাক্টরদের।

“দাও শিল্পায়ন” — সোভিয়েত পোস্টার, ত্রিশের দশক
সারা দেশে তড়িতায়নের সপক্ষে লেনিনের চিত্রসহ প্রপাগান্ডা পোস্টার, ১৯৩০
স্তালিনের চিত্রসম্বলিত প্রপাগান্ডা পোস্টারে সমাজতন্ত্রের বিজয় সুনিশ্চিত এ দাবির সাথে পাওয়ার প্ল্যান্টের ছবি, ১৯৩২

প্রথম বৃহদাকার যে প্রজেক্টটা শুরু হয় সেটি বর্তমান ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর জলপ্রপাতের ওপর বিশাল একটি বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। দ্নিপ্রোগেস নামের এই প্রকল্পের প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত করা হয় মার্কিন কর্নেল হিউ কুপারকে। তিনি ছিলেন টেনেসি ভ্যালীতে ১৯২৪ সালে সমাপ্ত দৈত্যাকার মাসল শোলস পানিবিদ্যুত প্রকল্পেরও প্রধান। সোভিয়েতরা দ্নিপ্রো নদীর ওপর এত বিশাল প্রজেক্ট শুরু করল যেটা মাসল শোলসকেও হার মানায়। অথচ রাশিয়াতে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। যেখানে মার্কিন পুঁজিবাদীরা শুরু করে ছোট থেকে, তারপর চাহিদা অনুযায়ী আয়তন বাড়ায়, সেখানে লেনিনের স্বপ্ন একবারে চাঁদে লাফ দেয়া। এ কারণে পরে সমস্যা তৈরি হয়। লোড-ব্যালেন্স ঠিকমত না হলে সবসময় লাভজনকভাবে এসকল প্ল্যান্ট চালানো যায় না।

ইউক্রেনের কসাকদের একসময়কার দুর্ভেদ্য দুর্গ দ্নিপ্রো নদীর প্রপাতে মাসল শোলসের আরো বড় কপি এই বাঁধ তৈরিতে সাহায্য করে অসংখ্য পশ্চিমা কম্পানি। জেনারেল ইলেক্ট্রিক বানায় পাঁচটি বিশালকায় জেনারেটর। নিউপোর্ট নিউজ শিপবিল্ডিং তৈরি করে নয়টি ৮৫,০০০ অশ্বশক্তির টারবাইন — সেসময় বিশ্বের সর্ববৃহৎ। জার্মান ও সুইডিশদের অংশগ্রহণ থাকলেও ৭০ শতাংশ যন্ত্রাংশ ছিল মার্কিন। স্টীম শভেল, ক্রেন, ট্রেন ইঞ্জিন, ড্রীল, কন্স্ট্রাকশন স্টীল — সবকিছু আসে আমেরিকা থেকে। পুরো সাইটটি দেখে এক পরিদর্শক এর নাম দিয়েছিলেন “লিটল আমেরিকা।”

ইউক্রেনের দ্নিপ্রো নদীর ওপর সেকালের সর্ববৃহৎ দ্নিপ্রো বাঁধ ও পানিবিদ্যুৎকেন্দ্র, ১৯৩২ সালে সম্পূর্ণ হয়
দ্নিপ্রো বাঁধ নির্মাণে তদারকি করছেন যুকরাষ্ট্রে মাসল শোলস বাঁধের প্রধান পরিচালক কর্নেল কুপার, ১৯৩২
আমেরিকার আলাবামা স্টেটের মাসল শোলস বাঁধ ও পানিবিদ্যুতকেন্দ্র, যেটি দ্নিপ্রোর মূল ডিজাইন

১৯৩২ সালে দ্নিপ্রোগেস চালু হয় লেনিনের নাম নিয়ে। সেসময়ে সেটি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ পানিবিদ্যুতকেন্দ্র। হাজার হাজার সোভিয়েত প্রকৌশলী এখানে কাজ করে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে, তা দিয়ে উন্নত বিশ্ব থেকে পঞ্চাশ বছরের প্রযুক্তিশিক্ষার গ্যাপ পুরো হয়ে যায়। ১৯১৩ সালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা রাশিয়ার ছিল, ১৯৩২ সালে সেটা বেড়ে হয় ৭ গুণ। সে বছরই হিউ কুপারকে স্তালিন রাশিয়ার সর্বোচ্চ সম্মাননা অর্ডার অফ দ্য রেড স্টার প্রদান করেন। কুপারই ছিলেন সে মেডেলের প্রাপক প্রথম বিদেশী।

