ঐ তারকাখচিত আচ্ছাদনের ঊর্ধ্বে এক স্নেহময় পিতা অবশ্যই আছেন!

Featured Video Play Icon

আস্তিক হোন কিংবা নাস্তিকই হোন, একথা অস্বীকার করা খুবই কঠিন যে, মানুষের মস্তিষ্কের জৈবরাসায়নিক কম্পোজিশনের মধ্যে মহান অবিনশ্বর কোন শক্তিতে বিশ্বাস আর ‘স্বর্গীয়’ অনুভবের ক্ষমতা মজ্জাগতভাবে প্রোথিত।


অর্গানাইজড রিলিজিয়ন মানুষের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহের জন্ম দিলেও ধর্ম অতীতের একেকটা সভ্যতাকে দিয়েছিল একক অবিভক্ত পরিচয়। আর সেসব ধর্মের লক্ষ্য ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়েছে প্রথমত সমসত্ত্ব গোষ্ঠীদের নিজেদের মধ্যে নৈতিকতা আর ন্যায়পরায়ণতার প্রতিষ্ঠায়। তারপর তাদের মূল্যবোধের সম্প্রসারণ হয়েছে অন্য জাত-ধর্মের মানুষকে নৈতিকতার ছত্রতলে এনে, এক ধর্মের বিশ্বাস প্রভাবিত করেছে অন্য ধর্মকেও।


রেনেসাঁস-পরবর্তী যুগের ইউরোপের মনীষীরা অন্যান্য জাতি, ভাষা আর ধর্ম — বিশেষত প্রাচ্যের ইসলাম, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম — সম্পর্কে খুবই কৌতূহলী ছিলেন। তাঁদের জ্ঞান যত বাড়তে থাকলো, তত তাঁদের বোধোদয় হলো যে, একমাত্র খ্রীষ্টধর্মই যে মানুষের আত্মিক সকল চাওয়া-পাওয়ার একমাত্র উত্তর, এধরনের প্রাক-রেনেসাঁস ও রেনেসাঁসযুগীয় দৃষ্টিভঙ্গি খুবই সংকীর্ণ ও দাম্ভিকতাপূর্ণ


ফলশ্রুতিতে ভলতেয়ার-মঁতেস্কিউ-পেইনের মত চিন্তাবিদরা যীশুখৃষ্টের আধ্যাত্মিকতাবাদের সাথে প্রাচীন গ্রীস আর মধ্যযুগীয় ইসলামী মনীষীদের যুক্তিবাদী ধ্যানধারণার মিশ্রণের বীজ থেকে উৎপন্ন যে চারায় পানি ঢালা শুরু করলেন, সেটা হলো সার্বজনীন মানবতাধর্মের মতবাদ বা হিউম্যানিজম। আমেরিকার স্থপতিরা টমাস পেইনেরই চিন্তাশিষ্য ছিলেন। মার্কিন সংবিধানের প্রণেতা জেফারসন আর ‌অ্যাডামসের সংগ্রহে বাইবেলের পাশাপাশি তানাখ, কুরান আর গীতা ছিল।


এরকম এনলাইটেনমেন্টের যুগে জন্ম বীটোফেন আর শিলারের। নিচের ভিডিওতে প্রখ্যাত বার্লিন ফিলহার্মোনিক অর্কেস্ট্রা প্রয়াত কন্ডাক্টর হার্বার্ট ফন কারায়ানের পরিচালনায় পরিবেশন করছে বীটোফেনের নবম সিম্ফনির শেষ ‘কোরাল’ অংশটা। সাধারণত শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্র দিয়ে সিম্ফনি কম্পোজ করা হতো। বীটোফেনের নবম হলো সিম্ফনির জগতে কোরাল বা গণসঙ্গীতের প্রথম সফল সূচনা। কোরাল অংশে যে গানটা গাইছে বাস-তেনর-আলতো-সোপ্রানোরা, সেটা শিলারের লেখা কবিতা ‘আন ডি ফ্রয়ডা’ — ‘আনন্দের উদ্দেশ্যে’।


