আধুনিক জাতিরাষ্ট্র

যখন ছোট ছিলাম, তখনকার দুটো ভূরাজনৈতিক ঘটনা আমাদের প্রজন্মের স্মৃতিপটে গেঁথে আছে। এক, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তিকরণ ও তার জায়গায় একসাথে পনেরটি নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উৎপত্তি। দুই, সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাকী সেনাবাহিনীর কুয়েত আক্রমণ ও অ্যানেক্সেশন।

ছোটবেলায় তাই মনে একটা প্রশ্ন ছিল, একটা দেশ দেশ হয় কিভাবে? স্কুলের বইপুস্তক থেকে শেখা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ছিল সে প্রশ্নের তখন জানা একমাত্র উত্তর। কিভাবে পনেরটি দেশ যুদ্ধ ছাড়া হুঁট করে স্বাধীন হয়ে গেল, কিংবা কেন একটি বড় দেশ যুদ্ধ ঘোষণা করে আরেকটি ছোট দেশের স্বাধীনতা হরণ করে নিল, সে সব ছিল জানা উত্তরের বিপরীত। এসব নিয়ে জানতে বুঝতে উইকিপিডিয়ায় লেজুড় ধরে ধরে একের পর এক আর্টিকেল পড়ার মত পরবর্তী দশ বছরে পড়ে ফেললাম পুরো সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া, কম্যুনিজম, মার্ক্সিজম প্রভৃতির ইতিহাস। আমার খোঁজা উত্তরটা কিন্তু অন্য কোথাও।

একটি রাষ্ট্র কিভাবে রাষ্ট্র হিসাবে আবির্ভূত হয়? এটা আসলে একটা ক্লাবে ঢোকার মত। এক্সক্লুজিভ ক্লাব। চাইলেই আমি আপনি নিজেদের প্রাইভেটলি ওনড জায়গাজমি নিয়ে নতুন একটা স্বাধীন দেশ ঘোষণা করলাম, আর অন্যান্য সকল রাষ্ট্র আমাদের বাহবা দিয়ে তাদের ক্লাবে ঢুকিয়ে নেবে, এ এত সহজ নয়।

বর্তমান রাষ্ট্রের সংজ্ঞা ইউরোপ থেকে আগত — আপনি যতই সে সংজ্ঞাকে “ঔপনিবেশিক” বলে গালি দেন না কেন, আপনি সে সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত একটি রাষ্ট্রেই বসবাস করছেন। এটা‌ই বাস্তবতা। আর এ সংজ্ঞাটা যথেষ্ট কার্যকর।

ইউরোপের আধুনিক রাষ্ট্র সংজ্ঞার পেছনে প্রচুর রক্তপাতের ইতিহাস আছে। ঊনবিংশ শতকের শুরুর ভাগে নাপোলেওঁ বোনাপার্ত সমগ্র ইউরোপের মানচিত্র তছনছ করে ফেলেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে নামমাত্র রাষ্ট্র বানিয়ে দেন তিনি, সেগুলির মাথায় ছিল তার পরিবারের কোন না কোন সদস্য। ১৮১৫তে নাপোলেওনের পরাজয়ের পর মানচিত্র আগের জায়গায় ফিরে যায়। কিন্তু নাপোলেওনের সময়ের বিপ্লবী চিন্তাধারণাটা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে রয়ে যায়। প্রচুর রাষ্ট্রনীতিবিদ ও দার্শনিক রাষ্ট্রের বিভিন্ন যুক্তিসংগত সংজ্ঞা দিতে শুরু করেন, বাস্তব অবস্থাটা যেমনই হোক না কেন। জাতীয়তাবাদী দর্শনগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তারপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ বিপর্যয় আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আরও ব্যাপক মারণযজ্ঞের পরই ইউরোপ তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ একটা সময় পায় রাষ্ট্রের ক্রমাগত রিফাইনড ডেফিনিশনের কারণে। সে ইতিহাস এখনো চলমান।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ইউরোপে রাষ্ট্র গঠনের পেছনে ছিল সাম্রাজ্যের ধারণা। সেখানে জোর যার মুলুক তার। সকল রাজ্যের সীমানা নির্ধারিত হবে বড় সাম্রাজ্যগুলির ক্লাবে আলোচনার মাধ্যমে। এ ধরনের ভূরাজনীতির কারণেই অটোমান তুর্কী সাম্রাজ্য বহু দশক দুর্বলতায় ভুগেও বেঁচে থাকে। এক একটি সাম্রাজ্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সমন্বয়ে সংগঠিত, যার নেতৃত্বে একটি সংখ্যাগুরু জাতির একনায়কতন্ত্রী বা গণতান্ত্রিক শাসক অধিষ্ঠিত। এক সাম্রাজ্য ‌অন্য সাম্রাজ্যের সাথে নানা রকম প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ। তার অন্তর্গত জাতিগোষ্ঠীগুলির ইচ্ছা ও অধিকার সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের কাছে গৌণ।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মূল কারণ বড় সাম্রাজ্যগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতা। কলোনি, রিসোর্স, কৌশলগত এলাকার দখল প্রভৃতি নিয়ে। যুদ্ধপরবর্তী পরাজিত বিধ্বস্ত দেশগুলির ভাগ্য নির্ধারণের একটা মূলমন্ত্র ছিল ন্যাশনাল সেল্ফ-ডিটারমিনেশন। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি উডরো উইলসনের চৌদ্দ দফা এই মূলমন্ত্রের ধারক।