১৯২৮ সাল নাগাদ রুশদের কাছে টেইলরের থেকেও অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অটোমোবাইল শিল্পের পথিকৃত শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড। ১৯২৬ নাগাদ রাশিয়ায় আমদানি হয় ২৫ হাজার ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর। ১৯২৭এ রাশিয়ায় ব্যবহৃত ট্রাক ও ট্র্যাক্টরের ৮৫ শতাংশই ছিল ফোর্ডের তৈরি। ১৯২৪এ যেখানে মোটে ১,০০০ ট্র্যাক্টর ছিল রাশিয়ায়, সেখানে ১৯৩৪এর সংখ্যাটা ২ লাখ, অধিকাংশ তৈরি যুক্তরাষ্ট্রে। রাশিয়ার একাধিক গ্রামের নামকরণ হয় ফোর্ডসন নামে। ত্রতস্কির ভাষ্যে “দেশের প্রগতিশীল কৃষক সমাজের মুখে সবচেয়ে জনপ্রিয় নাম ফোর্ডসন।”

মডেল টি মোটরগাড়ীর সাথে মার্কিন শিল্পপতি হেনরি ফোর্ড
ডেট্রয়েট নদীর পাশে রিভার রুজে বিশাল একটি ফোর্ড মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট তৈরি হয় ১৯১৭ থেকে ১৯২৮এর মধ্যে, সোভিয়েত বহু প্রজেক্ট একে নকল করে
ফোর্ড প্ল্যান্টের অ্যাসেম্বলি লাইনে কর্মীদের চিত্র

ফোর্ডের লক্ষ্য যেমন ছিল সস্তায় অ্যাসেম্বলি লাইন প্রডাকশন আর মাস কনজামশন, সেই একই লক্ষ্যে সোভিয়েত সরকার ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির প্রকল্প হাতে নেয়। স্তালিনগ্রাদের একটি বিশাল ফ্যাক্টরির পরিকল্পনা দেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান। মস্কোতে তার অফিসে কার্যরত ছিল ২৫ মার্কিনের পাশাপাশি ৪,০০০ পর্যন্ত রুশ প্রকৌশলী। তার কম্পানি ডিজাইন করে কমপক্ষে ৫০০টি রুশ প্রকল্প। স্তালিনগ্রাদের কারখানাটি পুরো তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রে, তারপর পার্ট বাই পার্ট স্তালিনগ্রাদে নিয়ে এসে পুনর্বিন্যস্ত করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টার নামের মার্কিন কম্পানি থেকেও আসে উপদেষ্টার দল। কাল্ডার নামে মার্কিন প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ মার্কিন কর্মচারীর সহায়তায় ১৯৩০ সালে প্ল্যান্টটি উৎপাদন শুরু করে। কাল্ডার চেলিয়াবিনস্কেও আরেকটি ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট তৈরির নেতৃত্বে ছিলেন। ১৯৩৩ সালে সেটি স্তালিনেতস নামে মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি ট্র্যাক্টর তৈরি শুরু করে। এ সবের রয়্যাল্টি বাবদ কোন অর্থ মার্কিন পেটেন্ট হোল্ডারদের সোভিয়েত সরকার দেয়নি। লেনিনগ্রাদ ও খারকভেও ইন্টারন্যাশনাল হারভেস্টারের কপি বানানোর প্ল্যান্ট গড়ে ওঠে।

রাশিয়ায় ফোর্ড কম্পানির অফিস
মিশিগানের ফোর্ড ফ্যাক্টরিতে তৈরি হচ্ছে ফোর্ডসন ট্র্যাক্টর, যেগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নে রপ্তানি হত।
১৯২৯ সালে রাশিয়ায় মোটরগাড়ির প্ল্যান্ট বানানোর চুক্তি সইয়ের পর সোভিয়েত প্রতিনিধিদের সাথে হেনরি ফোর্ড

অশিক্ষিত চাষীদের ট্র্যাক্টর চালানোতে পারদর্শী করতেও প্রশিক্ষকদল আমেরিকা থেকে আসে। আবাদী জমির যৌথখামারীকরণের স্তালিনী পরিকল্পনায় মার্কিন ট্র্যাক্টর পালন করে অনস্বীকার্য অবদান।

ট্র্যাক্টরের পাশাপাশি মোটরগাড়িরও চাহিদা তৈরি হয় সোভিয়েত নগরগুলিতে। ফোর্ড কম্পানির সাথে স্তালিন সরকার চুক্তি করে নিঝনি নভগোরদ শহরে একটি বিশাল কারখানা বানানোর। মিশিগানের রিভার রুজের বিশাল ফোর্ড কারখানার আদলে এর পরিকল্পনা হয়। অস্টিন কম্পানিও আরেকটি গাড়ির কারখানার চুক্তি করে। আলবার্ট কান পরিকল্পনা দেন মস্কোর একটি কারখানারও।