আমার কাছে এই সিম্ফনিটা প্রার্থনাসম! ২৪ মিনিটের হলেও একটু সময় করে শুনে দেখুন! ডাবল বাস্ আর হর্ন সেকশনের গম্ভীর মিউজিক দিয়ে শুরু। এ যেন পুরনো ঘুনেধরা সংকীর্ণ মনোভাবের হতোদ্যম নাভিশ্বাস। অথবা ধরতে পারেন নাপোলেওনের ধ্বংসযজ্ঞে বিধ্বস্ত ইউরোপের নানাজাতের মানুষের ক্লান্তি। তার পরে ক্লারিনেট-ভায়োলিন-ওবো এসে যোগ দিলো সেযুদ্ধে বিজয়ী বীরদের গাঁথা গাইতে, সেও সনাতন সাম্রাজ্যের শৌর্যিক মূল্যবোধেরই নমুনা। এমন সময় বাস সোলোয়িস্ট এসে ভেঙ্গেচুড়ে দিলেন সব: “ও ফ্রয়ন্ডা, নিশ্ট ডিজা ট্যোনা…” — বন্ধু, এ লহরী আর নয়, এসো আজ উৎফুল্লতার গান গাই!


তারপরে শিলারের কাব্য থেকে একে একে উচ্চারিত হলো সকল মানুষের ভ্রাতৃত্ব আর স্বর্গীয়তার ঘোষণা! সেখানে জাতপাত আর ধর্মের বিভাজন নেই, আছে কেবল মনুষ্যত্ব! প্রকৃতিমাতার স্তন্যপানে ভাল-মন্দ সকল জীবের সমাধিকার! বন্ধুত্বের প্রমাণ সেখানে মৃত্যু দিয়ে হলেও তা আনন্দের উচ্চতম শিখর! মানুষ ভাগ্যের কাছে হতদরিদ্র জিম্মি নয়, তার আছে ললাটলিখনকে খন্ডানোর অপরিসীম ইচ্ছাশক্তি! আর আছেন স্রষ্টা! “জাইড উম্শ্লুঙেন, মিলিওনেন! ডিজেন কুস ডের গানৎসেন ভেল্ট!” — কোটি জনতা আলিঙ্গনাবদ্ধ, এই চুম্বন সমগ্র বিশ্বের! ব্র্যুডের, উ্যবার্ম শ্টের্নেনৎসেল্ট, মুস আইন লিবের ফাটার ভো’নেন!” — ভাইয়েরা, ঐ তারকাখচিত আচ্ছাদনের ঊর্ধ্বে এক স্নেহময় পিতা অবশ্যই আছেন!


১৮২২এ এই সিম্ফনি লেখার আগে ১৮০০ সালের দিকে ত্রিশবছরবয়সী বীটোফেন বধির হতে শুরু করেন, আর সেই বেদনায় তাঁর মনে এসেছিল আত্মহননের চিন্তা। হয়ত তিনি সেই ললাটলিখনকে জয় করেই আরো সাতাশ বছর বেঁচে ছিলেন নবম সিম্ফনিসহ অনেক কালজয়ী স্বর্গীয় সুরলহরীর জন্ম দিতে!

যুক্তির যুগ এবং ইবনে রুশদের উত্তরাধিকার

 

দ্য এইজ অফ রীজন — মার্কিন-ইংরেজ দার্শনিক টমাস পেইনের একটি বইয়ের নাম। হিন্দুপুরাণে যেমন বর্তমান যুগকে বলে কলিযুগ, সে রকম পেইন অষ্টাদশ শতকের শেষে হাঁটে হাঁড়ি ভেঙ্গে বলে দিলেন বর্তমান হল গিয়ে যুক্তির যুগ। তাঁর বইটি সেসময় রক্ষণশীল খ্রীষ্টানরা ভালভাবে না নিলেও এ আসলে গোপন কোন কিছু ছিল না যে, নতুন একটা যুগে মানুষ ইতিমধ্যেই পদার্পণ করেছে, আর তাদের জীবন পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। গ্যালভানির জৈববিদ্যুৎ আর স্টেভেনসনের বাষ্পইঞ্জিন আবিষ্কারের পরপর পশ্চিম ইউরোপ তখন শিল্পবিপ্লবের জন্যে প্রস্তুত। যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে পিছু টেনে আটকে রাখার শক্তিগুলি আগের যুগে যেধরনের অত্যাচার করেছিল, তার কারণে তাদের ওপর মানুষের ভক্তি উঠে গিয়েছিল।