ইউরোপের বড় দুটি সাম্রাজ্য জার্মানি ও অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরির দ্বিতীয়টি ছিল বহু জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত। সেটিকে ভেঙে বহু জাতিগত সীমানা নির্ধারিত হয়। ইউগোস্লাভিয়া গড়ে ওঠে তাদের থেকে অধিকৃত এলাকাকে সার্বিয়া-মন্টেনেগ্রোর সাথে যুক্ত করে। কিছু এলাকা পায় রোমানিয়া-ইতালিও। চেকোস্লোভাকিয়া-পোল্যান্ড বহু শতক পর আবার স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে।

ওদিকে রুশ সাম্রাজ্য মিত্রশক্তির সদস্য হলেও বলশেভিক বিপ্লবের ডামাডোলে তারা অক্ষশক্তির সাথে আলাদা শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। তাদের আত্মসমর্পণ থেকেও কিছু স্থায়ী ও ক্ষণস্থায়ী রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। বাল্টিকের দেশগুলি, ককেশাসের তিনটি দেশ, আর ইউক্রেন-বেলারুশ বিভিন্ন মেয়াদে স্বাধীন থাকে — সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদেরকে পুনর্দখলের আগ পর্যন্ত। তবে পোল্যান্ড-ফিনল্যান্ডকে আর আগের মানচিত্রে ফেরাতে পারেনি ত্রতস্কির লালবাহিনী।

নতুন গঠিত দেশগুলির যারা যারা বিজয়ী মিত্রশক্তিকে সাহায্য করে, যাদের ইতিমধ্যে একটি ক্লিয়ারলি ডিফাইনড বর্ডার, আর যথেষ্ট জনপ্রতিনিধিত্বপূর্ণ নেতৃত্ব রয়েছে, এবং বেশ আগে থেকেই যারা বৈদেশিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম হয়, তারা সহজেই জাতিগত পরিচয়ের ভিত্তিতে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাদের রাষ্ট্রপরিচয়কে স্বীকৃতি দেয় প্রথমে পরাশক্তিগুলির ক্লাব, পরে লীগ অফ নেশনসের কালেক্টিভ কনসেনসাস। শুধু তাই নয়, যেসব ছোট জাতিগত রাষ্ট্র শত্রুভাবাপন্ন বড় রাষ্ট্রের প্রতিবেশী, তাদের স্বাধীনতার গ্যারান্টর হয় শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলি। পোল্যান্ড-চেক এর উদাহরণ। এর থেকে লাভবান হয় ছোট রাষ্ট্রগুলি আর মিত্রশক্তির পরাশক্তি দেশগুলিও। এর বিপরীতে প্রাক্তন রুশ সাম্রাজ্যের থেকে ভেঙে বের হওয়া বেশ কিছু ছোট ছোট প্রজাতন্ত্র শুরুতে বলা ঐ শর্তগুলি পুরোপুরি পূর্ণ করে স্থায়ী রাষ্ট্র স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়।

অন্যদিকে, সাম্রাজ্যের পরিচয় থেকে জাতিগত পরিচয়ের এ ভূরাজনৈতিক প্রথায় আসতে গিয়ে উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী দর্শনের ক্যান অফ ওয়ার্মস খুলে আসে। চেক-পোলিশ রাষ্ট্রগুলি প্লুরালিস্ট ডেমোক্রেসি হিসাবে যাত্রা শুরু করলেও খুব শীঘ্রি জাতীয়তাবাদী পরিচয়টি বেশি আঁকড়ে ধরে। এর মূল কারণ ইতালি-জার্মানিতে ফ্যাশিজমের উত্থান। কোন কোন জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তাদের বিপরীত জাতীয়তাবাদের উগ্রপন্থী প্রতিক্রিয়া হিসাবেই শুরু হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তাই জার্মান-অস্ট্রিয়ান-ইতালিয়ান জাতীয়তাবাদী ইরেডেন্টিজমের চূড়ান্ত ফল। সে যুদ্ধের পর ইউরোপের পুনর্গঠনের সময় দেশগুলির রাষ্ট্রতন্ত্রে নতুন কিছু সাংবিধানিক ধারা যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে একেকটি রাষ্ট্রের অন্তর্গত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে দেয়া হবে তাদের প্রাপ্য সম্মান ও অধিকার। তারা অন্য জাতির ভূখন্ডে বাস করলেও পাবে সমাধিকার ও সমনিরাপত্তা। পরবর্তীতে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সদস্যপদ লাভের অন্যতম শর্ত করা হয় এই ধারাটিকেই। সোজা কথায় জাতীয়তাবাদ যেন রাষ্ট্রের নাগরিকদের অধিকার অর্জনের পথে বাঁধা না হয়ে দাঁড়ায়। আগের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধগুলির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।