এসব কারখানায় মার্কিন যন্ত্রাংশ অ্যাসেম্বল করে তৈরি হয় মার্কিন মডেলের কপি মোটরগাড়ি। শত শত মার্কিন প্রকৌশলীর সাথে তথ্য ও অভিজ্ঞতা আদানপ্রদান হয় সোভিয়েত প্রকৌশলীদের। নিঝনি নভগোরদের প্ল্যান্ট যখন ১৯৩০এ শুরু হয়, তখন সোভিয়েতরা ষড় করে মার্কিন প্রকল্প পরিচালককে দুই মাসের বিলাসবহুল ছুটিতে কৃষ্ণসাগর উপকূলে পাঠিয়ে দেয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ছাড়া সোভিয়েত প্রকৌশলীরা প্ল্যান্ট চালাতে পারছে কিনা, সেটা পরীক্ষা করে দেখা।

রাশিয়ায় বিশের দশকে জনপ্রিয় ছিল এই ফোর্ডসন ট্র্যাক্টরের নাম
১৯৩২ সালে সোভিয়েত সরকারে সাথে চুক্তি সই করেন মার্কিন স্থপতি আলবার্ট কান
আলবার্ট কানের তৈরি স্তালিনগ্রাদ ট্র্যাক্টর প্ল্যান্ট

১৯৩২ সালে যখন ফোর্ড মডেল এ উৎপাদন শুরু হয়, তখন ধীরে ধীরে সোভিয়েতরা মার্কিন ম্যানেজারদের সরিয়ে সে জায়গায় বসায় তাদের সোভিয়েত সহকারীদের। এভাবে সম্পূর্ণ হয় এক অভাবনীয় আকারের টেক ট্রান্সফার। সেবছর থেকে মার্কিন ট্র্যাক্টর আমদানি বন্ধ করে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন, ১৯৩৪ থেকে নিজেরাই সেটা রপ্তানি শুরু করে বিশ্বের অন্যত্র। আর নিঝনি নভগোরদের সেই কারখানায় বানানো ক্যাপাসিটির মোটে অর্ধেক বিক্রি হওয়ায় ফোর্ড কম্পানি ক্ষতির মুখে পড়ে যায়। (সাউন্ডস ফ্যামিলিয়ার?!)

শুধু মোটরগাড়ি, ট্রাক, ট্র্যাক্টর ও বিদ্যুৎ নয়, ধাতব ও ভারিশিল্পেও মার্কিনদের পুরোপুরি কপি করে সোভিয়েতরা। ইন্ডিয়ানার গ্যারী শহরের স্টীল মিলের আদলে উরাল পর্বতের মাগনিতোগোরস্কে তৈরি হয় বিশাল এক কমপ্লেক্স। এই মহাপ্রকল্পের কন্ট্রাক্টর ছিল মার্কিন ম্যাককী কম্পানি। লৌহআকরিক পরিশোধনের জন্য ৮টি ১,৫০০ টন ব্লাস্ট ফার্নেস সরবরাহ করে ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিং নামে মার্কিন ফার্ম। একই ফার্ম কুজনেতস্কের একটি আয়নওয়ার্কস তৈরিতেও সাহায্য করে। মাগনিতোগোরস্কে ৩টি রোলিং মিল তৈরি করে দেয় জার্মান একটি কম্পানি। ৩টি বেসেমার কনভার্টার ও ৪৫টি কোক ওভেন আসে মার্কিন ফার্ম কপার্স এন্ড কম্পানি থেকে। সোভিয়েতদের দায়িত্বে ছিল কেবল নিম্নপ্রযুক্তির ২৮টি ওপেন হার্থ ফার্নেস, পরিবহনব্যবস্থা আর পানিসরবরাহব্যবস্থা।

মার্কিন ক্যাটারপিলারের কপি রুশনির্মিত স্তালিনেতস ট্র্যাক্টর
নিঝনি নভগোরদ, বর্তমান গোর্কি, শহরে নির্মিত ট্রাক ও মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি
সোভিয়েত প্রপাগান্ডা পোস্টারে কর্মীদের উত্সাহিত করা হচ্ছে ৮০ লাখ টন ধাতব অ্যালয় তৈরির লক্ষ্যে, ১৯৩১

এই বিশাল কমপ্লেক্সে থাকার জন্য অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নকশা তৈরি করে দেন জার্মান স্থপতি এর্নস্ট মে। গোটা রাশিয়া থেকে অদক্ষ শ্রমিক, ক্ষুধার্ত চাষীর দল, সাইবেরিয়ার ভবঘুরে আর যৌথখামার থেকে পলাতক পরিবারের স্থান হয় এখানে। গমগম করতে থাকে উরালের বিরানভূমি।