উন্নতির এ পর্যায়ে পৌঁছুতে কিন্তু অনেক চরাই-উৎরাই পেরোতে হয়েছে পশ্চিমা বিজ্ঞানীদের। পেইনের আগে এসেছিলেন রনেসঁস যুগের দাভিঞ্চি, গ্যালিলেও, নিউটন, দেকার্ত। তাঁদের সবাই যে ভাগ্যবান ছিলেন তা নয়, টাইকো ব্রাহে আর জোর্দানো ব্রুনোকে অগ্নিআহুতি দিতে হয়েছিল। এঁরা কেউই নাস্তিক ছিলেন না। ব্রুনো বিশ্বাস করতেন, যদি পুরো বিশ্ব শুধু একটা পৃথিবী নিয়ে হয়, তাহলে তার স্রষ্টা কল্পনার তুলনায় অতিক্ষুদ্র। তিনি বিশ্বাস করতেন, খোদা আর তাঁর সৃষ্টির মাহাত্ম্য তাদের অসীমতায়। বলা বাহুল্য, ক্যাথলিক চার্চ যা বাইবেলে পায় তার সাথে এসবের মিল নেই, অতএব ‘চড়াও ওকে শূলে!’

ইউরোপীয় সভ্যতার ‘আধুনিক’ হয়ে ওঠার পিছনে অন্যান্য অনেক সভ্যতার অবদান আছে। যেমন চীনাদের আবিষ্কার করা কাগজ-বারুদ তৈরির আর মুদ্রণের প্রক্রিয়াকে তারা শৈল্পিক রূপ দেয়। কিন্তু চীনাদের এসব উদ্ভাবন ছিল চাহিদাভিত্তিক আর হাজার বছরের ভুল করে করে শেখা প্রযুক্তির ফল। বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা যেতে পারে ট্রায়াল-এন্ড-এরর প্রক্রিয়া। এর থেকে দক্ষ হল, যুক্তিবাদের ওপর স্থাপিত বৈজ্ঞানিক পন্থা, অর্থাৎ একটি প্রাকৃতিক ঘটনা কেন ঘটে, তার পিছনে কি কি কারণ আছে, সেগুলি কি নিয়মে চলে, আর এই উপপাদ্যগুলি প্রমাণের জন্যে কি ধরনের পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ দরকার। আর এসবের উত্তর জানার ফলে আমরা পেতে পারি নতুন কোন প্রযুক্তি।

এই যুক্তিবাদী পদ্ধতি ইউরোপীয় মনীষীরা পেয়েছিলেন আরব মুসলিম ও ইহুদী বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। আরবদের থেকে তারা জ্যোতির্বিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসা — এসব সংক্রান্ত অনেক তথ্য পেয়েছিলেন। কিন্তু সবচে’ বড় যে ধারণাটা আরবদের হাত ঘুরে ইউরোপীয়রা ফিরে পেয়েছিল, তা হল তাদেরই প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকদের যুক্তিবাদী চিন্তাধারা। অ্যারিস্টোটল, প্লেটো — এঁদের কোন লেখাই তখন ল্যাটিন বা গ্রীকে তারা পড়েনি, পড়েছিল আরবীতে। আর আরব মনীষীদের যারা এগুলিকে পুনর্জন্ম দিয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন ইসলামী স্বর্ণযুগের ধারক-বাহক। এদের মধ্যে ইবনে সিনা উল্লেখযোগ্য, তার পরেই ইবনে রুশদ। আর ইহুদী ধর্মাবলম্বী মুসা বিন মাইমুন, যার কারণে ইহুদী সমাজেও একটা দার্শনিক গতিশীলতা এসেছিল।