তবে পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে এই থিওরিটা প্র্যাক্টিসে রূপান্তরিত হয়, পূর্ব ইউরোপে সে প্র্যাক্টিসটি হয়নি। তার মূল কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সেসকল অঞ্চল ছিল রুশ অধিকৃত। তাছাড়াও এ দেশগুলি জাতিবিভেদের সবচে বেশি নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার স্বাক্ষী। এ সকল কারণে, পোল্যান্ড জার্মানি থেকে দখল করা নতুন অঞ্চল থেকে জার্মানভাষীদের বহিষ্কৃত করে। চেকোস্লোভাকরা করে একই কাজ। খোদ রাশিয়া পোল্যান্ডের যে এলাকাটি বেদখল করে, সেখানকার পোলিশদের পাঠায় নির্বাসনে। পূর্ব ইউরোপে এ ধরনের জাতিগত বিশুদ্ধিকরণ চলে পুরো স্নায়ুযুদ্ধের সময়টা জুড়ে। বলতে গেল বর্তমান ইইউ সদস্য হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী জনমতের মূলে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপীয় মূলধারার রাষ্ট্রসংজ্ঞা থেকে ভিন্ন অতীত ইতিহাস।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এশিয়া ও আফ্রিকার বহু উপনিবেশ স্বাধীনতা পায়। তাদের সীমানা কিন্তু তাদের ঐতিহাসিক কিংবা ঐতিহ্যবাহী জাতিগত পরিচয়ের সীমানা দিয়ে নির্ধারিত হয়নি। হয়েছে কলোনিয়াল ইম্পেরিয়ালিস্ট লেগ্যাসির ওপর ভিত্তি করে। যার ফলে নাইজেরিয়ার মধ্যে পড়েছে দু তিনটি প্রাচীন রাজ্যের উত্তরসূরীরা, যাদের একাংশ খ্রীষ্টান, একাংশ মুসলিম, একাংশ এনিমিস্ট। ভাষাপরিচয়েও সেরকম বৈচিত্র। ভারতও সেরকম। তবে যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই পুরনো জাতিরাষ্ট্রের কনসেপ্টটা দিয়ে রাষ্ট্রতন্ত্র দাঁড়া করিয়েছে, তারা স্বভাবতই একটা বড় প্রশ্নের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়েছে। সেটা হল, তাদের সীমানার ভেতরের সংখ্যালঘু জাতিদের পরিচয় কি হবে। এই অবস্থার সবচে বড় উদাহরণ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলি। বাথিস্ট ইরাক-সিরিয়া তাদের সকল সংখ্যালঘুদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করত। আরব পরিচয় না গ্রহণ করলে তাদের সমাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত।

এ প্রশ্ন থেকে বেঁচে গেছে প্রাচ্যের কিছু দেশ, যারা তাদের সাম্রাজ্য হারিয়ে “হোমোজেনাস হোম নেশনে” পরিণত হয়েছে। জাপান একটা উদাহরণ। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপের মত সংখ্যালঘুদের অধিকার যারা নিশ্চিত করতে পেরেছে, কোল্ড ওয়ারের সময়টা কিছু অস্থিতিশীলতা পোঁহাতে হলেও তারা শেষ পর্যন্ত তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াকে এ কাতারে কিছুটা ফেলতে পারি।