১৯৩৪ থেকে এই কম্প্লেক্সের দায়িত্ব ধীরে ধীরে হস্তান্তরিত হয় সোভিয়েত ম্যানেজারদের হাতে। বিদেশী ম্যানেজারদের দোষারোপ করা হয় যে তারা সে কাজে ধীরতা দেখাচ্ছে। তরুণ সোভিয়েত প্রকৌশলীরা বিদেশীদের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিদেশী গ্রেডের বেতনের চাকরি দখল করতেই মুখিয়ে ছিল।

মাগনিতোগোর্স্ক যখন শতভাগ কাজ শুরু করে আরো কয়েক বছর পর, তখন এখানে উৎপন্ন স্টীল ছিল চেকোস্লোভাকিয়া, ইতালি আর পোল্যান্ড সকলের উৎপাদনের চেয়েও বেশি। শুধু স্টীল নয়, এর আশপাশে ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য, প্লাটিনাম, তামা, নিকেল, দস্তা আর অ্যালুমিনামেরও খনি। এই বিশাল কম্প্লেক্সের নাম দেয়া হয় উরাল-কুজনেতস্ক-কম্বিনাত। এখান থেকে বেরিয়ে রাশিয়ার শিল্পায়িত শহরগুলিতে যেত ভারি অস্ত্র, ট্র্যাক্টর, রেলওয়ে কার, পরিশোধিত তেল, কয়লা।

মার্কিন অস্টিন কম্পানির ডিজাইন করা নিঝনি নভগোরদের মোটরগাড়ির ফ্যাক্টরি কমপ্লেক্স
মাগনিতোগর্স্কের স্টীল সিটিতে মার্কিন ফ্রেইন ইনজিনিয়ারিংয়ের করে দেয়া ব্লাস্ট ফার্নেস প্ল্যান্ট, ত্রিশের দশক
জার্মান স্থপতি এর্ন্সট মে’র পরিকল্পিত মাগনিতোগর্সকের কর্মীদের জন্য অ্যাপার্টমেন্ট, ত্রিশের দশক

মার্কিন ম্যানেজমেন্ট ব্যবস্থা যে শুধু শিল্পক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে তা নয়। রেড আর্মিকে সুসংহত করতে ত্রতস্কিও টেইলরিজমের শরণাপন্ন হন। লালবাহিনীর কঠিন সময়টাতে তার পাশে ছিল কেলী নামে এক মার্কিন প্রকৌশলী। অস্ত্র কারখানাগুলির উৎপাদনদক্ষতা বাড়াতে তিনি সাহায্য করেন।

আর সোভিয়েত সোশালিস্ট রিয়েলিজম শিল্পশৈলীর জন্মও এ সময়ে। গুস্তেভ নামে এক কবি সৈনিক-শ্রমিকের একটা পূজনীয় ইমেজ তৈরি করেন। সেই ইমেজে যন্ত্রের সাথে পেশী মিলিয়ে মানুষ হয়েছে অদম্য — ঈশ্বরেরও অধিক কিছু। গুস্তেভ জিনভিয়েভদের মত লেখকদের কল্পনায় জন্ম হয়েছিল নতুন এক মানবপ্রজাতির — হোমো সোভিয়েতিকাস। তবে, পেশীর সাথে সংযুক্ত যন্ত্রশক্তির এনেবলাররা হোমো সোভিয়েতিকাস নন, হোমো আমেরিকানাস! এবং যেনতেন আমেরিকান নন, পুঁজিবাদী শিল্পপতি আমেরিকান।

আর ইতিহাসের এই দ্রুততম টেক ট্রান্সফারের কাহিনী আজকের রুশ তো বাদ দিলাম, খোদ মার্কিনদেরই মনে নেই!

সোশালিস্ট রিয়েলিজম ধাঁচের উদাহরণ, কারখানা শ্রমিক ও যৌথখামারের নারী, তৈরি ১৯৩৭এ, মস্কো

সাইবেরিয়ার সোনার ট্রেন

সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদ বিশ্বের সবচে গভীর, সবচে প্রাচীন। আর এ হ্রদের গভীরেই হয়ত লুকিয়ে রয়েছে বিগত শতকের রোমাঞ্চকর এক রহস্যের উত্তর। রহস্যটিকে অনেকে রঙচঙে নাম দিয়েছে ‘ৎসারের হারানো স্বর্ণরাজি’, আবার আরেক নাম ‘কলচাকের সোনা’।

লেক বৈকালের তীর ঘেঁষে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একাংশ, যার নাম সারকাম-বৈকাল লাইন।