এদের মধ্যে ইবনে রুশদের লেখার মধ্য দিয়েই ইউরোপীয় আদি মনীষীরা যুক্তিবাদ শেখেন, আর তাঁকে এখনো বলা হয় সেক্যুলারিজমের জনক (সেক্যুলারিজমের অর্থ বাংলায় করে ধর্মনিরপেক্ষতা, এটা খুবই সংকীর্ণ অসম্পূর্ণ অনুবাদ)। তিনি ছিলেন আন্দালুসিয়ার রাজসভার কাজী আর মালিকী মতবাদের বিশেষজ্ঞ। তাঁর যুক্তিবাদের উদাহরণ দিই। মোমবাতি আলো দেয় কেন? এর উত্তরে তিনি ও তাঁর শিষ্যরা বলবেন যে, মোমে আছে দাহ্য পদার্থ, অগ্নির সংস্পর্শে আসলে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয় আর তার থেকে উত্তাপ হয়, সে কারণে আলো। এ ঘটে খোদার করে দেয়া প্রাকৃতিক নিয়মেই, খোদাকে প্রতিটা মোমবাতি জ্বলার জন্য আলাদা করে আদেশ করতে হয় না, মোমবাতি জ্বলে ওঠো। আর এভাবে ক্রিয়াকারণ জানার মাধ্যমেই আমরা খোদাকে ভালভাবে জানতে পারি, আর তাঁর তৈরি করে দেয়া প্রাকৃতিক নিয়মাবলীকে ব্যবহার করতে পারি নিজেদের জীবনটাকে একটু সহজ করার জন্য। এই সামান্য ব্যাপারটাই হলো যুক্তিবাদ।

ইবনে রুশদের বিপরীতে সেসময় ছিল সনাতনী সুন্নী গোষ্ঠী আশারী, তাদের নেতার নাম সবাই একটু আধটু শুনেছেন — হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজ্জালী। তিনি ইবনে রুশদের চিন্তাভাবনাকে সম্মান করতেন, কিন্তু ছিলেন সুফী অদৃষ্টবাদের প্রবক্তা। তিনি ইবনে সিনার যুক্তিবাদ খন্ডন করে একটি বই লিখেন। তাঁর হিসাবে মোমবাতি জ্বলে কারণ খোদা অপরিসীম শক্তিমান এবং এ জগতের কোন ঘটনা নেই তাঁর নির্দেশব্যতীত সংঘটিত হওয়ার। প্রতিটি মোমবাতিকে তিনিই ব্যক্তিগতভাবে আদেশ করেন প্রজ্জ্বলিত হওয়ার, তাতে সে জ্বলে। আর যদি তিনি আদেশ করেন কোনটিকে না জ্বলার, তাহলে শতবার আগুন দেয়ার পরও সে জ্বলবে না, আর তা হবে তাঁর একটি মুজিজা বা অলৌকিকতা।

আমরা আজ মসজিদে গাজ্জালীর নাম শুনি, কিন্তু ইবনে সিনা বা ইবনে রুশদের নয়। তাঁরাও তো প্রখ্যাত ফকীহ বা মুজাদ্দেদ (যার অর্থ কিন্তু সংস্কারক) ছিলেন। কেন শুনি না? কারণ, কার্যকারণ বুঝে বুঝে যদি খোদাকে জানতে-বুঝতে হয়, তাহলে তা অনেক কঠিন কাজ, আর প্রাকৃতিক নিয়মের বেড়ায় স্রষ্টা হয়ে যান দূরের কেউ। সাধারণ মানুষ এতকিছু বোঝে না, কষ্টও করতে চায় না। তারা ভাবতে পছন্দ করে স্রষ্টা অনেক নিকটে, আর সকলের অদৃষ্টলিখন করে দেয়া আছে, সে গন্ডি পেরোনো মানুষের অসাধ্য।

আজ মসজিদে ইবনে রুশদের বই শিক্ষা দেয়া হলে আমরা শিখতাম, মানুষকে খোদা ভাল-মন্দ যাচাইয়ের ক্ষমতা-স্বাধীনতা দুটোই দিয়েছেন, দিয়েছেন প্রকৃতির ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার বুদ্ধি। একটি বড় গন্ডির মধ্যে মানুষ তার স্বাধীনতা খাটাতে পারে, তার কল্পনাপ্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারে। যুক্তি দিয়ে যাচাই করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কিসে তার লাভ।

আজ কি কেউ মসজিদে ইবন রুশদদের চিন্তাধারা শেখাচ্ছেন? জানতে পারলে আমায় বলবেন!

(লেখাটি শেষ করার পর জানতে পারি ইবনে রুশদের গতকাল ১৪ই এপ্রিল ছিল ৮৯২তম জন্মবার্ষিকী!)

close

ব্লগটি ভাল লাগলে শেয়ার করুন!