বর্তমান বাংলাদেশের রাষ্ট্র সংজ্ঞা বাংলাভাষী মানুষের জাতিগত হোমোজেনিটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি সেটা। স্বাধীন রাষ্ট্রের ক্লাবে ঢোকার স্বীকৃতি পাবার জন্য যা যা দরকার ছিল বাংলাদেশ সেসব শর্তও পূর্ণ করে। ডিফাইনড বর্ডার আর আইডেন্টিটি। সত্তরের নির্বাচনের কারণে একটি লেজিটিমেট গণপ্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্ব। কূটনৈতিক সম্পর্ক ও পরাশক্তিগুলির সাথে লবিইং। ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেতে সক্ষম হয়।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির যে বিবর্তন হয়েছে, যেখানে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর ভাষাগত, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অধিকার সুনিশ্চিত করা হয়েছে, সেটা প্রাচ্যের অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রে অনুপস্থিত। ট্রাইবালিজম, ন্যাশনালিজম ইত্যাদি জনমানসে ষোল আনা বিদ্যমান। আর সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ইচ্ছাটাই সেসব দেশের রাষ্ট্রতন্ত্রে প্রতিফলিত। ইউরোপের বাইরে বর্তমানে চলমান সংঘাতগুলির অধিকাংশেরই মূল কারণ সেটা।

যা হোক! এত তাত্ত্বিক কথাবার্তা আসলে অন্য আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণার উদ্দেশ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় জাতি রয়েছে যারা আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের সকল শর্তই বলতে গেলে পূরণ করে। তাদের গৌরবময় ইতিহাসও রয়েছে। কিন্তু তাদের কোন রাষ্ট্র নেই। বহুবার চেষ্টাচরিত হয়েছে। কিন্তু এখনো সফলতা আসেনি। তাদের কাহিনীটাই বলব পরের খন্ডে। কারো ধারণা আছে কি, কোন জাতিটির কথা বলতে চাইছি?

.
.
.
.
.

[উত্তরঃ কুর্দিস্তান]

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বের ইউরোপ, ১৯১৪
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের ইউরোপ, ১৯১৯
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে ইউরোপ, ১৯৩৪
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ইউরোপ, মাঝ বরাবর আয়রন কার্টেন, ১৯৫৫
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ইউরোপ, ১৯৯১

সাইবেরিয়ার সোনার ট্রেন

সাইবেরিয়ার বৈকাল হ্রদ বিশ্বের সবচে গভীর, সবচে প্রাচীন। আর এ হ্রদের গভীরেই হয়ত লুকিয়ে রয়েছে বিগত শতকের রোমাঞ্চকর এক রহস্যের উত্তর। রহস্যটিকে অনেকে রঙচঙে নাম দিয়েছে ‘ৎসারের হারানো স্বর্ণরাজি’, আবার আরেক নাম ‘কলচাকের সোনা’।

লেক বৈকালের তীর ঘেঁষে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একাংশ, যার নাম সারকাম-বৈকাল লাইন।

বৈকালের তীরের ইরকুতস্ক শহরের মানুষ এখনো বিশ্বাস করে, হ্রদের তলদেশে একটি সোনাভর্তি ট্রেনের কার রয়েছে। বৈকালের ধারঘেঁষা ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলওয়ের একাংশ থেকে নাকি ছিঁটকে এটি পড়ে গেছিল ১৯২০ সালে। ২০১০এ একটি সাবমেরিন নাকি অনুসন্ধান চালিয়ে একটি বগি পায়, কিন্তু গভীর পানির নিচ থেকে সোনা কিংবা অন্য কোন বস্তু উদ্ধারের সক্ষমতা না থাকায় রহস্য রহস্যই থেকে গেছে।

এ পোস্টারে রাশিয়ার ম্যাপে বৈকাল হ্রদের অবস্থানের পাশাপাশি পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়া হয়েছে।

বিংশ শতকের শুরুতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভের আগে রুশ সাম্রাজ্যের স্বর্ণভান্ডার ছিল তৃতীয় বৃহত্তম। ব্রিটেন-ফ্রান্সের পরপরই তার স্থান। কিন্তু এই দেশ দুটির যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল, রাশিয়ার তা ছিল না। দাম্ভিক সম্রাটদের খায়েশে চলা দেশটিতে জনসাধারণের এক বিশাল অংশ ছিল ভূমিদাস। ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে সংস্কারায়নের ফলে শিল্পের অগ্রগতি হয়। কিন্তু তার সাথে যে দ্রুত সামাজিক পরিবর্তনগুলো আসে, তাকে সামাল দেবার যোগ্যতা পুরনো ঘরানার শাসনপদ্ধতিতে সম্ভব ছিল না।

তার ওপর একের পর এক সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার এলাকাবিস্তার চলতে থাকে। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি তুরস্ক-ইরান থেকে খাবলা মেরে বিশাল রাজত্বের মালিক হন ৎসারেরা। তারপর চীন-মাঞ্চুরিয়া-সাইবেরিয়ার দিকেও নজর পড়ে তাদের। সেদিকে পা বাড়াতে গিয়ে বাঁধা আসে নতুন এক শক্তিশালী দেশের কাছে থেকে। ১৯০৫ সালে রুশদের যুদ্ধে হারিয়ে বাকি বিশ্বকে তাঁক লাগিয়ে দিয়ে সুপার পাওয়ার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে আধুনিক জাপান।