বৈকালের তীরের ইরকুতস্ক শহরের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, হ্রদের তলদেশে একটি সোনাভর্তি ট্রেনের কার রয়েছে। বৈকালের ধারঘেঁষা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একাংশ থেকে নাকি ছিঁটকে এটি পড়ে গেছিল ১৯২০ সালে। ২০১০এ একটি সাবমেরিন নাকি অনুসন্ধান চালিয়ে একটি বগি পায়, কিন্তু গভীর পানির নিচ থেকে সোনা কিংবা অন্য কোন বস্তু উদ্ধারের সক্ষমতা না থাকায় রহস্য রহস্যই থেকে গেছে।

এ পোস্টারে রাশিয়ার ম্যাপে বৈকাল হ্রদের অবস্থানের পাশাপাশি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

বিংশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের আগে রুশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার ছিল তৃতীয় বৃহত্তম। ব্রিটেন-ফ্রান্সের পরপরই তার স্থান। কিন্তু এই দেশ দুটির যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, রাশিয়ার তা ছিল না। দাম্ভিক সম্রাটদের খায়েশে চলা দেশটিতে জনসাধারণের এক বিশাল অংশ ছিল ভূমিদাস। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে সংস্কারায়নের ফলে শিল্পের অগ্রগতি হয়। কিন্তু তার সাথে যে দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনগুলো আসে, তাকে সামাল দেবার যোগ্যতা পুরনো ঘরানার শাসনপদ্ধতিতে সম্ভব ছিল না।

তার ওপর একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার এলাকাবিস্তার চলতে থাকে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি তুরস্ক-ইরান থেকে খাবলা মেরে বিশাল রাজত্বের মালিক হন ৎসারেরা। তারপর চীন-মাঞ্চুরিয়া-সাইবেরিয়ার দিকেও নজর পড়ে তাদের। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে বাঁধা আসে নতুন এক শক্তিশালী দেশের কাছে থেকে। ১৯০৫ সালে রুশদের যুদ্ধে হারিয়ে বাকি বিশ্বকে তাঁক লাগিয়ে দিয়ে সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আধুনিক জাপান।

একই বছরে রাশিয়াতে রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। ৎসারের রক্ষীবাহিনী রাজধানী পিয়েত্রোগ্রাদে প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালালে সারাদেশে আগুন জ্বলে ওঠে। ‘স্বৈরাচারী’ ৎসার নিকোলাস নির্বাচন, সংসদ ও সংবিধান প্রনয়ণের দাবির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন।

এভাবে দেখতে দেখতে চলে আসে ১৯১৪ সাল। সুপার পাওয়ারগুলি যে সেকেলে ব্যালান্স অব পাওয়ারের মাধ্যমে বিশ্বে তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজিয়ে রেখেছিল, তার একিলিস হীলে আঘাত আসে। সার্বিয়ান এক জাতীয়তাবাদীর গুলিতে অস্ট্রিয়া-হাঙেরির যুবরাজ সপত্নীক নিহত হলে সারা ইউরোপের দেশগুলি দু’দলে ভাগ হয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু করে।

বলা বাহুল্য, রাশিয়ার সম্রাট যুদ্ধজয় নিয়ে আশাবাদী হলেও ভেতরে ভেতরে তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে আসছিল। জার্মান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে হার মেনে দেশের পশ্চিম ভাগের বিশাল এলাকা থেকে সরে আসতে হয় রুশ বাহিনীকে। পুরো সৈন্যদলের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অরাজকতা, পলায়নপ্রবৃত্তি। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরা জড়ো হয় বড় শহরগুলিতে। হাত মেলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সাথে। সে দলগুলিও একেকটি একেক রকম। কেউ শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কেউ সংসদীয় গণতন্ত্রে। কিন্তু বামপন্থী সোশাল-রেভলুশনারী (এসআর) পার্টির — লেনিনের বলশেভিক নয় — যে পরিমাণ সমর্থন ছিল তেমনটা আর কারো ছিল না।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যুদ্ধচলাকালীন সময়েই বিপ্লবের মুখে ৎসার নিকোলাস পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রের শাসনভার প্রথমে আসে প্রিন্স ল্ভভের হাতে, তারপর এসআর পার্টির নেতা আলেকজান্ডার কেরেনস্কির কাছে। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করার কোন চিন্তাভাবনা এ সরকারের ছিল না। বড় শহরগুলির অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যাগুলির দিকে নজর দেবার মত সক্ষমতাও ছিল না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সমাজতান্ত্রিক কট্টরপন্থী বলশেভিক পার্টি ও অন্যান্যরা। জার্মান সরকারও আগুনে কেরোসিন ঢালার জন্যে সময়মত এক গোপন ট্রেনে করে লেনিনকে সেন্ট পিটার্সবার্গে পাচার করে দেয়। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় আরেকটি বিপ্লব — মতান্তরে কু’য়ের।