একই বছরে রাশিয়াতে রাজনৈতিক অধিকারের দাবিতে সাধারণ জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। ৎসারের রক্ষীবাহিনী রাজধানী পিয়েত্রোগ্রাদে প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা চালালে সারাদেশে আগুন জ্বলে ওঠে। ‘স্বৈরাচারী’ ৎসার নিকোলাস নির্বাচন, সংসদ ও সংবিধান প্রনয়ণের দাবির কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হন।

এভাবে দেখতে দেখতে চলে আসে ১৯১৪ সাল। সুপার পাওয়ারগুলি যে সেকেলে ব্যালান্স অব পাওয়ারের মাধ্যমে বিশ্বে তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজিয়ে রেখেছিল, তার একিলিস হীলে আঘাত আসে। সার্বিয়ান এক জাতীয়তাবাদীর গুলিতে অস্ট্রিয়া-হাঙেরির যুবরাজ সপত্নীক নিহত হলে সারা ইউরোপের দেশগুলি দু’দলে ভাগ হয়ে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু করে।

বলা বাহুল্য, রাশিয়ার সম্রাট যুদ্ধজয় নিয়ে আশাবাদী হলেও ভেতরে ভেতরে তাঁর শেষ সময় ঘনিয়ে আসছিল। জার্মান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের কাছে কয়েকটি যুদ্ধে হার মেনে দেশের পশ্চিম ভাগের বিশাল এলাকা থেকে সরে আসতে হয় রুশ বাহিনীকে। পুরো সৈন্যদলের মধ্যে শুরু হয়ে যায় অরাজকতা, পলায়নপ্রবৃত্তি। পালিয়ে যাওয়া সৈন্যরা জড়ো হয় বড় শহরগুলিতে। হাত মেলায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির সাথে। সে দলগুলিও একেকটি একেক রকম। কেউ শাসনতান্ত্রিক রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী, কেউ সংসদীয় গণতন্ত্রে। কিন্তু বামপন্থী সোশাল-রেভলুশনারী (এসআর) পার্টির — লেনিনের বলশেভিক নয় — যে পরিমাণ সমর্থন ছিল তেমনটা আর কারো ছিল না।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে যুদ্ধচলাকালীন সময়েই বিপ্লবের মুখে ৎসার নিকোলাস পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রের শাসনভার প্রথমে আসে প্রিন্স ল্ভভের হাতে, তারপর এসআর পার্টির নেতা আলেকজান্ডার কেরেনস্কির কাছে। কিন্তু যুদ্ধে জার্মানির কাছে আত্মসমর্পণ করার কোন চিন্তাভাবনা এ সরকারের ছিল না। বড় শহরগুলির অর্থনৈতিক-সামাজিক সমস্যাগুলির দিকে নজর দেবার মত সক্ষমতাও ছিল না। এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সমাজতান্ত্রিক কট্টরপন্থী বলশেভিক পার্টি ও অন্যান্যরা। জার্মান সরকারও আগুনে কেরোসিন ঢালার জন্যে সময়মত এক গোপন ট্রেনে করে লেনিনকে সেন্ট পিটার্সবার্গে পাচার করে দেয়। ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় আরেকটি বিপ্লব — মতান্তরে কু’য়ের।

সোনার কাহিনীর শুরু বলা যেতে পারে এখানে। আসন্ন অস্থিতিশীলতার আঁচ পেয়ে নতুন রুশ সরকার প্রায় পাঁচশ টন ডবল-ঈগলছাঁপমারা সোনার বার ট্রেনে করে পূর্বে উরাল পর্বতের নিকটবর্তী কাজান শহরে পাঠিয়ে দেয়। অক্টোবর বিপ্লবের পর লেনিনের সহকর্মী ত্রতস্কি গঠন করেন লালবাহিনী। হাতে গোনা যে কটি শহর তখন বলশেভিকদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেসব থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ‘শত্রু’ শ্বেতবাহিনীকে উৎখাত করা ছিল তাদের কাজ। আর যার হাতে ৎসারের সোনা পড়বে শেষ পর্যন্ত, এই নিরন্তর গৃহযুদ্ধে তাদেরই জয় অবশ্যম্ভাবী।