সোনার কাহিনীর শুরু বলা যেতে পারে এখানে। আসন্ন অস্থিতিশীলতার আঁচ পেয়ে নতুন রুশ সরকার প্রায় পাঁচশ টন ডবল-ঈগলছাঁপমারা সোনার বার ট্রেনে করে পূর্বে উরাল পর্বতের নিকটবর্তী কাজান শহরে পাঠিয়ে দেয়। অক্টোবর বিপ্লবের পর লেনিনের সহকর্মী ত্রতস্কি গঠন করেন লালবাহিনী। হাতে গোনা যে কটি শহর তখন বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ‘শত্রু’ শ্বেতবাহিনীকে উৎখাত করা ছিল তাদের কাজ। আর যার হাতে ৎসারের সোনা পড়বে শেষ পর্যন্ত, এই নিরন্তর গৃহযুদ্ধে তাদেরই জয় অবশ্যম্ভাবী।

ঘর সামলানোর যুদ্ধে মনোনিবেশের জন্যে বলশেভিকরা জার্মানির সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৭তে। পশ্চিম রাশিয়ার বিশাল এক এলাকা ছেড়ে দেয় তারা। ৎসারের পক্ষে লড়া স্বেচ্ছাসেবক চেক ও পোলিশ সৈন্যরা পড়ে যায় মহাবিপদে। তাদের ইচ্ছে ছিল চলমান যুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে পূর্ব ফ্রন্ট থেকে ফ্রান্সের পশ্চিম ফ্রন্টে যাবার।

চেক সেনাদল বিশাল ট্রেনবহর নিয়ে পাঁচ হাজার মাইল পূর্বে ভ্লাদিভস্তকের দিকে যাত্রা শুরু করে। এদের রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা আগের একটা লেখায় বলেছি। কাজান শহরে লালসেনারা ঘেরাও বসালে তাদেরকে হারাতে শ্বেতদের সাহায্য করে চেকরা। ঘেরাওয়ের ফাঁক গলে সোনার ট্রেন গায়েব হয়ে যায় আরো পূর্বে ইরকুতস্ক শহরে। কাজানে এসে ত্রতস্কি পান শূন্য খাজাঞ্চিখানা।

যারা রাশিয়া সম্পর্কে কিছুটাও জানেন তারা হয়ত ট্রান্সসাইবেরিয়ান রেলওয়ের কথা শুনে থাকবেন। পশ্চিমে পেত্রোগ্রাদ থেকে শুরু করে পূর্বে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ৫,৭০০ মাইল দীর্ঘ এই রেললাইন বিশাল দেশটির নাড়ি বললে ভুল হবে না। সাইবেরিয়ার খনিজ সম্পদ আর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির ওপর মাতবরি ফলাতে হলে এ রেললাইনের নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যাবশ্যক। মজার ব্যাপার হলো, রুশ গৃহযুদ্ধের অধিকাংশ সময় শ্বেত-লোহিত কোন রুশের হাতেই এ রেলপথের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ছিল আটকেপড়া চেক স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদলের হাতে। তারা স্বদেশের স্বাধীনতার আশায় অস্ট্রিয়া-হাঙেরির বিরুদ্ধে রুশদের পক্ষে যুদ্ধে শরিক হয়।

এই রেলবিচ্ছিন্নতার সুযোগে সাইবেরিয়ার ওমস্কে বলশেভিকবিরোধীরা কিছুটা স্থিতিশীল পাল্টা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। প্রথমদিকে এ সরকারে বামপন্থী এসআর যেমন ছিল, তেমন ছিল ৎসারের প্রচ্ছন্ন সমর্থক গোষ্ঠী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯১৮তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন ৎসারের নৌবাহিনীর এডমিরাল আলিয়েকসান্দর কলচাক।

রুশদের হয়ে উত্তরমেরু অভিযানে অংশ নিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন ৪৫ বছরবয়েসী এই নৌ অফিসার। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত ও বন্দী হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মান নৌবাহিনীকে রুখতে বাল্টিক সাগরে সামুদ্রিক মাইন স্থাপন অভিযানের সফলতাও ছিল তাঁর কৃতিত্ব। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় কৃষ্ণসাগরের তুর্কী অভিযান থেকে অব্যাহতি পান। পিয়েত্রোগ্রাদে গিয়ে কেরেনস্কিকে নৌসেনাদের নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি অবহিত করেন। তাঁর সুপারিশ ছিল, সশস্ত্র বাহিনীতে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি পুর্নবহাল করার। কেরেন্সকি সে উপদেশ শুধু যে অগ্রাহ্য করেন তা নয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ভয়ে কলচাককে যুক্তরাজ্যে একটি অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়ে দেন।