ঘর সামলানোর যুদ্ধে মনোনিবেশের জন্যে বলশেভিকরা জার্মানির সাথে যুদ্ধবিরতির চুক্তি স্বাক্ষর করে ১৯১৭তে। পশ্চিম রাশিয়ার বিশাল এক এলাকা ছেড়ে দেয় তারা। ৎসারের পক্ষে লড়া স্বেচ্ছাসেবক চেক ও পোলিশ সৈন্যরা পড়ে যায় মহাবিপদে। তাদের ইচ্ছে ছিল চলমান যুদ্ধে অংশ নেবার জন্যে পূর্ব ফ্রন্ট থেকে ফ্রান্সের পশ্চিম ফ্রন্টে যাবার।

চেক সেনাদল বিশাল ট্রেনবহর নিয়ে পাঁচ হাজার মাইল পূর্বে ভ্লাদিভস্তকের দিকে যাত্রা শুরু করে। এদের রোমাঞ্চকর অভিযানের কথা আগের একটা লেখায় বলেছি। কাজান শহরে লালসেনারা ঘেরাও বসালে তাদেরকে হারাতে শ্বেতদের সাহায্য করে চেকরা। ঘেরাওয়ের ফাঁক গলে সোনার ট্রেন গায়েব হয়ে যায় আরো পূর্বে ইরকুতস্ক শহরে। কাজানে এসে ত্রতস্কি পান শূন্য খাজাঞ্চিখানা।

যারা রাশিয়া সম্পর্কে কিছুটাও জানেন তারা হয়ত ট্রান্সসাইবেরিয়ান রেলওয়ের কথা শুনে থাকবেন। পশ্চিমে পেত্রোগ্রাদ থেকে শুরু করে পূর্বে ভ্লাদিভস্তক পর্যন্ত ব্যাপ্ত ৫,৭০০ মাইল দীর্ঘ এই রেললাইন বিশাল দেশটির নাড়ি বললে ভুল হবে না। সাইবেরিয়ার খনিজ সম্পদ আর গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির ওপর মাতবরি ফলাতে হলে এ রেললাইনের নিয়ন্ত্রণ থাকা অত্যাবশ্যক। মজার ব্যাপার হলো, রুশ গৃহযুদ্ধের অধিকাংশ সময় শ্বেত-লোহিত কোন রুশের হাতেই এ রেলপথের নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ছিল আটকেপড়া চেক স্বেচ্ছাসেবক সৈন্যদলের হাতে। তারা স্বদেশের স্বাধীনতার আশায় অস্ট্রিয়া-হাঙেরির বিরুদ্ধে রুশদের পক্ষে যুদ্ধে শরিক হয়।

এই রেলবিচ্ছিন্নতার সুযোগে সাইবেরিয়ার ওমস্কে বলশেভিকবিরোধীরা কিছুটা স্থিতিশীল পাল্টা সরকার গঠন করতে সক্ষম হয়। প্রথমদিকে এ সরকারে বামপন্থী এসআর যেমন ছিল, তেমন ছিল ৎসারের প্রচ্ছন্ন সমর্থক গোষ্ঠী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯১৮তে কুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতাদখল করেন ৎসারের নৌবাহিনীর এডমিরাল আলিয়েকসান্দর কলচাক।

রুশদের হয়ে উত্তরমেরু অভিযানে অংশ নিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন ৪৫ বছরবয়েসী এই নৌ অফিসার। জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আহত ও বন্দী হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জার্মান নৌবাহিনীকে রুখতে বাল্টিক সাগরে সামুদ্রিক মাইন স্থাপন অভিযানের সফলতাও ছিল তাঁর কৃতিত্ব। ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের সময় কৃষ্ণসাগরের তুর্কী অভিযান থেকে অব্যাহতি পান। পিয়েত্রোগ্রাদে গিয়ে কেরেনস্কিকে নৌসেনাদের নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতি অবহিত করেন। তাঁর সুপারিশ ছিল, সশস্ত্র বাহিনীতে মৃত্যুদন্ডের শাস্তি পুর্নবহাল করার। কেরেন্সকি সে উপদেশ শুধু যে অগ্রাহ্য করেন তা নয়, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের ভয়ে কলচাককে যুক্তরাজ্যে একটি অ্যাসাইনমেন্টে পাঠিয়ে দেন।

অক্টোবর বিপ্লব যখন শুরু হয়, তখন কলচাক যুক্তরাষ্ট্র হয়ে জাপানে। সেখান থেকে ভ্লাদিভস্তক হয়ে সোজা সাইবেরিয়া চলে যান তিনি। বলশেভিকবিরোধী বাহিনীগুলির একটির নিয়ন্ত্রণ নেন। সাইবেরিয়ায় কলচাকের পাশাপাশি ফিনল্যান্ড-এস্তোনিয়াতে ইউদেনিচ, ইউক্রেনে দেনিকিন-ভ্রাঙেল প্রমুখ ছিলেন শ্বেতবাহিনীর নেতৃত্বে। এদের পরস্পরের মধ্যে পারতপক্ষে যোগাযোগ ও সামঞ্জস্য না থাকায় ত্রতস্কির লালবাহিনী ক্রমে একে একে এদেরকে হারাতে সক্ষম হয়।

দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে দেনিকিনের অধীনস্থ শ্বেত বাহিনীর ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯১৯।
রাশিয়ায় আটকে পড়া চেক সৈন্যরা সুসংগঠিত ছিল। তাদের নিয়ন্ত্রিত সাইবেরিয়ান রেলপথে একটি ছোটখাট রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। সেখানে চালু ছিল এ ডাকটিকেট (১৯১৯)।
দক্ষিণ রাশিয়ার ইউক্রেনে দেনিকিনের অধীনস্থ শ্বেত বাহিনীর ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯১৯।
উত্তর-পশ্চিম রাশিয়ার বাল্টিক উপকূল, ফিনল্যান্ড ও এস্তোনিয়াতে জেনারেল ইউদেনিচের নেতৃত্বাধীন শ্বেতবাহিনি এ ডাকটিকেট ব্যবহার করে, ১৯১৯।
কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনী ছিল ৎসারের অনুগত। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন অ্যাডমিরাল ভ্রাঙেল। তাদের ব্যবহৃত ডাকটিকেট, ১৯২১।

১৯১৮তে ওমস্কে প্রভিশনাল অল-রাশিয়ান গভার্নমেন্টের শাসনভার দখল করেন কলচাক। এর মাসদুয়েক আগে ৎসার নিকোলাস সপরিবারে বলশেভিকদের হাতে নিহত হন। তাই বলশেভিকবিরোধী সমগ্র রাশিয়ার ‘সুপ্রীম লীডার’ হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করতে কোন সমস্যা হয়নি কলচাকের।

ভাইস-অ্যাডমিরাল আলিয়েকসান্দর ভাসিলিয়েভিচ কলচাক, ১৯১৬।

একটা কথা আছে, অ্যাবসলুট পাওয়ার করাপ্টস অ্যাবসলুটলি। পরবর্তীতে কম্যুনিস্টদের জন্যে কথাটি যতটা সত্য, কলচাকের জন্যেও ততটা। ক্ষমতা দখল করলেও সফল রাজনীতিবিদের যে দূরদর্শিতা ও সমঝোতার গুণ দরকার, তা দেশপ্রেমী কলচাকের ছিল না। প্রথমেই বামপন্থী শরিকদল এসআর সদস্যদের সরকার থেকে পদচ্যুত করেন। এসআর পার্টির একটি ব্যর্থ পাল্টা কুয়ের পর দলটির পাঁচশ সদস্যকে হত্যা করে কলচাকের অধীনস্থ কসাক সেনাদল।

যে চেক লেজিয়ন কলচাকের কাছে সোনার ট্রেন এনে দিয়েছিল, তারাও কলচাকের স্বেচ্ছাচারে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম ফ্রন্টের যুদ্ধও ১৯১৯এ শেষ। নতুন রাষ্ট্র চেকোস্লোভাকিয়ার ততদিনে গোড়াপত্তন হয়েছে। রুশদের রক্তাক্ত অন্তর্ঘাতে অংশ নেবার পরিবর্তে স্বদেশপ্রত্যাবর্তন হয়ে দাঁড়িয়েছে চেকদের মূল লক্ষ্য।

কলচাকের তাঁড়িয়ে দেয়া এসআর পার্টিও ততদিনে লালবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে। ত্রতস্কির সৈন্যরা সমানে ধেঁয়ে আসছে সাইবেরিয়ার আরো অভ্যন্তরে। এসআর পার্টির সাথে চেকরা ১৯২০এ গোপনে রফা করে যে পূর্বে নির্বিঘ্ন যাত্রা ও রেলরসদের বিনিময়ে কলচাক, তাঁর প্রধানমন্ত্রী আর সোনার ট্রেনবহর তুলে দেয়া হবে তাদের হাতে। কলচাক চেকদের ফাঁদে পা দিলেন। এসআর পার্টি তাঁকে কদিন বন্দী করে রাখে। তারপর বলশেভিকরা ইরকুতস্কের নিয়ন্ত্রণ নিলে কলচাক আর প্রধানমন্ত্রী পেলিয়ায়েভকে জনতার শত্রু আখ্যা দিয়ে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদন্ড দেয়।