অক্টোবর বিপ্লব যখন শুরু হয়, তখন কলচাক যুক্তরাষ্ট্র হয়ে জাপানে। সেখান থেকে ভ্লাদিভস্তক হয়ে সোজা সাইবেরিয়া চলে যান তিনি। বলশেভিকবিরোধী বাহিনীগুলির একটির নিয়ন্ত্রণ নেন। সাইবেরিয়ায় কলচাকের পাশাপাশি ফিনল্যান্ড-এস্তোনিয়াতে ইউদেনিচ, ইউক্রেনে দেনিকিন-ভ্রাঙেল প্রমুখ ছিলেন শ্বেতবাহিনীর নেতৃত্বে। এদের পরস্পরের মধ্যে পারতপক্ষে যোগাযোগ ও সামঞ্জস্য না থাকায় ত্রতস্কির লালবাহিনী ক্রমে একে একে এদেরকে হারাতে সক্ষম হয়।

দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে দেনিকিনের অধীনস্থ শ্বেত বাহিনীর ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯১৯।
রাশিয়ায় আটকে পড়া চেক সৈন্যরা সুসংগঠিত ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রিত সাইবেরিয়ান রেলপথে একটি ছোটখাট রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সেখানে চালু ছিল এ ডাকটিকেট (১৯১৯)।
দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে দেনিকিনের অধীনস্থ শ্বেত বাহিনীর ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯১৯।
উত্তর-পশ্চিম রাশিয়ার বাল্টিক উপকূল, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়াতে জেনারেল ইউদেনিচের নেতৃত্বাধীন শ্বেতবাহিনি এ ডাকটিকেট ব্যবহার করে, ১৯১৯।
কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনী ছিল ৎসারের অনুগত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ভ্রাঙেল। তাদের ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯২১।

১৯১৮তে ওমস্কে প্রভিশনাল অল-রাশিয়ান গভার্নমেন্টের শাসনভার দখল করেন কলচাক। এর মাসদুয়েক আগে ৎসার নিকোলাস সপরিবারে বলশেভিকদের হাতে নিহত হন। তাই বলশেভিকবিরোধী সমগ্র রাশিয়ার ‘সুপ্রীম লীডার’ হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করতে কোন সমস্যা হয়নি কলচাকের।

ভাইস-অ্যাডমিরাল আলিয়েকসান্দর ভাসিলিয়েভিচ কলচাক, ১৯১৬।

একটা কথা আছে, অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টদের জন্যে কথাটি যতটা সত্য, কলচাকের জন্যেও ততটা। ক্ষমতা দখল করলেও সফল রাজনীতিবিদের যে দূরদর্শিতা ও সমঝোতার গুণ দরকার, তা দেশপ্রেমী কলচাকের ছিল না। প্রথমেই বামপন্থী শরিকদল এসআর সদস্যদের সরকার থেকে পদচ্যুত করেন। এসআর পার্টির একটি ব্যর্থ পাল্টা কুয়ের পর দলটির পাঁচশ সদস্যকে হত্যা করে কলচাকের অধীনস্থ কসাক সেনাদল।

যে চেক লেজিয়ন কলচাকের কাছে সোনার ট্রেন এনে দিয়েছিল, তারাও কলচাকের স্বেচ্ছাচারে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধও ১৯১৯এ শেষ। নতুন রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার ততদিনে গোড়াপত্তন হয়েছে। রুশদের রক্তাক্ত অন্তর্ঘাতে অংশ নেবার পরিবর্তে স্বদেশপ্রত্যাবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে চেকদের মূল লক্ষ্য।

কলচাকের তাঁড়িয়ে দেয়া এসআর পার্টিও ততদিনে লালবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে। ত্রতস্কির সৈন্যরা সমানে ধেঁয়ে আসছে সাইবেরিয়ার আরো অভ্যন্তরে। এসআর পার্টির সাথে চেকরা ১৯২০এ গোপনে রফা করে যে পূর্বে নির্বিঘ্ন যাত্রা ও রেলরসদের বিনিময়ে কলচাক, তাঁর প্রধানমন্ত্রী আর সোনার ট্রেনবহর তুলে দেয়া হবে তাদের হাতে। কলচাক চেকদের ফাঁদে পা দিলেন। এসআর পার্টি তাঁকে কদিন বন্দী করে রাখে। তারপর বলশেভিকরা ইরকুতস্কের নিয়ন্ত্রণ নিলে কলচাক আর প্রধানমন্ত্রী পেলিয়ায়েভকে জনতার শত্রু আখ্যা দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড দেয়।