ইরকুতস্ক শহরে অ্যাডমিরাল কলচাকের স্মৃতিসৌধ।

ব্রিটেন-যুক্তরাষ্ট্র-জাপান ও অন্যান্য সকল সুপারপাওয়ারের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও কলচাকের সাইবেরীয় সরকারের এমন পতন হয়। যুক্তরাজ্যের চার্চিল তাঁর সরকারকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলেন, পারেননি প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন আর মার্কিন প্রেসিডেন্ট উইলসনের কারণে। কেরেনস্কি ততদিনে উইলসনের রুশবিষয়ক উপদেষ্টা। তাঁর প্ররোচনায় উইলসন ভেবেছিলেন কলচাক ৎসারপন্থী ও স্বৈরাচারী। মতবিরোধীদের নির্বিচারে হত্যা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাবিধানের বিরোধিতা, আর কলচাকের নাম নিয়ে অপমানসূচক কিছু বলা যাবে না — এধরনের আইনের কারণেও সরাসরি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয় কলচাকের সরকার।

কলচাক পদত্যাগের আগে ইউক্রেনের শ্বেতরুশবাহিনীপ্রধান দেনিকিনকে সুপ্রীম লীডার ঘোষণা করে যান। সাইবেরীয় শ্বেতবাহিনী ইরকুতস্ক থেকে বিশাল এক লম্বা যাত্রা শুরু করে ভ্লাদিভস্তকের দিকে। সে ছিল এক বিচিত্র কাফেলা। চেক সৈন্যরা ছিল তার রক্ষক। রুশ সাম্রাজ্যের বহু অভিজাত যারা সময়মত টের পেয়েছিল বলশেভিক মানেই বিপদ, তারাও তাদের অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে এসকল সৈন্যদের ঘুষ দিয়ে তাদের সহযাত্রী। এই গ্রেট সাইবেরিয়ান আইস মার্চ প্রথমে ইরকুতস্ক থেকে চিতা, তারপর চিতা থেকে মাঞ্চুরিয়ার পোর্ট আর্থার আর কামচাতকা উপদ্বীপের ভ্লাদিভস্তক গিয়ে পৌঁছে ১৯২১ সাল নাগাদ। তারপর সেখান থেকে জাহাজ নিয়ে কেউ জাপান, কেউ আমেরিকা হয়ে ইউরোপে পৌঁছে। পথিমধ্যে ক্ষুধায়, ঠান্ডায়, ক্লান্তিতে, রোগজরায় প্রাণ হারায় অগণিত সৈন্য। এদের মধ্যে ছিলেন দলনেতা জেনারেল কাপেলও।

চিত্রশিল্পীর কল্পনায় জেনারেল কাপেলের নেতৃত্বে গ্রেট সাইবেরিয়ান আইস মার্চ, ১৯১৯।

সেই সোনাগুলির কি হল? চেকরা সে ট্রেনগুলোর সবই কি বলশেভিকদের হাতে তুলে দিয়েছিল? নাকি চালাকি করে দু’তিনটে জুড়ে নিয়েছিল নিজেদের পূবমুখী কাফেলার সাথে? লোককাহিনী তাই বলে। সেই ট্রেনবহরের একটিই নাকি দুর্ঘটনাক্রমে ছিঁটকে পড়ে গেছিল বৈকাল হ্রদের মধ্যে। বাপ-দাদাদের মুখে অন্তত তাই শুনে এসেছে ইরকুতস্কবাসী। আবার আরেক আঞ্চলিক গল্প অনুযায়ী, কলচাকই নাকি ধরা পড়ার আগে কয়েকটি ট্রেনের বগি উত্তরের পাহাড়ের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে রাখার নির্দেশ দেন। আর তারপর সেসব সৈন্যদের সেখানেই গুলি করে মারে তাঁর বিশ্বস্ত অফিসাররা।

সাইবেরিয়ার কলচাক সরকারের স্বেচ্ছাসেবক শ্বেতরক্ষী বাহিনী, ১৯১৯।

আধুনিক যুগে এধরনের গালগল্প এখনো চলে সাইবেরিয়াতে। শাসক-শাসনব্যবস্থা পরিবর্তিত হয়, কিন্তু সত্যটা কখনোই বেরোয় না এদেশে। যা বেরোয়, তা কেবল প্রপাগান্ডা। জনগণও জানে সে কথা। তাই লোকমুখে যা চলে, তাই সত্য এখানে। তাই বৈকালের মাইলগভীর পানিতে, কিংবা ঘন সাইবেরিয়ান পাইন-সীডার-বার্চের জঙ্গলে এখনো মানুষ খুঁজে ফেরে ৎসারের হারানো স্বর্ণরাজি। খুঁজতে গিয়ে হারিয়েও যায় অনেকে। ধনভান্ডারের গল্পে এসে তখন যুক্ত হয় দুর্ভাগা অ্যাডমিরাল কলচাকের প্রেতাত্মার অভিশাপ।

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!