ইরকুতস্ক শহরে অ্যাডমিরাল কলচাকের স্মৃতিসৌধ।

ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র-জাপান ও অন্যান্য সকল সুপারপাওয়ারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কলচাকের সাইবেরীয় সরকারের এমন পতন হয়। যুক্তরাজ্যের চার্চিল তাঁর সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন, পারেননি প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনের কারণে। কেরেনস্কি ততদিনে উইলসনের রুশবিষয়ক উপদেষ্টা। তাঁর প্ররোচনায় উইলসন ভেবেছিলেন কলচাক ৎসারপন্থী ও স্বৈরাচারী। মতবিরোধীদের নির্বিচারে হত্যা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবিধানের বিরোধিতা, আর কলচাকের নাম নিয়ে অপমানসূচক কিছু বলা যাবে না — এধরনের আইনের কারণেও সরাসরি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয় কলচাকের সরকার।

কলচাক পদত্যাগের আগে ইউক্রেনের শ্বেতরুশবাহিনীপ্রধান দেনিকিনকে সুপ্রীম লীডার ঘোষণা করে যান। সাইবেরীয় শ্বেতবাহিনী ইরকুতস্ক থেকে বিশাল এক লম্বা যাত্রা শুরু করে ভ্লাদিভস্তকের দিকে। সে ছিল এক বিচিত্র কাফেলা। চেক সৈন্যরা ছিল তার রক্ষক। রুশ সাম্রাজ্যের বহু অভিজাত যারা সময়মত টের পেয়েছিল বলশেভিক মানেই বিপদ, তারাও তাদের অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে এসকল সৈন্যদের ঘুষ দিয়ে তাদের সহযাত্রী। এই গ্রেট সাইবেরিয়ান আইস মার্চ প্রথমে ইরকুতস্ক থেকে চিতা, তারপর চিতা থেকে মাঞ্চুরিয়ার পোর্ট আর্থার আর কামচাতকা উপদ্বীপের ভ্লাদিভস্তক গিয়ে পৌঁছে ১৯২১ সাল নাগাদ। তারপর সেখান থেকে জাহাজ নিয়ে কেউ জাপান, কেউ আমেরিকা হয়ে ইউরোপে পৌঁছে। পথিমধ্যে ক্ষুধায়, ঠান্ডায়, ক্লান্তিতে, রোগজরায় প্রাণ হারায় অগণিত সৈন্য। এদের মধ্যে ছিলেন দলনেতা জেনারেল কাপেলও।

চিত্রশিল্পীর কল্পনায় জেনারেল কাপেলের নেতৃত্বে গ্রেট সাইবেরিয়ান আইস মার্চ, ১৯১৯।

সেই সোনাগুলির কি হল? চেকরা সে ট্রেনগুলোর সবই কি বলশেভিকদের হাতে তুলে দিয়েছিল? নাকি চালাকি করে দু’তিনটে জুড়ে নিয়েছিল নিজেদের পূবমুখী কাফেলার সাথে? লোককাহিনী তাই বলে। সেই ট্রেনবহরের একটিই নাকি দুর্ঘটনাক্রমে ছিঁটকে পড়ে গেছিল বৈকাল হ্রদের মধ্যে। বাপ-দাদাদের মুখে অন্তত তাই শুনে এসেছে ইরকুতস্কবাসী। আবার আরেক আঞ্চলিক গল্প অনুযায়ী, কলচাকই নাকি ধরা পড়ার আগে কয়েকটি ট্রেনের বগি উত্তরের পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। আর তারপর সেসব সৈন্যদের সেখানেই গুলি করে মারে তাঁর বিশ্বস্ত অফিসাররা।

সাইবেরিয়ার কলচাক সরকারের স্বেচ্ছাসেবক শ্বেতরক্ষী বাহিনী, ১৯১৯।

আধুনিক যুগে এধরনের গালগল্প এখনো চলে সাইবেরিয়াতে। শাসক-শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়, কিন্তু সত্যটা কখনোই বেরোয় না এদেশে। যা বেরোয়, তা কেবল প্রপাগান্ডা। জনগণও জানে সে কথা। তাই লোকমুখে যা চলে, তাই সত্য এখানে। তাই বৈকালের মাইলগভীর পানিতে, কিংবা ঘন সাইবেরিয়ান পাইন-সীডার-বার্চের জঙ্গলে এখনো মানুষ খুঁজে ফেরে ৎসারের হারানো স্বর্ণরাজি। খুঁজতে গিয়ে হারিয়েও যায় অনেকে। ধনভান্ডারের গল্পে এসে তখন যুক্ত হয় দুর্ভাগা অ্যাডমিরাল কলচাকের প্রেতাত্মার অভিশাপ।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!